অচেনা কবি❤,পর্ব-৪

0
1142

অচেনা কবি❤,পর্ব-৪
লেখনীতেঃ কথা চৌধুরী❤

৭.

রাত নয়টা। ফোন হাতে বিছানায় হেলান দিয়ে আছি। ইদানীং আমার ফোন ব্যবহার করার পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। যে-কেউ দেখলে হয়ত ভাববে আমি ফোনখোর। নেশাখোর আছে জানি কিন্তু ফোনখোর বলে কোনো শব্দ আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে এমন শব্দ এখন একমাত্র আমার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।

ফোন স্ক্রোল করতে করতে এখন বিরক্ত লাগছে তবুও স্কোল করেই চলেছি। হঠাৎ ইনবক্সে ম্যাসেজ এলো মিরাজ মহাশয়ের। এতে আমি এবার সোজা হয়ে বসলাম। কারণ উনার সাথে আমার আজ অবধি দুইদিন কথা হয়েছিল আর উনি দৈনিক একবারের বেশি কথা বলেন না। আর আমি তো নিজে থেকে উনাকে কখনও ম্যাসেজ দেই না। কিন্তু আজকে বিকালে কথা হওয়া স্বত্বেও রাতে ম্যাসেজ দিলেন বিধায় খানিকটা চমকে গেলাম।

“কাব্যু
কাব্যু কাব্যু কাব্যু কাব্যু
কাব্যু কাব্যু কাব্যু।”

এতোবার উনার দেওয়া নামে আমাকে সম্বোধন করে ম্যাসেজ দিয়েছেন বলে দ্বিতীয়বারের মতো চমকে গেলাম। আনমনে বলতে লাগলাম, “এতোবার করে নামটা লেখার কি দরকার ছিল? একবার লিখলেই তো আমি উত্তর দিয়ে দিতাম।”

মনের ঘরে ভেসে উঠা কৌতূহলকে মেটাতে এবার উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, “একটা নাম এতোবার লিখলেন যে বরং।”

সাথে সাথে উনার ম্যাসেজ পেলাম, “খুব করে ইচ্ছে করছিল। তাই লিখে ফেললাম।”

“আপনার ইচ্ছেটা অদ্ভুত।” মুচকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে, দিলাম ছোট্ট ম্যাসেজ।

“আমি মানুষটাই হয়ত অদ্ভুত। ওহ, যেজন্য ম্যাসেজ দেওয়া।”

“হুম, বলুন।”

“একটা কবিতা লেখার ব্যর্থ চেষ্টা করেছি।”

“কবিতাটি কি কেউ পছন্দ করেনি? ব্যর্থ চেষ্টা বললেন যে।”

“কাউকে তো দেখানো হয়নি। তোমাকে নিয়ে লেখা কবিতা তোমাকেই দেখাতে চাই।”

“আমাকে নিয়ে লেখা কবিতা?” অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।

“হুম।”

“আমি তো কেবল বিকালে বলেছিলাম। আপনি এতো তাড়াতাড়ি লিখে ফেলেছেন?”

“তোমার সাথে আলাপচারিতা শেষ করেই লিখতে বসেছিলাম।”

“ও আচ্ছা, তা হঠাৎ আমাকে নিয়ে কেন কবিতা লিখতে ইচ্ছে হলো আপনার?”

“তুমি আমাকে কবি ভাবায় এখন আমাকে আমার কাছে কেমন যেন কবি কবি লাগছে।”

“হা হা হা। বেশ ভালো।”

“হাসি যেন ঝর্ণার ধারার মতো কেবল কান পেতে শুনতে ইচ্ছে হয়।”

অস্বীকার করে বললাম, “মোটেও না।”

“উম, সেটা তোমার কাছে হয়ত আমার কাছে নয়।”

“না দেখে, না শুনে কি মন্তব্য করা যায়? আপনি তো আমার হাসি দেখেননি আর শুনেননি।”

“কল্পনায়, আমি কল্পনায় দেখেছি আর কান পেতে তোমার হাসির শব্দ শুনেছি। জানো, দু’টোর মাঝে আমি কোনো তফাৎ খুঁজে পাইনি।”

কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে, “আপনি বড্ড বেশি বলছে।”

“সেটা না হয় আমার উপরেই ছেড়ে দাও।”

“ঠিক আছে। এখন কবিতাটা দেখি?”

“ওহ হ্যাঁ, পাঠাচ্ছি।” সাথে সাথেই কবিতা ম্যাসেজ করলেন আর আমিও মন দিয়ে পড়তে শুরু করলাম,

লেখনীর প্রেমে

আমি পড়েছি প্রেমে
রূপ নয়, অর্থ নয়, বিত্ত নয়
পড়েছি যে আমি তার লেখার প্রেমে।

আমি পড়েছি প্রেমে
শব্দের, বাক্যের, অর্থের
পড়েছি যে আমি তার কবিতার প্রেমে।

আমি পড়েছি প্রেমে
স্থান, কাল, চরিত্রভেদে
পড়েছি যে আমি তার গল্পের প্রেমে।

আমি পড়েছি প্রেমে
মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখা
তার কত-শত লেখার প্রেমে।

“অসাধারণ! আপনি এতো সুন্দর কবিতা লিখেও বলছেন ব্যর্থ চেষ্টা করছেন?”

“তোমার পছন্দ হয়েছে?”

খুশিতে গদোগদো হয়ে, “ভীষণ, আমার তো কবিতা অনেক অনেক পছন্দ। একটু আগেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা পড়লাম।”

“কী কবিতা?”

“নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ।”

“কেমন লাগলো?”

“এতোটাই ভালো লেগেছে যে, ১০/১২ বার পড়েছি।”

“বলো কী! সাংঘাতিক ব্যাপার তো।”

বিস্মিত হয়ে, “মাত্র ১০/১২ বার পড়াতে সাংঘাতিক ব্যাপার কোথায় পেলেন? আমি এমনিতেও কবিতা দুই-তিনবার করে পড়ি। কারণ কবিতার অর্থ বুঝতে একটু সময় লাগে।”

“হ্যাঁ, কবিতায় তো কবির মনোভাব থাকে তাই বুঝতে একটু সময় লাগে।”

“হুম, সেটাই। আর ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার কয়েকটা চরণ আমার খুব ভালো লেগেছে।”

“কোন চরণগুলো?”

কবিতার চরণ তো মুখস্ত নেই। তাই চোট করে বিছানা ছেড়ে টেবিলের উপর মেলে রাখা বইটা হাতে নিলাম। বিছানায় আবার বসে টাইপ করতে শুরু করলাম,

কী জানি কী হলো আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ-
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।
ওরে, চারি দিকে মোর
এ কী কারাগার ঘোর-
ভাঙ ভাঙ ভাঙ কারা, আঘাতে আঘাত কর্।
ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি,
এসেছে রবির কর।।

কবিতার চরণগুলো উনাকে পাঠিয়ে আবার ম্যাসেজ করলাম, “এই কয়েকটা চরণ খুব ভালো লেগেছে।”

“হুম, বুঝলাম। তা আমার লেখার কোনো চরণ ভালো লাগেনি।”

“হ্যাঁ, ভালো লেগেছে। এই তিন চরণ খুব ভালো লেগেছে,

‘আমি পড়েছি প্রেমে
মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখা
তার কত-শত লেখার প্রেমে।’

উনি ম্যাসেজ দিলেন, ” তোমার প্রশংসামূলক বাক্য আমার মনকে প্রশান্তি প্রদান করছে আর হৃদয়ে কবি ভাব জাগ্রত করছে।”

“হা হা হা।”

“আবার সেই ঝর্ণা ধারা। ইশ! যদি কাছ থেকে শুনতে পেতাম তোমার এই হাসির শব্দ।”

উনার ম্যাসেজে অন্য কিছুর আভাস পেয়ে জানতে চাইলাম, “কবি মহাশয় কি দেখতে চাওয়ার বায়না করার চিন্তায় আছেন?”

“করলে কি অপরাধ হবে?”

“জ্বী, অবশ্যই অপরাধ।”

“কারনটা কি জানতে পারি?”

“দু’দিনের আলাপে অবশ্যই কেউ রাজি হবে না।”

“হা হা হা।”

“হাসছেন কেন?”

“উম, তোমার কথায়। আসলে, আমি তোমার সাথে দেখা করতে তোমার হাসির প্রশংসা করিনি। আমি জানি, ম্যাসেজ পড়ে হাসির সৌন্দর্যের প্রশংসা করা নিতান্তই পাগলামি। কিন্তু, আমি আমার কল্পনায় তোমাকে হাসতে দেখেছি, সেটা তো আগেই বলেছি আর সেই দেখা থেকে প্রশংসা করেছি।”

উনার কথার জবাবে আমি তেমন কিছুই বললাম না কেবল ছোট্ট করে ম্যাসেজ দিলাম, “ওহ।”

“হুম, অচেনা কবি না হয় অচেনা-ই হয়ে থাকুক। তুমি কি বলো?”

“আমার কোনো আপত্তি নেই। কারন, আমি নিজেই অচেনা হয়ে থাকতে চাই।”

“সেটাই হবে মিস. কাব্যু। উম, রাত্রি গভীর হবে ধীরে ধীরে আর সেটা উপভোগ করতে চাই। তাই আজকের মতো সমাপ্ত হোক আমাদের আলাপচারিতা।”

“ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ।”

“আল্লাহ হাফেজ।”

৮.

‘কথা চৌধুরীর গল্পরাজ্য’ নামে আমার একটা ছোট্ট গ্রুপ আছে। শখের বশে খোলা গ্রুপে কেন যেন একের পর এক সমস্যায় বারবার জড়িয়ে যাচ্ছি। বিষয়টা কার কাছে কেমন লাগে জানি না। কিন্তু আমার কাছে খুব অবাক লেগেছে এটা ভেবে যে, আমার গ্রুপে আমার কথাই কেউ শুনতে এবং মানতে চায় না। কিছু বললে তর্ক করে আমার সাথে। আজব মানুষ! অন্যের গ্রুপে থাকছে অথচ সেই গ্রুপের মালিককে তোয়াক্কা করবে না– এটা কেমন কথা?

আজ সারাদিন গ্রুপ নিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। গ্রুপের সদস্য সংখ্যা খুব কম আর লেখালেখির জগতেও আমি নতুন। তাই কাউকে অনুরোধ করলেও মডারেটর হতে চায় না। এসব নিয়ে মন খারাপ হলেও কাউকে কিছু বুঝতে দেই না। বুঝালেও কোনো কাজ হবে না সেটা আমি জানি। আর এর কারন একটাই, আমার পাঠক সংখ্যা কম এবং আমি লেখালেখিতে একদম নতুন।

সবার কাছ থেকে খালি হাতে ফিরতে ফিরতে এখন ইচ্ছে করছে গ্রুপটা বন্ধ করে দিতে। কিন্তু এতো শখ করে খোলা গ্রুপটা অফ করতে কিছুতেই মনে সায় দিচ্ছে না। গ্রুপ নিয়ে তো মানসিক পীড়ায় ভুগছি পাশাপাশি শারীরিকভাবেও আমি খুব অসুস্থ। হাতের ব্যথায় এতো কষ্ট হচ্ছে যে, টাইপ করতে গেলে আমার মনে হয় যেন প্রাণটা বেরিয়ে যাচ্ছে। ব্যথায় টনটন করা হাতেও টাইপ করে আমার মডারেটরদের সাথে কথা বলে গ্রুপটা ঠিক করার চেষ্টা করছি। এমনকি নতুন কয়েকজনের সাথেও কথা বলে মডারেটর নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।

গ্রুপের ঝামেলায় ‘অনেক ভালোবাসি তোমায়’ গল্পটাও লেখা প্রায় বন্ধ করে রাখতে হয়েছে। অসুস্থ শরীর আর মন নিয়ে গল্প লেখা কোনো ভাবেই সম্ভব হচ্ছে না আমাকে দিয়ে। সবার সাথে গ্রুপ নিয়ে কথা বলতে বলতে কখন যে দুপুর পেরিয়ে বিকাল হয়ে গেল টেরই পেলাম না। মা অবশ্য কয়েকবার করে বলে গিয়েছিল, “খাবার খেয়ে তারপর না হয় ফোনে ডুব দেয়।”

আমার মার ভাষ্য মতে, আমিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফোন পাগলী আর আমার মতে তো আমি একটা ফোনখোর। অতিরিক্ত ফোন ব্যবহার করি বলে সবসময় মা’র কাছে শুনতে হয়, “ভাত না খেয়ে বরং ফোনটা গিলে ফেল।”

নয়ত বলে, “ফোনে ডুব দেয়।”

এসব কথা আমি এতো পরিমাণ শুনেছি যে, এখন এসব আমার কাছে গানের মতোই মধুর লাগে। মাঝে মাঝে তো আবার না শুনলে মনে মনে ভাবি, “ফোন পাগলীর তালিকায় থাকা আমার প্রথম স্থানটা কি সরে গেল নাকি? মা আমাকে আজকে একবারও বললো না কেন? এটা তো বড্ড চিন্তার বিষয়।”

হাত ব্যথার সাথে মাথাও প্রচন্ড ব্যথা করছে। এমন একটা শরীরেও আমি ফোনে টাইপ করতে ব্যস্ত আমার পাঠক প্রিয় মানুষদের সাথে এর মাঝে হঠাৎ মিরাজ মহাশয়ের ম্যাসেজ, “আসসালামু আলাইকুম মিস. কাব্যু।”

হাত ব্যথায় টনটন করছে তবুও উনাকে উত্তর দিলাম, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম, কবি সাহেব।”

“কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ তবে অসুস্থ।”

“কেন? কী হয়েছে?”

“হাতে প্রচন্ড ব্যথা, শরীর ভীষণ দূর্বল আর মাথাও ব্যথা করছে।”

“ডাক্তার দেখিয়েছো?”

“নাহ, তবে মেডিসিন নিচ্ছি।”

“কবে থেকে অসুস্থ?”

“কালকে রাত থেকেই হাত ব্যথা করছে। আর আজকে অনেক প্রেসার পড়েছে হাতে তাই ব্যথায় টনটন করছে।”

“আমাকে বলো নি কেন? আর অসুস্থ হাত নিয়ে তোমাকে কে বলে গল্প লিখতে?”

“আসলে গল্প লেখা বন্ধই আছে সম্পূর্ণ।”

“তাহলে হাতে প্রেসার পড়লো কী করে?”

“উম, আমার একটা ফেইসবুক গ্রুপ আছে ‘কথা চৌধুরীর গল্পরাজ্য’ নামে আর সেটার কাজ করতে গিয়েই প্রেসার পড়েছে।”

“হা হা হা, মিস. কাব্যু, গ্রুপে তো তেমন কোনো কাজ নেই। তাহলে প্রেসার কী করে পড়লো? হুম।”

উনার হাসি দেখে আমার রাগ লাগলো বিধায় জানতে চাইলাম, “আপনি হাসছেন?”

“তাহলে কী করবো?”

“নাহ, হাসুন। আমার সমস্যা নিয়ে সবাই হাসে। আপনিও হাসুন। হুহ।”

“এ কী! মহারানী কি রাগ করছেন?”

‘মহারানী’ নামটা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমি। সেই সাথে মুচকি মুচকি হাসছিও। কেন হাসছি সেটা জানা নেই। হয়ত এই নামটাও আমার মনে ধরেছে। তাই বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে মুখে কেবল হাসি ফুটছে। কিন্তু এই নামে কাকে সম্বোধন করলেন সেটা বুঝেও আবার জিজ্ঞেস করলাম, “মহারানী কে?”

চলবে…

(ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here