অচেনা কবি❤,পর্ব-৫

0
1105

অচেনা কবি❤,পর্ব-৫
লেখনীতেঃ কথা চৌধুরী❤

“প্রশ্নকর্তা নিজেই।”

“আমি?” অবাক হয়ে।

“হুম।”

আবার জিজ্ঞেস করলাম, “হঠাৎ করে আমায় মহারানী কেন ডাকছেন?”

“তোমার রাগটা আমার কাছে মহারানীর রাগের মতো লাগছে বিধায়।”

“মহারানী ছাড়া কেউ কি রাগ করতে পারে না?”

“হুম, পারে। তবে আমার কাছে তোমার রাগীরূপের সম্বোধন হলো মহারানী।”

উনার এমন আজগুবি কথা শুনে আমার হাসি পাচ্ছে। অদ্ভুত এই কথার মাঝে কিছু একটার খোঁজ পেয়েছে আমার মন। তাই আরও শুনবার তালে আমিও আজগুবি প্রশ্ন করে বসলাম, “তা আমি কোন রাজ্যের রানী?”

“হা হা হা।”

জবাব না দিয়ে আবারও হাসিতে মত্ত হলেন উনি। না শুনে, না দেখেও বুঝতে পারছি যে, উনি হেসে কুটিকুটি হচ্ছেন। এদিকে আমি নিজের মাঝে অনুভব করছি কিঞ্চিৎ রাগ সাথে খানিকটা অজানা অভিমান। এই অজানা অভিমানকে মিশিয়ে, তৈরি করা আমার প্রশ্নের জবাব চাইলাম উনার কাছে, “হাসছেন কেন আবার?”

“এমনিতেই। তা দুপুরে খাওয়াদাওয়া হয়েছে আর মেডিসিন নিয়েছো?”

“নাহ।”

“কেন?”

“গ্রুপের কাজ করতে করতে কখন যে সময় পেরিয়ে গেছে টের পাইনি।”

“তোমাকে ১৫ মিনিট সময় দিলাম। ফোন রেখে, দুপুরের খাবার খেয়ে, মেডিসিন নিবে। তারপর আমাকে এসে জানাবে যে, সব ঠিকঠাক মতো করেছো। বুঝেছো আমি কী বলেছি?”

এখন আমার খেতে একটুও ইচ্ছে করছে না বিধায় প্রতুত্তরে বললাম, “একটু পরে খেয়ে নিবো।”

“তুমি আমার কথা কি শুনবে না?”

“কী মুশকিলে পড়লাম রে বাবা!” আপনমনে যদিও এটা বলেছি কিন্তু উনার কাছে সময়ের প্রত্যাশায় জানতে চেয়েছি, “পাঁচ মিনিট পরে যাই?”

“আমি তোমাকে এখন বলেছি যেতে।”

ম্যাসেজ দেখে বোধ হচ্ছে হয়ত উনি রেগে যাবেন কথা না শুনলে। তাই সম্মতি জানাতে বললাম, “ঠিক আছে। সবকিছু শেষ করে আপনাকে টেক্সট করবো।”

“হুম।”

উনার কথা মতো ফোন রেখে খেতে চলে এলাম। ভাবতেই অবাক লাগছে যে, অচেনা কারোর কথা রাখতে আমি খেতে চলে এসেছি। আমার জন্য মা খাবার সাজিয়ে রেখেছেন অনেক আগে। চেয়ারে বসে খেতে শুরু করলাম। কিন্তু ভাত মাখাতে গিয়ে অনুভব করলাম হাতের ব্যথায় খাবার মাখানো দায়। ব্যথায় টনটন করা হাতে অনেক কষ্টে খাওয়া শেষ করলাম। এরপর মায়ের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে সেটাও খেয়ে নিলাম।

আজকে আমার পছন্দের সব খাবার তৈরি করা হয়েছিল কিন্তু ব্যথার দরুন খাবারের স্বাদ পেলাম না মন মতো। তাই উদাসীন আমি হেলেদুলে রুমে চলে এলাম। ফোন হাতে নিয়ে, একটা গান প্লে করে কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিলাম,

“একা দিন, ফাঁকা রাত নিভেছে আলো
তুই নেই, কেউ নেই লাগছে না ভালো।

একা দিন, ফাঁকা রাত নিভেছে আলো
তুই নেই, কেউ নেই লাগছে না ভালো।

তোর নাম না জানা অভিমানে,
কত দূরে ভাসা যায়?
আমি চাইছি তবু পারছি না তো
থামাতে আমায়।

একা দিন, ফাঁকা রাত নিভেছে আলো
তুই নেই, কেউ নেই লাগছে না ভালো।”

সময়ে অসময়ে গানের ভুবনে হারিয়ে যাই। আমার ভালো লাগা, মন্দ লাগার মুহূর্তে গানটা সবসময় আমার মনে অন্য আরেক ভুবনের সৃষ্টি করে। যে ভুবনে চলে শুধু আমার রাজত্ব আর আমার ভুবনে আমিই রানী, আমিই রাজা।

গানের তালে তালে মন নেচে চলেছে আমার। এই গানটা এখন অবধি কয়েক শতবার শুনেছি তবুও একঘেয়েমি বোধ হচ্ছে না। বরং যত শুনছি, ততই ভালো লাগা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কানে গানের সুর আর হাতের আঙুল নেচে চলেছে ফোনের রঙিন স্ক্রিনে, “কবি সাহেব, আছেন কি ইনবক্সে?”

প্রায় সাথে সাথেই জবাব দিলেন, “হুম, মিস. কাব্যু, আছি ইনবক্সে। তা খেয়েছো?”

“জ্বী।”

“মেডিসিন নিয়েছো?”

“জ্বী, নিয়েছি।”

“বাহ! ১৫ মিনিট সময় দিয়েছিলাম তার আগে চলে এলে। খুব ভালো।”

প্রশংসামূলক বাক্য দেখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম, “শুকরিয়া।”

“হাত কি খুব ব্যথা করছে?”

“হুম, করছে।”

“ঠিক আছে, ফোন রেখে এখন বিশ্রাম নাও। টাইপ করলে হাতের অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।”

“আচ্ছা, তাহলে পরে কথা হবে ইন শা আল্লাহ।”

“হুম, রাতে ডিনার করে আবার মেডিসিন নিয়ে নিও, কেমন?”

“ঠিক আছে, আল্লাহ হাফেজ।”

“কাব্যু
কাব্যু কাব্যু কাব্যু কাব্যু
কাব্যু কাব্যু কাব্যু
আল্লাহ হাফেজ।”

আবারও কয়েকবার করে ‘কাব্যু’ নামে সম্বোধন করলেন আমায়। সেটা দেখে নিজের মনকে জিজ্ঞেস করলাম, “নামটা উনি এতোবার কেন লেখেন?”

৯.

কথায় আছে, ‘এক মাঘে শীত যায় না।’ আমারও ঠিক একই অবস্থা। একে তো অসুস্থ তারপর আবার গ্রুপের অবস্থাও নড়বড়ে। নিজের শরীরের মতো গ্রুপটাকে অসুস্থ দেখে মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে গ্রুপ বন্ধ করে দিতে। কিন্তু শখের গ্রুপটা বন্ধ করতেও মনে সায় দেয় না।

আজকে খুব ইচ্ছে করছে একটা চলচ্চিত্র দেখতে। অনেকদিন বাংলা চলচ্চিত্র দেখা হয় না। ল্যাপটপে তাই চলচ্চিত্র খুঁজতে শুরু করলাম আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পেয়েও গেলাম। ‘গীত সঙ্গীত’ নামে একটা ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র দেখার ইচ্ছে পোষণ করলাম।

‘গীত সঙ্গীত’ নির্মিত হয় ১৯৯৩ সালে। তখন আমার জন্ম হবে তো দূর বাবা মা’র বিয়েও হয়নি। বেশ পুরনো এই চলচ্চিত্র ভালো লাগার পিছনে অন্যতম কারণ হলো এতে প্রাচুর্যের চেয়ে সঙ্গীতকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আর অন্য একটা দিকও খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আর সেটা হলো নিজের চেষ্টা, পরিশ্রম এবং সাধনা থাকলে যে-কোনো কাজেই উন্নতি করা সম্ভব।

“চোখের ভাষা যদি বুঝতে পারি
না বলা কথা যদি শুনতে পারি।

চোখের ভাষা যদি বুঝতে পারি
না বলা কথা যদি শুনতে পারি।

তবে করি না তো ভুল আমি এক চুল
তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার
তুমি আমার… … তুমি আমার… …
তুমি আমার… … তুমি আমার… …”

এই গানটা আমার খুব পছন্দের এবং শুনলেই ইচ্ছে করে গুনগুন করে সুর মিলাতে। এখনও ইচ্ছে করছে বলে অনেকটা জোরে জোরে গান গাইতে শুরু করলাম। হঠাৎ মা কিচেন থেকে চেঁচিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করল, “কথামনি, দেখ তো দরজার কাছে কোনো হাঁস পেক পেক করছে কিনা?”

আমি গান গাওয়া বন্ধ করে মাকে উল্টো জিজ্ঞেস করলাম, “এখানে হাঁস কোথা থেকে আসবে মা?”

“তাহলে আমি কার গলা শুনছি?” কথাটা মা যে আমাকে বলেছে, সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারছি। তাই মুখখানা মলিন করে জবাব দিলাম, “কারোর না মা।”

মনে মনে বললাম, “ধ্যাত, শেষমেষ আমার গানের গলার জন্য এতো বড় সম্মাননা পেলাম। জীবনে আর গানই গাইবো না।”

চলচ্চিত্র প্রায় শেষের দিকে। আচমকা ফোনের টোন শুনতে পেয়ে পাশে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে বললাম, “হ্যালো।”

“কী করছিলে কথামনি?” রাজ ভাইয়ার প্রশ্ন।

“ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র দেখছিলাম।”

ফোঁড়ন কেটে উনি বললেন, “সারাদিন ফোন ছাড়া কিছু চোখে দেখো না? ভাসা ভাসা চোখজোড়া যে এবার অন্ধ হওয়ার পথে।”

“ভাইয়া, আমি ফোনে নয় ল্যাপটপে দেখছিলাম।”

“দু’টো মাঝে কোনো তফাৎ আছে?”

“হ্যাঁ, ফোন আকারে ছোট আর ল্যাপটপ বড়।”

কপট রাগ দেখিয়ে, “ফাজলামি করছো তুমি আমার সাথে?”

“আপনি কি আমার দুলাভাই যে, আপনার সাথে ফাজলামি করব।”

“ভাগ্যিস, তোমার বোন নেই নয়ত তোমার এই কথা শুনে সবাই আমাকে সন্দেহ করত।”

“সবাই সন্দেহ করা না ভাইয়া। কেউ কেউ অন্ধের মত বিশ্বাসও করে।”

মলিন কন্ঠে বলা আমার কথাগুলো শুনে ভাইয়া হঠাৎ চুপ করে গেলেন। আমিও উনার সাথে তাল মিলিয়ে কিছুক্ষণের জন্য নীরবতাকে আপন করে নিলাম। কিন্তু পিনপতন নীরবতায় দম আটকে আসছে বলে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভাইয়া, আপনার কি কোনোকিছু বলার ছিল?”

“কেন?”

“হঠাৎ কল করলেন তো তাই।”

“কিছু বলার না থাকলে কি তোমায় কল করা যাবে না?”

“কেন যাবে না? আসলে আপনি তো কোনো দরকার ছাড়া ম্যাসেজও পাঠান না। আজকে তো কলই করেছেন। তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

শান্ত গলায়, “দরকার নেই আবার দরকার আছে।”

“মানে?” বুঝতে না পেরে।

“কিছু না তা হাতের অবস্থা কেমন এখন?”

“মোটামুটি ভালো।”

“মেডিসিন নিচ্ছো তো ঠিক মতো।”

“জ্বী, কিন্তু আমাকে নিয়ে আপনি এত কেন ভাবছেন ভাইয়া?”

“আমাকেই তো ভাবতে হবে কারণ তুমি আমার…” বাক্য সম্পূর্ণ করার আগে উনি হঠাৎ চেঁচিয়ে বলতে শুরু করলেন, “মা আমি আমার রুমে আছি।”

ভাইয়ার কথা শুনে বুঝতে পারলাম হয়ত মামী উনাকে ডাকছেন। মামীর ডাকে সাড়া দিয়ে এবার আমায় বললেন, “মা ডাকছে। তুমি সময় মত খাবার খেয়ে মেডিসিন নিও। আল্লাহ হাফেজ।”

“ঠিক আছে ভাইয়া। আল্লাহ হাফেজ।”

আমি উত্তর দিতে ভাইয়া কল কেটে দিলেন। ফোনের স্ক্রিনে উনার নামটা ভাসিয়ে তাকিয়ে রইলাম। ভ্রু কুঁচকে বিড়বিড় করে বললাম, “উনি কেন আমার কথা ভাববেন? আর আমি উনার কে? কে হই আমি উনার? আজকাল রাগ করে কথা বললেও উনি বকাবকি করেন না আমায়। অথচ আগে ভালো করে কথা বললেও বলতেন আমার মুখে নাকি মুধ নেই। অবশ্য এখনও ত্যাড়া ত্যাড়া করে কথা বলেন আমার সাথে। তবে আমার রাগও হজম করেন।… করবে না আবার? বিনা কারণে আমাকে সেদিন কত বকেছে। তাহলে তো আমার রাগ হজম করতেই হবে।”

চলবে…

(ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here