অচেনা কবি❤,পর্ব-৬
লেখনীতেঃ কথা চৌধুরী❤
১০.
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবার তোড়জোড় চলছে পশ্চিম আকাশে। আলতা রাঙা গোধূলি দেখবার আশায় আমার কাজল কালো চোখও চঞ্চল হয়ে উঠেছে। আজ অনেকদিন বাদে চোখ রাঙিয়েছি আমি কালো কাজলে।
গুটি গুটি পায়ে হেঁটে চলে এলাম বেলকনিতে। মিনিট কয়েক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে এবার দৃষ্টি দিলাম আমারই নূপুর পড়া পায়ে। একদৃষ্টিতে সেথায় তাকিয়ে থেকে আচমকা একটা গান মনে আসতে গুনগুন করতে শুরু করলাম, “বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর পায়ে দিয়ে সোনার নুপুর।”
‘সোনার নুপুর’ কথাটা ভাবতেই মাথায় চাটি মেরে বললাম, “এই যা, আমার তো রূপোর নুপুর।”
একটু থেমে সুরে সুরে বলতে লাগলাম, “বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর পায়ে দিয়ে রূপোর নুপুর।… হুম, এইবার ঠিক আছে।”
দুই হাতে বৃষ্টিতে ভেজা গ্রিল আঁকড়ে ধরলাম। বৃষ্টির ফোঁটা আমাকে ছুঁয়ে দিতে আলতো করে চোখ বুঁজে দাঁড়ালাম। ভেজা বাতাসের গন্ধ টেনে নিয়ে মনের খোরাক জোটালাম। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে আমি খানিকটা আঁতকে উঠলাম। এই অসময়ে কে এলো সেটা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করতে করতে শুনতে পেলাম মা দরজা খুলে দিয়েছেন।
বৃষ্টিবিলাশে ইতি টেনে রুমে চলে এলাম আমি। ওড়না দিয়ে ভেজা মুখখানা মুছে দিতে শুনতে পেলাম মা’র কন্ঠে, “এমন বৃষ্টিতে ভিজে কেন এলে বাবা?”
পরিচিত কন্ঠে কাউকে জবাব দিতে শুনলাম, “বের হওয়ার আগে তো আকাশের অবস্থা এতো খারাপ ছিল না ফুপ্পি। আর এসব নিয়ে বাসায় ফিরে যাওয়াও দুষ্কর। তাই তোমার এখানেই চলে এলাম।”
মা বলছেন, “ভিজে জবজব করছে তোমার শরীর। দাঁড়াও আমি কথামনিকে বলছি তোমাকে তোয়ালে দিতে।” সাথে সাথেই মা’র ডাক কানে এলো, “কথামনি, কথামনি?”
“যাই মা।” গলা উঁচিয়ে দেওয়া আমার জবাব।
“একটা তোয়ালে নিয়ে আয় তো রাজের জন্য।”
“ঠিক আছে, আনছি।”
আলমারি থেকে নতুন একটা তোয়ালে নিয়ে চলে এলাম ড্রয়িংরুমে। উনার ভিজে যাওয়া চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। সাদা বর্ণের মানুষটাকে ভেজা শরীরে আরও বেশি ফর্সা লাগছে। শুনেছি, যারা ফর্সা হয় দেখতে তাদের নাকি সাদা পোশাকে কালো বর্ণের দেখায় কিন্তু এই মানুষটাকে কেন সাদা পোশাকে আরও ফর্সা লাগছে?
তোয়ালে হাতে আমাকে দেখে মা বললেন, “দে মা, তোয়ালেটা রাজকে দেয়। আর তোর বাবার একটা লুঙ্গি আর শার্ট নিয়ে আয়।”
আমি মাকে কিছু বলার আগে ভাইয়া বলে উঠলেন, “না, না, ফুপ্পি। এসব কিছু লাগবে না। আমি এক্ষুণি বাসায় চলে যাবো।”
মলিন কন্ঠে মা বলল, “এমন বৃষ্টিতে ভিজে এসে আবার চলে যাওয়ার কথা কেন বলছো বাবা? আজকে তুমি আমাদের এখানে থেকে যাবে। এমন ঝড়বৃষ্টিতে আমি তোমাকে বের হতে দিচ্ছি না। এখন আবার করোনার প্রকোপও বাড়ছে। ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে ডাক্তারও পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।”
“কিন্তু ফুপ্পি…” ভাইয়াকে বলতে না দিয়ে, “কোনো কিন্তু নয় বাবা। আমি এক্ষুনি ভাবীকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।” আমার দিকে তাকিয়ে, “তুই এখানে এখনও কেন দাঁড়িয়ে আছিস? যা শিগগির।”
‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়িয়ে চলে এলাম বাবার রুমে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বাবা ফোন স্ক্রোল করছিলেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে মা? কে এসেছে?”
“রাজ ভাইয়া।” বলেই আলমারি খুলে লুঙ্গি আর শার্ট খুঁজতে শুরু করলাম। আমার খোঁজাখুঁজি দেখে বাবা আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কী খুঁজছিস?”
“ভাইয়া বৃষ্টিতে ভিজে এসেছেন। তাই মা বলেছেন তোমার থেকে একটা লুঙ্গি আর শার্ট নিয়ে ভাইয়াকে দিতে।”
“ওহ, এখানে পাবি না। তোর ডান দিকে দেখ আমার কিছু আগের টিশার্ট আছে সেখান থেকে নিয়ে যা। যুবক বয়সে কিনেছিলাম কিন্তু পড়া হয়নি।” দীর্ঘ শ্বাসে বাবা কথা শেষ করলেন। বাবার কথা মতো নতুন টিশার্ট আর লুঙ্গি নিয়ে চলে এলাম ড্রয়িং রুমে। ভাইয়া এক হাতে চুল মুছতে ব্যস্ত তো অন্য হাতে ফোন স্ক্রোল করতে। আমি হাত বাড়িয়ে বললাম, “পোশাক বদলে নিন ভাইয়া।”
আমার হাত থেকে কাপড়গুলো উনি নিতেই বললাম, “এগুলো একদম নতুন কিন্তু অনেক আগের।”
আঁড়চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি জানতে চেয়েছি?”
“নাহ, কিন্তু আমিই বললাম। আচ্ছা, বাইরে তো আহামরি বৃষ্টি হচ্ছে না তাহলে আপনি এমন গরু ধোয়ার মতো ধুয়ে কেন এলেন?”
এবার উনি চোখমুখ খিঁচে আমায় জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি চাও আমি এখন তোমাদের বাসা থেকে চলে যাই?”
“না, না, সেটা কেন চাইবো? আপনার ফুপ্পি মানে আমার মাতাজান যদি জানতে পারে আমার কথায় আপনি চলে গেছেন। তাহলে তো আমাকেও আপনার মতো গরু ধোয়ার অবস্থা করে ছাড়বেন।”
“কিছু বলছি না বলে কি ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আমার মাথা খাচ্ছো?”
“ভাইয়া, আপনার মাথা রুইমাছের মাথার মত সুস্বাদু হলেও সেটা না খেয়ে আমি শুধু ভাত খেতাম।”
উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “তুমি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু ভাত খাও। আমি ওয়াশরুমে গেলাম। যতসব আধপাগল।”
রাত নয়টা বেজে কুড়ি মিনিট। নিজের রুমেও মেহমানের মত চেয়ারে বসে আছি আর নবাবজাদা আমার বিছানায় শুয়ে পা দোলাচ্ছে। কোথ থেকে উড়ে এসে এখন আমার রুম জুড়ে বসেছে। আমি মুখে উনার সাথে পটরপটর করলেও ভেতরে ঠিকই ভয় কাজ করে। তাই তো সেই কখন থেকে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছি। ফোন হাতে নিতে মনটা উশখুশ করলেও ভাইয়ার সামনে ফোন ধরলে উনি আমায় একগাদা কথা শুনিয়ে দিবেন।
বাইরে বৃষ্টি আর ঘরের মাঝে স্তব্ধতা। মাঝে মাঝে বইয়ের পাতা উল্টানোর শব্দ হলেও মুখ নড়ছে না কারোর। চোখের সামনে মেলে রাখা বইয়ের পাতায় চোখ স্থির হচ্ছে না। পানি পান করার অজুহাতে রুম থেকে কেটে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বই বন্ধ যেই উঠতে যাবে ঠিক তখন উনার প্রশ্ন, “কোথাও যাচ্ছো?”
“হ্যাঁ, পানি আনতে।”
“পানি আনতে না পালাতে?” নির্বিঘ্নে জিজ্ঞেস করলেন।
“আপনি কি বাঘ নাকি ভাল্লুক?”
ফোন স্ক্রোল বন্ধ করে রাগী দৃষ্টি দিলেন আমার দিকে৷ উনার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমি ভেতরে ভেতরে চুপসে গেলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করলাম না, “চোখ রাঙিয়ে কাজ হবে না। কারণ আমি আপনাকে মোটেও ভয় পাই না। হুহ।” এই বলে ফোন হাতে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম কিন্তু নিজের বাহাদুরির জন্য এখন আবার ভয় করছে আমার।
“উনি যদি মা’র কাছে নালিশ করেন? মা তো উনার কথা সব বিশ্বাস করবেন।” আনমনে বলে এবার সিদ্ধান্ত নিলাম ভাইয়ার এখনকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করব। তাই বাইরে দাঁড়িয়ে রুমে উঁকি দিলাম। উনাকে দেখে আমি এবার ৪২০ ভোল্টের শক খেলাম কারণ উনি নালিশ করবেন তো দূর রাগই করেননি উল্টো হেসে লুটিয়ে পড়ছেন। আর হাসতে হাসতে বলছেন, “পাগল মেয়ে একটা। কীসব বলে আর কীসব করে?”
ভাইয়াকে হাসতে দেখে এখন আমার খুব করে লজ্জা লাগছে। লজ্জা রাঙা মুখে নখ খুঁটে বললাম, “ইশ, আমি কীসব বলি আর কীসব করি!”
১১.
কালকে অঝোরে বৃষ্টি হওয়ার পর আজকের আকাশ একদম ফকফকা। কিন্তু বাতাসে এখনও হিম ভাব বিরাজমান। কালকে রাতে ফোন হাতে নিলেও অনলাইন হওয়ার সুযোগ হয়ে উঠেনি। তাই আজকে সাত সকালে ফোন হাতে নিয়ে বসলাম। ইনবক্সে উঁকি দিতে দেখি কালকে মিরাজ মহাশয় আমাকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলেন, “আসসালামু আলাইকুম মিস. কাব্যু। এখন কেমন বোধ করছো? শোনো, তোমার হাতের অবস্থা ভালো নয়। তাই ম্যাসেজ দেখে, সালামের উত্তর দিয়ে ছোট্ট করে ভালো বা মন্দ লিখবে। ব্যথাযুক্ত হাতে একদমই বেশি টাইপ করবে না।”
উনার ম্যাসেজ পড়ে খানিকটা জোরে হেসে উঠলাম। আজকে আলহামদুলিল্লাহ হাতের অবস্থা ভালো। তাই উনাকে জবাব দিতে টাইপ করতে লাগলাম, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আপনি?”
দুই মিনিট বাদে জবাব দিলেন, “আমিও ভালো আছি আর আমার খোঁজ খবর নিতে হবে না। তুমি কি এখন ফ্রি আছো? টাইপ করবে না। ‘হ্যাঁ’ হলে লাইক ইমোজি দিবে আর ‘না’ হলে ডিজলাইক।”
আমি এখন অবসরই আছি। তাই উনার কথা মতো ‘হ্যাঁ’ সূচক লাইক ইমোজি দিলাম। উনি আবার ম্যাসেজ দিলেন, “ঠিক আছে, এখন আমি ম্যাসেজ করবো আর তুমি শুধু ইমোজি দিবে, কেমন?”
“কিন্তু আজকে তো আমার হাতের অবস্থা আল্লাহর রহমতে ভালো। আমি টাইপ করতে পারব।”
“ও আচ্ছা, তা কালকে ইনবক্সে আসোনি?”
“নাহ।”
“কেন?”
“আমার মামাতো ভাই এসেছিলেন। উনি ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার করা পছন্দ করেন না। তাই উনি বাসায় থাকাকালীন ফোন ব্যবহার করা হয়নি।”
“এখনও কি বাসায়?”
“নাহ, উনি তো খুব ভোরেই চলে গেছেন হয়ত কোনো কাজ আছে উনার।”
“ও আচ্ছা। শোনো, হাত ভালো আছে কিন্তু খারাপ হতে কতক্ষণ? তাই টাইপ করতে হবে না, ইমোজি দিলেই চলবে।”
মুচকি হেসে আমার জবাব, “ঠিক আছে, কবি সাহেব।”
উনি এবার লিখতে শুরু করলেন, “আবারও একটা কবিতা লিখেছি। বুঝতে পারছি না তোমার কথা শুনে কবি হয়ে যাচ্ছি কিনা। কবিতাটা কি দেখবে?”
আমি লাইক ইমুজি দিয়ে বুঝালাম, হ্যাঁ, দেখবো। এরপর উনি কবিতাটা আমাকে পাঠাতেই আমি পড়তে শুরু করলাম,
“মনের চোখে
তোমাকে দেখে,
এঁকেছি আমি
তোমার-ই ছবি।
তোমাকে নিয়ে
কবিতা লিখে,
হতে চাই তোমার
অচেনা কবি।”
কবিতা পড়ার মাঝে উনি আবার জানতে চাইলেন, “কেমন হয়েছে মিস. কাব্যু?”
জবাবে কী ইমুজি দেওয়া উচিত বুঝতে পারছি না কেবল মুচকি মুচকি হাসছি আমি। কবিতা আমার সবসময়ই ভালো লাগে। এতোটাই পছন্দ যে, এক একটা কবিতা আমি সর্বনিম্ন ১০/১৫ বার পড়ি। উনার এই কবিতাটাও মোটামুটি ৪/৫ বার পড়ে ফেলেছি। অন্য কারোর কাছে কতটা ভালো লাগবে তা আমার জানা নেই। কিন্তু আমার তো অসাধারণ লেগেছে। তারপর উনি আমাকে খুশি করতে আমার দেওয়া নামে কবিতা লিখেছেন। ভাবা যায়!
কয়েক মূহুর্ত ভেবে, মুখে আমার হাসি ছড়িয়ে দিলাম উনার কবিতায় লাভ ইমোজি। এখন অপেক্ষা করছি উনার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য যে, এটা দেখার পর উনি কী ভাবেন আর কী টেক্সট করেন?
আমার ভাবনার মাঝে উনি টেক্সট করলেন, “একি করলে মিস কাব্যু! আমার কবিতায় তুমি লাভ ইমোজি দিলে? আমার তো এটাকে কবিতাই মনে হচ্ছে না আর তুমি কিনা লাভ ইমোজি দিলে। এতো ভালো লেগেছে?”
আমি আবারও লাভ ইমোজি দিয়ে মুখে লাজুক হাসি টেনে অপেক্ষা করতে লাগলাম। উনার জবাব, “আবারও লাভ ইমোজি দিলে? এতোবার লাভ ইমোজি দিও না সমস্যা হতে পারে, বুঝলে?”
‘হ্যাঁ’ সূচক লাইক ইমোজি দিলাম এবার। উনার কথামতোই কোনো ম্যাসেজ না দিয়ে শুধু ইমোজি দিয়ে চলেছি। আর উনি একের এক ম্যাসেজ দিয়ে চলেছেন, “মিস কাব্যু, জানি না, আমার সাথে কথা বলতে তুমি কতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করো। কিন্তু আমার না কেন যেন ভালো লাগে তোমার সাথে কথা বলতে। মোটামুটি কয়েকবারই তোমার সাথে কথা হয়েছে। কিন্তু তুমি আমার সম্পর্কে কোনো কিছুই জানতে চাওনি, আমিও চাইনি। আসলে, পরিচয় দিয়ে কী করবো? তোমাকে তো আমি জানি, বুঝি আর তোমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা আছে আমার। তাই নতুন করে আর কিছু জানতে চাই না।”
উনার ম্যাসেজে আমি বেশ চমকে গেলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, “আমার সম্পর্কে উনার জানা আছে মানে? উনি তাহলে আমাকে সত্যিই চেনেন?”
চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)