অচেনা কবি❤,পর্ব-৯ (শেষ পর্ব)

0
4237

অচেনা কবি❤,পর্ব-৯ (শেষ পর্ব)
লেখনীতেঃ কথা চৌধুরী❤

অনেকটা সময় উনি কোনো উত্তর দিলেন না হয়ত আমার ম্যাসেজটা পড়ে ভাবছেন। এক-দুই মিনিট পর ম্যাসেজ দিলেন, “হুম, বুঝলাম। তবে সত্যি কথা কি জানো?”

“কি?”

“লেখার মান যেমনই হোক না কেন? আমরা কাউকে উৎসাহ দিতে পারি না। তবে ভুল করলে ঠিকই সমালোচনা করতে পারি। আবার সমালোচনাও এমনভাবেই করি যে, তার কাজের চেয়ে ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে বেশি হস্তক্ষেপ করি। আসলে আমাদের মন-মানসিকতা ভিন্ন রকম। অন্যের উন্নতির চেয়ে অবনতি আমাদের বেশি আনন্দ দেয়, পৈশাচিক আনন্দ। তাই তো কারো উন্নতির চেয়ে অবনতির বেশি চিন্তা করি কিন্তু এতে যে আমাদেরও ক্ষতি হয় সেটা আমরা কখনও ভাবি না। আজ আমরা কারোর সাথে যেমনটি করবো, সে নিজে ফেরত না দিলেও প্রকৃতি একদিন ঠিকই ফিরিয়ে দিবে। তাই বলবো, ভেঙে পড়ো না। ধৈর্য্য ধরো। দেখবে, একদিন তুমিও তোমার কষ্টের ফল ঠিকই পেয়েছো আর লেখালেখিতে তো তুমি নতুন তাই লেখার মান পারফেক্ট হতে সময় লাগবে, বুঝলে মিস কাব্যু?”

ছোট্ট করে জবাব, “হুম।”

“বেশ ভালো। আচ্ছা, আমার সাথে তোমার কথা বলতে বিরক্ত বোধ হয় না তো?”

“উম, আপাতত হয়নি তবে ভবিষ্যতে হবে কিনা তা জানা নেই।”

“বাহ! বেশ সোজাসাপটা উত্তর দিলে তো।”

উনার ম্যাসেজে মুচকি হেসে উঠলাম আমি। ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়েই আলতো হাতে টাইপ করলাম, “হ্যাঁ, বলে দিলাম।”

“আচ্ছা, আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করলে জবাব দিবে কি? আর তার আগে বলো তো, তোমার হাতে ব্যথা হবে না তো?”

“না, না, সমস্যা নেই। আপনি জিজ্ঞেস করুন। জবাব দেওয়ার মতো হলে অবশ্যই দিবো।”

“লেখালেখিতে কেন এলে? মানে অন্যকিছুও চাইলে করতে পারতে।”

“বেশ জটিল প্রশ্ন। আসলে ছোটবেলা থেকে লেখালেখিটা আমার পছন্দ। মানে স্কুলে যদি হোমওয়ার্ক দিতো সবার আগে আমি লাফিয়ে উঠতাম কারণ লিখতে পারবো বলে। তবে আমার হাতের লেখা একদমই ভালো নয়। কিন্তু কাগজে কলমে মিশে থাকতে ভালো লাগে আর কবিতা আমার খুব পছন্দের। তাই নিজেও এটা সেটা লিখতে চাইতাম কবিতার রূপ দিতে যদিও কবিতা হতো না একবিন্দুও। আর হ্যাঁ, চিঠি। চিঠি আমার খুব পছন্দের। প্রায়শই চিঠি লেখা হয় নিজেকে।”

“নিজেকে?”

“হ্যাঁ, আর কাকে দিবো?”

“কেন? আমাকেও তো দিতো পারো, তাই না?”

অবাক হয়ে, “আপনাকে?”

“হ্যাঁ, বন্ধু হিসেবে তোমার কাছ থেকে কি আমি চিঠি প্রত্যাশা করতে পারি না?”

“কিন্তু আপনাকে আমি কী বিষয়ে চিঠি দিবো? আর ঠিকানাও তো জানা নেই যে চিঠি পাঠাবো।”

“হা হা হা।”

“এ কি! হাসছেন কেন?” খানিকটা বিরক্ত হয়ে।

“আরে বাবা, তুমি ইনবক্সে চিঠি পাঠাবে আর যে-কোনো বিষয় নিয়েই লিখতে পারো। আমি চিঠি পেলেই হলো।”

“দ্বিতীয়ত আমি আপনার বাবা নই।”

“হা হা হা। ঠিক আছে, তুমি আমার বাবা নও। কিন্তু দ্বিতীয়ত কেন? তাহলে প্রথমত কী?”

“খুব শীগ্রই আপনাকে চিঠি লিখবো– এটাই প্রথমত।”

“অপেক্ষায় রইলাম আমি তোমারও চিঠির আশায় কিন্তু এখন আসি মিস কাব্যু কারণ সময় যে বয়ে যায়।”

“ঠিক আছে, আল্লাহ হাফেজ।”

“হুম, আল্লাহ হাফেজ।”

১৬.

রাত দশটা। চিন্তামগ্ন আমি ফোন হাতে অবস্থান করছি নিজের রুমে। কিছু লিখবার বৃথা চেষ্টা চলছে সেই কখন থেকে। দোটানায় ভুগছি আমি, “উনাকে চিঠি লেখা কি উচিত হবে?” পরক্ষণেই আবার বিড়বিড় করে বললাম, “নিজে থেকে যখন বলেছে তাহলে লিখেই ফেলি একটা চিঠি। তাছাড়া আমিও ভাবছিলাম জানিয়ে দিবো আমার মনে লুকায়িত সেই কথা।”

সোজা হয়ে বসে এবার আলতো হাতে টাইপ করতে শুরু করলাম,

“অচেনা কবি,
আপনি কি সত্যিই অচেনা? মাঝে মাঝে মনে হয়, অচেনা হয়েও খুব করে চেনা। জানেন, এই প্রথম আমি কোনো পুরুষকে চিঠি লিখছি তাও আবার ভার্চুয়ালে। সত্যি বলতে বুঝতে পারছি না কী লেখা উচিত? তবে হ্যাঁ, নিজের মনে লুকায়িত একটা কথা আপনাকে জানাতে চাই৷ আমি না একজনকে ভালোবাসি। খুব সহজে এটা আপনাকে বললেও তাকে আজ পর্যন্ত বলতে পারিনি। কী করে বলবো বলুন? উনি তো উনার বোনের জন্য আমাকে ভুল বুঝে বসে আছেন অথচ আমি উনার বোনের ব্যাপারটা নিয়ে কিছুই জানতাম না। বিনা দোষে দোষী হয়ে উনার কাছে অনেক বকাঝকা শুনেছি। এটা নিয়ে অনেক রাগারাগিও হয়েছে কিন্তু রাগ থেকে কখন অনুরাগ হলো সেটা টেরও পেলাম না। কিন্তু ঐ ঘটনার পর থেকে হয়ত উনার কাছে আমি অনেক নিচে নেমে গিয়েছি। তাই এখন যদি আমি উনাকে বলি যে, রাজ ভাইয়া আমি আপনাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চাই তবে উনি ভাববেন, আমি মজা করছি। কী করে উনাকে বুঝাবো? কী করে বলবো আমি উনাকে ভালোবাসি?”

লেখা শেষ হতে পুরো লেখায় একবার চোখ বুলিয়ে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিলাম। মিনিট দুয়েক বাদে কবি সাহেব আমাকে ম্যাসেজের উত্তর না দিয়ে সরাসরি কল করে বসলেন। আমি তো উনার কল পেয়ে থ মেরে গেলাম। ম্যাসেঞ্জারে আসা উনার কল আলতো হাতে রিসিভ করতে উনি জিজ্ঞেস করলেন, “আমার সাথে রসিকতা করছো?”

“রসিকতা কোথায় পেলেন?”

“তুমি আমাকে ভালোবাসো?”

“আমি কি বলেছি, আমি আপনাকে ভালোবাসি?”উনি বেশ রেগে কথা বললেও আমি উনাকে শান্ত গলায় জবাব দিলাম।

“দেখো, ত্যাড়াত্যাড়া কথা বলবে না। তোমার এসব ত্যাড়াত্যাড়া কথা আমার একদম পছন্দ হয় না।”

এই মূহুর্তে উনার রাগে আমি বেশ মজা পাচ্ছি। মজা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে কেমন কথা পছন্দ আপনার কবি সাহেব?”

“কীসের কবি আর কীসের সাহেব? আমি রা…”

“আপনি কী?” বুঝেও না বুঝার ভান করে প্রশ্ন করেছি।

কয়েক সেকেন্ড পর উনাকে বলতে শুনলাম, “ওহ শিট!”

এবার আমি জোরে জোরে হাসতে শুরু করলাম। আমার হাসি শুনে উনি জিজ্ঞেস করলেন, “হাসছো কেন?”

“চোর ধরা পড়ে আবার জিজ্ঞেস করছে, আমাকে ধরা হয়েছে কেন?”

“আমি চোর?”

হাসি থামিয়ে, “নাহ, একদম নয়। আপনি তো হলেন ডাকাত।”

কপট রাগ দেখিয়ে, “আমি ডাকাত?”

“জানি না, ভাইয়া। তবে বোকা তো অবশ্যই। কী সুন্দর করে আপনার চালাকি ধরে ফেললাম, তাই না?”

“বুঝলে কী করে আমি মিরাজ নই, রাজ?”

“অনেক আগে আপনার একটা আইডি ছিল মিরাজ নামে। সেটা মনে পড়তে এই আইডি দেখে খটকা লাগলেও ভাবলাম হয়ত আমার ভুল হচ্ছে। কিন্তু আপনার আমার সম্পর্কে করা ধারণা থেকে আমার মনে সন্দেহ শুরু হতে থাকে। আমার হাতের ব্যথার কথা মা আর পেইজে ছাড়া কাউকে বলিনি অথচ সেদিন সকালে আমার খোঁজ নিলেন। এতে আমার সন্দেহ আরও বাড়ালো। আমার পছন্দের গানের কথা আমি আপনাকে ছাড়া কাউকে বলিনি তাহলে এটা অচেনা কবি কী করে জানলো?”

“এতেই বুঝে গেলে?”

“নাহ, যেদিন চোখে কাজল পড়লাম তার পরেরদিন কাজল আর চোখ নিয়ে কথা বললেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো শেষ যে আট লাইনের কবিতা আমাকে পাঠিয়েছেন নিজের নাম করে, সেটা আমার লেখা।”

অবাক হয়ে, “তোমার লেখা?”

“জ্বী, এটা আমি অনেক আগে স্পৃহার জন্য লিখেছিলাম কিন্তু আপনি চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন।”

“ইয়ে মানে…”

“থাক আর মানে মানে করতে হবে না।”

“আসলে এখন অবধি তোমাকে যা পাঠিয়েছিলাম সেগুলোর একটাও আমার লেখা নয়।”

“জানি, কারণ আপনার মতো অকর্মণ্য এসব বাংলা সাহিত্য বুঝবে না।”

আমার কথা শুনে জোরেশোরে হেসে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, “তাই?”

“হ্যাঁ, তাই। কিন্তু আপনি হঠাৎ এতসব করতে গেলেন কেন?”

“রাগ থেকে কখন অনুরাগ হলো টের পাইনি। তাই সারাজীবন কারো কাব্যে ডুবে থাকার আশায়, কারো সাথে ঘুম জড়ানো সকালে এককাপ চায়ের স্বাদ নেওয়ার আশায়, কারোর মিষ্টি অভিমানে নিজের অস্তিত্ব খোঁজার আশায় কিছু বৃথা চেষ্টা করেছিলাম।” আবার সেই শীতল কন্ঠে মিষ্টি বচন ভেসে এলো আমার কানে। মৃদু হাওয়াটা আজ বড্ড জোরে বইছে। তাই তো হৃদয় খুব করে ধুকপুক করছে আর লজ্জায় কান গরম হচ্ছে। নিজেকে সামলানো দায় হয়ে পড়েছে আমার জন্য। মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছি না কেবল লজ্জা নামক জালে আঁটকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি।

মিনিট দুয়েক বাদেও যখন মুখ নড়ছে আমার, তখন শীতল কন্ঠে ডাকলেন আমায়, “ঐ, কিছু বলছো না কেন?”

লজ্জায় ধরে আসা গলায় কোনোমতে বললাম, “আমি এখন রাখছি ভাইয়া।”

“খবরদার, একদম পালানোর চেষ্টা করবে না। বারবার এমন সুযোগ আসবে না। তাই আজকেই আমি সব কথা বলতে এবং শুনতে চাই।”

“কিন্তু আমার তো কিছু বলার নেই।”

“তাহলে কি চিঠির ঐ শব্দগুলো মিথ্যা, চিঠিতে ভাসিয়ে তোলা অনুভূতিগুলো ভিত্তিহীন?”

এবারও আমি শব্দহীন হয়ে পড়লাম। উনাকে দেওয়ার মতো কোনো উত্তর নেই আমার কাছে। ধীরে ধীরে ভাইয়া বললেন, “নীরবতা কিন্তু সম্মতির লক্ষণ। তাহলে কি আমি ধরে নিবো সবকিছু মিথ্যা?”

“নাহ।” আঁতকে উঠে বললাম।

“কী নাহ?”

শুকনো একটা ঢোক গিলে বললাম, “বাবা মা’র অমতে আমি কিছু করতে চাই না আর অনিশ্চিত কোনো কিছুর মধ্যে নিজেকে জড়াতেও চাই না।”

দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে, “হুম, বুঝলাম কিন্তু সবাই যদি রাজি থাকে তখন?”

“জানি না।”

মৃদু হেসে উনি বললেন, “যা করার সব পরিবারকে জানিয়ে করব ইন শা আল্লাহ। তুমি শুধু আমায় কথা দাও আমায় নিয়ে কাব্য লিখবে। তোমার কাব্যে আমায় একটুখানি জায়গা দিবে।”

শান্ত গলায় আমি জবাব দিলাম, “একটুখানি নয়, পুরো কাব্যে আপনাকে স্থান দিতে চাই। অচেনা কবি নামক আস্ত একটা কাব্য আপনাকে নিবেদন করতে চাই।”

“কিন্তু আমি তো কোনো কবি নই মিস কাব্যু।”

“তাতে কি? আমার কাছে না হয় চিরকাল থাকবেন হয়ে, আমার অচেনা কবি।”

উচ্চৈঃস্বরে হেসে নিজের মনকে শান্ত করলেন উনি। তারপর ধীরে ধীরে আবৃত্তি করতে লাগলেন আমার লেখা সেই কাব্য, অচেনা কবি। উনার আবৃত্তিতে মননিবেশ করে হারালাম আমি উনার মাঝে,

“মনের চোখে
তোমাকে দেখে,
এঁকেছি আমি
তোমার-ই ছবি।

তোমাকে নিয়ে
কবিতা লিখে,
হতে চাই তোমার
অচেনা কবি।”

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here