#অতঃপর_দুজনে_একা,সূচনা পর্ব
লাবিবা ওয়াহিদ
০১.
–“আপনি আমার ফিয়ন্সের ফ্রেন্ড না? আমার রুমে কী করছেন আপনি?”
মাহবিন চমকে পিছে ফিরে তাকায়। আয়ন্তী বিষ্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে মাহবিনের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহবিন ভ্রু-দ্বয় কুচকে বলে,
–“তোমার রুম মানে? ইউ মিন, এটা তোমার রুম?”
আয়ন্তি ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। মাহবিন দুই আঙুল কপালে ঘঁষে চোখ-মুখ অত্যন্ত কুচকালো! নিশ্চয়ই ইচ্ছা করে আসেনি মাহবিন? আয়ন্তি খেয়াল করলো মাহবিনের হাতের পাশে থাকা ছোট সাইজের লাগেজটাকে। আয়ন্তি কিছু একটা সন্দেহ করে বললো,
–“আপনাকে কোন রুমে থাকতে দেয়া হয়েছে?”
–“কনফিউজড। বললো দো’তলার শেষ মাথার কোনো একটি রুম! আমি এই রুমটা খোলা পেয়ে এটাতেই ঢুকেছি।”
আয়ন্তি নিজেও বিরক্ত হলো। মেহমানদারিতে এত গাফলতি কিসের কাজের মেয়েটার? কী একটা বিব্রতকর অবস্থা। আয়ন্তি বেশ নম্রতার স্বরে বললো,
–“আমার সাথে আসুন।”
বলেই হাতের সরবতের গ্লাসটি সহ আয়ন্তি নিজের রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মাহবিনও একবার আয়ন্তির রুমটি পর্যবেক্ষণ করে আয়ন্তির পিছু নিলো। আয়ন্তি মাহবিনকে তার রুমের পাশের রুমটি খুলে দিলো। আয়ন্তি রুমের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“এটা আপনার রুম!”
মাহবিন রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
–“থ্যাংকস! অলসো, সরি!”
আয়ন্তি চমকালো। পিটপিট করে মাহবিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“কেন?”
–“ভুল করে তোমার রুমে ঢুকে তোমায় বিব্রত করলাম!”
মাহবিনের এরূপ আচরণে আয়ন্তি মুগ্ধ হলো। অনিমেষ মাহবিনের পানে তাকিয়ে আলতো হাসি দিলো। অতঃপর হাসি-মুখেই বললো,
–“সমস্যা নেই। এখানে আপনার কোনো ভুল নেই। সরবরতটি নিন, আপনার জন্য!”
মাহবিন সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে আয়ন্তির হাত থেকে গ্লাসটি নিয়ে নিলো। তবে এখানে এক অপ্রস্তুত ঘটনা ঘটলো। মাহবিনের দুই আঙুল আয়ন্তির আঙুলকে স্পর্শ করলো। যা রীতিমতো আয়ন্তীকে প্রচন্ড রকম কাঁপিয়ে তুললো। মাহবিনকে এমতাবস্থায় বিব্রত দেখালো না। হয়তো বিষয়টাকে মাহবিন স্বাভাবিক নিয়েছে। আয়ন্তি এবার এক মুহূর্তও দাঁড়াতে চায় না। উল্টো দিকে ঘুরে ফিরে আসতে নিলেই মাহবিনের কন্ঠস্বর শুনতে পেলো।
–“ওয়াসিফ’রা আসছে। জ্যামে আটকে ছিলো, তবে এখন দ্রুত-ই চলে আসবে। মেবি তোমাদের এঙ্গেজমেন্ট হয়ে যাবে!”
মাহবিনের দেয়া আপডেটে আয়ন্তির ভেতরটা মুঁচড়ে ওঠে, প্রখরভাবে। এতক্ষণের সকল খুশি যেন এক নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। কী এমন পাপ হতো, যদি ওয়াসিফের জায়গায় মাহবিন থাকলে? কেন জীবনটা তার সাথে এভাবে খেললো।
বিকালের দিকে ওয়াসিফ’রা পৌঁছালো। ঘন্টাখানেকের মধ্যে আয়ন্তী এবং ওয়াসিফের বিয়ের কথাবার্তাও পাকাপাকি হয়ে গেলো। ওয়াসিফ এক সময় আয়ন্তীর সাথে কিছুটা সময় কাটানোর প্রস্তাব করলো। রাজি হলো আয়ন্তীর বাবা মনিরুল আলম। আয়ন্তী বর্তমানে শাড়ি পরে প্যাকেট হয়ে আছে। আয়ন্তীর মা আয়েশা একপ্রকার জোর করেই শাড়িটা পড়াতে বাধ্য করেছে। নয়তো আয়ন্তির বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলো না ওয়াসিফের জন্যে শাড়ি পরার। ওয়াসিফ তো এসেই একটু পর পর আয়ন্তিকে গিলছে। যা আয়ন্তি বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে সক্ষম।
আয়ন্তি ওয়াসিফের সাথে একপ্রকার বাধ্য হয়েই ছাদে আসলো। রুমে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। রুমটা আয়ন্তি ইচ্ছাকৃত এলোমেলো করে রেখেছে। ছাদে আসতেই আয়ন্তি চমকালো। মাহবিন ছাদের এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। ওয়াসিফ মাহবিনকে দেখে ভ্রু কুচকালো।
–“তুই এখানে?”
মাহবিন ফোন কানে দিয়েই পিছে ফিরে তাকালো। দু’জনকে একসাথে ছাদে দেখে মাহবিন চমকালো বেশ। কী মনে করে ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটাকে বললো,
–“কল হোল্ড করুন প্লিজ!”
বলেই বক্ষে ফোনটা চেপে বললো,
–“ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলছি। এছাড়া তুই আমাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলে দেরী করে আসলি কেন? তোর খবর আমি পরে করছি!”
বলেই মাহবিন পুণরায় ফোন কানে দিয়ে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পরলো। ওয়াসিফ মাহবিনকে গুরুত্ব না দিয়ে আয়ন্তির কোমড় স্পর্শ করে সামনে এগোতে নিলেই আয়ন্তি বিদ্যুতের গতিতে দূরে সরে গেলো। চোখ বড়ো করে ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–“এসব কী?”
–“কোন সব?”
–“আমায় স্পর্শ করলেন কোন সাহসে?”
ওয়াসিফ হাসলো। যেন আয়ন্তি তাকে বড়ো কোনো কৌতুক শোনালো। হাসতে হাসতে শুধায়,
–“তুমি আমার ফিয়ন্সে। এটা তো সামান্য ব্যাপার। আমার তো ইচ্ছে করছে তোমায় কি’স করি। বে~বি, আই লাভ ইউ সো মাচ!”
বলেই কামুক দৃষ্টিতে আয়ন্তিকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। ওদিকে আয়ন্তির চোখ জোড়া যেন কোটর হতে বেরিয়ে আসার উপক্রম। কীসব যা-তা বলছে এই ছেলে? আয়ন্তী চোখ পাকিয়ে বলে,
–“মাথা ঠিক আছে আপনার? এসব আপনি কী বলছেন? বিয়ে ঠিক হয়েছে, বিয়ে হয়ে যায়নি আমাদের। এছাড়া আপনি, আমি দু’জন সম্পূর্ণ অচেনা ব্যক্তি। পরিচিত হবার বদলে আপনি কাছে আসছেন?”
ওয়াসিফকে সামান্য বিরক্ত দেখালো। বিরক্তির সাথে বললো,
–“সো হোয়াট! পরিচিত হইনি, হয়ে যাবো। তাই বলে তুমি আমাকে রিজেক্ট করছো কেন? আমার কোনো গার্লফ্রেন্ডকে কি’সের কথা বলতে হয়নি, আর তোমাকে আমার সব বলা লাগবে কেন?”
গা ঘিনঘিন করে উঠলো আয়ন্তির। সাথে একরাশ লজ্জাও তাকে ঘিরে ধরলো। তার ভালো লাগার মানুষটার সামনে এভাবে এই ছেলেটা বলে যাচ্ছে? আয়ন্তির ইচ্ছা করছে ঠা’স করে শক্ত একটি চ’ড় বসিয়ে দিতে। আয়ন্তি নাক-মুখ অসম্ভব কুচকে বললো,
–“আমি আপনার ওসব গার্লফ্রেন্ড নই। লজ্জা করছে না নিজের ফিয়ন্সের সামনে এসব বলছেন আবার নিষিদ্ধ জিনিস চাইছেন? আই রিপিট, আমি আপনার বিয়ে করা বউ নই। আর এটাও পশ্চিমা দেশ নয়, বাংলাদেশ। এখানে আমি যথেষ্ট শালীনতার সাথে চলি!”
–“শাট আপ আয়ন্তি! আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। নাও আমি তোমার ফিয়ন্সে! চাইলেই আমরা প্রাইভেট টাইম লীড করতে পারি। সো, তোমার ননসেন্স কথাবার্তা তোমার কাছেই রাখো! উড বি এর কাছে কিসের শালীনতা? এসব পাপ’ও না ওকে?”
ওয়াসিফের চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি। আয়ন্তি ছলছল নয়নে একবার ওয়াসিফের দিকে তো একবার ওয়াসিফের থেকে দূরে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখছে। মানুষটা সম্পর্কে ওয়াসিফের বন্ধু হয়। নাম তার মাহবিন। সে ভ্রুক্ষেপহীন হয়ে ছাদের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। কানে তার ফোন। আয়ন্তি পুণরায় ওয়াসিফের দিকে তাকালো।অতঃপর নরম গলায় বললো,
–“আপনি বোঝার চেষ্টা করুন। আপনার আগের অতীতও ঠিক নেই, সাথে আপনি নিজেও। আগে বাংলা সংস্কৃতি সম্পর্কে জানুন, তওবা করে ফিরুন তারপর আমি আপনাকে বিয়ে করব, এর আগে না।”
আয়ন্তির কথা গলায় আটকে আসছে। পুণরায় বিব্রত হয়ে কিছু বলতে নিলেই খেয়াল করলো ওয়াসিফ তার দিকে কেমন কামুক নজরে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে। চেহারা-ভঙ্গি এমন যেন আয়ন্তির কোনো কথা কান অবধি পৌঁছায়নি। আয়ন্তির সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো আতঙ্কে। অস্ফুট স্বরে চেঁচালো আয়ন্তি।
–“মাহবিন ভাই!”
মাহবিন কান থেকে ফোন নামিয়ে চমকে পিছে ফিরে তাকালো। আতঙ্ক মিশ্রিত কন্ঠস্বর শুনে একটু অপ্রস্তুত-ও হয়েছে বটে। ওয়াসিফ থেমে যায় পুণরায়। আয়ন্তির ভীত মুখখানা তাকে আরও দ্বিগুণ বিরক্ত করে তুললো। এক সময় মাহবিনের কাছে চলে গেলো। আয়ন্তি সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। নিরবে। ওয়াসিফ রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বারংবার বলছে,
–“ড্যাম, ড্যাম, ড্যাম ইট!”
মাহবিন ঘাড় বাঁকিয়ে আয়ন্তির দিকে দৃষ্টি ঘুরালো পুণরায়। ছাদের কর্ণারে থাকা বাল্বের আবছা আলোয় অস্পষ্ট আয়ন্তির ক্রন্দনরত মুখশ্রী দৃশ্যমান। মাহবিন পরিবেশ স্বাভাবিক করতে আয়ন্তির উদ্দেশ্যে হাঁক ছেড়ে বলে,
–“ঠান্ডা বাড়ছে। তুমি নিচে চলে যাও!”
আয়ন্তি একদমই দাঁড়ায় না। দ্রুত ছুটে চলে যায় ছাদের চৌকাঠের দিকে। আয়ন্তি চলে যেতেই মাহবিন থমথমে গলায় বলে,
–“এটা বিডি, কানাডা না। রা’বি’শ!”
ওয়াসিফ মাহবিনের কথা শুনলো, কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। সবকিছু-ই আপাতত তার বিরক্ত লাগছে।
আয়ন্তি নিজ রুমে দরজা আটকে কাঁদছে। কান্নার বেগ ক্রমাগত বাড়ছেই। থামার নামগন্ধ নেই। কেন আল্লাহ তার এত বড়ো পরীক্ষা নিচ্ছেন? একদিক দিয়ে বাবা আরেক দিক দিয়ে তার অশান্ত, অবিশ্রান্ত হৃদয়। কাকে শুনবে? যেদিন পাত্রপক্ষ অর্থাৎ ওয়াসিফ তাকে প্রথম দেখতে এসেছিলো, আয়ন্তি প্রথমদিনই ভেবেছিলো পাত্র মাহবিন, ওয়াসিফ নয়। বলাবাহুল্য মাহবিনকেই ওয়াসিফ ভেবেছিলো। দু’জন পাশাপাশি বসায় আয়ন্তি পাত্র ধরতে পারেনি। এছাড়া পূর্বে ওয়াসিফের ছবিও দেখা হয়নি কখনো। তাই প্রথম দেখাতে-ই মাহবিনের প্রতি তার ভালো লাগাটা এসেছিলো, তাও গাঢ়। কিন্তু যখন পরবর্তীতে শুনে ওয়াসিফ মাহবিন নয় তখন থেকেই আয়ন্তির ভেতরটা ভিষণ ভার হয়ে আছে। ওয়াসিফকে কেন যেন মানতেই পারছে না। একটা মেয়ের পক্ষে কীভাবে সম্ভব, মনে একজনকে স্থান দিয়ে আরেক পুরুষকে বিয়ে করা? অন্তত আয়ন্তির জন্যে এটা কঠিন ব্যাপার। বাবাকে বলতে চেয়েছিলো সবটা, কিন্তু বাবা মনিরুল আলম আগেই বলে দিয়েছে, তার পছন্দ-ই যেন আয়ন্তির হয়। ওয়াসিফ কানাডায় পড়াশোনা করে সেখানেই ভালো একটা কোম্পানিতে জব করছে। এমতাবস্থায় মনিরুল আলম কিছুতেই এই পাত্র হাতছাড়া করবেন না। কাল-পরশু হয়তো ওদের এঙ্গেজমেন্ট হয়ে যাবে।
আয়ন্তির খালাতো বোন গুলা একটু পরপর দরজায় কড়াঘাত করে যাচ্ছে। কাজিন’রা এসেছে গতকাল-ই। আয়ন্তি মুখে হাত চেপে কাঁদছে। শব্দ বহিঃপ্রকাশ হলে সমস্যা হতে পারে। অনেকক্ষণ কাঁদলো আয়ন্তি। এখন চোখের জল ফুরিয়ে এসেছে। চোখ জ্বালা করছে। নাকটাও ক্ষণে ক্ষণে টেনে উঠছে আয়ন্তি। আর বসে থাকলো না। মনিরুলের কানে গেলে চিন্তিত হয়ে পরবেন। তাই আয়ন্তি সময় নিয়ে ওয়াশরুমে মুখ ধুলো। চোখ-মুখ অসম্ভব লাল। আয়ন্তি ওয়াশরুম থেকে বের হতেই শুনলো মনিরুল আলমের কন্ঠস্বর এবং কড়াঘাত।
–“আয়ন্তি মা? কী হলো! সাড়া দিচ্ছো না কেন? কথা বলো। দরজা খুলো। বাবা চিন্তিত যে!”
আয়ন্তি দ্রুত মুখে পাউডার মেখে গায়ে শালটা জড়ালো। অতঃপর নিজেকে সামলে ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। মনিরুল আলম চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। আয়ন্তিকে সুস্থ-সবল পেতেই আবডালে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আয়ন্তি কন্ঠস্বর যথেষ্ট স্বাভাবিক করে বলে,
–“কিছু বলবে বাবা?”
নির্বিকার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মেয়ের পানে মনিরুল। কেমন লাল হয়ে আছে চেহারা। চোখ লাল হয়ে ফুলে আছে। মনিরুলের বুঝতে বাকি নেই কিছু!
–“কাঁদছিলে তুমি মা?”
আয়ন্তি জবাবহীন। প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলে,
–“আম্মু কোথায়?”
–“আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি মা!”
মনিরুলের কন্ঠে স্পষ্ট কাঠিন্য! আয়ন্তি কিছুটা ঘাবড়ালো। পরমুহূর্তে কিছুক্ষণ চুপসে রইলো। আমতা আমতা করে শুধায়,
–“আমি এই বিয়ে করতে পারবো না বাবা!”
–“কেন? ওয়াসিফে কী সমস্যা? ছেলে ভালো, ভালো পজিশন আছে। ইভেন বিয়ের পর তুইও যে কানাডায় সেটেল হয়ে যাবি। তাহলে অমতের প্রশ্ন আসে কেন?”
“ছেলে ভালো”! শব্দটি শুনে আয়ন্তি তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। যেই ছেলে বিয়ের আগে প্রাইভেট স্পেস চায় সে আবার কিসের ভালো ছেলে? হোক সে কানাডায় বড়ো হওয়া ছেলে। বাঙালি মেয়েকে বিয়ে করার আগে তার একবার নয় বরং দশবার ভাবা উচিত ছিলো। বাঙালি মেয়েদের আত্মসম্মান এবং সতীত্ব দুটোই তাদের জীবন। সে যদি এরকম বিয়ের আগে স্পেস চায় তাহলে কী দরকার এখানে বিয়ে করার? সে ওরকম মেয়ে খুঁজে বিয়ে করে নিক।
–” কী হলো মা? উত্তর দিলে না যে?”
–“আমি বিয়েটা করবো না বাবা, প্লিজ। ওয়াসিফকে তুমি যত ভালো ভাবছো তত ভালো সে নয়!”
এবার মনিরুলের চোখে-মুখে ক্রোধ প্রকাশ পেলো। হয়তো ভেবে নিয়েছে মেয়ে কারো সাথে সম্পর্কে জড়িত। ওয়াসিফকে সে যথেষ্ট চিনে। বলাবাহুল্য ওয়াসিফের আচরণে মুগ্ধ হয়ে মাথায় চড়িয়ে ফেলেছে। তাই আপাতত ওয়াসিফের ব’দনাম সে নিতে পারছে না। মনিরুল স্পষ্ট ভঙ্গিতে কাঠ কাঠ গলায় বললো,
–“আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা-ই হবে। যদি তোমার অন্য কোথাও সম্পর্ক থেকে থাকে তাহলে বলছি সময় থাকতে নিজেকে শুধরে নাও। বাবা-মায়েরা কখনোই সন্তানের অকল্যাণ চায় না!”
বলেই হনহন করে চলে গেলো মনিরুল। এদিকে আয়ন্তি মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রয়। সে স্তব্ধ, বিমূঢ়। তার বাবা তাকে এরকম অবিশ্বাস করলো? কিছুক্ষণের মাঝে আয়ন্তির মা আয়েশা আসলো আয়ন্তির নিকট। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
–“কী রে? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মুনিয়ারা সবাই নিচে। চল। ডিনার করবি!”
ব্যস্ত পায়ে আয়েশা চলে গেলো। আয়ন্তি তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে নিচের দিকে চলে গেলো। নিচে আসতেই দেখলো ওয়াসিফের পরিবার, মাহবিনসহ আয়ন্তির বোনগুলাও খাবার টেবিলে বসে আছে। ওয়াসিফের ডান পাশের চেয়ারটাতে আয়ন্তির কাজিন জয়া এবং বামপাশে মাহবিন বসেছে। মাহবিনের অপজিটেই একটা সিট খালি। সবেই সেই সিট হতে ওয়াসিফের মা খেয়ে উঠেছেন। আয়ন্তি সেই চেয়ারে গিয়ে-ই বসলো। ওয়াসিফ একপলক আয়ন্তির দিকে তাকিয়ে নজর ঘুরিয়ে নেয়। আয়ন্তি এক পলকের জন্যেও ওয়াসিফের দিকে তাকালো না। বড়ো’রা উঠে যেতেই কাজিন’রা মিলে কথাবার্তা, ঠাট্টা, মশকরা করে যাচ্ছে। ঠাট্টা-মশকরার কেন্দ্রবিন্দু ওয়াসিফ এবং আয়ন্তি। আয়ন্তি কোণা চোখে বারংবার মাহবিনকে দেখছে। মাহবিনের মাঝেমধ্যে আয়ন্তির দিকে নজর পরলে আবার তা সরিয়ে নেয়। মুনিয়া হঠাৎ বলে ওঠে,
–“আমাদের দুলাভাইয়ের কত তাড়া দেখেছিস? কাল-পরশুর মধ্যেই আমাদের আয়ন্তিকে রিং পরাবে। এখন কথা হলো, আমাদের যে এত এত শপিং এবং প্রিপারেশন নেয়ার বাকি, তা আমরা কবে নিবো শুনি? এখন তো মনে হচ্ছে ঘুম বাদ দিয়ে সব প্রস্তুতি নেয়া লাগবে!”
ওয়াসিফ হাসলো। ওয়াসিফও টুকটাক কথা বললো। ওয়াসিফের বাংলা কথায় বোঝা যায়, সে বাংলায় দুর্বল। এর মাঝে আয়ন্তির আরেক বোন তানজিলা বলে ওঠে,
–“আচ্ছা, মাহবিন ভাইয়া কী সবসময় এমন চুপচাপ-ই থাকে!”
মাহবিন খাওয়া বন্ধ করে শীতল চাহনি নিক্ষেপ করলো তানজিলার পানে। মাহবিনের নামটা শুনতেই আয়ন্তির হৃদপিন্ড ধক শব্দ করে উঠলো। অস্পষ্ট ঢিপঢিপ শব্দও শ্রবণ হচ্ছে। ঝোলে ভাত মাখানো হাতটি নিজের অজান্তেই থেমে যায় আয়ন্তির। কান খাড়া হয় মাহবিন সম্পর্কে কিছু শোনার লোভে৷ মাহবিন সম্পর্কে আয়ন্তি কিছুই জানে না বলা চলে। ওয়াসিফ ঘাড় বাঁকিয়ে মাহবিনের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে,
–“আমার বন্ধুটা কিছুটা গম্ভীর, কথা কম বলে। এটা ওর সবসময়ের স্বভাব। এই ইউজলেসটা কী করে যে আমার বেস্টফ্রেন্ড হলো বুঝতেই পারি না। কানাডাতে থাকলেও এর সাথে দিনে দু’বার কথা না বলে থাকতেই পারি না।”
মাহবিন এবারও কিছু বললো না, শুধু সৌজন্যমূলক হাসি দিলো। তানজিলা হাসতে হাসতে বলে,
–“তাহলে আজ মাহবিন ভাইয়ার থেকে শুনবো, তা ভাইয়া আপনার ইন্ট্রোডাকশন দিন। আমি স্পিকার অন করছি, অদৃশ্য মাইকটাও আপনার সামনে রাখা হলো!”
মাহবিন অধর প্রসারিত করে বলে,
–“মাইকটা অদৃশ্য হলে আমার ইন্ট্রোডাকশনও হাওয়াতে ছেড়ে দিলাম। আমি বিজনেসম্যান!”
–“ওয়াও! আপনার বাড়িতে কে কে আছে?”
–“কেউ নেই তো!”
সকলে স্তব্ধ। মাহবিনের মুখশ্রীতে তখনো বাঁকা হাসি। আঁখিপল্লবে একরাশ গাম্ভীর্য। ওয়াসিফ পানি খেতে নিয়েছিলো, মাহবিনের এরূপ উত্তরে পানি মাথায় উঠে গেলো। যার ফলস্বরূপ ওয়াসিফ কাশতে লাগলো। কাশতে কাশতে বললো,
–“শা**! আন্টি আঙ্কেল থাকতেও বলছিস কেন কেউ নেই?”
মাহবিন নিরুত্তর। কারো কথা কানে না নিয়ে এবার খেতে মনোযোগ দিলো। আয়ন্তি পুরোই হতবিহ্বল মাহবিনের কর্মকান্ডে। মাহবিনের চুপ হয়ে যাওয়া নিয়ে কেউ আর প্রশ্ন করলো না। যেহেতু মাহবিন নিজ থেকে কিছু বলতে চাইছে না সেহেতু তাকে ঘেটে কী লাভ? কিছুক্ষণ চললো নিরবতা। প্রগাঢ় নিরবতা। একসময় জয়া হুট করে বলে ওঠে,
–“ওয়াসিফ, তুমি তো কানাডায় বড়ো হয়েছে। তাহলে মাহবিন কী করে তোমার বেস্টফ্রেন্ড হয়?”
জয়া আয়ন্তির থেকে বছর চারেক বড়ো। ওয়াসিফ এক লোকমা পোলাও মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে বললো,
–“মাহবিন আমেরিকা থেকেই পড়াশোনা করেছে। তবে মাহবিন বিডিতে ফিরে আসে আর আমি সেখানেই থেকে যাই। সিম্পল!”
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই সকলে উঠে গেলো। আয়ন্তি হাত ধুয়ে টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিলো তখনই ওয়াসিফ তার পথ আটকে দাঁড়ায়। আয়ন্তি বিরক্তি দমিয়ে ওয়াসিফের দিকে তাকায়। ওয়াসিফ আয়ন্তির দিকে অনিমেষ তাকিয়ে মৃদু স্বরে আওড়ায়,
–“একটু তো সময় দিতে পারো আমায়। দু’মাস তো থাকবো না। প্রাইভেট টাইম স্পেন্ড করলে কী সমস্যা হয় বলো তো?”
আয়ন্তির রাগ হলো এবার, ভিষণ রাগ। আয়ন্তি আশেপাশে নজর বুলালো। আয়ন্তির মা এবং ওয়াসিফের মা রান্নাঘরে। লিভিংরুমে আয়ন্তির বাবা এবং ওয়াসিফের বাবা আড্ডা দিচ্ছেন। আজ ওয়াসিফের পরিবার তাদের বাড়িতেই থাকবে। এঙ্গেজমেন্ট পর্যন্ত তাদের আনাগোণা থাকবে। এঙ্গেজমেন্টের পর নাকি ওয়াসিফ কানাডা ব্যাক করবে। দুই মাস পর এসে তাদের বিয়ে হবে, এমনটাই প্রস্তাব করেছেন ওয়াসিফের বাবা। আয়ন্তি বেশ কাঠ কাঠ গলায় বলে,
–“এটা কানাডা নয়, বাংলাদেশ। এখানে আপনার চাওয়া সব বিয়ের পরে। বাংলাদেশের কালচার এবং এদেশের মেয়েদের পশ্চিমা দেশের সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না!”
ওয়াসিফকে শান্ত মুখশ্রী হঠাৎ বেশ রাগাম্বিত দেখালো। ওয়াসিফ কিছুক্ষণ কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মিনমিন করে বলে,
–“আসলেই, তুমি সদ্য ক্ষেত থেকে উঠে আসা মেয়ে। তুমি বুঝোই না, লাভ সাইটের মানে। ইডিয়েট!”
ওয়াসিফ এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। ছুটে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়। আয়ন্তি তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। নিজের মায়ের এবং ধর্মের শিক্ষা মানলে যদি সে ক্ষেত হয়, তাহলে হ্যাঁ। সে ক্ষেত! এতে আয়ন্তির বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। মোটকথা, ওয়াসিফের কোনো কথাই সে গায়ে মাখবে না। তবে আয়ন্তি ভেবে পাচ্ছে না, যেই ছেলে বিয়ের আগে এমন ব্যবহার করছে সেই ছেলের ব্যবহার বিয়ের পর কীরকম হতে পারে? বুঝে এলো না আয়ন্তির। তবে সে ক্লান্ত। ওয়াসিফকে নিয়ে ভেবে, ভেবে ক্লান্ত। ভিষণ ক্লান্ত। দেহটা নরম বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দেয়ার আকুল আবেদন জানাচ্ছে। আয়ন্তি হাই তুলতে তুলতে উপরে চলে গেলো। আয়ন্তি আগেই ওর কাজিনদের বলে দিয়েছে, আজ আয়ন্তি ঘুমাবে। রাত জেগে কোনো আড্ডা আজ হবে না। তাইতো ওরা আগে-ভাগেই নিজেদের রুমে চলে যায়। আয়ন্তির কাজিন এসেছে মোট পাঁচজন।
আয়ন্তি করিডোর পার করে আসতেই পুরুষালি নরম কন্ঠস্বরে শুনতে পেলো। মুহূর্তে-ই দমে যায় আয়ন্তির পা জোড়া। ভুল শুনেছে? হয়তো। মাহবিন কই থেকে আসবে? আর কেন-ই বা আয়ন্তিকে ডাকতে যাবে? আয়ন্তি মনের ভুল ভেবে পুণরায় পা চালায়।
–“আয়ন্তি!”
~~চলবে, ইনশাল্লাহ।