অতঃপর_দুজনে_একা -০৮,০৯

0
676

#অতঃপর_দুজনে_একা -০৮,০৯
লাবিবা ওয়াহিদ

——————————-
ভার্সিটির উদ্দেশ্যে আয়ন্তি এবং নীলা একসাথে বের হয়। নিচে নামতেই আয়ন্তি দেখতে পায় গতকালের সেই দারোয়ানকে। আয়ন্তি হঠাৎ দমে গেলো। নীলা পিছে ফিরে আয়ন্তির দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে,
–“দাঁড়িয়ে গেলি কেন? চল। লেট হচ্ছে তো।”
–“তুই রিকশা খুঁজ। আমি একটু আসছি।”
–“একসাথে গেলে প্রব্লেম কী?”
–“আরে ভাই, বললাম তো। তুই আগে আগে যা, আমি পিছে পিছে আসছি।”

নীলা কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। নীলা চলে যেতেই আয়ন্তি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো এবং দারোয়ানের দিকে তাকালো। দারোয়ান এখনো আয়ন্তিকে খেয়াল করেনি অবশ্য। আয়ন্তি সময় বিলম্ব না করে দারোয়ানের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। মধ্যবয়সী দারোয়ান হকচকালো। আয়ন্তি ভ্রু কুচকে দারোয়ানকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। দারোয়ান আয়ন্তিকে এড়িয়ে যেতে চাইলে আয়ন্তি তার পথ আটকালো।
–“আমার কিছু জানার ছিলো আপনার থেকে।”
–“কী জানার আছে?”
–“গতকালের প্যাকেট গুলো আপনাকে কে দিয়ে গেছে?”

আয়ন্তির করা প্রশ্নে দারোয়ানকে ভীষণ বিরক্ত দেখালো। চোখ কুঁচকে বললো,
–“বললাম তো ডেলিভারি বয় দিয়েছে।”
–“ছেলেটা কে ছিলো?”
–“আমি চিনি না। কাঁধে বড়ো ফুড পান্ডার ব্যাগ ছিলো। খাবার দিয়ে গেছে। তুমি মেয়ে এসব অদ্ভুত প্রশ্ন করছো কেন? যারা খাবার ডেলিভারি দেয় তাদের নাম, ঠিকানা আমি পকেটে নিয়ে ঘুরি নাকি?”

আয়ন্তি আরও কিছু বলার পূর্বেই নীলার উচ্চস্বরের ডাক শ্রবণ হয়।
–“কী রে আয়ন্তি? রিকশা নিয়ে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো? দ্রুত আয়।”

আয়ন্তি দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে ম্লান স্বরে বলে,
–“দুঃখিত চাচা। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য।”
দারোয়ানের মন যেন গললো। নরম স্বরে বললো,
–“সাবধানে যাও।”

আয়ন্তি বাইরে এসে দেখে নীলা রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে। আয়ন্তিকে দেখতেই নীলা রিকশায় উঠে বসলো। আয়ন্তিও এক ছুটে গিয়ে রিকশায় উঠলো। রিকশা চলতে শুরু করলো। নীলা ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে করতে বললো,
–“তুই আরেকটু লেট করলে আমার আবার নতুন রিকশা খুঁজতে হতো।”

আয়ন্তি নীলার ফোনে উঁকি দিয়ে বলে,
–“কী করছিস?”
–“রিয়ন ভাইয়াকে কল দিচ্ছি। তোকে কলে পাচ্ছে না বলে আমায় কল দিচ্ছে বারবার। এখন জানিয়ে দিতে হবে তুই সহ আমরা ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিছি।”

আয়ন্তি কী মনে করে নিজের ফোন বের করলো। ফোন বের করে দেখে আটটা মিসড কল। আর সবচেয়ে বড়ো কথা ফোন সাইলেন্ট মুডে আছে, তাই আয়ন্তি শুনতে পায়নি। নীলা রিয়নকে কল দিতেই রিয়ন সাথে সাথে রিসিভ করলো। যেন মুঠোফোনটি হাতে নিয়েই বসে ছিলো। নীলা আয়ন্তির পানে তাকিয়ে বলে,
–“আমরা ভার্সিটি যাচ্ছি ভাইয়া। আপনি চিন্তা করবেন না।”
–“আয়ন্তি কই?”
–“আমার পাশেই।”
–“ফোনটা দে ওকে।”

নীলা ফোন এগিয়ে দিলো। আয়ন্তি তখন ভাবনায় মশগুল। কে পাঠালো তাকে খাবার? কী তার উদ্দেশ্য? সেই অপরিচিত মানুষটা কী তার পূর্ব পরিচিত? নীলা আয়ন্তিকে ঝাঁকালো। আয়ন্তির সম্বিৎ ফিরে পাশে তাকাতেই নীলা বললো,
–“কই হারালি? ফোনটা নে।”

আয়ন্তি বেসামাল ভঙ্গিতে নীলার ফোনটা হাতে নিয়ে কানে রাখলো।
–“ভাইয়া?”
–“কমনসেন্স নেই তোর? ফোন কই? কতবার কল দিয়েছি খেয়াল আছে?”
–“সরি, ফোন সাইলেন্ট ছিলো।”
–“খেয়েছিস।”
–“হ্যাঁ। তুমি?”
–“এখন খাবো।”
–“আচ্ছা। খেয়ে নাও।”
–“ভার্সিটিতে আসবো তোকে নিতে?”
–“এই না, না। তোমার না অফিস আছে?”
–“কিসের অফিস? আগামীকাল ইন্টারভিউ আছে। এখনো তো জয়েন হইনি।”
–“ও আচ্ছা।”

কেন যেন আয়ন্তি রিয়নের সাথে কথা বলতে পারছে না। তার বারংবার মনে পরছে সেই রাতের ঘটনা। নীলার বলা সেই কথাগুলো,
–“জানিস আয়ন্তি? তখন রিয়ন ভাই মাহবিন ভাইয়ের সাথে ঝামেলা করেছিলো।

মাহবিন ভাইকে অনেক কথা শুনিয়েছে রিয়ন ভাই। আমার তো মোটেও মাহবিন ভাইকে ওয়াসিফের মতোন লাগে না।”

–“কী হলো আয়ন্তি? কই হারালি?”
সম্বিৎ ফুরে আয়ন্তির। আয়ন্তি ঘনঘন পলক ফেলে রিয়নের উদ্দেশ্যে বলে,
–“কল রাখছি ভাইয়া। ভার্সিটি এসে পরেছি।”

বলেই আয়ন্তি কোনরকমে কল কাটলো। নীলা আয়ন্তির থেকে নিজের ফোন নিতে নিতে বলে,
–“রিয়ন ভাইকে মিথ্যে বললি কেন? ভার্সিটিতে পৌঁছাতে আরও পাঁচ মিনিট লাগবে।”

আয়ন্তি অন্যদিকে ফিরে বলে,
–“জানি না।”
–“মন খারাপ?”
–“কেন হবে?”
–“মনে হচ্ছে।”
–“ওরকম কিছু না। এমনি ভালো লাগছে না।”

আয়ন্তি আশেপাশে তাকাচ্ছে আর ব্যস্ত মানুষের মাঝে খুঁজে যাচ্ছে কাঙ্খিত সেই মুখ। যদি আল্লাহ মিলিয়ে দেয়। কিন্তু আয়ন্তির আশা পূরণ হলো না। মাহবিনকে খুঁজেই গেলো। পেলো আর না। ভার্সিটিতে এসে দ’জন দুই ক্লাসে চলে গেলো। আয়ন্তি এবং নীলা সমবয়সী। তার দুজনেই অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। তবে ওদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা।

———————-
বিকালের দিকে নীলা এবং আয়ন্তি বের হয় কিছু কেনাকাটা করতে। একটি নামি-দামি রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি আসতেই নীলা আয়ন্তিকে টেনে আড়ালে চলে গেলো। আয়ন্তি বিরক্তির সাথে বলে,
–“কী?”
–“চুপ। সামনে তাকা।”

আয়ন্তি উঁকি মেরে সামনে তাকালো। ওয়াসিফ এবং জয়া রেস্টুরেন্ট থেকে বের হচ্ছে। দু’জনে ভীষণ ঘনিষ্ঠ। ওয়াসিফ জয়ার গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
–“এসব আমি খেতে পারি না বেবি। আই নিড বিয়ার অর ইউ।”
–“কেন? আয়ন্তির বাসায় তো ঠিকই ভাত খেতে। তখন কেমনে খেতা?”
–“তখনকারটা বাদ। পাপা এন্ড মমের কাছে গেলেও আমার এসব গিলতে হয়। ইট’স টু মাচ! বাট ইউ নো, আই অলসো লাভ বিরিয়ানি। বিডিতে এলে এটা মাস্ট খাই আমি।”
–“হ্যাঁ। পাপা, মমের সাথে খেতা আবার আয়ন্তির কাছে গিয়েও খেতা। কত যে ভাব ছিলো তোমাদের।”
–“শাট আপ। শি ইজ মাই এক্স উড বি। ইউ আর মাই প্রেজেন্ট। আর তোমার ডিসগাস্টিং কাজিন তো টু মাচ বোর। টাচই করতে দিতো না। হার লিপস সো এট্রাক্টিভ।”

ওয়াসিফ কথাগুলো বলার সময় নীলাদের পাশ ঘেঁষে যাচ্ছিলো। ওয়াসিফের ন’ষ্টালজিক কথাবার্তায় আয়ন্তির গা ঘিনঘিন করে উঠলো। নীলার রাগ তো পৌঁছে যায় আসমানে। সে রেগে কিছু বলতে নিলেই আয়ন্তি পেছন থেকে ওর মুখ চেপে ধরে ফিসফিস করে বলে,
–“চুপ কর নীলা। তুই কিছু বলতে যাস না। যা ইচ্ছা বলুক এই থা’র্ডক্লাসটা।”

নীলা আয়ন্তির মুখ থেকে হাত সরিয়ে রাগে গজগজ করে বলে,
–“কত নিচ মানসিকতা এর। ছিহ! চাচ্চু তোর জন্যে এই ছেলে খুঁজেছে? ইচ্ছে তো করে এর মুখে গিয়ে থুঁ মে”রে আসি।”
–“আচ্ছা। থাম। চল বাসায় যাই, আজকে আর কেনাকাটার দরকার নেই।”
–“পাগল নাকি? ওদের পিছু নিবো আমি।”
–“পাগল তো তুই হয়ে গেছিস। কীসব যা-তা বলছিস? ওদের পিছু নিয়ে আমরা কী করবো।”
–“অনেককিছু।”
বলেই আয়ন্তির এক হাত টানতে টানতে ওদের পিছু যেতে লাগলো।

জয়া ওয়াসিফের কথা শুনে রেগে মাথা তুলে তাকালো। জয়া কাঠ কাঠ গলায় বলে ওঠে,
–“তুমি আমার সামনে ওকে এট্রাক্টিভ বলছো? তোমায় এত উপকার করলাম, তোমায় ভালোবাসলাম আর তুমি বারবার আয়ন্তিকে টানছো?”
–“উহু… বলায় ভুল করলে। আমি টানছি না বরং তুমি শুরু থেকেই টেনে এনেছো।”

জয়া নিজেকে ওয়াসিফের থেকে ছাড়িয়ে দ্রুত পায়ে চলে যেতে শুরু করলে ওয়াসিফ,
–“হেই বেবি। স্টপ!”

বলেই জয়ার পিছে ছুটে গিয়ে জয়াকে এক হাতে জড়িয়ে নিলো। জয়া নিজেকে মিথ্যে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,
–“ছাড়ো। যাও তুমি আয়ন্তির কাছে। যখন রিজেক্ট করবে, তাড়িয়ে দিবে তখন তো এই জয়ার কথা মনে পরবে।”
–“ও মাই এংগ্রি বার্ড। আই লাভ অনলি ইউ। চলো না, তোমার লিপস এর টেস্ট নেই।”

জয়া শোনার পাত্রী নয়।
–“ওসব পরে। তুমি বলেছিলে আমায় শপিং করাবে। চলো, আমায় শপিং এ নিয়ে যাও। ওইতো মল।”
ওয়াসিফ খুশিমনেই জয়াকে নিয়ে পাশে বড়ো মলটায় চলে গেলো।

–“ওই দেখ ওরা মলে যাচ্ছে। এবার তো চল।”
–“না। আরে দেখি না এদের কাহিনী, ভালোই লাগছে।”
–“বে”য়াদপ মেয়ে। আর কত ঘুরাবি আমায়?”
–“কেন গো সোনা? জ্বলছে বুঝি তোমার? পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি?”

নীলার করা ঠাট্টায় আয়ন্তি রেগে এক বিরাট গা”লি ছাড়লো নীলাকে। নীলা আয়ন্তির মুখ চেপে আশেপাশে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,
–“আরে আস্তে বল। মান-সম্মান খাবি নাকি?”
–“তো ওদের পিছে লাগছিস কেন তুই? একটু আগে তো রেখে আ’গুন হয়ে গেছিলি।”
–“ওয়াসিফের উপর তো আমার রাগ আছেই। চাইলেও প্রকাশ করতে পারি না। আমি শুধু দেখতে চাই জয়া আপু কতটা নিচে নামতে পারে। চল নয়তো ওদের হারিয়ে ফেলবো।”

পুণরায় আয়ন্তিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওয়াসিফ এবং জয়ার পিছু পিছু শপিংমলে ঢুকে পরলো। কয়েকটা দোকান ঘুরে শপিং করার পর একটি ড্রেসের শো-রুমে গিয়ে ওদের আর খুঁজে পেলো না। এই আউটলেটে কর্মী সংখ্যার চাইতে জায়গাটা অনেক বড়ো। নীলা ভুলবশত এক দোকানে দুল দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরেছিলো তাইতো ওয়াসিফদের সাথে ঢুকতে পারেনি। আয়ন্তি এদিক ওদিক তাকিয়ে নীলাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বলে,
–“এখানে হয়তো নেই। চল, চলে যাই। আমার এসব আর ভালো লাগছে না।”

নীলা আশেপাশে ঈগল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিরক্তি স্বরে ফিসফিস করে বলে,
–“আরেকটা কথা বললে সত্যি তোর খবর আছে। একটু চুপ থাকতে পারিস না? খুঁজতে দে, হারিয়ে ফেলেছি।”

বলেই ওরা একপাশ দিয়ে যাচ্ছিলো তখনই ওরা কিছু অদ্ভুত অস্বস্তিজনক শব্দ শুনতে পায়। দু’জনের চলমান পা জোড়া থমকে যায়। আয়ন্তি, নীলা একে অপরের দিকে বড়ো বড়ো চোখে চাওয়া-চাওয়ি করছে। আয়ন্তি ইশারায় বললো,
–“আয় চলে যাই।”

কিন্তু নীলা আয়ন্তিকে অগ্রাহ্য করে শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে কিছুটা এগোতেই দেখলো দুই জামা-কাপড়ের স্ট্যান্ডের মাঝে ওয়াসিফ এবং জয়া লিপস কিস করছে। তারই এক অপ্রস্তুত ভেঁজা শব্দ হচ্ছে। নীলা এবং আয়ন্তি দু’জন কাছাকাছি ছিলো দেখে এই অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেয়েছে। এদিকটা খুবই নিরব। আশেপাশে মানুষজন নেই। নীলাকে ওভাবে থমকে দাঁড়াতে দেখে আয়ন্তি এগিয়ে আসলো। নীলার দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই দেখলো এইসব ঘৃণ্য কাজ। আয়ন্তি বড়ো হা করে ফেললো। মুখে তার কম্পিত হাত। সে নিজেও এই ধরণের দৃশ্যের জন্যে প্রস্তুত ছিলো না। এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে আয়ন্তি চোখে হাত দিয়ে অন্যদিকে তাকালো। নীলা কী বুঝে ওদের ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের ছবি কৌশলে তুলে ফেললো। আয়ন্তি এক হাতে চোখ ঢেকে অন্য হাতে দ্রুত নীলাকে টেনে অন্যদিকে নিয়ে গেলো। ওয়াসিফের ঠোঁটের চাওয়া ততক্ষণে জয়ার গাল, গলায় গিয়ে মিশেছে। একের পর এক শব্দের সাথে পাগলের মতো অধর দ্বারা জয়াকে স্পর্শ করছে। প্রবলভাবে, প্রখরভাবে। জয়া ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ওয়াসিফকে সামলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। বারবার এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাঙ্গা গলায় বললো,
–“ওয়াসিফ! প্লিজ, ছাড়ো। কান্ট্রোল ইওরসেল্ফ। আমরা পাবলিক প্লেসে আছি, প..প্লিজ!”

ওয়াসিফকে অনেক ধাক্কিয়ে নিজের থেকে ছাড়ালো সে। ওয়াসিফ বসেই শার্টের বোতাম আর চুল ঠিক করছে। জয়াও নিজেকে ঠিকঠাক করে ওয়াসিফের সাথে উঠে দাঁড়ায়। তারপর সেখান থেকে দুইটা ড্রেস নিয়ে চলে গেলো।

রিকশায় দু’জন দুই মুখী হয়ে বসে আছে। কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। ভাষা যেন হারিয়ে গিয়েছে। নীলা এবং আয়ন্তি উভয়ই স্তব্ধ কিছুক্ষণ আগের ঘটনায়। নীলা অন্যমনস্ক হয়ে বলে,
–“ভাই, মুভির সিন আজ সরাসরি দেখে ফেললাম।”
–“তোর কাছে কেউ এক্সপ্লেইন চাইছে?”
–“আচ্ছা আয়ন্তি, জয়া আপুর জায়গায় তুই থাকলে..”
–“স্টপ!!”
–“সিসি ক্যামেরার ভয় ছিলো না ওদের ভাই? কেমনে?”
–“আল্লাহ’র ওয়াস্তে থাম নীলু, গা ঘিনঘিন করতাছে আমার।”
–“তোর বাপ এই ক্যারেক্টারের এক পোলার সাথে.. তোর বাপরে এই দৃশ্য দেখানো উচিত ছিলো।”

এবার আয়ন্তি কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ নীলার পানে। নীলা আয়ন্তির সেই দৃষ্টিকে অবজ্ঞা করে বলে,
–“ভালো কথা। ছবি তো তুলেই আনসি। এক কাজ করি, রিয়ন ভাইয়া আর তোর বাপরে পাঠাই দেই? কেমন হবে?”
–“এবার কিন্তু তুই লিমিট ক্রস করে ফেলছিস নীলা। তোর লজ্জা-শরম নাই ভাই? মুখটাকে একটু লাগাম দে।”
–“লাগাম দেয়ার মতো পরিস্থিতি আছে নাকি? জয়া আপুর বেড ইফেক্ট আমার গায়ে ভাইরাস আকারে ঢুকেছে। ওই যে, তোর বলা লজ্জা-শরম।”
–“লাস্টবারের মতো ওয়ার্ন করছি নীলা। আর একটা কথা বললে তোরে লা’ থ মেরে রিকশা থেকে ফেলে দিবো। তোকে লা’ থ মারতে কিন্তু আমারও লজ্জা লাগবে না।”

নীলা মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে ফিরলো। ন’ স্টালজিক দৃশ্যটা এখনো চোখের সামনে থেকে যাচ্ছে না। বিরক্তিকর।

রাত বারোটার পরে নীলা হুট করেই জয়াকে কল দিলো। রিং হচ্ছে কিন্তু জয়া রিসিভ করছে না। নীলার পাশেই ঘুমিয়ে আছে আয়ন্তি। নীলা একটু পরপরই পা দিয়ে আয়ন্তিকে ঠেলে ঠেলে ওঠানোর চেষ্টা করছে। আয়ন্তি বারংবার কপাল কুচকে বলছে,
–“বিরক্ত করিস না নীলা। প্লিজ ঘুমোতে দে।”
–“ঘুমাবি পরে। আগে জেনে নিই জয়া আপু কেন তোরে ধোকা দিলো?”

আয়ন্তি পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল। ঘুম কন্ঠে বলে ওঠে,
–“কিসের ধোকা?”
–“সেটা জয়া আপু রিসিভ করলেই বুঝে নিস।”
–“ধুর। তোর যত আজাইরা প্যাঁচাল।”

নীলা হার না মেনে বারবার কল করছে জয়াকে। কল করতে করতে মিনমিন করে বলছে,
–“নিশ্চয়ই রোমান্টিক মোমেন্টে বিজি।”
–“তো তোর সমস্যা কী? হুদাই ডিস্টার্ব করছিস।” ঘুম ঘুম কন্ঠেই আওড়ায় আয়ন্তি।
–“তুই চুপ থাক তো।”

প্রায় অনেকক্ষণ পর গিয়ে নীলার কল রিসিভ করে জয়া। জয়ার অদ্ভুত কন্ঠস্বর। বাজে শব্দও শোনা যাচ্ছে মলের মতো। জয়া বেশ বিরক্তির সাথে বলে,
–“খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? এত রাতে কল দিচ্ছিস কেন?”

নীলা ততক্ষণে আয়ন্তিকে ধা”ক্কিয়ে ধু”ক্কিয়ে উঠিয়েছে। আয়ন্তির সামনে লাউড স্পিকার দিয়ে বলে,
–“না, তোমার কী ওয়াসিফ ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেছে? তা জানতে ইচ্ছা ছিলো।”

জয়া বিরক্তির চরম পর্যায়ে চলে গেলো। এরকম একটা মোমেন্টে এসে এসব প্রশ্ন? জয়া ফিসফিস করে বলে ওয়াসিফের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসলো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–“না, কেন?”
–“কবে বিয়ে করছো?”
–“ওটা আমার আর ওয়াসিফের ডিসিশন।”

নীলা নৈঃশব্দে জয়ার কথাটাকে একইভাবে বলে ভেঙ্গালো।
–“আচ্ছা আরেকটা কথা জানার ছিলো।”
ওয়াসিফের উত্তেজিত মুখশ্রীর দিকে চোখ বুলিয়ে বলে,
–“কী? দ্রুত বল।”
–“দ্রুত কেন? কেউ অপেক্ষা করছে বুঝি?”
–“বাকওয়াস কম কর। যা বলেছি তার কর।”
–“ওকে, ওকে। রাগছো কেন? আচ্ছা তুমি ওয়াসিফ ভাইকে কেমনে ইম্প্রেস করলে? আয়ন্তির হবু বর জানা সত্ত্বেও?”

জয়া হাসলো। হাসতে হাসতে ওয়াসিফের থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে গর্বের সাথে বললো,
–“সেটা তোর না জানলেও চলবে।”
–“প্লিজ বলো না।”
–“ওকে শুন। যখন আয়ন্তি ওয়াসিফকে রিজেক্ট করতো তখন আমি জোর করে ওয়াসিফের কাছে যেতাম, ওয়াসিফকে নিজে ভালোবাসা বুঝাতাম। ব্যাস। পটে গেলো!”
–“এতে তোমার লাভ কী?”
–“শোন নীলা। আমি আয়ন্তির থেকে কম নই, ইভেন আমার পড়ালেখাও আগেই শেষ। আমি চাইতাম না আমার বাবা-মা এক বুড়োর সাথে আমায় বিয়ে দিক। এছাড়া আমাকে বুড়োর সাথে বিয়ে দিবে আর আয়ন্তি আমার চেয়েও চার বছরের ছোট হয়ে বিদেশী, হ্যান্ডসাম জামাই পাবে সেটা কীভাবে হতে দিই? তাইতো সব ছাড়লাম। এখন আমার সুখ আর সুখ।”
–“এর পরিবর্তে তুমি কী পেলে?”
–“অনেক কিছুই। কানাডা স্যাটেল হবো, দামী গাড়িতে করে ঘুরবো। আমার চেয়ে সুখী কেউ আছে? আচ্ছা রাখছি, ওয়াসিফ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। বাই!”

নীলা খট করে কল কেটে বিছানায় ধপ করে ফেলে দিলো। রাগী চোখে আয়ন্তির দিকে তাকাতেই দেখলো আয়ন্তি দেয়ালে মাথা এলিয়ে ঘুমে কাত। নীলা বোকার মতো তাকিয়ে রয় আয়ন্তির পানে। মেয়েটা এভাবে ঘুমাচ্ছে। এর মানে কী কিছুই শুনেনি? মেজাজ-ই খারাপ হয়ে গেলো। এত কষ্ট কী নিজে শোনার জন্য করেছে নাকি? থাক কী করার। বিস্তারিত সকালেই আয়ন্তিকে জানাতে হবে। নীলা ফোন হাতে নিতেই ওয়ালপেপারে তার চোখ আটকে গেলো। নিলয়ের সাথে সেই পিকটা। নীলা এবার দুনিয়া ভুলে নিলয়কে কল্পনা করতে মত্ত হয়ে পরলো। এখন হয়তো নিলয় তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে সুখের ঘুম দিচ্ছে। আচ্ছা সেই সুখের ঘুম কেন নীলাকে ধরা দেয় না? নীলা আপনমনেই আওড়ায়,
–“আপনি আমার কল্পনায় সিক্ত! সকল স্থানেই আপনাকে অনুভব করি, চোখ বুজলে আপনার সেই শীতল চাহনি ভেসে ওঠে আঁখিপল্লবে৷ আপনি আমার নিত্যদিনকার এক অকারণের রুটিন ছিলেন, আছেন আর হয়তো থাকবেন! সবসময়।”

———————-
–“মাহবিন বেটা? আর ইউ অ্যাস্লিপ?”
মাহবিনের বিরক্তিকে কপাল এবং ভ্রু-দ্বয় কুঁচকে এলো। চোখ জোড়া এখনো তার বন্ধ। আবারও সেই বিরক্তিকর কড়াঘাত এবং বিরক্তিকর কন্ঠস্বর। মাহবিন চোখ মেলে তাকালো। সকাল হলেও রুমটা এখনো আঁধারে ঘেরা। বাহিক্য সূর্যের আলো আলিশান রুমটিতে প্রবেশ করেনি। মাহবিন উঠে বসলো। এসির পাওয়ার কমিয়ে পাশ থেকে টি-শার্টটি উঠিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিলো। বিছানা থেকে নেমে বিরাট জানালার পর্দা সরিয়ে নিলো। তীক্ষ্ণ কিরণ চোখে প্রবেশ করতেই মাহবিন চোখ বুজে ফেললো। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে চোখ মেললো। কিছুটা ব্যায়াম করলো। দরজার অপরপাশে যে কেউ তার অপেক্ষা করছে, তাকে ডাকছে সেই বিষয়ে কোনোরূপ হেলদোল নেই। মাহবিন নিজের মনমতো আরও পাঁচ মিনিট কাটিয়ে গিয়ে দরজা খুললো। দরজার ওপাশে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে এক মধ্যবয়সী সুন্দরী মহিলা। গায়ে তার ফর্মাল সুট। মাহবিনকে দেখে হাসিমুখে বললো,
–“গুড মর্নিং বেটা। ঘুম ভাঙলো? আসো, একসাথে ব্রেকফাস্ট করি।”

মাহবিন কোনো উত্তর না দিয়ে ভেতরে ঢুকে পরলো। মহিলাও তার পিছু পিছু প্রবেশ করলো। মহিলার পিছে প্রবেশ করলো দু’জন সার্ভেন্ট। মাহবিন ওদের তোয়াক্কা না করে টি-টেবিলে রাখা ওয়াইনের খালি বোতল গুলো সার্ভেন্টদের ধরিয়ে দিলো। খালি বোতল দেখে মহিলাকে আরও খুশি দেখা গেলো। এতদিন শুধু সার্ভেন্টদের কাছেই শুনেছে বোতল খালি, আর আজ নিজ চোখে দেখে নিলো। এবার আর বিশ্বাস করতে বাঁধা নেই। মাহবিন মহিলার উদ্দেশ্যে গাঢ় কন্ঠে বলে ওঠে,
–“কেন এসেছো?”
–“নিজের ছেলের ঘরে আসতে মানা নাকি? এছাড়া তুমি এসব খাও?”

মাহবিন হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি। বিড়াল মাছ চুরি করে বলছে সে মাছ খায়নি। বড্ড হাস্যকর। মাহবিন মাঝে মধ্যে-ই রাতে ফিরে তার রুমের টি-টেবিলে চার-পাঁচটা বা এরও বেশি ওয়াইনের বোতল পায়। সবই পাঠায় মাহবিনের আপন মা। মাহবিনের আরও দু’জন ভাই-বোন আছে। ওরা এবোর্ডে পড়াশোনা করতে গেছে। আপাতত মাহবিনের বাবা-মা এবং মাহবিন-ই এই সৌখিন বাড়িতে থাকে।
–“দাঁড়িয়ে আছো যে? যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। ব্রেকফাস্ট করবো।”

মহিলা খুশিমনে সার্ভেন্ট নিয়ে বেরিয়ে যায়। একজন সার্ভেন্ট মাহবিনের বেড পরিষ্কার করতে যেতেই মাহবিন বিকট শব্দে ধমক দিয়ে উঠলো,
–“ডোন্ট টাচ মাই বেড। গেট লস্ট ফ্রম মাই রুম।”

সার্ভেন্ট কেঁপে ওঠে মাহবিনের ধমকে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আটকে গলায় বললো,
–“স্যার…”
–“কী বলেছি শুনোনি? আই স্যে গেট লস্ট৷ নয়তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

সার্ভেন্টে কাঁপতে কাঁপতে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। সার্ভেন্ট বের হতেই মাহবিন দরজা লক করে নিজ উদ্যোগে নিজের বিছানা গুছিয়ে নেয়। এলোমেলো সোফার কুশন ঠিক করে, এলোমেলো জামা-কাপড় বাস্কেটে এবং আলমিরায় তুলে নেয়। অতঃপর তোয়াল নিয়ে নিজের চুল ঠিক করতে করতে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে৷ মাহবিন তার জীবন-যাত্রায় এসব কাজ একা করতেই পছন্দ করে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ফর্মাল স্যুটে তৈরি হয়ে নিচে চলে যায়। গিয়ে দেখে সোনিয়া অর্থাৎ মাহবিনের মা এবং মাহবিনের বাবা শাকিল খাবার টেবিলে বসে তার জন্যেই অপেক্ষা করছে। মাহবিন তাদের সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে সোফায় গিয়ে বসলো।
–“আমার ব্রেকফাস্ট এখানে সার্ভ করো। ফাস্ট!”

সার্ভেন্ট’রা মাহবিনের কথা অনুযায়ী মাহবিনের খাবার সেখানেই সার্ভ করলো। মাহবিন সুন্দর ভাবে খেতে লাগলো। সোনিয়া কাটা চামচ শক্ত করে ধরে বলে,
–“তুমি আমাদের ইনসাল্ট করলে মাহবিন। আমাদের দেখেও তুমি ওখানে গিয়ে খেতে বসেছো কোন সাহসে? এই তোমায় শিখিয়েছি?”

মাহবিন ঘাড় বাঁকিয়ে শূন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সোনিয়ার পানে। ব্রেডে বাইট বসিয়ে চিবুতে চিবুতে বললো,
–“আমার সাহস সম্পর্কে আপনি অবগত মিসেস। আর আপনি কবে কী শেখালেন আমায়? হাসালেন। আমি কখনোই আপনাদের সাথে এক টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করিনি। তাই এই যুক্তিহীন কথাবার্তা বাদ দিন।”

সোনিয়া আরও কিছু বলতে গেলে শাকিল সোনিয়ার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দেয়। সোনিয়া শাকিলের পানে তাকাতেই শাকিল চোখ বুজে আশ্বাস দেয়। সোনিয়া দমে গেলো। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই সোনিয়া পুণরায় বলতে লাগে,
–“তোমার পাপা তোমার সাথে জরুরি কথা বলতে চায়।”
–“এতক্ষণে আসছেন মতলবের পয়েন্টে। এজন্যই তো বলি, আপনি আপনার প্রিয় স্বামী, বিজনেস ফেলে কেন আমায় সকাল সকাল ডেকে আনলেন।”
–“মাহবিন!!”
–“আমার খাওয়া শেষ। আসছি আমি।”

বলেই মাহবিন উঠে গিয়ে চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে বেরিয়ে গেলো। সোনিয়া পিছু ডাকলো কয়েকবার। কিন্তু মাহবিনের কান অবধি কোনো ডাক পৌঁছাতে পারেনি। পৌঁছালেও হয়তো মাহবিন শুনতে চায়নি।

–“ড্রাইভার?”
–“জ্বী স্যার।”
–“ভার্সিটির দিকে গাড়ি ঘুরাও তো। এক ক্লায়েন্টের সাথে মিট করতে হবে।”
–“ওকে স্যার।”
বলেই ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে ভার্সিটির পথে রওনা হলো। মাহবিন চোখ থেকে সানগ্লাস খুলতেই ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রিসিভ করলো মাহবিন,
–“আসছি আমি। তাকে অপেক্ষা করতে বলো সুজন।”
——-
–“আচ্ছা, বাই।”

—————————
~চলবে, ইনশাল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here