#অতঃপর_দুজনে_একা -১৭,১৮
লাবিবা ওয়াহিদ
১৭
—————————–
দিনটা সোমবার। আয়ন্তি প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত। অসময়ের বৃষ্টিতে ভেঁজার ফল এই জ্বর। আজ আয়ন্তির ভার্সিটি যাওয়া হয়নি। আয়ন্তির জন্যে নীলাও ভার্সিটি যায়নি। আয়ন্তি বিছানায় পরে আছে আর দব কাজ নীলা করছে। আয়ন্তির খেয়াল রাখার পাশাপাশি রান্না করা একদম সম্ভব না। তাইতো নীলা আয়েশাকে খাবার বানিয়ে পাঠাতে বললো। নীলাদের অপর রুমে র মেয়ে দু’জন ভার্সিটিতে। হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে। নীলা ছিলো তখন রান্নাঘরে। উঁকি দিয়ে দরজার দিকে তাকালো সে। নীলা ভ্রু কুচকে বলে,
–“খাবার তো এত তাড়াতাড়ি আসার কথা না। এছাড়া আমি তো চাচীকে বলে দিয়েছি ড্রাইভার আসলে যেন কল দেয়। মাস্ট ড্রাইভার আসবে না। তাহলে এই অসময়ে কে এলো?”
কিছু সময়ের মধ্যে আবারও কলিংবেল বেজে ওঠে। নীলা উপায়ন্তর না পেয়ে দরজা খুলতে চলে যায়। দরজা খুলতেই নীলা অবাকের চরম পর্যায়ে চলে যায়। দুটো ছেলে, মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলা ভ্রু কুচকালো৷ দুজনের মধ্যে বিদেশী একটা ভাব আছে। বেশ মর্ডানও দেখাচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে নীলা দু’জনের একজনকেও চিনে না। ছেলেটা তো নীলাকে প্রথম দেখায় একদম গিলে ফেলে অবস্থা। নীলা পিটপিট করে তাকিয়ে বলে,
–“কী চাই? কাকে চাই?”
–“তোমাকে চাই। আসবে?”
নীলা যেন আকাশ থেকে পরলো৷ কোটর থেকে চোখ জোড়া বেরিয়ে আসার উপক্রম। মেয়েটি ছেলের কাঁধে এক চ’ ড় মেরে বলে,
–“আবারও ফ্লার্ট শুরু করেছিস? ভাই জানলে আস্ত রাখবে না তোকে।”
–“শাট আপ! ফ্লার্ট কই করলাম? জাস্ট কিডিং!”
নীলা বেকুবের মতো দু’জনের দিকে তাকালো। মেয়েটি ছেলেটিকে চোখ রাঙানি দিয়ে নীলার উদ্দেশ্যে বলে,
–“সো সরি। আমার ভাইয়ের কথায় মাইন্ড করবেন না প্লিজ।”
–“ইট’স ওকে। এবার দয়া করে পরিচয়টা দিন।”
–“বাহ। পরিচয় জানার এতই ইচ্ছে?”
নীলা এবার চোখ রাঙালো রিহাবকে। রিহাব এতে হাসলো। হাসি বজায় রেখে বলে,
–“সো সুইট।”
শায়লা এবার না পেরে রিহাবের পায়ে হিল দিয়ে চেপে দিলো। রিহাব চাপা আর্তনাদ করে উঠলো। শায়লা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলে,
–“আমি শায়লা আর ও হচ্ছে রিহাব। ব্রাদার কোথায়?”
–“সরি, ব্রাদারটা কে?”
ঠিক তখনই মাহবিন তার ফ্ল্যাট থেকে বের হলো। তিনজনই মাহবিনের দিকে তাকালো। মাহবিন রিহাব এবং শায়লাকে দেখে কিছুটা চমকালো। শায়লা একবার নীলার দিকে তো একবার মাহবিনের দিকে তাকাচ্ছে। বুঝতে আর সমস্যা হলো না যে তাঁরা ভুল জায়গায় চলে এসেছে। নইজের ভুল বুঝতে পেরে আড়ালে শায়লা ছোট করে নিজ জিহবায় কা’ মড় দিলো। অতঃপর নীলার দিকে তাকিয়ে বলে,
–“এক্সট্রেমলি সরি। একচুয়ালি আমাদের বুঝতে সমস্যা হয়েছিলো আমাদের ভাইয়ের ফ্ল্যাট খুঁজতে। এনিওয়ে, নাইস টু মিট ইউ।”
–“ধুর! কিসের জন্যে সরি বলছিস? ভালোই হলো, ভুল করে হলেও সুন্দরীর দেখা পেয়ে গেলাম।”
–“আপনি কিন্তু লিমিট ক্রস করছেন।”
–“নাহ, আমি আরও লাইন বানাচ্ছি।”
নীলা কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রিহাবের পানে। শায়লা কপট রেগে রিহাবকে ধমকালো,
–“রিহাব!”
শায়লা টেনে-হিঁচড়ে রিহাবকে মাহবিনের কাছে নিয়ে এলো। মাহবিন একপলক নীলার দিকে তাকিয়ে ভাই-বোনকে ভেতরে নিয়ে গেলো। মুখ-ভঙ্গি ছিলো তার বরাবরের মতোই গম্ভীর। নীলা ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বেশ অবাক হয়ে বললো,
–“এই অদ্ভুত মানুষ গুলো কারা? আজব তোহ।”
–“কী রে নীলা, কার সাথে কথা বলছিস?”
আয়ন্তির ডাকে নীলা দরজা বন্ধ করে ভেতরে চলে আসলো। ভেতরে গিয়ে দেখে আয়ন্তি ততক্ষণে উঠে বসেছে। আয়ন্তির মুখশ্রী ভীষণ ফ্যাকাসে। চুলগুলো এলোমেলো। চোখ লাল হয়ে ফুলে আছে। চোখের নিচেও কালচে ভাব সৃষ্টি হয়েছে। নীলা ব্যস্ত ভঙ্গিতে আয়ন্তির কাছে এসে বললো,
–“উঠছিস কেন? শুয়ে পর দ্রুত৷ নিজের অবস্থা দেখেছিস? জ্বরে গা পু’ড়ে যাচ্ছে।”
–“কে এসেছিলো?”
–“মাহবিন ভাইয়ের ভাই-বোন।”
আয়ন্তি যেন আকাশ থেকে পরলো। চোখ জোড়া বড়ো বড়ো করে বললো,
–“মানে কী? আমার জানামতে তো মাহবিনের কোনো ভাই-বোন নেই।”
কৌতুহলে নীলারও ভ্রু-দ্বয় কুচকে এলো। তবে প্রশ্ন করলো না সে।
–“হতেও পারে ভাইয়ার কাজিন ওরা।”
–“হ্যাঁ, তাও হতে পারে। বাদ দে, মা খাবার পাঠিয়েছে?”
–“দুপুরের আগেই খাবার চলে আসবে। চিন্তা করিস না।”
–“আমার জন্যে শুধু শুধু তুই পেরাসানিতে পরলি নীলা।”
–“ধুর। কিসের পেরাসানি? একসাথে থাকছি। দু’জন দু’জনের খেয়াল রাখতে না পারলে থেকে কাজ কী? আমার কাজ আমায় করতে দে। খবরদার আর যদি শুনেছি এসব।”
আয়ন্তি উত্তরে শুধু হাসলো। ঘুমে নেতিয়ে পরছে যেন তার চোখ জোড়া। তাই পুণরায় শুয়ে পরলো সে। যোহরের আযানের আগে দিয়ে আয়েশা ড্রাইভার দিয়ে খাবার পাঠালো। নীলা ড্রাইভারের ফোন রিসিভ করে নিজেই নিচে চলে গেলো। খাবারের হটপট হাতে নিয়ে ড্রাইভারকে বিদায় করে নিজেও ভেতরে চলে আসলো। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় পুণরায় রিহাবের মুখোমুখি হলো নীলা। নীলা এবার বিরক্ত হলো। রিহাব হাসি হাসি মুখ করে বলে,
–“হাতে ওটা কী?”
–“বি’ ষ! খাবেন নাকি?”
–“এত বড়ো পটে বি’ ষ আনলে যে? এত খেয়ে কাজ কী?”
–“আপনি খেতে চাইলে আপনাকেও দিচ্ছি।”
–“সত্যি দিবে? তাহলে তো ভালো হয়। তোমার হাতের বি’ ষ এখন আমার কাছে মধু। দাও তো দেখি।”
বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো নীলা। পাগল নাকি ছেলেটা? এভাবে নীলার পিছে পরে আছে কেন? আজ দিনটাই খারাপ যাচ্ছে নীলার। কার মুখ দেখে যে উঠেছিলো। সবশেষে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আপনার কথা শেষ হলে আমি যেতে পারি?”
–“জ্বী অফ কর্স। কাল আবার আসব জ্বালাতে। কেমন? বাই।”
বলেই নীলাকে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে নীলার পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। শায়লাকে আর নামতে দেখলো না। নিশ্চয়ই নিচে নেমে গেছে। নীলার ইচ্ছে করছিলো ফ্লাইং কিস ছুঁড়া হাতটা ভে’ ঙ্গে রিহাবের হাতে ধরিয়ে দিতে। এমন ব’দ এই ছেলে! নীলা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নিতেই রিহাব তড়িঘড়ি ভঙ্গিতে নীলার সামনে চলে আসলো। নীলাও যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। বুকে থুঁ থুঁ মা’ রার ভঙ্গি করে চোখ বড়ো বড়ো করে রিহাবের দিকে তাকালো। অতঃপর হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
–“আসল কথাই তো জানা হলো না।”
–“কী?”
–“নাম কী তোমার?”
জীবনে প্রথম এই প্রশ্নকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর প্রশ্ন লাগলো নীলার। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আর একবার জ্বালিয়েছেন তো মাহবিন ভাইয়ের কাছে আপনার নামে বিচার দিবো।”
–“গ্রেট! আই লাইক ইট। এবার নাম বলো, নয়তো যাবো না।”
নীলা নাম বলবে না। রিহাবও হার মানার পাত্র না। নীলার নিজেকে অসহায় লাগলো। বুঝে গেলো তাঁর চেয়েও বেশি জেদী হচ্ছে এই রিহাব। শেষমেষ বাধ্য হয়েই নাম বলে দিলো নীলা।
——————
পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতেই আয়ন্তি চমকে উঠলো। লাফ দিয়ে উঠতে চাইলেও পারলো না। মাহবিন আয়ন্তির কপাল ধরে আবার শুইয়ে দিয়েছে। আয়ন্তি চোখ বড়ো বড়ো করে মাহবিনের পানে তাকিয়ে আছে। মাহবিন তার গম্ভীর কন্ঠস্বরে নম্রতা এনে শুধায়,
–“উঠতে হবে না। শুয়ে থাকো।”
আয়ন্তি বাধ্য মেয়ের মতো বিছানায় লেপ্টে থাকে। নজর তার মাহবিনের মুখশ্রীতে। মাহবিন একপলক আয়ন্তির চোখ-মুখের দিকে চেয়ে আয়ন্তির কপালে গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিলো। আয়ন্তি পরম আবেশে চোখ বুজে ফেললো। কপালের তাপ যেন মাহবিনের ওই বলিষ্ঠ হাত দিয়ে অনায়াসে ঢুকে যাচ্ছে। মাহবিন আয়ন্তির তাপমাত্রা চেক করে বলে,
–“এত জ্বর হলো অথচ আমায় জানালে না?”
আয়ন্তি চোখ মেলে তাকালো। চোখে-মুখে ফুটে উঠলো একরাশ কৌতুহল। পিটপিট করে মাহবিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“বললে কী হতো?”
–“কী হলে তোমার ভালো লাগতো?”
পাল্টা প্রশ্নে আয়ন্তি থতমত খেয়ে গেলো। তার গলা দিয়ে টু-শব্দও বের হলো না। আসলে সে নিজেই জানাতে ইচ্ছুক ছিলো না। আয়ন্তি ভেবেছিলো অনেকদিন মাহবিন থেকে দূরে থাকবে। কিন্তু সম্ভব আর হলো কই? মাহবিনের উক্তিতে আয়ন্তির ধ্যান ভাঙলো,
–“ওষুধ নিয়েছো?”
–“সকালে নিয়েছিলাম।”
–“এখন ক’টা বাজে জানো?”
–“ঘুমিয়েছিলাম। বলতে পারি না।”
আয়ন্তি ভাঙ্গা কন্ঠস্বরে যেন মায়া ঢেলে দেয়া হয়েছে। এত মধুর লাগছে শুনতে। মাহবিন নিরবে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো আয়ন্তির ফুলে যাওয়া মুখশ্রীতে। আয়ন্তি ইতস্তত বোধ করছিলো, তাই সে নজর নত করে রেখেছে। হৃদপিন্ড প্রচন্ড ঢিপঢিপ শব্দ করছে তার। দেহে এক শিহরণ খেলে গেলো তার। মাহবিন হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। পকেটে দুই হাত গুঁজে বলে,
–“খেয়ে-দেয়ে ওষুধ নিয়ে নাও। আমি আবার পরে আসবো।”
মাহবিন চলে যেতে নিলে আয়ন্তি পিছু ডাক দেয়।
–“শুনুন।”
আয়ন্তির ডাকে মাহবিন থমকে দাঁড়ায়। ঘাড় বাঁকিয়ে আয়ন্তির দিকে তাকায়নি। আয়ন্তি মাহবিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“নীলা বলছিলো আপনাকে খুঁজতে দু’জন ছেলে-মেয়ে এসেছিলো। কারা ছিলো ওরা?”
–“ভাই-বোন।” মাহবিনের সহজ স্বীকারোক্তি।
–“আপন?”
–“হু।”
–“আপনি না বলেছিলেন আপনার কেউ নেই?”
এবার কোনো উত্তর আসেনি মাহবিনের পক্ষ থেকে। আয়ন্তি তখনো উত্তরের অপেক্ষায় মাহবিনের পানে তাকিয়ে। কিন্তু আফসোস, তার প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। মাহবিন বিনা-বাক্যে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আয়ন্তি শুধু চেয়ে, চেয়ে দেখলো। মাহবিনকে আর পিছু ডাক দিলো না।
—————————
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ।
#অতঃপর_দুজনে_একা – [১৮]
লাবিবা ওয়াহিদ
—————————-
সময়টা যাচ্ছে খুবই দ্রুতগতিতে৷ এর মাঝে কেটে গেছে আরও এক মাস। প্রায় এক মাস-ই মাহবিন ছিলো আয়ন্তিদের পাশের ফ্ল্যাটটায়। দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, একজন আরেকজনের বাড়ি খাওয়া-দাওয়া হয়েছে৷ নুরুল আলম যখন শুনলেন মেয়ের জ্বরের কথা তখন থেকে দুই তিন বার মেয়ের বাড়ি এসেছেন। নিজের সাথে নিয়ে আসার জন্য জোর করেছেন। কিন্তু আয়ন্তি রাজি হয়নি। একদমই রাজি নয়। একসময় নুরুল আলম দোটানায় পরলেন। তখন স্ত্রী তার পাশে এসে বসলেন। নুরুল আলমের কুচকানো ভ্রু-দ্বয়ের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে থমথমে গলায় শুধালেন,
–“শুনেছেন, আমাদের নিলয়ের ঘরে নাতনি আসছে। ঘর আলো করে আসবে কিছুদিন বাদেই। আমাদের প্রথম প্রদীপ হিসেবে আসবে। যখন আমাদের নাতনিটা পৃথিবীর আলো দেখবে, সবকিছু বুঝতে শিখবে। তখন যদি তার বাবা-মাকে প্রশ্ন করা হয় তার দাদু-দাদী তাকে কতটা স্নেহ করেছে? তখন কেমন লাগবে বলুন তো? নিলয় এবং মেঘার মুখমন্ডলে থাকবে একরাশ হতাশা। তাদের হৃদয়ের সুপ্ত কোণে বেজে উঠবে,
“তোর দাদা-দাদী তোকে কখনো আদর করেনি রে৷ আমাদের কাউকে তাদের বসতিতে আশ্রয় দেয়নি।”
এরকম একটি বাস্তবতা আপনি বা আমি মানতে পারবো? আমি তো কখনোই পারবো না। কোন মানুষ পারবে? সবার-ই নাতি-নাতনীর সখ, ইচ্ছে হয়। আপনি কেন ব্যতিক্রম হলেন? ছেলেটা কী দোষ করেছে? আজ কী আমার পরিবারের চাইতেও আপনার ইগো বড়ো? ইগো করেছিলেন মনে নেই? সেই ইগোতে মেয়েকেও হারালেন। মেয়েটাকে কতদিন হলো একনজর দেখলাম না। আমার ভেতরের ক্ষ’ ত দেখতে পারছেন নিলয়ের আব্বু? ছেলেটা তো খারাপ কিছু করেনি। শুধু বিয়ে করেছে, আল্লাহ্’র ফরজ পালন করেছে৷ আপনি কোথায় ছেলে-বউকে আগলে নিবেন৷ তা না করে উল্টো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন।”
নুরুল আলম চুপটি করে শুনলেন। আয়েশা নুরুল আলমের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখতে পেয়ে হতাশ হলেন। হতাশার সাথে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে রুম ত্যাগ করলেন।
–“মেঘা, একদম ভয় পাবে না। আমাদের বেবি সুস্থ। চিন্তার কোনো কারণ নেই। আল্লাহ্ ভরসা।
–“হু, আল্লাহ্’র ভরসা। এখন কিছু তো খাওয়াও। আমার আর বেবিকে না খাইয়ে রাখার মানে কী? আল্টাসনোগ্রাফ তো হলোই।
–“খাবো তো। শুধু বাইরের স্ট্রিট ফুড খাওয়া যাবে না। ফ্রেশ ফল কিনব। তারপর খেতে খেতে বাসায় ফিরবা। কেমন?”
নিলয়ের প্রস্তাবে মেঘা মুখ বাঁকালো। নিলয় শব্দ করে হাসলো। যত দিন এগিয়ে আসছে, মেঘা দেখতেও তেমন গুলুমুলু আর সুন্দরী হয়ে যাচ্ছে৷ দু’জনেই হসপিটাল থেকে বের হচ্ছিলো। আজ মেঘার আল্ট্রাসনোগ্রাফি সহ বেশ কিছু চেকাপ ছিলো। রিপোর্ট আল্লাহ্’র রহমতে সব ঠিকঠাক। আগামী মাসে মেঘার ডেলিভারি ডেট পরেছে৷ নতুন অতিথির আগমন নিয়ে এই দম্পত্তির হাজারো ব্যস্ততা এবং স্বপ্ন। নিলয় গেটের বাহিরে আসতেই থমকে দাঁড়ালো। মেঘাও থমকে নিলয়ের দিকে তাকালো। চোখে-মুখে বিস্ময় ভর করছে। হয়তো সে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি নিলয়ের হঠাৎ থমকে দাঁড়ানোর কারণ। নিলয়ের দিকে তাকাতেই দেখলো নিলয় অবাকমিশ্রিত দৃষ্টিজোড়া সামনে নিবদ্ধ করে আছে। মেঘাও নিলয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো। মুহূর্তে সে নিজেও ‘থ’ হয়ে গেলো। সামনে যে তার শ্বশুর মশাই। নিলয়ের বাবা। নুরুল আলম!
——————————
–“আমার কী মনে হয় জানিস? রিহাব তোকে পছন্দ করে।”
নীলা নাক সিটকালো। আয়ন্তি নীলার গাল টেনে দিয়ে বললো,
–“সিরিয়াস কথা বলছি, সিরিয়াসনেস নিয়ে শোন।”
নীলা বাধ্য মেয়ের মতো আয়ন্তির দিকে তাকালো। তাঁরা দু’জন এখন রিকশা করে ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরছে। আয়ন্তি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
–“বিশ্বাস কর, আমার এ জীবনে এত পাগল ছেলে কোথাও দেখিনি। তোর জন্যে যে কী পাগ’ লামী করছে সব কিছুতেই আমি সাক্ষী। ভার্সিটির সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, তোর পিছে পিছে আসা, তোকে হুটহাট প্রপোজ করা। সব কিছুই একদিকে ইঙ্গিত করছে। তোকে ভালোবাসে রিহাব। রিহাব বাইরের কেউ না, মাহবিনের-ই ছোট ভাই। তাহলে তুই কেন বারবার তার সাথে কথা-কাটাকাটি করিস? নিজের জীবন গুছাবি না? এভাবেই কী জীবন চলবে? জীবনের এক ধারাবাহিকতা আছে। সেই ধারাবাহিকতায় কত মানুষ আসবে, যাবে। এই বলে কিছুই থেমে থাকবে না। তাই বললাম তুই বিষয়টা নিয়ে ভাব। আমার মন অন্তত বলছে এবার কোনো গোলমাল হবে না।”
–“কিন্তু এগুলা ফ্লার্ট ছাড়া কিছুই না আয়ন্তি। শায়লা আপু প্রথমদিন-ই বলেছে রিহাব আমার সাথে ফ্লার্ট করছে, তাই যেন সিরিয়াস না নেই। আচ্ছা নিলাম না, নিতেও চাই না। বিদেশী অনুরাগ তার মধ্যে। আমি তোর মতো আর কোনো ওয়াসিফের খপ্পরে পরতে চাই না।”
–“যাচাই করতে কেউ বাঁধা দেয়নি। বিদেশী হলেই সবাই ওয়াসিফ হয়ে যায় না নীলু। কেউ কেউ আলাদা ধাচের রিহাবও হয়। তবুও বলবো সময় নে।”
নীলা আয়ন্তির কথাগুলো নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। তবে ইদানীং নিলয়ের ছবিটা তাঁর ওয়ালপেপারে নেই। ছবিও নেই। কেন নেই, তা নীকার নিজেরও জানা নেই। রিহাবকে সে বিশ্বাস করে না। তবে এইটুকু উপলব্ধি করেছে রিহাব তার জীবনের রঙ পাল্টে দিয়েছে৷ রিহাবের উদ্ভট কান্ডগুলো তাকে নিলয়ের ঘোর থেকে টেনে বের করেছে। নিলয় নীলার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা। প্রথম ভালোবাসার মানুষটি না চাইলেও সারাজীবন হৃদয়ের এক কোণায় থেকে যায়। এটা স্বাভাবিক। তবে নীলা নিলয়কে একদমই ভুলতে পারছিলো না। এখন উপলব্ধি করছে নিলয় এখন অন্যকারো স্বামী। সে এতই ভাবনায় বিভোর হয়ে পরেছিলো যে বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারেনি। কারণ, জীবন নিলয়ের জন্যে বসে নেই। নিলয় তার অতীতে ছিলো। অতীত থেকে শিক্ষা নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
—————
বেশ কিছুক্ষণ ধরে একের পর এক কলিংবেল বেজেই চলেছে। দরজার বাহিরে অবস্থানরত ব্যক্তিটির যেন এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার মতো ধৈর্য নেই। বড্ড বেপরোয়া হয়ে আছে, তা কলিংবেল টেপার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে। মাহবিন ওই অবস্থায় চুপ করে কানে হেডফোন দিয়ে কথা বলছে। সোফায় বসেছে হেলান দিয়ে। বাহিরে যে একজন অপেক্ষা করছে এতে কোনারূপ ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন সে জানে দরজার ওপাশের ব্যক্তিটি কে? মাহবিন কানে ব্লুটুথ লাগিয়ে নিরবে বসে আছে। মুহূর্তে-ই কলের অপর প্রান্তের মানুষটির কন্ঠস্বর শ্রবণ হলো।
–“এত কলিংবেল কে বাজাচ্ছে ভাইয়া? তুমি দরজা খুলছো না?”
–“কেউ না। তোরা দ্রুত আয়। আর কতটুকু পথ বাকি?”
–“এইতো প্রায় চলে এসেছে। পাঁচ মিনিট লাগবে।”
মাহবিন কল কেটে দিলো। ব্লুটুথ নামিয়ে হেলেদুলে সদর দরজার দিকে অগ্রসর হলো। দরজা খোলার আগে আবার সে রিহাবকে কল দিয়ে পাওয়ার বাটন ক্লিক করলো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে দরজা খুললো। সঙ্গে সঙ্গেই হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো সোনিয়া। শাকিলও এসেছে। তবে সে বাইরে অবস্থান করছে। ভাব-ভঙ্গি এমন যেন সোনিয়ার মতো তাঁর তেমন তাড়া নেই। তবে তার মুখশ্রী বিষন্ন, ভয়াবহ। সোনিস অসম্ভব ফুঁসছে। ক্রোধে তার দেহ রিঁ রিঁ করছে। মুখ লাল। গতকাল অনেক কষ্টে মাহবিনের ঠিকানা বের করেছে। রিহাবের থেকে জেনেছে। মাহবিন পকেটে এক হাত রেখে দরজা থেকে সরে আসলো। সঙ্গে সঙ্গে শাকিলও প্রবেশ করলো। যেন মাহবিনের ভেতরে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। আজ তাঁদের চেহারায় অন্যরকম সেই আমেজটা নেই। বর্তমানে তাঁদের মুখশ্রী যে কেউ-ই পরে ফেলবে৷ বুঝতে পারবে এই দম্পত্তি তাঁদের সর্বস্ব খুইয়েছে৷
সোনিয়া সময় বিলম্ব না করে হুংকার ছেড়ে উঠলো,
–“তুই আমার পেটের সন্তান হয়ে আমাদের রাস্তায় নামালি? এত দাপট দেখাস? বাপে মরসে, সম্পত্তির এক ভাগও দিলি না, যেখানে আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। শু**** বা**! তোরে জম্ম দেয়াই আমার জীবনে সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিলো। কেমনে পারলি এমন একটা কাজ করতে? বিবেকে বাঁধলো না?”
মাহবিন নিরবে শুনে গেলো। তার চেহারায় এক ফোঁটাও রাগ বা দুঃখ প্রকাশ পায়নি। বরং এই দিনটার জন্যই ভেতরে ভেতরে নিজেকে প্রস্তুত করেছে, কঠিন করেছে। আজ নিশ্চয়ই এই দু’মুখো বি’ ষের তেঁতো কথাবার্তা তার ধৈর্যশক্তিকে বিফলে ফেলবে না। অনেক পরিকল্পনার পর এই দিন এসেছে। কম বুদ্ধি ব্যয় করেনি এই দিনের জন্যে। মাহবিন হাসলো। সোনিয়ার কাঁটা গায়ে নুঁনের ছিঁটা দিতে ঘর কাঁপিয়ে হাসলো। হাসতে হাসতে চোখের কোণ ভিঁজে গেল। এ যেন বিজয়ের হাসি। আনন্দের হাসি। হাসতে হাসতে একসময় থামলো মাহবিন।
–“আপনাদের সাহস দেখে বড্ড অবাক হই। হাতে নেই এক আনাও, তাও অহংকার ভাঙ্গে না। এত টাকা-পয়সা দিয়ে কী হবে? আপনাদের সম্পত্তির ভাগ দিবো-ই বা কেন? আপনার সাথে তো আমার বাবার ডিভোর্স হয়েছে সেই ছোটবেলাতেই। তাহলে এত কাহিনী করার কী মানে? কাজে পারেন না দেখে কথায় লাগতে আসছেন, বাহ্! খুব চমৎকার বিষয় তো।”
সোনিয়া কিছু বলতে নিলো, মাহবিন থামিয়ে দিলো। মাহবিনের মুখশ্রীতে এখন পুরো দমে গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে। সে কী ভয়ংকর লাগছে তাকে। মাহবিন রাশভারী কন্ঠে কাঠ কাঠ গলায় বললো,
–“খুব টাকার গরম দেখিয়েছিলেন না? আজ সেই টাকা আর ক্ষমতা দিয়েই আপনাদের পিষে ফেললাম। এবার লোন কীভাবে শোধ করবেন, আপনাদের বিষয়।”
এবার সোনিয়া না পেরে বেশ অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করলো। অতীতের কীর্তিকলাপ সব মুখে প্রকাশ করলো। মানুষের গোপন সত্যি তখনই বেরিয়ে আসে যখন মানুষটি অসম্ভব রেগে কাহিল হয়ে পরে। সোনিয়ার বেলাতেও ব্যতিক্রম হলো না। রাগের মাথায় মাহবিনকে এবং তার বাবাকেও খুব রকম গালাগাল করলো। একসময় না পেরে এও বলে ওঠে,
–“যেদিন তোর জম্ম হইছে, আমার উচিত ছিলো সেদিনই তোকে গলা টিপে হ/ ত্যা করার। তোর বাপরেও বালিশ চাপা দিয়ে হ/ ত্যা করার। ম/ রাডা ম’ রেও আমায় অশান্তিতে ফেলে গেলো। তোদের বাপ-ছেলেরে…”
বাহিরে শব্দ হওয়ায় সোনিয়া থামলো। মাহবিনের পিছে তাকাতেই যেন আকাশ থেকে পরলো। রিহাব এবং শায়লা দাঁড়িয়ে আছে। রিহাবের কানে ফোন। চোখ-মুখ অসম্ভব শক্ত। চোখ রক্তিম হয়ে টলমলে। পাশে দাঁড়ানো শায়লার চোখে জল। যেটা গাল স্পর্শ করেছে অনেক আগেই। সোনিয়ার মাথায় হাত। উপলব্ধি করতে পারছে রাগের মাথায় বেহুঁশ ছিলো সে, সেই বেহুঁশতা তার জীবনে কাল ডেকে আনবে শীঘ্রই।
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্