#অতঃপর_দুজনে_একা – ১৯,২০
লাবিবা ওয়াহিদ
————————-
চিৎকার-চেঁচামেঁচি শুনে নীলা এবং আয়ন্তি দু’জনেই দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এলো। মাহবিনের ফ্ল্যাটের মধ্যে তাকাতেই দু’জনেই থমকালো। রিহাবের পায়ের কাছে এক মহিলা বসে আছে। রিহাব মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। দরজার দিকে রিহাবের পিঠ, তাই আয়ন্তি’রা বুঝতে অক্ষম রিহাবের পতিক্রিয়া। মহিলা একমনে কান্না করতে করতে একটা কথাই বলছে,
–“এগুলো সব মিথ্যে বিশ্বাস কর। মাহবিন ইচ্ছা করে সব করেছে। বাবা আমার, শায়লা! তোদের মা কে বিশ্বাস করবি না?”
শায়লা চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে৷ শাকিল বারবার শায়লাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু ফলাফল শূণ্য। ওরা নিজ চোখে যা দেখার এবং শোনার তা বুঝে নিয়েছে। রিহাব শক্ত মুখে মাহবিনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“ভাইয়া, ফর গড সেক! এদের দু’জনকে বের করো। নয়তো আমি লাগামছাড়া হয়ে যাবো। আমার জবান থেকে এমন, এমন কথা বের হবে যা এদের প্রাপ্য কিন্তু এরা হজম করতে পারবে না। প্লিজ, লিভ দেম!”
–“রিহাব! তুই তোর মাকে বিশ্বাস করবি না?”
রিহাব মুহূর্তে-ই হুংকার ছেড়ে উঠলো। তার ভয়ানক কন্ঠস্বরে সোনিয়া এবং শাকিল উভয়েই চমকে উঠলো। হারে হারে উপলব্ধি করলো ছোট মানুষের রক্ত গরম।
–“কিসের মা? হু দ্য হেল আর ইউ? আপনি মা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। আপনি টাকা-পয়সা, সম্পদের জন্যে এক লো’ ভী মহিলা। আপনার কাছে সন্তান মানেই হচ্ছে সম্পদ আর টাকা-পয়সা। আপনার সম্পদের জন্যে কাউকে হ’ ত্যা করতেও হাত কাঁপে না। যে নিজের সন্তানকেই ছাড় দেয়নি সে কখনোই মা হতে পারে না। কী দোষ ছিলো মাহবিন ভাইয়ের বাবার! আসল কালপ্রিট তো আপনি আর আমার এই কুলা* বাপ! ছিঃ! থুঁ মা’ রতে ইচ্ছে করছে আপনাদের। এক্ষুনি এখান থেকে বের হোন। ওই বাড়িতেও যেন আপনাদের না দেখি। যদি আমাদের ত্রিসীমানায়ও আপনাদের দুজনকে দেখি তাহলে আমি রিহাব কথা দিচ্ছি। নিজ হাতে পুলিশে তুলে দিবো আপনাদের!”
সোনিয়া থমকে গেলো। কম্পিত কন্ঠে বললো,
–“রি..রিহাব!”
–“আপনার ওই নোং রা মুখে আমার নাম উচ্চারণ করবেন না মিসেস শাকিল! গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার।”
সোনিয়া এবার ঘুরে শায়লার দিকে তাকালো। শায়লার চোখে-মুখেও জলন্ত আ’ গুন। শাকিল শায়লার কাঁধ ধরতে আসলে শায়লা ঝাড়ি করে দূরে সরে গিয়ে বললো,
–“আমার কাছে আসার চেষ্টাও করবেন না। রিহাব কী বললো শুনতে পান নি? জাস্ট লিভ!”
স্বামী-স্ত্রী অসহায় চাহনিতে একে অপরের দিকে তাকালো। মাহবিন নিরবে তাঁদের দেখছে। একসময় সোনিয়া চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়। ভাঙ্গা গলায় শুধায়,
–“চলো শাকিল।”
শাকিলের চোখে-মুখে ক্রোধ। আজ সোনিয়ার রক্ষা নেই। চুপচাপ দু’জন একসাথে বের হবে এমন সময়ই পেছন থেকে মাহবিন বলে ওঠে,
–“হ্যাপি জার্নি।”
এরকম উক্তিতে সোনিয়া থেমে দাঁড়ালেও পুণরায় বেরিয়ে গেলো। সবটা আয়ন্তি এবং নীলা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো। কিছুই তাদের মাথায় ঢুকলো না। কিছু সময় অতিবাহিত হতেই শায়লা মুখ চেপে কেঁদে উঠলো। আয়ন্তি না পেরে শায়লার কাছে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো। রিহাব ততক্ষণে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলো। নীলাও তার পিছু নিলো।
———-
–“রিহাব?”
রিহাব আড়ালে চোখ মুছে নিলো অতি দ্রুত। নীলা কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। ভেতরের ঘটনা তাঁর অজানা। তাই কোথা থেকে বলা শুরু করা উচিত, ঠাওর হলো না। নিরবতা চললো কিছুক্ষণ। কাঠফাঁটা রোদে রিহাব একমনে দাঁড়িয়ে। নীলা অবশ্য কিছুটা দূরে ছায়ায় দাঁড়ানো। গরমে যেন সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে নীলা। আচ্ছা, রিহাবের কী গরম লাগছে না? রিহাব একসময় বলে ওঠে,
–“সরি নীলা।”
নীলা চমকে উঠলো। হঠাৎ সরি বলার কারণ কী? অদ্ভুত! নীলা পিটপিট করে রিহাবের পানে তাকিয়ে বললো,
–“হঠাৎ? কিন্তু কেন?”
–“তোমার সাথে একসময় ফ্লার্ট করেছিলাম তাই।”
নীলা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস। সে নিজেও জানে যে এগুলা সব ফ্লার্ট ছিলো। তবে সব প্রথম দিকের মতো ফ্লার্ট লাগেনি৷ কিন্তু মন মানতে চাইছে না কিছু। তাও নীলা সন্তপর্ণে নিজেকে সামলে নিলো। পিছে ঘুরে চলে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই রিহাব বলতে শুরু করলো,
–“শুরুর দিকে তোমার সাথে ফ্লার্ট করলেও বুঝিনি তোমায় মন দিয়ে ফেলবো৷ তুমি আমার কাছে ভীষণ চমৎকার একজন মানবী। এজন্য-ই প্রপোজ করতাম বারবার। কিন্তু হাস্যকর বিষয় জানো? আমি প্রপোজ করতে জানি না, বাঙালির মতোন। এজন্যই তুমি সিরিয়াস নাওনি কখনো। এটা আমি বুঝেছি। তাও আমি সবকিছুর জন্যে সরি। হয়তো তোমায় অতিরিক্ত ডিস্টার্ব করে ফেলেছি। কিন্তু জানো? এখন আমি নিজের প্রতি, নিজের ভাবনার প্রতি ডিস্টার্বড! চরমভাবে ডিস্টার্বড! হাস্যকর না?”
নীলা থম মেরে সব শুনে গেলো নিরবে। এর মানে কী সত্যি রিহাবের মনে তার জায়গা ছিলো? আদৌ ছিলো? ছেলেটার এলোমেলো কথা যে তা-ই জানান দিচ্ছে। নীলা এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। ধপাধপ পা ফেলে নিচে চলে গেলো।
———–
রিহাব এবং শায়লা ছিলো সোনিয়া-শাকিলের ছেলে-মেয়ে। এর মানে ওদের মা এক হলেও বাবা ছিলো ভিন্ন। সবার বড়ো মাহবিন, তারপর শায়লা। এরপর হচ্ছে রিহাব। রিহাব এবং শায়লার বয়সের দেড়-দুই বছরের পার্থক্য। মাহবিন কখনো তাঁদের পর করে দেখেনি। বরং নিজেরই এক অংশ ভেবে এসেছে। মাহবিনের ভালোবাসা পেয়ে দুই ভাই-বোনও তাকে বড়ো ভাই হিসেবে মানতে শুরু করেছে তাকে। বাচ্চা’রা আদর, ভালোবাসার কাঙাল। এরা কারো থেকে এক ভাগ ভালোবাসা পেলেই সেই মানুষটিকে অন্ধের মতো ভালোবেসে ফেলে। যদিও মাহবিন বেশিরভাগ সময় ছিলো দেশের বাহিরে। কিন্তু মাহবিন যখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলো তখন প্রায় রোজ-ই যেত রিহাব, শায়লার সাথে তাদের স্কুলে দেখা করতে। এছাড়া সোনিয়ার সাথে সেরকম যোগাযোগ না থাকলেও মাহবিন ছোট থেকেই ওদের বাসায় আসা-যাওয়া করতো। তখন সোনিয়া এবং শাকিল উভয়েই থাকতো অফিসে। বাচ্চা দু’জনকে কে সামলাবে? এই চিন্তায় মাহবিন শান্তিতে বসতে অবধি পারতো না। হোক সৎ, তাতে কী? মাহবিন সেই সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে চলে যেত সোনিয়াদের বাড়িতে। সময় কাটাতো বিকাল পর্যন্ত। তারপর চলে আসতো। সোনিয়া, শাকিল আজ অবধি জানতে পারেনি সেই আসা-যাওয়ার বিষয়টি। একজন বিশ্বস্ত কাজের খালা ওদের দেখাশোনা করতো। মাহবিনকেও তিনি বড্ড স্নেহ করতেন। তাইতো মাহবিন আসার খবর ভুলক্রমেও দম্পত্তিকে জানানো হয়নি।
মাহবিনের চোখের সামনে সেই স্মৃতিগুলো ভেসে ওঠে। মাহবিন একমনে শায়লার কান্না দেখছে। মাহবিন নিজেই ওদের জানিয়ে দিয়েছিলো যে মাহবিন ওদের সৎ ভাই। এজন্যে এ বিষয়ে খুব একটা সমস্যা পোহাতে হয়নি তাঁর। কারণ, এই কঠিন সত্যটি হয়তো ওরা অন্যদের থেকে শুনলে কষ্ট পেত, দূরে সরে যেত। মাহবিন সেটা চায়নি একদমই। তাই নিজ থেকে সব জানিয়েছে। মাহবিন মিনমিন করে বলে ওঠে,
–“তোরা আমার আপন না, কিন্তু তোদের প্রতি আমার ভালোবাসাটা আপনের চেয়েও যে গভীর।”
—————
কতক্ষণ ধরে আয়ন্তির কল বেজে চলেছে নীলার খেয়াল নেই। আয়ন্তি ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো ফোন বাজছে। ফোন হাতে নিতে নিতে আয়ন্তি বললো,
–“কতক্ষণ ধরে কল বাজছে তুই আমায় ডাকিসনি কেন? আজব!”
নীলা ভ্রুক্ষেপহীন। আয়ন্তি নীলাকে না ঘেটে ফোন হাতে তুলে নিলো। ফোন হাতে নিতেই চমকে উঠলো আয়ন্তি৷ নুরুল আলম কল করেছে। নিরাশ হলো আয়ন্তি। হয়তো আবার তাকে মানাতে কল করেছে। কেন বুঝতে চায় না তাঁর বাবা? অসহায় ভঙ্গিতে কল রিসিভ করলো আয়ন্তি। সালাম দিলো। নুরুল আলম সালামের উত্তর নিয়ে বললো,
–“ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেও মামুণি। আমি আসছি তোমাদের নিতে।”
চমকে উঠলো আয়ন্তি। কী বলছে নুরুল আলম?
–“কিন্তু আব্বু,..”
–“বাড়িতে তোমার জন্যে সারপ্রাইজ আছে। নীলাকেও নিয়ে আসবো। ওকেও বল রেডি হতে।”
আয়ন্তি আর কিছু বলার পূর্বেই নুরুল আলম কল কেটে দিলেন। আয়ন্তি এদিকে কয়েকবার হ্যালো, হ্যালো করলো। উত্তর না পেয়ে বুঝলো কল কিছুক্ষণ আগেই কেটে গেছে। নীলা এবার আয়ন্তির দিকে তাকালো। শূন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
–“কে ছিলো? এভাবে আছিস কেন?”
–“আব্বু কল দিয়েছে।”
–“কেন?”
–“রেডি হয়ে থাকতে বললো।”
চমকালো নীলাও। কী চলছে নুরুল আলমের মনে? নুরুল আলম আসতেই দু’জনে রেডি হয়ে দাঁড়ালো। নুরুল আলম আয়ন্তির ব্যাগ হাতে নিতে গেলে আয়ন্তি তাকে থামিয়ে দেয়৷ পিটপিট করে নুরুল আলমের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“এসব কী হচ্ছে আব্বু?”
আলতো হাসলেন নুরুল আলম। হাসি বজায় রেখেই উত্তর দিলেন,
–“তোমার শর্ত কবুল হয়েছে মামুণি।”
আয়ন্তি এবং নীলা চরম বিস্ময়ের সাথে একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলো। নুরুল আলমের কথা কারো-ই বুঝতে বাকি নেই। আয়ন্তি যেন স্বপ্ন দেখছে। কী হলো ব্যাপারটা? সত্যি, নাকি ভ্রম? নুরুল আলম মুচকি হেসে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে পরলো। আয়ন্তি এবং নীলা ধীরে-সুস্থে বের হলো। বের হতেই চোখের সামনে পরলো মাহবিন এবং রিহাবকে। মাহবিন পিটপিট করে আয়ন্তির দিকে তাকালো।
–“কোথায় যাচ্ছো?”
নীলা রিহাবের দিকে তাকালো। রিহাব অন্যদিকে ফিরে আছে। চোখ জোড়া এখনো ফুলে আছে তাঁর। নীলা চোখ নামিয়ে ফেললো। আয়ন্তি মাহবিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“বাড়ি যাচ্ছি।”
হঠাৎ-ই আয়ন্তির বক্ষঃস্থলে শূণ্যতা অনুভব হলো। আবারও মাহবিনকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে বহুদূর। আর কাছাকাছি থাকা হবে না, প্রাণভরে মাহবিনকে দেখা হবে না। বিরহ শব্দটি কেন এতটা অসহনীয়? যন্ত্রণাদায়ক? আয়ন্তির মস্তিষ্ক উত্তর দিকে ব্যর্থ। মুহূর্তে-ই ছলছল করে উঠলো আয়ন্তির চোখ জোড়া। দ্রুত নজর নামিয়ে ফেলে সে। বুকের বা পাশটা চিনচিন ব্যথা করছে বড্ড। মাহবিন নিরবে আয়ন্তির দিকে তাকিয়ে বলে,
–“ঠিকাছে। সাবধানে যাও।”
আয়ন্তি থমকালো। যেন এরকম উক্তি আশা করেনি। তার প্রত্যাশা যেন ছিলো অন্যকিছু। হুঁ হুঁ করে উঠলো আয়ন্তির সমস্ত বক্ষঃস্থল। কান্না’রা দলা পাকিয়ে আসছে। কেন মাহবিন বুঝে না? কেন মাহবিন তাকে বোঝার চেষ্টা করেনি? আয়ন্তি নিজেকে অসম্ভব সামলে বললো,
–“আসছি।”
–“যাও।”
আয়ন্তি দাঁড়ায় না। দ্রুত ছুটে চলে যায়। হয়তো নিজের কান্না চেপে রাখতে ব্যর্থ সে। নীলা মাহবিনের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি দিয়ে বলে,
–“আসি ভাইয়া।”
এবার রিহাবের দিকে তাকালো নীলা। কিছুক্ষণ শূণ্য নজরে তাকিয়ে ভাঙ্গা গলায় বললো,
–“আসছি রিহাব। ভালো থাকবেন।”
নীলাও চলে গেলো। রিহাব নিরবে নীলার চলে যাওয়া দেখলো। মুখ ভার তাঁর। মাহবিন ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে রিহাবের উদ্দেশ্যে বললো,
–“আমার লাগেজ গোছাতে হেল্প কর। আমাদের বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে।”
—————-
বাড়িতে ফিরতেই আয়ন্তি চমকালো। ভীষণ চমকালো। একপ্রকার সারপ্রাইজড হয়ে গেলো বলা যায়। নিলয় এবং মেঘা এই বাড়িতে অবস্থান করছে!! আয়ন্তি খুশিতে গদগদ হয়ে পরলো মুহূর্তে। নুরুল আলম মেয়ের পানে তাকিয়ে রয় অনিমেষ। এতদিনের হাহাকার করা বক্ষে আজ তৃপ্তিদের মেলা বসেছে। সেই মেলায় ভীড় জমিয়েছে অসংখ্য তৃপ্তি এবং ভালোবাসার সম্ভার। আয়ন্তি অস্ফুট স্বরে “ভাইয়া” বলে নিলয়ের দিকে ছুটে গেলো। নিলয় হাসিখুশি হয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। আয়েশার মুখেও হাসি, সে বর্তমানে মেঘাকে আগলে বসে আছে। অসম্পূর্ণ পরিবার আজ হাসি-খুশিতে পূর্ণ। প্রাণহীন বাড়িটায় আজ অট্টহাসি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, হাসি’রা চারিপাশে বিচরণ করছে। আজ বাড়িটি মোটেও প্রাণহীন লাগছে না। সতেজ হয়েছে যেন এই বাড়ি। নুরুল আলমের চোখের কোণে ভিঁজে উঠেছে। সে আজ সবচেয়ে সুখী মানুষ। এরকম একটা দিনের জন্যে কতরাত ছটফট করেছে, তার কোনো হিসেব নেই। কী হতো নিজের সকল ইগো, আত্মসম্মান, দাম্ভীকতা সব ঝেড়ে ফেললে? পরিবারের কাছে এরা সবসময়ই মূল্যহীন। এই মূল্যটা নুরুল আলম বুঝেছে দেরীতে। সে অনুতপ্ত, তাঁর কাজ তাকে ভীষণ নিচু করে ফেলেছে।
নীলা পিটপিট করে সবটা দেখছে। আজ তাঁর মুখে হাসি। দুঃখ নেই সেই হাসিতে। কেন যেন আজ নিলয় এবং মেঘাকে দেখে তাঁর ভেতরে ক্ষ’ ত তৈরি হচ্ছে না। নীলার হাসি নিমিষেই মিলিয়ে গেলো। কেন? কেন নিলয়কে দেখে আগের মতো অনুভব হয় না? হঠাৎ কী হলো নীলার? গাঢ় চিন্তায় পরে গেলো যেন।
পরিবার পূর্ণ হিসেবে এবং বেবি আসার উপলক্ষে পরেরদিন রাতে একটি পার্টি রাখা হলো। বেবি শাওয়ার পার্টি। সেই পার্টিতে প্রথমবারের মতো মেঘার বাবা-মা এলেন। নুরুল আলম এবং আয়েশার সাথে ওরা পরিচিত হলো। মেঘার মুখ থেকে যেন হাসি আজ সরছেই না। তাঁর সাথে তাঁর আত্নীয়রাও এই বাড়িতে প্রবেশ করেছে। কী যে সুখী লাগছে নিজেকে। মেঘা নড়াচড়া বেশি করছে দেখে আয়ন্তি হেসে বলে,
–“থামবে তুমি ভাবী, মেক-আপটা তো ঠিকমতো করতে দাও। পরে আমার ফুপির আম্মুকে ভূতনির মতো দেখাবে। এটা কী হয় বলো তো?”
মেঘা ফিক করে হেসে দিলো। আয়ন্তিও হেসে মেঘাকে সাজাতে মনোযোগী হলো। আয়ন্তি উপরে দিয়ে হাসলেও তার ভেতরটা ভালো নেই। ভীষণ পু’ ড়ছে তার ভেতরটা। কারণ একটাই। বিরহ। দ্বিতীয়বারের মতো বিরহ আয়ন্তি সইতে পারছে না একদম। কোথাও ভীষণ চিনচিন করছে তাঁর। মাঝেমধ্যে নিঃশ্বাস নিতেও সমস্যা হচ্ছে তাঁর। তাও পরিবারের মানুষগুলোর জন্যে নিজের ব্যথা লুকিয়ে রেখেছে। হয়তো রাত বাড়লে সেই ক্ষ’ত গুলো সপ্তপর্ণে বেরিয়ে আসবে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো আয়ন্তি।
কিছুক্ষণ পর মেঘাকে নিয়ে বেরুলো আয়ন্তি। আয়ন্তির সাথে নীলাও ছিলো। কিন্তু নীলার কল আসতেই সে দূরে চলে গেলো। আয়ন্তি মেঘাকে নিলয়ের হাতে শপে দিয়ে বললো,
–“নিন ভাইজান। আপনার বউ-বাবুকে আপনি সামলান। আপাতত আমার দায়িত্ব শেষ।”
নিলয় হাসলো। মেঘার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকালো। নিলয়ের সেই চাহনিতে মেঘা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো। আয়ন্তি ওদের চোখে চোখে প্রেম দেখে সরে আসলো। ভীষণ সুন্দর লাগছে দু’জনকে। হঠাৎ সামনে তাকাতেই আয়ন্তি চমকে ‘থ’ মেরে দাঁড়ালো। চোখ জোড়া যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। বিস্ময়ে একবার চোখ কচলালো। যদি ভুল দেখে, তাই। কিন্তু না, তার দৃষ্টিভ্রম হয়নি। সঠিক দেখছে। তার থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে মাহবিন। তাঁর চেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে নুরুল আলম বেশ হেসে খেলে মাহবিনের সাথে কথা বলছে। বিস্ময়ে আয়ন্তি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো। নুরুল আলম মেয়েকে দেখতেই এগিয়ে এলেন। হাসি বজায় রেখে বললেন,
–“আমার মামুণিকে আজ ভীষণ প্রিটি লাগছে।”
আয়ন্তি মিষ্টি হেসে মাহবিনের দিকে তাকালো। মুহূর্তে-ই চোখাচোখি হয়ে গেলো। মাহবিন নজর সরিয়ে ফেলতেই আয়ন্তি হেসে বাবার উদ্দেশ্যে বললো,
–“থ্যাঙ্কিউ আব্বু। আচ্ছা, মাহবিন এখানে..”
–“ভালো কথা। তোমায় জানাতে ভুলে গেছিলাম। মাহবিন আমার বিজনেস পার্টনার। ছেলেটা ভালো। সব দিকেই তার যত্নশীল। ওয়াসিফের বন্ধু হয়েও ওদের মধ্যে কতো পার্থক্য। আকাশ-পাতাল পার্থক্য। ভাবতে পারছো?”
আয়ন্তির বিয়ে ভাঙ্গার পরপরই নুরুল আলম বেশ খোলামেলা হয়েছেন মেয়ের সাথে। মেয়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেন এখন। দাম্ভীকতা নেই তার আচরণে।
নুরুল আলমের বলা আকাশ-পাতাল পার্থক্য তো বাদ। আয়ন্তি নিজে আকাশ থেকে পরলো নাকি জমিন থেকে বের হলো বুঝে উঠতে পারলো না। শেষমেষ মাহবিন তার-ই বাবার বিজনেস পার্টনার?
—
নীলা কথা শেষ করতেই তার পেছন থেকে কেউ বলে ওঠে,
–“এ বাড়ির ছাদটা কোন দিকে বলতে পারবেন?”
পরিচিত পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে নীলা চমকে পিছে ফিরে তাকালো। রিহাব! নীলাকে দেখে রিহাবও সমানভাবে বিস্মিত। হয়তো নীলাকে সে এক্সেপ্ট করেনি। নীলা অবাক মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,
–“আপনি?”
–“আমারও তো একই প্রশ্ন। তুমি এখানে দ্যাট মিন, আয়ন্তিও এখানেই?”
–“থাকাটা তো অসম্ভব কিছু না। এটা আয়ন্তিদের বাড়ি।”
–“ও মাই গড!”
নীলা নিরবে রিহাবের বিস্মিত মুখশ্রী দেখছে। এর মানে রিহাব নিজেও জানে না এসবের ব্যাপারে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। আলতো হেসে বললো,
–“ছাদে যেতে চেয়েছিলেন না? আসুন আমার সাথে।”
রিহাব এদিক সেদিক দৃষ্টি বুলিয়ে ইতস্ততার সাথে নীলার পিছু নিলো। শায়লা আপাতত আয়ন্তির সাথে কথা বলতে ব্যস্ত।
–“বিয়ে করতে পারবেন আমায় রিহাব?”
রিহাব চমকে নীলার দিকে তাকালো। নীলা ভাবলেশহীন হয়ে অদূরে তাকিয়ে আছে। দমকা হাওয়া নীলার উম্মুক্ত চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। রিহাবের কোথাও খুব শান্তি অনুভব হলো। ভালো লাগছে তার, নীলাকে এভাবে দেখে। নীলা আবারও বললো,
–“আমি জানি না আপনি আমায় ভালোবাসেন কি না, তবে একজন জীবনসঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। মানসিক শান্তি, মানসিকভাবে উৎসাহ দেবার মতো।”
রিহাব নীলার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে বলে,
–“তুমি আমার মানসিক শান্তি নীলা। তোমায় দেখলে আমি আমার ক্ষ’ তগুলো ভুলে যাই। এইযে, তোমার এই রূপ আমায় ঘায়েল করছে। নিবিড়ভাবে আমায় প্রশান্তি দিচ্ছে। কিন্তু তুমি তো আমায় ভালোবাসো না। ইভেন সহ্য-ই করতে পারো না। তাহলে সোজা বিয়ের কথা উঠালে যে? শান্তি পাবে কী আমার সাথে? বিয়ে হচ্ছে পবিত্র বন্ধন। সেই বন্ধনে জড়ানো দু’জন মানুষের আত্মার মিল হতে হয়।”
নীলা হাসলো। হাসি বজায় রেখে বললো,
–“জানেন রিহাব। কিছু মানুষের জন্যে আমার জীবন থেমে গেছিলো। আমি ভেবেছিলাম তাদের স্মৃতিচারণ করেই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিবো। কিন্তু না। সময় আমার সিদ্ধান্ত বদলে দিলো, আমার অতীত আছে রিহাব।”
বলেই নীলা তার অতীত খুলে বললো। রিহাব স্তব্ধ সবটা শুনে। নীলা হেসে বলে,
–“আমি চাইনি আপনি এসব জানা থেকে বঞ্চিত হন। তাই আমি নিজ উদ্যোগে আপনাকে সবটা জানালাম৷ আমি চাই না আপনাকে ঠকাতে। এখন মতামতটা আপনার উপর নির্ভরশীল। আসছি।”
নীলা চলে যেতে নিলে রিহাব নীলার হাত ধরে হেঁচকা টান দিলো। নীলা টাল সামলাতে না পেরে সোজা রিহাবের বুকে গিয়ে পরলো। থরথর করে কেঁপে ওঠে মুহূর্তে-ই। বিস্মিত চাহনি নিক্ষেপ করে রিহাবের পানে। রিহাব নীলার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে বলে,
–“বিয়ের তারিখ ঠিক করবো না? এভাবে চলে গেলে হবে?”
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।