অতঃপর_দুজনে_একা -২২,২৩

0
875

#অতঃপর_দুজনে_একা -২২,২৩
লাবিবা ওয়াহিদ

————————
ওটি থেকে বাচ্চার কান্নাসুর ভেসে আসছে। চিন্তায় বিধ্বস্ত নিলয়ের যেন ধ্যান ভাঙলো সেই শব্দ শুনে। শুধু নিলয়ের কানেই নয় বরং ওটির বাইরে উপস্থিত সকলের কানে সেই কান্নারত সুর প্রবেশ করেছে। আয়ন্তি চিকচিক চোখে একপলক নিলয় তো আবার ওটির দিকে তাকাচ্ছে। উপস্থিত সকলের মধ্যে কম-বেশি উল্লাস দৃশ্যমান। চিন্তায় ব্যাকুল হওয়া কম-বেশি সকলের মুখেই ফুটেছে হাসির রেখা। শুধু হাসি নেই নিলয়ের অধরে। মেঘাকে নিয়ে চিন্তিত সে। মেঘা সুস্থ তো? সেই চিন্তায় এখনো কপালে ভাঁজ বিদ্যমান। হয়তো এটাই ভালোবাসা। মাহবিন আয়ন্তির কাঁধে হাত দিতেই আয়ন্তি ঘাড় বাঁকিয়ে পিছে ফিরে তাকালো। মাহবিন চোখ দিয়ে আশ্বাস দিয়ে জানায়,
–“হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে-ই ডক্টর বেরিয়ে আসবে।”

হলোও তাই। কিছুক্ষণ বাদে নার্স শুভ্র তোয়ালে মুড়ানো সদ্য ধরনীতে আগমন করা এক পরীকে কোলে করে নিয়ে আসলো৷ তার কান্না এখনো থামেনি। নার্সের চোখে-মুখে খুশির ঝলক। নার্সের পেছনে আসছেন ডক্টর। নার্স নিলয়ের কোলে ফুটফুটে পরীকে দিয়ে হাসি হাসি মুখে বলে,
–“অভিনন্দন। আপনি কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন। আপনার ওয়াইফও ভালো আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে কেবিনে শিফট করা হবে।”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো নিলয়। যেন বুকের ওপর থেকে বিরাট বড়ো পাথর নেমে গেছে। নিলয় অপলক নয়নে তার ছোট্ট পরীকে দেখতে লাগলো। ছোট্ট পরী কান্নায় ব্যস্ত। নিলয়ের খুশিতে চোখের কোণ ভিঁজে গেলো। কত কষ্টের ফল সে। আগেরবার একজন কে হারিয়ে তাকে পেলো। নিলয় বাবা হলো। বাবা হওয়ার অনুভূতিটা সত্যি প্রকাশ করার মতো নয়। গোল হয়ে সকলে নিলয়কে ঘিরে ধরেছে। সকলেই নতুন অতিথিকে দেখার জন্যে ব্যাকুল। নুরুল আলম ডক্টরের সাথে কথা বলছেন। মাহবিন আয়ন্তির কানে ফিসফিস করে শুধায়,
–“আই উইশ, আমাদেরও এরকম একটি পরী আসুক। বাকিটা আল্লাহ্’র ইচ্ছা।”

মাহবিনের এমন শীতল কন্ঠস্বর শুনে আয়ন্তি শিউরে ওঠে। পরমুহূর্তে মাহবিনের এরূপ ইচ্ছা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যায়।

——————
আজ নিলয়ের মেয়ে নিফতাহার পাঁচ দিন চলছে। আজ রিয়নের এঙ্গেজমেন্ট। রিয়নের মায়ের পছন্দেই বিয়েটা হচ্ছে। রিয়ন না করেনি। সে নিরবে মেনে নিয়েছে। আয়ন্তি এখন তাঁর ধরাছোঁয়ার বাইরে। চাইলেও আয়ন্তিকে সে ছুঁতে পারবে না, চাইতে পারবে না। সব পথ যে বন্ধ। একমাত্র পথ খোলা আছে এবং তা হচ্ছে মা-বাবা। তাই তাদের জন্যে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতেই হলো। এই দু’জন মানুষ এক বোনের জন্যে কম কষ্ট পায়নি। রিয়ন সেজন্য তাদের পুরানো ক্ষত তাঁজা করতে চায়নি। মেনে নিয়েছে ভাগ্যকে। মেনে নিয়েছে সব।

এঙ্গেজমেন্টে আয়ন্তি, আয়েশা এবং মাহবিন এসেছে। নীলাও আসতো, তবে তার টেস্ট থাকায় সে আসতে পারেনি। নুরুল আলম কাজে বিজি। নিলয়ও মেঘাকে ফেলে আসতে পারে না। তাই সেও আসতে পারেনি। এঙ্গেজমেন্টে বেশ আপ্যায়ন হলো ওদের। রিয়নের হবু বউও বেশ সুন্দরী। আয়ন্তি যেন বেশ খুশি তাকে ভাবী হিসেবে পেয়ে। মাহবিন রিয়নের কাঁধ চাপড়ে বলে,
–“তুমি রাজী আছো তো?”

রিয়ন শুকনো হাসি দিলো৷ হেসেই জবাব দিলো,
–“বিকল্প পথ নেই, ভাগ্যকেই মেনে নিয়েছি।”
মাহবিন একপলক রিয়নের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো।
–“গুড লাক ফর ইওর নিউ লাইফ।”

——————
আজ মাহবিন এবং আয়ন্তিদের হলুদ কমপ্লিট হলো। সম্পূর্ণ ঘরোয়া আমেজে হয়েছে সবটা। বিয়েটাও হবে ঘরোয়া ভাবে৷ মসজিদে। এটা অবশ্য মাহবিন চায়। বিয়েটা সেরে গেলে বড়ো কমিউনিটি সেন্টারে অতিথিদের খাওয়া-দাওয়া হবে। তবে বউ থাকবে নিজ বাড়িতে। বেশ পরিকল্পনা মাফিক-ই বিয়েটা হচ্ছে। আয়ন্তি তো অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। সম্পূর্ণ বিয়েটাই ইসলামিক রীতিতে করতে চাইছে সে। আয়ন্তিকেও সাজিয়ে পরপুরুষদের সামনে রাখতে একদম নারাজ সে। আজকাল কয়টা বিয়ে এরকম করে হয়? নুরুল আলম মাহবিনের প্রস্তাবে কিছুটা এদিক সেদিক করলেও পরবর্তীতে নিলয়ের কথায় রাজি হয়ে যায়। নিলয়ও অত্যন্ত সন্তুষ্ট মাহবিনের এরূপ বিচার-বিবেচনায়। এছাড়া নিলয়ের মেয়ে নিফতাহাও সবে একুশ দিনের। চাইলেও এত অতিথি নিয়ে মেঘা দৌড়াদৌড়ি করতে পারবে না। ক্লান্ত হয়ে আয়ন্তি ঘুমিয়ে পরেছিলো। সকালে উঠেই দেখে মাহবিনের সাতটা মিসড কল। সময় চেক করে বুঝলো আয়ন্তি ঘুমিয়ে যাওয়ার পরপরই কল করেছে। হয়তো বুঝতে পেরেছে আয়ন্তি ঘুমে কাত। পরবর্তীতে আর কল আসেনি। তাও আয়ন্তি ফিচেল হাসি দিয়ে মাহবিনকে মেসেজ পাঠায়,
–“গুড মর্নিং জামাই মশাই।”

এখন বাজে সকাল ন’টা। আয়েশার ঘ্যানঘ্যানানির জন্যে আয়ন্তিকে উঠতে হয়েছে। কিসের নিয়ম নাকি আছে সেসব পালন করে গোসল সারতে হবে। মাহবিন নিশ্চয়ই এখনো ঘুমোচ্ছে। নয়তো সাথে সাথেই রিপ্লে আসতো। নীলা আয়ন্তির পাশেই ঘুমিয়ে আছে। বেচারী নীলারও উঠতে হয়েছে। নীলা চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম জড়ানো কন্ঠে আওড়ায়,
–“ভাই, বিয়ে তোর! আর পেরাশানি আমাদের সকলের। এটা মানা যায়? ঘুমিয়েছি কত রাত করে, এইটুকুনি ঘুমে হয়?”

আয়ন্তি আলতো হেসে বলে,
–“বিয়ে খেতে এসেছিস, একটু আকটু নাহয় কাজ কর। সারাদিন বসে বসে খেলে তো ফুলে যাবি। তখন তুই সোফায় বসে থাকলে রিহাব বলবে ওটা তুই নয় বরং কেউ আটার বস্তা রেখে দিয়েছে।”

নীলা বালিশ দিয়ে আয়ন্তির পিঠে এক ঘা লাগালো। আয়ন্তি ঘর কাঁপিয়ে হেসে দ্রুত ছুটে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো। শুভ্র হাতজোড়া মেহেদীর গাঢ় রঙে আবৃত। নীলা একমনে আয়ন্তিকে গা’ ল-মন্দ করেই চলেছে। কিছুক্ষণ বাদে আয়েশা আসতেই নীলাকে ওই অবস্থায় জোর করে নিয়ে গেলো। বেচারী নীলা পরেছে কাজের চিপায়। ফোনটাও আনতে পারেনি। যদি রিহাব ফোন দেয়? রিহাবের তো আবার ফোন দেয়ার স্পেসিফিক সময় নেই। সাহেবের যখন ইচ্ছা হবে তখন কল দিবে। এ নিয়ে অবশ্য নীলার কম ঝা’ড়ি খায় না সে। রিহাব সবসময় একটি কথা-ই বলে,
–“তোমায় মিস করার জন্যে নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয় না নীল পাখি।”
নীলা অবশ্য সেই এক বাক্যেই বরফের ন্যায় গলে যায়। তখন সর্বাঙ্গ জুড়ে খেলে যায় সুমধুর প্রশান্তি।

দুপুর থেকেই শুরু হয় বউ সাজানোর ব্যস্ততা। পার্লারের মেয়েদের আনা হয়েছে। সম্পূর্ণ ব্রাইড সাজ দেয়া হয় আয়ন্তিকে। তবে হ্যাঁ, সাজানোর আগেই বিয়ে সম্পূর্ণ হয়। যোহরের পরপরই বিয়ে পড়িয়েছে। কবুল বলা শেষ হতেই আয়ন্তিকে সাজানো শুরু হয়েছে। আয়ন্তি বিশ্বাস করতে পারছে না যে সে মাহবিনের বউ হয়ে গিয়েছে। একসময় ভেবেছিলো মাহবিন তার একতরফা ভালোবাসা, এখন মাহবিন তার বর। সত্যি-ই সময় কখন মানুষকে কোথায় নিয়ে গিয়ে পৌঁছায় সেটা এক উপরওয়ালা ব্যতীত কেউ জানে না। তানজিলা তো একটু পরপর হাসতে হাসতে আয়ন্তিকে “মাহবিন ভাইয়ের বউ” বলে বলে খোঁচাচ্ছে। আয়ন্তি উপরে উপরে চোখ রাঙালেও তার গালজোড়া রক্তিম আভায় বিস্তৃত। এ নিয়েও সকলের মশকরার শেষ নেই। মেঘা নিফতাহাকে নিয়ে আয়ন্তির রুমে-ই অবস্থান করছে। ছোট্ট পরীটা পিটপিট করে চারপাশের সকলকে দেখছে। আবার কিছুক্ষণ পরপর চোখ বুজে ঘুমিয়েও পরছে। কোলাহলে তার মনোযোগ নেই। সে নিজের মতো থাকতেই ব্যস্ত। কয়েকবার সাজ-সজ্জার মাঝে দিয়ে অবশ্য আয়ন্তি দু’একবার নিফতাহার কাছে এসেছে। নিফতাহাকে যতবার দেখছে ততবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে আয়ন্তির। মন ভরে কাঁদতেও পারছে না৷ আয়েশা কিছুক্ষণ পরপর-ই ঘরে দরজা আটকিয়ে গিয়ে কাঁদছে৷ এই খবর আয়ন্তি ঠিকই পেয়েছে। এই মিষ্টি পরিবার ছেড়ে, তার স্মৃতিতে মোড়ানো বাড়ি ফেলে চলে যেতে হবে সারাজীবনের জন্যে। এই ব্যথা যদি বক্ষ কে’ টে সবাইকে দেখাতে পারতো যে বিদায়বেলায় একটি মেয়ের কতটা কষ্ট হয়, কতটা তাঁর ফাটে। মেঘা বারবার আয়ন্তিকে কাঁদতে নিষেধ করছে বিধায় আয়ন্তি দমে আছে। এছাড়া কাজিনদের ফাইজলামিতে আয়ন্তি না চাইতেও হেসে ফেলছে।

মাহবিন আপাতত কমিউনিটি সেন্টারে আছে। সেখানের মেহমানদের দেখাশোনা করছে। আয়ন্তিকে নিতে আসবে সন্ধ্যার দিকে। নুরুল আলম, রিয়ন এবং আমিরও সেখানে। শুধু নিলয় বাড়িতে আছে। আয়ন্তি বউ সেজে তার রুমে বসে আছে। তাকে ঘিরে আবার বসেছে আয়ন্তির কাজিন মহল এবং বান্ধুবী’রা। বড্ড অস্থিরতায় ভুগছে সে। রিয়ন কিছুক্ষণ আগেই তাঁর সাথে দেখা করেছে। আয়ন্তির দিকে পলকহীন তাকিয়ে অধরে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলেছে,
–“খুব সুন্দর লাগছে রে তোকে আয়ন্তি।”

আয়ন্তি কয়েক মুহূর্তের জন্যে চমকে গেছিলো। কারণ, রিয়নের গলা শোনাচ্ছিলো একদম অন্যরকম। তবে পরমুহূর্তে এ বিষয় নিয়ে খুব একটা ঘাটেনি।

——————-
–“স্বাগতম কুইন, তোমার আমার একান্ত রাজ্যে।”

আয়ন্তি গাড়ি থেকে নেমে অবাক নয়নে সজ্জিত বাড়িটিকে দেখছে। মাহবিনের কথায় লাজুক হেসে বলে,
–“কিন্তু আমার যতটা মনে পরছে এটা তো আপনার আগের বাড়ি না।”
–“ঠিক ধরেছো। আসলে আগের বাড়িটার প্রতিটা কোণায় কোণায় বিষাদ এঁটে ছিলো। তাই আমি চাইনি আমার নতুন জীবনটা বিষাদকে সাথে নিয়ে শুরু করতে।”

আয়ন্তি আর প্রশ্ন করলো না। মাহবিনের অতীত সম্পর্কে সে জানে। মাহবিন নিজ উদ্যোগেই বলে দিয়েছে সেই প্রথমেই। অতীত শোনার পর মাহবিনের প্রতি আরও কয়েক ভাগ দুর্বল হয়ে পরেছে আয়ন্তি। এখন তো কোনক্রমেই মাহবিনকে ছাড়া থাকতে চায় না সে।

বিয়ের প্রথম রাত মূলত বাসর রাত। আজও ব্যতিক্রম নয়। ফুলে, ফুলে সজ্জিত মাহবিনের রুম। চারপাশ ফুলের সুগন্ধীতে মৌ মৌ করছে। কী মন মাতানো সেই ঘ্রাণ। আয়ন্তি এখন ফুলে আবৃত বড়ো বিছানাটির মাঝখানে বসে আছে। তাঁর গর্জিয়াস লাল লেহেঙ্গাটি চারপাশে গোল হয়ে বিস্তৃত। আয়ন্তির মনে কাজ করছে অদ্ভুত ভয়, আতঙ্ক এবং জড়তা। অস্থিরতায় যেন দমটাই বেরিয়ে যাবে তার। খোলামেলা রুমটাতেও অস্বস্তিতে তার দম আটকে আসছে। অদ্ভুত অনুভূতি এবং লাজ তাকে সূর্যমুখীর ন্যায় নুইয়ে ফেলছে। সময় যত গড়াচ্ছে আয়ন্তি তত-ই গুটিশুটি মেরে বসছে। আজ এত লাজে’রা উদয় হলো কোথা থেকে? আয়ন্তির ভাবনার মাঝেই দরজা খোলার শব্দ শোনা গেলো। শব্দটা একটু বেশি ছিলো। যেন ওপারের মানুষটি তাঁর উপস্থিতি জানান দিতে চায়। আয়ন্তি জানে মানুষটি কে। মানুষটির পদচারণের শব্দ আয়ন্তির কর্ণধারে নিবিড়ভাবে প্রতিধ্বনিত। অন্তর কেঁপে উঠলো আয়ন্তির। হৃদপিন্ড ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঢিপঢিপ শব্দ করেই চলেছে। সে কী অস্থিরতা। মাহবিন আসতে আসতে বিছানার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। আয়ন্তি মাথা না উঠিয়েই কোণা চোখে একপলক মাহবিনকে দেখে নিলো। আপাতত মাহবিনের কোমড় এবং পা জোড়া ব্যতীত কিছুই দেখলো না। হাঁটু পর্যন্ত বিয়ের শেরওয়ানি জড়িয়ে আছে। আজ যেন মাথা উঠিয়ে মাহবিনের দিকে তাকাতেও তার লজ্জা লাগছে৷ নিঃশ্বাস গতি ক্রমাগত বাড়ছে তাঁর। মাহবিন আয়ন্তির দিকে একমনে তাকিয়ে বলে,
–“তাকাবে না?”

আয়ন্তি নড়েচড়ে বসলো শুধু। জানান দিলো আয়ন্তি তাঁর কথা শুনেছে বটে তবে কথা রাখতে পারবে না। মাহবিন হাসলো। ফিচেল হাসি। হাতের মোটা খামটা নিয়ে সপ্তপর্ণে বসলো মুহূর্তে-ই হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি তীব্র মাত্রায় বেড়ে গেলো। কথারাও যেন গলাতেই আটকে রইলো। মাহবিন হাতের খামটি বেডবক্সের উপর রাখতে রাখতে বললো,
–“দেনমোহর এটাতে আছে। তুমি চাইলে পরোখ করে নিতে পারো।”

আয়ন্তি ফিরেও তাকালো না সেই দেনমোহরের দিকে। ঘাড় বাঁকাতেও ইতস্ততায় জমে যাচ্ছে। মাহবিন চাইলো আয়ন্তি শান্ত, স্বাভাবিক হোক। আজকের রাতটা স্মৃতির পাতায় নিবিড়ভাবে খোদাই করতে চায় সে। মাহবিন একবার জানালা ভেদ করে বাহিরে তাকালো। ওইতো, চাঁদের দেখা মিলেছে। মাহবিন স্মিত হাসলো। আয়ন্তির উদ্দেশ্যে বললো,
–“চন্দ্রবিলাস করবে?”

আয়ন্তি গলায় কথা গুলালো। আমতা আমতা করে বললো,
–“করা যায়।”
–“তাহলে বারান্দায় চলো। খুব সুন্দর পরিবেশ। তোমার হালকা লাগবে।”
আয়ন্তি বারণ করলো না। বরং রাজি হলো। মাহবিন উঠে দাঁড়ালে আয়ন্তি ধীরে-সুস্থে বিছানা থেকে নেমে পরে। মাহবিন তাকে সাহায্য করলো। লেহেঙ্গা অতিমাত্রায় বড়ো। লেহেঙ্গায় পা পরে উষ্টা খাবার সম্ভাবনা আছে। তাই মাহবিন এক পাশ দিয়ে আয়ন্তির লেহেঙ্গা ধরে রাখলো। দু’জন বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। কিছু সময় তাকিয়ে রয় আকাশের পানে। সময় আরও কিছুটা অতিক্রম করতেই হঠাৎ মাহবিন আয়ন্তিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আয়ন্তির সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো প্রেমিক পুরুষের স্পর্শে। মাহবিনের খোঁচা খোঁচা গাল আয়ন্তির গালে ঘঁষলো। আলতো করে। আয়ন্তি থরথর করে কেঁপে মাহবিনের বুকে মাথা এলিয়ে দিলো। শরীরের ভারটাও ছেড়ে দিলো মাহবিনের উপর৷ মাহবিনের স্পর্শে যেন সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে এসেছে। মাহবিন সেই অবস্থায় আকাশের পানে তাকিয়ে বলতে লাগে,
–“তোমায় কবে দেখেছিলাম জানো? ওয়াসিফের সাথে যখন প্রথম তোমার বাসায় গেলাম। তোমাদের সেই বাগানে গেলাম, তখন উপরের দিকে তাকাতেই বারান্দাতে তোমায় দেখতে পাই। আমি জানতাম না তুমি-ই ওয়াসিফের হবু বউ। তাই ভুল হয়ে যায় আমার থেকে। চরম ভুল। প্রেমে পরে যাই তোমার। সেই বারো মিনিটের দেখাতে তোমায় মগ্ন হয়ে গেছিলাম। পরে যখন জানতে পারলাম তুমি-ই ওয়াসিফের হবু বউ, তখনই ভেঙ্গে গুরিয়ে গেছিলো আমার মন। হাল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দুই রাত ঘুম হয়নি। বরাবরই চাপা স্বভাবের মানুষ আমি। আমার ভালো না থাকার খবর কাউকে জানাতে পারিনি। ওয়াসিফকেও না। না চাইতেও সেদিনের পর তোমায় ফলো করতাম, তোমার খোঁজ-খবর রাখতাম। পরে জানতে পারলাম ওয়াসিফ তোমায় আমার মতো করে ভালোবাসে না তখনই তোমায় জানালাম বিয়ে ভাঙ্গার কথা। আমার জন্যে এলো এক চান্স। তোমাকে পাওয়ার আশা খুঁজে পেলাম। এরপর থেকে আবারও নিজের মনকে প্রশান্তি দিতে তোমার পিছে ছুটলাম। যেভাবেই হোক, বিয়ে ভাঙলো। কিন্তু এলো বিরহ। তোমার নাম্বার থাকা সত্ত্বেও তোমায় কখনো কল করিনি। কী মনে করবে সেই ভেবে। অফিস থেকে ফেরার সময় দূর থেকে একবার দেখে আসতাম তোমায়। ওতেই আমার তৃপ্তি মিটে যেত।”

আয়ন্তির চোখ মুহূর্তে-ই ঝাপসা হলো। গড়িয়ে পরলো সেই অশ্রু চোখের কোণ বেয়ে। ভেঁজা কন্ঠে শুধায়,
–“অথচ খবর নিলেন না আমার মনের অবস্থা!”
–“নিতে চাইনি, দুটো কারণে। এক, তোমায় বিরক্ত করার জন্যে নির্দিষ্ট সময় পরিকল্পনায় ছিলো। আর দুই, তোমার মধ্যে যদি আমার প্রতি এক বিন্দুও অনুভূতি থাকে সেটা তুমি যেন বুঝতে পারো। কথায় আছে, বিরহে মানুষ তাঁর ভালোবাসার মানুষটির অভাব নিবিড়ভাবে অনুভব করতে পারে। তবে তোমার সেদিন জড়িয়ে ধরাতেই বুঝেছি আমার বারতি শক্তি ব্যয় করতে হবে না তোমার প্রতি।”
মাহবিন তাঁর বক্তব্য শেষ করতেই আয়ন্তির গালে নিবিড়ভাবে চুমু খেলো। আয়ন্তি কেঁপে উঠলো সেই স্পর্শে। নিঃশ্বাসের গতি আচমকা বেড়ে গেলো তার। এ কীরকম অনুভূতি? আয়ন্তির জানা নেই। আয়ন্তির নিকট এই অনুভূতি, স্পর্শ সম্পূর্ণ নতুন লাগলো যেন। মাহবিন আয়ন্তিকে নিজের দিক ফিরিয়ে নিলো। আয়ন্তির কপালে তাঁর অধর ছোঁয়ালো। আয়ন্তি শক্ত করে খামচে ধরে মাহবিনের হাত। শক্ত হয়ে জমে গেছে মাহবিনের অধরের স্পর্শে। মাহবিন আয়ন্তির মুখশ্রী জুড়ে অজস্র চুমু খেলো। আয়ন্তি বাঁধা দিতে গিয়েও ব্যর্থ হলো বারবার। ক্রমশ তার নিঃশ্বাসের গতি অসম্ভব বাড়ছে। মাহবিনের মাতাল করা স্পর্শে ম”‘রে যেতে ইচ্ছে করছে কেন? একসময় আয়ন্তির অধরজোড়া নিজ অধরের দখলে নিয়ে নিলো মাহবিন। পিলে চমকে উঠলো আয়ন্তির। দম গলায় আটকে রইলো। নিঃশ্বাস নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। মাহবিনের থেকে ছুটে পালাতে চাইলো। কিন্তু মাহবিন তার বলিষ্ঠ হাত লেহেঙ্গার ভেতর দিয়ে কোমড় ছুঁয়েছে। হাতের শক্ত বাঁধনে আয়ন্তি বন্দি। চেয়েও পালাতে পারলো না সেই স্পর্শ থেকে, মাহবিনের বাঁধন থেকে।
একসময় কীভাবে যেন মাহবিনের হাতের বাঁধন হালকা হলো। আয়ন্তি সেই সুযোগের সৎ ব্যবহার করে মাহবিনকে জোরে ধাক্কা দিলো। মাহবিন বেসামাল ভঙ্গিতে কিছুটা দূরে সরে যায়। আয়ন্তি সেই সুযোগে ছুটে রুমে আসে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে যেন। ঘনঘন নিঃশ্বাদ ফেলে এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালো। মাহবিন এর মাঝে রুমে চকে আসলো। চোখে ভয়ানক ঘোর। সেই চোখ জোড়ায় তাকিয়ে আয়ন্তি আঁতকে উঠলো। যেন সেই চক্ষু-দ্বয়ে স্পষ্ট তার বিনাস এঁটে আছে। মাহবিনের এগিয়ে আসা দেখে আয়ন্তি পেছাতে লাগলো। একসময় মাহবিন খপ করে ধরে ফেলে আয়ন্তিকে। মাহবিন নেশালো কন্ঠে বললো,
–“পালাচ্ছো কোথায়? আজ তো পারবে না আমার থেকে পালাতে। মিথ্যে শক্তি অপচয় করে কী লাভ বলো তো?”
আয়ন্তি আটকে গলায় বলে,
–“প্লিজ ছা..ছা..ছাড়ুন, আ..আমি ঘুঘু-ঘুমাবো।”
–“উহু, আমার আজ ঘুম পাচ্ছে না, তোমায় কী করে ঘুমাতে দেই বলো তো?”

আয়ন্তির উত্তরের অপেক্ষা না করে মাহবিন ফট করে তাকে কোলে তুকে নিলো। মুহূর্তে-ই আয়ন্তির পিলে চমকে উঠলো। বুঝতে পারলো, আজ তাঁর রক্ষা নেই।

———————-
মাহবিনের ফুপি হচ্ছে সৈয়দ আহমেদের একমাত্র আদরের বোন। তাঁর নাম তাসলিমা। মাহবিনের প্রতি সবসময়ই তাঁর আলাদা টান। মাহবিন তো ভালোবেসে তাকে দ্বিতীয় মা বলে ডাকতো। বড়ো হতে হতে প্রথম মায়ের স্থান-ই দিয়ে বসেছে। তাসলিমা ফুপির বিয়ে সন্তান থাকলেও মাহবিনকে কখনো-ই তাদের থেকে আলাদা চোখে দেখেনি৷ মাহবিনের মা থাকা সত্ত্বেও দূরে আছে বিষয়টা একদম মানতে পারেনি তাসলিমা ফুপি। তাইতো মমতায় কোনো কমতি রাখেনি সে। মাহবিনও একমাত্র তাঁর সাথেই সব কথা শেয়ার করে। তাসলিমা ফুপির ছেলে’রা যখন নানান কাজে ব্যস্ত তখন মাহবিন চকে আসতো তাকে সময় দিতে। এছাড়া তাঁর ছেলেরা এখন বিবাহিত। বউদের দেখবে নাকি মাকে? একপ্রকার অবহেলিত তাসলিমা ফুপি শুধু সুখ পেতেন মাহবিনের কাছে। ছেলেটা মন খারাপ করতেই দেয় না। মাহবিন অনেকদিন বলেছিলো যাতে মাহবিনের কাছে এসে পরে। তবে তাসলিমা ফুপির রুচি হয়নি সোনিয়া এবং শাকিলের সাথে একই ছাদের নিচে বসবাস করতে৷ এর চেয়ে ছেলেদের অবহেলায় থাকাও ভালো ছিলো তার জন্যে। আয়ন্তির কথাও বলেছে সেই অনেক আগে। তাসলিমা তো শুধু বারবার এক কথাই বলতো,
–“প্রস্তাব কবে গিয়ে দিতে হবে শুধু একবার বল! দেখবি তোর তাসলিমা ফুপি তোর সুখের জন্যে ঠিক কী করতে পারে!”

উত্তরে মাহবিন শুধু হাসলো। হাসি বজায় রেখে বলতো,
–“আমি জানি তোমার গুণ ফুপি। তুমি কোনোদিনও আমার খারাপ চাইতে পারো?”

এবার যেহেতু বউ নিয়ে নতুন বাড়িতে উঠেছে সেহেতু মাহবিন বেঁকে বসেছে এবং বলেছে, তাসলিমা ফুপি তাঁর সাথে না থাকলে মাহবিন ফুপির সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিবে। তাসলিমা ফুপি জানে মাহবিন যোগাযোগ বন্ধ করবে না। তাও সে মাহবিনের খুশির জন্যে একবারের জন্যে মাহবিনের কাছে চলে আসে। রিহাব, শায়লা, মাহবিন, আয়ন্তিকে নিয়ে তাঁর সময় ভালোই কাটবে।

এসব মধুর মুহূর্ত ভাবছেন এবং নাস্তা বানাচ্ছেন তাসলিমা। কাজের লোককে রান্নায় হাত লাগাতে দিলেন না তিনি। আয়ন্তির প্রথম দিন আজ। তাই তিনি নিজ হাতেই সব রান্না করলেন। রান্না শেষে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে কাজের খালার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,
–“কয়টা বাজে রে শান্তি?”
–“দশটা বাজে আপা।”
–“আচ্ছা, তুই নাস্তাগুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখ। আমি সকলকে ডেকে আনছি।”
শান্তি সম্মতি জানিয়ে কাজে মনোযোগ দিলো। তাসলিমা প্রথমে চলে গেলো মাহবিনের কামড়ার উদ্দেশ্যে।

আয়ন্তি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে ব্যস্ত। সবেই গোসল সেরে বেরিয়েছে। মাহবিন এখনো বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। আয়ন্তি একটু পরপর আয়না দিয়ে মাহবিনকে দেখে নিচ্ছে। গত রাতের মুহূর্তগুলোর কথা ভাবলেই আয়ন্তি লাল হয়ে যাচ্ছে বারবার। তার ভাবনায় ছেদ ঘটালো দরজার কড়াঘাত। আয়ন্তি দ্রুত গতিতে মাথায় ঘোমটা পরে দরজার দিকে ছুটলো। দরজা খুলতেই তাসলিমা ফুপিকে আবিষ্কার করলো আয়ন্তি। মুখে তার চওড়া হাসি।
–“উঠে পরেছো?”
আয়ন্তি লাজুক কন্ঠে বললো,
–“জ্বী।”
–“মাহবিন কোথায়?”
–“উনি ঘুমোচ্ছে।”
–“তোমার “উনি” কে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিচে এসো দ্রুত। নাস্তা রেডি।”

লজ্জায় রক্তিম হয়ে গেলো আয়ন্তি। তাসলিমা মুগ্ধ নয়নে আয়ন্তির মুখশ্রী দেখে হাসতে হাসতে চলে গেলো।

~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here