অতঃপর_মিঠিকথা-১৪,১৫,১৬,১৭,১৮
শানজানা আলম
১৪
-রেজা কোথায় তুমি, অফিসে যাওনি আজ?
–না, কে বললো তোমাকে মৌরিন?
–আন্টি বললেন, অফিসে যাওনি তো কোথায় আছো? আমাকে আগে বলতে, আমিও ছুটি নিতাম!
–অফিসে না যাওয়া মানে এই না যে আমার কাজ নেই, যাই হোক, আমি তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই!
–আমার সাথে, অবাক বিষয়, তুমি তো কথাই বলো না।
-হু, কক্সবাজার থেকে ফিরে আমার সাথে একটু বসবে, খুব জরুরি বিষয়।
–ফোনে বলো, আমার টেনশন হচ্ছে!
–মৌরিন, আমার মনে হয়, আমি এখন বিয়েটা করতে চাই না।
-মানে, হোয়াট এ জোক, তুমি বিয়ে করতে চাও না?
-জোক কেন হবে, আমি ভূমিকা করতে পারি না।
-রেজা আমাদের এনগেজমেন্ট বেশ আয়োজন করে হয়েছে, দু দিকের আত্মীয় স্বজন জানে, এখন এমন একটা কথা বলা কি রেসপনসেবলিটির পরিচয়?
-মৌরিন শোনো, আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী দু’দিন কথা বলবে, তারপর থেমে যাবে।
কিন্তু বিয়ের পরে যদি আমরা হ্যাপি না হই কেউ দেখতে আসবে না।
-রেজা তুমি আমার উপরে রাগ করেছো, ওইদিন হার্সলি কথা বলেছি বলে?
–না মৌরিন, তুমি কিছু ভুল করোনি, কিন্তু আমার এটিচুড ঠিক ছিল না। এই ঠিক না থাকাটাই প্রবলেম।
–রেজা আমার মনে হয় আমাদের নিজেদের একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন, এত দূরে দূরে থেকে, ফর্মালিটি মেইনটেইন করলে অধিকারবোধ জন্মাবে না, তখন আমার দাবিও তোমার অযৌক্তিক লাগবে।
–মৌরিন, আমি ভেবে চিন্তে তোমাকো বলছি, ফোনে সবটা বলা যায় না। সামনাসামনি হলে বুঝিয়ে বলতে পারতাম।
তুমি জোর করলে তাই বললাম, এই জোর করাটাও আমার ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে দম বন্ধ লাগছে।
সম্পর্ক হবে মুক্ত বাতাসের মতো। যেখানে নিঃশ্বাস নিয়ে শান্তি পাওয়া যাবে, উই আর নট ফর ইচ আদার।
–আমার সাথে তো তুমি মিশলেই না, এত দূরে থেকে কথাটা বলে দিলে!
-কে কার জন্য আর কে কার জন্য না এটা বুঝতে মিশতে হয়না মৌরিন।
এটাই একটা অলৌকিক ব্যাপার। কারো সাথে তুমি মিশলেই না, কিন্তু মানুষটা তোমার মনের কাছাকাছি চলে এলো, আবার একজীবন পাশাপাশি থেকেও দুজন দুজনার হতে পারে না। এই প্রাকটিস আমাদের দেশে বেশি দেখা যায়, স্বামী স্ত্রী একত্রে বছরের পর বছর থাকে, কিন্তু একে অপরের মনের নাগাল পায় না।
আমি চাইনা এমন হোক।
তোমার মতো স্মার্ট, কোয়ালিফাইড মেয়ে, তার জন্য নিশ্চয়ই পারফেক্ট ম্যাচ অপেক্ষা করছে, আই অ্যাম নট দ্যাট ওয়াট মৌরিন!
মৌরিনের কেমন যেন একটা ফাঁপা অনুভুতি হচ্ছে, রেজার জন্য এত তাড়াতাড়ি ভালোবাসা তৈরি হয়নি।
কিন্তু কি, একটা বিয়ের কথা হলে, এনগেজমেন্ট হলে একটা অধিকারবোধ আর সম্পর্ক অদৃশ্যভাবে তৈরি হয়।
প্রথম থেকেই রেজা একটু ফর্মাল ছিলো।
মৌরিনকে সারপ্রাইজ করার জন্য অথবা খুশি করার জন্য কিছু করেনি।
রেজার কি অ্যাফেয়ার ছিল? যাকে ও পায়নি?
ও এত রিসার্ভ থাকে, মনের কাছেও যাওয়া যায়না।
রেজাকে ফোনে না পেয়ে ওর মা কে ফোন করেছিলো মৌরিন।
তখনি শুনলে রেজা সকালে অফিসে যায়নি। রেজাকে ভালো না বাসলেও ভালো লাগে। মৌরিন ভেবেছিলো একসময় কাছাকাছি থাকতে থাকতে রেজাও মিশতে পারবে স্বাভাবিক ভাবে। এখন রেজা এটা কি বলছে, কি করবে মৌরিন, যে সম্পর্কে থাকতে চায় না তাকে আটকে রাখা কঠিন। আবার ছেড়ে দেওয়া মানে হেরে যাওয়া, সম্পর্কে ধরে রাখাও যোগ্যতা, সবাই ধরে রাখতে পারেনা।
আজকাল অনেকে বিয়ে করে আবার ভাঙে, আবার বিয়ে করে, আবার ভাঙে, পার্সোলিটি ক্রাইসিস, ইগো প্রবলেম।
কিন্তু বারবার সম্পর্ক বদল করা কোন কাজের কথা না, এটা মৌরিনের মনে হয় সবসময়।
সম্পর্ক বদল করলেই ভালো থাকবে এমনটাও না।
সে তো সুযোগই পেলো না ঠিক মতো।
না, মৌরিন এত সহজে হাল ছেড়ে দেবে না।
অন্তত চেষ্টাটা করতে হবে ধরে রাখার।
রেজা যথেষ্ট ভালো ছেলে, পোলাইট ধরনের।
এনগেজমেন্ট হয়ে যাওয়ার পরেও মৌরিনের সাথে সীমা অতিক্রম করে কথা বলার চেষ্টা করেনি। মৌরিন অসংখ্যাবার সুযোগ দিলেও রেজা বুঝতে চায়নি।
এধরনের মানুষের সাথে থাকা যায়, বিশ্বাস করা যায়।
মৌরিন, শক্ত হও। এখনি ছেড়ে দিও না, প্রয়োজনে বড় কারো সাথে আলাপ করো, বন্ধুদের সহযোগিতা নাও।
সম্পর্ক ধরে রাখাটাও যোগ্যতা।
রেজা ফিরেছে তখন সন্ধ্যা পার হয়েছে, মিঠি মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে রিক্সায় উঠে গিয়েছে।
আজ একটু রিলাক্স লাগছে, মিঠিকে কথাটা বলা হয়েছে, মৌরিনকেও বলা হয়েছে। এর চাইতে বেশি স্পষ্ট করে কিভাবে বলতে হয়, রেজা জানে না।
এখন ফিডব্যাকের অপেক্ষা।
রেজা রাত জাগলো না। রাতে খেয়ে অল্প সময় গল্পের বই পড়ার চেষ্টা করছিলো, তারপর ঘুমিয়ে গেলো, এমনিতেও একটু টায়ার্ড লাগছিলো।
(চলবে)
শানজানা আলম
#অতঃপর_মিঠিকথা-১৫
মিঠির ভীষণ অস্থির লাগছে।
রেজার কথাগুলো কানে বাজছে, আমাকে বিয়ে করবে মিঠি?
এটা ঠিক, মিঠির রেজাকে ভালো লাগে, ভালো লাগার শুরুটা তখন থেকে হয়েছিলো, যখন রেজার দেওয়া সেই শপিংব্যাগের বাবলগুলো দেখেছিলো।
পরে বিয়ের কথা থেমে গেলেও মিঠি ভেবেছে, এভাবে কি কেউ কখনো মিঠিকে নিয়ে ভাববে?
এই মুহুর্তে মিঠি খুব কষ্ট পাচ্ছে, ইচ্ছে করছে হ্যা বলে দিতে, কিন্তু এটা ভীষণ স্বার্থপরতা।
সেই মেয়েটা, যার সাথে রেজার এনগেজমেন্ট হয়েছে তার তো কোন দোষ নেই, মিঠির জন্য মেয়েটা ধাক্কা খাবে।
আবার রেজার কথাটা ফেলে দিতেও ইচ্ছে করছে না।
রেজা বলেছে, তুমি খুব ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করো, মন থেকে যদি মনে হয় একবারো, যে আমাকে তোমার ভালো লাগে, প্লিজ মনের কথা শোনো, সামাজিকতা ভেবে জীবনটা এলোমেলো করে দিও না মিঠি!
রেজা ভীষণ সোজাসাপটা কথা বলে, আবার মিঠি যদি হ্যা বলে, ফুপু কি করবে কে জানে, হয়ত গুন্ডা পান্ডা নিয়ে এসে বাড়ি দখল করবে!
আকাশ ভাই খারাপ না ততোটা, কিন্তু ফুপুকে মিঠি পছন্দ করে না।
মিঠিকে আকাশের সাথে বিয়ে দিতে পারলে সে সব চাইতে বেশি জ্বালাবে মিঠিকে, মিঠির পরিবারকে।
মিঠি আলো নিভিয়ে শুয়ে ছিলো, মিঠির মা এসে বসলো পাশে।
মিঠি, ঘুমাচ্ছিস?
না মা বলো?
পায়ে ব্যাথা আছে?
না,
আকাশ অনেক উপকার করলো সেদিন!
হু,
আকাশ ছেলেটা কিন্তু খারাপ না মিঠি, কিন্তু মন থেকে সাড়া দেয় না, তোর ফুপুর স্বার্থ আছে বলেই সে জোর করছে, বিয়ের পর কিন্তু আমরা মেয়ের পরিবার, চুপচাপ, নরম থাকতে হবে।
কি আশ্চর্য, একই কথা মিঠিও ভাবছে।
মা, ফুপি তো বাবার সম্পত্তির ভাগ পাবে, তাকে দিয়ে দাও না, আমাকে টানাহ্যাচড়া করা হচ্ছে কেন?
আমি তোকে টানি নি মা, তোর ফুপিই ঘ্যান ঘ্যান প্যান প্যান করে। একবার ভাবছি, ভাগ্যে থাকলে বিয়ে হবে!!
মা একটা কথা ছিলো, মিঠি উঠে বসলো।
বল,
রেজা সাহেব আসলো না সেদিন, উনি আমার সাথে যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছেন, বিয়েটা এখন সম্ভব কিনা!!
সে কী, ওর তো এনগেজমেন্ট হয়েছে, শায়লা বলেছে!!
হু, সেটাও বলেছে, কিন্তু উনি আমাকে বিয়ে করার কথা বলছেন!
আমি খুব দ্বিধায় পড়ে আছি!
তুই তো বিয়েটা করতে চাসনি?
তখন অন্য বিষয় ছিল, আর না করে দিয়েছিলেন উনি!
তোর কি রেজাকে পছন্দ? বিয়ে করতে চাও??
কিভাবে মা?? ওনার যে মেয়েটার সাথে এনগেজমেন্ট হলো, তার কি হবে!!
কপালে যার সাথে কলেমা পড়া বিয়ে থাকবে তার সাথেই হবে মা! এটা আল্লাহর ইচ্ছা মানুষ উছিলা ছাড়া কিচ্ছু না!
কি বলব তাকে?
আবার জিজ্ঞেস করলে বাসায় কথা বলতে বলিস, রেজাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছিলো, কিন্তু ভাবলাম, কপালে নেই।
আর ফুপু? আকাশ ভাই?
আকাশের সাথে কেউ তোর বিয়ের কথা বলেনি, তোর ফুপু একলা বলছে, আকাশ ভালো ছেলে, বুঝিয়ে বললে ঠিক বুঝবে।
আর তোর ফুপু চায় সম্পত্তির ভাগ, সাথে আমার উপর ছড়ি ঘোরাবে বলে তোকে বাড়ির বউ করতে চাইছে, আমি কথা বলব, তোর বিয়েটা হয়ে গেলে, ডেভেলপার কোম্পানির সাথে কথা বলে, ও যে কয়টা ফ্ল্যাট পায়, লেখা পড়া করে দিয়ে দিবো। এই শহরে বেশিরভাগ মানুষ ভাড়া বাসায় থাকে৷ আমরাও বছর দুই তিন থাকতে পারবো, ফ্ল্যাট না পাওয়া পর্যন্ত।
এই বাড়িটা ভাঙবেই??
কিচ্ছু করার নাই, জায়গা বেচে টাকা দিলে কারোই লাভ হবে না। তোদের একটা করে ফ্ল্যাট, আর বাবুর জন্য দুইটা বা তিনটা, ভাগে কয়টা পাওয়া যায়, দেখা যাক, এটাই আমাদের জন্য লাভজনক।
তোর বাবা যেন বৈষয়িক কিছু বুঝতেই চায় না!
মিঠি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে গেলো। পৃথিবীতে একমাত্র মা ই মনে হয় সকল সমস্যার সমাধান খুঁজে দিতে পারে।
এরপরে রেজা ফোন করলে মিঠি বলবে, এ বিষয়ে ফ্যামিলির সাথে কথা বলে নিতে।
(চলবে)
শানজানা আলম
#অতঃপর_মিঠিকথা-১৬
দুটোদিন কেটে গেলো।
রেজা অপেক্ষা করে ছিলো মিঠি ফোন করবে, মিঠির মনে হয়েছে মিঠি নিজে যদি ফোন করে বিষয়টা খুব গায়ে পড়া মনে হবে, একটু অপেক্ষা করে দেখা যাক কি হয়।
রেজা কি আবার ফোন করবে?
কখন করবে!
কিন্তু রেজা ফোন করলো না, আসলে ব্যস্ততাও ছিলো।
মনে মনে মিঠির ফোনের অপেক্ষা করে রেজা ঠিক করলো মিঠিকে ফোন করবে।
মিঠিও ভেবে ফেললো, রেজাকে ফোন করা যাক তাহলে!
কিন্তু মিঠির ফোনে একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন ঢুকলো হঠাৎই। মিঠির একবার মনে হলো, রেজা কি?
তারপর ভাবতে ভাবতে ফোনটা তুলে ফেললো!
একটা মেয়ে ফোন করেছে, হ্যালো, মিঠি বলছেন?
জি, কে বলছেন প্লিজ?
আসলে আমাকে আপনি ঠিক চিনবেন না, আমার নাম মৌরিন!
মৌরিন! খুব চেনা মনে হচ্ছে, আচমকা মনে করতে পারলো না মিঠি।
আমি রেজার উড বি….
মিঠি চমকালো, রেজার হবু স্ত্রী, ওকে ফোন করেছে, নম্বর কোথায় পেলো, কেন ফোন করেছে, রেজা কিছু বলতে বলেছে!
মৌরিন আবার বললো, রেজাকে চিনেছেন নিশ্চয়ই?
মিঠি বললো, জি, চিনবো না কেন?
মিঠি, আমি আপনার সাথে একটু দেখা করতে চাই, যদি আপনি সময় দেন কাইন্ডলি!
আমার সাথে দেখা করবেন? ঠিক কি বিষয়ে যদি বলতেন…..
সেটা সামনাসামনি বলি না হয়, আসলে আপনাকে খুঁজে বের করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে, তাই প্লিজ না করবেন না, আমার সাথে আপনার দেখা করাটা জরুরি!
আমার কেন জরুরি হবে, আমি তো আপনাকে চিনিই না!
ওই দুজনেরই জরুরি! আসুন প্লিজ, কাল?
আপনার অফিসের আসেপাশেই বসি কোথাও?
আচ্ছা ঠিক আছে, কখন?
মৌরিন সময় বলে দিলো, এত সহজে মিঠি আসবে আশা করেনি।
শেষে বললো, মিঠি, আমি জানি রেজার সাথে আপনার কথা হয়, প্লিজ আমাদের যে কথা হয়েছে, আপনি ওকে জানাবেন না এখনি, আমাদোর মিটিংটা হোক, তারপর আপনার মনে হলে জানাবেন না হয়!
আচ্ছা ঠিক আছে, কেউই জানবে না!
কি অদ্ভুত, রেজার বরাত দিয়ে কথা বললো, আবার রেজাকে জানাতে না করছে! কি জানি কি বলবে, মিঠির অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ।
ঘটনার শুরুটা ছিলো এরকম,
রেজা অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো, ওর মা ঘরে ঢুকলেন, কি ব্যাপার, মৌরিনের সাথে কিছু হয়েছে তোর, ওকে কি বলেছিস?
কি বলেছি?
ওকে বলেছিস তুই বিয়ে করতে চাস না?
এটা তোমাকে কে বললো?
মৌরিন বলেছে!
আচ্ছা, হু বলেছি।
কেন?
ওর সাথে আমার ঠিক এডজাস্ট হবে না মা!
মানে কি রেজা, সব কি ছেলেখেলা নাকি! আমাদের একটা মানসম্মান আছে, সবাই কি ভাববে!
রেজা মুচকি হেঁসে বললো, সবাই কি ভাববে এটা ভেবে দেখবে নাকি আমি কিভাবে ভালো থাকবো, সেটা ভেবে দেখবে!
কি হয়েছে বাবা, বল তো?
রেজা বললো, তোমার মিঠির কথা মনে আছে মা? শায়লা আন্টির বাড়িওয়ালার মেয়ে?
হুম, তোর জন্য সম্বন্ধ এনেছিলো, শেষ মুহূর্তে তুই না করলি!
হু, আমি ওকেই বিয়ে করতে চাই মা!
কেন? হুট করে ওকে কেন বিয়ে করতে চাইছিস?
মিঠিকে আমার খুব ভালো লেগেছিলো, তখন একটা সমস্যার কারনে না করেছিলাম, এখন আর সমস্যাটা নেই।
ওসব পুরোনো কথা বাদ দে, মৌরিন কত ভালো মেয়ে, ওর কথা ভাব।
না মা, আমি মিঠিকে দেখার পর অন্য কাউকে ভাবতেই পারিনি, কোন অজানা কারনে ওকে আমার খুবই ভালো লেগেছে!আমি কথা বলেছি, ও এখনো কিছু জানায়নি, তবে নিশ্চয়ই হ্যা বলবে, আমি জানি। ও আমাকে না করতে পারবে না।
এসব কথা মৌরিনের সাথে এনগেজমেন্ট এর আগে বলতে হতো রেজা!!
বলবো কিভাবে, দেখাই তো হলো গত সপ্তাহে, শায়লা আন্টির বাসায়।
আচ্ছা, দু সপ্তাহে মেয়েটা রেজার উপর এতোটা প্রভাব বিস্তার করে ফেললো, কি গায়ে পড়া মেয়েরে বাবা!
মৌরিন তো এমন নয়, রেজার মা বললেন, ওর ফোন নম্বর দে আমাকে, তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলবেন, মৌরিনকে ডেকে মিঠির বিষয়ে বুঝিয়ে বলে, মিঠিকে না করতে হবে, এছাড়া আর কোন উপায় নেই, ছেলের এখন রক্ত গরম, সমাজ মানে না!
মৌরিনও তার আত্মীয়ের মধ্যেই, মান সম্মান থাকবে না মৌরিনের সাথে বিয়ে ভেঙে আরেকটা বিয়ে দিলে!
রেজা অফিসে যেতেই রেজার মা মৌরিনকে ডাকলেন এবং পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বললেন।
মৌরিন বুদ্ধিমতি মেয়ে, রেজার মা তাকে খুব পছন্দ করে, এটা সে বুঝতে পারে।
রেজা বুঝতে না চাইলেও, বিয়ে ভাঙার কোন রকম কোন ইচ্ছে তার নেই, তাই রেজার মায়ের পরামর্শে মৌরিন মিঠিকে ফোনটা করে ফেলে!
★★★
অফিসের জন্য বাসে উঠতেই রেজার ফোনটা বাজলো।
-জামিলুর রেজা বলছেন?
-জি, কে বলছেন?
-আমি ডক্টর দিল আনোয়ার স্যারের চেম্বার থেকে বলছি, আপনার আগামীকাল একটা এপয়েন্টমেন্ট আছে।
রাত নয়টার দিকে।
-ওহ আচ্ছা!
-স্যার আপনাকে কিছু টেস্ট করাতে বলা আছে, আপনি রিপোর্ট গুলো নিয়ে আসবেন প্লিজ।
-টেস্ট তো করানো হয়নি, আপনাদের ওখানে সবগুলো করা যাবে না?
-যাবে, সেক্ষেত্রে আপনার আজই করাতে হবে, কারণ রিপোর্ট কাল পাবেন। কাল করালে আপনার এপয়েন্টমেন্ট পিছিয়ে যাবে আবার পনেরো দিন।
-আচ্ছ আচ্ছা, অনেক ধন্যবাদ।
-নো মেনশন স্যার, এটাই আমার ডিউটি।
ডা. দিল আনোয়ার হার্ট স্পেশালিষ্ট, রেজা রুটিন চেকআপটা রেগুলার করায়।
উনি ভীষণ ব্যস্ত হলেও, এপয়েন্টমেন্ট দেওয়া রোগীদের যত্ন করে দেখেন এবং সার্বিক খেয়ালটা রাখার চেষ্টা করেন।
এই রেজা টেস্ট না করিয়ে গেলে উনি আরেকটা সিটিং দিতে পারতেন, কিন্তু ঠিকই মনে করিয়ে দেওয়া হলো।
রেজা ঠিক করলো, অফিস থেকে বের হয়ে টেস্ট গুলো করে ফেলবে। এসব চিন্তার মধ্যে মিঠির সাথে আর কথা বলা হলো না।
(চলবে)
শানজানা আলম
#অতঃপর_মিঠিকথা-১৭
ডাক্তারের চেম্বারে অনেকক্ষণ এসেছে রেজা। সময় যেন কাটছে না। অবশ্য এখন কোন সমস্যা হয় না, আগে বুকে একটু চাপা ব্যাথা ছিল, ইদানিং আর সেটা নেই।
তবে রেজার সিড়ি ভেঙে উঠতে কষ্ট হয়, হাঁপিয়ে যায়।
এটা কি বড় কোন সমস্যার লক্ষণ, কে জানে!
রেজা নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করছে গত দেড় বছর।
কোথাও কোন অনিয়ম করে না।
চেম্বারে তেমন লোক নেই, এখন শুধু হাতে গোণা চার পাঁচজন আছে, এখানে ঠিক সময়মতো পেসেন্টকে ডাকা হয়, তাই ভীড় থাকে না।
রেজার সামনের দেয়ালে একটা মানুষের ফুল বডির শিরা উপশিরার ছবি, এই ছবি সব ডাক্তারের চেম্বারেই থাকে।
এখানে অনেক লোক চাকরি করে কিন্তু কোথাও কোন ভীর নেই।
চাইলেই সবকিছু সুন্দর সিস্টেমের মধ্যে করা যায়, এই নার্সিংহোমটা তার প্রমাণ।
নিচে কফি পাওয়া যায়, রেজা একবার খেয়ে এসেছে, কফিটা ভালো ছিল,
–আরে, রেজা ভাইয়া না আপনি, কেমন আছেন? প্রশ্নকর্তাকে রেজা চিনতে পারলো না ঠিক।
তবুও উত্তর দিলো, জি ভালো। আপনি?
–আপনি মনে হয় আমাকে চিনতে পারেননি, আমি শামীম, মৌরিনের বন্ধু, ওইদিন বনানীতে দেখা হলো, ভুলে গেছেন?
–ওহ আচ্ছা, আসলে কয়েকজন ছিলেন তো, তাই মনে করতে পারছিলাম না।
-এখানে কি মনে করে, আঙ্কেল না আন্টির রিপোর্ট দেখাতে এসেছেন?
–কারোই না, আমারই রিপোর্ট,, আপনি?
–আমার মায়ের। আপনি কি এখানে রেগুলার পেসেন্ট?
মানে এখন তো আগের রোগীদের সময় দেওয়া, তাই!
–তা বলতে পারেন, রুটিন চেক আপ করাই!
-আচ্ছা, কোন সমস্যা আছে?
–আছে একটু, বুকে হালকা চাপা ব্যাথা হয় মাঝে মাঝে।
-একাই এসেছেন, মৌ কে নিয়ে আসতেন?
-ও তো ব্যস্ত, আর আসলে কাউকে অযথা হয়রানি করতে ভালো লাগে না।
আমি একাই আসি এটাই ভালো।
-তবুও, অনেক সময় ডক্টররা পেসেন্টকে সরাসরি কিছু কথা বলতে চান না। এসব ডাক্তাররাও বলেন না, আমার মাকেই তো জানাই না।
-আমার ক্ষেত্রে সেরকম সমস্যা নেই।
ভেতর থেকে ডাক এলো, রেজা ভেতরে গেলো।
ডাক্তার দিল আনোয়ার সাহেব বেশ গম্ভীর তবে মিষ্টভাষী।
অনেকক্ষণ ধরে ভুরু কুঁচকে রিপোর্ট দেখলেন।
রেজা সাহেব, কোন সমস্যা হয়?
না স্যার, সিড়ি ভাঙতে কষ্ট হয়।
হুম, রিপোর্ট বলছে এনজিওগ্রামটা করানো দরকার, করিয়ে ফেলুন, দেখা যাক৷
স্যার, কিছু খারাপ দেখছেন?
এখনো বলতে পারছি না, দেখা যাক রিপোর্টে কি আসে।
আপনাকে একদিন আগে ভর্তি হতে হবে। একদিন অবসার্ভ করে, তারপর এনজিওগ্রাম, ওকে?
–ওকে।
রেজা বের হলো ভেতর থেকে, শামীম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কি বললেন ডাক্তার!
-তেমন কিছু না! রেজা নিস্পৃহ উত্তর দিলেও ভেতরে একটা চিন্তা কাজ করছে।
রেজা রিসিপশন থেকে কাগজপত্র বুঝে নিয়ে এনজিওগ্রামের ডেটটা নিয়ে চলে গেলো।
রেজা চলে যাওয়ার পরে শামীম রিসিপশনে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা ওনার কি সমস্যা বলা যাবে?
-না স্যার, এটা আমাদের নীতিমালা বিরোধী।
-আসলে উনি আমার পরিচিত, বাসায় কিছু না জানিয়ে এখানে এসেছেন তো, তাই!
-ওহ, তাহলেও স্যার আমরা বলতে পারবো না।
আপনি ওনার কাছ থেকে শুনে নিবেন।
শামীমের মনে হচ্ছে রেজার সমস্যা সাধারণ না আর এটা মৌরিন জানে না।
যাই হোক, বন্ধু হিসেবে মৌরিনকে যতোটুকু জানানো দরকার, সেটা সে জানিয়ে দিবে।
শামীমের সিরিয়াল চলে এলো, সে ভেতরে ঢুকলো।
(চলবে)
শানজানা আলম
#অতঃপর_মিঠিকথা-১৮
মৌরিন শামীমের ফোনটা পেলো রাত বারোটার দিকে।
সে খুবই অবাক হলো যখন শুনলো, রেজা নিয়মিত ডাঃ দিল আনোয়ারের পেশেন্ট। শামীমকে তেমন কিছু না বলে, মৌরিন নিজের মায়ের কাছে জানতে চাইলো, যে তারা এ বিষয়ে কিছু জানে কিনা!
যথেষ্ট রাত হলেও মৌরিনের বাসা থেকে ওদের বিয়ের সম্বন্ধে মধ্যস্থতা করা আত্মীয়াকে ফোন করা হলো।
কিন্তু বেচারিও কিছু জানে না।
তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, যেহেতু কার্ডিওলজিস্ট এর রেগুলার পেশেন্ট, তার মানে সমস্যা কিছু আছে এবং তারা সেটা গোপন করেছে!!
মৌরিন একমাত্র মেয়ে আর এরকম লুকোচুরি করা হয়েছে তাই এখানে আর কথা আগানো ঠিক হবে না।
মৌরিনের কি ছেলের অভাব হবে নাকি!
মৌরিন একবার বলার চেষ্টা করলো, একবার খোঁজ নিলে হতো না!
কিন্তু সেটা নিয়ে কথা আর আগালো না।
মৌরিনের ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগলো। গতকালই রেজার মায়ের সাথে কথা হলো, তিনি একবারো কিছু বললেন না, আর মিঠির সাথে কথা বলে, মিঠিকে বুঝিয়ে বলতে বললেন।
মিঠির সাথেও মৌরিন কথা বলেছে, এই মুহুর্তে ওকে কি বলবে!
জীবন নাটকের চাইতেও নাটকীয় হয়!!
রেজাকে ফোন করবে?
রেজা এখন ঘুমাচ্ছে। এটা ঠিক, রেজা খুব নিয়ম মেনে চলে, কিন্তু তার পেছনে এমন কাহিনি থাকতে পারে, মৌরিন আশা করেনি। রেজাও কখনো বলেনি।
রেজা কি তাহলে এ কারণে না করেছে, মিঠির বিষয়টা তাহলে কিছু না? মৌরিন ভীষণ দ্বিধায় পড়ে গেলো।
তবুও বাসা থেকে হয়ত আর চাইবে না এই বিয়েটা হোক।
আরো দুজন অবাক হলো।
মিঠি এবং রেজার মা।
রেজার মা যখন শুনলেন, মৌরিনের পরিবার আর আগ্রহী নয় এবং কারণটা তিনি জানলেন, তিনি কষ্ট পাওয়ার চাইতে চিন্তায় পড়ে গেলেন বেশি।
কি হয়েছে রেজার, সেভাবে কিছু তো বলে না কখনো!
রেজার কাছে জানতে চাইবেন তাহলে? এটা কি সত্যি না বিয়ে ভাঙার জন্য রেজা এমন করেছে!
তিনি রেজাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তারের বিষয়টা
কি? সত্যি নাকি অন্য কোন বিষয় আছে?
রেজা এবারে আর লুকাতে পারলো না।
বিষয়টা বাসায় জানাতে হবে, এনজিওগ্রাম করে ব্লক পাওয়া গেলে রিং পড়াতে হবে, তখন জানলে মা বাবা ধাক্কা খাবেন।
রেজার মা কষ্ট পাওয়ার বদলে হতভম্ব হয়ে গেলেন!
এটা কিভাবে সম্ভব, রেজার কতটুকু বয়স, কেন ওরই এমন একটা অসুখ হতে হবে!!
মিঠি ভীষণ অবাক হলো, যখন মৌরিন ফোন করে জানালো, তাদের আর দেখা করার প্রয়োজন নেই ।
মিঠি জানতে চাইলো, আপনার কি এমন দরকার হয়েছিলো আমার কাছে আবার এখন দরকার শেষ?
মৌরিন বললো, রেজা হয়ত জানাবে তোমাকে, আফটারঅল তুমি তো ওর কাছের বন্ধু।
ফোন রাখার আগে, মৌরিন জিজ্ঞেস করলো, মিঠি, তুমি কি জানো, রেজা একটু অসুস্থ, ও কার্ডিওলজিস্ট এর নিয়মিত পেশেন্ট??
মৌরিনকে অবাক করে দিয়ে মিঠি বললো, হুম জানি তো, কেন?
মৌরিন একটা নিঃশ্বাস ফেললো, রেজা আসলেই ওকে কখনো আপন ভাবে নি, যাকে ভেবেছে, তাকে কিছুটা হলেও বলেছে!
★★★
রেজা একটা অদ্ভুত দোলাচলে পড়ে গেলো।
এই অবস্থায় মিঠির সাথে জড়ানোর কোন মানে হয় না, মিঠির সামনে পুরো জীবনটা।
রেজার হার্টে যদি ব্লক থাকেও সেটা হয়ত রিং পড়িয়ে চলা যাবে, একটু জীবনটা একটু কেমন হয়ে যাবে, অনিশ্চিত, আর পাঁচটা স্বাভাবিক ছেলেদের মতো হবে না।
মিঠিকে যদিও বিয়ের কথা বলেছে, ওর সাথে কিচ্ছু লুকাবে না রেজা।
পুরোপুরি বলে দেবে সবকিছু।
মিঠিও হয়তো মৌরিনের মত পিছু হাঁটবে, মিঠির পরিবার হয়ত আগাতে চাইবে না!
সামনের দিনগুলো ভেবে রেজার টেনশন হচ্ছে।
ইশ, এই অনিশ্চিত যাত্রায় মিঠি এসে যদি হাতটা ধরতো!
মিঠির সাথে বসে কখনো বাবল ওড়ানো হবে না রেজার।
মিঠি স্বপ্নদৃশ্যেই থেকে যাবে সবসময়!
অন্য কেউ মিঠির পাশে হাঁটবে, রেজার বুকের মধ্যে একটা অদ্ভুত কষ্ট হতে লাগলো, বুকের চাপা ব্যাথার চাইতেও সূক্ষ্ম,
তীক্ষ্ণ। এই ব্যাথার সাথে চোখও ঝাপসা হয়ে আসে!!
শানজানা আলম