অতিথি,পর্ব:০৬,০৭
লেখা: মিশু মনি
পর্ব:০৬
কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিল মিশু।পথে মৈত্রিকে দেখে থমকে দাড়াল।এটা স্বপ্ন নাকি বাস্তব! কাজী সাহেব কোনো বার্তা ছাড়া ই এসে হাজির!
মিশু ছুটে মৈত্রির সামনে এসে দাড়াল।হাফাতে হাফাতে বলল,কি ব্যাপার কাজী সাহেব! আপনি!
– হুম।চলে আসলাম। তোমার চিঠি পড়ে আর ঘরে থাকা গেল না।
মিশু লজ্জা পেয়ে বলল,কি যে বলেন! চিঠি কবে পেয়েছেন?
– পরশু।
– ও আচ্ছা।একা কেন? মেজ বিড়াল আসেনি?
– না।ওর সাথে তো তোমার ঝগড়া। ও আসলে হয়ত ওর গায়ে বমি করে দিতে।তাই ও আসেনি।
মিশু হেসে বলল,বলেছি বলে ভয় পেয়ে আসল না? যাই হোক অনেক কষ্ট করে এসেছেন। হেটে যাবেন নাকি? অটোতে উঠুন।
– এইটুকু পথ তোমার সাথে হেটেই যাই।আর আমার কোনো কষ্ট হয়নি।
– বাব্বাহ! এত টা পথ এসেও এত্ত এনার্জি! গুড।
– এত টা পথ হলেও সময় বেশি লাগেনি।
– ঢপ মারা হচ্ছে?
– আরে আজিব তো! ঢপ মারবো কেন? আমার খুব বেশি সময় লাগেনি।গোসল করে বাসা থেকে বের হয়েছি।দেখো এখনো আমার চুল ভেজা।
– ইয়ার্কি করার জায়গা পান না?
– ইয়ার্কি করবো কেন?
– দেখুন আমাকে রাগাবেন না।
– রাগাচ্ছি কোথায়?
– তাছাড়া কি? আপনি ঢাকায় গোসল করে গাড়িতে উঠেছেন আর রংপুর এসে বলছেন এখনো চুল ভেজা? ফাজলামো হচ্ছে?
– কথার কথা বললাম।
– কথার কথা কেন বলবেন? কোনো দুই মাস বয়সের বাচ্চাও এটা বিশ্বাস করবে না বুঝলেন?
– মিথ্যে তো বলিনি।
মিশু রেগে বলল,এসেই এমন শুরু করেছেন?
– তুমি আমার কথা টা বোঝার চেষ্টা করো শিশু।আমি প্লেনে এসেছি।
– আচ্ছা সরি।আমি এটা ভাবিই নি যে আপনি প্লেনে আসতে পারেন।
– তুমি তো শিশু।কিছু বলার আগে ভেবে নিবা।আর রাগার আগে বুঝে নিবা।
মিশু চুপ করে গেল।বাকি টা পথ আর কোনো কথাই বলল না।
.
খেতে বসে মিশুর বাবা মিশুকে বললেন,মৈত্রি তোমাকে নিতে এসেছেন।ওর সাথে যাও।কিছুদিন ঘুরে আসো।
মিশু খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলল,সত্যি! বেড়াতে যাবো! কি মজা!
– হুম।কালই যেও।
– আর কেউ যাবেনা? আমি একা যাবো?
– হ্যা।সপ্তাহ খানেক পর আমি আর তোমার মা গিয়ে তোমায় নিয়ে আসবো।
মিশুর আনন্দ যেন আর ধরেই না।ও এমনিতেই ঘুরতে ভালবাসে।তারউপর কাজী সাহেব দের বাসায় গেলে তিন বিড়াল কেই খুব জব্দ করা যাবে।
মিশু বলল,আব্বু আমি তাহলে জামা কাপড় গুছিয়ে নিই?
– হ্যা নাও।
মিশু আর খেতেই পারল না।তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে রুমে এসে ব্যাগ গোছানো শুরু করে দিলো।
.
পরদিন সকালেই মৈত্রি মিশুকে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ল। মিশু ভীষণ খুশি।ওর আনন্দ দেখে মৈত্রির ও খুব ভালো লাগছে।মৈত্রি চেয়েছিল বিমানে যেতে।কিন্তু মিশু এত কম সময়ের জার্নি চায়না।সারাদিন বাসের সিটে বসে ক্লান্ত হওয়ার মাঝেই অন্যরকম মজা।অগত্যা মৈত্রিকেও রাজি হতে হলো।
বাসে উঠে মিশু জানালার পাশে বসে পড়ল।মৈত্রি পাশে বসতেই ও বলল,এক টানা আট ঘণ্টা আপনি আমার পাশে বসে থাকবেন?
– হ্যা থাকবো।আপত্তি আছে?
– আপত্তি থাকলে কি সিট চেঞ্জ করবেন?
– হ্যা।
– থাক বাবা।তখন আবার কোন বুড়াকে আমার পাশে বসিয়ে দিবেন। দরকার নেই।
মৈত্রি হেসে বলল,কিছু কিনে নিতে হবে?
– হ্যা হবে।
– কি?
– আইসক্রিম, চিপস, চকোলেট আর চুইংগাম বিশ টা।
– বিশ টা!
– মুরগির বিষ্ঠা নয়।বিশ টি চুইংগাম।
মৈত্রি হেসে বলল,আমি কি বলেছি মুরগির বিষ্ঠা? সবসময় বেশি বুঝো।
– হ্যা বুঝবো। কারন আমি শিশু।এখন যান,এগুলা কিনে নিয়ে আসুন।ভ্যানিলা আইসক্রিম কিন্তু।
– আচ্ছা।
.
মৈত্রি পাচ প্যাকেট চিপস,দুই টা আইসক্রিম, এক বয়াম চুইংগাম,চল্লিশ টা বিভিন্ন প্রকার চকোলেট আর অনেক গুলা চাটনি নিয়ে এসে হাজির!
যাত্রীরা সকলেই অবাক হয়ে দেখছে আর হাসছে।মিশু দেখে তো একদম থ!
মৈত্রি বলল,নাও।কত খাবা খাও।
মিশু হেসে বলল,আমি তো ভেবেছিলাম হকার এসেছে!
মৈত্রি বলল,নাও এগুলা।
মিশু সবগুলা খাবার নিয়ে ব্যাগে ভরে রাখল।তারপর বলল,পুরো দোকান টাই তো কিনে এনেছেন।
– হ্যা আনলাম।
– আমিতো ভাবলাম আপনি গাড়ি তেই ব্যবসা করবেন। হকারি!
– তুমি সবসময় এমন অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা করো কেন? আমি এখন হকারি করবো?
মিশু হেসে বলল,দারুন লাগবে।
– আচ্ছা।যখন খেতে খেতে অরুচি ধরে যাবে,তখন বিক্রি শুরু করে দিবো।
মিশু হেসে আইসক্রিম খেতে শুরু করে দিলো।
.
বাস ছেড়ে দিলো। মিশু আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে।এই প্রথম ও বাবা মা ছাড়া অন্য কারও সাথে বেড়াতে যাচ্ছে।খুব ভালো লাগছে মিশুর।
মৈত্রি হেডফোন বের করে মিশুকে দিয়ে বলল গান শোনো।
-দিন।
ইতিমধ্যেই মিশুর আইসক্রিম খাওয়া শেষ। মৈত্রি এখনো এক তৃতীয়াংশ ও খেতে পারেনি।মনে মনে ভাবছে মেয়ে টা কি আইসক্রিম খাদক নাকি? কয়েক মিনিটেই আড়াইশ টাকা খেয়ে ফেলল!
মিশু গান শুনে খুব পুলকিত। মৈত্রিকে ধন্যবাদ জানিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।
মিশু জানালায় মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে আছে।বাতাসে চুল উড়ে মৈত্রির মুখে পড়ছে। মিশুর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।ও একমনে গান শুনছে আর ভ্রমণ উপভোগ করছে।
এলোমেলো ভাবে চুল গুলো উড়ছে, মিশু আনমনা হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।ওকে দেখে মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে ওর মত খুশি আর কেউ নেই।মুখে প্রশান্তির ছাপ!
মৈত্রি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে মিশুর মুখের পানে! এখন মেয়েটিকে আর শিশুসুলভ লাগছে না।মনে হচ্ছে সুখী একজন তরুণী যে সবকিছু নিয়ে অনেক আনন্দিত!
মিশু হঠাত পাশ ফিরে মৈত্রিকে বলল,আর্টসেলের গান আমার ভাল্লাগেনা। চেঞ্জ করে দিন।
মৈত্রি চমকে উঠে বলল,দিচ্ছি।
– থাংকু।আর এতক্ষণ হা করে কি দেখছিলেন আমার দিকে?
মৈত্রি লজ্জা পেয়ে বলল,কই কিছু না তো।
– মিশু সব বুঝে হুম।আমার দিকে অনেকক্ষন চেয়েছিলেন।অবশ্য আপনার দোষ নেই,পাশে সুন্দরী মেয়ে থাকলে তো দেখবেন ই।
মৈত্রি কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
মিশু বলল,দেখুন।কিন্তু কাজী সাহেব কিছু ভাবার আগে এটা মনে করবেন যে,আপনি আমার তের বছরের সিনিয়র।
মৈত্রি অবাক হয়ে বলল,কি ভাব্ব? আজিব তো!
– আমি কিন্তু বড় হচ্ছি।সবই বুঝি কিন্তু।
মৈত্রি হাসল।মেয়েটি বাচ্চাদের মত হলেও অনেক পাকা পাকা কথা বলতে পারে! অদ্ভুত মেয়ে!
.
মিশু মৈত্রির হাতে একটা চুইংগাম দিয়ে বলল,নিন চিবোন।
– থ্যাংকস।
– হুম।চিবিয়ে বল ফুলান দেখি।
– বল মানে!
মিশু বাবল গাম ফুলিয়ে দেখাল।- এইভাবে বল ফুলান দেখি আমার মত।
মৈত্রি হেসে বলল,আনএবল।
– পারেন না বাবল গাম ফুলাতে?
– নাহ।
মিশু কয়েকবার দেখিয়ে দিয়ে বলল এইভাবে ফুলান।পাড়বেন।
মৈত্রি অনেক চেষ্টা করেও বল ফুলাতে পারল না।মিশু হেসে ঢলে পড়ছে।
মৈত্রি কয়েকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো।কিছুতেই হচ্ছেনা।অবশেষে মুখ থেকে চুইংগাম টা পড়েই গেল।
মিশু আবারো একটা চুইংগাম বের করে মৈত্রির হাতে দিলো।
মৈত্রি বলল,আমি পারবো না।
– আপনাকে তো ডিম পারতে বলিনি।না পারার কিছুই নেই।বিদেশ ফেরত ডিগ্রিধারি,শুধু পড়াশুনাই শিখেছে আর কিচ্ছু শেখেনি।রামগাধা কোথাকার।বল ফুলান।
মৈত্রি আবারো বাবল গাম মুখে দিয়ে জিভ দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল।
.
মিশু বলল,আচ্ছা কাজী সাহেব একটা প্রশ্ন করি?
– হুম করো।
– জার্নি প্রিয় একজন দার্শনিক ছিলেন।যিনি ভ্রমণ করতে খুব ভালবাসতেন।কয়েকদিন পরপর ই তিনি ট্রেন, বাস,আর বিভিন্ন যানে ভ্রমন করতেন।জানালার পাশে বসে প্রকৃতি দেখতে খুব ভালবাসতেন।বিয়ে করলে বউকে জানালার পাশের সিট টা দিয়ে দিতে হবে বলে তিনি কখনো বিয়েই করেন নি।আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই দার্শনিকের নাম কি?
মৈত্রি কিছুক্ষণ ভেবে বলল,বলতে পারছি না।
– কি জানেন তাহলে? আসলেই আপনার মাথায় সার আছে।গোবর সার।
মৈত্রি বলল,গোবর সার অনেক উপকারী। জমির উর্বরতা বাড়ায়।
– সে জন্য বুঝি আপনার মস্তিষ্ক উর্বর করতে পারেনি?
মৈত্রি হাসল।
.
মিশু আবারো জানালায় মাথা রেখে বাইরে তাকাল।
মৈত্রি ফোন বের করে ফেসবুক চালানো শুরু করল।
আবারো মিশুর চুল এসে ওর মুখে পড়ল।মেয়েটার লম্বা চুল গুলো যেন আজ বাঁধনহারা হয়েছে।
মৈত্রি কয়েকবার মিশুকে ডাকল।কিন্তু মিশু জোরে সাউন্ড দিয়ে হেডফোনে গান শুনছিল বলে শুনতে পায়নি।
মৈত্রি একটা ধাক্কা দিয়ে বলল,এই মিশু,
মিশু পাশ ফিরে তাকাল,হ্যা বলুন।
– হেডফোন টা খুলে রাখো। গল্প করি।
মিশু হেডফোন টা খুলে বলল,কি গল্প? বলুন
– তোমার চুলের গন্ধে আমার ঘুম এসে যাচ্ছে।
– হা হা।ঘুমান তাহলে।আমার বমি পেলে কিন্তু আপনার কোলে বমি করে দিবো।
– ছি ছি।এমন টা কোরোনা।ওটা তো মর্মর গায়ে করে দেয়ার কথা।
– এমনি বললাম।আমার বমি করার অভ্যাস নেই।
– আচ্ছা।ভালো মেয়ে।
মিশু একটা চিপস বের করে খাওয়া শুরু করল।একটু পরপর মৈত্রির দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।কেবল তখন ই মৈত্রি চিপস খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।কিন্তু মৈত্রির ভীষন ভালো লাগছে।
.
– কাজী সাহেব
– হ্যা বলো
– জার্নি কেমন লাগছে?
– খুউউউউব ভালো। দারুন উপভোগ করছি।
– আপনি তো প্লেনে যেতে চেয়েছিলেন।প্লেনে গেলে কি এত্ত ভালো লাগত?
– কখনোই না।তোমাকে অসংখ্য থ্যাংকস মিশু।রিয়েলি খুব ইনজয় করছি।
– আমার গান গাইতে ইচ্ছে করছে।
– গাও…
– হুম।কিন্তু আপনাকে শুনাবো না।
.
মিশু জানালায় মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে আপন মনেই গান গেয়ে উঠল।গানের হালকা সুর মৈত্রির কানে ভেসে আসছে।মৈত্রি মিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।খুব ভালো লাগছে ওর।একটা বাস ভ্রমণ যে এতবেশি ভালোলাগার হতে পারে সেটা ও জানত না।হয়ত মিশুর গুনেই সেটা সম্ভব হয়েছে….
( চলবে….)
অতিথি
পর্ব:০৭
লেখা: মিশু মনি
.
মিশু জিজ্ঞেস করল- আপনি কখনো লোকাল ট্রেনে ভ্রমণ করেছেন?
মৈত্রী জবাব দিলো – না।
– মিস করেছেন।
– কি?
– সত্যিকার আনন্দ।নানান শ্রেণীর মানুষ, হরেক রকম হকার,বিভিন্ন রকমের ভিক্ষুক।কেউ গান গেয়ে ভিক্ষা করে আবার কেউ গান গেয়ে মলম বেচে।
– হা হা। তাই নাকি?
– হুম।খুব ইনজয় করতেন।
– এমনিতেও তোমার সাথে যেকোনো জার্নিই ইনজয় করা সম্ভব।
– আমার গুনে নয়।আসলে সব জিনিসের মাঝেই আনন্দ থাকে।শুধু আনন্দ টাই খুজুত।দেখবেন উপভোগ করার মত অনেক কিছুই পাবেন।
মৈত্রি ভাবছে মেয়েটা একেবারে বাচ্চা নয়।অনেক কিছুই জানে দেখছি।
.
মিশু ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখল তিন টা ইনকামিং মেসেজ। বান্ধবী সিথির নাম্বার থেকে।সিথি জানতে চেয়েছে মিশু ভ্রমণ কেমন উপভোগ করছে।
মিশু রিপ্লে দিলো – মনে হচ্ছে উড়ে চলেছি।খুব্বি ভালো লাগছে।
আবারো মেসেজ আসল- কাজী বিড়াল আজেবাজে কিছু বলেনি তো?
মিশু লিখল- আজেবাজে কথা কেমন হয় উনি হয়ত সেটাই জানেন না।কাজী মৈত্রী খুব ভালো একজন মানুষ।
মেসেজ টা সেন্ট করে দিয়েই মিশু চোখ বন্ধ করল।মুহুর্তেই ঘুমে ঢলে পড়ল।কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বাসের ঝাঁকুনিতে মাথা টা জানালায় গিয়ে লাগল।মিশু আঘাত পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল।মৈত্রি জিজ্ঞেস করল- কি হয়েছে?
– ব্যাথা পেলাম।
– ওখানে মাথা রেখেছ কেন? আবার আঘাত পাবা।আমার কাধে মাথা রাখো।
মিশু কয়েকবার চোখ মিটমিট করেই মৈত্রীর কাধে মাথা রাখল।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবারো ঘুমিয়ে পড়ল।
মৈত্রী ঘার ঘুরিয়ে দেখছে মিশুকে।মেয়েটার ঘুমন্ত মুখ টা খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।চুল উড়ে এসে ওর মুখের উপর পড়ে সৌন্দর্য যেন আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।মৈত্রী পলকহীন ভাবে তাকিয়েই আছে।
হঠাত খেয়াল করল মিশুর হাতে মোবাইল।ওটা হাত থেকে পড়ে যেতে পারে ভেবে মৈত্রি মোবাইল টা নিজের হাতে নিলো।
কৌতুহল বশত স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই মিশুর সেন্ট করা মেসেজ টা চোখে পড়ল। মেসেজ টা দেখেই মৈত্রীর মনে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করল।বারবার মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খেতে লাগল-“কাজী মৈত্রী খুব ভালো একজন মানুষ।”
মৈত্রী মনে মনে বলল,তুমিও খুব ভালো একটা মেয়ে মিশু।আমাকে এতটা বিশ্বাস করো জেনে ভালো লাগল।
.
মিশু ঘুমাচ্ছে।মৈত্রী বারবার ওর মুখের পানে তাকাচ্ছে।মেয়েটা খুব মিষ্টি দেখতে! ভাবছে আর মিটিমিটি হাসছে মৈত্রী।
আধ ঘণ্টা পর মিশুর ঘুম ভাংল।মাথা তুলেই ও লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।
মৈত্রী বলল,ঘুম হলো?
– আপনার কাধে মাথা রেখে ঘুমালাম কখন?
– ঘুমানোর পর মাথা রেখেছ।
মিশু মুচকি হেসে বলল,ব্যাপার টা সিনেম্যাটিক হয়ে গেল না?
– কেন?
– সিনেমায় দেখেছি নায়ক নয়ত নায়িকা পাশের জনের কাধে মাথা রেখে ঘুমায়।
– বাস্তবেও ঘুমায় মিশু।
– হুম।আমি নায়িকা আর আপনি নায়ক।
– হা হা হা।পিচ্চি নায়িকা।
– আমি পিচ্চি?
– হুম।মিশু এখনো শিশু।
মিশু হেসে বলল,ইউ লাইক দিছু?
– হা হা হা।
মিশু বারবার হাই তুলছে দেখে মৈত্রী বলল,ঘুম হয়নি? না হলে আবার ঘুমাও।
মিশু দুষ্টুমি করে বলল,আমার কাধে মাথা রাখো এটা বললেই পারেন। অযথা ঘুমের দোহাই কেন?
– মানে!
– আপনি তো চাইছেন আমি আবার আপনার কাধে মাথা রাখি।এত ঢং করার কি আছে?
মৈত্রী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।কি রকম কথা এটা! মিশুর মুখে এ কি রকম বাক্য! অবিশ্বাস্য!
মিশু প্রাণখোলা হাসি হাসছে।মৈত্রী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। মিশুর হাসি যে এত সুন্দর এটা আগে খেয়াল করেনি।
.
মিশু বলল,আপনি কি বোরিং ফিল করছেন?
– একদম ই না।কেন?
– বোরিংনেস কাটাতে একটা উপায় প্রয়োগ করবো।
– কি উপায় শুনি?
– কিছু অদ্ভুত প্রশ্ন করবো। উত্তর দিতে হবে।
– আচ্ছা।এখুনি বলো।
মিশু দারিয়ে বাসের সকল যাত্রীর মুখ দেখে নিলো। তারপর বলল,ধরুন হঠাত বাস থেমে গেল।আর চাকা ঘুরছে না।যতক্ষণ কাজী মৈত্রী অবিবাহিত থাকবে ততক্ষণ বাস চলবে না।সকল যাত্রী আপনাকে অনুরোধ করল তাড়াতাড়ি একটা যাত্রীকে বিয়ে করে ফেলুন।নয়ত বাসের চাকা ঘুরবে না।বাধ্য হয়ে আপনাকে বিয়ে করতে হবে।তখন আপনি বাসের ভিতরে কোন মেয়ে টাকে বিয়ে করবেন?
মৈত্রী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,আজগুবি কথা বার্তা।
– হ্যা।বলুন আপনি কাকে বিয়ে করবেন?
মৈত্রী দাড়িয়ে সকল যাত্রীকে এক পলক দেখে নিয়ে বসে পড়ল। বলল,একটাকেও পছন্দ হচ্ছে না।
– কিন্তু বিয়ে করতেই হবে।নয়ত বাসের চাকা ঘুরবে না।আমাদের কে এখানেই পড়ে থাকতে হবে।
– কেন? আমরা অন্য বাস ধরে চলে যাবো।
– সেরকম অপশন নাই।বিয়ে করতেই হবে।কাকে বিয়ে করবেন বলুন?
মৈত্রী আরেকবার পিছনে তাকিয়ে বলল,শেষের দিকে বসেছে হলুদ জামা পড়া মেয়েটা,ওকে।
– কি বললেন? আমি এখন মেয়েটিকে গিয়ে বলে দিবো যে কাজী সাহেব আপনাকে বিবাহ করিবেন।
– তারপর মেয়েটা কি বলবে?
– বিয়েতে রাজি হবে।কেমন হবে বলুন তো যদি বাসের ভিতরে বিয়ে হয়? বাসায় ফেরার সময় একটা বউ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। আপনার আব্বু হার্ট এটাক করে ফেলবেন সেটা দেখে।
– মিশু,যত উদ্ভট সব চিন্তা আসে তোমার মাথায়।আজিব!
মিশু মুখ কালো করে বাইরে তাকাল।মৈত্রী চিন্তায় পড়ে গেল।মেয়েটি রাগ করলে ভালো লাগেনা।কি বলা যায়?
মৈত্রী বলল,মিশু শোনো।
মিশু মাথা ঘুরে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না।
– মিশু,যদি তোমাকে বলে এই কাজটি করতে,তখন তুমি কাকে বিয়ে করবে?
– আমার পাশে যে বিড়ালটি বসে আছে,কাজী মৈত্রী।
কাজী বিস্মিত হয়ে বলল তাই! তাহলে মর্ম’র কি হবে? তুমি না প্রতিদিন ওর শার্টে নাক ঝেরে দিবা?
– হুম দিবো তো। আপনি তো আমার তের বছরের বড়, সেই অনুযায়ী আমার তের বছর আগে আপনি মারা যাবেন। আপনি মরার পর আমি মর্মকে বিয়ে করবো।
মৈত্রী অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। কি বলে এই পাগলী মেয়েটা! ভারি অদ্ভুত অদ্ভুত কথা!
.
মিশু হঠাত মৈত্রীর হাত টেনে ধরে বাইরে তাকাতে বলল।মৈত্রী বাইরে তাকিয়ে বলল, কি দেখতে বলছ?
– ওই যে মিনার টা দেখছেন? একটা নিশান পতাকা উড়ছে?
– হুম।
– এখানে মহাস্থানগড়।
– সত্যি নাকি! আগে বলোনি কেন? তুমি তো আমাকে মহাস্থানগড় দেখাও নি।
– আপনারা ই তো তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। আরেকবার আসলে দেখাবো।
– হুম।এবার হাত টা ছাড়ো নয়ত হালকা করে ধরো।এত শক্ত করে ধরলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।
মিশু লজ্জা পেয়ে হাত সরিয়ে নিলো। পরক্ষনেই মৈত্রীর মনে পড়ে গেল মিশুর সেই মেসেজের লাইন টা “কাজী মৈত্রী অনেক ভালো একজন মানুষ ”
কথা টা মনে পড়তেই কাজী ভাবল ভুল হয়ে গেল।মিশুর মন আর চিন্তা ভাবনা অনেক বিশুদ্ধ।ওর সামনে এই ধরনের কথা বলা যাবে না।
ভেবেই মিশুর দিকে তাকাল।মিশু চিপস খাচ্ছে।কাজীর হাসি পেল।হাত বাড়িয়ে বলল,আমাকে একটা দিবেন?
মিশু হেসে বলল,আপনি মহাস্থানগড়ের ফকির গুলার মত করে বলছেন।
– হা হা হা।তাই নাকি?
– হুম।এখানকার ভিক্ষুকরা মারাত্মক।
– যেমন?
– আমাদের কলেজের স্যারের কাছে শুনেছি।স্যার একবার তার বন্ধুসহ এসেছিলেন। ভিক্ষুকরা সব চিল্লাচিল্লি করে টাকা চায়।স্যারের বন্ধুর পা ধরে একজন ভিক্ষুক খুব করে টাকা চাইছিল।তো উনি ওই ভিক্ষুককে টাকা দিয়ে পা বাড়িয়েছেন। তখন আরেক ভিক্ষুক ধরে ফেলল।উনি বললেন, একজন কে টাকা দিছি।তোমাকে আর দিতে পারবো না।উত্তরে ভিক্ষুক বলেছিল,শালার ব্যাটা তুই ওরে টাকা দিলু,আমারে দিবি না ক্যান? ওই ফকির কি তোর বাপ হয়?
মৈত্রী হো হো করে হেসে উঠল – মহাস্থানের ভিক্ষুকরা তো আসলেই ভয়ানক।
– হুম।একবার আমার পা টেনে ধরেছিল।আমি টাকা দেইনি।আব্বু বলেছিল কাউকেই টাকা দিবা না।সারি সারি ভিক্ষুক বসে থাকে।একজন কে টাকা দিলেই বিপদ। সবগুলা এসে ঝাপিয়ে পড়বে।
মৈত্রী হেসে বলল,একজনকে টাকা দিয়ে দেখতা কি বিপদ হয়?
মিশু বলল,ওদের ভাষা আমার জানা আছে।নিশ্চয়ই বলে ফেলত ওই ফকির কি তোর…… থাক শব্দ টা উচ্চারণ করলাম না।
মৈত্রী হাসি থামাতে পারছে না।মিশুও হাসছে আর চিপস খাচ্ছে।
– মিশু,তুমি খুব ফানি।
– হ্যা।আমি মিসেস বিন।
– সেকি! মিসেস বিন?
– নাহ।মিসেস সারাংশ।
– সারাংশ মানে!
– সারের অংশ যার মাথায় আছে।তিনি হচ্ছে কাজী বিড়াল মৈত্রী।
– বাবাহ! কিসব নাম দিচ্ছ আমাদের! মর্ম হচ্ছে সারমর্ম আর আমি সারাংশ!
– হুম।
.
বাস একটা রেস্টুরেন্ট এর সামনে এসে দাড়ালো।খাবার গ্রহনের জন্য আধ ঘণ্টা বিরতি।
.
মিশু বাস থেকে নেমে মৈত্রীকে বলল,এখানে আমি কিছু খাবো না।
– কেন?
– এরা বিল বেশি নেয়।
– পাগলী, খেতে হবেনা?
– নাহ।ক্ষুধা নেই।এরা আসলেই বেশি পয়সা নেয়। আমি খাবো না।
– আরও অনেক টা পথ যেতে হবে।রাত হয়ে যাবে বাসায় পৌছাতে।খেয়ে নাও কিছু।
– আচ্ছা চলুন।
.
খেতে বসে মিশু বলল,আমি অড়হরের ডাল খাবো।
– কি? সেটা এখানে কিভাবে পাবা?
– তাহলে কচুফুলের ডাল।
– ডাল বাদ দিয়ে অন্য কিছু খাও।ওইসব এখানে পাবা না।
– তাহলে আলু সেদ্ধ?
মৈত্রী মুখ বাকিয়ে বলল,এসব জিনিস খাওয়ার শখ জাগছে না?
– হা হা।আসলে আমার বান্ধবীরা বলেছে আপনাকে খুব জব্দ করতে।
– ওহ হ্যা,এই নাও তোমার মোবাইল।পড়ে যাবে ভেবে পকেটে রেখে দিয়েছিলাম।
মিশু মোবাইল টা নিয়েই বলল,ভুলেই গিয়েছিলাম এটার কথা।
-এবার বলো কি খাবা?
– আপনার যা ইচ্ছে।
.
খাওয়া শেষ করে মিশু বাইরে এসে বলল,একটা সিগারেট খাওয়াবেন কাজী সাহেব?
– কিহ!
– শিঙাড়া।
– তুমি সিগারেট বলেছ।
– তাহলে জিজ্ঞেস করলেন কেন? খাওয়াবেন?
– অবাক হয়ে যাচ্ছি মিশু।
– অবাক হতেই থাকুন।পাশাপাশি একটা সিগারেট। আমার ছোটবেলার শখ একদিন সিগারেট টানবো। কখনো হয়ে উঠেনি। প্লিজ…
– এখানে নয়।লোকজন খারাপ বলবে।বাসায় গিয়ে খাওয়াবো।
– প্রমিস?
– হুম প্রমিস।
মিশু খুশিতে লাফিয়ে উঠল। কাজী ভাবল- এ কেমন অদ্ভুত মেয়েরে বাবাহ!
.
দুজনে বাসে উঠে পড়ল। কিছুক্ষনের মধ্যেই আবারো বাস ছেড়ে দিলো…..
মিষ্টি বাতাস এসে মনটাকে ফুরফুরে করে দিচ্ছে।
(চলবে…)