অতিথি,পর্ব:০৮,০৯
লেখা:মিশু মনি
পর্ব:০৮
জানালা দিয়ে মিষ্টি বাতাস এসে মনটাকে ফুরফুরে করে দিচ্ছে।
মিশু হঠাত মৈত্রীর মুখের দিকে একদৃস্টিতে তাকিয়ে রইলো। পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে।মৈত্রীর কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে।
বলল,মিশু এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
– আপনার চুল গুলা এত্ত সুন্দর কেন? আগে তো খেয়াল করিনি।বলেই মৈত্রির চুলে কয়েকবার হাত বুলিয়ে দিলো। মৈত্রী থ মেরে বসে আছে।কি বলবে বুঝতে পারছে না।
মিশু বলল,আপনার চোখ সবচেয়ে বেশি সুন্দর! এত সুন্দর কেন এই চোখ গুলো?
মিশুর কথা আর প্রশংসাময় বাক্যের সুর টাই অন্যরকম শোনাচ্ছে।মৈত্রীর কেমন যেন লাগছে।
মিশু একদৃস্টে তাকিয়েই আছে।মৈত্রী চোখ নামিয়ে নিলো। মিশু এভাবে পলকহীন ভাবে তাকাচ্ছে ব্যাপার টা অস্বস্তিকর।
মিশু বলল,জানেন জীবনে আজ ই প্রথম কোনো ছেলে মানুষ কে এত কাছ থেকে দেখছি।
মৈত্রী মাথা নিচু করে আছে।ওর ও ইচ্ছে করছে মিশুর চোখের দিকে তাকাতে।কিন্তু মিশু যেভাবে তাকিয়ে আছে, তাতে চোখাচোখি হলেই বিপদ।মিশু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছে। মৈত্রী নিজের দায়িত্ববোধ নিয়ে ভাবছে।দুই পরিবার অনেক ভরসা করে মৈত্রীর সাথে মিশুকে পাঠিয়েছে।তাছাড়া মিশুও মৈত্রীকে অনেক বিশ্বাস করে।কারও বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে অন্যপ্রকার কিছু ভাবা টা অন্যায় হয়ে যাবে।মিশুর বয়স কম।এভাবে তাকিয়ে থাকা টা ভয়ংকর, মেয়েটা সেটা বুঝেনা।অবুঝ মেয়ে।
মৈত্রী ফেসবুকে মনোযোগ দিলো। সে কোনোভাবেই মিশুর দিকে তাকাবে না আর।মিশুকে তো নিষেধ করাও যাচ্ছেনা।নিষেধ করলেই মুখ কালো করে ফেলবে।
মিশু বলল,কাজী সাহেব কি করছেন?
– ফেসবুকিং করছি।
– কিভাবে?
– বাসায় গিয়ে মর্ম’র কাছে শিখে নিও।
– আপনি শিখিয়ে দিন না।
– মর্ম বলেছে তুমি আসলে শিখিয়ে দিবে।ও তো সুন্দর কিছু প্রোফাইল পিক বেছে রেখেছে।
– আচ্ছা ঠিক আছে।আপনার মন খারাপ হলো কেন হঠাত?
– কই না তো।
– আমি দেখছি আপনার মন খারাপ। বলুন না কি হয়েছে? ফেসবুকে কি দেখে মন খারাপ হলো?
মৈত্রী মোবাইল টা পকেটে রেখে বলল,তোমাকে একটা কথা বলি মিশু? রাগ করবা না তো?
– নাহ।বলুন,
– তুমি এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? তুমি কি জানো এভাবে পলকহীন ভাবে তাকানো ঠিক না?
– কেন? তাকালাম বলেই তো বুঝতে পারলাম আপনার চোখ সুন্দর! দেখতেই ইচ্ছে করছে।
– এখানেই তো ভয় মিশু।এভাবে তাকালে কি হয় জানো?
– না তো। কি হয়?
– প্রেম হয়।
মিশু হঠাত কেমন যেন একটা ধাক্কা খেল।মনটা নিমিষেই অনেক খারাপ হয়ে গেল।মাথা নিচু করে ফেলল।
মৈত্রী বলল,কখনো কারও দিকে এভাবে তাকাবে না।তোমার বয়স অল্প,সবকিছু বুঝো না।এভাবে কাউকে দেখা খুব ভয়ংকর। আমি যদি তোমার দিকে এভাবেই তাকাই,তুমি নির্ঘাত প্রেমে পড়ে যাবে।তুমি বড় হচ্ছ।এই ব্যাপার গুলো মাথায় রাখবা।
মিশু জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।কিন্ত সবকিছু ঝাপসা দেখছে।চোখ ছলছল করছে।
মৈত্রী বলল,তুমি অবুঝ একটা মেয়ে।বড় হচ্ছ,এটা ভুলে যেও না।
মিশু বলল,আমি আর কোনোদিনো কারও চোখের দিকে তাকাবো না।
বলেই জানালায় হাত রেখে হাতের উপর মাথা দিয়ে চুপ হয়ে গেল।
মৈত্রী ভাবছে কি বলতে কি যে বললাম।ভালো কথাই তো বললাম।কিন্তু মিশু কি কাঁদছে!
– মিশু,
মিশুর কোনো সাড়া নেই।
– এই মিশু,
– হুম।
– রাগ করলা? ছোট আপু,রাগ করেনা।দেখো আমি তোমাকে একটা জিনিস বুঝিয়ে দিলাম। তুমি হচ্ছ,তোমার জানা দরকার। কখনো কোনো ছেলে তোমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকলে তুমি দৃস্টি সংযত করে নিবা।বুঝেছ?
মিশু কাঁদছে। কোনো জবাব নেই। কাজী অনেক কিছু বলেও মিশুর কোনো জবাব পেল না।মেয়েটা খুব মন খারাপ করেছে।কিন্তু এই পরিস্থিতিতে এটা বলা দোষের কিছু হয়নি।মৈত্রী চুপ করে ভাবছে।ব্যাপার টা কেমন যেন হয়ে গেল।ছোট মানুষ গুলোকে নিয়ে আর পারা যায় না।
– মিশু,গল্প শুনবা?
– কি গল্প?
– আমি বিদেশে ডিগ্রি নিতে গিয়েছিলাম তার গল্প।শুনবা?
মিশু চোখ মুছে মাথা নিচু করে বলল,বলুন শুনি।
– জানো আমি যে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম ওখানে একজন লন্ডনের ম্যাম ছিলেন। ম্যামের চেহারা দেখতে ছিল অনেকটা ঐশ্বর্য রায়ের মত।প্রথম প্রথম আমি ভাবতাম ইনি বোধহয় ঐশ্বরিয়ার বড় বোন।তারপর একদিন কি হলো জানো?
– থামুন। ম্যামের গল্প শুনবো না।অন্য গল্প বলুন?
– কেন?
– ভালো লাগছে না শুনতে।
– তাহলে কিসের গল্প শুনবা?
– আপনার কণ্ঠ শুনতে ইচ্ছে করছে না।কিছু মনে করবেন না।প্লিজ চুপ করে থাকুন।
মৈত্রী চুপ করে গেল।মিশু খুব মন খারাপ করেছে বোঝাই যাচ্ছে।আর কিছু বলতে সাহস করল না মৈত্রী।
মিশু হেডফোনটা বের করে বলল,আমাকে ডাকবেন না।আমি এখন গান শুনবো আর কাঁদবো। আর্টসেলের গান ছেড়ে দিন।
– কিন্তু তুমি তো আর্টসেলের গান পছন্দ করোনা।
– এখন শুনবো। আপত্তি আছে আপনার?
মৈত্রী কিছু না বলে ওর মোবাইল টা মিশুর দিকে এগিয়ে দিলো- যা খুশি শুনো।
মিশু চুপচাপ গান শুনতে লাগল।মৈত্রী চোখ বন্ধ করে আছে।জার্নির শুরু টা যেমন ছিল,শেষ টা তেমন হচ্ছেনা।আর বোধহয় হবেও না।মেয়েটা কাঁদছে।
মৈত্রী মনে মনে নিজের উপর ই রেগে গেল।কি দরকার ছিল ওকে কিছু বলার? ও বাচ্চা মেয়ে,আমার দিকে তাকিয়ে থাকত যতক্ষণ ইচ্ছে।আমার তো কোনো অসুবিধা ছিল না।অযথা কিছু বলতে গিয়ে মেয়েটাকে কষ্ট দিলাম।ভাবতে ভাবতে মৈত্রী ঘুমিয়ে পড়ল।
মিশু বাইরে তাকিয়ে আছে।গান শুনছে আর কাঁদছে। কেন কাঁদছে সেটা ও নিজেও জানেনা।
.
মৈত্রীর ঘুম ভাংল প্রায় দুই ঘণ্টা পর।চোখ মেলে দেখল মিশু জানালায় মাথা রেখে বাইরে তাকিয়ে আছে।মুখ দেখা যাচ্ছে না।
অনেক্ষন মৈত্রী চেষ্টা করল কথা বলতে।কিন্তু মিশু এদিকে ফিরেও তাকাল না।মৈত্রীর ও মনটা খারাপ হয়ে গেল।
হঠাত মিশু লাফিয়ে উঠে বলল,যমুনা সেতু!
মাথা বাড়িয়ে সেতু দেখতে লাগল।খুব উতফুল্ল দেখাচ্ছে।মৈত্রীর ভালো লাগল।এতক্ষনে মেয়েটাকে স্বাভাবিক লাগছে।মনটা ভালো হয়ে গেল।
মিশু বলল,সেতুর ঢোকার আগেই জায়গা গুলা বেশি ভালো লাগে।দুপাশে গাছের সারি,খুব সুন্দর না?
– হুম খুব সুন্দর।
– আমাকে এখানে বেড়াতে নিয়ে আসবেন?
– আচ্ছা নিয়ে আসবো।
– এতদূর নিয়ে আসবেন?
– তুমি যেখানে যেতে চাইবে, সেখানেই নিয়ে যাবো।
মিশু খুশি হয়ে বলল,আমি আপনাকে রংপুর দেখিয়েছি।আপনি আমাকে ঢাকা ঘুরে দেখাবেন।
– সারছে রে।রংপুর ঘুরতে তো বেশি সময় আর টাকা লাগেনি।কিন্তু তুমি ছয়মাসেও ঢাকা ঘুরে শেষ করতে পারবা না।আর টাকা কিরকম লাগতে পারে আইডিয়া আছে?
– তাহলে কোথাও যাবো না।সারাদিন রুমে বসে থাকবো।
– আহা! রাগ করো কেন মেয়ে? এটা এমনি বললাম। সত্যি তুমি যেখানে যেতে চাইবে,সেখানেই নিয়ে যাবো। খুশি?
– হুম।চিপস খাবেন?
– এই প্রথম আমাকে খেতে বললা।
মিশু হেসে এক প্যাকেট চিপস বের করে দিলো।
মৈত্রী চিপস খাচ্ছে।মিশু বাবল গাম ফুলাচ্ছে।
– কাজী সাহেব,আপনি কিন্তু বল ফুলাতে অক্ষম।আমার সব বান্ধবীকে বলে দিবো।
– আচ্ছা।
– আপনার মোবাইলে একটা কল রেকর্ড পেয়েছি।শুনে ফেলেছি কিন্তু।এটাও সবাইকে বলে দিবো।
মৈত্রী হাসল।এখন মিশুকে আগের মতই লাগছে!
মিশু বলল,আপনি খুব ভালো।
– তুমিও খুব ভালো মেয়ে মিশু।
– আমি ভালো? দাড়ান জব্দ শুরু করছি।
বলেই মুখ থেকে চুইংগাম বের করে মৈত্রীর চুলে লাগিয়ে দিলো।
মৈত্রী হতভম্ব! কিন্তু কিছু বলল না।মেয়েটি শান্ত থাকলে ভালো লাগেনা।যা খুশি করুক,কিচ্ছু বলবো না।
.
মিশু খিলখিল করে হাসছে।মৈত্রী চুলে হাত ও দিলো না।
বলল,এটা চুলেই থাক।তুমি দেখবা আর হাসবা।
– হা হা হা।তাহলে আপনার গায়েও একটা লাগিয়ে দিই?
– কি পাজি মেয়েরে বাবাহ!
– হা হা হা…
.
বাসায় পৌছেই মিশু দৌড়ে সবার সামনে গিয়ে আলাপ জমাতে লাগল।
মৈত্রীর বাবা মা মেয়েটির আনন্দ দেখে খুব খুশি!
মাত্রা এসে বলল,হ্যালো মিশু আপু।
– হ্যালো মুলভাব,
– মুলভাব মানে?
– বড় জন সারাংশ, মেজ জন সারমর্ম আর তুমি মুলভাব।
– হা হা হা।
মিশু হেসে কাজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,এই ছকিনা কেমন আছো?
– ভালো আপা।কিন্তু আমার নাম তো ছকিনা না।
– হা হা।আমি জানি, তুমি হচ্ছ ছকিনা হিমু।
হিমুও হাসতে লাগল।মিশুকে ওর খুব ভালো লাগে।
– এসেই পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছে রে।রাক্ষসী রানী কটকটি।
মিশু তাকিয়ে দেখে মর্ম।
মিশুকে দেখে সকলেই অনেক খুশি আর মর্ম বলছে রাক্ষসী!
মিশু রেগে মর্ম’র সামনে এসে দাড়ালো।
মর্ম বলল,রাক্ষসী তো এক সপ্তাহেই বড় হয়ে গেছ।
– পরে কথা বলছি।আগে তোমার রুম টা দেখিয়ে দেখিয়ে দাও।
– কেন?
– মুত্রথলির প্রেশার কমাবো।
মর্ম জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল,সর্বনাশ! তুমি চিঠিতে যা লিখেছ তা কি সত্যিই করবা নাকি?
– জ্বি।
– মিশু প্লিজ।এসব করিও না।তুমি আমার বোনের মত।
মিশু রেগে বলল,আমি তোমার বোনের মত?
– হ্যা আপু।অনেক দূর জার্নি করে এসেছেন। আপু এখন ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করুন।কি খাবেন বোন?
– হারামি তোর ঘাড় মটকে তোর রক্ত খাবো।
– সে জন্যই বলছি রাক্ষসী রানি কটকটি।রাক্ষসী আপা আমি রক্তকণিকার সংখ্যা বাড়াই আর আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।
– আমাকে আপা বলবা না।
– ওকে বোন।আপনাকে বোন বলবো।
– ওয়াশরুম কোনদিকে?
– হিমু দেখিয়ে দিবে।হিমু মিশুকে নিয়ে যাও তো।
.
মিশু ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তার টেবিলে বসল।
মর্ম হঠাত হো হো করে হেসে উঠল। সবাই তাকাল ওর দিকে।
মৈত্রী বলল,হাসছিস ক্যানো?
– ভাইয়া তোর চুল গুলা দলা পাকিয়ে আন্দোলন করছে কেন বলতো?
– চুইংগাম খেয়ে চুলে লাগিয়েছি।
– কেন?
– অনেকদিন থেকে চুল উঠেনা।তাই যাতে চুল উঠে, সেই ব্যবস্থা করছি।
– হা হা হা।
মিশু বলল,মিথ্যে কথা।ওটা আমি লাগিয়ে দিয়েছি।
মৈত্রীর বাবা বলল,সেটা আমাদের বুঝতে বাকি নেই।
– আংকেল আপনি কি বকা দিবেন?
– না।
– আংকেল তাহলে আপনার চুলে লাগিয়ে দেই?
মৈত্রীর বাবা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন। সবাই তো থ! কি বলে এই মেয়েটা!
( চলবে….)
অতিথি
পর্ব:০৯
লেখা: মিশু মনি
.
সকলে থ মেরে চেয়ে আছে মৈত্রীর বাবার দিকে।
তিনি বললেন,আমার চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দেয়ার কথা মুখে তুলেছ।তাহলে কাজটা করাও তোমার জন্য অসম্ভব না।কিন্তু মিশু মনি,আমি তো তোমার বাবার মত,আমার সাথে এসব দুষ্টুমি মানাবে না।
মিশু বলল,তাহলে আংকেল আপনার তো তিন তিনটা ছেলে;আমি ওদেরকে জব্দ করি?
– হ্যা করো।ওরা তো ছেলেমানুষ।
– আচ্ছা আংকেল।যত রকমের জব্দ আছে সব ওদের উপর প্রয়োগ করবো। আপনি পারমিশন দিলেন তো?
– হ্যা দিলাম।
তিন ভাই খাওয়া বন্ধ করে হা করে ওদের বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।বাবার মাথাও খারাপ হয়ে গেল নাকি! মিশুর সাথে তাল মিলিয়ে নিজের ছেলেদের জব্দ করতে বলছেন!
মিশু খুশিতে চেঁচিয়ে উঠে বলল,হুররে,লাইসেন্স পেয়ে গেছি।
তিন ভাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।
মিশু খেয়াল করে দেখল ওর পায়ের কাছে একটা বিড়াল। ও বলল,আপনাদের বাসায় বিড়াল আছে!
মর্ম বলল,হুম।ওটা আমাদের পোষা বিড়াল।
– তোমরা তাহলে চার ভাই?
সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।মর্ম রেগে যাচ্ছে।মৈত্রী হাসছে আর মিশুর সাহস দেখে অবাক হচ্ছে।আর মাত্রা ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে তাকাচ্ছে বারবার।
বাবা বললেন,মিশু চারভাই বলতে?
– আংকেল আপনার তিন ছেলের নাম হচ্ছে, হুলো বিড়াল, মেনি বিড়াল আর পুষি বিড়াল। আর এই যে আমার পায়ের কাছে এটা হচ্ছে পোষা বিড়াল। এরা চার ভাই।
– হা হা হা।মিশু তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে।কাউকে ভয় পাওনা তুমি,যা মনে আসে তাই বলো।
– সত্যি আমায় পছন্দ হয়েছে?
মৈত্রীর বাবা বললেন, হ্যা।খুব পছন্দ হয়েছে।
মিশু ভ্রুদুটো নাচিয়ে বলল,তাহলে আপনার ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিবেন?
মৈত্রীর বাবা মা দুজনেই থ! কারো মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছেনা।
মৈত্রী জিহ্বায় কামড় দিয়ে মিশুর দিকে তাকিয়ে আছে।ওর আশ্চর্য হওয়ার মাত্রা শেষ পর্যায়ে!
মর্ম মিটিমিটি হাসছে।মিশুর পাগলামো গুলো খুব উপভোগ করছে সে।
মিশু বুঝতে পারল, এই কথাটা বলা উচিৎ হয়নি।এখন নিজেরি লজ্জা লাগছে।
মিশু উঠে এক দৌড় দিয়ে রুমে চলে আসল।আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্বকে বলল,এই মিশু মনি।তুই এত্ত ইডিয়ট কেন রে? জানিস না বড়দের সামনে কিভাবে কথা বলতে হয়? তুই বডড ছেলেমানুষ রে।কবে বুঝবি এসব? আজ তো বাসে মৈত্রীর প্রেমেই পড়ে যাচ্ছিলি।ভাগ্যিস ছেলেটা ভালো ছিল।তুই কি হ্যা? পাজির পা ঝাড়া কোথাকার!
এভাবে অনেক্ষন আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের সাথে কথা বলে মিশু বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। খুব ক্লান্ত লাগছে।চোখ বন্ধ করা মাত্রই ঘুম এসে গেল।
.
খাবার টেবিলে কেউ আর কোনো কথা বলল না।সবাই চুপচাপ খেয়ে উঠে যে যার মত চলে গেল।
.
রাতের খাবার খাওয়ার জন্য মিশুকে ডাকতে এসে দেখা গেল ও গভীর ঘুমে মগ্ন।তাই কেউ আর ডাকেনি।
.
রাতে মর্ম মৈত্রীকে বলল,ভাইয়া রে।মিশুর মাঝে লজ্জার কোনো বালাই নাই।
– মেয়েটা ভালো।
– হুম। কিন্তু এমন ক্যান?
– তা আমি কি করে বলবো? তবে মিশু এমন বলেই আমাদের এত ভালো লাগে।ও যদি বুঝদার মেয়ে হত,তাহলে আমাদের হয়ত এতটা আনন্দ হত না।
– তাই নাকি? জার্নি কেমন লাগল?
– আজ আমার জীবনের সবচেয়ে সেরা ভ্রমণ ছিল।
– বাহ! খুব ভালো।
– হুম।খুব ক্লান্ত রে।ঘুমাতে হবে।
.
মিশুর ঘুম ভাংল খুব ভোরে।ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারল খুব ক্ষুধা লেগেছে।মনে পড়ে গেল রাতে খাওয়া হয়নি।কেউ ডেকে তুলেনি কেন? এটা হয়ত এ বাড়ির নিয়ম,কেউ ঘুমালে ডাকা যাবেনা।
ভাবতে ভাবতে মিশু উঠে ফ্রেশ হয়ে আসল।খুব ভালো ঘুম হয়েছে আজ।এক ঘুমেই রাত কাবার।
মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল সাড়ে চারটা বাজে।মিশুর আর ঘুম আসছে না।কি করা যায় তাই ভাবতে লাগল।ভাবতে ভাবতে মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি এসে গেল।মর্মকে জব্দ করা যাক।
.
মিশু পা টিপে টিপে মর্ম’র দরজায় আসল।কোথাও কোনো সারা শব্দ নেই।দরজায় ধাক্কা দিয়ে দেখল দরজা খোলাই আছে।মিশুর আনন্দ যেন আর ধরেই না।আজ মর্মকে এমন জব্দ করবো!
কথাটা মনে মনে বলে খুব সাবধানে রুমে ঢুকল মিশু।ঘর অন্ধকার। হাত নেড়ে নেড়ে বিছানা খুঁজে বের করে বিছানায় উঠে পড়ল।মর্ম গভীর ঘুমে মগ্ন।জোরে জোরে নিশ্বাস উঠা নামা করছে।
মিশু বিছানায় চুপ করে বসে ভাবতে লাগল কিভাবে জব্দ করা যায়! কিন্তু এখানে মর্মই ঘুমাচ্ছে তো! যদি অন্যকেউ ঘুমিয়ে থাকে! ভেবে মিশুর ভয় হতে লাগল।
মনে মনে বলল,যদি এমন হত;অন্ধকারে কিছুই দেখা যাবেনা শুধু মানুষের মুখ দেখা যাবে।তাহলে এই অন্ধকারে মুখ দেখে শিউর হতাম এটাই মর্ম।এখন কিভাবে সিউর হই?
মিশু বিছানার শিয়রে হাতরাতে লাগল।বিছানার শিয়রে মোবাইল থাকার সম্ভাবনা ৯০%.. সকলেই প্রায় বালিশের কাছে মোবাইল রেখে ঘুমায়।
মিশুর ধারনা ঠিক হল।বালিশের পাশে মোবাইল পাওয়া গেছে।মিশু মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে দেখল মর্ম’র ঘুমন্ত মুখ।মিশুর মনটা নেচে উঠল। এবার জব্দ শুরু করা যাক।
মিশু মর্ম’র গালে,কাধে,হাতে সমান তালে চিমটি দিতে লাগল।মর্ম ঘুমের ঘোরেই গালে চড় দিচ্ছে আর বলছে আহ! মশা আসল কি করে!
মিশু খুব মজা পাচ্ছে।এবার চিমটি বন্ধ করে অন্য উপায় প্রয়োগ করতে হবে।
মিশু মর্ম’র পাশে চুপ করে শুয়ে রইলো। তারপর মর্ম’র দিকে সরে আসতে লাগল।মর্ম যতই সরে যাচ্ছে মিশু ততই ওর দিকে সরে আসছে।মর্ম ঘুমের ঘোরেই সরে আসতে আসতে ধপাস করে বিছানা থেকে হুরমুরিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল।
মিশুর প্রচুর হাসি পাচ্ছে।খুব কষ্টে হাসি চেপে রাখল।মর্ম চেঁচিয়ে উঠল – উহহ বাবাগো।পড়ে গেলাম কি করে!
মিশু ততক্ষনাত বলে উঠল – কে এখানে! কে রুমে?
মিশুর কণ্ঠ শুনে মর্ম’র গলা শুকিয়ে গেল।একি! আমি মিশুর রুমে এলাম কি করে!
মর্ম কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না সে মিশুর রুমে আসল কিভাবে! কিন্তু যেভাবেই আসি না কেন এক্ষুনি পালাতে হবে। মিশু চেঁচামেচি শুরু করলে অবস্থা খারাপ আছে।মর্ম চুপ করে রইলো। মিশু যে রুমে ঘুমিয়েছে তার দরজা টা বামদিকে হওয়ার কথা।মর্ম হাতরে হাতরে দেয়ালে এসে দরজা খুঁজতে লাগল।
মিশু ভাবছে মর্ম হঠাত চুপ করে গেল কেন? নাকি মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়েছে?
মর্ম অনেক খুজেও দরজা অনুসন্ধান করে পেল না।আর পাবেই বা কিভাবে,সে তো মিশুর রুমে নয়। সে তার নিজের ই রুমে।আর মর্ম’র রুমের দরজা ডানদিকে।কাজেই দরজা খুজে পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
মর্ম চুপ করে দাড়িয়ে আছে।প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে।মিশুর রুমে আসল কিভাবে সেটাই বুঝতে পারছে না।আর রুমের দরজা গেল কোথায়?
পরক্ষনেই মর্ম’র মনে হলো আমি হয়ত নিজের রুমেই আছি।মিশুর কণ্ঠ ভুলেই শুনেছি বোধহয়।
ভাবতে ভাবতে ও বিছানার দিকে এগোতে লাগল।
অন্ধকারে মিশুও বুঝতে পারছে না মর্ম কি করছে।ও চুপচাপ বসেই আছে বিছানায়।
মর্ম বিছানায় উঠেই মিশুর সাথে ধাক্কা খেল।মিশু চেঁচিয়ে উঠল। মর্ম মিশুর মুখ চেপে ধরে বলল,চুপ চুপ চুপ।
মিশু হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, মর্ম! তুমি আমার রুমে!
– মিশু চুপ প্লিজ।আব্বু শুনতে পারলে মেরে ফেলবে।আস্তে কথা বলো।প্লিজ।
– ওকে আস্তেই বলছি।
মিশু ফিসফিস করে বলল,তুমি আমার রুমে কেন?
– আমার কান্না পাচ্ছে মিশু।আমি নিজেও জানিনা আমি তোমার রুমে কিভাবে আসলাম!
মিশু মনে মনে হেসে উঠল। বলল,এসবের মানে কি মর্ম?
– জানিনা।
মিশু মোবাইল এর টর্চ জ্বালিয়ে বলল,লাইট জ্বালো।
মর্ম লাইট জ্বালিয়ে হতভম্ব! সে তো তার নিজের রুমেই আছে।মিশু তার রুমে আসল কিভাবে?
মর্ম বিছানায় উঠে মিশুর সামনে বসে চোখে আগুন ঝরিয়ে বলল,তুমি আমার রুমে কেন? জানো কত টা ভয় পাইছিলাম?
মিশু কিছু না জানার ভান করে বলল,মানে! আমি তো কিচ্ছু জানিনা।আমিও অবাক হয়ে যাচ্ছি।আমি এই রুমে আসলাম কিভাবে? তুমি কি আমাকে তুলে এনেছ?
মর্ম জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল,সর্বনাশ! কি বলছ এসব! আব্বু মেরে ফেলবে।চুপ করো।
– কেন? আমিতো বলে দিবো ওনাকে।আমি ঘুমাচ্ছিলাম।আমি ঘুমালে কিচ্ছু বুঝতে পারিনা।আর তুমি আমাকে তুলে এই রুমে নিয়ে এসেছ।
মর্ম বলল,আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
– আমিতো ঘুমাচ্ছিলাম।আমি এই রুমে আসলাম কিভাবে!
মিশু কাদো কাদো গলায় বলল,তুমি আমাকে তুলে নিয়ে এসেছ? সত্যি করে বলো।
মর্ম চিন্তায় পড়ে গেল।মিশুকে দেখে মনে হচ্ছেনা সে নিজে এসেছে।তাহলে ও কিভাবে আসল এই রুমে!
চিন্তার কুলকিনারা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।মর্ম’র টেনশন বেড়েই চলেছে।
মর্ম’র চিন্তিত মুখ দেখে মিশুর খুব আনন্দ হচ্ছে।খুব জব্দ করা হলো।এবার সত্যি টা বলে দেয়া যাক।
বলার আগেই মর্ম বলল,মিশু বোন আমার আমি কিছু জানিনা বিশ্বাস করো।
মিশু হো হো করে হেসে উঠল।
– এই মিশু,হাসছ কেন?
– তুমি কি বোকা!
– তারমানে!
– আমি নিজেই হেটে হেটে তোমার রুমে এসেছি।বুঝলে বুদ্ধু?
মর্ম’র খুব রাগ হলো।এই মেয়ে তো সাংঘাতিক দুষ্টু! একটু আগেই কি চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল!
মিশু বলল,সরি মর্ম।
– সরি! চুপ করো পাজি মেয়ে।
– উহু।আমি পাজির পা ঝাড়া।
মর্ম অবাক হয়ে যাচ্ছে।এই মেয়েটা এমন কেন?
মিশু বলল,গুড মর্নিং সারমর্ম।
– গুড?
– হুম।আচ্ছা আপনি ঘুমান আমি যাই।
– আগে বলো কখন এসেছ আমার রুমে?
– সাড়ে চারটায়।এখন পাচ টা বাজে।
– কেন এসেছিলে?
– ঘুম ভেঙে গেছিল।আর ঘুম আসছিল না।তাই ভাবলাম তোমাকে একটু জব্দ করি।
– এত দুষ্টুমি বুদ্ধি পাও কই হুম?
মিশু হেসে বলল,রাগ করেছ?
– না।
– ভালো ছেলে।রাগ করেনা।তুমি ঘুমাও আমি যাই?
– নাহ বসো।আর ঘুম আসবে না।গল্প করি।
– আচ্ছা।আমার আপত্তি নেই।
মর্ম বলল,আমার কি পরিমাণ টেনশন উঠে গেছিল জানো? এমন দুষ্টু কেউ হয়?
– হা হা হা।আমি এমন ই।ভোর হয়েছে অনেক আগে।আকাশ ফর্সা হয়ে গেছে।চলো বাইরে হাটতে যাই?
– আচ্ছা চলো।
মর্ম কখনো ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাইরে বের হয়নি।আজ মিশুর সাথে খুব বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে।
.
বাইরে বের হয়ে দেখল চারিদিকে আবছা অন্ধকার এখনো। মাত্র ভোর হয়েছে।খুব মিষ্টি একটা সকাল!
মর্ম মিশুকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল,এত মিষ্টি সকাল!
মিশু বলল,জুতা খুলে রাখো।খালি পায়ে হাটবো।
– খালি পায়ে?
– হ্যা।হালকা শিশির পড়েছে ঘাসের উপর। বাগানে হাটবো আসো।
মর্ম মিশুর কথামত খালি পায়ে বাগানে আসল।কেমন অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে।মর্ম কখনোই ঘাসের শিশিরের উপরে খালি পায়ে হাটেনি।আজই প্রথম। তাই আনন্দ টাও অন্যরকম।
মিশু জিজ্ঞেস করল,আজকের সকাল টা খুব সুন্দর না?
– হ্যা।খুউউব সুন্দর!
– শিউলি ফুলের গাছ আছে তোমাদের বাগানে?
– হুম আছে।
– আমাকে নিয়ে চলো।
মর্ম মিশুকে শিউলিতলায় নিয়ে আসল।ফুলের ঘ্রাণে মন ভরে যাচ্ছে।এত মিষ্টি লাগছে সবকিছু যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা।
মর্ম মুগ্ধ! প্রকৃতির এই সৌন্দর্য কখনো উপভোগ করা হয়নি।
মিশু ফুল কুড়াচ্ছে।মর্মও যোগ দিলো। ফুল কুড়াতে এত মজা মর্ম আগে জানত না।
মিশু বলল,কেমন উপভোগ করছ সকাল টা?
– অসাধারণ!
ফুল কুড়িয়ে নিয়ে ওড়নায় ভরে বাসার দিকে পা বাড়াল মিশু।মর্ম’র যেতে ইচ্ছে করছে না।এখানেই ভালো লাগছে।
মিশু বলল,এই বাসায় চলো।
– আর কিছুক্ষণ থাকি?
– খুব ক্ষিধে পেয়েছে।প্রচুর ক্ষিদে।আমি ক্ষুধা সহ্য করতে পারিনা।খাবো চলো।
মর্মকে বাসায় আসতেই হলো।এখনো কেউ ওঠেনি।
মিশু বলল,ফ্রিজে মিষ্টি আছে?
মর্ম মিষ্টি বের করে দিয়ে বলল,খালি পেটে মিষ্টি খেও না।
– আমি খাবো। তুমি চা করে আনো যাও।
– আমি! পাগল হইছ?
– কেন ছেলে হয়েছ বলে চা করতে পারবা না? যাও চা করে নিয়ে আসো।
– পারবো না।
– যাও বলছি।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও মর্ম রানাঘরে ঢুকলো।
মিশু মিষ্টির প্লেট হাতে রান্নাঘরে এসে বলল,বিয়ের পর কিন্তু তুমি রান্না করবা।আর আমি খাবো।
– কিহ! বিয়ে মানে?
– তোমার আর আমার বিয়ের পর তুমিই রান্না করবা।বুঝেছ?
– হুহ আমার খেয়েদেয়ে কাজ নেই।তোমার মত বান্দর মেয়েকে বিয়ে করতে যাবো।
মিশু রেগে বলল, আমি বান্দর? যাও তোমার হাতের চা আমি খাবো না।
বলেই মিশু বেড়িয়ে আসল।মর্ম বাইরে এসে মিশুকে খুঁজতে লাগল।মিশু নেই কোথাও।মর্ম বিরক্ত হয়ে নিজের রুমে চলে আসল।
.
মিশু হিমুকে ডেকে তুলে রান্নাঘরে নিয়ে আসলো। তারপর কোমর বেধে রান্নায় লেগে পড়ল। সবাই ঘুম থেকে উঠার আগেই নাস্তা বানাতে হবে।হিমু মিশুকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে লাগল।
মর্ম ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়ল।
.
মৈত্রীর মা মিশুর কাজকর্ম দেখে অবাক! এত সকাল সকাল মেয়েটা কয়েকপ্রকার নাস্তা বানিয়ে ফেলেছে!
(চলবে…)