অতিথি
শেষ পর্ব
লেখা: মিশু মনি
.
প্রিয় অতিথি’র কিছু কথায় মিশুর জীবনে যে পরিবর্তন এসেছিল তা আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে।মিশু সবসময় ই নিজেকে উন্নত করার পেছনে সময় ব্যয় করেছে।কারো কাছেই মাথা নত করেনি,সর্বদা নিজের বিশ্বাসে অটল ছিল।
দেখতে দেখতে পাচ বছর কেটে গেছে।মিশু ডাক্তারি পড়ছে।ঢাকায় থেকে পড়াশুনা করলে ও এই পাচ বছরে মৈত্রী ছাড়া কাজী পরিবারের কারো সাথেই মিশু যোগাযোগ করেনি।এমনকি মৈত্রীর বিয়েতে ও শুধু মিশুর বাবা মা গিয়েছিলেন,মিশু উপস্থিত ছিল না।
.
পড়াশুনার খুব চাপ থাকার কারনে মিশু অনেক দিন বাসায় আসতে পারেনি।দীর্ঘ সময় পর আজ মিশু বাড়িতে ফিরলো।
.
মিশুর আসা উপলক্ষ্যে মা নিজ হাতে অনেক খাবার রান্না করলেন।মিশু রান্নাঘরে মায়ের পাশে বসে থেকে রান্না দেখছে আর চেঁচাচ্ছে, এত এত খাবার কে খাবে? মিশু কি গরু নাকি খাদক? আম্মু কি যে করো বুঝিনা।এত রান্না করছ কেন?
আম্মু হেসে বললেন, কতদিন পর এসেছিস বাসায়।
– আহা! অনেক দিন তো থাকবো। পরীক্ষা তো শেষ আম্মু।যতদিন থাকবো প্রতিদিন রান্না করে খাওয়াবা।
মা মিশুর কথায় অভিমান করে বললেন, আমি বুঝি রান্না ও করতে পারবো না?
মিশু আর কিছু বলল না।নিজের রুমে চলে আসলো।
.
এমন সময় বাড়ির সামনে গাড়ি এসে থামলো।মিশু অবাক হয়ে ছুটে বাইরে আসলো।
কালো রঙের গাড়িটার কাচগুলাও কালো,জানালা দিয়ে দেখা যায় না ভিতরে কে আছে!
মিশু অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে..
.
অবশেষে তারা গাড়ি থেকে নামলেন।মিশু চমকে উঠল। আরে এরা তো সেই অতিথি! যারা পাচ বছর আগে মিশুদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। সেই বিখ্যাত কাজী পরিবার।
মিশু আর দারিয়ে থাকতে পারলো না।এক ছুটে এসে মৈত্রীর মাকে জড়িয়ে ধরল।তিনি ও মিশুকে ধরে কেঁদে ফেললেন।
মিশুর চোখে ও পানি এসে গেছে।কত বছর এই প্রিয় মানুষ গুলোর সাথে দেখা হয়নি! সবাই কত বদলে গেছে!
মৈত্রীর বাবাও মিশুকে ধরে বললেন, কেমন আছো মা?
– ভালো আছি আংকেল।আপনি কেমন আছেন?
– অনেক ভালো আছি।তোমাকে দেখার পর কি আর খারাপ থাকতে পারি?
– চেহারা খারাপ হয়েছে আপনার।
– তুমি তো ডাক্তার হয়ে গেছ মিশু মা।এখন কিছুদিন এই ছেলের সেবা করে সতেজ করে তুলবা।
মিশু হেসে বলল,আচ্ছা আংকেল।আপনাদের দেখে কতটা খুশি হয়েছি জানেন না।
মিশুর চোখে আবারো পানি এসে গেলো।
মৈত্রীর স্ত্রী মিশুকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলল,আমার কথা ভুলেই গিয়েছ তাই না?
মিশু হেসে সুজানাকে জাপটে ধরল।
মাত্রা অনেক বড় হয়ে গেছে।মিশুর সাথে অনেক ফাজলামি করে বাড়ির ভিতরের দিকে গেলো।
মিশু কাজের মেয়ের কাছে এসে বলল,এই তোমার নাম কি ছকিনা?
– না আফা,
– তাহলে কি জরিনা?
– না আফা
– তাহলে কি নুরি?
– আফা আপ্নে ভুইলা গেছেন আমার নাম?
– আরে নাহ।তুমি হচ্ছ ছকিনা হিমু।
সকলে হেসে বাড়ির ভিতরে চলে গেলো।
.
মিশু কিছু একটা ভেবে আনমনা হয়ে যাচ্ছিল।মনের ভিতরে কেমন যেন করছে।মিশু বুঝতে পারছে না কি চলছে তার মনে।
ঘাসের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে,কেউ একজন এসে সামনে দাড়ালো।মিশু চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে মর্ম!
.
পাচ বছরে দুজনের মাঝেই বিশাল পরিবর্তন চলে এসেছে।মিশু বড় হয়ে গেছে,আগের চেয়ে অনেক সুন্দরী হয়েছে।মর্ম আগের মতই আছে তবে চেহারায় বয়স বৃদ্ধির ইংগিত।
দুজন দুজনের দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে আছে।যেন কারও মুখে কথা বলার শক্তি নেই।কথা হচ্ছে চোখে চোখে।
মর্ম’র চোখ বলছে,এই স্বার্থপর মেয়ে,এত বছর না দেখে কিভাবে ছিলে?
মিশুর চোখ জবাব দিলো, একবার ক্ষমা চাওয়ার অজুহাতে ও সামনে এসে দাড়াও নি স্বার্থপর।
মর্ম চোখে চোখে বলল,এখনো অভিমান করে আছো?
মিশুর চোখ জবাব দিলো,এ অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা কখনো করলে না।হায়রে মানুষ!
চোখে চোখেই কথা হচ্ছে।কেউ মুখ ফুটে কিছু বলছে না।
মৈত্রির উপদেশ,” কেউ চোখের দিকে একদৃস্টে তাকালে তুমি দৃস্টি সংযত করে নিবা।” – মিশু এতদিন সেটাই করে এসেছে।কিন্তু আজ চোখ সরাতে ইচ্ছে করছে না।এই মর্ম’র উপর অভিমানে কত অশ্রুজল ফেলেছে মেয়েটা, মর্ম কখনো নিজে থেকে কথা বলতে আসেনি।একবার কথা বললে হয়ত মিশু সব ভুলে কাজী বাড়িতে পা ফেলতে পারত।
কিন্তু মর্ম নিজের কাছে এত টাই ছোট হয়ে গিয়েছিল যে মিশুর কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ টাও তার ছিল না।
আজ দুজনে মুখোমুখি হয়েও সে চুপ করে আছে।
মিশুর কান্না আসছে।ও দাড়িয়ে থাকতে পারলো না।ছুটে নিজের ঘরে চলে আসলো।
.
সবাই নাস্তা খেতে বসলো একসাথে।মিশু খুব হাসছে আর আনন্দ করছে।মর্ম শুধু তাকাচ্ছে মিশুর দিকে।মেয়েটি আগের মতই চঞ্চল আর দুষ্টু আছে।
নাস্তা প্রায় শেষের দিকে তখন মৈত্রীর বাবা বললেন, মিশু মা একটা কথা বলবো?
– হ্যা আংকেল বলুন,
– আমার চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দিবা না?
সবাই অবাক হয়ে তাকাল ওনার দিকে।মিশু হেসে বলল,আচ্ছা।খাওয়া শেষ করে লাগিয়ে দিবো। চুইংগামের আঠা কিন্তু পিরিতের মত।একবার লাগলে পরে ছারে না।
সবাই হেসে উঠল।
মিশু বলল,আংকেল আপনার শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব আছে।আজ একটা ওষুধ লিখে দিবো।
– আচ্ছা।আমার মামনি ডাক্তার হয়ে বড় উপকার হলো।
মিশু বলল,সবার ই জন্য ওষুধ দিতে হবে।
মাত্রা জিজ্ঞেস করল,কেন আপু? আমাদের আবার কি অসুখ?
মিশু হেসে বলল,কৃমি।সবার কৃমি হয়েছে।
কেউ আর খাচ্ছে না।খাবার সময় এই কৃমি শব্দ টা উচ্চারণ না করলেই কি নয়?
মাত্রা ও ভীসন দুষ্টু হয়েছে।ও বলল,মিশুপু কৃমি দেখতে কেমন গো?
মিশু বলল,কৃমি দেখতে পুরাই নুডুলসের মত।
– আর কিসের মত?
– কেচো।কেচোর মত একদম।
সুজানা ওয়াক করে উঠল। কেউ হাসছে আর কেউ মিশুর দিকে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে।খাওয়ার রুচি টা আর কারও নেই।
মিশু এখন এই ধরনের কথা বলেই না প্রায়।কিন্তু আজ বড় বলতে ইচ্ছে করল।পুরোনো মানুষ গুলো যে বড় প্রিয়।
সবাই আবার খেতে শুরু করেছে।
মর্ম খেতে পারছে না।ওর শুধু বারবার মনে হচ্ছে মিশুর কাছে সহজ হই কি করে?
.
মৈত্রীর বাবা বললেন, মিশু একটা প্রস্তাব ছিল।
– হ্যা বলুন
– আমাদের বাড়ির বউ হবে না?
মিশু থমকে গেল।আচমকা এমন প্রশ্ন শুনার প্রস্তুতি ওর ছিল না।
মিশু বলল,মানে!
– মর্মকে বিয়ে করবে?
মিশু আর থাকতে পারল না।নিজের রুমে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল।অনেক স্মৃতি আজ মনে পড়ে যাচ্ছে।এই পাচ বছরে কারও সাথে বন্ধুত্ব করেনি সে।সবকিছু কেমন যেন লাগছে!
মিশু দরজায় তাকিয়ে দেখে মর্ম দারিয়ে আছে।মিশু অন্যদিকে তাকালো।
মর্ম এসে মিশুর সামনে দারাল।মিশু ও দারিয়ে পড়ল।
মর্ম কি বলবে বুঝতে পারছে না।এত দীর্ঘ সময় পর আজ কিভাবে সে মিশুর সাথে কথা শুরু করবে? কিভাবে ক্ষমা চাইবে সে মিশুর কাছে?
মিশু মাথা নিচু করে দারিয়ে আছে।মনটা অনেক আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছে। এই বুঝি কেঁদে ফেলবে মিশু।
মর্ম অনেক ভেবে ও বুঝতে পারলো না কি বলে কথা শুরু করবে।
চিন্তা ভাবনার কিনারা খুঁজে না পেয়ে বলেই ফেলল, I love you Mishu.
.
মিশু চমকে উঠে একবার তাকাল মর্ম’র দিকে।তারপর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে মর্মকে জরিয়ে ধরল।
মর্ম’র চোখে পানি এসে গেছে।মিশু শব্দ করে কাঁদছে। মর্ম নিষেধ করবে না।ও কাদুক,যত ইচ্ছে কাদতে থাক।
মিশু মর্ম’র বুকের সাথে মিশে যাচ্ছে আর কেঁদে চলেছে।মর্ম’র বুক ভিজে যাচ্ছে মিশুর চোখের জলে।
.
বাকিটা পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হবেনা,এবার বিয়ে,তারপর হানিমুন,তারপর মর্ম মিশুর ভালোবাসায় কাজী পরিবারে আশির্বাদ হয়ে জন্ম নিবে নতুন কোনো “অতিথি “…
সেই “অতিথি’ নিয়ে আবার রচিত হবে নতুন কোনো গল্প……
ভালো থাকুক মিসেস কাজী বিড়াল মিশু,ভালো থাকুক সকল “অতিথি ”
সমাপ্ত