অদ্ভুত_সম্মোহনী❤ PART_18

0
2904

অদ্ভুত_সম্মোহনী❤
PART_18
#FABIYAH_MOMO?

— তোর এই অবস্থা কিভাবে হইছে?
— উফ মা খেতে দেও না আগে।
— আমার সাথে নাফরমানী করবিনা সাদ!
— সরি,
— আমি জিজ্ঞাসা করেছি ‘কে করেছে এই কাজ!’

শেষের কথাটুকু হুঙ্কার দিয়ে বললো সাদের মা। সাদ পানি খেতে গিয়ে রীতিমতো গলা ভিজিয়ে ফেললো ধমকানি শুনে। সাইয়েদা আফরোজ খুবই কঠোর শক্তপোক্ত ধরনের মহিলা। কোনো কথা একবারের বেশি দু’বার বলতে মোটেও পছন্দ করেননা। সাদ ঠেলেঠুলে ঠোটে হাসি এনে বললো,
— মা?
— আমাকে রাগান্বিত করিস না!
— সরি…এগেইন সরি। মা প্লিজ তুমি আগে আমার কথাটা শুনো। তারপর যা ইচ্ছা তাই বলো। ঠিকআছে?
— সেটা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।

সাদ আবার টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে দুঢোক পানি খেলো। সাইয়েদা আফরোজ সোফায় মুখোমুখি হয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সাদ গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো,

— আসলে আমি অসুস্থ মা,
সাইয়েদা আফরোজের দৃষ্টিশক্তি রাগের অতলে ডুবে গেলেও নিজেকে সংযত রাখলেন। গলায় ঝাঝঁ মিশিয়ে চাপা কন্ঠে বললেন,
— আবার মিথ্যা!
— আরে সরি তো। ধুর ছাই। তোমার সাথে বলতে গেলেই খালি সরি সরি বলা লাগে।
— আমাকে তোর বাবা ভাবিস না সাদ। তোর বাবা থাকলে খুব সুন্দর করে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলতি। কিন্তু সময় এখন আমার দখলে! সত্য বল!
— রাহাত পিটিয়ে হসপিটালাইজ্ড করেছে।
— কোন সাহসে এই মহান করলো?
— মা ছেড়ে দাও। কিচ্ছু করতে যেও না।
— তুই আমাকে না করবি? আর আমি তোর কথা শুনবো? আমার রুলস রেগুলেশন ভুলে গেছিস সাদ?
— মা প্লিজ।
— কাল সকালের মধ্যে রাহাতকে সঠিক জায়গায় পাঠাচ্ছি । আমার ছেলের উপর হাত তোলার স্বাদ একেবারে পশমে পশমে টের পাইয়ে ছাড়বো।
— আল্লাহ্ মা! প্লিজ!
— মুরগি খাবি না হাসঁ খাবি?
— হাসঁ খাবো। মা প্লিজ! খাওয়াদাওয়া পরে! আগে তুমি মত চেন্জ করো।

সাইয়েদা ভাত মাখিয়ে ছেলের মুখে লোকমা পুড়ে দিলেন। খুবই শান্ত গম্ভীর ভঙ্গি। মুখে কতবছর যাবৎ হাসি নেই সাদ তা জানে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই মা হাসেনা। বাবার লাশের খাটিয়ার সাথে মায়ের হাসিটাও চলে গিয়েছিলো সেদিন। সাদ গাল ফুলিয়ে ভাত চিবুতেই বলে উঠলো,
— মা প্লিজ তুমি রাহাতকে কিছু করতে যেও না।
সাইয়েদা হাসেঁর মাংস ছিড়ে লোকমার ভেতরে পুড়ে সাদের উদ্দেশ্যে বললো,
— তুই আমার কাছ থেকে কতো কথা লুকাচ্ছিস সব কিন্তু জানি। তুই যে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে ওই স্টুডেন্টের বাসায় গিয়েছিলি সেটাও জানি।
সাদ চিবানো শেষ করে লোকমা গিলে বললো,
— মা আবার! উফ.. কতোবার বলেছি আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও। তুমি আবারো স্পাই লাগিয়ে দিয়েছো?
— ছেলেকে ছাড় দিয়েছি কিন্তু ছেড়ে দেয়নি। ভুলিস না আমি কি করতে জানি। তুই ওই বাড়ি থেকে মার খেয়ে আসবি আর আমি বসে থেকে তোর রঙ তামাশা দেখবো! তা চলবে না বাপু।
— তুমি কি করতে চাইছো মা?
— কিছুই না। যার যেটা প্রাপ্য সেটাই সুদ সহকারে বুঝিয়ে দিবো।
— তুমি কিন্তু আমাকে মারাত্মক টেনশানে ফেলছো মা!
— মেয়েটা কেমন! ভালো?
— এক কথায় মিষ্টি।
— মিষ্টি সব মেয়েই হয়। শুধু সময়ের সাথে সাথে মিষ্টি রূপ বদলে বিষাক্ত হয়ে যায়।
— তুমি তোমার ছেলের চয়েজের উপর ডাউট করছো মা?
— অবশ্যই না। তুই চাইলে এক্ষুনি মেয়েটাকে তোর পাশে এনে হাজির করতে পারি।
— ক্ষমতার জোর খাটাতে হবে না। তোমার ছেলে নিজেই তোমার মাকে এনে উপস্থিত করবে। আচ্ছা সাদিয়া আপু কবে আসবে? উনার না পরশু আসার কথা ছিলো?

সাইয়েদা তোয়াক্কা না করে ছেলের ঠোটে ঘোলাটে পানির গ্লাস ধরে বললেন,
— স্যালাইনের পানি এটা, খা। আর সাদিয়া একটু আগে ফোন দিয়ে বললো তোর ভাগ্নীর নাকি জ্বর। দুটো দিন পরে আসবে।
— সাদিয়া আপু আসলে কি মজা হতো। আপু সবসময়ই এন্ড মোমেন্টে প্ল্যান ক্যানসেল করে।জাস্ট ডিসগাস্টিং!

সাদকে শোয়ার টিশার্ট পড়িয়ে রুমের জানালা আটকে দিলো সাইয়েদা। বাড়ির সবচেয়ে ছোট রুমটা সাদের। বড়বোনের প্রতি অসীম মমতার অজুহাতে পাশের সবচেয়ে বড় রুমটা এখনো বদ্ধ রাখছে বহুদিন ধরে। আপু আগে ওরুমটায় থাকতো, বিয়ের পর রুমটা খালি, স্মৃতি হিসেবে রেখে রুমটি। সাইয়েদা বিছানায় বসে খাটে পিঠ লাগিয়ে কোলে ছেলের মাথাটা নিতেই সাদ মায়ের হাত গালে টেনে নেয়। মায়ের শরীর থেকে মা মা ঘ্রাণ পেয়েই অদ্ভুত মায়ায় ঘুম হাতছানি দিচ্ছে। মায়ের ঘ্রাণটা কতোদিন শুকে না সাদ!! এখন ভারী ভারী নিশ্বাসে শুকে নিচ্ছে মায়ের মিষ্টি সুভাস গন্ধ। সাইয়েদা চশমার আড়ালে থাকা দুটো চোখ দিয়ে ছেলেকে মনভরে দেখছে। ছেলেটা বাবার চেয়েও তিনগুণ বেশি সুন্দর হয়েছে। আরাফ তো সুদর্শনের জলন্ত প্রমাণ ছিলো কিন্তু এই ছেলে যে বাপকেও ছাড়িয়ে ফেলেছে! কি অদ্ভুত! এসব ভেবে মৃদ্যূ মনে দোল খাচ্ছেন সাইয়েদা। মনে করছেন পুরোনো দিনের কথা। এক পড়ন্ত বিকেলে উচ্ছল কিশোরীর মতো খিলখিলিয়ে বিনুনি আকড়ে হাটছিলেন তিনি। কোত্থেকে টুপ করে এক ছেলে এসে উনাকে চমকে গিয়ে একগোচ্ছা বেলিফুল এবং চার ভাজ করা কাগজ হাতে গুজে দিলো। সাইয়েদা হতভম্বের মতো মিনমিন করছিলো জিনিসগুলো দেখে। সে ভয় পেয়ে যেই দৌড় দিবে তার আগেই সুন্দর মতো একটি মিষ্টি চেহারার লোক এসে রাস্তা আটকে বলে, ‘ভালোবাসি’। সাইয়েদা কঠিন মুখে শত চেষ্টা করেও হাসি আনতে পারলেন না। একচুল না। আরাফের মৃত্যুটা সবকিছুর মৃত্যু ঘটিয়ে যায়। একটি হাসিখুশি মহিলার জীবন থেকে খুশি থাকার মাধ্যমটা চলে যায়। সে হাসতে পারেনা। শত চেষ্টাতেও না। এখন হাসির বদলে আসে বুক ফেটে কান্না। এই কান্না সন্তানদের দেখানো যায় না। কিছু জিনিস নিতান্তই নিজের। তার মধ্যে অন্যতম নিজের নোনাজলের অশ্রুগঙ্গা। সেটা কখনো কাউকে দেখানো যায় না। নিজের কলিজার মানিককেও না।

আরাফ কতো আদর করতো ছেলেকে নিয়ে। মানুষটা বারো বছরের বাচ্চা সাদকে রেখে পরপারে পাড়ি দিয়েছে। কঠিন চোখদুটো হঠাৎ ঝাপসা হয়ে এলো। ছেলেকে দেখলেই স্বামীর কথা মনে পড়ে সাইয়েদার। প্রিয় মানুষটার বিচ্ছেদ মেনে নেওয়ার কষ্টকর। সেই বিচ্ছেদ যদি মৃত্যু নামক কঠিন শব্দে জড়িয়ে থাকে সেটা আরো দুঃসহ। সাইয়েদা চোখ আড়াল করলেন। মাথায় ঘোমটা টানলেন। সাদ চোখ বুজে নম্র কন্ঠে বলে উঠলো,

— মা জানো? রাহা না খুব মিষ্টি।
— তুই এই কথাটা এ পযর্ন্ত অষ্টম বার বললি।
— তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো?
— না।
— একটু হেসে হেসে কথা বললে কি ক্ষতি হয়? আজীবন ঠোটের মধ্যে রাগীসুলভ ভাব।
— আমাকে নিয়ে বেশি কথা বলবি না। আগেও বলেছি।
— সরি,
— ঘুমা।
— মা? রাহা কিন্তু তোমার মতো ইরানি ইরানি ফর্সা না। ও একটু শ্যামলা। কিন্তু আমার ওতে সমস্যা নেই।
— স্বাভাবিক ভাষায় বললে, ও কালোই। কিন্তু আমি মেয়েটাকে দেখেছি। আমার কাছে চামড়া ফ্যাক্ট করেনি।
— আচ্ছা মা, আমি এক্ষুনি বললে এক্ষুনি কাজি ডাকবে?
— দুই মিনিট লাগবে।
— না বাবা দরকার নেই। কাজি যদি তোমার টিমের মানুষগুলাকে দেখে ভয় পায়? রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে বেচারার।

সাদ আলতো হেসে মায়ের হাত দুটো নিজের মুখের উপর নিয়ে বলে উঠলো,
— মা? রাহাকে এনে দিবে?
— তুই বললে আনবো।
— তুমিও না!! আমার কোনোকিছুতেই না করো না। কি যে ঝামেলা। মাঝেমাঝে না-ও তো করতে পারো। খালি একটা জিনিসই দাওনি। আফসোস!
— তোকে কোন জিনিসটা দেইনি?
— তোমার হাসিটা।
— আমার হাসি দেওয়ার মতো না। সেটা তোর বাবা নিজের লাশের সাথে কবরে নিয়ে গেছেন। এখন যাকে দেখছিস তার মধ্যে কোনো হাসিখুশি অনুভূতি নেই।
— রাহা খুব মিষ্টি মেয়ে। তোমাকে এতো এতো হাসাবে তখন তুমি তখন ওর আস্তানা থেকে ছাড় পাবেনা।
— নবম বার।
— মা তুমিওওও না…

হঠাৎ বিছানার কাছে কোনো কিছুর মাঝারি ধরনের কম্পন অনুভূত হলো। সাদ হাত বারিয়ে এদিক ওদিক হাতড়াতেই সাইয়েদা সেটা বালিশের কাছ থেকে নিয়ে ওর হাতে গুজে দিলেন। চোখ বন্ধ করে কোনোরকমে রিসিভ করেই কানে আটলো ফোন।

— তুই খুব খারাপ! তোর জামাই একটা বদ!
— খবরদার! তুই তানভীরকে নিয়ে যদি বিশ্রী কিছু বলেছিস!
— কি করবি? কি করার সাহস আছে? একটা ঘুষি মারলেই বাচ্চাদের সামনে হাত পা ছড়িয়ে ভ্যা ভ্যা করে কাদবি।
— মা কে বলে দিবো কিন্তু! এরপর দেখিস কেমন মজা দেখায়!!
— এহ্! আসছে! চোরের মায়ের বড় গলা!!
— তুই মাকে চোর বললি?
— ওই গাধা! তোর মাথায় কি গোবর ছাড়া ভালো কিছু নেই? গোবর যা আছে তাও যত্তসব উৎকৃষ্ট!
ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে বললো,
— সাদ!

সাদ হাসতে হাসতে বললো,
— চিল্লা চিল্লা!! আরো চিল্লা! তোর বাচ্চাদের সামনে তোর মানসম্মান যাবে। আমার কিছুই হবে না!!
সাদিয়া রাগে ফেটে যাচ্ছে। তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে তার রাগের হুল্কা! এই সাদটা দিনদিন প্রচন্ড বেয়াদব হয়ে উঠছে! বড় বোনের সাথে কিভাবে বিহেভ করা লাগে এখনো জানেই না সে! কেউ বলবে এই ছেলে বুয়েটে পড়ে? রাত পোহালেই তিনবাচ্চার বাপ হয়ে যাবে! অথচ এখনো বেয়াদবি করে বেড়াচ্ছে! সাদিয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে এলো কিছু ভয়ানক গালি দেওয়ার জন্য! যেই মুখ কুচকে ঠোঁট ভেদ করে কিছু বলবে সাদ কথার মোড় ঘুরিয়ে বললো,

— আপু কবে আসছিস? তোকে খুব মিস করছি রে। প্লিজ তাড়াতাড়ি আয় না। তোকে খুব ইর্ম্পট্যান্ট একটা কথা বলবো।
সাদিয়ার সদ্য জ্বলে উঠা রাগটা নিমিষেই নিভে গেলো। নিচু স্বরে অভিমানভরা কন্ঠে বলে উঠলো,

— তুই আমার সাথে কথা বলবি না বেয়াদ্দব! তুই আমার সাথে যে আচরণ করিস…
— তুই ছাড়া আমার আছে কে? কার সাথে এমন করবো বল?

সাদিয়ার হঠাৎই কথাটা সূচেঁর মতো বুকে বিধলো। ভেতরটা চিনচিন ব্যথায় করে উঠলো বুঝি। চোখ ঠেলে কান্না আসতে চাইলো। সাদিয়া পাশ ফিরে ঘুমন্ত বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে শান্ত সুরে বললো,
— তনুর জ্বর রে পাগলা। ওকে নিয়ে কিভাবে জার্নি করবো?
— আপু তনু কি খুব অসুস্থ রে? ভাই কোথায়? বাসায় নেই? তোর দজ্জাল শ্বাশুড়ি কি ঘুমায় নাকি?
— তানভীরের কাজের চাপ। মা অসুস্থ। দুটো দিন ধরে পায়ের ব্যাথায় ঘুমায় না।
— আমি কি আসবো আপু? তোর শ্বাশুড়ির তো আবার ঝামেলা না করলে তৃপ্তি লাগেনা।
— তুই বেশি বলছিস!
— তুই মিথ্যা বলছিস!
— আসতে হবে না বুড়া। দু’দিন পর তোর ভাইয়ের সাথেই আসবো। এখন বল কোন বিষয় নিয়ে এতো উতলা হয়ে আছিস? বিয়ে করবি নাকি? প্রেমিক পেয়েছিস?
সাদ একচোখ খুলে মাকে দেখলো। এরপর নিরিবিলি ভঙ্গিতে বললো,
— মা? তুমি ঘুমাও গিয়ে। আমি আপুর সাথে কথা বলবো।

সাদের মা সাদকে বালিশে শুয়িয়ে দরজা চাপিয়ে চলে গেলেন। সাদ মাথা উঠিয়ে দরজার শেষপ্রান্তে চোখ বুলালো। মা বাইরে দাড়িয়ে আছি কিনা দেখার জন্য। যদি ছায়া থাকে তাহরে মা বাইরে দাড়িয়ে কান খাড়া রেখেছে। উহু..ছায়া নেই। সাদ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বালিশে মাথা রাখতেই ‘হ্যালো হ্যালো’ বলে চিল্লাচ্ছে সাদিয়া। সাদ বিরক্ত কন্ঠে বললো,

— আরে বয়ড়া! ফোন কাটিনি! মা পাশে ছিলো। বুঝছিস?
— তাই বল। এভাবে চুপ হয়ে গেলি দেখে টেনশন হচ্ছিলো। বল বল সব বল!! মেয়েটা কে? কিসে পড়ে? কোথায় থাকে? দেখতে কেমন? সুন্দর? আমার কিউট ভাইটার প্রেমে অবশ্যই একটা পরী ফেসেছে!! তাই না রে পাগলা?
— তুই আস্তা একটা গাধার ছাও!
— ওমা! কি বললাম?
— একসাথে এতোগুলা প্রশ্ন করতে হয়? ভাইবাতেও এতো প্রশ্ন করেনি যতটা তুই করেছিস! কি যে শিক্ষা দিবি অমার আম্মুগুলাকে!
— এই বাড়াবাড়ি করবি না বলছি! তুই কিন্তু খুব খারাপ বিহেভ করছিস!
— শোন বলি। মেয়েটার নাম রাহা। দেখতে পুরো মিষ্টির দোকান। এতো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে যে তোর পুরো মাথাই ঘোলাটে করে দিবে। আর জানিস? ও না তোর ভাইয়ের মতো বুয়েটে পড়তে চায়! কি ম্যাচিং টেস্ট দেখছিস?

সাদিয়া অবাক হয়ে বললো,
— তোর স্টুডেন্ট নাকি সাদ?
— কারেক্ট!
— ওমা! তুই কি বোকা নাকি রে ! ওই ছাত্রীর সাথে হাঙ্কিপাঙ্কি করেছিস? ছি ছি স্যার হয়ে স্টুডেন্টের সাথে প্রেম? ও মাবুদ তুমি আমার ভাইয়ের জন্য মাটি ফাঁক করো! নিয়ে যাও নিয়ে যাও!!
— কেমন বজ্জাত! নিজেরটা না বলে আমার জন্য মাটি ফাক করার দোয়া চলছে! বাহ্ রে বাহ্!!
— আচ্ছা তুই কি সিরিয়াসলি বিয়ে করেছিস? প্লিজ ভাই তুই আবার সাকিব খানের মতো কারবার করিস না!
— আরে বোন আমার। সম্পূর্ণ কথা তো শোন! আমি এখন পযর্ন্ত তিন কবুলই বলিনি। জাস্ট মন থেকে বউ মেনেছি। মনের ট্যূরই বড় ট্যূর…বুঝছিস না?
— বেকুবের বাচ্চা! তাড়াতাড়ি বিয়ে কর! আর কতো সিঙ্গেলের স্ট্যাম্প লাগিয়ে ঘুরবি?
— আহ্..উচিত কথা! এবার দেখিস এমন বিয়ে করবো না! তোর শ্বশুরবাড়ির চৌদ্দগুষ্ঠি পযর্ন্ত সাদ সাদ করবে!
— তুই কথায় কথায় আমার শ্বশুরবাড়ি টানিস কেন!
— কারন তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন একেকটা খাচ্চর!
— তোকে কি করেছে শুনি!
— অনেককিছু করছে বলা যাবে না। প্রথম কথা, আমি আমার আদরের বোনকে ওই বাড়িতে পাঠিয়েছি অথচ কেউ তাকে সম্মান করেনা।
— এগুলো বলিস না পাগলা। মা শুনলে কষ্ট পাবে।
— মা মা করেই তো জীবনটা তোর গেলো। মা যে কত্তো ডেন্জারাস চিজ! জানিস আমার পেছনে আবার স্পাই লাগিয়েছে! মন চাচ্ছে এক চামচ শরবত খেয়ে মরে যাই!

সাদের কথা শুনে আর থামতে পারলো না সাদিয়া। হো হো করে হেসে উঠলো। হাসি যেনো থামছেই না। সাদের মনে প্রশান্তির অনুভব হলো। বড় বোনকে হাসাতে পারলে নিজেকে কতোটা স্বার্থক লাগে। এই অনুভূতিটা কাগজে কলমে বোঝানো সম্ভব না। কক্ষনো না। সাদ ফোনের বিপরীতে হাসির শব্দটা শুনে মুচকি হাসলো।

— তুই আর শুধরালি বান্দর!! ওমা কি যে পেট ব্যথা করছে!! ইশ রে হাসির শব্দে তনু উঠে গেলো। আচ্ছা পড়ে কথা বলি। এখন রাখছি কেমন? আল্লাহ হাফেজ।
— আল্লাহ হাফেজ আপু।

?

সকাল হতেই ভয়ঙ্কর কান্ড ঘটে গেলো রাহার বাসায়। একদল পুলিশের ইউনিফর্ম পড়া লোক ঢুকে রাহাতের নাম নিচ্ছে বারবার। পাচঁজন পুলিশের মধ্যে একজনের হাতে রূপোর তেরি চকচকে হ্যান্ডক্রাফ। দেখে মনে হচ্ছে পুলিশের লোকগুলো রাহাত নামক প্রাণীর জন্য মাত্র জিনিসটা কিনে আনলো। রাহার বাবা রীতিমতো ঘামতে শুরু করেছেন পুলিশ দেখে। পান্জাবীর পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল মুছছেন একটু পরপর। রাহার মা, ফুপি, ফুপা, নিবির নিচে থাকলেও রাহাত নিচে নামেনি এখনো। নাক ডেকে উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে রুমে। উপর থেকে পুলিশের আগমন দেখে রূপ প্রচন্ড ভয় পেলো! যদি পুলিশ ওদের বিনা দোষে ধরে নিয়ে যায়? রূপ দৌড়ে রাহার রুমে ছুটে দরজা আটকে সাদের নাম্বারে তৎক্ষণাৎ ডায়াল বসালো। রূপের হঠাৎ প্রবেশ দেখে বিছানায় বসে থাকা রাহার চোখ গোলগোল হয়ে গেলো। কিছু তো একটা ঘটেছে! আপুকে এতো চিন্তিত দেখাচ্ছে কেনো? মনে মনে প্রশ্নের আকিবুকি করতেই রাহা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,

— আপু? তুই এরকম ছিলা মুরগির মতো ছটফট কেন করছিস?

রূপের হাত, পা, মুখ ঘেমে চিকচিক করছে। কানে ফোন লাগিয়ে কাউকে কলের উপর কল করেই যাচ্ছে। রূপ আরেকবার ডায়াল বসিয়ে ফোন কানে ধরতেই রাহার দিকে তাকিয়ে বললো,

— নিচে পুলিশ এসেছে!! পুলিশ রাহাত ভাইকে ধরে নিয়ে যাবে!!

— কিহ্!

রাহা তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নামতে গিয়ে পায়ের পাতায় উষ্টা খেলো। ‘উহ্..’ শব্দ করে চোখ কুচকে বসতেই রূপের ছটফটানি গলার স্বর শুনতে পেলো,

— সাদ ভাইয়া! সাদ ভাইয়া!! বাসায় পুলিশ!!
—…………………….
— আপনি তাড়াতাড়ি কিছু করুন!! পুলিশ এসে রাহাত ভাইকে খুজছে!!!
—…………………….
— আমার ভয় করছে ভাইয়া!! যদি কিছু হয়ে যায়…

?

— আসসালামুয়ালাইকুম, ভালো আছেন নিশ্চয়ই?

তোতলাতে তোতলাতে বললেন,
— ও ওলাইকুমসসালাম..জ জ্বি ভভালো,
— আহা তোতলাচ্ছেন কেন? আমাকে ভয় পেলে চলবেনা। এইযে নিন টিস্যু। কপালের ঘাম মুছুন।
— ননা ননা ললালাগবে না,
— বেশ। মূলকথায় আসি, বিয়েটা দিবেন কবে? ডেট, টাইম ফিক্স করা তো আমাদের উচিত। তবে আপনাদের সুযোগটা দিচ্ছি।
— আআপনি দেদেখলে ভভালো হয়,
— মহাশয়? দয়াকরে তোতলানো বন্ধ করুন। এগুলো আমাকে অস্বস্তি ফিল করাচ্ছে।

সাইয়েদা হাতঘড়িটা চোখের সামনে তুলে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
— আমার হাতে সময় নেই বেয়াই সাহেব। কাজে যেতে হবে। আমি আবার পাংচুয়েলিটি পছন্দ করি।

রাহার বাবা রুমালে কপাল ঘষে জোরপূর্বক হাসি টেনে বললেন,
— কাকালকে ঠিক করি?

হঠাৎ ঘড়ি দেখা বাদ দিয়ে উনি চকিত নজরে রাহার বাবার দিকে তাকালেন। উনি থতমত খেলেন ভদ্রমহিলার তীরের মতো দৃষ্টি দেখে। চোখ নামিয়ে করলেন ফ্লোরে।

— আমি তো ভেবেছি আপনি আরো দেরি করবেন। বেশ! আমি আজ রাতের মধ্যে বিয়ের মালসামান আপনাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। হৈচৈ বিয়ে আমার সহ্য না। সাধারণ বেশভূষায় বউকে তুলে নিয়ে যাবো। আপনি কি মত দিচ্ছেন?

রাহার বাবা মাথা তুলেই অস্থির কন্ঠে বললেন,
— জ্বী জ্বী…জ্বী আপনি যেটা ভালো মনে করেন।
— তাহলে আজ উঠি। কাল এসে বউকে নিয়ে যাবো। ভালো থাকবেন।

সাইয়েদা আফরোজ সোফা ছেড়ে উঠে দাড়াতেই হঠাৎ কি যেনো ভেবে বলে উঠলেন,
— বউয়ের রুমটা কোথায়? দেখবো!
রাহার বাবার পাশে উঠে দাড়িয়ে ইশারা করলেন রাহার মাকে। রাহার মা সম্মতি সূচকে মা উপরনিচ নাড়িয়ে হাসিমুখে সাইয়েদাকে নিয়ে যেতে লাগলেন। দরজার সামনে দাড়াতেই রাহা একজন পরিপাটি মহিলাকে দেখতে পেলো। কি সুন্দর দেখতে! অপরূপ সুন্দরী এই মহিলা! গায়ে গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি, মাথায় সুন্দর করে হিজাব বাধা, মুখটা নিকাপের আড়ালে ঢেকে থাকলেও চোখ দুটো বর্ননা করে দিচ্ছে সাইয়েদার সৌন্দর্য্য। রাহা উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করলে সাইয়েদা হাত উচু করে থামিয়ে দেয়। রাহা স্থির হয়ে বিছানায় বসে পড়ে। সাইয়েদা রাহার মাকে বললেন,

— একান্ত ছাড়ুন।

রাহার মা রাহার দিকে একপলক তাকিয়ে হাঁটা ধরলেন প্রস্থানের দিকে। সাইয়েদা রুমে ঢুকে রাহার পাশে বসে। রাহার ফোলা ফোলা চোখদুটোতে নিজের চোখ আটকে বলে উঠলেন,

— সারারাত কেদেঁছো?
রাহা কথা বলতে পারলো না। দেখা গেলো নিচের ঠোটটা দাঁতে চেপে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। চোখের মণিতে কত কান্না!!সাইয়েদা মাথায় হাত রাখলেন। রাহার বামচোখের কোণা থেকে টপ করে একফোঁটা অশ্রু গড়ালো। সাইয়েদা নিজের শাড়ির আচলটা টেনে রাহার গাল সর্ন্তপণে মুছে দিলো। রাহার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না ইনি ওর হবু শ্বাশুড়ি। শ্বাশুড়ি এতো স্নেহের সাথে নিজের শাড়ির আচলে চোখ মুছে দিবেন? এমন কি হয়? সাইয়েদা বললেন,

— এই রাতটুকু কষ্ট করো। কাল থেকে আমার ছেলের সাথে বন্দি করে রাখবো।
রাহার চোখ এবার বর্ষার জ্বলের মতো প্লাবিত হলো। মাথা নুয়ে চোখ থেকে অঝোরে অশ্রুবৃষ্টি বর্ষণ করলো। টপটপ করে মোটা প্রশস্ত অশ্রুগুলো সাদা চাদরে গোলাকার হয়ে পড়ছে। সাইয়েদা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই বলে উঠলেন,
— ছেলেটা যদি আগেই বিয়ের জন্য আমাকে বলতো। তোমার এতো কষ্ট পোহাতে হতো না। শুনেছি একরাত তোমরা কোন বাড়িতেও থেকেছো। বিয়েটা হয়ে গেলে রাতটা তোমাদের কষ্ট হতো না। দম্পতির মতোই থাকতে পারতে। আমি আমার সাদকে চিনি নিজের সীমা অবশ্যই লঙ্ঘন করেনি। কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করতেও বেগ পেতে হয়েছে। বাদ দেই। তোমার বাবার সাথে সব আলোচনা করে গিয়েছি। কাল এসে হলুদ দিয়ে একেবারে বিয়ের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবো। কান্না করো না। তোমাকে আমার মতো শক্ত হওয়া উচিত। যেকোনো পরিস্থিতিতে কাদঁলেই যে সমস্যার সমাধান হবে। তা জীবনেও ভাববে না। মেয়ের মতোই রাখবো। পড়াশোনা করতে চাইলে করবে। আমাকে যেমন আরাফ বাধা দেয়নি, তোমাকিও তোমার পড়াশোনা চালাতে বাধা দিবো না। আরাফ হলো তোমার মরহুম শ্বশুড়। ব্রেন স্ট্রোকে পরপার হয়েছেন। আমি চাই না আরাফের মতো দূর্ঘটনা তোমার জীবনেও হোক। ছেলেকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে দেশব্রতে একটু নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই। ছেলেটাকে দেখে রেখো। খুব সহজ দায়িত্ব মনে হলেও ততো সহজ না। মা হিসেবে যতটুকু দায়ভার ছিলো সব পূর্ণ করেছি। এখন থেকে সবটা তোমার। সাদকে দেখে রেখো। দেরি হয়ে যাচ্ছে অফিসে। চলি মা।

রাহার সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো। কানে বারংবার প্রতিধ্বনিত্ব হচ্ছিলো ‘মা’ ডাকটা। কি মধুর ডাক! কোনো শ্বাশুড়ি এতো আবেগপূর্ণ ডাকে মা বলতে পারে? মায়ের টানটা সাইয়েদার প্রতিও চুম্বকের মতো অনুভব হচ্ছে। রাহা শ্রদ্ধা ভরা চোখে সাইয়েদার চলে যাওয়া দেখলো। একজন সৎ, ভালো, ন্যায়নিষ্ঠ মায়ের গর্ভ থেকে একজন সাদের মতো ছেলেই হয়। না কখনো খারাপ নেশায় ঝুকেছে, না কখনো প্রতিশোধের আগুন দপদপ করেছে। রাহাতকে কতো সুন্দর করে মাফ করে দিলো সাদ। মাকে মানিয়ে পুলিশকে বিদায় করে কি সুন্দর নিপূণতার সাথে বুকে চেপে ধরলো রাহাতকে। সাদের সেই মিষ্টি, মায়াবী হাসিটার শব্দে রাহাতের মনটা কেমন নতজানু হয়ে রইলো। রাহাত কি ভুল বুঝতে পেরেছে? বন্ধুকে ভুল বুঝে পিটানো যে ঘোরতর পাপ হয়েছে! হারে হারে কি অনুশোচনা করছে রাহাত? এমন বন্ধু যে ভাগ্যবান পায় নাকি সেটা ভেবেই ভাষা হারিয়ে চুপ করে ছিলো সে?

-চলবে

#ফাবিয়াহ্_মম?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here