অদ্ভুত_সম্মোহনী❤ PART_19_20

0
5111

অদ্ভুত_সম্মোহনী❤
PART_19_20
#LAST_PART
#FABIYAH_MOMO?

(ইতি পর্ব)
?
সকাল থেকে ব্যস্ত সবাই। চোখেমুখে উপচে পড়া ব্যস্ততা, তুমুল অস্থিরতা, ঘামে শরীর চটচটে, হুলস্থুল অবস্থা। রাহার মা রান্নার কাজে পইপই করছেন, বাবা গিয়েছেন কাজির ব্যবস্থা সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেখতে, নিবির বাড়িতে আলোকসজ্জার ডেকোরেশন নিয়ে এদিক-ওদিক ছুটছে, রূপ দেখছে রাহার দিকে। রাহার মনটা সকাল থেকেই কাঁদোকাঁদো। হুট করে বিয়ে হওয়াটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেনা। কালই দেখা হলো সাদের মায়ের সাথে! আর আজ কিনা নতুন বাড়িতে গিয়ে অন্য একজনকে মা মা ডাকবে। যদিও রাহাকে নিয়ে রাহাতের মনে এখনো একটু-আধটু মনোমালিন্যের রেশ থেকে গেছে। কথা বলেনা রাহার সাথে। রূপ বিছানার উপর বিয়ের লেহেঙ্গা, কসমেটিক আইটেম, গহনা, অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রসাধনী লাগেজ থেকে বের করে রাখছে। বিছানার এককোণে চুপচাপ রূপের বান্ধুবীদের পাশে বসে আছে রাহা। সীমা বিয়ের লেহেঙ্গা দেখতেই চোখ বিষ্ময়ে তুলে বলে উঠলো,

— কিরে! এতো সুন্দর লেহেঙ্গা! এই লেহেঙ্গা না প্রিয়ন্তীর বিয়েতে দেখছিলাম? একটা সেলিব্রেটি আপু পড়ে আসছিলো?
রুশা কথা কেটে বলে উঠলো,
— হ্যাঁ একদম ঠিক বলছিস! আমি কতক্ষন ধরে ঠেলাঠেলি করছি অথচ মনেই করতে পারছিনা কোথায় দেখেছি!
— প্রচুর হেভি ওয়ার্ক দোস্ত! রাহা এইটা পড়বে কি করে? শরীর খসে যাবে!
তানিশা হুঙ্কার দিয়ে বললো,
— বিয়ের রাতে বুঝি শরীর ঠিক থাকবে? কত প্রকার ঝামেলা যে পোহাবে!!
রুশা কথা টান মেরে বললো,
— সাদ ভাই কিন্তু জম্পেশ খেলোয়াড়!! তার উপর হট চিজ!! রাহার কিন্তু মাথা ঠিক থাকবেনা!!
— উফ রুশা! কথা কিন্তু ভুল বলিস নি রে!! আমাদের রাহার লাক আসলেই খুব ভালো! দেখ না? আমরা সারাবছর একটার পর একটা রিলেশন করলাম কিন্তু নাকের তল দিয়ে রাহা হাত মারলো!! হোয়াট এ্যা গ্রেট খিলাড়ি!
তানিশার কথা শুনে সবাই হো হো করে হাসিতে মেতে উঠলো। রূপ খানিকটা দূরে দাড়িয়ে আয়নার সামনে জিনিস রেডিতে ব্যস্ত।
রাহা ভ্রুকুচকে তানিশার কথা বোঝার চেষ্টা করতেই তানিশা কথাটা যে খুবই বাজে ভাবে গুলাচ্ছে সেটা বুঝতে পেরে পাল্টা জবাব দিলো,

— আপু তুমি কথাটা একটু খারাপ দিকে নিচ্ছো না? সবসময় এটা ভাবো কেনো বিয়ের রাতে ধকল যাবে? যারা ধকলের মধ্যে থেকেছে তারা অবশ্যই তাক মাথাওয়ালার টাকাপয়সা দেখেই বিয়ে করেছে। ফলাফল কচি বউ পেয়ে বেটার লোম খাড়া হয়েছে! দুঃখিত কথাগুলো খারাপ ভাবে বলতে বাধ্য হলাম। কিন্তু তোমরা কিন্তু একটু পর পর খারাপ খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছো! আমার এগুলো ভালো লাগছে না। আপু? এই আপু? শোন তো?

রাহার চিল্লাচিল্লির ডাক শুনতেই রূপ কপালে ভাজঁ ফেলে দ্রুত বিছানার কাছে এসে বললো,
— কিরে ডাকছিস? কিছু প্রয়োজন?
— আপু তোমার বান্ধুবীদের বিদেয় কর। আমার এখন কিচ্ছু ভালো লাগছেনা প্লিজ!
— ওরা কি করেছে?
— আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছে। তুমি তো জানো আমি উটকো কথার ঢেকি শোনার জন্যে বসে নই। কুইক এদেরকে যেতে বলো! এক্ষুনি!

রূপ কিছু বলার আগেই সবকয়টা অপমানবোধ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। রূপ ওদের যাওয়ার দিকে একমনে তাকিয়ে থাকলে রাহা গড়গড় করে বললো,
— সরি আপু। আমি কিন্তু মোটেও উনাদের সাথে উগ্র আচরন করতে চাইনি। উনারা যতবারই আসে ততবারই ফালতু ফালতু কথা শোনায়। এসব কিন্তু অসহ্য! একটু টেবিলের কাছ থেকে ফোনটা দিবে?

রূপ হাত থেকে পার্ল ক্লিপের পাতাটা বিছানায় রাখতেই রাহার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিলো। রাহা ফোনটা নিয়ে কাউকে কল দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে রূপ পাশ থেকে বলে উঠে,
— হাত কি নাড়াতে পারছিস? ব্যথা কমেছে? আর পায়ের অবস্থা কি রকম বলতো?
রাহা কানে ফোন ধরে রূপের দিকে তাকিয়ে বললো,
— এইযে দেখো ফোন ধরে আছি ব্যথা নেই। পা-টা একটু ব্যথা করে। কিন্তু আরেকবার গরম সেক নিলেই উধাও হয়ে যাবে। তুমি গোসলে যাবা না? যাও যাও.. পরে কিন্তু টাইম পাবা না।

রূপ সব ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে নিজের শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে আবদ্ধ হলো। রাহার কাঙ্ক্ষিত কলটা কেউ ধরতেই ওপাশ থেকে ঘুমু ঘুমু কন্ঠে কেউ বলে উঠলো, ‘হ্যালো’। অস্বাভাবিক ঘুমে তলিয়ে কথাটা বলছে! এই অসময়ে ঘুম কিসের? আশ্চর্য!রাহা জিজ্ঞাসু স্বরে বললো,

— আপনি এখন ঘুমাচ্ছেন? বিকেলে না বরযাত্রী নিয়ে রওনা হবেন? কাজ নেই?

অতিরিক্ত ঘুমে ঢুলুঢুলু কন্ঠে ধীরে ধীরে বললো,
— রাত জাগতে হবে তো। তাই এখন ঘুমাচ্ছি।
— কিহ্!
— আহা…অবাকের কি আছে,
— আপনি কোন্ মিনে কথা ডাইভার্ট করছেন?

বড় একটা হাই তোলে চোখ বন্ধ অবস্থায় বললো,
— যাহা সত্য তাহাই বলেছি। বায় দ্যা ওয়ে…আমি রাতে খুশির ঠেলায় ঘুমাতে পারিনি। মা কালরাতে হুট করে বউ তুলে আনার কথা বলবে! স্টিল মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। সকালের নাস্তা খেয়ে যে শুয়েছি এখনো বিছানা ছাড়িনি।
— আন্টি বকেনি?
— একমিনিট! কে আন্টি?
— আপনার আম্মু,
— মায়ের সামনে ভুলেও তুমি আন্টি বলতে যেও না। চড় দিয়ে গাল লাল করে দিবে।
— কিহ্ বললেন! কেনো মারবে?
— তুমি মা না ডেকে আন্টি ফান্টি ডাকলে তোমাকে কি চুমু দিবে?
— আপনি ঘুম থেকে উঠুন। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আপনি জলদি আসুন।
— ফিলিং ছটফট নাকি?
— আজাইরা। জোয়ান একটা ছেলে এভাবে নাক ডেকে বিয়ের দিন ঘুমালে কেমন দেখায়?
— আপু ঘুম থেকে উঠতে দেয়নি।
— সাদিয়া আপু?
— হ্যাঁ, তানভীর হ্যাংলাটা সার্প্রাইজ দিয়েছে আপুকে এনে। আপুর দুইটা লক্ষীসোনা রাতের বেলা আমাকে ঘুমাতে দেয়নি। একটাকে কাধে চড়িয়ে আরেকটাকে বুকে জড়িয়ে পুরো ঘরময় খেলেছি।
— তাহলে ঘুমান রাখি।
— দাড়াও দাড়াও কল কেটো না!!
— কি বলবেন?
— শরীরের ব্যথা কমেছে?
— ব্যথা তো নেই।
— ইয়াহু!
— খুশির কি আছে?
— এগ্লা তুমি বুঝবা না!!যাও রেডি থাকো আসতেছি নিতে!!

রাহা মুচকি হেসে ফোনটা কেটে দিলো। আচ্ছা? আজ তো রাহা এ বাড়ি থেকে বিদায় নিবে, রাহাত কি এখনো কথা বলবেনা তার সাথে? রাহার মনটা আকুপাকু করছে। রাহাতের সাথে সব ঠিক করতে পারলে মনে শান্তি মেলতো। রাহাত হয়তো সে সুযোগ দিবেনা। বড়ই নিষ্ঠুর আচরন করছে এখন! বড়ই নিষ্ঠুর!

?

রাহা বিছানায় ভারী লেহেঙ্গা গায়ে বসে আছে দুইঘন্টা যাবৎ! কেউ নিতে আসছেনা এখনো! একটু আগে নিবির এসে জানিয়ে গেছে নিচে নাকি বিরাট কান্ড ঘটতে চলেছে। তাই রাহাকে কিছুটা সময়ের জন্য রুমবন্দি থাকতে হবে। রাহা তো ভেবেই পায়না নিচে আসলে কি এলাহি কান্ড ঘটেছে! বিয়ে কি শেষমেশ ভেঙ্গে যাবে? একটার পর একটা ঝাপটা এসে যেভাবে সব চুরচুর করে দিচ্ছে এখন বিয়ে ভাঙ্গার কথা শুনলেই মনটা কেদে ভাসিয়ে দিবে! রাহা দাঁতে নখ লাগিয়ে পায়চারি করছে। একবার এইদিকে! আরেকবার ওইদিক! বারবার ঘড়ি দেখছে। রাত আটটা পয়ত্রিশে ঘুরঘুর করছে সময়। বুকের ভেতর ধপাস ধপাস করছে! হাত মুচড়ে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে অনবরত। ঘড়িতে আবার দেখলো! নয়টা পাচঁ! কি আশ্চর্য! একটু আগেই না আটটার ঘরে ছিলো? চোখের পলকে সময়েও উধাও হয়ে যাচ্ছে নাকি? রাহা লেহেঙ্গা ধরে দৌড়ে বন্ধ দরজা সমানে ধাক্কাতে লাগলো। চিৎকার চেচাঁমেচি করতে লাগলো। ‘কেউ খোলো! কেউ তো খোলো প্লিজ!’ কেউ খুললো না! ধাক্কাতে ধাক্কাতে হাফিয়ে উঠে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে ধপ করে বসে পড়লো ফ্লোরে। সেই সকালে একটা পাতলা রুটি খেয়েছিলো। আর কিছুই মুখে নেয়নি রাহা। শরীর অসার হয়ে আসলেও চোখমুখ স্থির। এখন তো চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে নিজের ভাগ্যের পরিণাম দেখে! মনে হচ্ছে বিয়ে আর হবেই না!! নিশ্চয়ই কোনো অমঙ্গলজনক ঘটনা ঘটেছে নিচে!! রাহা হাটুতে মাথা লাগিয়ে থরথর করে কাপতে লাগলো। প্রচণ্ড হতাশায় ভুগলে সমস্ত শরীর আপনা আপনি কাপতে থাকে রাহার। এখনো কাপছে। কিন্তু পূর্বের তুলনায় বহুগুণ বেশি কাপছে। শান্ত রুমে ঘড়ির টিকটিক শব্দতরঙ্গ শোনা যাচ্ছে তীব্রভাবে, অন্যদিকে রাহার ভেতরে অব্যক্ত ধ্বনি। সাদের নাম্বারেও অজস্রবার কল করেছে। কেউ ধরেনি। হঠাৎ দরজা থেকে ঠকঠক করে চাপড়ানোর শব্দ হলো। রাহা মুখ তুলে ঘড়ির দিক তাকিয়ে দেখলো নয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে লেহেঙ্গায় পা আটকে হোচট খেলো একটা। তবুও ধড়মড়িয়ে উঠে দাড়িয়ে দরজায় কান লাগিয়ে বললো,

— প্লিজ প্লিজ দরজাটা খুলো!! নিচে কি হয়েছে!! কি হয়েছে বলো!! কে বাইরে?? কে??
দরজার বিপরীত থেকে শব্দ এলো,
— আমি সাইয়েদা। দরজা খুলছি দাড়াও।

সাইয়েদার তীক্ষ্ম গলার স্বর শুনে রাহা হকচকিয়ে দরজা থেকে দুইকদম ছিটকে গেলো। চোখের অক্ষিগোলক ভীষণ বড় করে তাকিয়ে আছে! যেনো চোখ বেরিয়ে আসতে চাইছে অক্ষিকোটর থেকে। অসংখ্যবার ঢোক গিলতেই সাইয়েদাকে দেখলো রাহা। পড়নে সোনালী রঙের দারুণ কারুকার্যের জামদানী শাড়ি। কালকের মহিলা আর আজকের মহিলার মধ্যে বিশাল তফাত! হঠাৎ যেনো সাইয়েদাকে কম বয়সী মনে হচ্ছে এই শাড়িতে! সাইয়েদার যৌবনকালের কিছুটা সৌন্দর্য যেনো চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে চোখের সামনে। কি দারুণ দেখতে সাইয়েদা। সাদা ধবধবে দুটো হাতের তালু, লালচে ফর্সার টুকটুকে গাল, মাথায় সুন্দর করে কালো রঙের হিজাব আটোসাটো করে বাধা। হিজাবের বাড়তি কাপড়ে পিঠসহ সামনের অনেকখানি অংশ ঢেকে আছে। চোখে স্কয়ার সাদা গ্লাসের চশমা, ঠোটদুটো লিপস্টিক বিহীন তবুও তেলতেলে ভাব। সাইয়েদা কখনো নিজের চুল দেখাননি। আজো সে দেখাচ্ছেনা। মুখে নিকাব না থাকলেও সার্জিকাল মাস্কটা দুইকানে ঝুলিয়ে থুতনিতে রাখা। উনি একজন চাকুরীজীবি মহিলা হওয়া সত্ত্বেও পর্দাহীন হয়ে চলে না। সবসময় ঢিলেঢালা পোশাকে, শাড়ির মোড়কে, মাথাটা পযর্ন্ত ঢাকা থাকে। সাইয়েদা নিষ্পলক দৃষ্টিতে রাহার কাছে গিয়ে ওর হাতদুটো নিজের হাতে পুড়লো। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

— চলো নিতে এসেছি। অনেক অপেক্ষা করিয়েছি আর পারছিনা। তিন কবুল বলে দ্রুত বিয়েটা সম্পন্ন করে সঙ্গে চলো।

রাহা নিষ্পাপ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সাইয়েদার অক্ষিগোলকে। সাইয়েদা হঠাৎ অবাক হয়ে হাত এগিয়ে রাহার গাল ছুয়ে বলল,
— একি! তুমি কাদঁছিলে? না না এভাবে তো চলবেনা! তুমি সাইয়েদা আফরোজের বউ! এভাবে চুপিচুপি কাদলেও তোমার চলবেনা। কঠিন শাস্তি দেওয়া লাগবে বুঝেছি! এতো করে বলেও যখন শুনছো না! শাস্তি তোমার প্রাপ্য!
রাহা তেতে বললো,
— আপনি আমায় চড় মারবেন না আন্টি..সরি সরি মা। আমি কখন যে গাল ভিজিয়ে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি..

সাইয়েদা যমের মতো জটিল ভয়ঙ্কর দৃষ্টি ছুড়লে রাহা নিচু চোখে ঢোক গিলতে থাকে। সাইয়েদা ফিক করে বাঁকা হেসে দুইহাতের তালুতে রাহার গাল মুছে দিয়ে বলে,
— তোমার শাস্তি হলো এই পরবর্তী দু’দিন তুমি রান্নাঘরে ঢুকবেনা। আমি আমার মেয়েকে যেমন রান্নাঘরে কালির কাছে যেতে দেইনি তুমিও যাবেনা। আমি শ্বাশুড়ি হয়েছি বলে মেয়ে এবং বউয়ের মধ্যে পার্থক্যসূচক করবো তা সম্ভব না! কাদবে না। কঠিন হও। মানুষ তোমার এক চুল বাকাঁ করার সাহস পাবেনা।

আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে আছি। উনাকে দেখলে আমার কান্না করার স্পৃহা হারিয়ে যায়। কতো কষ্ট পেলে একটা মানুষ এতোটা গভীর কথা বলতে পারে! মা আমাকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে! দুনিয়া বুঝাচ্ছে! মানুষের আচারানুষ্ঠান শিখাচ্ছে! মুগ্ধ হই আমি উনার ব্যবহারে। মুগ্ধ হই বারবার। মা আমার মাথার ঘোমটাটা লম্বা করে টেনে দিয়ে হাত ধরে যেই হাটা দিলেন!সেই হাটা থামলো একেবারে কাজির কাছে সোফায় বসে। ঘোমটার আড়ালে বোঝা যাচ্ছে আমার সামনে সোফায় বরবেশে মুখে রুমাল চেপে সাদ মশাই। কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু সবার মুখ কেমন থমথমে! যেনো বিরাট একটা অঘটন কিছুক্ষণ আগে ঘটে গেছে। কিন্তু কি ঘটেছে? চোখ একটু এপাশ ওপাশ ফিরে দেখলাম আপুকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বাবা- মার মুখ চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো হয়ে আছে, রাহাত ভাইয়ের চোখ রক্তিম লাল, ফুপি দেখি আচলে মুখ ঢেকে চোখের পানি ফেলছেন, পাশ থেকে ফুপা উনাকে সামলাচ্ছেন। আমি এসব নিয়ে ভাবতেই হঠাৎ বয়োবৃদ্ধ কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,

— মা, বলেন কবুল।

ভাবনার দুনিয়া থেকে হুশ ফিরতেই আরেকবার বলে উঠলো,

— মা? তাড়াতাড়ি বলেন কবুল।

আমি খানিকটা জড়তা মেশানো নিচু গলায় আস্তে করে বললাম,
— কবুল।

কাজি সাহেব এবার সাদ ভাইয়ার কাছ থেকে প্রতিউত্তর পেয়ে ঘোষনা দিলেন বিয়ে সম্পন্ন। কিন্তু হাসিখুশির কোনো আমোদ শব্দ শোনা গেলো না। সবাই কেমন উদাস, নারাজ, বিক্ষিপ্ত। কেউ চায়নি বিয়েটা হোক। তবুও প্রকৃতির কঠিন ইশারায় বিয়েটা হয়েই গেলো। গাড়ি চলছে। পাড়ি দিয়েছি শ্বশুরবাড়ি নামক নতুন ঠিকানার ভিড়ে। নতুন পরিবেশ, নতুন দুনিয়া, নতুন এক পরিচয়ের নীড়ে। গাড়ির কাঁচের জানালায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টিফোঁটা পড়ছে। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে কাঁচের জানালা। হঠা হঠাৎ দুমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট প্রবেশ করে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার চেহারা। সিটে হেলান দিয়ে জানালার বাইরে রাতের দৃশ্যপটে বৃষ্টিবিলাস করছি। পাশে সাদ ভাইয়া আমার বাহু দু’হাতে আকড়ে ধরে কাধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছেন। গাড়িতে কেবল ড্রাইভার এবং আমরা। আমার রূপবতী আপু নাকি নিবির ভাইয়ের সাথে পালিয়ে গিয়েছে। কোথায় গিয়েছে কেউ তা জানেনা। বিয়েতে শুধু আমরা আমরাই ছিলাম বলে এখনো পাড়া প্রতিবেশি কেউ এ ব্যাপারে জানেনা।এখন বুঝলাম রাহাত ভাইয়া কেনো লালচক্ষুতে তাকিয়ে ছিলো, ফুপি কেনো বিলোপ পেরে কাদঁছিলেন। আদরের ছেলেটা যখন দুনম্বরি মেয়ের সাথে ভেগেছেন ব্যাপারটা কটু! হঠাৎ আমার কাধের উপর সাদ ভাইয়ার মাথাটা নড়ে উঠলো। উনি বাহু ছেড়ে দিয়ে আমার কোমর চেপে গলায় ছোট্ট একটা ঠোঁট বসিয়ে দিলেন। আমি উনাকে ছাড়তে বললেও লাভ হয়নি। ড্রাইভার থাকা সত্ত্বেও আমাকে এভাবে ধরে রেখেছেন। আমার হাতটা নিয়ে আঙ্গুলের ফাকে নিজের আঙ্গুল ঢুকিয়ে বলে উঠলেন,
— পান্জাবীর বাম পকেটে থেকে ফোনটা বের করো তো।
আমি কপাল কুচকে বললাম,
— কেনো?
উনি মাথাটা আবার আগের মতো আমার কাধে এলিয়ে বললেন,
— ফোনটা বাজছে। একটু চেক করো না। আমার আলসেমি লাগছে।

আমি জাস্ট অবাক! সামান্য একটা ফোন উনি পকেট থেকে বের করবেন তাতে উনার আলসেমি লাগছে? ভাইরে ভাই এ কেমন ঠাট্টা? আমি চরম বিরক্তি নিয়ে উনার হাত থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে পকেটে ঢুকালাম। ভাইব্রেট ফোনটা ভুম ভুম করে বাজছে। স্ক্রিনের নাম্বারটা অচেনা, কোনো নাম সেভ পযর্ন্ত সেভ করা নেই। আমি ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বললাম,

— এইযে? দেখুন না একবার!! কে দিলো চেক করুন না!!
উনি কোমরের কাছে হাতটা আরো শক্ত করে ধরলেন। আমার এখন লজ্জায় মাথা হেট হচ্ছে! ইশশ ড্রাইভার কি উনার বেশশরম কারবার দেখছে? দেখে তো মনে হচ্ছেনা উনি আমাদের প্রেমলীলা দেখছেন। উফ…উনাকে কি করতে ইচ্ছে করে! রাগে ফুসফুস করতে করতে শেষমেশ বিরক্তিকর ফোনটা আমি রিসিভ করলাম,

— হ্যালো কে বলছেন? কোথা থেকে বলছেন?

কি আজব! কথা কেনো বলছেনা? আমি কান থেকে ফোন সরিয়ে দেখি কলটা কেটে দিয়েছে। আমি অবাকের চেয়েও অবাক হয়ে আছি কে কলটা দিলো! উনার গফটফ নাকি? মেয়েলি ভয়েস শুনেই কেটে দিছে এমন কিছু? আমি এক ধাক্কা মেরে সাদ ভাইয়াকে দূরে সরালাম। সাদ ভাই আচমকা ধাক্কায় ওপাশের জানালার সাথে খুব জোরে ব্যাথা পেলেন। মাথা ধরে চিৎকার দিতেই সামনে থেকে ড্রাইভার ব্রেক কষে দেয়। আমার এহেন কান্ডে ড্রাইভারের সম্পূর্ণ চাহনি আমার দিকে। আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে একবার ড্রাইভারের দিকে আরেকবার সাদ ভাইয়া কুকানো দৃশ্যের দিকে তাকাচ্ছি। করলাম কি! ধ্যাত! আমি অপ্রকৃতিস্থ গলায় বললাম,

— চাচা কিছু হয়নি..কিছু হয়নি। আপনি গাড়ি স্টার্ট দিন।

ড্রাইভারের একবিন্দু কৌতুহল কাটেনি তবুও আদেশসূচকে স্টার্ট দিলেন গাড়ি। সাদ ভাইয়া চোখ খিচে মাথা দুহাত চেপে ঝুকে বসে আছেন। আমি ফালতু ফোনটা রেখে উনার দিকে যেতেই উনি রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,

— মেরে ফেলতে চাইছিলা না! ঠিকনা? একটু আদর করে ধরেছি তুমি এমন ধাক্রকা দিলা! উফ মাথা…

আমি উনার মাথা থেকে হাত সরিয়ে কাছে ঝুকে দেখতে লাগলাম। ভাগ্যিস কোথাও ফাটেনি! উনার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালের সামনের চুলগুলো সরিয়ে দিতেই বললাম,
— বুঝতে পারিনি সরি, এতো জোরে ছিটকে যাবেন বুঝতে পারিনি.. বিশ্বাস করুন।

সাদ ভাইয়া কপালে কয়েকরেখা ভাজ ফেলে চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করতেই বললেন,
— কারেন্টের মতো লেগেছে জানো? এখন যদি মরে যেতাম? এই জানালার কাঁচ যদি মাথার ঘিলুতে ঢুকতো? বিধবা হয়ে যেতে না?
— কি আবালতাবোল বলছেন! প্লিজ আজকের দিনে এইসব উটকো কথা তুলতে যাবেন না! আমি মায়ের কাছে বিচার লাগাবো!

— হইছে! হইছে!! এখন আমার মায়ের কাছেই নাকি নালিশ বসাবে হাহ্! যাও কাছে আসা লাগবে না।
— সরি বললাম তো, এই দেখুন আবার বলছি, আমি দুঃখিত! দুঃখিত! দুঃখিত! তিন দুঃখিত!!

সাদ মশাই আমার কথায় দৃষ্টি দিবে তার আগেই ওই বদমাইশ মার্কা ফোনটা পুনরায় বাজতে লাগলো! দাড়া এবার এই কল দেওয়া পাব্লিকের কি অবস্থা করি। কই গেলো! কই গেলো ফোনটা! ফোন খুজতেই দেখি আমার কোলে শাড়ির ভাঁজে! সাদ ভাইয়া আমার দিকে অবুকের মতো তাকিয়ে আছেন। আমি ফোনটা ধরেই ফটাফট বলি,

— বজ্জাত! ছ্যাঁচড়া! ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা! কল দ্যাস কেন? কোন সুখে কল দেস? তোর জামাই? তোর সাথে শুইছে? কিরে কথা বলোস না কেন? এই ছেড়ি! কিরে বলবি তুই? তুই আমার জামাইকে কল দিলি কেন? কথা যদি না বলিস দাঁতের মাড়ি আলগা করে দিবো! বল! কেন কল দিলি! রাম ছাগল কোথাকার!

সাদ ভাইয়া ইয়া বড় হা করে চোয়াল ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছেন। ড্রাইভার চাচাও দেখি উকিঝুকি মারছেন পিছনে। কি লজ্জা! কি লজ্জা! কথার তালে তালে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে বঙ্গোপসাগরের ভাষা উত্থান করে ফেলেছি খেয়ালই নেই। কথার কি শ্রী! ছি! ছি!! সাদ ভাইয়া চোয়াল বন্ধ করে বড় ঢোক গিলে অপ্রচ্ছন্ন গলায় বললেন,

— রাহা? তোমার স্বামী তোমাকে ছাড়া অন্য কারোর সাথে লাইন মারেনি। তুমি কাকে যা তা বলে গালি দিচ্ছো?
আমি কান থেকে ফোন নামিয়ে দেখলাম কলটা আগের মতো কেটে দিয়েছে। আমি ফোনটা উনার দিকে বারিয়ে বললাম,

— আমি ভেবেছি আপনার পুরোনো এ্যাক্স কিনা…
উনি আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বললেন,
— আমার কোনো এ্যাক্স ফ্যাক্স নেই।

কথাটা বলতেই উনি পরোখ করতে লাগলেন নাম্বারটা নিয়ে। কয়েকবার কলও করলেন কিন্তু কেউ ধরেনা। উনি আমার হাত টেনে উনার বুকে মাথা এটে বললেন,
— কখনো এমন নোংরা আচরণ করবেনা। কে না কে! উল্টো তুমি খারাপ ভাষায় গালাগাল করে দিলে! শান্ত হও এখন। আরেকটু পথ বাকি, বাড়ি এসে যাচ্ছে।

দরজার কপাটে দাড়িয়ে আছি সামনে মা, সাদিয়া আপু, তানভীর দুলাভাই, দুই ক্ষুদে বাচ্চা মিটিমিটি করে হাসছে। মা আমার দিকে কিছু পুরোনো ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি পালন করতেই সাদিয়া আপু বলে উঠলেন,

— মা তানভীর কিন্ত রেডি!! নতুন বউকে কোলে নিয়ে রুমে পৌছে দিতে সে প্রস্তুত।

আমি হতভম্ব দৃষ্টিতে সাদ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। উনিও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন একই আশ্চর্যে! হঠাৎ উনি মুখ ঘুরিয়ে প্রতিবাদী সুরে বলে উঠলেন,
— আমার বউ অন্য একজন হাত দিবে কেন? এ কি নিয়ম!
সাদিয়া আপু বাজখাই গলায় বলে উঠলেন,
— হাত দিবে মানে? তুই অশ্লীলভাষায় কেন বলছিস সাদ! এগুলা লোকজ নিয়ম! ইভেন আমিও এসব পালন করেছি। মা-ও তো পাল করেছে। রাহার জন্য ভিন্ন কিসের?
— আমার বউকে রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য আল্লাহ্ দুটো শক্তিশালী হাত দিয়েছে আপু! তুই তোর স্বামীকে দিয়ে কেন বউ তুলবি?
— তাহের ভাইও তো আমাকে কোলে তুলে প্রবেশ করিয়েছে! তুই খামোকা কাহিনী করছিস কেন বুঝতে পারছিস না!
— আমার বউকে কেবল আমি ছোঁবো! ওকে আমি তোর স্বামী দ্বারা প্রবেশ করাতে পারছিনা। মাফ কর আপু!

সাদ ভাই সবার সামনে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। সাদিয়া আপু অটলাবস্থায় দরজা ধরে দাড়িয়ে থাকলে মা আপুকে চোখ ইঙ্গিতে সরে দাড়াতে বলে। আপু খুব অভিমান নিয়ে দাড়িয়েই থাকে। লোকজ রীতিনীতি যুগ রুগ ধরে পালন হয়ে আসছে আর এদিকে ছোটভাই তামাশা শুরু করেছে!সাদিয়ার আক্ষেপ দেখে সাইয়েদা এবার ঝাঝালো গলায় বললেন,

— সরে দাড়া বলছি!

সাদিয়া চমকে উঠে কেপে উঠলো! মায়ের কি ভয়ঙ্কর কন্ঠ! বক্ষস্থল পযর্ন্ত ছিড়ে ঝাঝড়া করে দেয়। সাদিয়া রাস্তা ছেড়ে দিলো। সাদ রাহাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমের দরজাটা পা দিয়ে খুলে ওকে বিছানায় বসালো। মাথা থেকে খয়েরী রঙের পাগরি খুলে রুম থেকে বেরিয়ে মায়ের হাতে দিয়ে নিচুস্বরে বললো,
— মা আপুকে বুঝাও! তুমি তো জানো আমি এসব নিয়মকানুন মানিনা। ইসলামধর্মও এসবের অনুমতি দেয়না। তুমিই বলো, আমার বউকে পরপরুষ এসে কোলে তুলে চেপেচুপে রুমে গিয়ে বসাবে? ভাবতেই তো গা ঝাড়া দিয়ে উঠে!
সাইয়েদা ছেলের পান্জাবীর কলার ঠিক করতে করতে বললেন,
— তানভীর তো বদ ছেলে না। কিন্তু তোর চাচাটা বদ ছিলো। যা রুমে যা। রাহা বসে আছে। মেয়েটা নতুন পরিবেশে সহজ কর।

সাদ মায়ের প্রথম কথাটা বুঝতে পারলো না। চাচা কি এই লোকজ নিয়মের সুযোগে ওর মাকে খারাপ স্পর্শ করেছে? সাদ আড়চোখে তানভীরের দিকে তাকালো। তানভীর হাসি মুখে দুই মেয়েকে নিয়ে সোফায় বসে খেলা করছে। আপু মুখ গোমড়া করে ভাইয়ার পাশে বসে লেবুর শরবত একটু একটু করে খাচ্ছে। আজ মাকে খুব অদ্ভুত লাগলো! উনি হঠাৎ এই কথা কেনো বললো? ‘তানভীর তো বদ ছেলে না কিন্তু তোর চাচাটা বদ ছিলো’…..সাদ গলার কাছে পান্জাবীর বোতাম খুলতে খুলতে রুমে চলে গেলো।

?

সাদকে অন্যমনস্ক দেখে রাহা ঘোমটার আড়ালে বললো,

— আপনি আগ বারিয়ে হিরোগিরি দেখাতে গেলেন কেনো?
সাদ কিন্ঞ্চিত মাথা ঝাড়া দিয়ে রাহার কথায় দৃষ্টি দিলো। কিছু শুনতে না পেয়ে বললো,

— তুমি কিছু বলেছো?
— হ্যাঁ বলেছি। আপনি আগ বারিয়ে হিরোগিরি দেখাতে গেলেন কেনো? দুলাভাই কোলে তুলে নিয়ে আসলে তো আমার সমস্যা হতো না।
— চুপ করো। আমিই তোমাকে টাচ করার আগে বেল পাইনা। অন্য কেউ তোমাকে কোলে তুলবে! ইটস ইম্পসিব্যাল!
— আপনার জন্য আপুর মনটা উদাস হয়ে গেলো।
— হোক! ও কাদুক! তুমি শাড়ি পাল্টে এসে নরমাল জামা পড়ো। তোমাকে এই জোব্বা অবস্থায় আমারই গরম লাগছে।

রাহা বিছানা ছেড়ে উঠতেই বললো,
— বাইরে বৃষ্টি, ভেতরে ফ্যানের ঠান্ডা। আপনার গরম লাগে কি করে?
সাদ পান্জাবী খুলে গায়ে টিশার্ট পড়তেই বললো,
— আমি তোমার জন্য এই ভারী কাজের লেহেঙ্গা চুজ করিনি। এটার সম্পূর্ণ ক্রেডিট মায়ের! এগুলা কেউ পড়ে? যাও চেন্জ করো।

রাহা লাগেজ খুলে নরমাল সালোয়ার কামিজ বের করে সেটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। কাটায় কাটায় পনের মিনিট পর লেহেঙ্গা হাতে ওয়াশরুমের দরজা আটকে যেই ঘুরতে নিবে ওমনেই টাইফুনের বেগে কেউ দরজার সাথে চেপে ধরলো। রাহার হাত থেকে লেহেঙ্গা পড়ে গেল। রাহা নড়াচড়া করতেই কেউ বলে উঠলো,
– স্টপ! নড়ছো কেনো?
রাহা থেমে যায়। চোখ খুললে রুম অন্ধকার দেখতে পায়। সাদ কি রুমের লাইট নিভিয়ে দিলো? হঠাৎ হাত ছুয়ে ছুয়ে কারোর স্পর্শ গলা পযর্ন্ত পৌছলো। রাহা শিরশির করে কাপছে। এই অজানা অনুভূতিটা আবার সাড়া জাগাচ্ছে। একটা হাতে রাহার কাধের কাছ দিয়ে ঘাড়ের কাছে থেমে গেলো। অপর হাতটা গলা থেকে ক্রমশ উপরে উঠে গালের চিবুকের কাছে থামলো। রাহা হাত মুঠো করে শক্ত করে দাত কিড়মিড় দিয়ে দাড়িয়ে আছে। সাদের প্রথম স্পর্শ পড়লো রাহার কপালে। দ্বিতীয় স্পর্শ পড়লো নাকে। অজস্র ছোয়ায় মিলিয়ে দিতে লাগলো রাহার মুখটাতে। রাহা অস্থিতি অবস্থায় আসন্ন হতেই আচমকা সাদের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। ব্যালেন্স বিগড়ে সাদ পিছনদিকে কয়েকপা পিছিয়ে গেলো। রাহাকে আবদ্ধ করে ধরতেই বলে উঠলো,

— চলো ঘুমাবো।

সাদ আবদ্ধ অবস্থাতেই রাহার পা নিজের পায়ের উপর নিয়ে অগ্রসর হলো বেডে। রাহা চুপটি মেরে আছে বুকে। সাদ রাহাকে শুয়িয়ে দিতেই রাহার ঠোটে ঠোট ডুবিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিতেই ভ্রম ভ্রম তীক্ষ্মধ্বনিতে কিছু বাজার আওয়াজ হলো। সাদ মাথা উঠিয়ে আশপাশে তাকাতেই বিছানায় বসে পড়লো। আশ্চর্য ! কিসের শব্দ হচ্ছে এখন? সাদ ফ্লোরে পা রেখে উঠে দাড়িয়ে ওয়াবড্রবের দিকে নজর দিলো। নীলচে আলো জ্বলছে সেখানে। শব্দটাও ওখান থেকেই আসছে। ঠোট মুছতেই ফোনটা নিয়ে দেখলো একগাদা মেসেজ। সেখানে টুক করে ক্লিক করতেই সচকিত ভঙ্গিতে রাহার দিকে তাকালো। রাহা সাদের দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। সাদ ফোনের দিকে চোখ রেখে রাহার কাছে এগিয়ে এসে ফোনটা দিয়ে বললো,

— তোমার জন্য এসেছে।

রাহা প্রচণ্ডরূপে অবাক হয়ে চোয়াল নামিয়ে সাদের হাত থেকে ফোনটা নিলো। ফোনের স্ক্রিনে উঠে আছে, 4 new messages. রাহা বিষ্ময়ের তুঙ্গে পৌছে মেসেজ চেক করতে গিয়েছে আরো কয়েকদফা ধাক্কা খেলো। স্থির চোখদুটো ফোনের মধ্যে আটকে মনেমনে পড়তে লাগলো। লিখাগুলো ইংলিশে টাইপ করা।

‘রাহা? আমি জানি এখন তুই সাদ ভাইয়ার সাথে আছিস। আজ তোর বাসররাত। আমি বাড়ি থেকে পালিয়েছি বোন। আমার দ্বারা নিবিরকে ছাড়া সম্ভব না। নিবির তোর সাথে অনেক কিছুই করেছে যা আমি কিছুক্ষণ আগে জানতে পারি। ছেলেটা তোর হাতও নাকি পুড়িয়ে দিয়েছিলো। তোকে খুলে বলা দরকার রে বোন। বিভ্রম না ভাঙালে তুই আজীবন অন্ধকারে থাকবি। নিবির তোকে ভালোবাসতো না। ও আমাকে পছন্দ করতো। ও চাইছিলো তুই যেনো ওকে ভয় পেয়ে তটস্থ থাকিস। চুপচাপ থাকিস। আসলে বেকুবটা ভেবেছিলো তুই আমাদের ব্যাপারে সব জেনে গেছিস। তাই তোকে শাষানোর জন্য ওসব কীর্তিকান্ড করেছে। যেদিন আমাদের বাড়ি এসেছিলো সেদিনই আমাকে ওর মনের কথাটা খুলে বলে। আমি যে তোকে বলেছিলাম না? আমার নতুন একটা বয়ফ্রেন্ড জুটেছে? সেটা আর কেউ না নিবির ছিলো। আমার ১১তম বয়ফ্রেন্ড। নিবিরের কাছে আমি কিছু লুকাইনি। আমি যে আগে এতোগুলা রিলেশন করেছি সব ওকে বলেছি। কিন্তু ও নাছোড়বান্দা কিছুতেই আমাকে ও ছাড়বে না। এদিকে ফুপি আমার ব্যাপারে গোপন তদন্ত বসিয়ে সব খুটিনাটি অতীত বের করে ফেলেছে। নিবিরের ইচ্ছে ছিলো তোর বিয়ের আগে আমাদের বিয়ের তিন কবুল বলা হোক। কিন্তু ফুপি সেটা মেনে নিতে পারেনি। রাহাত ভাই আমাকে খুব মেরেছে রে। ঠোঁটের শেষকোণাটা ছিলে রক্ত এখনো পড়ছে। কথা বলতে পারিনা। বললেই ব্যথা করে রক্ত পড়ে। নিবির আমাকে নিয়ে পালিয়েছে। আমার পালানোর ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু মান ইজ্জতের কথা চিন্তা করলে নিজের সুখ কখনো পাওয়া হবেনা। আমি বাবাকে বলেই পালিয়েছি। বাবা দুটো জুতার বারি দিয়ে বিদায় করেছেন। আমি অবশ্য খুশি হয়েছি অন্তত বলে তো পালিয়েছি। তোর শ্বাশুড়িটা খুব ভালো রে রাহা। তোর শ্বাশুড়ি যেই টাউট মানুষ! তোকে কখনো কষ্ট পেতেই দিবেনা। উনি তোকে আম্মুর মতোই আগলে রাখবে। জানিস তোর শ্বাশুড়ি আমাদের উবার ঠিক করে পালাতে সাহায্য করেছেন। পেছন থেকে রাহাত ভাই দা আনতে গিয়েছিলো। কিন্তু আন্টি চোখের পলকে দেবদূতের মতো গাড়িতে তুলে দিয়েছেন। এ কথা কক্ষনো কাউকে জানাস না। তোর শ্বাশুড়ি আমায় বারন করেছে কাউকে জানাতে। আমি এয়ারপোর্টে বসে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্লাইটে উঠবো। দেশের বাইরে যাওয়ার একদম ইচ্ছে নেই। তাই নিবিরকে বলেছি চট্টগ্রামে আমাদের গোছানো সংসার সাজাবো। আপাতত কোর্ট ম্যারিজ সেরেছি। বাকিটা বোধহয় আর লাগবেও না। তোকে চট্টগ্রাম পৌছে ইনফর্ম করবো। ঠিকানা দিলে আসিস ঘুরতে। হানিমুন ট্রিপ হিসেবে কক্সবাজার ঘুরে যাস। নিবির বলেছে তোরা আসলে আমরা দুটো বোন দুজনের স্বামী নিয়ে ঘুরতে যাবো। ফ্যামিলি প্ল্যানিংটাও তোদের সাথে মিলিয়ে করতে চাইছে ও। আমি জানি না নিবির এতো রোমান্টিক কিভাবে। বলতো ওকে দেখলে কখনো বুঝতি? ও এতোটা রোমান্টিক? তোকে ঘন্টাখানিক আগে কল করেছিলাম। তুই কি যে অশ্রাব্য ভাষায় বকলি! আমার মাথা ৯০° এঙ্গেলে ঘুরে গেছে! সাদ দুলাভাইয়ের পাশে যে তুই তেলাপোকাও সহ্য করবিনা বুঝা শেষ। আসলে কল করেছিলাম তোকে এই কথাগুলো ফোনে বলতে। কিন্তু সাহস হয়নি। তোর বিয়ের আমেজ নষ্ট করার অজুহাতে যদি রাগ করে থাকিস তাই কল করেও কথা বলতে পারিনি। আমাদের কিন্তু একইদিনে বিয়ে হয়েছে রাহা!! কোনো একদিন একইসাথে পেট নিয়ে ঘুরবো আমরা!! শুভকামনা বোন। বাসররাতে বিড়াল মারা কার্যক্রম তোদের শুভ হোক!! বায় বায়!! টা টা!!

রাহা পুরোটা মেসেজ পড়ে মুচকি হাসতেই পাশ থেকে টান অনুভব করে ছিটকে পড়লো বেডে। মুখের উপর সাদের চেহারা দেখতেই রাহা কাচুমাচু করে করতে লাগলো। সাদ দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে উঠলো,

‘বিড়াল মারার সাইন্সটা না!!আমি আদৌ বুয়েটে পড়ে বুঝলাম না! এটা কি নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতো? প্রত্যেক বস্তুরই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে?? টেল মি!!টেল মি!! টেল মি!! ওহ্ শিট! ভুল বলে ফেলছি! ‘ রাহা? কিস মি কুইক!’

‘সমাপ্ত’

গল্পের শেষে গল্পকথা: অদ্ভুত সম্মোহনী গল্পটা পর্ব ১২ তে শেষ হতো। কিন্তু পার্সনাল সমস্যার জরিপে সেটা সম্ভব হয়নি একফোটাও। এই গল্পটা নিয়ে প্রচুর তাল কেটেছে! প্রচুর! প্রচুর! প্রচুর! শেষে জিদ চেপেছিলো আর লিখবোই না ডিলিট করে দিবো গল্পটা। তবুও সমাপ্তি না এনে কোনোকিছু আধুরা রাখা ঠিক না। তাই শেষমেষ এটা শেষ করেই দিলাম। আমার পাশে এতদূর থাকার জন্য ধন্যবাদ!ধন্যবাদ!ধন্যবাদ! তবে হ্যাঁ, নতুন গল্পে আপনাদের প্রিয় কিছু চরিত্র আনছি❤ কাল থেকে নিউটা দেওয়ার চেষ্টা করবো। ফেসবুক আপডেট সিস্টেমের কারনে পেজে গল্প দেওয়া কষ্টসাধ্য হচ্ছে। আইডিতে দিবো এবার নিউ গল্পটা। ইনশাআল্লাহ পূর্বের থিম থেকে আলাদা হবে এবারেরটা❤ ওয়েট..ওয়েট..ওয়েট.. একমিনিট? রিভিউ কি প্রাপ্য না? না দিলে কিন্তু কালকে থেকে লিখতে পারবো না।

#ফাবিয়াহ্_মমো❤
(‘মম’ কে মম্, মমু, মোম নামে বিকৃত করার সমীপে নিজের ছোট্ট নামটা লিখবো এভাবে — ‘মমো’) ভালোবাসা এত্তোগুলা❣

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here