অদ্ভুত_সেই_বাড়িটি-১০,১১

0
867

#অদ্ভুত_সেই_বাড়িটি-১০,১১
#লেখনীতে_মুসাফফা_মারহামা_মিম।
১০

সাদিয়া রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে মতির মায়ের সব গুলো কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো।তার চোখের পাপড়ি ভিজে উঠেছে।পুরো দেহ অসার হয়ে যাচ্ছে।এ কি শুনলো সে! প্রিয়ার সাথে সাদমানের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে।এটা সাদমান তাকে জানাতে পারতো? অথচ সে এ সম্পর্কে কিছুই বলেনি।সাদিয়ার মন ভেঙে গেলো।সে এক মূহুর্তও আর এখনে থাকতে চায়না।দ্রুত প্রস্থান নিতে পারলেই যেন সে বাঁচে।সাদিয়া ঘুরে দাড়ালো। কিছু একটা ভাবতেই সে আবারো মতির মায়ের দিকে ফিরলো।এবং ঠান্ডা গলায় বললো।সাদমান ভাইয়ার বিয়ে ঠিক এই বিষয়টি আপনি আমাকে কেন জানাতে চাচ্ছেন শুনি?
তাও আবার এত আগ্রহ নিয়ে।

তেমন কোনো কারন না।আমি আপনারে জানাইলাম আমার মনে হইলো আপনি সাদমানরে পছন্দ করেন।

কেন মনে হলো আপনার?

এমনিই।

আচ্ছা ঠিকাছে আসি তাহলে।

জী আচ্ছা যান।

সাদিয়া ফিরে আসলো।তারকথা বলতে ইচ্ছে করছেনা ।গগনে মেঘ জমেছে।ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। বাতাসের উপদ্রব ঢের।বাতাসের সাথে সাথে ধুলা বালি উড়ে বেড়াচ্ছে।টুকরো টুকরো পলিথিন বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে ইশানকোণে মিলিয়ে যাচ্ছে। সাদিয়া রাস্তার কিনারা ঘেঁষে হেঁটে চলেছে। তার মন ব্যথিত।নয়ন অশ্রুসিক্ত। হৃদপিণ্ডে আর্তনাদের শব্দহীন ধ্বনি।মস্তিষ্ক ঘিরে শুধু প্রিয়াকে নিয়ে আলোচনা। এরি মধ্যে মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ হতে থাকলো।সাদিয়া বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য কোনো দোকানের নিচে দণ্ডায়মান হলোনা। সে হাঁটতে থাকলো তার গন্তব্যে। কিছু দূর যাওয়ার পর তার সম্মুখে সব কিছু ঝাপসা হয়ে উঠলো।হয়তো এটা তার কান্নার কারনে হচ্ছে।সাদিয়া এক হাত উলটো করে চোখ মুছে আবারো হাঁটতে থাকলো।দোকানে বসে থাকা মানুষগুলো সাদিয়াকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে দেখছে। এই মেয়ে ঘন বৃষ্টির মধ্যে কিভাবে এক মনে হেঁটে যাচ্ছে!ভয় করেনা? যদি বিদ্যুৎ চমকায়? অথচ সাদিয়া এসবে ভ্রুক্ষেপহীন। সে এখন অনুভূতি শূন্য।ভয় জিনিসটা আপাতত সময়ের জন্য তার মধ্য থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।সাদিয়া বাড়িতে পৌঁছে গেলো।গগন এখন পরিস্কার। মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। কিছুক্ষন বাদেই গোধুলি লগ্ন বিদায় নিবে। সাদিয়ার বোরকা বৃষ্টির নীরে ভিজে টইটম্বুর। সে প্রধান গেট পেরিয়ে ঘরে ঢুকলো।বাড়ির সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত।সাদিয়া তার কক্ষে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিলো।তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু এটা সম্ভব না।বাড়ির মানুষরা জেনে যাক এটা সে চায়না।সাদিয়া গোসলঘরে প্রবেশ করে ঝর্ণা ছেড়ে দিলো।সে সেথায় কিছুক্ষণ অনুভূতি হীন মূর্তির ন্যায় বসে থাকলো। মসজিদে মাগরিবের আজান দিতেই সে সেথা থেকে বেরিয়ে আসলো। আজকের রাতটি সে কিভাবে পাড় করবে সে নিজেও জানেনা।কষ্ট,দুঃখ আমাদের সাথে জড়িয়ে থাকা একটি ইমোশন।তারা আছে বিধায় হয়তো আমরা সুখ বা শান্তির মর্ম বুঝতে পারি।কিন্তু দুঃখ যদি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় তবে সেটা সহ্য করার সক্ষমতা খুব কম মানুষেরই হয়।আর তখনই জন্ম নেয় বিষাদ নামক তিনটি শব্দের।তবে বুদ্ধিমানরা বিষাদ থেকে বের হয়ে আসে আল্লাহর সিদ্ধান্ত কে হাসি মুখে মেনে নিয়ে।হয়তো সাদিয়াও পারবে।কিন্তু সময় লাগবে তার।

__________

রাত বাজে ১২ টা। সাদমান একটি গিফট বক্স পেপার করছে। সে এটা কাওকে দিতে চায়।কিন্তু কাকে দিতে চায় এ সম্পর্কে এখন বুঝা যাচ্ছেনা।সে সেখানে প্রাপকের ঠিকানা,বা নিজের ঠিকানা কিছুই লিখেনি। শুধু একটি সাদা চিরকুটে কিছু একটা লিখে বক্সের ভিতরে রেখে দিয়েছে। সাদা কস্টিপ দিয়ে ভালো ভাবে বাধাই করা শেষ।সাদমানের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে এক চিলতে মিষ্টি হাসি। সে বহির্ভাগে দৃষ্টি দিয়ে অস্ফুট স্বরে বললো।

আমি এমনটা ততদিন করতে থাকবো।যতদিন তুমি তোমার মনের কথা গুলো আমায় বলবেনা।ছেলেবেলা থেকে একবারও মনে হয়নি সাদমানকে ব্যাপারটা সম্পর্কে জানানো উচিত। তুমি নিজে না বলা অবধি আমি তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবোনা। সাদমান বিড়বিড় করে এসব বলা শেষ করলো।অতঃপর চন্দ্রের দিকে দৃষ্টি দিলো।খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। আশে পাশে কয়েকটি নক্ষত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে।বৃষ্টি হওয়ার দরুন গগনে মেঘেদের আনাগোনা ক্ষীন।সাদমান অনিমিখে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। ভয়াবহ দিন গুলোর কথা মনে হতেই তার চোখ ভিজে উঠলো। সে হাত দিয়ে চোখ মুছে নিলো।কাঁদতে চায়না সে।অনেক কেঁদেছে একটা সময়। এতটাই কেঁদেছে যে তার চক্ষু এখন নীর শূন্য প্রায়।এখন চোখ দিয়ে পানি আসলে নাম না জানা যন্ত্রণা শুরু হয় তার মনে। এ যন্ত্রণা সেই বাড়িতে থাকা যন্ত্রণা থেকে মোটেও কোনো অংশে কম নয়।সাদমান নিজেকে স্বাভাবিক করে জানালার সাথে হেলান দিয়ে বসলো।পায়ে জড়িয়ে থাকা চাদরটি পুরো শরীরে জড়িয়ে নিলো।আচানক তার ফোন বেজে উঠলো। আননোন নাম্বার। এ মূহুর্তে তার কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা।অবশ্য বিরাট বড় কারন নেই এর পিছনে।তার ইচ্ছে করছেনা ব্যাস সে ফোন ধরবেনা।সাদমান ফোন ধরলোনা।কিছুক্ষণ পর আবারো ফোন বাজতে থাকলো।এবারো সে ফোন ধরলোনা।৩য় বার কিছুটা বিরক্তি ভাব নিয়ে ফোন কর্ণে তুলে নিলো।

প্রিয়া ফোন দিয়েছে।

সাদমান সালাম দিলো।

প্রিয়া সালামের উত্তর নিলো।

এরপর দুজনই নিরব।কারো মুখে কোনো কথা নেই।সাদমান আগ বাড়িয়ে বললো।

কিছু বলবেন?

জী।

বলুন।

আপনার শরীরের কি অবস্থা।

আলহামদুলিল্লাহ এখন কিছুটা ভালো।

হাঁটতে পারেন?

জী না।

রাতে কি খেয়েছেন?

লাউ তরকারি।আর মিষ্টি কুমড়া ভাজি।
মা খাইয়ে দিয়েছে।

বাহ খুবই ভালো কথা।

প্রিয়া আর কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা।কিছুক্ষণ নিরব থেকে সে আবারো বলতে শুরু করলো।

আপনি নাকি বিয়েটা করতে চাচ্ছেননা।

জী।

কিন্তু কেন জানতে পারি?

তেমন কোনো কারন নেই।

তাহলে সমস্যা কি?আপনি আমাকে বলতে পারেন।

সাদমান চুপ হয়ে গেলো।

কিছুক্ষণ পর প্রিয়া গম্ভীর গলায় বললো।আমি আপনাকে মন থেকে চাই সাদমান।

সাদমান এখনো নিরব। উভয় পাশেই এই নীরবতার ছায়া গ্রাস করেছে।

সাদমান নিরবতা ভেঙে বললো।প্রিয়া শুনুন

জী বলুন।

আমাদের জীবনে কখন যে কি হয় আমরা কেউ ধারণাও করতে পারিনা।সত্যি জানলে আপনি কষ্ট পাবেন তবুও বলছি। ওই বাড়ি থেকে আসার পর আমার মন প্রান সব কিছু একজন ভালো মানুষের কাছে চলে গেছে।আপনাকে বিয়ে করতে পারি আমি।কারন আপনি খুব ভালো মেয়ে। আপনার মত জীবনসঙ্গীনি পাওয়া ছেলেদের স্বপ্ন।কিন্তু আপনি কি এটা মেনে নিতে পারবেন? আপনার স্বামীর মনে আপনি ছাড়াও অন্য কেউ রয়েছে?

না পারবোনা।

আমি কি বুঝাতে চেয়েছি আশা করি বুঝতে পেরেছেন আপনি।বুদ্ধিমানদের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। আর আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী।

প্রিয়া কিছুই বলতে পারলোনা।তার গলা আটকে এসেছে।কন্ঠনালী সুর হারাচ্ছে।কপোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।তবুও সে নিজেকে সংবরণ করে বললো। জী সাদমান আমি বুঝতে পেরেছি আপনি কি বলতে চাচ্ছেন।

আমাকে ক্ষমা করে দিন প্রিয়া।

ক্ষমা চাওয়ার মত তেমন কোনো ব্যাপার হয়নি।মতির মা মেয়েটির কথা আমাকে বলেছে।

মতির মা কে কিভাবে চিনেন?

তার ভাবি আমাদের বাসায় কাজ করে সেভাবেই চিনি।

কি বলেছে তিনি।

কি বলেছে সেটা না হয় থাক।তবে এটুকু বলি।মেয়েটা সত্যিই আপনাকে খুব ভালোবাসে।ভালো না বাসলে নিজের জীবন হুমকির মুখে ফেলে আপনাকে বাঁচাতো না।

সাদমান অস্ফুট স্বরে বললো।হুঁ।সে এটাও বলতে চাচ্ছিলোনা।সে ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে প্রিয়া কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু এখানে তার কিইবা করার আছে।হয়তো প্রিয়া তার ভাগ্যে নেই তাই বিয়েটা ভেঙে যাচ্ছে।কখনো কখনো ভালোমানুষ গুলোও এভাবে হারিয়ে যায়।কারন তারা আমাদের ভাগ্যে থাকেনা।সাদমান সাদিয়াকে ভালোবাসে।এর পিছনে যথেষ্ট কারন রয়েছে।সাদিয়া সেই ছেলেবেলা থেকে মানুষটাকে এক তরফা ভাবে ভালোবেসে গেছে।কখনো সাদমানের খারাপ চায়নি।সাদমানকে কঠিন মূহুর্ত থেকে ফিরিয়ে এনেছে।নতুন জীবনের উসিলা হয়েছে।তা ছাড়া মেয়েটি যথেষ্ট সৎ।প্রিয়া যেমন একজন ভালো মেয়ে।সাদিয়া তেমনই একজন ভালো মেয়ে। এমন মানুষের প্রেমে পড়ে যাওয়া অনিশ্চিত বা অসম্ভব কিছুনা।সাদমান প্রিয়াকে পছন্দ করেছে তার লিখা পড়ে।এটা প্রিয়ার বাহ্যিক দিক।আর সাদিয়াকে ভালোবেসেছে তার ভালোবাসার শক্তি অনুভব করে। স্বাভাবিক অর্থেই সে সাদিয়ার সাথে ভালো থাকবে বা প্রশান্তি খুজে পাবে।এমন ধারণা করা যুক্তি বাহিরে পড়েনা।বরং এটা যুক্তিযুক্ত। তাছাড়া সব কি যুক্তিতর্ক দিয়ে হয়?কিছু কিছু জিনিস আমাদের মন সায় দেয়, ভাগ্য সাপোর্ট করে তাই হয়ে যায়।

প্রিয়া আর কথা না বাড়িয়ে ফোন রেখে দিলো।প্রচুর কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার।সে কাঁদলো।জোর গলায় কাঁদলো।তার বাবা মায়ের ঘুম ভেঙে গেলো।তারা মেয়ের পাশে এসে বসলেন। মেয়েকে বিভিন্ন ভাবে বুঝাতে থাকলেন। আল্লাহর সিদ্ধান্তকে তোমার মেনে নেওয়া উচিত মা। হয়তো সাদমানের সাথে থাকলে তোমার জীবনে অনিষ্ট আসতে পারে।যেটা সহ্য করার ক্ষমতা তোমার নেই।তাই হয়তো আল্লাহ তাকে তোমার জীবন থেকে সরিয়ে নিয়েছেন।সাদমান ভালো ছেলে তা ঠিকাছে।এমনো হতে পারে আল্লাহর কাছে তোমাদের জোড়া পছন্দ হয়নি। তুমি কষ্ট পেওনা মামুনি।তুমি কষ্ট পেলে আমরাও কষ্ট পাই।

প্রিয়ার কান্নার আওয়াজ নিচু হচ্ছে।

তার বাবা বললো।মা তুমি নিজেকে সময় দাও।আল্লাহ তোমার জন্য আরো ভালো কাওকে নির্বাচন করেছেন । যে সাদমানের থেকেও তোমাকে ১০ গুন ভালো রাখবে।

প্রিয়া ঈষৎ মাথা নাড়ালো।এবং নরম গলায় বললো।তোমরা ঘুমাতে চলে যাও।আমি নিরাশ হইনি।এবং আল্লাহর সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অসন্তোষও নই।আমার নিজেকে স্বাভাবিক করতে সময় লাগছে এই আরকি। তোমার ঘুমাও যেয়ে।আমি এখন ঘুমাতে চাই।

প্রিয়ার বাবা চলে আসলেন।তার মা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আজ রাতে তার ঘুম হবেনা।তিনি মেয়ের পাশে বসে থাকলেন।এবং মেয়েকে বুঝাতে থাকলেন।

পরদিন সকাল বেলা। সাদিয়া এখনো ঘুম থেকে উঠেনি।ঘড়িতে সময় এখন ১২ টা।কিছুক্ষণ পর জোহরের আজান দিবে।সাদিয়ার মা রেহানার কাছে ব্যাপারটি সন্দেহ সূচক লাগলো।তিনি মেয়ের দরজায় যেয়ে কড়া নাড়লেন।ভিতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেলোনা।তিনি ভয় পেয়ে গেলেন।জোর গলায় সাজিদকে ডাকতে থাকলেন। সাজিদ হন্তদন্ত হয়ে মায়ের কাছে আসলো।

কি হয়েছে মা।

তিনি কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন।সাদিয়া দরজা খুলছেনা ।সকালেও আমি ডেকেছি কয়েকবার।

আচ্ছা কান্না করোনা দেখছি আমি।

আমার মেয়েটা রাতেও ভাত খায়নি।কি হয়েছে মেয়েটার?

আহ মা তোমাকে না বললাম কান্না করোনা।

রেহেনা কাপড় দিয়ে মুখ চেপে কান্না করতে থাকলেন।

সাজিদ সাদিয়ার নাম ধরে ডাকলো।
ভিতর থেকে কোনো প্রকার আওয়াজ ভেসে আসলোনা।সাজিদের বুক কেঁপে উঠলো। অন্তরিন্দ্রিয়ে অশ্রুপাত হচ্ছে।রেহেনা বেগম মেঝেতে বসে কাঁদতে থাকলেন।সাজিদ তার শরীরের শক্তি খরচ করে দরজায় জোরে পদাঘাত করলো।দরজা খুললোনা।কয়েকবার এমনটা করার পর দরজা খুলে গেলো। সাদিয়া মেঝেতে শুয়ে আছে।রেহেনা দৌড়ে মেয়ের কাছে চলে গেলেন। মায়ের মাথা কোলে তুলে নিয়ে আবারো কাঁদতে থাকলেন।

মা আমার কথা বল
কি হয়েছে তোর?
মাকে সব খুলে বল।

সাদিয়ার নিশ্চুপ,নিথর। যেন সে বাস্তব জগতে নেই।

সাজিদ তার শাহাদাত আঙুল সাদিয়ার নাকের কাছে ধরলো।সাদিয়া শ্বাস নিচ্ছে। অথচ বারবার ডাকার পরও সে চোখ খুলছেনা।সাজিদ বুঝতে পারলো তার বোন মূর্ছা গিয়েছে।সে বিন্দু মাত্রও অপেক্ষা না করে বোনকে কোলে তুলে নিলো। এবং হাসপাতালের দিকে যেতে লাগলো।

রেহেনার কান্নার শব্দ শুনে পাশের বাড়ির মহিলারা এসে পড়েছেন।তার মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা প্রায় কাছাকাছি ।পাশের বাসার একজন ভাবি সাদিয়ার বাবাকে ফোন দিলেন।তিনি অফিসে আছেন।মেয়ের অসুস্থতার খবর শুনে দ্রুত অফিস থেকে বের হয়ে গেলেন।

আসছে।

ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এবং আপনাদের মূল্যবান মতামত জানাবেন?।

#অদ্ভুত_সেই_বাড়িটি_১১
#লিখায়_মুসাফফা_মারহামা_মিম

প্রিয়া ফুল গাছে পানি দিচ্ছে।এই কাজটি সে খুব মনোযোগ সহকারে করে। উঠোনে একটি চেয়ার পেতে ফজলুল সাহেব বসে আছেন।মেয়েকে অবাক দৃষ্টিতে দেখছেন। কি থেকে কি হয়ে গেলো।মেয়েটা একটা সময় কত প্রানবন্ত ছিলো।এখন যেন হাসতে ভুলে গেছে । ফজলুল সাহেবের চোখ ভিজে উঠলো।তিনি মেয়ের দুঃখভরা মুখ আর দেখতে চাননা। চেয়ারে বসে থেকেই একটি পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেললেন। পরিচিত এক বন্ধুর ছেলে।পড়া লেখা শেষ করে কানাডা থেকে এসেছে ১ সপ্তাহ হলো।ছেলের নাম রায়হান।এক বাপের এক ছেলে। খুব আদরের। বন্ধু দুই দিন আগে ফোন দিয়ে জানালো।আমার ছেলের জন্য পাত্রী খুজছি।যদি তোর জানামতে ভালো কোনো মেয়ে থাকে আমাকে খবর দিস। ফজলুল সাহেবের রায়হানকে বেশ পছন্দ হয়েছে। তিনি প্রিয়ার ব্যাপারটি নিয়ে বন্ধুর সাথে আলোচনা করে দেখবেন। তার উঠোনে বসে থাকতে আর ভালো লাগছেনা।ক্লান্ত লাগছে।উঠে চলে এলেন ঘরে। কিছুক্ষণ বিছানায় লম্বা ভাবে শুয়ে চোখ বুজে থাকলে ক্লান্তির রেশ কিছুটা কমবে। প্রিয়া গুনে গুনে ১০ টি গাছে পানি দেওয়া শেষ করলো। গোলাপ ফুল গুলোতে পানি দিলেই এখন কাজ শেষ।এরি মধ্যে সাবিকুন খালা এসে উপস্থিত।
আরে আপা আপনি কেন গাছে পানি দিতাছেন?
আমারে দেন।

ঠিকাছে সমস্যা নাই।তুমি মাকে সাহায্য করো খালা।

আইচ্ছা ওইডা করমু।দেন পাইপটা আমার হাতে দেন আমি গাছে পানি দিতাছি।

প্রিয়া দিলোনা। গাছে পানি দিতে তার ভালো লাগছে।সাবিকুন খালা আর জোর করলেননা।তিনি চলে গেলেন।কিছুক্ষণ পর আবারো ফিরে আসলেন।আফা আপনারে কিছু একটা কইতে চায়।

হুঁ শুনছি।

মতির মা একখান ভুল কইরা ফেলছে।

কি ভুল?

উনি আপনার কথা ওই মাইয়ারে কইয়া দিছে।

প্রিয়া সম্পূর্ণ মনোযোগ সাবিকুন খালার দিকে দিলো।হাত থাকা পানির পাইপটি নিচে রেখে দিলো।এবং ললাটে ভাজ ফেলে বললো।উনি কেন শুধু শুধু আমার কথা বলতে গেলেন?

আমি নিজেও জানিনা আফা।তয় মাইয়াডা এখন অসুস্থ।

কি হয়েছে তার?

যেদিন বিকেলে উনি মাইয়াডার কাছে আপনার কথা কইছে। এরপর দিন সকালে নাকি মাইয়াডারে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে।

ইশ মতির মা কেন এই ভুল করতে গেলেন?
মেয়েটা অত্যাধিক কষ্টের কারনে হার্টে আঘাত পেয়েছে।তাই অচেতন হয়ে গেছে। দেখি আমার ফোন নিয়ে আসো।সাদমানকে ব্যাপারটা জানাতে হবে।

না আফা এই কাজ কইরেননা।যদি তারা তার চাকরি বাতিল কইরা দেয়।

করবেনা।

সাদমান সাদিয়ার অসুস্থ হওয়ার ব্যাপারটিতে খুব আহত হয়েছে । কিন্তু সে সাদিয়াকে দেখতে যেতে পারেনি।তার মা বাবা সবাই এখন সাদিয়াদের বাড়িতে। সে কিছুক্ষণ পরপর তার মায়ের কাছ থেকে সাদিয়ার খবর জেনে নিচ্ছে।হঠাৎ করে কি হয়ে গেলো মেয়েটার? ইচ্ছে হচ্ছে একবার সাদিয়াকে কল দিবে।কিন্তু সাহস হচ্ছেনা । সাদমান ফোন হাতে নিয়ে আজও জানালার পাশে বসে আছে।অজানা কারনে আজ তার খুব কষ্ট হচ্ছে।বুকের বা পাশে চিনচিন করে ব্যথা করছে।এরি মধ্যে তার ফোন বেজে উঠলো।খুব উৎসুক হয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো।মূহুর্তেই চোখে মুখে নিরাশাজনক ছাপ পড়লো। সে ভেবেছিলো তার মা ফোন দিয়েছে।কিন্তু তা না? ফোন দিয়েছে প্রিয়া। সাদমান ফোন কর্ণে তুলে নিলো।

আসসালামু আলাইকুম সাদমান।আপনাকে কিছু বলতে চাই।

ওয়ালাইকুম আসসালাম। জী বলুন।

প্রিয়া জড়তাহীন ভাবে সব গুলো কথা বলা শেষ করলো।

সাদমান নরম গলায় বললো।আপনি নিশ্চিত এ জন্যই সাদিয়া অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

দেখুন নিশ্চয়তা দিতে পারছিনা।তবে বিষয়টি আপনি ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন।সে বিকেলে মতির মায়ের থেকে আপনার আর আমার ব্যাপারে শুনলো।এবং রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লো।এখান থেকেইতো ব্যাপারটি পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে।

দেখুন আমি কত বোকা আর নির্বোধ। এখনো সাদিয়ার নিজে থেকে আমার কাছে আসার অপেক্ষা করছি।

এখন আর দেরি করার দরকার নেই।আপনার মা বাবার সাথে কথা বলে সব ঠিক করে নিন।

জী আচ্ছা।সাদমান ফোন রেখে দিতে চাইলো।কিছু একটা ভাবতেই সে আবারো কানের সাথে শক্ত করে ফোন ধরলো।এবং হালকা গলায় বললো।আপনি খুব ভালো মেয়ে প্রিয়া। দেখবেন আল্লাহ আপনাকে অনেক বেশি প্রতিদান দিবেন।তখন হয়তো আপনি এটা বলবেন।তুমি আমাকে কখনো নিরাশ করোনি।

প্রিয়া অস্ফুট স্বরে বললো।হুঁ ইন শা আল্লাহ।দু পাশ থেকেই কিছুক্ষণ নিরবতা বিরাজ করলো।তমসাপূর্ণ নিরবতা। এভাবে কিছুটা সময় কাটার পর সাদমান ফোন রেখে দিলো।প্রিয়া আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। অজানা এক কারনে তার খুব কষ্ট হচ্ছে।সে গোলাপ ফুলের টবের সম্মুখে বসে পড়লো।আজ তার চোখ নীর শূন্য।বুকের ভারী বোঝার ভার ঈষৎ ক্ষীণ। এর কারন হয়তো নিজের ভাগ্যকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া।প্রিয়া গোলাপের গাত্রে জড়িয়ে থাকা কাঁটার উপর আঙুল রাখলো।উদগত সেই কাঁটার সুচের মতো তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ প্রিয়ার আঙুলে বিধে গেলো।সেথা থেকে টুপ টুপ করে রক্ত পড়ছে। প্রিয়া সেটা বিস্ময়ের চোখে দেখছে।লাল গোলাপের মিষ্ট অবয়ব প্রিয়ার দিকে অনিমিখে চেয়ে আছে।যেন তারা কিছু বলতে চাচ্ছে। হয়তো তারা এটাই বলতে চাচ্ছে।কষ্ট হচ্ছে তাইনা প্রিয়া? প্রিয়ার অবয়ব ভঙ্গিমা যেন এটা বলছে। দুঃখ কষ্ট এগুলো জীবনের অংশ সুতরাং এগুলোকে সাথে নিয়েই আমাদের পথ চলতে হবে।

সাদিয়া এখন কিছুটা সুস্থ। রেহেনা বেগম সাজিদের কাছ থেকে সবটা শুনেছেন।তিনি মেয়ের উদবেগের কারন এখন জানেন।তিনি চিন্তিত কারন সাদমান বেশ বড় পরিবারের সন্তান।উচ্চবিত্তদের তালীকায় তাদের নাম রয়েছে। অথচ সাদিয়ারা হলো মধ্যবিত্ত। সাদমান কেনই বা সাদিয়াকে চাইবে? তিনি তার দুশ্চিন্তার কথা সাদিয়াকে বলার সাহস পাচ্ছেননা।মেয়েটা অসুস্থ।কয়েকমাস যাবত অসুস্থ। মানসিক ভাবে ভালো নেই। নিজের মধ্যে কষ্ট গুলো চেপে রাখতে রাখতে এখন এমন অবস্থা হয়েছে।অধিক দুঃখ পেলেই সে অজ্ঞান হয়ে যায়।ডাক্তাররা পরিপূর্ণ রেস্টে থাকতে বলেছেন।চিন্তা মুক্ত থাকতে বলেছেন।তাই এখন এসব বলে মেয়েকে উৎকন্ঠায় ফেলে দেওয়া কখনোই যুক্তির মধ্যে পড়েনা।এর উপর আবার সাদিয়ার বাবাকে সাদমানের বাবা তলব করেছেন।কি জানি বলেন কে জানে? না আর ভাবতে ইচ্ছে করছেনা।এসব দুঃশ্চিন্তা রেহেনাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। দুপুরের রান্নাও এখনো করা হয়নি।রেহেনা সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে মেয়ের কক্ষে গেলেন।সাদিয়া লাল রঙের একটি কাথা গাত্রে জড়িয়ে শুয়ে আছে।তার দৃষ্টি জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে নিবদ্ধ। যেন একটুকরো আকাশ সে তার ঘরে থেকেই দেখতে পাচ্ছে।সাদিয়া মাকে দেখ উঠে বসলো।এবার এক টুকরো আকাশ বিশালতায় পরিপূর্ণ হলো। মস্ত বড় গগন মাথার উপর।রেহেনা মেয়ের পাশে বসতে বসতে বললেন।

কি রান্না করবো আজ?

তোমার যেটা ভালো লাগে।

সব সময়তো তোদের ইচ্ছেমতই রান্না করি।

আজ তোমার ইচ্ছেমত করো।

ফ্রিজে ইলিশ মাছ, পাবদা মাছ,আর চিংড়ি মাছ আছে।ইলিশ মাছের ঝোল রান্না করি কি বলিস?

সাদিয়া নিশ্চুপ। এখনো সে আকাশ দেখছে।
রেহেনা মেয়ের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন।কিছু একটা ভাবছেন তিনি।অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে করে মেয়ের সাথে।কিন্তু সাহস করে উঠতে পারেননা।তিনি কিভাবে মেয়েকে বলবেন।সাদমাকে ভুলে যা মা।অথচ সাদমানই প্রথম পুরুষ যাকে সে প্রথম ভালোবেসেছে,মনে থেকে চেয়েছে।
রেহেনা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন।

আয় মা আমার সাথে।

কোথায়?

আমি মাছ কাটবো তুই বসে বসে দেখবি।

এটা দেখার কি আছে?

কিছু নাই তবুও দেখবি।একা সারাদিন এভাবে রুমের মধ্যে শুয়ে বসে থাকলে তোর মন আরো খারাপ হবে।চল আমার সাথে ।

সাদিয়া বাধ্য হয়ে মায়ের সাথে কিচেনে গেলো।রেহেনা একটি পিঁড়ি তে আসন পেতে বসলেন।সাদিয়া ছোট্ট একটি মোড়াতে বসে আছে।রেহেনা ফ্রিজ থেকে ২ টি ইলিশ মাছ বের করেছেন। শাণিত বঁটির সাহায্যে তিনি মাছ কেটে নিচ্ছেন।সামনে রাখা একটি রন্ধনপাত্র। মাছগুলো কেঁটে তিনি এই পাত্রে রাখছেন।আর মাছের নির্গত আবর্জনা তিনি একটি সাদা পলিথিনে ভরে রাখছেন।সাদিয়া অকপটে সেদিকে তাকিয়ে আছে।কিছুক্ষণ পর রেহেনা বেগম নিরবতা ভেঙে বললেন।তোর জন্য মাছের মাথা রাখবো।

আমার জন্য কেন।সাজিদ পছন্দ করে ওর জন্য রেখো।

তাহলে তোর জন্য লেজ টা রাখবো।

আচ্ছা।

আমাদেরকে অনেক ভালোবাসিস তুই, তাইনা মা?

এ আবার কেমন প্রশ্ন।

তোর মাকে কতটুকু ভালোবাসিস বলতো আমায়?

কি সব প্রশ্ন করছো তুমি? আল্লাহ,এবং রাসুলের পরে তোমাকেই আমি সব থেকে বেশি ভালোবাসি মা।

তাহলে মায়ের একটা কথা রাখবি?

সাদিয়া চুপ হয়ে গেলো।কপোল বেয়ে নয়ননীর গড়িয়ে পড়তে থাকলো।সে জানে তার মা কি বলতে চায়? মেয়ের কাণ্ড দেখে রেহেনার চোখ ভিজে উঠলো।তবুও সে নিজেকে সংবরণ করে বললো।

মা এটা কি সম্ভব। এত বড় ফেমিলির ছেলে আমার মেয়েকে কেন বিয়ে করতে আসবে বল?

সাদিয়া এবারো নিশ্চুপ।

রেহেনা মেয়েকে অনেক কথা বলতে চান।কিন্তু তার গলা আটকে আসছে।মনের বিষয় কি বললেই করা যায়? মন অবাধ্য, বাধ্য দুটোই হতে পারে।একবার নিজের অবাধ্য হয়ে গেলে তাকে বাধ্য করা ৪ টি খানি কথা নয়। প্রিয়ার নাম শুনার পর সাদিয়া চেয়েছে সাদমানকে ভুলে যাবে।কিন্তু এটা মনের ব্যাপার।অতটা সহজ কাজ নয়।এসব চিন্তা করতেও বুক কেঁপে উঠে।চোখ অশ্রুসিক্ত হয়। রেহেনা মেয়েকে আর কিছুই বললেননা।তিনি মেয়েকে সব থেকে বেশি ভালো বুঝেন।মা বলে কথা। রেহেনার মাছ কাঁটা প্রায় শেষ।এখন ধুয়ে পরিস্কার করে রান্না বসিয়ে দিতে হবে। এরি মধ্যেই কলিংবেল বেজে উঠলো।সাদিয়া ওড়না দিয়ে চোখ মুছে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।তার বাবা এসেছে।সে দরজা খুলে দিলো। বাবা সাদিয়াকে দেখেই শুকনো গলায় বললেন।

তোমাকে না কাঁদতে বারণ করেছি।

কই কাঁদলাম?

তোমার চোখ দেখেই আমি বুঝে গিয়েছি।আর কাঁদবেনা তুমি।একটি সুখবর রয়েছে তোমার জন্য। রেহেনা বাবা মেয়ের কথপোকথন শুনে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসলেন। এবং কান্না বিজড়িত কন্ঠে বললেন।

সাদিয়ার বাপ,তারা কি আমার মেয়েকে নিতে চায়?

হুঁ।

আপাতত এনগেজড করিয়ে রাখতে চায়।সাদমানের পা ঠিক হলে বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে যাবে।

রেহেনা সুখবরটি শুনে হাসলেননা।তিনি কাদঁলেন। জোরস্বরে কাঁদলেন।সোফায় বসে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।হয়তো কষ্টের পর যখন সুখ আসে তখন এমনই হয়।সাদিয়া তার কক্ষে গিয়ে অজু সেরে নিলো।এবং নামাজ শেষ করে সেও অনেকক্ষণ কাঁদলো।আল্লাহর কাছে লম্বা মুনাজাত করলো। বারবার শুকরিয়া জ্ঞাপনে শির নত করে দিলো। মুনাজাত শেষে আকাশ পানে চেয়ে ঠান্ডা গলায় বললো।তুমি কখনো আমাকে নিরাশ করোনি আল্লাহ।

আসছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here