#অনান
#পর্ব-৫
ফোনটা এলো গভীর রাতে। একা একাই ঘুমাতে চায় নীরা কিন্তু এতো বড় বাড়িতে শুধু দু’জন থাকলে কেমন গা ছমছমে অনুভূতি হয়। আর তাছাড়া বাড়িতে তো জীবনেও একা শোয়ার অভ্যেস ছিলো না, হোস্টেলেও একরুমে তিনজন থাককো। নীরা চাইলেও এই অভ্যাস রপ্ত করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে মোর্শেদের সাথে বেড শেয়ার করতে হয়। যদিও বিছানা যথেষ্ট বড়, তবুও নীরা জড়সড় হয়ে এককোনে পরে থাকে। উফফ অসহ্য! নীরা বিরক্ত হয়ে পাশ ফেরে। মোর্শেদ হ্যা করে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে আর পাশেই ওর ফোনটা বেজে যাচ্ছে অনবরত। নীরা একটু উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কে ফোন করেছে। বাবা লেখা দেখে বুঝে গেলো বড় চাচা ফোন করেছে। কিন্তু এতো রাতে চাচা আবার কেন ফোন করলো? বাড়িতে কারো কিছু হলো নাতো? নীরা মোর্শেদকে ডাকলো দু’বার। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বিরক্ত মোর্শেদ বললো-
“আহ ডাকিস নাতো। সারাদিন অনেক খাটুনি করেছি এখন শান্তি মতো ঘুমাতে দে।”
“চাচ্চু ফোন করেছে, ধর জরুরি কিছু হয়তো?”
“তুই কথা বল।”
“তোর ফোন আমি ধরবো?”
“হ্যা ধরবি। তুই আমার বউনা? ফোন ধরতে কি সমস্যা? আর জ্বালালে এ ঘরে একা রেখে চলে যাবো বলে দিলাম?”
নীরা মুখ ভ্যাংচালো, মনে মনে দু’চারটা গালি দিল। শুধু হুমকি ধামকি দেওয়া ছাড়া আর পারেটা কি? উল্টো পাল্টা ভাবতে ভাবতে ফোনটা কেটে গেলো। যাক বাবা বাঁচা গেলো, ভাবতেই ফোনটা আবারও বাজতে শুরু করলো। এবার আর দেরি না করে ফোন রিসিভ করলো নীরা-
“হ্যালো চাচু, কি খবর? তোমরা ভালো আছো তো সবাই?”
“নীরু, মোর্শেদ কোথায়? তুই কেন ফোন ধরেছিস?”
“ও ঘুমাচ্ছে চাচু, তুমি আমাকে বলো।”
“এখনই মোর্শেদের কানে ফোনটা ধর নীরু, দেরি করিস না!”
চাচার ধমকে কেঁপে উঠলো নীরা, তাড়াহুড়ো করে ফোনটা মোর্শেদের কানে ঠেকালো। ঠিক তিরিশ সেকেন্ডের মাথায় মোর্শেদ লাফিয়ে বিছানায় বসলো।
“তুমি কিছু ভেবো না বাবা, আমরা এখনই রওনা দিচ্ছি। ”
মোর্শেদের ওভারে ওঠা দেখে নীরা ভয় পাওয়া গলায় বললো-
“কি হয়েছে? কোথায় যাবি এখন? আমি কিন্তু একা থাকতে পারবো না বলে দিলাম।”
“আহ নীরা চুপ কর। পনেরো মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নে। আমরা বেরুবো।”
” কোনো প্রশ্ন করিস না তো। আমি অন্য বাথরুমে গেলাম। তুই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে।”
মোর্শেদ এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না। নীরা কিছুই বুঝতে পারছে না। এতো রাতে কেন যেতে হবে? বাবার কিছু হয়নি তো? অজানা ভয়ে নীরার বুক কেঁপে উঠলো।
★★★
রাতের আধারে গাড়ি ছুটে চলেছে বগুড়ার দিকে।
গাড়ি দেখে অবাক হয়েছিলো নীরা। এতোরাতে মোর্শেদ কিভাবে গাড়ি ম্যানেজ করলো কে জানে। তবে বুঝলো মোর্শেদটা বেশ কাজের। এইজন্যই বুঝি বাবা ওকে এতোটা বিশ্বাস করেন।
“শোন, দাদীজানের কি কিছু হয়েছে নাকি?”
মোর্শেদ অফিসে মেইল করছিলো। টাইপ করতে করতে হাত থেমে গেলো ওর। নীরাকে দেখলো এক ঝলক। এখনই বলাটা কি ঠিক হবে? মোর্শেদ এড়িয়ে গেলো।
“নাহ, দাদীজান ভালো আছে। বাড়ি গেলেই দেখতে পাবি। আব্বু তো এতো ভেঙে কিছু বলেনি। শুধু বললো তোরা চলে আয়।”
“ওহহহ।”
নীরা হতাশ হলো। কেন যেন ভীষণ অস্থির লাগছে। ঢাকা থেকে যাওয়ার পর আব্বুর সাথে ঠিকমতো কথা বলেনি কেবল হাই হ্যালো ছাড়া। মা কয়েকদিন ধরে ফোন করে যেতে বলছিলো বারবার। তবে কি মায়ের কিছু হলো? নীরা চুপচাপ সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো।
সকাল সাতটা নাগাদ পৌঁছালো নীরারা। বৈঠকখানায় দাদীকে বসে থাকতে দেখে একটু চমকে গেলো বৈকি। এইসময়টা দাদীজান নিজের রুমে বসে কোরআন পড়েন। মা ছোট চাচী নাজু ব্যাতীত দুই চাচীই দাদীর পাশে বসে আছে। ভেতর ভেতর ঘামছে নীরা তবুও পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো। দাদীজানের পাশে বসতেই নজরে পড়লো তাকে। ভীত মুখচোখ নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে মিরা, নীরার বড় বোন। ও এখানে কেন? ও না ঢাকায় ছিলো? আর বাবা মাই বা কোথায়?
“দাদীজান!”
“বুবু, তুমি আসছো? ও মোর্শেদ, বুবুরে নিয়া জলদি হাসপাতালে যা দেখি। দেরি করিস না।”
“হাসপাতালে কেন দাদী? কে আছে হাসপাতালে?”
“তোর বাপ। খালি তোকে আর মোর্শেদকে খোঁজে।”
“আব্বা! আব্বার কি হইছে? আব্বা কেন হাসপাতালে?”
নীরা বিস্মিত হয়ে জানতে চায়।
“কেন আবার? এই যে কালনাগিনী বাড়ি আসছে। আইসাই আমার ব্যাটাকে খাইলো। গতবার আমার ব্যাটাকে আধমরা করছিলো এইবার পুরা মারার প্লান করছে।”
মিরা চকিতে একবার নীরাকে দেখলো। ওর দু’চোখ জলে টইটম্বুর। নীরার চোখে চোখ পড়তেই মিরা চোখ সরিয়ে নিলো। নীরা দেখতে লাগলো বড় বোনকে। চোখের কোটরে কালি, শুকিয়ে গালের হাড় উচু হয়ে আছে। নীরার ভীষণ মায়া হলো মিরাকে দেখে।
“দাদীজান, বাদ দাও না। নীরা চল তো হাসপাতাল থেকে ঘুরে আসি। নাকি তুই ফ্রেশ হয়ে যাবি? আমি ততক্ষণে না হয় ঘুরে আসি?”
মোর্শেদের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে গেলো নীরার-
“না, আমি এখনই যাবো।”
“চল তাহলে।”
আরো একবার বোনকে দেখে নিয়ে নীরা বেড়িয়ে এলো মোর্শেদের সাথে।
ওদেরকে দেখেই মোর্শেদের বাবা আমজাদ আহমেদ দৌড়ে এলেন। নীরা দেখলো একটু দূরে রাতুল মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।
“নীরা দৌড়ে যা তো মা, বাবার অবস্থা বেশি ভালো না। খুব করে দেখতে চাইছে তোকে। মোর্শেদ তুইও যা।”
চাচার কথা শুনে নীরার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। কি বলছে চাচা? বাবার হঠাৎ করে করে এমন অবস্থা হলো? নীরা জরাগ্রস্থের মতো দাঁড়িয়ে আছে। মাথাটা কেমন শুন্য লাগছে। টলতে টলতে দেয়াল ধরলো নীরা। ওর অবস্থা বুঝেই মোর্শেদ এসে পেছন থেকে জাপ্টে ধরলো নীরাকে। নীরা কেবল ঘোলাটে চোখে মোর্শেদের পানে চাইলো। প্রানপনে কান্না আটকানোর চেষ্টায় ঠোঁট জোড়া কামড়ে ধরলো, অস্ফুটস্বরে বললো-
“বাবা!”
“কাদিস না প্লিজ। তোকে কাঁদতে দেখলো বড় মা ভেঙে পড়বে।”
নীরা নিজেকে সামলে নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। বাবার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। মনিটরে হার্টবিট দেখা যাচ্ছে। মা বাবার দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক চোখে। নীরা যেতেই মা ফিসফিস করলো-
“বাবাকে ডাক নীরা দেখ কেমন ঘুমিয়ে আছে? এই মোর্শেদ তুই ডাক, তোকে বেশি ভালোবাসে। দেখবি তোর ডাকে সারা দেবে।”
নীরা বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে দু’বার বাবা বাবা করে ডাকে। হাসনাত সাহেব সত্যি সত্যি চোখ মেলে। মুখের সামনে নীরাকে ঝুকে থাকতে দেখে একটু হাসি ফোটে তার। আলতো করে হাত তুলে নীরাকে কাছে ডাকেন, বিরবির করে কিছু একটা বলেন। নীরা বোঝে না। নীরা অসহায় হয়ে মোর্শেদের দিকে তাকালো। মোর্শেদ ঝোঁকে-
“বড় আব্বু, কি বলছেন?”
হাসনাত সাহেব দূর্বল হাতে মোর্শেদের হাতটা ধরেন, ইশারায় নীরাকে ডাকে, দু’টো হাত এক করার চেষ্টা করেন। মোর্শেদ বুঝতে পেরেই শক্ত করে নীরার হাতটা ধরে-
“বড় আব্বু, আপনি কিছু ভাববেন না আমি সব সামলে নেবো। আপনি শুধু সুস্থ হয়ে যান।”
হাসনাত সাহেব একটু হাসার চেষ্টা করেন। আশ্বস্ত হয়ে চোখ বন্ধ করেন। বাবাকে এমন দেখে নীরার ভীষণ কান্না পায়। সে দৌড়ে বেড়িয়ে আসে বাইরে। যতই রাগ করুক বাবাকে ছাড়া যে জীবনটা কল্পনাও করে না নীরা। ছোটর থেকেই বাবা তাদের আগলে রেখেছেন, কখনো কোনো সমস্যা হওয়ার আগেই সেটা সলভ করে দিতো বাবা। মায়ের চাইতে বাবাই তার কাছের মানুষ। শুধু নিজের বিয়েটা নিয়ে বাবার সাথে কেমন একটা দূরত্ব চলে এলো। নীরা দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। মাথায় নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ খোলে নীরা। আমজাদ সাহেব দাঁড়িয়ে। নীরা চাচার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো।
দু’দিন পর ভোরের দিকে হাসনাত সাহেব নিঃশ্বব্দে মারা গেলেন।
চলবে—–
Farhana_Yesmin।