#অনান
#পর্ব-৭
নীরার নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়েছে। এটাই লাস্ট সেমিস্টার তাই নীরা ক্লাস ফাঁকি দিতে চায় না। এবার ঢাকায় আসার পর নীরার জীবনের রুটিন বেশ খানিকটা চেঞ্জ হয়েছে। আগে কর্তব্যের খাতিরে মোর্শেদের কাজগুলো করতো কিন্তু আজকাল যত্নের সাথে করে। শুধু কি যত্ন? সাথে একটু ভালোবাসা কি নেই? নীরা বেশ ভাবে বিষয়টা নিয়ে। ভাবনার কারন হলো মোর্শেদের নীরবতা। নীরা যত যাই করুক মোর্শেদ কোনো কিছুতেই আগের মতো উচ্ছ্বসিত প্রশংসা বা সারা দেয় না। সকালে উঠে নিজের মতো খাওয়া দাওয়া করে অফিসে চলে যায়। সন্ধ্যায় কখনো কখনো বাড়ি ফিরলে চুপচাপ টেবিলে রাখা খাবার খেয়ে নেয় কখনো কখনো খায় না, বলে খেয়ে এসেছে। নীরাও আর কথা বাড়ায় না। অবিশাস্য হলেও সত্যি যে, এই গুরুগম্ভীর মোর্শেদকে নীরার কেমন যেন ভয় লাগে। কিন্তু সেই সাথে এতো বড় বাড়িতে শুধু দু’জন থাকে তারউপর কথাবার্তা নেই, সবকিছু মিলে নীরার দমবন্ধ লাগে। গত একমাসে নীরা হাফিয়ে গেছে। আজ ভার্সিটি থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফিরেছে, একটা ক্লাস হয়নি তাই। খুব ক্লান্ত লাগছিলো তাই কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে গেলো। তার সেই ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যা সাতটা নাগাত। চোখ ডলতে ডলতে উঠে এসে দেখলো ডাইনিং এ বসে কফি খাচ্ছে মোর্শেদ। ওকে দেখে একবার তাকালো তারপর আবার মোবাইলে মনোনিবেশ করলো।
“তুমি কখন এলে?”
আচমকা নীরার মুখে তুমি শুনে চমকে উঠলো মোর্শেদ। নিজের অবাক ভাব লুকিয়ে কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে নীরাকে দেখলো আপাদমস্তক। মোর্শেদের সে দৃষ্টি দেখে নীরা মিইয়ে গেলো। সে কি ভুল কিছু বলেছে? স্বামীকে তো মানুষ তুমি করেই বলে নাকি? বান্ধবী মল্লিকা তো সে কথাই বললো।
“তোর কি শরীর খারাপ?”
মোর্শেদের গমগমে কন্ঠ শুনে বুক কেঁপে উঠলো নীরার।
“ন ননননা তো? কেন?”
“হঠাৎ করে তুমি করে বলছিস যে? জ্বর টর হয়েছে নাকি?”
“না শরীর ঠিকই আছে। কি রান্না করবো রাতে?”
নীরা এবার ইচ্ছে করেই সম্বোধন এড়িয়ে গেলো।
“যা খুশি। আমার কোনো স্পেশাল রিকোয়ারমেন্ট নেই। ”
“আচ্ছা, তাহলে খিচুড়ি করি সাথে ডিম ভাজি আর ছোট মায়ের দেয়া আমের আচার আছে। খুব মজা লাগবে।”
নীরা উচ্ছ্বসিত হয়ে বকবক করে। মোর্শেদ বিরস বদনে উঠে রুমে চলে গেলো। নীরার কথার জবাবে কেবল ছোট করে বললো-
“তোর যেমন ইচ্ছে।”
উফফ এইটুকু রান্না করতেই নীরার সাড়ে নয়টা বেজে গেলো। তারপর চট করে ফ্রেশ হয়ে এসে টেবিলে বসে খাবার বেড়ে মোর্শেদকে ডাকলো। খিচুড়ির পাতে দু’চামচ ঘি ছড়িয়ে দিলো। মনে মনে খুব করে আশা করে আছে মোর্শেদ খেয়ে ওর রান্নার প্রশংসা করবে। নীরা খাচ্ছে আর কিছুক্ষন পর পর আড়চোখে মোর্শেদকে দেখছে। মোর্শেদ নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে। নীরা না পারতে জানতে চায়। মোর্শেদের গরুর মাংস পচ্ছন্দ বলে আজ সারপ্রাইজ হিসেবে গরুর মাংস করেছে জীবনে প্রথমবার। তাও মোর্শেদ চুপ।
“খিচুড়ি খেতে ভালো লাগছে? ”
“হুম।”
“আর গরুর মাংস কেমন হয়েছে?”
“হুম।”
নীরা এবার রেগে গেলো।
“কি হুম হুম করছিস কখন থেকে? এতো কষ্ট করে রান্না করলাম একটু প্রসংশা করতে পারছিস না? কি হয়েছে তোর? সারাদিন একা একা থাকি, বাসায় এলে আমার সাথে একটু গল্প করা যায় না?”
“বাহ, তুমি থেকে তুই? স্বরুপে ফিরলি তবে? আর তোর সাথে কি কথা বলবো? তোর তো আমার কথা পচ্ছন্দ না। তাই তোকে বিরক্ত করি না।”
নিজের ব্যবহারে মনে মনে লজ্জিত হলো নীরা। এতোদিন মোর্শেদ ওর আগে পিছে ঘুরেছে তখন ও মোর্শেদকে পাত্তা দেয়নি আর এখন অল্প কয়েকদিনের ভেতর নীরা হাঁপিয়ে গেলো? তাহলে মোর্শেদের না জানি কতো কষ্ট হয়েছে?
“তখনকার কথা আলাদা, এখন তো একটু কথা বলতে পারো?”
“উফফ, তোর এই তুমি করে বলাটা যেন কেমন লাগছে। দয়া তুই ‘তুই’ বল। এসব আমি নিতে পারছি না। দেখা যাবে হার্টফেল করে পগারপার হয়ে গেছি।”
মোর্শেদ আকাশের দিকে ইশারা করলো।
“বালাই শাট, এতো আজেবাজে বকিস কেন? আচ্ছা যা তুমি করে বলা বন্ধ তবুও আমার সাথে একটু কথা বলিস।”
“গেলাম, ঘুম আসছে আমার। সকালে আবার অফিস আছে।”
মোর্শেদ যেন শুনতে পায়নি এমন ভাবে কথা বললো। নীরার জবাবের অপেক্ষা না করেই চলে গেলো। এবার বড্ড অভিমান হলো নীরার। নিজেকে কেমন যেন অনাহুত মনে হলো। এদিকে মাও ঠিকঠাক মতো কথা বলে না ওর সাথে। এদিকে মোর্শেদেরও একই অবস্থা। কোথায় যাবে সে? বাবা এইভাবে চলে যেয়ে একদম ঠিক করেনি। বাবা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই বুঝতো ওকে। এভাবে অবহেলায় দূরে সরিয়ে দিতো না। না একটা ভুল করেই ফেলেছে ও,তাই বলে এভাবে সাজা দেবে সবাই মিলে? আর মিরাপা, সে কিভাবে পারলো এতোকিছু করতে? তার কি একটুও বুক কাঁপলো না? দেখা হলে ঠিক ঠিক এর জবাব চাইবে নীরা।
★★★
আজ আর বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না নীরার। ক্লাস শেষে মল্লিকাকে সাথে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে হালকা খেয়ে নিলো।
“শপিংয়ে যাবি?”
“তুই আর শপিং! তোর কি শরীর খারাপ নাকিকে নীরা?”
মল্লিকা অবাক হয়। যে মেয়েকে ঠেলেঠুলে শপিংয়ে নেওয়া যায় না সে আজ নিজ থেকে শপিংয়ে যেতে চায়।
“নারে শরীর ঠিকই আছে। আসলে বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। এতো তাড়াতাড়ি যেয়েই বা কি করবো?”
“ওহহহ, তাহলে এই ব্যাপার? ভাইয়ার সাথে সব ঠিকঠাক হলো তোর?”
“কোথায় আর হলো। আগে আমার সাথে সারাক্ষণ লেগে থাকতো আর এখন আমার দিকে ফিরে তাকানোর সময় হয় না।”
“আমার কি মনেহয় জানিস, ভাইয়া ইচ্ছে করেই এমন করছে। তুই হয়তো একটু বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছিস ভাইয়াকে।”
“হুম। তাতো দিয়েছিই।”
মনে মনে বললো নীরা। মল্লিকা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর ফোন বাজলো। কথা বলেই তড়িঘড়ি করে উঠলো-
“নীরা, খুব জরুরি কাজ পড়ে গেছে রে বাসায়। আমি গেলাম রে।”
“কি হয়েছে?”
“মা মনেহয় অসুস্থ হয়ে গেছে।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে যা তাড়াতাড়ি।”
মল্লিকা যাওয়ার পর অনেকক্ষণ একা একাই বসে রইলো নীরা। কফি খেলো চুপচাপ। তারপর বিল পে করে অলস হেঁটে শপিং মলে ঢুকলো। আনমনে এটা ওটা দেখে সময় নষ্ট করছে। হঠাৎই পেছন থেকে ডাক এলো-
“নীরা।”
নীরা আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজলো কে ডাকছে। কাউকে খুঁজে না পেয়ে এক্সেলেটরে উঠতেই আবার ডাকলো-
“এই যে এখানে আমি।”
এবার পাশ ফিরতেই মিরাকে দেখতে পেলো। সাথে ছোট একটা পিচ্চি ছেলে। মুখে একেবারে মিরার আদল। পিচ্চিটাকে দেখলেই আদর করতে মনচায় নীরার। মিরা নীরার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো এককোনে-
“কি রে একা একা ঘুরছিস যে?”
“এমনিতেই। তুমি এখানে কি করছো?”
দায়সারা ভাবে জিজ্ঞেস করে নীরা। ওর মোটেও মিরার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
“কিরে রাগ করেছিস আমার উপর?”
“নাহ রাগ করবো কেন? এখন ভালো আছো তো? তোমার তো আবার নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে না।”
“শোন, আমি ইচ্ছে করে কিছু করি নাই রে। বাড়িতে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। মাঝে মাঝে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে জানিস। অল্প বয়সে ভুল করেছিলাম তার মাসুল দিচ্ছি এখানো। আমি নিজেকে কখনো মাফ করতে পারবো না। আমার জন্য বাবা মারা গেলো। বিশ্বাস কর আমি কখনো এরকমটা চাইনি।”
“তাই! কি চেয়েছো তাহলে?”
“সত্যি বলছি রে, আমি বাধ্য ছিলাম। রিয়াজ বাচ্চাটাকে আঁটকে রেখে আমাকে বাবার কাছে পাঠিয়েছিলো। বলেছিলো টাকা না নিয়ে আসলে বাচ্চাটাকে কিছু একটা করে ফেলবে। আমি কি করবো বল? বাধ্য হয়ে আমাকে বাড়ি যেতে হয়েছিল। যে বাসা থেকে নিজ ইচ্ছায় বেড়িয়ে এসেছিলাম সেখানে আবার ফেরত যাওয়া কতোটা লজ্জার তোকে কিভাবে বোঝাই বলতো?”
নীরা কিছু বলে না। আসলে কি বলবে বুঝতে পারছে না।
“শোন, আমি রিয়াজকে ছেড়ে দিয়েছি। এখন একাই আছি আমার এই পুতুলটাকে নিয়ে। মোর্শেদই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। একটা চাকরিও ম্যানেজ করে দিয়েছে। ভালোই আছি এখন। শোন নীরা, তুই খুব লাকি যে মোর্শেদের মতো লাইফ পার্টনার পেয়েছিস। ও তোকে অনেক সুখে রাখবে দেখিস।”
নীরার কানে যেন আর কিছু ঢুকলো না। তার কানে মিরার বলা কথাগুলো বেজে যাচ্ছে অনবরত। মাথায় কেবল একটা নামই ঘুরছে “মোর্শেদ”। আচ্ছা, মোর্শেদ কি কখনো তাকে ভালোবেসেছিলো?
চলবে—–
Farhana_Yesmin।