#অনুভবী_হিয়া,১৪,১৫,১৬
#মাইশাতুল_মিহির
১৪.
আমার ভিনদেশি তারা
তোমার আকাশ ছুঁয়া বাড়ি,
আমি পাই না ছুঁতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী.!!
এই মুহূর্তে এই গান পুরাই পারফেক্ট। আকাশে মিটমিট করছে তারা। মৃদু মাতাল হাওয়ায় মনোমুগ্ধকর লাগছে পরিবেশটা। পাশাপাশি হাটছে দুজন। নিরবতা বিরাজ করছে তাদের মাঝে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরে শুভ। শুভকে দাঁড়াতে দেখে মিহির প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায়। শুভ মিহিরের কাছে এসে মৃদু স্বরে বলে, ‘মিহি আমাকে আর একটা সুযোগ দেয়া যায় না?’
মিহির শান্ত আর নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। হৃদপিন্ড দ্রুত গতিতে চলছে। শুভ মিহিরের হাত ধরে আবেগভরা চোখে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে, ‘বিশ্বাস করো মিহি আমি ভালো ছিলাম না। তোমাকে ছাড়া আমি একটুও ভালো ছিলাম না। ওই দিন আমি রেগে তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করে ছিলাম। আমি তোমাকে সরি বলতাম কিন্তু তুমি চলে গিয়েছিলে। অনেক খুঁজেছি তোমাকে। দিন রাত এক করে ছয় মাস যেখানে পেরেছি পাগলের মতো খুঁজেছি। মিতুর কাছেও হাত জুর করে বলেছিলাম একবার তোমার খোঁজ দিতে সে দেয়নি। আদিল সামির কিংবা রাহুলকে জিজ্ঞেস করতে পারো। আমার অবস্থা পাগলপ্রায় হয়েছিলো। আমি কানাডা যেতে চাইনি কিন্তু সবাই আমাকে জোড় করে পাঠিয়েছিলো। ওখানে থেকেও রোজ তোমার খবরের জন্য লোক লাগিয়েছিলাম।’
মিহির অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার সামনে থাকা প্রেমিক পুরুষটির দিকে। চোখের কোণায় জল চিকচিক করছে, বুকের বা পাশে চিনচিন ব্যাথ্যা করছে। শুভ এক হাত মিহিরের ডান গালে রেখে আবেগী হয়ে বলে,
‘আমি ভিতরে ভিতরে পুড়ে যাচ্ছি মিহির। এই দহন আমার সয্যের ক্ষমতার বাহিরে। আমি আর পারছি না মিহি। এতো গুলো দিন পরে তোমাকে কাছে পেয়েও কাছে পাচ্ছি না, আগলে নিতে পারছি না। এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কি হবে তুমি বলো? আমার তোমাকে দরকার মিহি। ভীষণ ভাবে দরকার। তোমার উষ্ণতায় আমাকে জায়গা দেবে মিহি? অনেক বেশি ভালোবাসি আমার ঘুমকুমারীকে। ভালোবাসি আমার কৃষ্ণপরীকে।’ ধরা গলায় বলে শুভ। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে তার। কথা যেনো তার গলায় আটকে আছে। শুভ যে কাঁদছে মিহির বুঝতে পারছে। একে-ওপরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারা। খানিকক্ষণ পর মিহির শুভকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায় সে। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে সব। কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না সে। শুভ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিহিরের দিকে। মিহির যে এখনো তাকে ক্ষমা করতে পারেনি সেটা শুভ বুঝতে পারছে। মিহির নিজেকে সামলে বলে, ‘আমার দেড়ি হয়ে যাচ্ছে শুভ। মা চিন্তা করবে!’
বলেই সামনের দিকে চলা শুরু করে মিহির। পিছন থেকে শুভ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিহিরের যাওয়ার দিকে। কষ্ট হচ্ছে তার। মানুষ বলে ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। এটা সম্পূর্ণ ভুল মনে হচ্ছে শুভর। তার এখন গলা ফাটিয়ে হাত পা ছুড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বলতে ইচ্ছে করছে, ‘মিহিকে লাগবে আমার!’
গাড়ি চলছে আপন গতিতে নিদিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। গাড়িতে কেউ টু শব্দও করে নি। শুভ আড়চোখে মিহিরকে দেখেছে। মিহির কাচ নামিয়ে এক দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে আছে। শুভ কথা বলতে চেয়েছিলো কয়েকবার কিন্তু মিহির হু হা ছাড়া কিছু বলেনি। এড্রেস জানতে চাইলে মিহির ছোট করে বলে।
রাত নয় টায় মিহিরদের বাসার গেইটের সামনে এসে থামে গাড়ি। মিহির ইতস্ততবোধ করছে নামবে কিনা ভেবে। শুভ মিহিরের দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যার জন্য আরো অস্বস্থিতে পরে মিহির। আমতা আমতা করে ছোট করে বলে, ‘আব্ আমি আসছি!’ বলে যেই সিটবেল খুলে গাড়ির দরজায় হাত দিবে তখনি শুভ আচমকা মিহির কে টান দিয়ে ডান গালে একহাত রেখে আরেক হাত কোমড় চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয়। ঘটনাক্রমে মিহির স্থব্ধ হয়ে যায়। নিউরনের স্নায়ু কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে বোধহয়। আবেশে মিহিরও শুভর সাথে তাল মিলাচ্ছে। শুভ পরম আবেশে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয় মিহিরকে। এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে জোড়ে জোরে শ্বাস নিচ্ছে দুজন। শুভ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মিহিরের ঠোঁট মুছে দেয়। আবেগী হয়ে শান্ত স্বরে বলে শুভ, ‘তুমি চাও আর না চাও তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে মিহির। তুমি থাকতে বাধ্য!’ বলেই মিহির কে ছেড়ে সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে শুভ। মিহির কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থেকে চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে যায়। শুভকে কিছু না বলে বাসায় চলে যায় সে। শুভ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মিহিরের যাওয়ার দিকে। বাকা হেসে গাড়ি স্টার্ট দেয় শুভ।
_______________
রুমে গিয়ে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায় মিহির। নিজেকে দেখে লজ্জায় মুখে হাত রাখে সে। ইশ কি হলো এটা? শুভ এমন করলো কেনো? অসভ্য লোক একটা! লজ্জায় ব্লাশিং করছিলো মিহিরের গাল।
রাত সাড়ে দশ টার দিকে মাহিন আসে মিহিরের রুমে।
দরজায় হেলান দিয়ে পকেটে হাত গুঁজে গম্ভীর মুখে বলে মাহিন, ‘কোথায় ছিলি এতোক্ষন?’
টেবিলে বসে এসাইনমেন্ট লিখছিলো মিহির। হঠাৎ ভাইয়ের প্রশ্নে ভরকে যায় সে। এইসময় ভাই বাসায় কেনো? ভাইকে কি বলবে এখন? মিথ্যে বলতে হবে তাহলে? মাহিন কে পাল্টা প্রশ্ন করে মিহির, ‘তুমি এইসময় বাসায়? কাজে যাও নি?’
‘আমি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি মিহু। কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবি না।’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শান্ত স্বরে বলে মাহিন। ভাইয়ের শান্ত স্বর বলে দিচ্ছে সে এখন তার উত্তর না পেলে প্রচুর ক্ষেপে যাবে। তাই মিন মিন গলায় বলে মিহির, ‘মিতুদের বাসায় ছিলাম। এসাইনমেন্ট আর কিছু নোট আনার ছিলো।’
‘সত্যি?’
‘হ্যা!’ ছোট করে বলে মিহির। মাহিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিহিরের দিকে। মিহির এতোক্ষন কোথায় ছিলো সব জানে মাহিন। তাও সত্তিটা শুনতে মিহিরের কাছে এসেছিলো এইভেবে যে মিহির সত্যি বলবে। কিন্তু না তার ধারনা ভুল মিহির তাকে মিথ্যে বলেছে।
“তুই ভালো মিথ্যে বলা শিখে গেছিস মিহু। তোর কাছ থেকে সত্তিটা জানতে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু তুই আমাকে মিথ্যে বলেছিস এটা তোর থেকে আশা করিনি।’ বলে কিছুক্ষণ মিহিরের দিকে তাকিয়ে থাকে মাহিন। তারপর চলে যাওয়ার জন্য দরজা কাছে গিয়ে আবার মিহিরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, ‘ভুলে যাস না সারাদিন তুই কি করিস কোথায় থাকিস সব আপডেট আমার কাছে আসে। তাই কিছু করার আগে সাবধানে থাকিস।’ বলেই দরজা চাপিয়ে চলে যায় মাহিন। মিহির অপরাধী ন্যায় তাকিয়ে আছে ভাইয়ের যাওয়ার দিকে। ভাইয়া নিশ্চয় কষ্ট পেয়েছে। কেনো যে মিথ্যে বললাম। ভাইয়া তো সব জানে তাহলে বলে দিলেই পারতাম। কান্না পাচ্ছে মিহিরের। এমন না করলেও পারতো সে। এখন নিশ্চয় ভাই কিছু দিন মিহিরের সাথে কথা বলবে না।
চলবে..!!
#অনুভবী_হিয়া
#মাইশাতুল_মিহির
১৫.
সকালে রাশেদার সাথে টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছিলো মিহির। বার বার ভাইয়ের রুমের দরজার দিকে তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর মাহিন বেরিয়ে আসে রুম থেকে।
‘মা আমি বের হচ্ছি। আর আজকে আমার একটা জরুরি কাজ আছে আসতে লেইট হবে টেনশন করো না।’ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে মাহিন। রাশেদা বেগম ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘ওমা নাস্তা না করে বেরিয়ে যাচ্ছিস মানে? খেয়ে যা দেখ মিহু তোর প্রিয় হালুয়া রান্না করছে। আয় খেয়ে যা।’
‘আমি বাহিরে খেয়ে নেবো। এমনিতেই আমার দেড়ি হয়ে গেছে। আমি আসছি।’ বলেই মোবাইল পকেটে রাখতে রাখতে বেড়িয়ে যায় মাহিন। মিহিরের কান্না পাচ্ছে খুব। অন্য সময় হলে মাহিন বসে চেটেপুটে তার রান্না করা খাবার খেতো। আজকে তার দিকে একবারো তাকালো না। চোখে পানি মানছে না। দ্রুত রুমে চলে যায় মিহির। দুই ভাই বোনের মাঝে যে মনোমালিন্য চলছে রাশেদা বেগম ভালোই বুঝতে পেরেছে। যদিও কেউ কারোর সাথে বেশিক্ষন রেগে থাকতে পারে না। ভাই বোনের ব্যাপার তারাই ঠিক করে ফেলবে।
মিহিরও না খেয়ে বেরিয়ে গেছে। তার জন্য তার ভাই না খেয়ে বের হলো আর সে কিভাবে খাবে? অফিসে গিয়ে চুপচাপ মন মরা করে বসে আছে মিহির। ভালো লাগছে না কিছু। মাহিনের নাম্বারে কল দিয়েছে কিন্তু রিসিভ করছে না। রাগ হচ্ছে শুভর উপর। ইচ্ছে করছে শুভর মাথা ফা:টিয়ে দিতে। শুভর যদি এমন না করতো তাহলে তার ভাই তার সাথে রেগে থাকতো না। উগান্ডার হাতি একটা!!
শুভ অফিসে আসে দেড়িতে। শুভকে আসতে দেখে মিহির শুভর কেবিনে যায় প্রজেক্টের ফাইল নিয়ে।
কেবিনে নক না করে ঢুকে পরে মিহির। শুভ চেয়ারে বসেছিলো তখন। মিহির কে ঢুকতে দেখে শুভ মুচকি হেসে বলে, ‘কেমন আছো মিহি?’
‘ভালো অনেক ভালো। এতোটাই ভালো যে নাচতে নাচতে ট্রেনের নিচে ঝা:প দিতে ইচ্ছে করছে।’ ঝাঁঝালো গলায় বলে মিহির। মিহিরের এমন আচরনে বোকা বনে যায় শুভ। বোকা বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘মানে?’
‘মানে? মানে জিজ্ঞেস করছেন? সব আপনার দুষ। আপনি ইচ্ছে করে আমাকে ওইখানে নিয়ে গেছেন। আপনার মতো নাম্বার ওয়ান শয়তান লোক দুনিয়াতে আর একটাও নাই। ইচ্ছে করছে পচা পানিতে চু:বিয়ে মা:রতে আপনাকে।’ রাগে ফোশ করতে করতে বলে মিহির। শুভ কিছুই বুঝতে পারছে না বেচারা। মিহিরের হাতে থাকা ফাইল টা শুভর সামনে জোরে শব্দ করে রেখে দাঁত চেপে বলে, ‘এই নিন আপনার অসভ্য ফাইল।’
‘কি হয়েছে তোমার বলবে? রেগে আছো কেনো?’
‘রেগে থাকবো কেনো? আপনার জন্য আজ..’
মিহির কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার মোবাইলে ম্যাসেজ আসে।
‘আমি নিচে ওয়েট করছি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আয়!’
ম্যাসেজ টা মাহিন পাঠিয়েছে। মিহির থাইগ্লাসের দিকে এগিয়ে গিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখে মাহিন বাইকে বসে আছে। মিহির শুভকে কিছু না দ্রুতগতিতে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। হঠাৎ মিহিরের কি হয়েছে বুঝতে পারছে না শুভ। সেও থাইগ্লাসের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে কালো ড্রেসআপে মাথায় হেমলেট দিয়ে বসে আছে একছেলে। তখনি মিহির অফিস থেকে বেরিয়ে বাইকের কাছে যায়।
মিহিরকে আসতে দেখে মাহিন কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে দেখে তাকে। মিহির হাটুতে দুই হাত ভর দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মাহিন বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘তোকে দৌড়ে আসতে কে বলেছে? সব জায়গায় পাকনামি করিস কেনো?’
‘তুমি ডেকেছো আমি তাড়াতাড়ি আসবো না তা কখনো হয়?’ হাসি ভরা মুখে বলে মিহির। মাহিন হেমলেটের ভিতরে মুচকি হাসে। তারপর নিজ হাতে মিহির কে সযত্নে হেমলেট পরিয়ে দেয়।
‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
‘না খেয়ে বেরিয়েছিস কেনো? তোকে বারন করেছিলাম না আমি? বাইকে উঠ।’ বাইকে বসতে বসতে বলে মাহিন। মিহির ভাইয়ের কাধে হাত দিয়ে বাইকে উঠে বসে। মাহিন বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায় রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে।
কেবিনে দাঁড়িয়ে এতোক্ষন সব দেখছিলো শুভ। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে সে। টেবিলের উপর থাকা ফ্লাওয়ার বেস ভেঙে ফেলে।
_______________
রেস্টুরেন্ট থেকে মিহিরকে লাইব্রেরী তে নামিয়ে মাহিন চলে যায় ল্যাবে।
এই সুযোগ টা সাধারনত মিহির কে একা দিয়েছে আয়াজ রায়হান! যখন খুশি অফিসে যাবে যখন খুশি বেরিয়ে আসতে পারবে মিহির। অফিসে জয়েনের আগে মিহির তার ভার্সিটির কথা বলেছিলো আয়াজ কে।তাই আয়াজ তাকে এই সুযোগ দেয়। আর দিবে না কেনো আয়াজ রায়হানের ছেলের হবুবউ বলে। এনিয়ে অফিসে অনেক কানাঘুষা হয়েছিলো এখন অবশ্য কেউ কিছু বলে না।
আপাতত লাইব্রেরী তে বসে বই ঘাটছে মিহির। মিতুর আসার অপেক্ষা করছে সে। মিহিরের সামনের টেবিলে মনমরা করে বসে আছে সুহা। তার হালুকের জন্য বসে আছে সে। কল দিতে গিয়ে কি ভেবে আর দেয়নি। হঠাৎ নজরে পরে সামনের বেঞ্চে বসে থাকা মিহিরের উপর। বড়বড় চোখ করে তাকায় সুহা। দ্রুত উঠে মিহিরের পাশে এসে বসে সে। তারপর উল্লাসিত কন্ঠে বলে, ‘হাই আপু আমি সুহা!’ বলে হাত বারিয়ে দেয়। মিহির মুচকি হাসি দিয়ে হাত মিলিয়ে বলে, ‘আমি মিহির!’
সুহা আনন্দে উত্তেজিত হয়ে ফট করে বলে ফেলে, ‘জানি! তোমাকে এখানে দেখতে পারবো ভাবতেই পারি নি। তুমি কি এখানে প্রতিদিন আসো?’
সুহার কথা কেমন অবাক হয় মিহির। তারপর বলে, ‘জানো মানে? আমাকে আগে কোথাও দেখেছিলে তুমি?’
সুহা বুঝতে পারে উত্তেজিত হয়ে কি বলে ফেলেছিলো। তারপরেও নিজেকে সামলে বলে, ‘আরে আপু ওই দিন তোমাকে রিকশায় উঠতে দেখেছিলাম আরকি তাই বললাম।’
‘ওহ আচ্ছা। আমি মাঝে মাঝে আসি এখানে। ভালো না লাগলে এখানেই টাইম স্পেন্ড করি।’ স্বাভাবিক ভাবে বলে মিহির। সুহা বলে, ‘আমিও মাঝে মাঝে আসতাম। তুমি যেদিন আসবে ওই দিন আমাকে জানিয়ে দিবে আমি এসে তোমার সাথে গল্প করবো ওকে?’
সুহা অনেক মিশুক আর কিউট একটা মেয়ে। কিন্তু সুহা কে কেমন চেনা চেনা লাগছে মিহিরের। কোথায় দেখেছে তাকে? উফ!
সুহা আর মিহিরের গল্পের মাঝে মিতু আসে। সুহা মিতুকে দেখে খানিকটা বিরক্তিবোধ করে সুহা। মিতুর কাছে শুভ কত বার গিয়েছে মিহিরের খোঁজ নিতে কিন্তু মিতু দেয়নি। তাই সুহা বিরক্ত মিতুর উপর। তাছাড়া তার আর তার ভাবির মাঝে কাবাব কা হাড্ডি। মিতু এসে সুহার সাথে পরিচিত হয়। তার পর তিজ জন মিলে বেশ জমিয়ে আড্ডা দেয়।
________________
রাতের আকাশ, হাজার টা তারার মেলা। আকাশের তারাগুলোর মতো সমান ভাবে মনে অভিমান পুষে রেখেছে সুহা। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আনমনে আকাশের কাছে অভিযোগ করছে সে। আজ সারাদিনে একবারও কল দেয় নি মাহিন। সুহা কল দিয়েছিলো কিন্তু নাম্বার বন্ধ। লাইব্রেরী তে অনেকক্ষন বসেছিলো মাহিনের জন্য কিন্তু মাহিন আসে নি। কালকে তো কতকিছু বললো কিন্তু আজকে। মাহিন তো আমাকে একবারো ভালোবাসি বলে নি। মাহিন তাহলে ভালোবাসে না। কাল সব মিথ্যে বলেছে। কান্না পাচ্ছে তার। চুপচাপ রুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে ঘুমিয়ে পরে সে।
চলবে..!!
#অনুভবী_হিয়া
#মাইশাতুল_মিহির
১৬.
রাত তিনটার দিকে মাহিন বাড়ি ফিরে। দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে মিহিরকে কল দেয় সে। কল দেওয়ার দুইবার রিং হওয়ার পরেই রিসিভ করে মিহির। গায়ে ওড়না দিয়ে চুপিচুপি দরজা খুলে দেয় সে। মাহিনকে দেখে কিছুক্ষণ স্থব্ধ যায়। মাহিন আস্তে আস্তে হেঁটে রুমে চলে যায়। মিহির দরজা লাগিয়ে ভাইয়ের রুমের দিকে এগিয়ে যায়।
রুমে এসে দেখে মাহিন গা থেকে জ্যাকেট খুলে পাশে রাখে। জ্যাকেটের ভিতরে থাকা সাদা রঙের হাফ হাতা টি-শার্ট র:ক্তে ভিজে আছে। টি-শার্ট খুলতে গিয়ে ব্যাথ্যায় মৃদু আওয়াজ করে মাহিন। ভাইয়ের পিঠ দেখে মিহিরের চোখ ছলছল করছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না করছে নিশব্দে। মাহিন পিছে ফিরে মিহিরকে দেখে নিরব হয়ে থাকে। তারপর এগিয়ে এসে দরজা লাগিয়ে বোনকে বিছানায় বসায়। বোনের মাথা নিজের বুকে রেখে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাহিন। শান্ত স্বরে বলে, ‘কান্না করিস না প্লিজ। তোর চোখের পানি আমার সয্য হয় না।’
মিহির এবার ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করে। মাহিন একটা ধীর্ঘ শ্বাস ফেলে। মেয়েটা এতো কান্না করতে পারে। আগে জানলে মিহুকে কিছুতেই জানাতো না মাহিন।
মিহির কান্না থামিয়ে উঠে গিয়ে ফাস্ট এন্ড এইড বক্স নিয়ে আসে। তুলো আর সেভলন দিয়ে ডেসিং করে দেয় কাটা স্থান, ছিলে যাওয়া জায়গায়। ব্যান্টেজ লাগিয়ে বলে, ‘এগুলো কিসের কাটা ভাইয়া?’
‘ছু:ড়ি!’
আতংকে উঠে মিহির। শরিলের পশম দাঁড়িয়ে পরে। মিহিরের অবস্থা বুঝতে পেরে মাহিন হেসে ফেলে, ‘আরে পিনিক হোস না। যেই ব্লাস্টার আঘাত করেছে না তাকে উপরে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
‘মানে তুমি মা:র্ডার করেছো?’ বিস্ফোরিত হয়ে বলে মিহির। মাহিন জুড়ে হেসে ফেলে। তার পর বলে, ‘আরে এসব করতে এমন একটা দুইটাকে উপরে টপকাতে হয়। টেনশন নট মাই লিটল সিস্টার!’
‘ক্যাস টা কি সলভ হয়েছে?’ আগ্রহ নিয়ে বলে মিহির। মাহিন বিছানায় গা এলিয়ে বলে, ‘হ্যা! ওরা যে এতো গাধা জানা ছিলো না। আমার ফেলা ফাঁদে পা দিয়ে সব কটা টপকে গেছে। তবে ক্যাসটার ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার ছিলো বুঝলি!’
‘কি ব্যাপার?’
‘অ্যান্টিমনি, রাইসিন! নাম শুনেছিস?’
‘রাইসিনের নাম শুনেছি এটা বিষাক্ত পদার্থ। কিন্তু কেনো?’
‘ব্রাহ্মাণবাড়িয়া তে সাধারন দুইজন লোক খুন হয়েছিলো। তাদের দেহে এই দুই বিষাক্ত পদার্থ পাওয়া গেছে।’
বিস্মিত হয়ে বলে মিহির, ‘কারা খু:ন করেছে ভাই?’
‘এই দুইজন কালো জগতের সাথে জড়িত ছিলো। তাদেরই দলের লোক তাদের মার্ডার করে। ইনভেস্টিগেশন করে জানা যায় আরকি। ওদের দলের লিডার দেশে এসে অনেক বড় বোকামি করেছে মিহু।’
‘তাদের ধরতে গিয়েই বুঝি এই অবস্থা তোমার?’
হেসে ফেলে মাহিন। তারপর বলে, ‘এতো দিনের সাজানো ফাঁদে পা দিয়েছে ব্যাটা। ভালো মতেই ফেঁসেছে। ভেবেছিলাম হয়তো ২৭/২৮ বছরের কেউ হবে। কিন্তু না ভুরিওয়ালা ব্যাটা।’
মিহিরওও সাথে হেসে ফেলে। মাহিন বিছানায় গা এলিয়ে বলে, ‘এখন যা, আমি ঘুমাবো।’
‘এই না! খেয়েছো তুমি? মাত্রই তো আসলা আমি খাবার গরম করে রেখেছিলাম তুমি আসছো জানানোর পর। একটু ওয়েট করে আমি খায়িয়ে দিবো তোমাকে।’ বলে বের হয়ে যায় মিহির। মুচকি হাসে মাহিন। কাজ নিয়ে যখন সে প্রচুর প্রেশারে থাকে তখন মিহির প্রায়ই খায়িয়ে দেয় তাকে।
_____________
এমআর হাসান উরফে আয়াত হাসান মাহিন। সিক্রেট এজেন্ট অফ বাংলাদেশ। ডিপার্টমেন্টের সবাই তাকে এমআর হাসান নামে চিনে। মাহিন এই পেশায় প্রায় ৪ বছর যাবত জড়িত। কাকতালীয় ভাবে সিক্রেট এজেন্টের হেড উজ্জ্বল আহসানের সাথে তার পরিচয় হয় কুমিল্লাতে। বেশ কয়েকটি ক্যাস সলভ করতে মাহিন তাকে সাহায্য করে। মাহিনের সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কাজের প্রতি মনোবল সব মিলিয়ে উজ্জ্বল আহসান তার প্রতি মুগ্ধ ছিলো। তাই তাকে ডিপার্টমেন্টের সদস্যের লিডার হিসেবে যুক্ত করে। বয়সে সবার ছোট কিন্তু বুদ্ধিতে সবার উপরে। সবাই তাকে যতেষ্ট সম্মান আর স্নেহ করে। মাহিনের এই পেশা সম্পর্কে একমাত্র মিহির, সবুজ, আর মাহিনের বেষ্ট ফ্রেন্ড ফুফাতো ভাই শান্ত আরাফ ছাড়া কেউ জানে না। ক্যাসের Investigation করতে সব সময় শান্ত তার পাশে থাকে। শান্তও মাহিনের মতো সিক্রেট এজেন্ট বটে। শান্তকে সবাই এসআর আরাফ নামে চিনে।
_____________
আজ মিহির অফিসে যায় নি। অসুস্থ ভাইকে রেখে অফিসে যাওয়া ইম্পসিবল। তাছাড়া মা জানে না মাহিনের কথা। জানলে কেলেঙ্কারি বানিয়ে ফেলতো, ভাইরে দফারফা করে ফেলতো ভেবে হেসে ফেলে মিহির।
দুপুর ১ টায় উঠে মাহিন। ঘুমের মেডিসিন খেয়েছিলো সে। এখনো শরিল ব্যাথ্যা করছে প্রচুর। সে সবে তোয়াক্কা না করে ওয়াশরুমে গিয়ে লম্বা শাওয়াল নেয় সে। তার পর ফুল হাতা শার্ট পরে বেরিয়ে আসে। ভাইকে দেখে মিহির সোফা থেকে উঠে বলে, ‘কখন উঠলে? আমাকে ডাকতে আমি গোসল করায় হেল্প করতাম।’
মাহিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই কড়া গলায় বলে উঠে রাশেদা, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ নবাবের পুত্রকে এবার কোলে বসিয়ে গোসল করিয়ে দেই কেমন? নবাব যখন খুশি বেরিয়ে যাবে, আসবে কখন, যাবে কখন, খাবে কি কিছুই জানানোর প্রয়োজনবোধ করে না।’ বলতে বলতে টেবিলে খাবার রাখে মাহিনের জন্য।
মাহিন বিরক্ত হয়ে চেয়ারে বসে। মিহির এসে খায়িয়ে দিতে লাগে মাহিনকে। পরম যত্নে ভাইকে খায়িয়ে দেয় মিহির। খাবার শেষে মাহিন রুমে চলে যায়।
__________
অফিসে গিয়ে মিহিরের খোঁজ নেয় শুভ। মিহির অফিসে আসেনি দেখে রাগ লাগে তার। একে তো কালকের ঘটনা আর আজকে অফিসে আসে নি। রাগে চোয়াল শক্ত করে বসে থাকে সে। মেয়েটা তাকে একদিন পাগল করেই দিবে। সাত পাঁচ না ভেবে মিহিরকে কল দেয়। মোবাইল সাইলেন্ট থাকায় কল রিসিভ করে নি মিহির।
বাহ্! এখন আমার কল রিসিভ করছে না। নিশ্চয় আবার ওই ছেলে টার সাথে বাইকে করে ঘুরতে গেছে। এই ছেলে কে কাছে পেলে জ্যা:ন্ত পুঁ:তে ফেলবো। আচ্ছা মিহির কি কোনো রিলেশনে আছে? তাহলে সবুজ? এই ছেলেটা আবার কে? ওয়েট মিহিরের কয়টা বয়ফ্রেন্ড? ধ্যাত কি ভাবছি আমি। মিহির কোনো রিলেশনশিপে নেই সিউর। উফ আমি পাগল হয়ে যাবো!! ?
_______________
সন্ধ্যায় মাহিন সুহার নাম্বারে কল দেয়। কয়েকবার রিং হওয়ার পর রিসিভ করে সুহা। চুপচাপ মোবাইল কানে দিয়ে ডিভানের উপর বসে আছে সে। কেউ কোনো কথা বলছে না। নিরবতা ভেঙে মাহিন শান্ত স্বরে বলে, ‘সুহা? শুনতে পাচ্ছো?’
সুহা উত্তর না দিয়ে চুপ করে আছে। মনে মনে ভেবে রেখেছে কথা বলবে না সে মাহিনের সাথে। মাহিন সুহার অভিমানের কারণ বুঝতে পেরে বলে, ‘সুহারানী কি তবে রেগে আছে আমার উপর?’
সুহার চোখে পানি চিকচিক করছে। কান্না ধরে রাখতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে। সুহার কান্নার আওয়াজ মাহিনের বুকের বা-পাশে গিয়ে তীরের ন্যায় ফুটে।
‘আপনি অনেক খারাপ। দুই দিন দেখাতো দূরের কথা একটা কলও দেন নি। বুঝতে পেরেছি আপনি আমাকে ভালোবাসেন না একটুও না। ওই দিন রাতে মিথ্যে বলেছেন। আপনি অনেক খারাপ লোক। আপনার সাথে কথা বলবো না আমি। আড়ি আপনার সাথে।’ কান্না মিশ্রীত কন্ঠে বলে সুহা।
ধীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রেয়সীর কান্না মাখা গলায় অভিযোগ শুনে মাহিন। এতো ভালোবাসে মেয়েটা দুই দিন কল না দেওয়ায় কেঁদে দুনিয়া ভাসিয়ে দিচ্ছে। মৃদু হাসে মাহিন।
‘ভালোবাসো আমায়?’ শান্ত স্বরে বলে মাহিন। সুহা কান্না ততোক্ষণে কমে যায়। ভাঙা গলায় বলে, ‘নাহ!’
‘সত্যি তো?’
‘আপনি অনেক খারাপ। কথা নেই আপনার সাথে।’ কাঁদুকাঁদু ভয়েজে বলে সুহা। মাহিন ফিক করে হেসে ফেলে। মাহিনের হাসির আওয়াজ শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে সুহা। চেঁচিয়ে বলে, ‘এই এই সাদা ভাল্লুক হাল্লুক হাসছেন কেনো? আমি হাসির কিছু বলেছি?’
‘নাহ!’ স্বাভাবিক ভাবে বলে মাহিন। সুহা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘তাহলে হাসলেন কেনো?’
‘তোমার কাঁদুরে ভয়েজটা অনেক কিউট সুহারানী। কাছে থাকলে আদর করে দিতাম। ছুঁয়ে দিতাম তোমার ওই কান্নামিশ্রীত আদুরে মুখটি।’ নেশাক্ত গলায় বলে মাহিন। এক নিমিষেয় সুহার সকল প্রকার অভিমান গায়েব হয়ে যায়। লজ্জার আভা গালে ভেসে উঠে।
চলবে..!!