অনুভবী_হিয়া,২২,২৩,২৪

0
650

#অনুভবী_হিয়া,২২,২৩,২৪
#মাইশাতুল_মিহির

২২.

শুভ মিতুর বাসার এড্রেস নিয়ে মিতুর বাসায় যায়।মিতুকে অনেক অনুরোধ করে মিহির কোথায় থাকে জানতে কিন্তু মিতু বলে নি। কারন মাহিন কড়া নিষেধাজ্ঞা করেছে। শুভ বেশ কয়েকদিন মিতুর বাসায় গিয়েছে কিন্তু বরাবর ফলাফল শূন্য। মিহিরের খুঁজে পাগলপ্রায় হয়ে গেছে শুভ। রুম থেকে বের হয় না। রুমে বসে বসে ইচ্ছে মতো ভাংচুর করে, মিহি বলে জোরে জোরে ডেকে বাচ্চাদের মতো কাঁদে। চোখমুখ ফেকাসে হয়ে গেছে। যার কাছে যেমন শুনেছে খুঁজেছে। পুরো ঢাকা পাগল পাগল করে খুঁজেছে শুভ। অবশ্য আদিল রাহুল সামির সাহায্য করেছে। মিহির এক বার বলেছিলো চট্টগ্রাম তার ভালো লাগে, ব্যাস শুভ চট্টগ্রামেও খুঁজেছে মিহিরকে।

মিহির চলে যাবার ছয় মাস পরেও শুভ স্বাভাবিক হয় নি। মিহিরকে যেভাবে পারছে সেভাবেই খুঁজেছে সে। শুভর বাবা মা বন্ধুরা শুভর এমন অস্বাভাবিক আচরন সয্য করতে পারছে না। তারা সবাই শুভকে নিয়ে প্রচুর চিন্তায় পরে যায়। অবশেষে শুভকে কানাডা তাদের ব্যবসা সামলানোর জন্য পাঠাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু শুভ কিছুতেই যেতে রাজি না। আদিল সামির রাহুল শুভকে বুঝায় তারা লোক লাগিয়ে মিহিরকে খুঁজবে। একসময় বাধ্য হয়ে কানাডা যেতে রাজি হয় শুভ।

মিহির চলে যাবার ছয় মাস পর কানাডা যায় শুভ। শুভ যেতে চাইনি বহুত কাঠখড় পুড়িয়ে রাজি করানো হয়েছে। কানাডা শুভকে একা ছাড়া ঠিক হবে না ভেবে আদিলও তার সাথে কানাডা যায়। কানাডা গিয়েও শুভ মিহিরের খুঁজার চেষ্টা করে। আদিল সেখানে প্রায় সাত মাস থেকে দেশে ব্যাক করেছে কিন্তু শুভ তখন বাবার ব্যবসায় মন বসিয়েছে তাই সে আসে নি।

সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকলেও রাতের অন্ধকারে মিহিরের ছবি দেখে কাটায় শুভ। চোখ ভিজে আসে তার। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,

‘কাটিয়ে দিয়েছি নির্ঘুম রাত,
পুরেছে দেহ, ক্ষতবিক্ষত হয়েছে হৃদয়,
তবু মিলেনি ভালোবাসার প্রণয়,
আশা ছাড়ে নি এই তৃষ্ণার্ত মন!’
~মাইশাতুল মিহির!

মিহির বাবা চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা যাওয়ার পথে বাসের সাথে ট্রাকের সংঘর্ষে সেখানেই স্পট ডেট হয় তার। রাহিম হাসান মা:রা যাওয়ায় রাশেদা বেগম আর মিহির অনেক ভেঙে যায়। তাদের দুজনকে একা হাতে সামলায় মাহিন। মা বোনকে স্বাভাবিক রাখার জন্য মাহিন তাদের কুমিল্লা রেখে দেয়। পরিবারের মামা মামি কাজিনদের সাথে থেকে মিহির শুভকে প্রায় ভুলেই গেছে। শুভ নামক ব্যক্তি তার জীবন থেকে মুছে দিয়েছে সে। যদিও মাঝে মাঝে মনে পরে কষ্ট হয় তবুও নিজেকে সামলে নেয় মিহির।

অপরদিকে শুভ কানাডা চলে যাওয়ার খবর পেয়ে মাহিন কিছুটা শান্ত হয়। কারন মাহিন শুভকে আর মিহিরের জীবনে আসতে দিতে চাই না তাই শুভর খোঁজ সে এখান থেকেও রেখেছে। মিহিরের সাথে যোগাযোগ রাখার, তার খোঁজ নেওয়ার সম্পূর্ণ পথ মাহিন বিচ্ছিন্ন করেছিলো। তাই শুভ খোঁজ পাইনি মিহিরের।

মিতুর কাছ থেকে যখন জানতে পেরেছে শুভ মিহিরকে ভরা রেস্টুরেন্টে অপমান করেছে তখন তার ক্ষোভ, তীব্র রাগ জন্মায় শুভর উপর। রাগের বশেই সে দিন শুভকে মে:রেছিলো সে। আর মিহিরের আশে পাশে শুভকে কখনোই এলাউ করবে না মাহিন। কখনোই না!

শুভ কানাডা চলে যাবার দুই মাস পর মা বোনকে নিয়ে তাদের নতুন বাড়িতে উঠে মাহিন। তাদের বাড়িটি পাঁচ তলা, তারা উঠেছে চার তলায়। মাহিন এখন থেকে ঢাকা মা আর মিহিরের সাথে থাকবে বলেই ঠিক করছে।

একদিন রাস্তায় শুভর বাবা আয়াজ রায়হানের গাড়ি খারাপ হয়ে যায়। আয়াজ গাড়ি থেকে নেমে বাহিরে দাঁড়ায়। কড়া রোদ উঠেছিলো ওই দিন। প্রচন্ড গরমে আর রোদে আয়াজ রায়হানের মাথা ঘুরে পরে যেতে নেয়। তখন মিহির ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরছিলো। রাস্তায় আয়াজ রায়হান কে পরে যেতে দেখে দৌড়ে ওনাকে ধরে মাথায় পানি ঢেলে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মিহির তখনো আয়াজ রায়হান যে শুভর বাবা সে ব্যাপারে অবগত ছিলো না।

আয়াজ রায়হান মিহিরকে শুভর মোবাইলে দেখেছিলো বিধায় চিনতে পারে। তাই হাসপাতালে আসার সময় আয়াজ রায়হান ইচ্ছে করে মিহিরকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় অসুস্থতার বাহানা দিয়ে। আয়াজ রায়হান কে বাড়িতে পৌছে মিথিলা চৌধুরী আর সুহার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে মিহির। আয়াজ রায়হান তখন মিহিরকে এই চাকরীর কথা বলে। মিহির পড়াশোনা আছে বলে মানা করে দিলে আয়াজ রায়হান বলেছিলো,

‘তোমার পড়াশোনা তুমি করো। অফিসে শুধু তুমি আমাকে সাহায্য করবে। যখন ইচ্ছে অফিসে যাবে আসবে। এই নিয়ম টা শুধু তোমার জন্য বরাধ্য করবো। না করো না মা। সোমবার থেকে তুমি অফিস জয়েন করবে আমি তোমার অপেক্ষা করবো।’

একটা কার্ড দেয় মিহিরকে। মিহির সবার থেকে বিধায় নিয়ে চলে যায়। অনেক ভেবে চিন্তে রাজি হয় চাকরী করার। ব্যাস এভাবেই কাহিনী শুরু।



হঠাৎ ইটের সাথে খোঁচট খেয়ে ভাবনা থেকে বের হয় মিহির। মোবাইলে তাকিয়ে দেখে সকাল ৭:৩৫ বাজে। হায় এতোক্ষন বাহিরে ছিলো সে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। ভাগ্যিস টাকা এনেছিলো সাথে নাহলে ফের হেটে বাড়ি ফিরতে হতো। হাত বারিয়ে রিকশা থামিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে উঠে পরে মিহির।
__________________

ফাঁকা রাস্তায় পাশাপাশি হাটছে মাহিন সুহা। মাহিনের ডান হাতের বাহু ধরে নিচে ঝুকে মাহিনের পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিজের পা ফেলছে আর খিলখিল করে হাসছে। জুটি করা চুল সুহার তালে তাল মিলিয়ে নাচছে। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে তার প্রেমিক পুরুষকে দেখে। এতো সুদর্ষন পুরুষটিকে সে ভালোবাসে ভেবেই মুচকি হাসে সে। মাহিনের দৃষ্টি তার প্রেয়সী সুহারানীর দিকে। সুহা যে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে সেটা মাহিন বুঝতে পেরে মনে মনে হাসে শুধু। হঠাৎ সুহা দাঁড়িয়ে নিরবতা ভেঙে বলে, ‘আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?’

মাহিন ভ্রুঁ কুঁচকে সুহার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’ সুহা ঠোঁট ওল্টে বলে, ‘একবারও ভালোবাসি বললেন না! তার মানে ভালোবাসেন না আমাকে।’

সুহার কথায় হেসে ফেলে মাহিন। মুখে মৃদু হাসি রেখে বলে, ‘ ভালোবাসলেই কি তা মুখে বলতে হবে? অন্য প্রেমিকের মতো হাজার বার ভালোবাসি বলতে পারবো না আমি। ভালোবাসা মানে অনুভূতি সুহারানী! এই অনুভূতি দেখা যায় না খুঁজে নিতে হয়। আমার ভালোবাসাও তুমি খুঁজে নাও। অনুভব করে নাও মাহিনের শহরে তার সুহারানী জন্য ঠিক কি পরিমাণ ভালোবাসার জাল বেধে আছে।’

সুহা অপলক তাকিয়ে থাকে মাহিনের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর উল্লাসিত কন্ঠে বলে, ‘এতো কিছু বুঝি না। আপনি শুধু আমার থাকলেই চলবে।’ সুহার বাচ্চামিতে ফিক করে হেসে ফেলে মাহিন। তারপর সুহার গাল টেনে বলে, ‘এই মাহিন শুধু তার সুহারানীর জন্যই বরাধ্য!’

মাহিনের সাথে সুহাও মিষ্টি হাসে। সুহা বলে, ‘হ্যা আপনি শুধু আমার। কোনো মেয়ে আপনার দিকে তাকালে তার চোখ তুলে ফেলবো। আর আপনি তাকালে আপনার চোখ তুলে আমার কাছে রেখে দেবো হুহ!’ ভাব নিয়ে বলে সুহা। উচ্চস্বরে হেসে ফেলে মাহিন। হাসলে তার বাম গালের ঠোঁটের পাশে একটা ছোট্ট ভাজ পরে। হাসি থামিয়ে শীতল চোখে শান্ত কন্ঠে বলে মাহিন, ‘

‘প্রেয়সী,
নীরবে নিভৃতে তোমায় ভালোবাসি,
অনুভূতি গুলো অবক্ত্য রয়ে যাবে প্রেয়সী,
তোমার খুব নিকটেই অদৃশ্য হয়ে রবো,
তোমায়, হ্যা শুধু তোমায় ভালোবেসে যাবো!
~ অর্নীল!

চলবে..!!

#অনুভবী_হিয়া
#মাইশাতুল_মিহির

২৩.

ভার্সিটিতে বসে নোট লিখছে মিহির। পাশে মিতু বসে আছে। হঠাৎ মিতু বলে, ‘জানিস আয়নার সাথে কথা হয়েছে আমার।’ মিহির চোখ তুলে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কেমন আছে? কি কথা হয়েছে?’ মিতু এক্সাইটেড হয়ে বলে, ‘আয়নার বিয়ে ঠিক হয়েছে। নেক্সট মান্থে ৬ তারিখ। যাবি?’

‘আরে না কিভাবে পসিবল? আয়না বরিশাল থাকে ওখানে যাওয়া এখন সম্ভব না। তাছাড়া ভাইয়া বলেছে সামনের মাসে কুমিল্লা যাবে। আমিও ভাবছি ভাইয়ার সাথে যাবো।’ চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে মিহির। মিতু মিহিরের এক হাত ধরে বলে, ‘কত দিন থাকবি?’ মিহির কিছু একটা ভেবে বলে, ‘থাকা হবে বেশি দিন মনে হয়!’

‘শুভর কথা ভাইয়াকে বলেছিস?’ ছোট করে বলে মিতু। মিহির হাই তুলে বলে, ‘আমাকে বলতে হয়নি ভাইয়া নিজেই জানে।’ মিহিরের কথায় হা করে তাকিয়ে থাকে মিতু। এমন সময় মিহিরের নাম্বারে শুভ কল দেয়। মিহির কল ধরতে চাইনি মিতুর কথা কল রিসিভ করে।

‘আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি তাড়াতাড়ি আসো!’ কল রিসিভ করার পর কথা বলেই কেটে দেয় শুভ। মিহিরের রাগ ৩৬০ ডিগ্রি বেঁড়ে যায়। শুভকে কয়েকটা কড়া কথা শুনাবে ভেবে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসে মিহির। রাস্তার অপর পাশে শুভকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে যায় সে। শুভর সামনে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলে মিহির, ‘সমস্যা কি আপনার? বলেছি না আমি আপনার কাছে ফিরে যাবো না তাও কেনো আমাকে বিরক্ত করছেন?’

শুভ আশেপাশে তাকিয়ে বলে, ‘আস্তে কথা বলো আমাকে কি গণধোলাই খাওয়াতে চাইছো নাকি?’ মিহির বিরক্ত হয়ে বলে, ‘কি জন্য এসেছেন সেটা বলে যান এখান থেকে!’

শুভ চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে অবাক স্বরে বলে, ‘এটা তোমার একার ভার্সিটি নাকি যে আর কেউ আসতে পারবে না। আমি আমার কাজে এসেছি। আর রাস্তায় এভাবে জান ডেকো না আশেপাশের মানুষ কি ভাববে বলো তো? দুষ্টু মেয়ে!’ শেষের কথাটা বলে চোখ টিপ দেয় শুভ। মিহির হা হয়ে তাকিয়ে থেকে বলে, ‘আমি কখন আপনাকে জান বললাম?’

‘যা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে? ফিকার নট, আমি মনে রেখেছি। তোমার হবুবরের সৃতিশক্তি আবার অনেক ভালো!’ বলে ভাব নিয়ে শার্টের কলার ঠিক করে শুভ।

মিহির তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে, ‘ফালতু পাবলিক তো আপনি। আপনাকে জেলের ভাত খাওয়ানো উচিত।’

দূর থেকে কেউ একজন মিহির আর শুভর দিকে চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে। মিহিরের দিকে এগিয়ে এসে শক্ত গলায় বলে, ‘মিহু!’

পিছনে ফিরে তাকায় শুভ মিহির। শান্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিহির শুকনো ঢুক গিলে। ভাবতে পারেনি এক্স এর সাথে বড় ভাইয়ের সামনে পরতে হবে। মাহিনের থেকে শান্তকে একটু ভয় পায় মিহির কারন শান্তর রাগ সবসময় আকাশের উপর থাকে যেকোনো মুহূর্তে নিচে টপকে পরে যাবে।

শান্ত ঢাকা এসেছিলো ১০ টায়, বাসায় মাহিনকে পায়নি বলে মাহিনের উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছিলো সে। রাস্তায় মিহিরকে দেখে গাড়ি থামিয়ে মিহিরের কাছে আসে। শান্ত শুভর দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে কড়া গলায় বলে, ‘ক্লাস না করে এখানে কি করিস?’ মিহির আমতা আমতা করে বলে, ‘আসলে আমি…’

‘বাসায় যাবি চল!’ বলেই একপলক কড়া চোখে শুভর দিকে তাকিয়ে মিহিরের হাত ধরে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায় শান্ত। মিহির ভয়ে জান যায় যায় অবস্থা। কারন শান্ত মাহিন দুজনেরই শুভর উপর রেগে আছে প্রচুর। তার উপর আজকে শুভর সাথে দেখেছে শান্ত। মিহির মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে। কেনো যে প্রেম করতে গেলো। এমন লজ্জায় পরতে হবে জানলে জিবনেও প্রেম করতাম না।

গাড়ি ড্রাইভ করছে শান্ত। মিহির চুপচাপ বসে আছে।কিভাবে কি বলবে বুঝতে পারছে। নিরবতা ভেঙে শান্ত বলে, ‘শুভর সাথে তোর কথা হয়?’

ছোট করে উত্তর দেয় মিহির, ‘নাহ!’

‘রিজাইন দিচ্ছিস না কেনো?’ চট করে চোখ তুলে শান্তর দিকে তাকায় মিহির। দুজনেই তাহলে জানে শুভ তার অফিসের বস। মাথা নিচু করে উত্তর দেয় সে, ‘দিয়ে দিবো।’

‘শুভর সাথে যেনো ভুলেও না দেখি।’ স্বাভাবিক ভাবে বললেও কথাটার মাধ্যমে যেনো স্পষ্ট শুভর প্রতি রাগ দেখতে পাচ্ছে মিহির। কিছু না বলে বাহিরে তাকায় সে। বুঝতেই পারছে দুই ভাই এই জীবনে শুভকে মেনে নিবে না।
_________________

চোয়াল শক্ত করে বসে আছে শুভ। আদিল সামির আর রাহুল একে অপের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে।

সামির বলে, ‘ একটা ছেলে প্রচন্ড অধিকারবোধ নিয়েই একটা মেয়ের হাত ধরতে পারে!’ চোখ তুলে তাকিয়ে বলে শুভ, ‘কি বলতে চাইছিস তুই?’

‘দেখ, ছেলেটা কে যখন মিহু তার হাত ধরতে দিয়েছে তার মানে ছেলেটা মিহুর খুব কাছের কেউ। লাইক বয়ফ্রেন্ড, ফিয়ন্সে।’ এতো টুকু বলে শুভর দিকে তাকাতেই শুকনো ঢুক গিলে বলে, ‘কিংবা ভাইও হতে পারে। তুই করে যেহেতু বললো।’ শুভর চোখ লাল হয়ে আছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে কিন্তু পারছে না। কষ্ট হচ্ছে তার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। মিহি কেনো বুঝে না তাকে? কেনো এতো কষ্ট দিচ্ছে? আদিল শুভর কাধে হাত রেখে শান্ত স্বরে বলে, ‘যা হবার হয়েছে ভাই। মিহু মনে হয় না আর তোর কাছে ফিরবে। ভুলে যা সব!’

রেগে যায় শুভ। এক ঝাটকা দিয়ে আলিদের হাত সরিয়ে ফেলে সে। চেঁচিয়ে বলে, ‘ভুলে যাবো? এতো সহজে বলে ফেললি ভুলে যাবো? ভালোবাসি মিহি কে। ভুলে যাবার কথা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারি না। আই জাস্ট নিড হার।’ শেষের কথাটা বলেই কান্নায় ভেঙে পরে শুভ।

বাচ্চাদের প্রিয় খেলনা নিলে যেমন তারা হাউমাউ করে কান্না করে ঠিক তেমনি ভাবে কান্না করছে শুভ। দুই হাত দিয়ে মাথার চুল মুঠ করে ধরে নিচে দৃষ্টি রেখে কাঁদছে সে। বন্ধুর কান্না সয্য করতে পারছে না কেউ। কিভাবে শান্তনা দিবে বুঝতে পারছে না তারা। সামির শুভর কাধে হাত রাখতেই শুভ কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে, ‘দোস্ত, মিহিকে এনে দে প্লিজ। প্রমিস করছি কখনো কষ্ট দিবো না, রেগে কথা বলবো না ওর সাথে। অনেক অনেক ভালোবাসবো ওকে। প্লিজ ইয়ার তোরা আমার মিহিকে আমার কাছে এনে দে। মিহিকে ছাড়া আমি জীবন্ত লাশ হয়ে যাবো। আদিল? আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। মিহিরের উপেক্ষা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আমি আর নিতে পারছি না। অনেক অসহায় লাগছে নিজেকে।’

মুখের কথা যেনো হারিয়ে ফেলেছে সবাই। চেষ্টা করছে বন্ধুকে তাকে শান্ত করার।

চলবে..!!

#অনুভবী_হিয়া
#মাইশাতুল_মিহির

২৪.

ডিপার্টমেন্টের হেড উজ্জ্বল আহসানের সামনে বসে আছে মাহিন, শান্ত। পাশে দাঁড়িয়ে আছে অর্ধবয়স্ক ইন্সপেক্টর আমজাত। হাতে থাকা ফাইল তাদের সামনে রেখে বলে, ‘মিঃ হোসাইন কবির। বিআইবি কোম্পানির মালিক। ক্যাসটা উনার বৃদ্ধ মা করে কারন উনার মতে তার ছেলেকে কেউ মার্ডার করেছে। আর উনার থেকে জানতে পারি মিঃ হোসাইন আর তার ওয়াইফের কিছুদিন যাবত পারিবারিক ভাবে ঝামেলা হয় কারণ টা কেউ বলে নি। আমি মিসেস হোসাইন এর কাছ থেকে জানতে পারি মিঃ হোসাইন অফিস থেকে ফিরে রাত নয়টায়। তখন অনেক ক্লান্ত ছিলো আর স্বাভাবিকের চেয়ে নাকি অতিরিক্ত ঘেমে ছিলো। মিসেস হোসাইন আরো বলেন মারা যাবার আগে শ্বাসকষ্ট হয় উনার। আর বাসায় ফেরার দুই ঘন্টা পর মৃত্যু হয় তার। পোস্টমর্টেমের রিপোর্টে আসে হার্ট এটাকে মারা যায় উনি। কিন্তু স্যার আমি দেখেছি লাশটার ঘাড়ের বা পাশের অল্প একটু জায়গা কেমন কালচে লাল হয়ে ছিলো। আমারও কেনো জানি মনে হচ্ছে মিঃ হোসাইনের মৃত্যু টা স্বাভাবিক নয়।’ বলে মিঃ হোসাইনের ঘাড়ের সেই কালচে দাগের কয়েকটা ছবি দেখায় তাদের।

পিনপিন নিরবতা পালন করছে মাহিন শান্ত। তাদের দিকে তাকিয়ে আছে উজ্জ্বল আহসান। আসলে নিরবতা নয় মনে মনে ছক কষছে দুজন।

শান্ত লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলে, ‘কোন হস্পিটালে ডে:ডবডি পোস্ট:মর্টেম করা হয়েছিলো?’ আমজাত তড়িঘড়ি করে হস্পিটালের রিপোর্টের ফাইল বের করে শান্তর দিকে এগিয়ে দেয়। লোকটি কাজের ব্যাপারে খুব সাবধান আর সতর্ক বুঝায় যাচ্ছে। শান্ত ফাইল কিছুক্ষণ ঘেটে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলে, ‘টাকা দিয়ে সব করা যায় আমজাত কাকা। জানেন তো?’

বিস্মিত হয়ে তাকায় ইন্সপেক্টর আমজাত। এমন একটা মুহূর্তে এই কথাটা ঠিক তার বোধগম্য হচ্ছে না তার। মৃদু আওয়াজে হেসে ফেলে মাহিন। শান্ত বলে, ‘টাকা ঢেঁলে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে আসল সত্ত্য ঢাকার চেষ্টা করছে খু:নি। যারা উনার পোস্টমর্টেম করেছে তাদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকেন। লা:শটা অন্য এক হস্পিটালে নিয়ে আবার পোস্টমর্টেম করুন। রিপোর্ট গুলো আমাদের ল্যাবে নিয়ে আসবেন। উনার শরিলে বিষাক্ত জাতীয় কিছু পুশ করা হয়েছে।’

মাহিন এবার সোজা হয়ে বসে বলে, ‘একটা ব্যাপার অনেক রহস্য ঠেকছে। আপনার ভাষ্য মতে মিঃ হোসাইন বাসায় যাবার দুই ঘন্টা পর মা:রা যায়। বায়ায় যাবার পর থেকেই উনার শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় অথচ কেউ ডক্টর কে ডাকলো না? কি মনে হয় আপনাদের? মার্ডার করা হয়েছে আর সেটা তার পরিবারের লোকরাই করেছে। উনার পরিবারের সবার সাথে কথা বলতে চাই। বিশেষ করে উনার স্ত্রী।’

ইন্সপেক্টর আমজাত সম্মতি জানায়। আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে বেরিয়ে যায় মাহিন শান্ত।

___________

রাত ১০:২২! রাস্তা ঘাট যেনো নিস্থব্ধতায় একাকার। রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল কমে গেছে। জেগে আছে শুধু দারোয়ান চাচা। মিহিরের বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে শুভ, আদিল, সামির আর রাহুল। রাহুল আশেপাশে তাকিয়ে একবার প্রখর করে বলে, ‘ভাই নিজেরে কেমন চুর চুর লাগতাছে।’

সামির বলে, ‘শুভ তুই মিহুকে একবার কল করে বল বাহিরে দেখা করে যেতে তাহলেই তো সমস্যা শেষ। আমাদের চুরের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না!’

কিঞ্চিৎ বিরক্ত নিয়ে বলে শুভ, ‘তোদের কি মনে হয় মিহি আমার কল ধরবে?’

‘ধরতেও পারে ট্রাই করে দেখ না!’ আদিলের কথায় মিহিকে কয়েকবার কল দেয় শুভ। কিন্তু মিহি কল রিসিভ করে নি। তারপর মিহিরের নাম্বারে কয়েকটা ম্যাসেজ পাঠায় শুভ। ভালো লাগছে না তার। কবে শেষ হবে এই দূরত্ব? কবে মিহিকে আপন করে পাবে?
________________

অন্ধকারের ডেকে গেছে চারপাশ। কুকুরের আর্তনাদ শুনা যাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দেখা যাচ্ছে দুজন যুবকের অবয়। নিরবতা বজায় রেখে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। হঠাৎ ফোনের কর্কশ আওয়াজে ধ্যান ভাঙে দুজনের। মাহিন পকেট থেকে মোবাইল বের করে মৃদু হাসে তা দেখে শান্তও মনে মনে হেসে বড় বড় কদম ফেলে সামনে এগিয়ে যায়।

‘এখনো ঘুমাও নি তুমি?’ মাহিন শান্ত গলায় বললেও অপর পাশ থেকে কাটকাট গলা ভেসে আসে, ‘কেনো আমার কি ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো?’ হেসে ফেলে মাহিন। যা সুহার কর্ণগোচর হয়। অভিমানের পাল্লা ভাড়ি হয় আরো। মাহিন এতোই ব্যস্ত থাকে যে তাকে একটা কলও দেয় না? সুহা কে চুপ থাকতে দেখে বলে মাহিন, ‘আমার সুহারানী রাতে খাবার খেয়েছে তো?’ সুহা উত্তর না দিয়ে অভিমানী গলায় বলে, ‘আপনি অনেক খারাপ। সেই দুপুরে একটু কথা বলেছেন তারপর একটা কলও দেন নি। দেখাও করেন না দুই দিন ধরে। আমার বান্ধুবিরা দিব্যি তাদের বয়ফ্রেন্ড কে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর আপনি কলও দেন না। আসলে আপনি আমাকে ভালোবাসেন না তাই তো বলেনও না। কথা বলবেন না আমার সাথে।’

মৃদু আওয়াজে হাসে মাহিন। তার রাজ্যের রানী অভিমান করেছে। কতশত অভিমান নিয়ে বসে আছে পিচ্চি এই মেয়ে। নিজের অজান্তেই যে মেয়েটা তাকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে সেটা সে নিজেও জানে না। নরম কন্ঠে বলে, ‘ভালোবাসলেই বলতে হবে সুহা? অনুভূতি গুলো ঠিক প্রকাশ করে পারি না। আমি যে বড্ড চাপা স্বভাবের। বুঝে নিতে পারবে না আমাকে?’ চুপচাপ শ্রবণ করছে সুহা। মাহিনের স্বভাব এতো দিনে সে বেশ বুঝতে পেরেছে। লোকটা ব্যাথা পেলেও মুখ ফুটে টু শব্দ করবে না। বলতে গেলে একদম ইন্ট্রোভাট টাইপ লোক। মাহিন যে সুহা কে ভালোনাসে সেটা সে জানে।

‘জানো সুহা? অভিমান করলে না তোমার গাল দুটো ফুলে থাকে তখন ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দিতে। ট্রাস্ট মি সুহা তোমার পাশে থাকলে টুস করে কামড় দিতাম তোমার লাল টমেটো টাইপ গালে। গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিতাম তোমাকে।’

মাহিনের এমন লাগাম ছাড়া কথা শুনে সুহার অভিমান পালিয়ে একদফা লজ্জার রেশ হানা দিয়েছে। কে বলবে এই লোকটা গম্ভীর পকৃতির? আর কেউ না জানুক সুহা ভালো করেই জানে লোকটার মধ্যে লজ্জার ‘ল’ টাও নেই।

‘সুহা তুমি নিশ্চয় এখন লজ্জা পাচ্ছো? তোমার এই লজ্জাভরা মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে। কবে বিয়ে হবে বলো তো আমাদের?’

‘আপনি খুব বাজে! অসভ্য একটা লোক!’

‘অসভ্যের মতো তো কিছুই করলাম না আমি। তবে হ্যা একবার বিয়ে টা হতে দাও তার পর দেখাবো অসভ্য কাকে বলে। সুহারানী আমার প্রস্তুত থেকো!’ বলেই হেসে দিলো মাহিন। সুহাও সাথে হেসে ফেললো। যাক অভিমান ভেঙেছে মহারানীর। এভাবে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দেয় মাহিন। এগিয়ে যায় শান্তর দিকে।

চলবে..!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here