#অনুভবী_হিয়া,৪১,৪২
#মাইশাতুল_মিহির
৪১..
আকাশে সূর্য কে আড়ালে ঢেকে কালো মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। এই বুঝি ঝুম বৃষ্টি নামবে। কিয়ৎসময় পরপর বজ্রপাতের আওয়াজ চারপাশ কানে আসছে। মাহিন যতদ্রুত সম্ভব বাইকে চালিয়ে কাঙ্ক্ষিত স্থানে এসে পৌছায়। গেইটের ভিতরে ঢুকে একবার উপরে তাকায় সে। ধক করে উঠে বুকটা। সুহা আর জিহান বারান্দার রেলিঙের পাশে দাড়িয়ে আছে। সুহা কিছুটা ঝুকে আছে আর জিহান তাকে ধরে রেখেছে ছেড়ে দিলেই সুহা নিচে পরে যাবে। মাহিন নিচ থেকে ‘সুহা’ বলে চেঁচিয়ে উঠে। মাহিনের কণ্ঠস্বর শুনতেই সুহার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে। ঘাড় ঘুরিয়েও মাহিনকে এএকপলক দেখতে পারেনি সুহা। তবে কি এখানেই সমাপ্তি তাদের প্রণয়? কষ্টে বুক ভার হয়ে আসে সুহার। অস্ফুটিত কন্ঠে মা’হি’ন বলে সুহা। মাহিন দৌড়ে বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঢুকে পরে। অতিরিক্ত উত্তেজনায় তার হার্ট দ্রুতগতি তে চলছে। জিহান যে সুহাকে উপর থেকে ফেলে দিবে তার কোনো সন্দেহ নেই। লিফটে বাটন চাপলে লিফট ওপেন হয় না। শীট বলে লাথি দেয় লিফটের দরজায়। অতঃপর দৌড় লাগায় সিঁড়ি দিয়ে। যত দ্রুত সম্ভব উপরে উঠার চেষ্টা করছে মাহিন। ফ্লাটে আসতে আসতে একটু বেশি দেড়ি হয়ে যায় তার। ফ্লাটের ভিতর পা রাখতেই সুহার চিৎকার কানে আসে মাহিনের। দৌড়ে বারান্দায় এসে দেখে জিহান একা। মাহিন এগিয়ে নিচে ঝুকে দেখে সুহা নিচে পরে আছে। তার চারপাশে রক্তে ভেসে আছে। মাহিন স্থব্ধ হয়ে যায়। মস্তিষ্কের নিউরন কাজ করা বন্ধ হয়ে যায় তার। বাকশুন্য হয়ে পরে সে। পাশ থেকে জিহানের চাপা হাসির আওয়াজ কানে আসে মাহিনের। চোয়াল শক্ত করে জিহানের দিকে তাকায় মাহিন।
জিহান হেসে আহত গলায় বলে, ‘সরি ব্রাদার, সুহামনিকে মারতে চাইনি। ওই দিন রাস্তায় সুহার সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখে হয় আমার। ট্রাস্ট মি ব্রো সি ইজ রিয়েলি সো প্রিটি।’
মাহিন জিহানের নাক বরাবর ঘুষি মারে। নাক দিয়ে সিটকে রক্ত বেরিয়ে আসে। জিহান এক হাতের পিঠ দিয়ে নাক মুছে আবার বলতে লাগলো, ‘ছবি থেকে বাস্তবে অসম্ভব সুন্দর সুহামনি। কিছু সময়ের জন্য মনে হয়েছিলো সুহামনি কে লাগবে আমার। দ্বিধায় পরে গিয়েছিলাম কিছুদিন। ভেবেছিলাম সুহামনি কে লাইফ পার্টনার বানাবো। কিন্তু কাল রাতে তোদের বিয়ে হয়ে গেলো। মানতে পারিনি ব্যাপার টা। রাগ হলো তাই…! আই রিয়েলি লাইক হার বাট তোর বউ হয় এটাই তার লাইফ শেষ করার জন্য যথেষ্ট ছিলো।’
হিংস্র হয়ে উঠে মাহিন। স্বজোড়ে জিহানের বুকে লাথি মারে। জিহান দূরে সিটকে পরে। মাহিন এগিয়ে এলোপাথাড়ি কিল ঘুষি দিতে থাকে জিহান কে। পাশে থাকা বড় ফুলের টব হাতে নিয়ে জিহানের মাথা বরাবর মারে। মুহূর্তে রক্তে ভরে যায় জিহানের শরিল। চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে জিহানের মুখ থেকে। তবুও সে প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। মাহিন জিহানের কলার ধরে তুলে ঘুষি দিতে দিতে বলে, ‘কু/ত্তা/র বা’চ্চা, আজকে তোকে আমি মেরেই ফেলবো।’
জিহান আহত গলায় কাপাকাপা কন্ঠে বলে, ‘মেরে ফেল বাচতে চাই না। সুহামনির সাথেই ফেলে দে।’
জিহানের মুখে সুহামনি নাম টা শুনতে মাহিনের মাথায় রক্ত উঠে যায়। আরো কয়েক দফা মেরে জিহানকেও সেই বারান্দা থেকে ফেলে দেয়। অর্ধ আহত শরিল নিচে পরে মুহূর্তেই থেঁতলে যায় জিহানের মাথা। পরপর দু দুটো মানুষ উপর থেকে পরাই চারপাশে ভীড় জমে যায়। কোলাহলে পূর্ব হয়ে যায় পরিবেশ।
.
মাহিন বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঢুকার পরেই শুভ মিহির আসে। তখনি গেইটের কাছে এসে সুহার চিৎকার কানে আসতেই উপরে তাকায় দুজন। সুহাকে নিচে পরতে দেখে বাকশুন্য হয়ে পরে শুভ। মিহির মুখে হাত দিয়ে চিৎকার করে উঠে। শুভ দৌড়ে সুহাকে ধরার চেষ্টা করে কিন্তু কাছে আসার আগেই সুহা পরে যায়। এতো অল্প সময়ের মাঝে ঘটনা ঘটে গেলো যে কেউ টের পায়নি। শুভ চোখের সামনে বোনকে পরে যেতে দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে নি। দৌড়ে সুহার কাছে এসে সুহাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। মিহির সুহার পাশে বসে সুহার গা হাল্কা ধাক্কা দিয়ে কাপাকাপা গলায় বলে, ‘সুহা? কথা বলো? আজকে না আমাদের ম্যাচিং করে শাড়ি পরার কথা ছিলো? উঠো সুহা???’ চিৎকার করে কেদে ফেলে মিহির।
তখন আবারো উপর থেকে জিহানের শরিল পরে। শুভর বুঝতে বাকি নেই জিহান সুহাকে উপর থেকে ফেলেছে। কিছু সময় পর মাহিন তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে আসে। চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ। কেউ কেউ আফসোস করছে, কেউ কেউ কষ্টে চোখ মুছচ্ছে। ভীড় ঠেলে এগিয়ে আসে মাহিন। সুহাকে এভাবে পরে থাকতে দেখে তার পা থেমে যায়। চোখ থেকে টুপ করে এক ফোটা পানি গরিয়ে পরে। মিহির সুহার এক হাত ধরে বসে পাগলের মতো কাঁদছে। শুভ সুহাকে বুকে আগলে রেখে আরেক হাতে মিহিরকে ধরে রেখেছে। মাহিন ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সুহার পাশে বসে। কাপাকাপা হাতে সুহাকে টেনে নিজের কোলে আনে। অতঃপর সুহার এক গালে হাত রেখে হাল্কা চাপড় দিয়ে মৃদু কাপা কন্ঠে বলে, ‘সুহা? এই সুহা? উঠো, কথা বলো প্লিজ।’
সুহার দুই হাত মেহেদীর রঙ্গে সজ্জিত। হাতের তালুর মাঝে সুন্দর করে লিখা ‘MahinShuha’
মাহিন সুহার হাত বুকের মাঝে নিয়ে বলে, ‘দেখো সুহা তোমার হাল্লুক কাঁদছে তোমার জন্য। তুমি না বলতে আমি কাদি না কেনো? আমাকে এখন কাঁদাচ্ছ কেনো তুমি? উঠো প্লিজ।’
ভাইয়ের অবস্থা দেখে মিহির মুখে হাত দিয়ে জোড়ে কেঁদে ফেলে। শুভ দুই হাতে মিহিরকে বুকে আগলে রেখে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। মাহিনের চোখ ঘোলাটে হয়ে আছে। সুহাকে সেই কখন থেকে বুকে আগলে বসে আছে। অনুভূতি তার শূন্য।
কিছুসময় পর সেখানে পুলিশ, আর এম্বুলেন্স আসে। জিহানের বডি একটা এম্বুলেন্সে উঠিয়ে নেওয়া হয়। সুহাকে এম্বুলেন্সে উঠাতে চাইলে মাহিন বাধ বাধে। কোনো প্রকার উত্তেজিত না হয়ে সুহাকে কোলে নিয়ে তাৎক্ষনাৎ এম্বুলেন্সে উঠে পরে। শুভ মিহিরকে ধরে এম্বুলেন্সে উঠে সুহার পাশে বসে। তড়িৎ গতিতে গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে আনা হয় সুহাকে।
হাসপাতালে আনার পর ডক্টর রা এক মুহূর্তও দেড়ি না করে অক্সিজেন লাগিয়ে সুহা আর জিহানকে আইসিইউ তে নেওয়া হয়। দুজনের অবস্থায় বেশ বেগতিক। তাৎক্ষনাৎ রক্ত এরেঞ্জ করে দেওয়া হয় দুজনকে। মিহির বসে কাঁদছে, তার পাশে শুভ বাকশূন্য হয়ে বসে আছে। মাহিন আইসিইউর সামনে দাঁড়িয়ে ঠোট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে। এতো প্রেশার নিতে না পেরে মিহির শুভর বাহুতে জ্ঞান হারায়। নিচে পরে যেতে নিলেই শুভ মিহিরকে ধরে ফেলে। একজন নার্স এসে পানির বোতল দেয়। মাহিন মিহিরের চোখে মুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করে কিন্তু কাজ হয়নি। তখন ডক্টরের কথায় সেলাইন লাগানো হয় মিহিরকে। ডক্টর জানায় অতিরিক্ত শকে জ্ঞান হারায় মিহির। কয়েক ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসবে।
এরি মাঝে বাড়িতে জানানো হয় সব। সকলে ইতিমধ্যে হাসপাতালে উপস্থিত। মিথিলা বসে মাথায় হাত দিয়ে কান্না করছে। তাকে শান্তনা দিচ্ছে রাশেদা, সে নিজেও কাঁদছে সুহার জন্য। আদিল রাহুল সামির কারোর মুখে কোনো কথা নেই। তারা সবাই সুহাকে নিজেদের বোনের মতো আদর করেছে। আয়াজ রায়হান স্ত্রীর পাশে বসে মেঝেতে এক দৃষ্টিরে তাকিয়ে আছে।
ঘন্টা খানেক পর ডক্টর এসে জানায় জিহান মারা গেছে। কিন্তু কারোর কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। পুলিশ জিহানের লাশ পোস্টমর্টেম করার জন্য মতান্তরে নিয়ে গেছে তারা।
সুহার অবস্থা খুবই বেগতিক। অক্সিজেন লাগানো শর্তেও শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সুহার হার্টবিট অনেক কম গতিতে চলছে। আইসিইউর বাহিরে দাঁড়িয়ে সবাই কাঁদছে আর দো’য়া করছে।
মাহিন আইসিইউর সামনে দরজার কাচ দিয়ে ভিতরে মৃত্যুর সাথে লড়াই করা তার সুহারানী কে দেখছে। মনে মনে একটা কথায় আওড়াচ্ছে ‘প্লিজ সুহা, আমাকে একা ফেলে যেও না। প্লিজ ফিরে আসো, হাজার টা অভিমান নিয়ে ফিরে আসো। আগলে নিবো তোমাকে। ভালোবেসে অভিমান ভাঙ্গাবো। প্লিজ আমাকে একা করো না।’
চলবে??
#অনুভবী_হিয়া
#মাইশাতুল_মিহির
৪২.
‘পাপ্পাপা!’
হাস্যউজ্জল চেহারায় সদ্য ফুটফুটে বাচ্চাটি একটু একটু করে কথা বলছে। পাশ থেকে শুভ তার ছোট ছোট কোমল পা দুটো হাতে নিয়ে নাচিয়ে নাচিয়ে বলে, ‘পাপা সাইকেল সাইকেল।’
সাইম খিলখিল করে হেসে উঠলো। শুভও সাইমের সাথে হেসে দুলে কথা বলছে। পাশ থেকে মিহির বলে উঠে, ‘তোমরা রেডি?’
শুভ সাইমকে কোলে নিয়ে বলে, ‘ইয়াহ্ মেডাম, উই আর রেডি ফর গো! রাইট পাপা?’ হেসে উঠে সাইম। মিহির শাড়ির আচল টেনে বলে, ‘তাহলে আমার কুচিটা একটু ধরো আমি ঠিক করতে পারছি না।’
শুভ সাইম কে বিছানায় বসায়। অতঃপর মিহিরের সামনে হাটু গেড়ে বসে কুচি ঠিক করতে করতে বলে, ‘তোমার সাথে আমরা দুজন রেডি হলাম। আর তোমার এখনো হয় নি। এতো টাইম লাগে কেনো?’
মিহির কড়া গলায় বলে, ‘চুপ করো।’
শুভ কুচি ঠিক করে উঠে দাঁড়ায়। মিহির আয়নায় একবার নিজেকে ভালো করে দেখে শুভকে বলে, ‘কেমন লাগছে আমাকে?’
শুভ মৃদু হেসে মিহিরের কপালে চুমু একে বলে, “মাশা’আল্লাহ! আমার সাইমের আম্মু টাকে প্রচুর কিউট লাগছে।’ তখন পাশ থেকে সাইমের আওয়াজ আসে। দুজন তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। শুভ এগিয়ে সাইমকে কোলে নিয়ে বলে, ‘ওলে বাবারে, তোমাকেও আদর দেই।’
মিহিরও এগিয়ে সাইমের গালে চুমু দেয়। শুভ বলে, ‘আমার?’ মিহির চোখ পাকিয়ে তাকায় শুভর দিকে। শুভ আফসোস স্বরে বলে, ‘থাক লাগবে না। বেবি আসার পর থেকে বদলে গেছো। আমাকে চোখেই পরে না তোমার। আদর তো দূর একটা ছোট্ট কিস ও দাও না। সব বেবির জন্য খালি।’
মিহির অবাক হয়ে যায়। মিহিরের রিয়েকশন দেখে শুভ হেসে ফেলে। অতঃপর মিহিরের গাল টেনে বলে, ‘আসো লেইট হয়ে যাচ্ছে।’ সাইমকে শুভ কোলে নিয়ে বেরিয়ে যায়। মিহির শুভর পিছে পিছে যায়।
ড্রয়িংরুমে এসে দেখে আয়াজ আর মিথিলা বসে আছে। শুভ মিহির নিচে নামার পরেই মিথিলা উঠে সাইমকে কোলে নিয়ে বলে, ‘দাদু ভাই, মাশা’আল্লাহ। দাদুকে সাথে নিবে? দাদু চকলেট দিবো।’ সাইম কি বুঝলো কে জানে। খিলখিল করে হেসে উঠে দাদূর কথায়। আয়াজ বসে থেকেই বলে, ‘দাদু ভাইকে আমার কাছে দাও।’
মিথিলা এগিয়ে সাইমকে দেয় তার কাছে। আয়াজ কোলে নিয়ে বলে, ‘দাদু ভাই আমার একদম আমার মতো। কি বলো মিথিলা?’ তারপর শুভর উদ্দেশ্যে বলে, ‘সন্ধ্যার আগে ফিরে এসো, সাইম কে নিয়ে রাতে বাহিরে থাকার দরকার নেই। খারাপ কিছুর নজর লাগতে পারে।’ শুভ সম্মতি জানায় বাবার কথায়। মিহির এগিয়ে সাইমকে কোলে নিয়ে নেয়। তার পর শুভ মিহির সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়।
_____________
কোলাহল পূর্ন শহর, ব্যস্ত নগরী। কিছুক্ষণ আগে থাকা ঘোলাটে আকাশ এখন বর্ষণমুখর। টুপটাপ বৃষ্টির ফোটা পরছে ধরনীর বুকে। এই বর্ষণ কারোর জীবনে রঙ্গিন দিন আনে, আর কারোর জীবনে মেঘের মতোই ঘোলাটে আকাশ উপহার নিয়ে আসে। ছয় তলার এপার্টমেন্টের ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমে থাইগ্লাসের পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চোখ রাখে মাহিন। অনুভূতি শূন্য এই চোখ। নির্বিকার, হাহাকার, যন্ত্রনার। কেউ নেই কারোর পাশে। কেউ নেই দুঃখ ভাগ করে বুঝে নেবার। আকাশটা আজও সেই দিনের মতো মেঘলা। চোখের কার্নিশে জল চিকচিক করছে। ভাবছে তার সেই চঞ্চল, হাসিখুশি সুহারানী কে নিয়ে। মেয়ে অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। আইসিইউ তে নেওয়ার একদিন পরেই সুহা কোমায় চলে যায়। আজ দুবছর সুহার এখনো জ্ঞান ফিরে নি। মাহিনের সাথে আর আগের মতো হাসিখুশি কথা বলে না, অভিমান করে না, ভালোবাসেন না বলে দাবি করে না। মাহিনকে একলা করে সেই যে ঘুম দিয়েছে এখনো উঠে নি। অপেক্ষায় আছে মাহিন সেই দিন টির জন্য যে দিন সুহা তাকে ‘মিঃ হাল্লুক’ বলে ডাকবে। নিশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহিন। তখন মোবাইলে কর্কষ আওয়াজে রিংটোন বেজে উঠে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে তাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে কল এসেছে। এই প্রফেশনের জন্যই আজ তার সুহা বেচে থেকেও তার পাশে নেই। কল রিসিভ করে কথা বলার পরেই মিহিরের কল আসে। ঠোটে হাল্কা হাসি টেনে মাহিন কল রিসিভ করে।
অপর পাশ থেকে মিহির বলে উঠে, ‘ভাই কোথায় তুমি?’
‘বাসায়! কেন?’
বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলে মিহির, ‘কেন কি আবার হবে। তোমার ভাগ্নে, হয়েছে তো তোমার মতোই।’
হেসে ফেলে মাহিন। তারপর বলে, ‘মামা টাহ কি করছে?’
মিহির ঠোট উল্টে বলে, ‘জ্বালাচ্ছে, এর জ্বালা কবে সে পরপার হয়ে যায় আল্লাহ ভালো জানে।’
মাহিন গম্ভীর কন্ঠে বলে, ‘মিহির?’ বিরক্তির মাঝে কি বলে ফেলেছিল মিহির হুশ আসে। পরোক্ষনে হেসে প্রশংজ্ঞ বদলায়। বলে, ‘আসো তো, সাইম কে সামলাও। তোমার জন্য কান্না করছে সাইম।’
মাহিন হেসে উত্তর দেয়, ‘আসছি। কি লাগবে তোর?’
‘না, তুমি চলে আসো শুধু।’
মাহিন ‘আচ্ছা’ বলে কল কেটে দেয়। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিহির। ভাইটা তার অনেক বদলে গেছে। মিহিরের মা রাশেদা গতবছর স্টোক করে মারা গেছে। সেই পর থেকে মাহিন একা থাকে। মিহির কত করে বলে বলেছিলো তাদের সাথে থাকার জন্য কিন্তু মাহিন থাকে না। মাঝে মাঝে দেখা করতে এসে আবার চলে যায়। ভাইকে দূর থেকে এমন নির্বিকার, ভাবলেশহীন দেখে কষ্ট হয় মিহিরের। সুহা যদি সুস্থ থাকতো তাহলে তার ভাইয়ের জীবনও আর পাঁচটা মানুষের মতো সুন্দর স্বাভাবিক হতো। চোখ ঘোলা হয়ে আসে তার। তখন শুভ রুমে আসে। মিহিরকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে এসে অস্থির হয়ে বলে, ‘মিহি কাঁদছ কেন? কি হয়েছে?’
মিহির শুভকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয়। ভাঙ্গা গলায় বলে, ‘ভাইকে এভাবে দেখতে আর ভালো লাগে না আমার শুভ। কষ্ট হয় অনেক।’
শুভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিহিরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন। সব কিছু।’
‘কোথায় ঠিক হচ্ছে শুভ? দুই বছর ধরে সুহা কোমায় আছে। সুহা অন্তত্য আমাদের সাথে থাকতে পারতো। সুহাকে অনেক মিস করি শুভ।’
শুভর চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। নিশব্দে মিহিরকে আগলে বলে, ‘হুশ কাঁদবে না। দেখো সাইম তাকিয়ে আছে। দো’য়া করো সব ঠিক হয়ে যাবে।’
_______________
রাত তখন সাতটা ছুঁই ছুই। মাহিন হাসপাতালের সামনে গাড়ি থামিয়ে ভিতরে যায়। তার হৃদস্পন্দন কাপছে। নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। বুকের ভীতর হাজারো ব্যাথা চেপে একটি কেবিনে ঢুকে। কেবিনে হাল্কা টিমটিম আলো জ্বলছে। মাহিন এগিয়ে লাইট অন করে বেডে তাকায়। মুহূর্তে তার চোখের কোণে পানি এসে পরে। ঠোটে ঠোট চেপে এগিয়ে বিছানার পাশে থাকা টুলে বসে। ফ্যাকাশে মুখ, এলোমেলো চুলে মুখে অক্সিজেন মাক্স রেখে শুয়ে থাকা তার সুহারানীর দিকে পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকায় সে। সুহার বা হাতের উল্টো পিঠে চুমু খায় মাহিন। এক হাতে সুহার হাত বুকে চেপে রেখে আরেক হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে আহত গলায় বলে, ‘সুহারানী? তাকাও প্লিজ। দেখো তোমার হাল্লুক তোমার জন্যই বসে আছে। কাঁদছি আমি দেখো। এভাবে একা করে গেলে কেন তুমি? এখনো সময় হয় নি তোমার চোখ খুলার? ভালোবাসি সুহা। অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি।’
মাহিন কিছুটা এগিয়ে সুহার কপালে গাঢ় চুমু একে বলে, ‘তোমার অপেক্ষায় আছি সুহা। খুব শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাও।’
মাহিন চোখের পানি মুছে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। ডক্টরের সাথে কথা বলে গাড়িতে উঠে। উদ্দেশ্য তার ভাগ্নে সাইমের কাছে যাওয়া।
চলবে?