অনুভবে,পর্ব-১

0
3470

অনুভবে,পর্ব-১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

পর্দা খুলতেই মিষ্টি সোনালী রোদ্দুর এসে ছুঁয়ে যায় বিছানায় শুয়ে থাকা কন্যার উপর। সকালের সোনালী রোদ্দুর চোখে পড়তেই নড়ে-চড়ে উঠে কন্যাটি। একটি মধ্যবয়সী মহিলা মেঝেতে পড়ে থাকা কাপড় গোছাতে গোছাতে বলল, “ইনুমণি, ও ইনুমণি। উঠো গো, সকাল হয়েছে।”

“আর একটু, খালাজান। ঘুম আসছে।” ইনারা পাশ ফিরে বালিশ বুকে জড়িয়ে ধরে। তার খালাজান বলে, “নিচে যাও, নাস্তার সময় হয়েছে।”
ইনারা তবুও উঠে না। ঘুমাতেই থাকে। যেন তার কিছু আসে যায় না। খালাজান না পেরে বলে, “আজ এক তারিখ। তুমি না কোন কনসার্টে যাবে? সেখানে গেলে তো টাকা লাগবে।”
“পরে আব্দুল কাকার থেকে নিয়ে নিব।”
“কিন্তু বড় সাহেব তো এখনই তোমায় ডেকেছে।”

কথাটা শুনতেই লাফ দিয়ে উঠে ইনারা। বিছানায় দাঁড়িয়ে একগাল হেসে বলে, “খালাজান তুমি আগে বলব না আব্বু এসেছে?”বলেই সে দৌড়ে যায় রুম থেকে বাহিরে। খালাজান বলে, “আরে ইনুমণি ব্রাশ তো করে যাও। মেয়েটা যেন হাওয়ার সাথে চলে। কাজের সময় কাজ করে না তারপর তাড়াহুড়ো।”

বাড়িটা দুই মঞ্জিলের। বাড়ি না যেন, মহল। এই মহলের রাজকুমারী ইনারা। পরিবারের একমাত্র মেয়ে। যেমন চঞ্চল, তেমন মিষ্টি। সবে এইচ-এস-সি পরীক্ষা শেষ করেছে। ভার্সিটিতে উঠবে। তার কোনো কাজ কখনো সময়ে হয় না। শেষ মুহূর্তে সবকিছুতে তাড়াহুড়ো।
আজ অনেকদিন পর সে এত সকালে নিচে এসেছে। সাধারণত সে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ঘুমায় কিন্তু আজ তার আব্বু এসেছে জেনে সে খুশিতে আত্নহারা হয়।

ইনারার বাবা মুশতাক আবসার। বাংলাদেশের নামকরা পরিচালক তিনি। এই কজের কারণেই দেশ বিদেশ ঘুরতে হয় তাকে। এ কারণে বাড়িত খুব কম আসে সে। এখানে কম আসার আরেকটা কারণ হলো তার স্ত্রীর স্মৃতি। এই বাড়িতে পা রাখতেই যেন তাকে স্মরণ করে দম বন্ধ হয়ে আসে তার। তাই মাসে, দু’মাসে একবার আসে সে। এবার একটু বেশি সময় হয়ে গেল। প্রায় তিনমাস পর সে বাসায় আসে।

ইনারা খুশিতে আত্নহারা হয় তার বাবাকে দেখে। সে দৌড়ে এসে বাসার সামনে দাঁড়ায়। হাসিমুখে বলে, “আব্বু, আমাকে দেখতে চেয়েছ তুমি?”
মুশতাক সাহেব বিরক্তির দৃষ্টিতে একপলক ইনারার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। ইনারার দিকে সে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না। ইনারার মা’য়ের সাথে তার চেহেরার অনেকটা মিল আছে। সে যত বড় হচ্ছে ততই তার মা’য়ের চেহেরার সাথে মিল বাড়ছে। ইনারার বয়স যখন আট, তখনই তার মা’য়ের মৃত্যু হয়। সে থেকে মুশতাক সাহেবের তাকে নিয়ে কেমন ছন্নছাড়া ভাব।

আজ এতদিন পরে তার বাবাকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়, “আব্বু কেমন আছো তুমি? তুমি আমাকে দেখতে চেয়েছিলে?”
“তোমার এ অবস্থা কেন? কোন ভালো পরিবারের মেয়ে রুম থেকে এইভাবে বের হয়? মনে হচ্ছে বস্তি থেকে উঠে এসেছ। নিজের বড় বোনকে দেখ, সকাল সকাল তৈরি হয়ে এসেছে।” কঠিন কণ্ঠে বললেন মুশতাক সাহেব। বড় বোন বলতে তার ফুফাতো বোন আইজার কথা বলছেন তিনি। প্রায়ই তাকে ভুল ধরানোর জন্য আইজার উদাহরণ দেওয়া হয়। কারণ আইজা সবকিছুতে পার্ফেক্ট বললেই চলে।

আইজা বলে, “মামা এতদিন পর ওর সাথে দেখা করছেন। বকা দিবেন না প্লিজ। মেয়েটার সবে কলেজ শেষ হয়েছে এখন না আরাম করলে কবে করবে?”
“তাই বলে এমন বস্তির মতো থাকবে।”
ইনারা মাথা চুলকে বিড়বিড় করে বলে, “বস্তিতেও তো মানুষ থাকে। আর আপনার থেকে বেশি পরিশ্রম করে টাকা কামায়।”
“তুমি কি বলছ?” মুশতাক সাহেবের প্রশ্নে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায় ইনারা, “কিছু না। আব্বু আপনি সহজে বাসায় আসেন না কেন?”
“তোমাকে এখন আমার কৈফয়ত দিতে হবে?”
“এভাবে বলি নি।”
“ভালো কথা, তুমি আব্দুল থেকে তিন মাস আগে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা নিয়েছিলে কেন?”
ইনারা চুপ করে থাকে। উওর দেয় না। এতে মুশতাক সাহেবের রাগ উঠে যায়। সে টেবিলে থাবা মেরে উঠে দাঁড়ায়, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি।”

কেঁপে উঠে ইনারা, “আমা…আমার এক বন্ধুকে দিয়েছি। ওর কলেজের ভর্তি ও ফর্ম ফিলাপ আটকে ছিলো। টাকা না দিলে ওর পরীক্ষা দেওয়া হতো না। আর..আর পরীক্ষা না দিলে ওর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেত।” ভয়ে এক নিশ্বাসে সব বলে দেয় ইনারা।
চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ইনারার ফুপু এবং খালাজান উপর থেকে এসে নিচে নেমে আসেন।

“তাহলে পরীক্ষা দিবে না তোমার কী? কি গরীব বন্ধুবান্ধব রাখো তুমি? লজ্জা করে না? এদের জীবনে রেখে আমার টাকা তাদের উপর উড়াও।”
এই কথাটা ইনারার গায়ে কাঁটার মতো লাগে। সে মুখ তুলে মুশতাক সাহেবের চোখে চোখ রেখে বলে, “এসব আপনার হলো কবের থেকে? এসব আমার মা’য়ের টাকা। সে রেখে গেছেন। আমার উল্টো বলা উচিত আপনি কেন উনার টাকা উড়াচ্ছেন? নিজের মৃত বউয়ের টাকা দিয়ে দিয়ে ছবি বানাতে আপনার লজ্জা লাগা উচিত, আমি কেন বন্ধু রাখতে লজ্জাবোধ করব?”
কথাটা শুনে যেন মুশতাক সাহেবের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। সে খালাজানের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই লালন-পালন করেছ তুমি এই মেয়েকে। এই বেয়াদবি শেখানোর জন্য টাকা দিয়েছি তোমাকে?”
“ওইটাই তো, নিজে তো কখনো দেখেন নি আমি কেমন আছি। বছরে দু’তিনবার দেখা করে এমন চিল্লালেই আপনি নিজের বাবার কর্তব্য পালন করে নিবেন?”

খালাজান দৌড়ে এসে ইনারার হাত ধরে বল, “ইনুমণি এভাবে বাবার সাথে কেউ কথা বলে?”
আইজাও বলে, “ইনু, মামার সাথে এভাবে বেয়াদবি করিস না। উনি বাবা হয় তোর।”
“ইনুমণি বাবাকে সরি বলে দেও।” খালাজান অনুরোধ করে বলে।

ইনারা তখনো চোখ সরায় না। চোখে চোখ রেখে কঠিন গলায় বলে, “আমি যে কথায় সঠিক, সে কথার জন্য আমি কখনো ক্ষমা চাইবো না। তিনি আমাকে আদব কায়দা শেখাচ্ছে অথচ অন্য মানুষের সম্মান করতে হয়, এটাও তিনি জানে না। আপনি উনার কত বড় আপনার সাথেও এভাবে চিল্লিয়ে কথা বলছেন উনি। আর তিনি বছরে যে কয়বার দেখা করে তা কেবল বকা দেওয়ার জন্য। বাবা এমন হয়? খালাজান, এরপর আর উনার সাথে দেখা করার কথা বলবে না। উনি থাকুক নিজের অহংকার আর টাকা নিয়ে।”

ইনারা রাগে হনহনিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে নিলেই মুশতাক সাহেব বলেন, “আমি তোমাকে টাকার কদর শেখাচ্ছি আর তুমি আমার সাথে তর্কাতর্কি করছো? অনেক হয়েছে, আজ থেকে তোমার সব হাতখরচ বন্ধ। তোমার ভার্সিটির জন্য খরচও নিজে চালাবে। আমার টাকা খরচ করতে তো মায়া লাগে না, যখন নিজে কামাই করবে তখন বুঝবে টাকার মূল্য।”

ইনারা সিঁড়ি পর্যন্ত উঠে গিয়েছিলো। মুশতাকের কথা শুনে দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে উঁচু স্বরে বলে, “প্রয়োজন নেই আপনার টাকার। নিজের খরচ আমি নিজে উঠাতে পারবো।” বলেই সে উপরে উঠে যায়। নিজের রুম লক করে বিছানায় এসে শুয়ে থাকে। রাগে তার মাথা ধরে গেছে। দম আটকে রেখেছে সে। তার রাগ নিয়ন্ত্রণে আনার অহেতুক চেষ্টা। কিন্তু তার রাগ কমে না। তা জল হয়ে বেরিয়ে আসে চোখ থেকে। সে তার বিছানার পাশের টেবিল থেকে তার মা’য়ের ছবির ফ্রেম হাতে নিয়ে বলল, “মা তুমি কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? আজ তুমি থাকলে কেউ আমাকে এভাবে বলতে বকতে পারতো না। তুমিই বলো মা আমি কী ভুল করেছি? প্রিয়র পড়া বন্ধ হয়ে গেলে তো ওকে দেখারও কেউ নেই। ওর বাবা মারা যাবার পর দায়িত্ব তো ওরই। ওর পড়াশোনা বন্ধ হলে ভবিষ্যতে ওর মা এবং বোনকে কে দেখবে বলো? ওর কষ্ট আমি বুঝি। আমার কাছে তুমি নেই, আব্বা থাকতেও নেই। আর ওর কাছে আমার মতো এত অহরহ সম্পদও নেই যে বসে বসে এক জীবন খেতে পারবে। তাকে একটুখানি দিলে কি হয়েছে বলোতো? আব্বা তো একটা ঘড়ি কিনতেই এই টাকা খরচ করে দেয়, আমি আমার বন্ধুকে সাহায্য করে কী ভুল করেছি?”

“ইনুমণি দরজা খুলো।” খালাজান দরজা ধাক্কা দিয়ে বললেন। ইনারা দরজা খুলে না। সে বলে, “খালাজান তুমি যাও, আমি এখন কারও সাথে কথা বলবো না।”
বলেই সে তার মা’য়ের ছবির ফ্রেমটা বুকে আঁকড়ে ধরলো। খালাজান আবারও ডাকে ইনারাকে, “ইনুমণি তুমি না ভালো? এভাবে রাগ করে না। আচ্ছা বাবা, একটু নাস্তা তো খেয়ে নেও। গতরাতেও কিছু না খেয়ে ঘুমিয়ে গেলে।”
“খালাজান তুমি যাও। আমার মুড ভালো হলে আমি বের হবো।”
খালাজান সম্ভবত চলে গেল। তার কন্ঠ আর শোনা যাচ্ছিলো না। এই ঘরে সবাই তাকে অনেক আদর করে। বিশেষ করে খালাজান। তার মা’য়ের জন্যও কাজ করতেন তিনি। মা মারা যাবার পর সে-ই ইনারাকে বড় করেছেন।

কিছুক্ষণ পর আবার দরজায় টোকা পড়ে, “ইনারা মা দরজাটা খোল।”
ফুফার কন্ঠ। তার আত্নীয় বলতে কেবল তার ফুফু, ফুপা এবং ফুফাতো বোনই আছে। ইনারার সাথে বাড়িতে তারাই থাকে। কোনো এক অজানা কারণে তার মা’য়ের বাড়ির কারও সাথেই তার সম্পর্ক নেই। কিন্তু তার ফুপুর পরিবার তাকে অনেক আদর করে। বিশেষ করে তার ফুপা। আইজার মতো তাকেও মেয়ের মতো আদর করে তিনি।

ইনারা দরজা না খোলায় ফুফা আবারও বললেন, “মা দরজাটা খুল। দেখ তোর মন ভালো করার জন্য একটা জিনিস নিয়ে এসেছি।”
ইনারা বিছানা থেকে নেমে কুড়কুড় করে যেয়ে দরজা খুলে। চাতক পাখির মতো চেয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমার জোহানের নতুন এলবাম এনেছ ফুফা?”
“না।”
ইনারা মুখ বানিয়ে সাথে সাথে দরজা বন্ধ করতে নিলো আর ফুফা বলল, “তাদের কনসার্টের টিকিট এনেছি।”
সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ফুফার দিকে। তারপর লাফিয়ে উঠে, “কনসার্টের টিকেট। ওয়াও। ফুফা তুমি একদম বেস্ট। কিন্তু এটা তো সোল্ড আউট হয়ে গিয়েছিলো। কীভাবে পেলে?”
“টাকা খাওয়ালে সব পাওয়া যায়। আর সুরভির ভাইও সাহায্য করেছে। আমি গতকালই পেয়েছিলাম তোর ফুপুর ভয়ে বের করি নি। সবে আব্দুল বলল নিচে কি হয়েছে। শুন ভাইয়ের কথা কানে নিবি না। ভাইবোন সব পাগলের দল। এক কান দিয়ে শুনে অন্যকান দিয়ে বের করে দিবে। এভাবেই তো পঁচিশবছর ধরে বিয়ে টিকিয়ে রেখেছি।”

ইনারা মুখ টিপে হাসে। ফুপার কথা থেকে তার কথা বলার ভঙ্গিটা অনেক মজার। ফুপা আরও বললেন, “তিনটা টিকিট। তোর, প্রিয় এবং সুরভীর জন্য। সুরভির ভাই একটা ছেলে ঠিক করেছে। তাকে বললে সে লুকিয়ে তোদের ফিফথ মেলোডির সকল মেম্বারের সাথে দেখা করিয়ে দিবে। তবে ভুলেও যেন কেউ তোদের ধরতে না পারে।”
“আরে ধ্যুর আমার তো কেবল জোহানের সাথে মতলব আছে। বাকি সবাই যাক জাগান্নামে।”
ফুফা ইনারার গাল টেনে বলে, “আমাদের ইনু যা সুন্দরী তোকে একবার দেখলেই সে তোর প্রেমে পাগল হয়ে যাবে।”
“উফফ ফুফা তুমিও না। কথাটা যদিও সত্য, তবুও তার পিছনে মেয়েরা যেভাবে মাছির মতো ঘুরঘুর করে আমাকে নজরে পরবে না’কি সন্দেহ। কিন্তু তোমার জামাইবাবু তো সে-ই হবে।” ইনারা ফুফাকে জড়িয়ে ধরে আবার বলে, “থ্যাঙ্কিউ ফুপা। আপনি একবারে বেস্ট।”
ফুফা হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “দেখতে হবে না ফুপা কার? শুন এখন যাই, নাহলে তোর ফুপু আবার কানের সামনে এসে খ্যাঁ খ্যাঁ শুরু করবে। একদম সুন্দর করে তৈরী হয়ে যা, যেন জোহান একবার দেখতেই প্রেমে পড়ে যায়। আর শুন রাগ মোটেও ভাঙবি না। সবাইকে দেখাবি রাগে তুই আজ সুরভির বাসায় যেয়ে থাকছিস। কনসার্ট মধ্যরাত পর্যন্ত চলবে।”
“ফুফা একটা কথা বলো না তুমি নিজের জোয়ানকালে কত আকাম করেছ? এত বাহানা পাও কীভাবে তুমি?”
“আগে অনেক ভদ্র ছেলে ছিলাম। তোর ফুপুর সাথে বিয়ে হবার পর থেকে এসব বাহানা ভাবতে হয়, নাহলে তোর ফুপু আমাকে বারবিকিউ করে এমনভাবে খাবে যে হাড্ডিও পাবি না।”
ইনারা হাসে। ফুফা যাবার পর সে টিকিটের ছবি তুলে হোয়াটস এপের “থ্রি ইডিয়টস” গ্রুপে দেয়। গ্রুপে সে, সুরভী এবং প্রিয়-ই আছে। সেখানে লেখে, “আজ সন্ধ্যা সাতটায় কনসার্ট। ছয়টার সময় তৈরি হয়ে থাকবি। দেরি হলে কনসার্টের সামনেই আছাড় মারবো। আর সুরভী আমি তোর বাসায় আসছি।”
.
.
“তুই কনসার্টে আসছিস না বিয়ে খেতে?” প্রিয় কপাল কুঁচকে ইনারাকে দেখে বলল। তারা সকলে সুরভির বাসায়। সবে প্রিয় এসেছে। রুমে ঢুকে ইনারাকে দেখে সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। ইনারা আজ সাদা রঙের আনারকলি ড্রেস পরে সেজেগুজে এসেছে। রূপালী রঙের কানের দুল, হাতের চুরি, চোখ ভর্তি কাজল এবং লাল লিপ্সটিক দিয়ে সেজেছে সে। এর পূর্বে সে কখনো ইনারাকে সাজতে দেখে নি। আজ দেখে সে হতভম্ব। সে আরও যোগ করে, “তোকে দেখি আসলেই মেয়েদের মতো লাগে রে।”
“গাঁধা, আমি তো মেয়েই।”
“কিন্তু কখনো তো তা ফিল হতে দেস নি। সারাজীবন তোকে প্যান্ট আর গেঞ্জিতে দেখে এসেছি। তোর তো চুল আঁচড়াতেই আলসেমি লাগে তাহলে আজ এত সাজুগুজু করার কারণ কী?”
“আর কি? জোহান।” সুরভি বলে। সে-ও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজছিলো। সে আবারও বলে, “কিন্তু দোস্ত তুই সাজায় বাচ্চামো চেহেরাটা ঢেকে গেছে। বড় বড় লাগছে। এখন একদম তোর মা’য়ের মতো দেখাচ্ছে। আমার মা তো এখনো বলেন, তার সময়ের সবচেয়ে সুন্দর অভিনেত্রী ছিলো ‘সাইয়ারা আফিয়া’। তোর চেহেরাও অনেকটা তোমার মা’য়ের….” সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার পূর্বেই ইনারা এসে সুরভীর মুখ চেপে ধরে। চোখ রাঙিয়ে বলে, “তোকে বলেছিলাম না ভুলেও কেউ যেন আমার পরিচয় না জানে। তুই ওয়াদা করেছিলি তাও?”
“সরি বাবা ভুল হয়ে গেছে।”

প্রিয় বিছানায় আয়েশ করে শুয়ে বলে, “তুইও আজব। আমার মা যদি অভিনেত্রী সাইয়ারা এবং বাবা পরিচালক মুশতাক হতো তাহলে আমি সারা জগতে বলে বেড়াতাম। সবাই আমাকেই সেলিব্রিটি বানিয়ে দিত।”
“তাই তো আমি চাই না। আমি এমন সাধারণ জীবনেই খুশি। আচ্ছা জলদি উঠ, নাহলে কনসার্টে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। সুরভী, সাঈদ ভাইয়া আমাদের নিয়ে যেতে পারবে না?”
“ভাইয়া নিজে দুইদিন বাসায় আসে নি। কনসার্টের কাজে ব্যস্ত ছিলো।”
“তোর ভাইও একটা জিনিস। নিজে জোহানের সাথে এত বছর ধরে কাজ করছে অথচ আজ পর্যন্ত একবার দেখা করাল না। আমার কত রিক্স নিয়ে ওর সাথে করতে যেতে হচ্ছে। ধরা পরলে আমি শেষ। একদিকে সুরভীর ভাই ওকে বাঁশ দিবে। অন্যদিকে আমার পরিবার জানলে আমার জল্লাদবাপে আমাকে জবাই দিবে। আর যদি পুলিশে দিয়ে দেয়?”
“আর তোকে কে বলছে এত ঝুঁকি নিতে?” প্রিয় জিজ্ঞেস করে।
“বাহরে আমার হবু জামাইয়ের আমি এতটুকু রিক্স নিব না?
“ব্রো এইসব ধোঁকা তো এক দুইদিনের। সে তোরে আসল রুপে দেখলে উল্টো পথে দৌড় দিব।”
ইনারা চোখ রাঙায়, “আর একটা শব্দ মুখ দিয়ে বের করলে তোরে লাত্থায়া লাত্থায়া কনসার্টে নিয়ে যাব।”
.
.
‘ফাইভ মেলোডি’, বাংলা নাম ‘পঞ্চসুর’। দেশের বিখ্যাত গানের দল। এমনকি বিদেশেও তাদের ভালোই চর্চা রয়েছে। পাঁচজন সদস্য নিয়ে দলটি তৈরি। সবচেয়ে জনপ্রিয় সদস্য হলো, সভ্য। তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারে নি। মানুষটা যদি নিজের মধ্যেই একটা রহস্য। কথা বলার ধরণ খুবই রুক্ষ এবং কঠিন। অথচ তার গানের কন্ঠ আবেগী। তার কন্ঠ শুনেই সকলে ভিনদেশে হারিয়ে যায়। সাথে সে সকল ধরণের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু তার বিশেষত্ব গিটার। তার এমন ব্যবহার এবং গানের সুরের কারণে তার প্রতি সকলের আকর্ষণ বেশি। অন্যান্য সকল সদস্যের জনপ্রিয়তা একত্রিত করবার পরও তার সমান হবে না।

দ্বিতীয় সদস্য জোহান। সভ্যের পর গায়কের জন্য তারই স্থান। কোম্পানির মালিকের ছেলে সে। একারণে শুরু থেকেই তাকে নিয়ে চারদিকে গুজব ছড়িয়ে থাকে। অনেকে এটাও মানে তার নিজের বিশেষ গুণ নেই৷ তার বাবার কারণে সে এই দলে আছে। এছাড়াও মেয়েদের নিয়ে নানান গুজবে জড়িয়ে থাকে তিনি। কিন্তু তার নাম সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে থাকার কারণ হল সভ্যের সাথে তার বিবাদের গুজবের কারণে।
তারই বোন ঐশি দলের মহিলা গায়িকা। দলের একমাত্র মেয়ে বলে সবচেয়ে প্রিয় এবং অপ্রিয় সদস্য সে।

চতুর্থ সদস্যের নাম হলো ইরফান। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আজ দেশের সবচেয়ে বড় দলের সদস্য সে। গান লেখা এবং ভায়োলিন, বাঁশি, পিয়ানো বাজানো তার বিশেষিতকরণ। দলের সবচেয়ে শান্ত এবং বুদ্ধিমান সদস্য মানা হয় তাকে।
শেষ সদস্য সামি। দলের সবচেয়ে মজার মানুষ এবং মিশুকও। তার বিশেষত্ব ড্রাম বাজানো।

আজ তাদের বছরের প্রথম কনসার্ট। তাদের প্রথম ঝলক দেখতেই দর্শকবৃন্দরা হৈ-হুল্লোড় শুরু করে দিলো। সকলে নিজের পজিশনে দাঁড়ায় এবং নিজের বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে। প্রথম গান শুরু হয় তাদের। গানটা শুরু হয় সভ্যের মুগ্ধময় কন্ঠ দ্বারা,
” ঝুমঝুমে বৃষ্টি নামে মনের কিনারায়
রাত জেগে আকাশ ডাকে কোন সে ইশারায়
মেঘডুবি কথা বলো চাও কী আমায়?
প্রেমজোয়ারে আসো ভেসে যাই
অনুভবের পৃথিবীতে হারিয়ে যাই
অনুভবে, অনুভবে, তুমি আমার অনুভবে,
অনুভবে, অনুভবে, তুমি আমার অনুভবে রবে….”

গান শুরু হবার পর ইনারা ঢুকতে পায় ভেতরে। চারপাশে কেবল সভ্যের নাম গুঁজছে। ইনারা কপাল কুঁচকে বলে, “সবাই এই কেবল সভ্যের নামের গুণগান গাচ্ছে কেন? চিৎকার করতে হলে আমার জোহানের জন্য করবে।”
সুরভি বলে, “তোর জোহানের পৃথিবী থেকে বের হয়ে এসে দেখ, সভ্যের কন্ঠ অতুলনীয়। আর সে দেখতেই সবচেয়ে বেশি সুদর্শন। হায়, আমার ক্রাশ।”
“আমার জোহান থেকে বেশি সুদর্শন না, বুঝলি?” ধমক দিয়ে বলে ইনারা। প্রিয় বিরক্ত হয়, “তোরা চুপ করবি? আগে সে লোকটাকে খুঁজতে হবে যে আমাদের ব্যাকস্টেজে নিয়ে যাবে। ইনু আমি আগেই বলে দিচ্ছি। আমি আর সুরভি ভেতরে ঢুকছি না। তুই একা যাবি। আর সামলে, কেউ যেন তোকে না চিনতে পারে। বিশেষ করে সাইদ ভাইয়া।”
ইনারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “কোন মুহূর্তে যে তোদের মতো ভীতুদের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিলো। সবকিছুতে ভয় পাস। কোনো সমস্যাই হবে না আমি ঝট করে যেয়ে ফট করে দেখা করে এসে পড়বো।”

যে লোক তাদের ভেতর নিয়ে যায় তার নাম ফারুক। ব্রেকটাইম হবার আগে তার সাথে দেখা করে ব্যাক স্টেজে যায় ইনারা। জোহানের রুমে নিয়ে যেয়ে ফারুক ইনারাকে বলে, “আপা আপনে এখানে দাঁড়ান। স্যারে আসলে বলবেন আপনার কাছে ভিআইপি টিকিট আছে তাই দেখা করতে এসেছেন। স্যার বেশিকিছু জিজ্ঞেস করে না। কথা বলে জলদি এসে পরবেন। অন্যকেউ যেন না দেখে, নাহলে ভিয়াইপি কার্ড চাবে। আমি বাহিরে আছি।”

ইনারা রুমে পায়চারি করছে। আজ, দুইবছর পর সে জোহানের সাথে দেখা করবে। আচ্ছা জোহান কি তাকে চিনবে? ক্রমশভাবেই ইনারার ভীত অনুভূতি বাড়তে শুরু করে। হৃদয়ের স্পন্দন বাড়ে। সে নিজের বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে অনুভব করে বেগতিক স্পন্দন। দরজা খোলার শব্দেই সে স্থির হয়ে যায়৷ খুশিতে নেচে উঠতে মন চাইছে তার। সে পিছনে ফিরে বলে, “জোহান আমি আপনার….” চুপ হয়ে যায় সে সাইদকে দেখে। পাথর হয়ে দাঁড়ায়।

সাইদ প্রশ্ন করে, “আপনি কে জানতে পারি? ব্যাকস্টেজে আসার অনুমতি আছে আপনার কাছে?”
ইনারা এক দুই না ভেবে মুখে ওড়না রেখে হাওয়ার গতিতে দৌড় দিলো। সাইদের পাশ কাটিয়ে দৌড় দিলো। সাইদ পিছন থেকে ডাকতে থাকে তাকে। কিছু সিকিউরিটির লোকও তার পিছনে পড়ে। ইনারা তাদের দেখে চিন্তায় পড়ে যায়। সাইদের হাতে সে পড়লে একদিকে সুরভির সমস্যা হবে অন্যদিকে তার। তার কিছু একটা করতে হবে। সে সিকিউরিটির চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে একটি রুমে ঢুকে পড়ে। দরজা লাগিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আবার পিছনে ফিরতেই তার চোখদুটো বড় বড় হয়ে যায়। চিৎকার করতে নিয়ে নিজেই মুখে হাত রেখে চুপ করায়। তার সামনে সভ্য দাঁড়ানো। তাও খালি গায়ে। শার্ট চেঞ্জ করা অবস্থায়। সে-ও ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ইনারার দিকে। তার বুঝে উঠতে সময় লাগছে যে একটি মেয়ে তার অনুমতি ছাড়া তার রুমে ঢুকে পড়েছে। মুহূর্তেই বিস্ময় রাগে পরিবর্তন হলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করে, “এক্সকিউজ মি,
হু দ্যা হেল আর ইউ? আমার রুমে আসার সাহস কি করে হয়েছে আপনার?”
“আস্তে কথা বলতে পারেন না? গলায় মাইক লাগিয়ে পয়দা হয়েছেন না’কি?”
“পয়দা? এটা কোন ধরনের শব্দ?”
“বাংলা শব্দই। বাংলা বুঝেন না?”
সভ্য রাগে নাক ফুলিয়ে বলে, “আমার অটোগ্রাফ নিতে আমার চেঞ্জিং রুমে ঢুকে পড়েছ, আবার বেয়াদবি করছ?”
“এহ, নিজের চেহেরা দেখছেন? ব্যাঙের মতো চেহেরা নিয়ে অপেক্ষায় আছে আমি তার অটোগ্রাফ নিব৷ শখ কত? আমি আপনাকে দুই চোখে সহ্য করতে করতে পারি না।”
কথাগুলো হজম করতে সময় লাগলো সভ্যের। তার চোখ যেন বিস্ফোরণে কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে
চাইছে, রাগে তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। সে নাক ফুলিয়ে বলে, “গেট আউট।”
“আরে আউট ফাউট আরেকটু পড়ে করেন। সিকিউরিটি আংকেলরা যেয়ে নিক। ততক্ষণ যাস্ট চিল মারো।”
“তুমি কার্ড ছাড়া এখানে….” ইনারা দ্রুত যেয়ে সভ্যের মুখ চেপে ধরে সিকিউরিটির কন্ঠ শুনে।

ইনারা বারবার পিছন দিকে তাকাচ্ছিলো। দেখছিলো রুমের ভেতর কেউ আসছে কি-না। সে সামনে সভ্যের দিকে তাকাতেই খেয়াল করে সে সভ্যের কাছে এসে পরেছে। একটু বেশিই কাছে। তার চোখ চোখ পড়ে তার। হয় প্রথম নয়নবন্ধন।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here