অনুভবে পর্ব-১০,১১

0
1228

অনুভবে
পর্ব-১০,১১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
১০

এখন কী তুমি ভালোবাসার ব্যাখা দিতে বলবে? আমি তা দিতে পারবো না। ভালোবাসা তো কেবল অনুভূতি, তা শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব না। ভালোবাসা তো কেবল থাকে অনুভবে….”
সভ্যের কথায় ইনারা ধ্যান দেয় না তেমন। বলে, “যার অভিজ্ঞতা নেই তার এসব নিয়ে কথা বলা উচিত না।”
“অভিজ্ঞতা করতে হলে অনেকবারই করতে পারতাম। কিছু অনুভূতি অভিজ্ঞতাহীনই মধুর লাগে। ভালো কথা আমি তোমাকে কৈফিয়ত দিচ্ছি কেন? ফোন রাখছি, আগামীকাল সময় মতো এসে পড়বে।”
“দাঁড়ান একটু আমার তদন্ত… মানে জিজ্ঞাসা তো কমপ্লিট করতে দিবেন।”
“তুমি ঘুমাবে না?”
“আমার রাত দুইটার আগে ঘুম আসে না।”
“দুইটা! তাহলে তুমি ঘুমাও কখন?”
“দুইটার পর।”
সভ্য বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোমার মা বাবা জানে না? তারা তোমাকে ঘর থেকে বের করে দেয় নি শুকরিয়া আদায় করো।”
“আমার মা তো নেই, আর বাবা বাসায় সহজে আসে না। তাই কেউ জানে না।”
কথাটা শুনে একপ্রকার ধাক্কা খেল সভ্য, “তোমার মা নেই মানে?”
“আমি যখন এগারো বছরের ছিলাম তখনই মা মারা গেছে।”
অনেকক্ষণ ধরে চুপ থাকে সভ্য। কি বলবে বুঝতে পারে না। ইনারা এত স্বাভাবিক ভাবে কথা বলার ধরনেও সে লুকানোর উদাসীনতা আভাস করতে পারছে।

সভ্যের উওর না পেয়ে ওপাশ থেকে ইনারা বলে, “কি হলো শুনছেন?”
“হুম।” নরম সুরে বলে সভ্য।
“তাহলে কথা বলেন না কেন?”
“তোমার বাবাও বাসায় আসে না?”
“আসে, মাঝেমধ্যে। কাজ অনেক থাকে তো। আর এসব বাদ দিয়ে সত্যি বলেন না আপনি আসলে কোনো সম্পর্কে ছিলেন না?”
ইনারার কথার পর সভ্য আর তার সাথে ঝগড়া করতে চায় না। একথাটা খানিক সময় আগে বললেও সে রাগ দেখাতো, রুক্ষভাবে কথা বলতো। কিন্তু এখন সে তা পারছে না। তাই সে সরল ভাষায় উওর দেয়, “না।”

উওরে মজা পায় না ইনারা। তার এই রাত বেরাতে সভ্যের সাথে ঝগড়া করতে মন চাইছে। কিন্তু সভ্যের এমন কোনো নিয়ত দেখতে পায় না ইনারা। তাই আবার খোঁচা মেরে বলে, “হবেও না। আমার জোহানের মতো হলে তো হবে। কোন মেয়ে আপনার মতো ভূতকে জেনেশুনে মাথায় নিয়ে ঘুরবে?”
“গিটার শুনবে?”
ইনারা অবাক হয়। হঠাৎ সভ্যের আচরণে এত পরিবর্তন কীভাবে এলো? তার চেয়ে বেশি দুঃখ হয়ে যে সভ্য তার সাথে ঝগড়া করছে না। কিন্তু সে গিটার শোনার লোভে অন্যকিছু বলে না। সংগীতের প্রতি আলাদা একটা দুর্বলতা আছে। যখনই তার মন খারাপ হয়, সে গান শুনে। হঠাৎ কেমন করে কিভাবে যেন তার মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠে।

সভ্য গিটার বাজানো শুরু করে। মধ্যরাতের নীরবতার মাঝে ফোনের ওপারে গিটার বাজানো শুনার মাঝে কি কোনো জাদু আছে? নাহয় ইনারার এমন কেন মনে হচ্ছে যে সে অন্যকোনো জগৎ-এ হারিয়ে গেছে। কানে হেডফোন লাগিয়ে দোলনায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল ইনারা। গিটারের সুর তার হৃদয়ে প্রশান্তি ছড়িয়ে দিলো। তার ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে এলো তার। অনেকক্ষণ ধরে সে এভাবে বসে থাকলে একটা কখন যে ঘুমিয়ে গেল টের পেল না।

সে ঘুম থেকে উঠে ভোরে। সূর্যের প্রথম রশ্মি চোখে পরতেই সে হড়বড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে সভ্য কল কেটে দিয়েছে অনেক আগেই। সে বিছানায় যেয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আর তার ঘুম আসে না।

আজ অফিসের পরিবর্তে সভ্যের বাসায় যাবার কথা। সে আজ সঠিক সময়ে যেয়ে পৌঁছায়। কলিংবেল দেবার অনেকক্ষণ পর দরজা খুলে সভ্য। সে চোখ ঢলে ভালো করে তাকায় ইনারা দিকে। ঘুমন্ত গলায় বলে, “তুমি?”
“আপনি এখনও ঘুমাচ্ছেন? জিমে যান নি?”
“আজ আমার ছুটির দিন। তুমি এত তাড়াতাড়ি এলে কেন?”
“আপনি তো বললেন আটটার দিকে আসতে।”
“তুমি এত দেরি করো সবসময়ই একারণেই বলেছি। আচ্ছা তুমি সোফায় যেয়ে বসো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”
সভ্য যাবার পরে ইনারা বসলো না। সে ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখতে শুরু করলো। এক বেড, ড্রইং, ডাইনিংরুমের ফ্লাট। প্রতিটা রুমের থিম অন্যরকম। সভ্যের বেডরুম সাদা-কালো এবং সাধারণ। অথচ তা ড্রইংরুম রঙিনে সাজানো। নীল রঙের সোফা, শোপিজও রঙিন এবং রুমে কতগুলো বড় রঙিন পেইন্টিং আছে, যা দেখতে অসম্ভব সুন্দর। অন্যদিকে ডাইনিং রুম কেবল কাঠ রঙের থিমে করা। ইনারার সবচেয়ে বেশি আজব লাগলো সব থিম আলাদা হওয়া সত্ত্বেও বাজে লাগছে না। উল্টো সুন্দর দেখাচ্ছে। ইনারা খুঁজেও সভ্যের পরিবারের কোনো ছবি পেল না।

সভ্য ডাইনিং রুমে এসে দেখে ইনারা সেখানে ঘুরঘুর করছে। সভ্য রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, “এভাবে কি দেখছ?”
“আপনার পরিবারের কোনো ছবি রাখেন নি কেন?”
“সারাক্ষণ জোহান জোহান করো, তাহলে তার পরিবারের খোঁজ রাখো। আমার পরিবারে দিয়ে তুমি কি করবে?”
ইনারা মুখ বানায়। ভেংচি কেটে বলে, “একটু বললে কি হয়?”
“ছয় বছর ধরে ঐশি এবং সামির সাথে বন্ধুত্ব আছে, ইরফানের সাথে তিনবছরের বন্ধুত্ব। আজ পর্যন্ত ওদের বলিনি, তোমাকে বলব?”
“আচ্ছা আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে নি কোম্পানিতে সাইন করার পূর্বে?”
“আমি নিজে দলে যুক্ত হবার জন্য প্রস্তাব দেই নি। মিঃ হক নিজে আমার পিছনে একবছর ঘুরে দলে আসার জন্য মানিয়েছেন। কিছু শর্ত দিয়েছিলাম। এর মধ্যে একটি শর্ত আমার পরিবারের সম্পর্কে ঘাটাঘাটি করা যাবে না।”
ইনারা কুড়কুড় করে সভ্যের পাশে দাঁড়ায়। চোখ দুটো ছোট করে তাকায় তার দিকে, “আপনার পরিবার কি মাফিয়ার না’কি? নাহলে এত লুকাচ্ছেন কেন আপনি? কুছ তো গারবার হে।”
সভ্য বিরক্ত হয়ে তাকায় ইনারার দিকে, “টিভি কম দেখো। টিভি দেখে দেখে এসব ফালতু জিনিস মাথায় ঢুকিয়ে রাখো।”
“কোনো কারণ না থাকলে আপনি নিজের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করান নি কেন?”
“তোমারও তো ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা হয় নি। সাইদের উপর বিশ্বাস করে না করাটা ভুল হলো। একবার করা উচিত তাই না? কী বলো?”
ইনারা খানিকটা বিচলিত হয়ে উঠে। সভ্য বলে, “তোমায় একটুখানি ব্রেনে কি চলে আমি ভালোমতো বুঝতে পারছি। উপদেশ দিচ্ছি, অকারণে আমার পরিবার সম্পর্কে খোঁজ করে নিজের সময় নষ্ট করবে না। কিছু তো পাবেই না, উল্টো নিজের চাকরিটা হারাবে।”
“আপনি কথায় কথায় আমাকে চাকরি থেকে বের করে দেন ধমক দেন কেন?”
“ধমক? আমি আসলেই বের করতে পারি।”
” আমি আপনার চাকরি করার জন্য মরে যাচ্ছি না। কেবল জোহানের জন্য আছি, আপনার চেহারা দেখে দিন খারাপ করার আমার কোনো শখ নেই।”
সভ্য ভ্রু কুচকে তাকায় ইনারার দিকে, “তোমার না পরিবারে অভাব দেখে তুমি চাকরি করতে এসেছ?”
“উফফ দুটো মিলিয়েই তো। আগেরটা আপনি জানেন আমি ওটা আবার কেন বলবো?”
“আচ্ছা এখন চুপচাপ সেখানে যেয়ে বসো। আমার মাথা খেও না।”
“কোনো কাজ দেন না আমি করি।”
“তুমি না’কি পানিও গরম করতে পারো না, কি কাজ করবে।”
“আরে একবার বলেনতো ইনারাকে দিয়ে কোন কিছুই অসম্ভব না।”
“আচ্ছা পিছনের কেবিনেট থেকে আটার ডিবা বের করে আনো।”
ইনারা কথামতো পিছনের কেবিনেট থেকে আটার ডিবা বের করতে নেয়। কিন্তু তার জন্য অনেকটা উঁচু হয়ে যায়। সে পায়ের পাতায় ভর দিয়ে ডিবায় পৌঁছানোর চেষ্টা করে। হাত পৌঁছাতেই সে ডিবাটা নিতে যেয়ে তার উপরই পরে যায়। তার মাথায় উপর ডিবাটা পরতেই সে শব্দ করে উঠে।

শব্দ শুনে সভ্য পিছনে ফিরে দেখে আটার ডিবা নিচে পরা। আটা মেঝেতে ছাড়ানো। সে চোখ তুলে ইনারার দিকে তাকায়। দেখে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। শব্দ করে হেসে দেয়। ইনারার চুলে, মুখে, জামায় আটা ভরে আছে।
সভ্য তাকে এই অবস্থায় দেখে হাসতে হাসতে কাহিল। বহু কষ্টে সে হাসি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে বলে, “তুমি গতকাল আমাকে ভূত করে ডাকছিলে তাই না? এখন দেখো, তোমাকে একদম ভূতের মতো দেখাচ্ছে।”
“হাসবেন না বলে দিচ্ছি।”
“তোমাকে এত ফানি দেখাচ্ছে না হেসে পারা যায়? ”
” তাই না?” ইনারা মেঝে থেকে একমুঠো আটা নিয়ে সভ্যের সামনে এসে তার মুখে মাখিয়ে দিলো। আবার বলল, “এবার নিজেকে আয়নায় দেখে হাসুন। আপনাকে আরও ভয়ংকর লাগবে।”
সভ্য রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তোমার সাহস কত বড় হলে…”
সভ্যের কথা শেষ হবার পূর্বেই ইনারা ভয়ে দৌড় দেয়। সভ্য যায় তার পিছনে, “এই মেয়ে তুমি দাঁড়াও। তোমাকে আমি আজ ছাড়বো না।”

ইনারা দৌড়াতে দৌড়াতে বলে, “আপনি এত বড় সেলিব্রিটি হয়ে আমার মতো সাধারণ মেয়ের পিছনে এভাবে দৌড়াচ্ছেন। মানায় আপনাকে?”
“সেলিব্রিটি মাই ফুট। তোমাকে আজ আমি ছাড়ব না। আমাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছ তুমি।”
“আমি জ্বালিয়েছি? আপনি দুইদিন ধরে আমাকে কাজ দিয়ে জান ছাড় ছাড় করে ফেলছেন।”
“এই মেয়ে তোমাকে বলেছি না সুন্দর ভাবে কথা বলবে আমার সাথে?”
“এখন দৌড়ে আপনার থেকে বাঁচবো, না-কি সুন্দর ভাষার ডিকশিনারির খুলে বসবো?”
ইনারা হাঁপিয়ে ওঠে দৌড়াতে দৌড়াতে। তার গতি কমে আসে৷ রান্নাঘর থেকে বেডরুমে তিন চার চক্কর লাগানোর পর অবশেষে ইনারাকে নাগালে পায় সভ্য। তাই পিছন থেকেই ধরে নেয়। বলে, “এবার কোথায় যাবে শুনি।”

ইনারা কম কিসের? সে হাওয়ায় পা নাচাতে থাকে। নড়তে থাকে। পিছনে ফিরে সভ্যের বুকে মারতে শুরু করে। হাতাহাতিতে পা পিছলে দু’জনেই মেঝেতে পড়ে যায়।
তবুও দুইজনে একে অপরের উপর রাগ দেখাতে চায়৷ থেমে যায় দু’জন। এতক্ষণের লড়াইয়ে একজনও খেয়াল করে নি এরা একে অপরের কতটা কাছে!

সভ্য চমকে উঠে এই ঘটনায়। সে ভাবে নি তাদের ঝগড়ার মাঝে এমন কিছু হয়ে যাবে। ইনারা তার বুকের উপর এসে পরে। ইনারার চোখে চোখ পড়ে তার। হয় মধুর নয়নবন্ধন। ব্যালকনির হাওয়া এসে তার স্বর্ণোজ্জ্বল কেশ এলোমেলো করে দেয়। তার মুখ এসে ছুঁয়ে যায় ইনারার কেশ। তবুও সে চোখ সরায় না ইনারার চোখ থেকে। তাকিয়ে থাকে। কেমন নীলচে ভাব তার সে দু’চোখে। তার দূর থেকে বুঝা যায় না, কিন্তু এতটা কাছে এলে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। তার চোখ দুটো যেন কেমন! যেন গাঢ় কোনো সাগরের জলের মতো।

ইনারা সংকোচিত হয়ে যায়৷ সে ঠিক সভ্যের উপর পড়েছে। সভ্যের বুকেতে। সভ্যের নিশ্বাসের উষ্ণতা পাচ্ছে সে৷ একটি ছেলে তার এতটা কাছে ভাবতেই কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে। এক ঢোক গিলে। ভীষণ লজ্জায় পড়ে যায় সে। দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। লজ্জায় আর একটিবারও তাকাতে পারে না সভ্যের দিকে। তার ফর্সা গালদুটো লালচে হয়ে যায়।

সভ্যের অবস্থাও অনেকটা এমন। সেও আর তাকাতে পারে না ইনারার দিকে। অস্বস্তি ছড়িয়ে যায় বাতাসের আছে। সে গলা পরিষ্কার করে নরমসুরে বলে, “তোমার জামা কাপড় আটা ভরে গেছে। রুমে যেয়ে পরিষ্কার করে নেও।”
“হুম।”
ইনারা দৌড়ে সেখান থেকে পালায়। কেমন অস্বস্তি জড়িয়ে ধরে তাকে। যেন তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সভ্যের রুমের ওয়াশরুমে যেয়ে আয়নাতে নিজেকে দেখে। তার গাল দুটো লালচে হয়ে গেছে। আচ্ছা সভ্য তার গাল দেখে নি তো? দেখলে কি না ভেবে বসে। সে নিজেকে পরিষ্কার করে বাহিরে যায়। সেখানে যেয়ে দেখে আগের থেকেই ডাইনিংরুমে সামি এবং ইরফান বসা। সামি জিজ্ঞেস করে, “গুড মর্নিং পার্টনার। তুমি কখন এলে?”
“কিছুক্ষণ আগেই। এসে দেখি মিঃ অসভ্য ঘুম থেকেই উঠে নি। অথচ আমাকে প্রতিদিন সকাল সাতটায় উঠে আসতে বলে। কী নির্দয় তোমার বন্ধু!” সে ইরফানের দিকে আবার তাকিয়ে বলল, “আপনি কি অসভ্যের থেকেও কম কথা বলেন?”
মৃদু হাসে ইরফান, “কম না। তবে ও সম্ভবত সভ্য তোমার সাথে বেশি কথা বলে। তাই না সভ্য?”
সভ্যের নাম শুনে ইনারা তার পিছনে তাকিয়ে দেখে সভ্য নাস্তার প্লেট নিয়ে আসছে। সভ্যকে দেখতেই ইনারা চোখ ফিরিয়ে নেয়। সভ্যের ক্ষেত্রেও তাই।

সভ্যের পিছনে আসছে আরেকটি মধ্যবয়সী মহিলা। সামি তার সাথে পরিচয় করায় ইনারাকে, “ইনারা ইনি হলেন আন্টি শোভা। উনি এবং উনার সাথে কয়েকজন কর্মী আমাদের ফ্লাট পরিষ্কার করে।”
ইনারা তার সাথে পরিচিত হয়। সভ্য তার সামনে একটি প্লেট দিতেই ইনারা মৃদু স্বরে বলে, “আমি আ-আসলে বাসা থেকে খেয়ে এসেছি।”
“ওহ, আচ্ছা। খিদে লাগলে পরে খেও।”
একে অপরের দিকে তাকানো তো দূরের কথা কথাও বলে না। দুইজনে চুপচাপ বসে থাকে। সভ্যের ক্ষেত্রে তা স্বাভাবিক হলেও ইনারার এই ব্যবহার হজম করতে পারে না সামি। সে ভ্রু কপালে তুলে বলে, “কিছু হয়েছে?”
ইনারা ঘাবড়ে যায় সামির প্রশ্নে, “কী হয়েছে? কী হবে? না, কিছুই তো হয় নি।”
সন্দেহের দৃষ্টি আরও গাঢ় হয় সামির, “কিছু তো হয়েছে। তোমার মুখ দেখে যেকেউ বলতে পারবে। তোমার এবং সভ্যের ভেতর কিছু হয়েছে। কতক্ষণ থেকে দেখছি, একে অপর থেকে দৃষ্টি লুকাচ্ছো। দুইজনে সামনা-সামনি বসা কিন্তু ঝগড়া করছো না। এটা তো অস্বাভাবিক। আর চুপ বসে আছো এটা আরও অস্বাভাবিক। বলো কী হয়েছে? নিজের পার্টনারকে বলবে না?”
সভ্য টোকা মারে সামির মাথায়, “এই পার্টনারগিরি বেশি করতে গেলে তোমার কি অবস্থা করব নিজেও বুঝতে পারবি না। চুপচাপ বসে খাওয়া শেষ কর। খাবারের টেবিলে বসে কথা বলা আমার পছন্দ না।”
সামি আর কিছু বলে না। মুখ ফুলিয়ে খেতে থাকে।

খাবারের মাঝে কলিংবেল বাজে। শোভা আন্টি যেয়ে দরজা খুলে। সাইদ প্রায় দৌড়ে ঢুকে বাসায়। ভেতরে ঢুকেই সভ্যকে জিজ্ঞেস করে, “আর ইউ ওকে?”
“আমার কি হবে? আর তুমি আজ ছুটির দিনে এখানে কীভাবে? আরও এই এই অবস্থায়!”
“সোশ্যাল মিডিয়াতে তোমার নাম ট্রেন্ডিং এ চলছে। তুমি কিছু জানো না?”
সামি বলে, “এটা তো প্রতিদিনই হয়। সভ্য এত জনপ্রিয়, ট্রেন্ডিং হওয়াটা স্বাভাবিক। এখানে এত অস্থিরতার কী আছে ব্রো?”
“গতকাল কোম্পানির কোন মেয়ে যেন সভ্যের নামে কোন গ্রুপে পোস্ট করেছে সে কোম্পানিতে চাকরি করে এবং কাজে সভ্য তাকে জ্বালাতন করছে। আই মিন শারীরিক… আমি কীভাবে বলি! মানে উত্ত্যক্ত করার কথা উঠেছে। এ নিয়ে রাতারাতি অনেক কথা ছড়িয়ে গেছে। অনেকে নানান ধরনের কথা বলছে। এই কথা মিঃ হকের কানে গেলে অনেক বড় সমস্যা হতে পারে৷ এমনকি জনগণ তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তোমার ক্যারিয়ার নষ্ট হতে পারে।”

ইনারা চমকে উঠে। গতকাল সে রাগে জোহানের সদস্য দলে এমন পোস্টই করেছিলো। কিন্তু সে বুঝে নি এত বড় কোনো ঘটনা ঘটতে পারে। এমনকি সে এভাবে কিছুই লিখে নি। তাহলে কীভাবে এক ছোট সাধারণ পোস্ট এত বড় ঘটনায় পরিবর্তন হলো?

চলবে…..

অনুভবে
পর্ব-১১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ইনারা চমকে উঠে। গতকাল সে রাগে জোহানের সদস্য দলে এমন পোস্টই করেছিলো। কিন্তু সে বুঝে নি এত বড় কোনো ঘটনা ঘটতে পারে। এমনকি সে এভাবে কিছুই লিখে নি। তাহলে কীভাবে এক ছোট সাধারণ পোস্ট এত বড় ঘটনায় পরিবর্তন হলো?

ইরফান গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে, “মানে কী? সভ্য এমন কিছু করতে পারে না তা আমরা সবাই জানি।”
“আমরাও জানি। আমরা নিজ চোখে দেখেছি। কিন্তু জনগণরা দেখে নি।”
“তাই বলে কি যা তা ছড়াবে?” আঁতকে উঠে সামিও। সে উঠে দাঁড়িয়ে উঁচু স্বরে বলে, “ঠিক আছে আমরা পাব্লিক ফিগার। সবার আমাদের নিয়ে অভিমত প্রকাশ করার অধিকার আছে কিন্তু আমাদের গান নিয়ে তারা মত দিক। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কেন? ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাটাঘাটি তাও বুঝতে পারি কিন্তু এমন মিথ্যা খবর নিয়ে কীভাবে তারা একজনের চরিত্রে প্রশ্ন তুলতে পারে? আর ওই মেয়েটা কে যে এই পোস্ট করেছে?”
“আমি সোজা এখানে এলাম। মেয়েটার খোঁজ করার সুযোগ পাই নি। এখনই করছি। তাকে যথাযথ শাস্তি দেওয়া হবে।”

ইনারা গতকাল রাতের ব্যাপারটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সামি এবং ইরফানের এমন রাগ দেখেই সে চুপ হয়ে যায়। তারা দুইজন এমন রাগ দেখালে সভ্য তার সাথে কি করবে? ভয় লাগতে শুরু করে তার। যেন দম আটকে আসছে। সে ভয়ে ভয়ে তাকাল সভ্যের দিকে। দেখে সভ্য তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ইনারা সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নেয়। তার সভ্যের সাথে দৃষ্টি মেলানোর সাহস নেই। তার বিশ্বাস হচ্ছে না তার এইটুকু এক পোস্টের কারণে সভ্যের ক্যারিয়ার নষ্ট হতে পারে। দিনে হাজারোজন এমন পোস্ট করে কাওকে বকে, ঘৃণা করে। সে-ও আগে জোহানের পক্ষ নেবার জন্য এমন অনেক পোস্ট করেছে সভ্যের বিরুদ্ধে। অবশ্যই ব্যক্তিগত দিক থেকে না। তাকে বকা দিয়ে। তবে আজ এমন কেন হলো? মাথায় কিছু ঢুকছে না তার। আজ প্রথম সে সাহস দেখিয়ে নিজের দোষ স্বীকার করার ক্ষমতাও রাখছে না।

হঠাৎ সভ্য বলল, “প্রয়োজন নেই। মেয়েটার খোঁজ করার পূর্বে প্রধান পোস্ট খুঁজে বের করো যে এই আরোপ লাগিয়েছিলো। এখানে এত হাইপার হবার কিছু নেই। একটা তুচ্ছ কোনো বিষয়কে বড় বানিয়েও মানুষ সমালোচনা করবে এটাই স্বাভাবিক। মেয়েটাকে খুঁজে সময় না নষ্ট করে বিষয়টা পরিষ্কার করো।”
সামি বলে, “কিন্তু সে তোর নামে…”
“সাইদ আমি যা বলেছি তা করবে।”
“ঠিকাছে।”
“এখন সবাই চুপচাপ বসে খাও। সাইদ তোমার জন্য নাস্তা বানাতে বলবো?”
সাইদ খানিকটা অবাক হওয়া ভঙ্গিতে বলে, “না, প্রয়োজন নেই।”

নাস্তা শেষে সামি এবং ইরফান ড্রইংরুমেই তাদের পরবর্তী এলবামের ব্যপারে আলোচনা করতে শুরু করে। সাইদ চলে গেছে। ইনারা দেখে সভ্য আশেপাশে কোথাও নেই। রান্নাঘরে উঁকি মারে সে। সেখানে দুইজন মহিলা কাজ করছিলেন। সভ্য নেই। জিজ্ঞেস করায় জানতে পারে সে কফি নিয়ে তার রুমে গেছে। সে সভ্যের রুমে যায়। দেখে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে সভ্য। আসমানের দর্শন করতে করতে কফিতে চুমুক দিচ্ছে সে। ইনারার খুবই সংকোচবোধ হয়। ভয়ও লাগে। সে এত বড় এক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। এতক্ষণ ধরে সে নিজেকে মানালো। বুঝালো যে ভুল করলে তা স্বীকার করার সাহস রাখা উচিত। এরচেয়ে বড় সাহসের প্রমাণ আর হয় না। অন্তত তার মা তাকে এটাই শিখিয়েছে। তাই সভ্যের কাছে সে নিজের দোষ স্বীকার করতে এসেছে।

ইনারা সভ্যের পাশে যেয়ে দাঁড়ায় মাথা ঝুঁকিয়ে। ভয়ে হাতের আঙুল নিয়ে খেলা করছে সে। সে কাঁপা-কাঁপা বলায় বলে, “প্লিজ বেশি রাগ করেন না। আমি পোস্টটা করেছিলাম কিন্তু সত্যি বলছি আমি এমন কিছু লিখি নি যে, আপনি আমার সাথে বাজে কিছু করার চেষ্টা করছেন। আপনি চাইলে আমি আপনাকে পোস্ট দেখাতে পারি। আমি সত্যি আপনার ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে কিছু করি নি।”
“আমি জানি।”

সভ্যের উওরে অবাক না হয়ে পারে না ইনারা। সে বিস্মিত গলায় বলে, “আপনি জানেন?”
“সাইদের কথাটা বলার সময় তোমার মুখ দেখেই বুঝে নিয়েছি।”
ইনারা এবার কেঁদেই দেয় শব্দ করে, “আমি আসলে তা লিখি নি। বিশ্বাস করেন। আমি এত বড় অপবাদ দেওয়া তো দূরের কথা কারও এত খারাপ চিন্তাও করতে পারি না। ভুল হয়ে গেছে। সরি।”
আরও শব্দ করে কেঁদে উঠে সে।

সভ্য হতভম্ব। ইনারার কান্না দেখে সে কিছু মুহূর্ত অবুঝের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর ইনারাকে চুপ করানোর জন্য বলল, “আমি জানি তুমি তেমন কিছু লেখ নি। এখন ইন্দুরনীর মতো তোমার এতটুকু ব্রেনে এত কঠিন ব্যাপার তো আসবে না।”
ইনারার কান্না আরও বাড়ে, “আমার জন্য আপনার ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যাবে। আমি এখন কি করবো? আম্মু…”
সভ্য উপায় না পেয়ে ইনারার মুখ চেপে ধরে। বলে, “গলা একটা মাইকের মতো। আশেপাশের সবাইকে ডেকে আনবে না’কি? কান্না বন্ধ করো। আমি একবারও তোমার দোষ বলেছি?”
ইনারার কান্না কমে একটু। সে তাকিয়ে থাকে সভ্যের দিকে। মধুর নয়নবন্ধনের মুহূর্তে দক্ষিণা শীতল বাতাস ছুঁয়ে যায় তাদের। সভ্য ধীরে ধীরে হাত নামায়। কান্নায় ইনারার চোখ, নাক, গাল, ঠোঁট সব গোলাপি হয়ে গেছে। চোখের পলকে জল জমেছে। কেমন মায়াবী দেখায় তাকে। কান্না করলে কাওকে এতটা মায়াবী দেখাতে পারে তার জানা ছিলো না।

ইনারা ঠোঁট উলটে বাচ্চাদের মতো করে বলল, “আপনি চিন্তা করেন না। আমি প্রমাণ করেই ছাড়বো আপনি নির্দোষ। আপনার ক্যারিয়ারের কিছু হবে না। আই প্রমিজ।”
বহু কষ্টে হাসি থামায় সভ্য, “তুমি পিচ্চি একটা মেয়ে কি করবে শুনি।”
“আমি পিচ্চি না।”
“আয়না দেখাব? বাচ্চাদের মতো কাঁদছ। আচ্ছা শুনো,” সভ্য খানিকটা ঝুঁকে তার গালে মুছে দিয়ে বলে, “থাক এখন আর এভাবে কাঁদতে হবে না। আমি সব সামলে নিব। তুমি চিন্তা করো না। এসব ব্যাপার না। আজকাল একটুখানি নাম হলেই মানুষ তাকে নিয়ে সমালোচনা করতে ভালোবাসে। মানুষ মানুষকে অকারণেই ঘৃণা করতে ভালোবাসে। কারণ ঘৃণা করাটা ভালোবাসা থেকে সহজ। এসব নিয়ে মাথা ঘামালে মিডিয়া জগৎ-এ আসা উচিত না।”
“কিন্তু আমিও তো আপনাকে হেইট করেছি। আপনার জন্য গতকাল পোস্ট দিয়েছি। আমার কারণে… ”
”উফফ আবারও এক কথা। বললাম তো সব ঠিক করে নিব। কান্না বন্ধ কর তো। বিরক্ত লাগছে।”

ইনারার কান্না আরও বাড়ে। সে সভ্যের বুকে মেরে বলে, “সব আপনার দোষ। আপনি আমাকে এত জ্বালিয়েছেন কেন? আপনার জ্বালায় আমি মেজাজ খারাপ করে পোস্ট করে ফেলেছি।”
ধমক দিয়ে উঠে সভ্য, “তোমার সাহস কত তুমি আমার উপর হাত তুলেছ?”
আরও বেশি কান্না করে দেয় ইনারা। সভ্য বিরক্ত হয়, আবার তার মায়াও লাগে। এক কথা এতবার বুঝানোটা তার কাছে আসলেই বেশ বিরক্তিকর। কিন্তু ইনারার এমন কান্না দেখে তার খানিকটা মায়াও লাগছে। সে বলে, “আচ্ছা ঠিকাছে বকা দিব না আর। কান্না বন্ধ করো।”
“আপনি এখনো আমাকে ধমক দিচ্ছেন।”
“আর দিব না।”

ইনারা কান্না থামায়। সভ্যকে জিজ্ঞেস করে, “সত্যি আপনার বড় সমস্যা হবে না তো?”
সভ্য মাথা নাড়ায়। উওর না। আরও বলে, “আর তোমাকে কাওকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আসল পোস্টের স্ক্রিনশট কেবল আমাকে দেও। আমি সাইদকে পাঠাচ্ছি।”
“আপনি তো আমার থেকে চরম রকমের বিরক্ত তাহলে কেন আমাকে সাহায্য করছেন?”
সভ্য বারান্দায় রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তার দু’পকেটে হাত ভরে আর বলে, “দু’টো কারণ। এক, তোমাকে জ্বালিয়ে আমার ভালোই টাইমপাস হয়। দুই, এই’যে তুমি প্রথমদিন আর আজকে কান্ড করলে তার শাস্তি কিস্তিতে দিব না?”
ইনারার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়, “কিন্তু আপনি বলেছেন আমার কোনো দোষ নেই।”
“এত বড় সমস্যায় তোমার দোষ না থাকলেও তুমি আমার বিরুদ্ধে একতো পোস্ট করেছ, আমাকে মেরেছ, এর উপর কানের সামনে এসে ভ্যা ভ্যা করে আমার মাথা ধরিয়ে দিয়েছ। ” সভ্য ইনারাকে তার খালি কফির মগ দিয়ে বলল, “যাও শোভা আন্টিকে বলো কফি দিতে। নিয়ে আসো।”
ইনারা কতক্ষণ রাগে মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে থাকলো। তারপর কফির মগ নিয়ে বলল, “আমি অকারণে আপনার জন্য খারাপ অনুভব করছিলাম। আপনি… আপনি আস্ত এক অসভ্য!”
“কি বললে তুমি?”
ইনারা দৌড়ে পালায় সেখান থেকে। তার এমন পালিয়ে যাওয়া দেখে সভ্য হেসে দেয়। পিছনে ফিরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “মেয়েটা সত্যিই একটা জিনিস। বিরক্ত করার নতুন নতুন পদ্ধতি কোথা থেকে বের করে আনে বুঝি না।”
.
.
ইনারা সভ্যের কথায় স্বস্তি পায় তাই আগের মতোই হাসিখুশি ঘুরে বেড়াতে থাকে। কতগুলো ফাইল এনেছিলো তার কাজ শেষ করে। সামি এবং ইরফান ব্রেক নেবার পর তাদের সাথে যায় বাসায়। সাথে সভ্যকেও টেনে নিয়ে যায় সামি। তাদের বাসাও প্রায় সভ্যের মতো। কেবল অতিরিক্ত একটা বেডরুম রয়েছে। সামির রুমে অনেকটা ভরা। বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত গায়কদের এলব্যাম, ম্যারচেন্ডাইজ, ফটো এলবাম আছে। এমনকি তাদের ছবিও দেয়ালে লাগানো। অন্যদিকে ইরফানের রুম একদম সাধারণ। চারদিকে কেবল বই এবং বাদ্যযন্ত্র। তার রুমে বিছানা, আলমারি, বুকশেলফ এবং টেবিল ছাড়া তেমন বিশেষ কিছু নেই। কেউ দেখে বলবেই না এটা দেশের সবচেয়ে বড় ব্যান্ডের সদস্যের রুম।

ইনারা রুম দেখে বলে, “আমার তো রুমে ঢুকতেই মাথা ঘুরান দিয়ে উঠে। এটা কি আপনার রুম না লাইব্রেরি?”
“জীবনে লাইব্রেরীর চেহেরা দেখেছ?” ইনারাকে প্রশ্ন করে সভ্য।
এটা সত্য যে ইনারা আগে কখনো লাইব্রেরিতে যেয়ে পড়ে নি কিন্তু সভ্যের কথায় তো সে একমত হতে পারে না। এখন সভ্য তো আর এটা জিজ্ঞেস করে নি যে গিয়ে পড়েছ কি-না। তাই সে বলে, “যাই নি আবার? অনেকবার গিয়েছি।”
“গিয়ে কি করেছ?”
ইনারা আমতা-আমতা করে বলে, “বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছি।”
“তোমার মুখ দেখেই বুঝা যায়। বইয়ের সাথে তোমার সাত জনমের শত্রুতা আছে।”
ইনারা প্রতিরক্ষা করে বলে, “দেখুন আমার ইজ্জত মারার চেষ্টা করবেন না। বইয়ের সাথে সদা যুদ্ধ লেগে থাকলেও আমার রেজাল্ট ভালো হয়। সবসময় ভালো হয়। এইবারও এইচএসসিতে এ-প্লাস আসবে দেখে নিয়েন।”
“সব ঠিক আছে। এই ইজ্জত মারাটা আবার কী?”
“ইজ্জত মারা বুঝেন না। আহারে…. ইজ্জত মারা মানে ইজ্জত ছারখার করে দেওয়া।”
“ছাড়খার আবার কী?”
ইনারা আফসোসের নিশ্বাস ফেসে সামির কাঁধে হাত রেখে তার কানে ফিসফিস করে বলে, “বুঝদার মানুষকে তাও বুঝানো যায়। এমন নির্বোধকে কী বুঝানো যায়?”
আবার সে তাকায় সভ্যের দিকে, “ছাড়খার মানে ত্যানা ত্যানা করে দেওয়া।”

আশাহত ভাবে সভ্য বলে, “তোমাকে কোন স্কুলে এসব ভাষা শিখিয়েছে জানতে খুব ইচ্ছে করছে।”
“আপনি শিখবেন? চাইলে আমি শিখাতে পারি। কেবল আপনি বেতন হিসেবে প্রতিদিন সকালে একবার এবং রাতে একবার বলবেন, ‘ইনু তুমি মহান। তোমার মতো সুন্দরী, বুদ্ধিমান এবং সাহসী আর কেউ নেই।”‘

সভ্য বিরক্তর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ইনারার দিকে। তারপর বলে, “তোমার ইচ্ছা আমি এই জীবনের সব মিথ্যা একসাথে বলব?”
ইরফান এবং সামি হেসে দেয় এ কথায়। সভ্য আবার বলে, “আমি গেলাম। এ বাসায় থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।”

“ওর ওসিডির রোগে আবার ধরেছে তাই চলে গেছে।” সামি সভ্য যাবার পর কথাটা বলে। আবার ইনারাকে বলে, “ডোন্ট ওয়ারি পার্টনার ওর মুখ দিয়ে যখনই কথা বের হয়, কঠিনই বের হয়। কিন্তু ওর আসল মতলব তা থাকে না।”
ইনারা মুখ ফুলিয়ে ছিলো। সে বিড়বিড় করে বলে, “অসভ্যটা ব্যবহার দেখে আমি নিজেও দ্বিধায় পড়ে যাই। কখনো করলার মতো তিক্ত আবার কখনো মধুর মতো মিষ্টি।”
সেদিকে মাথা ঘামায় না আর ইনারা। তার দৃষ্টি যেয়ে আটকায় টেবিলে। সেখানে সব ডায়েরি। একটি খোলা ডায়েরি দেখে সে যেয়ে তা হাতে নেয়, “এটা তো গল্প। আপনি গল্প লিখেন?”
“চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে ফিল্মের জন্য লেখার ইচ্ছা আছে। তাই আস্তে ধীরে লিখে যাচ্ছি।”
সামি জানায়, “আমাদের বেশিরভাগ গানও ইরফান লিখে। ওর ইচ্ছা রাইটার এবং ডিরেক্টর হওয়ার।”
“আমারও ইচ্ছা ছিলো অভিনেত্রী হবার। আব্বু জীবনেও দিবে না।” আফসোসের নিশ্বাস ফেলে ইনারা, “আপনি যখন অনেক বড় ডিরেক্টর হবেন তখন আমাকে অভিনেত্রী হিসেবে নিবেন ঠিকাছে?”
ইরফান কি উওর দিবে বুঝতে পারে না। সামিও তেমন কিছু বলে না। দুইজনকে চুপ দেখে ইনারা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “আমাকে কী অভিনেত্রীদের মতো দেখা যায় না?”
ইরফান ও সামি ভালো করে দেখে ইনারাকে। টাউজার এবং ওভার সাইজ হুডি পরা সে। হুডির ক্যাপ সারাক্ষণ মাথায় দিয়ে রাখে। সবসময়ই তাকে এভাবে দেখা। এই প্রশ্নের উওর মুখোমুখি দেওয়াটা তাদের আচরণে পড়ে না। সভ্য হলে মুহূর্তে দিয়ে দিতো। তাই এই প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল দুইজন।
.
.
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই ইনারা সাইদের মেসেজ পায়, “আজ অফিসে এসো না। মিটিং হচ্ছে। ওই সভ্যের ব্যাপার নিয়ে। তোমার আসার প্রয়োজন নেই। সভ্য বলেছে।”
সেদিন অফিসে না গেলেও তার মনে খুঁতখুঁত লেগেই থাকে কি হয়েছে মিটিং-এ। সভ্যকে কল দিলেও সে ধরে না। সাইদকে জিজ্ঞেস করলে সমস্যা হতে পারে বলে সে জিজ্ঞেস করে না। রবিবারে সকাল দশটা সোজা অফিসে আসতে বলা হয় তাকে। সময়ের আগেই পৌঁছায় সে। সেখানে যেয়ে দেখে রিহার্সাল রুমে অন্য কেউ নেই, জোহান ছাড়া।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here