অনুভবে পর্ব-১৪,১৫

0
1091

অনুভবে
পর্ব-১৪,১৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
১৪

ইনারার ঠোঁটের হাসি সাথে সাথেই মলিন হয়ে গেল। সে হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী বলছো ফুপি? এটা কীভাবে হতে পারে? আমি গতবছর যখন এত করে বলেছিলাম আমি কলেজের থিয়েটারে অভিনয় করতে চাই আব্বু কত খারাপ কথা বলেছিলো আমায়। কত বকেছিলো। বলেছিলো এই বাড়ির মেয়েদের এসব করা মানা। আর আইজা আপুকে ফিল্মে চান্স বাবা নিজে দিচ্ছে? আমার মানা হলে আইজা আপুর কেন নয়?”

ইনারার কথায় তার ফুপি কপাল কুঁচকে নেয়, “তোর বোন চান্স পেয়েছে এতে তুই খুশি না। এখনো নিজের কথা চিন্তা করছিস? তুই এতটা স্বার্থপর আমি তো জানতাম না।”
“স্বার্থপর? আমি কেবল সঠিক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছি। এমন বৈষম্য কেন? আমি যখন বলেছিলাম আমি মা’য়ের মতো বড় এক অভিনেত্রী হবো তখন আব্বু বলেছিলো মিডিয়া জগৎ আমার জন্য অনেক খারাপ। তাহলে তা আইজা আপুর জন্য নয়?”
“তোর আইজা আপু তোর থেকে বড়।”
“মানে আমি আপুর সমান হলে আমিও ফিল্মে যেতে পারবো। তাইতো?”
প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় ইনারার ফুপি। সে আমতা-আমতা করে বলে, “না মানে…এটা তো তোর বাবা বলতে পারবে। এছাড়া আমরা যদি মানা করি তোর ভালোর জন্যই করছি। আইজা তোর থেকে বেশি ম্যাচিউর। সিনেমা বাছাই, কোথায় কি বলতে হয়, কীভাবে চলতে হবে তা সব ও বুঝবে। ও এই জগৎ সামলাতে পারবে কিন্তু তুই…”
ইনারা ঠোঁটের কোণে বড় হাসি এঁকে বলে, “সে হিসেবে তো আমি আরও বেশি সামলাতে পারবো ফুপি। দেখো এসবের জন্য নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে হয়। তাও ছটফট করে। দেখো আপুর জীবনের সব সিদ্ধান্ত তো তুমি নেও। এই’যে আমি ছোট থেকে শুনে আসছি যে আপুর টিচার হবার এত শখ। আজ পর্যন্ত আপুর মুখে অভিনেত্রী হবার কথা শুনি নি। সে নিশ্চয়ই তোমার কথায় নিজের শখ মিটিয়ে এই পথ বাছাই করল। কিন্তু আমি তো এমন না। আমার যা করতে মন চাইবে আমি তাই করবো। ওয়েট ফুপি, তুমি এসব বলছো যেন আমি আব্বুর কথা না শুনে আমার মনের কথা শুনি। এই জন্যই তো মিডিয়া জগতে কি কি প্রয়োজন তা আমাকে বলে রাখছো। বাবা যেন রাগ না হয় এ-কারণে পরোক্ষভাবে বলছ তাই না? ওহ ফুপি তুমি কত সুইট!”
“না আমি এসব…”
“নেও এ খুশিতে তুমিও মিষ্টি খাও।”
ইনারা তার ফুপির মুখে মিষ্টি ভরে তার রুমের দিকে রওনা দিলো। হাসিমুখে ফুপিকে কথাগুলো বলে আসলেও রাগে তার শরীর জ্বলছে।

ইনারার মা ছোটবেলা থেকেই তার জন্য আদর্শ। তার সিনেমা দেখেই বড় হয়েছিল সে। তখন সে ভাবত বড় হয়ে একদিন নিশ্চয়ই তার মা’য়ের মতো হবে সে। সকলে তাকে ভালোবাসবে। অভিনয়ের শখও ছিলো তার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সিনেমার দৃশ্যের চর্চা করতো। কলেজের থিয়েটারে প্রথম অভিনয় প্রদর্শনেই প্রধান চরিত্র দেওয়া হয়। স্যার ম্যাডামরা তার প্রশংসা করতে শুরু করে। সবাই উৎসুক থাকে তার অভিনয় দেখার জন্য। কিন্তু তা আর হয় না। সে থিয়েটারেই আর যায় না। তার এই থিয়েটারের জন্য মুশতাক সাহেব অনেক বাজে কথা বলেছিলেন। জঘন্য পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো বাড়িতে। এমনকি ইনারা নিজেকে এক সাপ্তাহ ধরে রুমে আটকেও রেখেছিলো। সে কেবল তার মা’য়ের মতো হতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার সুযোগ আর পায় নি। তবে যদি তার অভিনয়ের অনুমতি না থাকে তবে আইজা আপুরও থাকার কথা নয়। তাকে বাবা নিজে সুযোগ দিচ্ছে সিনেমায় আসার। কিন্তু কেন? এই বৈষম্য কেন!
.
.
জোহান এসেছে তিন দিন হলো। ইনারা সারাদিনের ঘুরাঘুরি তার আশেপাশেই। প্রাক্টিস থেকে বের হবার পরও জোহান বেশিরভাগই সামির সাথে সময় কাটায়। সামির জন্য ইনারাও জোহানের সাথে সময় কাটাতে পারে। তাদের যে অনেক খাতির। কিন্তু জোহানের ইনারাকে সহ্যই হয়না। সারাক্ষণ বকবক করতে থাকে। তার পোশাক পরার ধরণ মার্জিত মেয়েদের মতো নয়। ছেলেদের মতো পোশাক-আশাকে ঘুরে বেড়ায়। আচরণও কেমন যেন! কোনো মেয়ে এমনভাবে আচরণ করতে পারে তার জানা ছিলো না। তবুও তার ইনারাকে সহ্য করতে হয়। কিন্তু তার সাথে কথা বলে না। তবে আজ কি মনে করে নিজ থেকে সে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা তোমার কি কোনো বড় বোন আছে?”

তারা ক্যান্টিনে বসা। সামি, ইনারা এবং সে। তার হঠাৎ এমন প্রশ্নে ইনারা একটু অবাক হলো। সে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাচ্ছিল। জলদি জোহানের প্রশ্নের উওর দেবার জন্য মুখে খাবার রেখেই বলল, “আপনি কীভাবে জানেন?”

জোহান মেজাজ আরো খারাপ হলো। ইনারার এসব বদভ্যাসের কারণে তাকে আরও অপছন্দ করতে শুরু করল সে। কিন্তু তা প্রকাশ করল না। তার ফ্যানদের সাথে বাজে ব্যবহার করার অনুমতি নেই। সে ইনারাকে বলল, “তোমার সাথে একজনের মিল পাই। কিছু মুহূর্তের জন্য দেখেছিলাম মাত্র। তার চেহেরাটা স্পষ্ট মনে আসে না। তবে কিছুটা তোমার মতো দেখতে।”

জোহানের ক’দিন ধরে চিন্তা করছে কনসার্টে দেখা মেয়েটাকে কিছুটা ইনারার মতো দেখায়। কিন্তু তা কীভাবে হতে পারে! কোথায় সে মার্জিত, সুন্দরী মেয়ে। আর কোথায় ছেলেদের মতো পরিধান করা, শত বদভ্যাসে ভরা ইনারা। দু’জনের মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ। যে কাওকে দেখে তো মুহূর্তের জন্য তার হৃদয়ের স্পন্দন থেমে যাবে না।

তারপর হঠাৎ গতকাল তার মাথায় আসে ইনারার কোনো বোন থাকতে পারে। যার চেহেরার মিল আছে ইনারার সাথে। কাকতালীয়ভাবে তার বোন সে মেয়েটা হতে পারে। কিছুই অসম্ভব নয়। যে করেই হোক, তার সে মেয়েটাকে খুঁজতেই হবে। যেদিন থেকে সে মেয়েটাকে দেখেছে তাকে ছাড়া অন্যকিছু ভাবতেই পারে না।

ইনারা আগ্রহ নিয়ে উওর দিলো,”আইজা আপুর কথা বলছেন? তার সাথে কোথায় দেখা হলো আপনার? সাইদ ভাইয়া দেখা করিয়েছে?”
ইনারার উওরে জোহানের ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে। সে উৎসুক গলায় জিজ্ঞেস করে, “সে কী দেখতে কিছুটা তোমার মতো?”
“আমার মতো? আমার থেকে অনেক সুন্দর। আইজা আপু বেস্ট। সব দিক দিয়ে বেস্ট।”
“সে কী তোমার মতো?”
“না, আমার একদম উল্টো সে। কিন্তু কেন?”
“তা পরে বলছি। তার ছবি আছে তোমার কাছে?”
“ছবি তো…” বলতে বলতেই ফোন বেজে উঠে তার। সভ্যের কল। সভ্যের কল দেখতেই ইনারা মুখ বানায়। বিড়বিড় করে বলে, “এই অসভ্যেরও শান্তি নেই। জোহানের সাথে একটু সময় কাটাচ্ছি তা ভাল্লাগে না তার।”

ইনারা কল ধরে বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী চাই?”
“কোথায় তুমি?”
“ক্যান্টিনে।”
“ক্যান্টিনে কি ফ্রী’র ইঁদুর নাচের প্রদর্শন চলে?”
“ব্যাঙের প্রোগ্রাম হবে। আপনাকে না’কি প্রধান অতিথি হিসেবে ডাকবে।”
“তাই না? ঘড়ির কাঁটায় পাঁচ মিনিটে উপরে আসো। নাহলে কি হতে পারে এতদিনে তোমার ধারণা হবার কথা।”
“আপনি এত অসভ্য কেন?”
তার কথা শোনার আগেই সভ্য কল কেটে দিল। ইনারা বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে, “মিঃ অসভ্যের আমাকে না জ্বালিয়ে খাবার হজম হচ্ছে না। আমি আসি।”
বলেই এক প্রকার দৌড় দিলো সে।

জোহান বিরক্ত হয়ে বলে, “এই মেয়েকে কি তার মা বাবা আদব কায়দা শিখায় নি। এভাবে কোনো মেয়ে চলাফেরা করে?”
সামি বলে, “ওর জীবন। তোর কী?”
“আমার তো দেখতে হচ্ছে। এর উপর সারাদিন পিছু পিছু ঘুরে। মাথা ধরিয়ে দেয়। বিরক্তিকর লাগে মেয়েটাকে। তার খাওয়া-দাওয়া, আচরণ, পোশাক সব কিছুতে বিরক্তিকর লাগে।”
“আমার পার্টনার লাগে। ওকে নিয়ে এভাবে বলবি না। ওর মনটা অনেক ভালো। তোকে অনেক পছন্দও করে। সারাদিন ওর মুখে কেবল তোর নামই শোনা যায়। তাও তুই ওর ব্যাপারে দুর্নাম করছিস।”
“এখন আমি তো পছন্দ করার মতো মানুষ। পছন্দ করবেই। কতজনই তো পছন্দ করে। কিন্তু ওকে দেখেছিস? মেয়েদের প্রথম নজর দেখেই আকর্ষণীয় লাগা উচিত। প্রথম নজরে চোখে না ভালো লাগলে মন দিয়ে কী করব? আর ওর উপর আকর্ষণবোধ করার কোনো কারণ পাই না।”
.
.
দুপুরের খাবার শেষে সামি এবং জোহান রিহার্সাল রুমে ফিরে আসে। এসে দেখে সভ্য, ইরফান এবং ঐশি কি যেন গানের চর্চা করছে। অন্যদিকে ইনারা সোফায় পা তুলে ডায়েরিতে কি যেন লিখছে। সামি যেয়েই ইনারার পাশে বসে গল্প করতে শুরু করে। জোহান আরও বিরক্ত হয়। তার দলের কারও সাথেই তেমন কথা হয় না, সামি ছাড়া। এখন ইনারাকে পেয়ে সামির কাছেও তার জন্য সময় হয় না।

ফোন বেজে উঠে জোহানের। তার মা’য়ের কল।
“হ্যালো মা, বলো।”
জোহানের মুখের থেকে মা শব্দটা শুনতেই ইনারা হাসিমুখে তাকায় তার দিকে। তার সৌমিতা আন্টি কল দিয়েছে? ইনারার তার সাথে কথা বলার ইচ্ছা জাগল। সে উৎসুক হয়ে কিছু বলতে নেবে তখনই জোহানের অন্য একরকম রূপ দেখতে পায় সে। জোহান সৌমিতা আন্টির সাথে ধমক দিয়ে কথা বলে, “তোমাকে বলেছি আমাকে এই ছোট ছোট কাজের জন্য কল দিবে না। আমার কাছে এত অবসর নেই। তোমার সময় না কাটলে তুমি শপিং এ যাও, নাহয় বান্ধবীর বাসায় যাও। আমাকে কল দিও না তো। আমার যখন ইচ্ছা হবে আমি বাসায় আসব। তোমার বলতে হবে না।”
জোহান ফোনটা রেখে দেয়।

ইনারা চোখ ঘুরিয়ে সকলের দিকে তাকায়। সকলে এমন ব্যবহার করছে যেন এটা খুবই স্বাভাবিক। এমনকি ঐশি আপুও কিছু বলছে না। ইনারার রাগ হলো। সে সামিকে জিজ্ঞেস করল, “উনি আন্টির সাথে এত বাজে বিহেভ করছে তাহলে কেউ কিছু বলছে না কেন? ”
“জোহানকে দেখতে অনেক শান্ত, চুপচাপ মনে হয়। কিন্তু তার রাগ অনেক খারাপ। কেবল সভ্যই তাকে কিছু বলার সাহস রাখতো। কিন্তু তাদের ঝগড়া হবার পর কেউ কিছু বলতে পারে না। তুমিও কিছু বলো না। একতো তোমার সমস্যা করতে পারে। আবার তোমাকে চরম অপছন্দ করতে শুরু করবে।”

ইনারার জন্য জোহান গুরুত্বপূর্ণ, তা ঠিক। কিন্তু এর কারণে সে এভাবে সৌমতা আন্টির অপমান হতে দেখতে পারে না। সে সোফার উপর দাঁড়িয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে উঠে, “কেউ নিজের মা’য়ের সাথে এভাবে কথা বলে?”
জোহানের সাথে সাথে সকলে চমকে উঠে। সকলের দৃষ্টি যেয়ে আটকায় ইনারার উপর।

জোহান হতভম্ব হয়ে যায়, “তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ?”
“নাহয় কী আপনার পাশে মিস্টার ইন্ডিয়া আছে যাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু আমি তার সাথে কথা বলতেছি। অবশ্যই আপনাকে বলতেছি। আপনার সাহস কিভাবে হয় আপনার মা’য়ের সাথে এভাবে কথা বলার?”
“তোমার সাহস কি করে আমার সাথে এভাবে কথা বলার?”
ইনারা দুই কোমরে হাত রেখে বলে, “আমার সাহস অনেক আছে। নমুনা দেখবেন? দেখালে কিন্তু এখানে কারও সামনে আপনার দুই পয়সার ইজ্জত থাকবে না।”

এই কথায় জোহান প্রভাবিত হয়। সে একটু দেবে যায়। সে আমতা আমতা করে বলে, “তুমি এত বেয়াদবির সাথে আমার সাথে কথা বলতে পারো না।”
“আমি সব পারি। নমুনা দেখবেন?”

ইনারা আবার বলে, “এখনই সৌমিতা আন্টিকে কল দিয়ে সরি বলেন।”
কপাল কুঁচকে নেয় জোহান, “তুমি আমাকে অর্ডার দিচ্ছ?”
“এরপর অর্ডার না। সোজা কান্ড করে দেখাবো। এরপর আমাকে বলতে পারবেন না যে আমি ওয়ার্নিং দেই নি।”

জোহান একটু ভয় পেল। সবার দিকে একনজর বুলালো। আসলেই যদি মেয়েটা কোনো পাগলামি করে বসে তাহলে সবার সামনে তার ইজ্জত যাবে। তাই সে সত্যি সত্যি ফোন বের করে তার মা’কে কল দিলো। নম্রসুওরে বলল,
“হ্যালো মা। কল দিয়েছিলাম যে, তোমার সাথে সেভাবে কথা বলাটা উচিত হয় নি। সরি। আমি আজ রাত দশটার মধ্যে আসবো। আচ্ছা রাখি।”

জোহানের মুখ থেকে এ কথা শোনার পর ইনারার প্রতিক্রিয়াই পরিবর্তন হয়ে যায়। সে একগাল হেসে জোহানের চুলে হাত বুলিয়ে বলে, “এইত্তো গুড বয়। এভাবেই আপনার আম্মুর সাথে ভালো ব্যবহার করবেন। ওকে?”
জোহান বিরক্ত হয়ে তাকায় ইনারার দিকে। রাগান্বিত দৃষ্টি!
সে এক ঝটকায় ইনারার হাত সরিয়ে দিয়ে দ্রুত কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। সে পরে যায় দ্বিধায়। অবুঝের মতো বলে উঠে, “উনার আবার কী হলো?”
সামি আর ঐশি তালি দিয়ে উঠে। ঐশি বলে, “এমন ভাবে না মা’ও কখনো বকার সাহস করে নি ভাইকে। ইনারা তুমি গ্রেট।”

সামিও তাল মেলায়, “একদম। জোহান কারও কথা শুনে, তাও এক মেয়ের আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। ইনারা তুমি তো কামাল ধামাল করে দিসো।”
কথাগুলো শুনে ইনারা একগাল হাসে। নিজের প্রশংসা শোনাটা তার খুব পছন্দের। সে ভাব নিয়ে বলল, “ইনারা মানেই তো কামাল।”

সভ্য তার কাজ করছিলো। এসবে তার ধ্যান নেই। সে তার কাজ করতে করতেই বলে, “মিস কামাল জোহান সবে গেছে আপনাকে কোম্পানি থেকে বের করার ব্যবস্থা করতে। এখন আপনি কী ধামাল করে চাকরিটা বাঁচান তা দেখার বিষয়।”

চলবে…..

অনুভবে
পর্ব-১৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সভ্য তার কাজ করছিলো। এসবে তার ধ্যান নেই। সে তার কাজ করতে করতেই বলে, “মিস কামাল জোহান সবে গেছে আপনাকে কোম্পানি থেকে বের করার ব্যবস্থা করতে। এখন আপনি কী ধামাল করে চাকরিটা বাঁচান তা দেখার বিষয়।”

কথাটা শুনে ইনারা ধপ করে বসে যায় বিছানায়। গালে হাত দিয়ে সামির দিকে তাকায়, “আমি উনাকে ভালো শিক্ষা দিচ্ছিলাম না? তাহলে আমাকে বের করবে কেন?”
“পার্টনার ভালো শিক্ষা তো দিলে, কিন্তু ভালো শিক্ষার কদর কে করে। আমরা কেউ ওকে বকা দেওয়ার সাহস পেলাম না অথচ তুমি এভাবে তাকে বকলে। এখন তো পরিনাম সহ্য করতেই হবে।”

ইনারা বিড়বিড় করে বলল, “আমি তো কেবল আমার কর্তব্য পালন করছিলাম। এখন আমার হবু জামাই ভুল কিছু করবে আর আমি চুপচাপ দেখব না’কি? বেয়াদবি করলে তো তাকে বুঝাতে হবে তাই না? নাহলে তো ভবিষ্যতে আমারই সহ্য করতে হবে। কিন্তু এখনতো দেখছি এত জলদি প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মারলাম। হবু জামাইরে শিক্ষা দিতে যেয়ে তাকে জামাই করার সুযোগ হাতছাড়া করে নিতেছি। ইনারা ভাব। জলদি কিছু ভাব।”

এরমধ্যে সামি আবার বলল, “বাই দ্যা ওয়ে, চাকরি থেকে বের হবার পরেও আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে কিন্তু। আমাদের মিশন এখনো তো শেষ হয়নি।”
“মিশনের গুষ্টি কিলাই। আগে বলো কীভাবে জোহানকে থামানো যায়। কোনো উপায় নেই জোহানকে থামানোর?”
“আছে বটে কিন্তু সে কোনো সাহায্য করবে বলে সন্দেহ।”
“সে-টা কে?”
সামি চোখের ইশারায় দেখাল সভ্যকে। ইনারা মুখ বানায়। সে সামির কাছে যেয়ে তার কানে কানে বলে, “এই অসভ্য আমাকে সাহায্য করবো? উলটা সে পারলে আমাকে অন্য গ্রহের এলিয়েনগো মাঝে ফালায় রেখে আসে। আর এই ব্যাঙের ছাতার থেকে আমি সাহায্য চাইব? অসম্ভব!”
“পার্টনার আর কোনো উপায় নেই। যা করতে পারে সভ্যই করতে পারে।”

ইনারা উপায় না পেয়ে সভ্যের কাছে যেয়ে দাঁড়ায়। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “আপনি প্লিজ কিছু করেন না।”
“কেন?”
“আমার জন্য।”
সভ্য চোখ তুলে তাকায় ইনারার দিকে। হাসিমুখে উত্তর দেয়, “তোমার জন্য? একটুও করবো না।”
“আমার কথা শুনেই আপনার গা জ্বলে কেন? অন্য সকল প্রকার আপনার কিছু আসে যায় না। আমি বললে আপনি এমন রিয়াক্ট করেন যেন আমি আপনার ব্যাঙের ছাতায় গুল্লি মারছি।”
“ব্যাঙের ছাতা? এই মেয়ে তোমাকে কি স্কুলে কথাবার্তার ধরণ শিখায় নি?
” এইত্তো আবার রাগ করছেন।”
সামিও অনুরোধের সুরে বলে, “ভাই তুই একটু নিজের পাওয়ার দেখিয়ে পার্টনারকে বাঁচিয়ে নে। আই প্রমিজ একমাস ধরে তোর দেওয়া ঘাসপুস খাব।”
“তুই আর এই মেয়ের সাথে থাকবি না।মুখের ভাষা ওর মতো হয়ে যাচ্ছে তোর।”

“প্লিজ হেল্প করেন না, আমি চলে গেলে আপনি জ্বালাবেন কাকে? আপনার টাইমপাস হবে কীভাবে?”
ইনারা এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল। সে ঠোঁট উল্টে নেয় বাচ্চাদের মতো, “প্লিজ।”
ইনারার এমন বাচ্চামো মুখ দেখে সভ্য খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়ে। এক মুহূর্তের জন্য ইনারাকে ভীষণ কিউট লাগে তার। এমনটা কীভাবে সম্ভব? সাথে সাথে সভ্য চোখ নামিয়ে নেয়। গম্ভীর গলায় বলে, “আমি কিছু করতে পারবো না।”
“প্লিজ তো।” বাচ্চামো করে বলে ইনারা।
“আচ্ছা আগে বলো তুমি বলেছিলে জোহানের ফ্যান গ্রুপের মেম্বার তুমি। তাই না? কত ফলোয়ার আছে সেখানে?”
“এই সত্তর হাজার।”
“জোহান কী এটা জানে?”
“না, আমি তো বলি নি।”
“সামি জোহানকে যেয়ে খবরটা দে। সাথে বল, ও গ্রুপে উল্টাপাল্টা কিছু বললে ওর ইমেজ খারাপ হতে পারে।”
সামি প্রশ্ন করে, “তোর মনে হয় এই প্রক্রিয়া কাজে দিবে?”
“এই প্রক্রিয়াই কাজে দিবে। ওকে আমি ভালোভাবে চিনি।”
ইনারা শান্তির নিশ্বাস ফেলে সভ্যের কথায়। কিন্তু সভ্যের শেষ কথাটা সে মাথা থেকে বের করতে পারে না। সভ্য এতটা নিশ্চিত কীভাবে যে এই প্রক্রিয়াই কাজে দিবে। তারা কী এত ভালো বন্ধু ছিলো?
.
.
সন্ধ্যার দিকে,
পঞ্চসুরের নতুন লাইভ শো হবার কথা পরের মাসেই। এই সুবাদে ভক্তদের চাহিদায় নাচের প্রদর্শন করা হবে।ঐশির সাথে ইরফানেরও নাচের চর্চা সবার পূর্বে হবে। এরপর হবে ঐশি এবং সভ্যের নাচের চর্চা। জোহান ও সামির নাচ প্রদর্শন থাকলেও তা সবার শেষে হবে। তাদের নাচের চর্চার জন্য সোহেল নামক কোরিওগ্রাফার এসেছে।

কিন্তু শেষ সময়ে এক ঘটনা ঘটে ঐশি এবং ইরফানের নাচের চর্চা শেষ হতে না হতেই ঐশির মা’য়ের কল আসে। জলদি করে যেতে হয় তাকে। সোহেল বলে, “এখন তো ঐশি নেই। কাপল ডান্স ছিলো। সামি এবং জোহানের আসাতেও সময় আছে। কী করবো?”
সভ্যের এতে বিশেষ কোনো রুচি নেই। তার গান ছাড়া অন্য কোনো কিছুতেই বিশেষ রুচি নেই। তাই সে সোফায় বসে বসে মোবাইল চালাতে থাকে। পাত্তা দেয় না সোহেলের কথায়। সাইদও ছিলো সে রুমে। হঠাৎ করে সে বলে উঠে, “ইনারা আছে না? ও অনেক ভালো নাচ পারে।”

ইনারা সাইদের পাশেই বসা। কথাটা শুনে সে চমকে উঠে। সাইদের বাহুতে চিমটি কেটে বলে, “ভাইয়া এই অসভ্যের সাথে নাচার আমার কোনো শখ নেই।”
“করে নেও না। ঐশি নাচে তাও ঠিকঠাক আছে। সভ্য পুরাই কাঁচা। ওর নাচ শিখতে সময় লাগে। লাইভ কনসার্টে বেশি সময় নেই। একদিন মিস হওয়া মানেও অনেক।”

সভ্য বিরক্ত হয়ে বলে, “এত মাখন লাগানোর প্রয়োজন কি? আর আমি বুঝি না আমাদের কাজ গান গাওয়া। এখানে নাচের ক্যাটাগরি রাখার প্রয়োজনটা কী ছিলো?”
“আহা, এটা তো কোম্পানির সিদ্ধান্ত। একটু সহ্য করো। ইনারা যাও একটু।”

ইনারা উঠে রুমের অন্যপাশে যায়। সভ্যও উঠে আসে। দুইজনে সামনা-সামনি দাঁড়ায়। ইনারা হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে বলে, “দুপুরের ফেভার ফিরিয়ে দেবার জন্য হেল্প করছি, নাহলে আপনার সাথে নাচার আমার শখ নেই কোনো।”
“কত অকৃতজ্ঞ তুমি! দুপুরে সাহায্য করলাম তার মূল্য নেই। আর তোমার কি মনে হয় তোমার সাথে নাচ করার জন্য আমার বয়ে গেছে? এমনিতেই এতটুকু তুমি। তোমার নাচ করতে গেলে আমার আরও কষ্ট হবে। ”
“দেখেন আপনি…” ইনারা কিছু সভ্যকে উওর দিতে যাবে তখনই সোহেল বলে উঠে, “এখন সব কথা বন্ধ। প্রাক্টিস শুরু হবে।”

নাচের চর্চা শুরু করা হয়। নাচ দেখানো হলেও সভ্য এবং ইনারার খুনসুটি শেষ হবার নাম নেই। সব স্টেপ দেখানোর পরও তারা ভুল করেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ইচ্ছে করেই এমনটা বারবার করে যাচ্ছে তারা। বিরক্ত হয়ে সোহেল তাদের নাচ বন্ধ করিয়ে বলে, “এটাকে নাচ বলে? দেখে তো মনে হচ্ছে দুই শত্রু একে অপরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। গানটা ভালোবাসার। তো ভালোবাসা নিয়ে একে অপরের দিকে তাকাও।”

সভ্য মুখ বানায়, “তুমি এই ইন্দুরনীর দিকে ভালোবাসা নিয়ে তাকাতে বলছ? ওকে দেখে কার ভালোবাসার ফিলিংস আসবে শুনি?”
“নিজের ব্যাঙের মতো চেহেরা নিয়ে একথা বলতে লজ্জা লাগে না? আপনাকে দেখেও কারও ভালোবাসার ফিলিংস আসে না।” ইনারা ক্রুদ্ধ গলায় বলে।
“ওহ প্লিজ, হাজারো মেয়ে আমার জন্য পাগল।”
“সবার চোখ খারাপ।”
“তোমার চোখ খারাপ।”
“কেন আপনি চান আমি আপনার প্রেমে পড়ি?”
“আমার মাথা এতটাও খারাপ না।”
“কিন্তু আপনার কথায় তো মনে হয় পুরাই খারাপ।”

“চুপ।” সাইদ দাঁড়িয়ে বলে, “একদম চুপ। কী হচ্ছে এসব? মনে হচ্ছে কুকুর আর বিড়াল ঝগড়া করছে।”
সভ্য ইনারার দিকে আঙুল তুলে বলে, “ও ইঁদুর। পুরাই ইঁদুরের মতো দেখা যায়।”
“সভ্য তোমার কী হয়েছে? ইনারাকে তো আমি চিনি। ও এমনই। কিন্তু তুমি এভাবে ঝগড়া করতে পারো আমার ধারণা ছিলো না। তুমি তো কখনো এমন ছিলে না। তোমাকে দেখে আজ আমার সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ লাগছে।”
সভ্য দ্বিধায় পড়ে গেল। কথাটা ঠিক। সে কখনো এমন ছিলো না। এটা ঠিক তার রাগ বেশি, কিন্তু সে শান্তও তেমন। কেবল নিজের কাজেই কাজ রাখত সে। হঠাৎ ক’দিন ধরে তার কি যেন হলো! পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে সে। তার অন্যের কথোপকথন শুনতে ভালো লাগে, সকলের আড্ডায় যুক্ত হতে ভালো লাগে। আর সবচেয়ে বেশি, ইনারার সাথে ঝগড়া করতে মজাই লাগে।

সোহেল বলে, “আচ্ছা সব বাদ। তোমাদের মধ্যে যা আছে তা এক পাশে রেখে নাচে ধ্যান দেও। আমি গান ছাড়ছি। যদি এতে তোমরা ঝগড়া ভুলে একটু অনুভূতি নিয়ে নাচ করো। যা শিখিয়েছি সে হিসেবে নাচবে।”

সভ্য এবং ইনারা সামনা-সামনি দাঁড়ায়। দুইজনের দৃষ্টিতে বিরক্তি। একে অপরের কাছে আসে। নয়নবন্ধন হয়। সভ্য ইনারার হাত ধরে কাছে টেনে নেয়। গানের তালে নাচের চর্চা করতে থাকে,

তুমি না ডাকলে আসব না
কাছে না এসে ভালোবাসব না
দুরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?
না কি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়?
দূরের আকাশ নীল থেকে লাল, গল্পটা পুরনো
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি…..

চোখে চোখ মিলিয়ে গানের সাথে তাল মেলায় দুইজন। এবার দুইজনে নিশ্চুপ। ইনারার হাত সভ্যের কাঁধে এবং সভ্যের হাত ইনারার কোমরে। হঠাৎ সভ্য এক টানে তাকে কাছে টেনে নেয়। চমকে উঠে সে। হতভম্ব হয়ে পড়ে এটা গানের চর্চায় ছিলো না। তার খুব কাছে ছিলো সভ্য। হঠাৎ করেই সভ্য তাকে ঘুরিয়ে তার পিঠ নিজের বুকে ঠেকায়। তার পেটে হাত আবদ্ধ করে তাকে খানিকটা তুলে নেয়। তার কাঁধে সভ্যের উষ্ণ নিশ্বাস ছুঁয়ে যাচ্ছে। তার গালের ছোঁয়া লাগছে।

ইনারার নিশ্বাস যেন আটকে আসছে। প্রথম কোনো ছেলে তার এতটা বেশি কাছে। একটু বেশিই। হৃদয়ের স্পন্দন কেমন দিশেহারা হলো। নিশ্বাস হলো মাতোয়ারা। কিছুটা অস্বস্তিও লাগলো। সভ্য যখন তাকে ঘুরিয়ে সোজা করে দাঁড় করায়। সে অস্বস্তিতে তাকাতে পারে না তার চোখে। চোখ নামিয়ে নেয়। তাও চুরি করে একপলক তাকায় সে সভ্যের দিকে। কেমনভাবে যেন তাকিয়ে আছে সে। লজ্জা পেয়ে যায় ইনারা।

গান বন্ধ করা হয়। প্রথম কিছু পঙক্তিতে নাচ করা হয়েছে। সোহেল হাত তালি দিয়ে বলে, “অনেক সুন্দর হয়েছে। আমি যেভাবে শিখিয়েছি তার থেকেও বেটার। এ স্টেপগুলো সহজ হলেও তোমাদের কেমিস্ট্রি টপ ক্লাস ছিলো। ঐশি এবং তোমার নাচের প্রদর্শন থেকে তো হাজারগুণ বেশি ভালো।”

ইনারা নাচ শেষেও সভ্যের কাঁধে হাত আবদ্ধ করে তাকিয়ে ছিলো তার দিকে। সোহেলের কন্ঠে তার হুঁশ ফিরে। সে লজ্জিত হয়ে পিছিয়ে যায়। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায়। এমন সময় আসে সামি। সে দরজাতেই দাঁড়িয়ে বলে, “ইনারা সভ্যের বুদ্ধি আসলেই কাজে দিয়েছে। জোহান চাকরি থেকে বের করার লেটার আনিয়েছিলো। আমার কথা শোনার পর তা ফালিয়ে দেয়।”

ইনারার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে, “সত্যি? কোথায় জোহান? আমি একটু কথা বলে আসি। দুপুরে আমি কেন এমন ব্যবহার করেছিলাম তাও বুঝিয়ে বলব।”
“জোহান তো বাহিরে। কিন্তু… ” কিন্তুর পরের কথা শোনার পূর্বেই ইনারা দৌড়ে বাহিরে যায়। সামি তাকে ডাক দেয় আবার, “ইনারা শুনে তো যাও। কিন্তু ও দিপার সাথে আছে।”

ইনারা দৌড়ে বাহিরে আসে। দূর থেকেই দেখতে পায় জোহানকে। সে দৌড়ে সেদিকে যেতে নিলেই মাঝপথে থেমে যায়। জোহান একটি মেয়ের সাথে দাঁড়ানো। মেয়েটা হলো অভিনেত্রী দিপা। যার সাথে জোহানের ডেটিং এর গুজব ছড়িয়ে আছে। সে দেখলো জোহান দিপার ঠোঁটের পাশেই চুমু দিচ্ছে।

ইনারা আর এগোতে পারল না। বুকে কেমন ব্যাথা করলো তার৷ মন উদাসীন হয়ে গেল। কান্না পেল। এই উদাসীন মুহূর্তে ইনারার পিছনে কেউ এসে দাঁড়াল। তার চোখে হাত রাখল। তার পিঠ বুকের কাছে ঠেকিয়ে। কানের কাছে মুখ এনে বলল, “যে দৃশ্য দেখে তোমার কষ্ট হয়, সে দৃশ্য দেখার প্রয়োজন তোমার নেই। তোমার আশেপাশে উদাসীনতা মানায় না।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here