অনুভবে পর্ব-২৭

0
1033

অনুভবে
পর্ব-২৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ইনারা খানিকটা অবাক হয় সভ্যের এমন আচরণে। আবার লজ্জাও পায় বটে। তবুও সে কোনো দ্বিধাবোধ না করেই জোহানের হাত থেকে হাত সরিয়ে নেয় এবং হাতটা রাখে সভ্যের হাতের মাঝে। সাথে সাথেই সভ্য তার হাতটা শক্ত করে ধরে নেয়।

সভ্য উঠে দাঁড়ায়। ইনারার হাত ধরে তাকে নিয়ে যায় হলের ঠিক মাঝখানে। সে গোলাকৃতি আলোটা এখনো তাদের উপরই স্থির। গান বাজে।

“ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি…..”
এই ডুবে যাওয়া ভালোবাসার গানের সুরের মাঝে দু’জনে ডুবে গেল একে অপরের মাঝারেতে। প্রেমের সুরভি ছড়িয়ে গেল চারপাশে। সভ্য তার বাহুতে আবদ্ধ করে ইনারাকে। তার নীলাভ চোখের মাঝারে হারিয়ে তার মনে হয় যেন গভীর কোনো সমুদ্রে ডুব দিচ্ছে। সে সাগরের মতো নয়নে আঁকা নীল কাজল। যা তার দৃষ্টির মায়া হাজারোগুণ বাড়িয়ে দিলো।

নাচের তালে তাকে দূরে যেতে দিতে হলেও কেন যেন এত দূরত্বটাও শ্বাসরুদ্ধকর মনে হলো সভ্যের কাছে। ইনারাকে ঘুরিয়ে তার পিঠ নিজের বুকে ঠেকাতেই চুলের মাঝের থেকে ভেসে আসা সুরভী পেল সে। কেমন মিষ্টি নেশা ধরানোর মতো সুরভি। সাথে সাথে সে নিজের নাচের স্টেপ ভুলে গিয়ে নিজের মতো করে নাচ শুরু করে। আচমকায় ইনারাকে নিজের দিকে ফিরায়। মেয়েটা বিস্মিত! হঠাৎ এভাবে তাকে ঘুরিয়ে নেওয়ায় ইনারা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। হঠাৎ করে যে তার কি হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না।

সভ্য আলতো করে তার গাল ছুঁয়ে দিতেই চোখ বন্ধ করে নেয় সে। সভ্য তার গাল থেকে ছুঁয়ে যেতে যেতে কাঁধে, এরপর হাতের উপর হাত বুলিয়ে তার আঙ্গুলের মাঝে আঙুল আবদ্ধ করে নেয়। আর গানের সুরে আপন মনে নাচের তাল মেলাতে থাকে। অবশেষে গানের শেষ দিকে সভ্য ইনারাকে ছেড়ে পিঠ করে হাঁটতে থাকে।

সকলে হতভম্ব। এ কি হচ্ছে! হঠাৎ এভাবে নাচের প্রদর্শন ছেড়ে যাওয়াটা যে বেমানান। কেউ তো এটা আশা করে নি। আর সভ্যই-বা এমনটা করছে কেন? সকলেই এই ভাবনার চুড়ান্ত ঘোরে হারানোর পূর্বেই সভ্য থেমে যায়। পিছনে ইনারার দিকে ফিরে দুই হাত মেলতেই ইনারা তার গাউনটা একটুখানি উঠিয়ে দৌড়ে ছুটে আসে সভ্যের বাহুডোরে। এখানেই তাদের নাচের প্রদর্শন এর সমাপ্তি ঘটে।

এভাবে দৌড়ে এসে যেন ইনারার ভারি মজা লেগেছে। সে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। হাসতে হাসতেই সে তাকায় সভ্যের দিকে। সে কেমন চাহনি! চেহারাটা দেখলেই বুকের ভিতর কেমন যেন করে উঠে। চোখে চোখ মেলে। হয় মধুর দৃষ্টি মিলন। সভ্য ইনারাকে মেঝেতে দাঁড় করানোর সময়ও একে অপর থেকে চোখ সরেনা। ঘোর লেগে আছে দুজনের। সে ঘোর ভাঙ্গে ভিড়ের হাত তালির সাথে। তাদের নামের চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে সভায়। সভার লোকেরা তাদের জুটিটা খুবই পছন্দ করেছে। সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

তবে সেগুলো সকলের যেন পছন্দ হয় নি। এর মধ্যে একজন হলো জোহান। রাগে তার মাথার রগটা লাফাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে, মুঠোবন্দী করে সে তাকিয়েই আছে দুইজনের দিকে। সে দৃষ্টি অগ্নিময়। সাথে সাথে সে ভিড় থেকে বের হয়ে কক্ষের শেষ মাথায় প্রস্থান করে। রাগে ফোঁপাচ্ছে সে। একটি টেবিলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। এই ভিড়ের মাঝে সে কোনো তামাশা করতে পারে না। কিন্তু তার রাগে নিয়ন্ত্রণ আসলো না। সে তার হাতের কাছে থাকা টেবিলটা এক ঝটকায় নিচে ফেলে দিলো।

তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো আবারো সভ্য এবং ইনারার কাছে থাকার দৃষ্টিটা। যতক্ষণ সে কেবল সভ্যের পছন্দের পাত্রী ছিল ততক্ষণও ব্যাপারটা মানা যেত। কিন্তু এখন! এখন তো সে জানে ইনারাই তার স্বপ্নচারিনী। যার জন্য নিদ্রাহীন কতগুলো রাত কাটিয়েছে সে। যে নারীটি তার সপ্নের রূপসী থেকেও সুন্দরী। তাকে এভাবে ছেড়ে দিতে পারে না। হঠাৎ তার মাথায় একটু বুদ্ধি আসলো। সে তার পকেট থেকে ফোন বের করে কল দিলো তার মা’কে,
“হ্যালো আম্মু!”
“আরে বাবা জোহান, তুই কীভাবে কল দিলি? সব ঠিক আছে তো? তুই ঠিক আছিস তো বাবা?”
“আমার কিছু হয় নি। শুনো তুমি জলদি করে তৈরি হয়ে পার্টিতে এসে পরো। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি।”
“আমি আসব! কিন্তু তোর বাবা যে রাগ করবে?”
“তা তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি সামলে নিব। আমি, বাবা, ঐশি সবাই আছি। তুমি না থাকলে কেমন দেখায়! এছাড়াও তোমার জন্য একটি স্যারপ্রাইজ আছে।”
“বলিস কি বাবা! তুই বললে আমি আসবো না। অবশ্যই আসবো। এখনই আসছি আমি।”
.
.
অন্যদিকে,
নাচ শেষে অনেকেই সভ্য এবং ইনারাকে ঘিরে দাঁড়ায়। অনেক বড় বড় সেলিব্রিটিও। কিন্তু তার দৃষ্টি খুঁজে তার বন্ধুদের। তাদের জন্য এসব এমনিতেই নতুন, এর উপর দুইজনকে এমন অচেনা পার্টিতে একা ছাড়ায় চিন্তা হচ্ছিল ইনারার। তাদের খুঁজে পাবার পর সে সভ্যের কানের কাছে এসে বছর, “আমার বন্ধুরা আছে তো আমি তাদের কাছে যাই। আপনি একটু ফ্রী হলে আসবেন। ওরা আপনার এবং পঞ্চসুরের অনেক বড় ভক্ত। দেখা করতে চায়।”
বলে ইনারা যেতে নিলেই সভ্য তার হাত ধরে নেয়। ইনারা অবাক হয়ে তাকায় সভ্যের দিকে। সে বলে, “আমাদের ফ্যান হলে তো আমাদের সবার আগে দেখা করা উচিত। ওয়েট করো।”
সভ্য সামি, ঐশি এবং ইরফানকে নিয়ে ইনারার সাথে যায় প্রিয় এবং সুরভির সাথে দেখা করবার জন্য। তাদের দেখেই তো দুইজন বরফ হয়ে যায়। অস্থিরতা ছড়িয়ে যায় দুজনের মাঝে। পঞ্চসুরের সকলের সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছে তারা বিশ্বাসই করতে পারছে না।

সভ্য হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে বলে, “হ্যালো। ইনারা অনেক কথা বলে তোমাদের। কেমন আছো?”
সুরভির তো কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেছে। তার এমন অবস্থা দেখে ইনারা বলল, “ভাই এত ঢঙ করার কী আছে? উনি তো মানুষই তাই না?”
“উফফ চুপ কর তো তুই বুঝবি না। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি সভ্যের হাত ধরছি। আহ আমার খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।” সুরভি অবশেষে সভ্যের সাথে হাত মিলিয়ে বলল।
ইনারা হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে ভেংচি কেটে বলল, “যত্তসব ঢঙ!”
“তাই না? তাহলে মেডাম আপনি জোহানের সাথে দেখা করার সময় এত ঢঙ করতেন কেন শুনি?”
সভ্য জোহানের কথা শুনে সুরভিকে বলে, “এখন তোমার তো একটু ঢঙ করা চলে। যার চয়েস ভালো তার একটু ঢঙ না করলে হয়? আর তোমার বান্ধবীর তো কাজই এই আজেবাজে বকা।”
“একশো শতাংশ খাঁটি কথা।” প্রিয় বলে।

ইনারা চোখ দুটো বড় বড় করে সভ্যের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি আজেবাজে বকি তাই না? কী বাজে বকলাম শুনি?”
“তোমার সব কথাবার্তাই তো আজেবাজে।”
“আপনি বাজে, রাক্ষস, অসভ্য।”
“আগে নিজের কথা শুনো, তারপর বলো কে অসভ্য?”
“আপনি অসভ্য। আর কে?”

সুরভি ইনারার হাত ধরে ফিসফিসিয়ে বলল, “কি করছিস তুই? এত বড় সেলিব্রিটির সাথে ঝগড়া… ”
সম্পূর্ণ কথা বলার পূর্বেই ইনারা তার হাত ছাড়িয়ে বলে, “উফফ ছাড় তো। দেখছিস না ঝগড়া করতেছি? শান্তি মতো ঝগড়া করতে দে তো।”

সুরভি তো অবাক হয়ে দুজন কে এভাবে দেখতেই থাকে। সভ্য কে সে গত তিন বছর ধরেই ফলো করে আসছে। অথচ তার ব্যবহার সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এখানে কতটা আলাদা!
সামি সুরভির পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে, “আরে ওদের ছাড়ো। এটা ওদের প্রতিদিনের রুটিন। তোমরা আমাদের সাথে কথা বলো। ওরা থাক। সারাক্ষণ এভাবেই ব্যাঙ আর ইন্দুরের মতো ঝগড়া করতেই থাকে।”
প্রিয় আর সুরভি একে অপরের দিকে তাকায়। দুইজন অপরিচিত এইসব থেকে। ইনারা সারাক্ষণ সভ্যকে বকলেও সে যে আসলে এভাবে তার সাথে ঝগড়া করবে তার আভাস ছিলো না তাদের।

তাদের প্রথমে খানিকটা অস্বস্তি লাগলেও সামি এবং ঐশি তাদের এই অস্বস্তিকর ভাব একদম দূর করে দেয়। বন্ধুত্বময় স্বভাব তাদের। যেন তাদের সাথে কত কালের পরিচয়। এরপর প্রিয় এবং সুরভি কিছুটা ফ্রী হয় তাদের সাথে।
.
.
আজকের নাচ প্রদর্শন এর পর অনেকেই ইনারার সাথে এসে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করছে। অনেক বড় বড় সেলিব্রিটি, পরিচালক এসে তার সাথে কথা বলছে। কিন্তু এমন কেন হচ্ছে ইনারা কিছুই বুঝতে পারছে না। আর এত বড় এবং ধনী মানুষের সাথে কথাও বলতে পারছে না। শত হোক, এখনো তার বয়স কম। এছাড়া তার পরিবারের কয়েকজন এবং কিছু বন্ধুবান্ধব ছাড়া কারও সাথে মেলামেশা করা হয় নি। তাই এত ফর্মালিটিসহ কথা সে বলতে পারে না। ইতিমধ্যে যখন ঐশি এবং ইরফানের পার্ফোরমেন্সের এনাউন্সমেন্ট করা হয়। ইনারা যেন একটু বাঁচে। সবার ধ্যান তার থেকে যেয়ে আটকায় হলের মাঝখানে। আগের মতোই আলো নিভে যায়। এমন সময় কেউ একজন হাত ধরে তাকে নিয়ে যায় রুমের একপাশে।

ইনারা কিছুই বলে না। হাল্কা আলোয় তার বাবার চেহেরাটা সে ঠিকই চিনতে পারছে। তাই চুপ করে গেল তার সাথে। ইনারাকে নিয়ে যেয়ে তার ছাত ছেড়ে মুশতাক সাহেব রাগান্বিত সুরে বলে, “তুমি এখানে কী করছ ইনারা? আর তুমি সভ্যের সাথে নাচছিলে কেন? তুমি কী ভুলে গেছ আমি তোমাকে বলেছি কেউ যেন না জানে তোমার আসল পরিচয়।”
ইনারা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে মৃদুস্বরে বলল, “কেউ তো জানে না। শুধু জোহান জেনে গেছে। তাও আপনার আর আইজা আপুর কথায়। আমার দোষ কোথায়?”
“তুমি আমার সাথে তর্ক করছো?”
“উঁহু, যা সত্য তা বলছি।”
কথাটায় মুশতাক সাহেবের রাগ উঠলেও এখানে তো আর সে কোন বাজে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনা এই সভাই। তাই সে ইনারার হাত শক্ত করে ধরে এবং কঠিন গলায় বলে, “তোমাকে আমি আগেও বলেছি, আমার সাথে এভাবে কথা বলার সাহস করবে না। এসব বেয়াদবি তোমাকে শিখায় কে? আর তুমি এখানে করছোটা কি? ”
ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে ইনারা। এক ঝটকায় তার বাবার হাত সরিয়ে নেয়। এবার ভারী রাগ উঠে তার। কিন্তু সে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলে, “আপনি না বলেছেন আপনি আমাকে আর টাকা দিবেন না। কিন্তু আমার তো নিজের খরচা লাগে না’কি? আমি চাকরি করি এই কোম্পানিতে। এবার জেনে খুশি?”

মুশতাক সাহেব ইনারার উপর হাত তুলতে যেয়েও থেমে যায়, “আস্তো বেয়াদব মেয়ে তো তুমি। কেউ নিজের বাবার সাথে এমন ব্যবহার করে?”
“বাবা বলেই আদবে আছি, নাহলে অন্যকেউ এভাবে শক্ত করে আমার হাত ধরলে তার হাত ভেঙে দিতাম। আর আপনি আমার গায়ে হাত তোলার অধিকার কোথায় পেলেন।”
“আমি তোমার বাবা।”
“কেবল শাসনের বেলায় বাবার অধিকারের কথা মনে পড়ে? সারাবছরে তো আপনার মনে থাকে না যে আপনার একটা মেয়েও আছে। আর খবরদার আমার সাথে এমন ব্যবহার করার কথা চিন্তাও করবেন না। নাহলে সবার সামনে আপনার আসল রূপ দেখিয়ে দিব।”
এবার রাগে ফেটে পড়ে মুশতাক সাহেব অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে, “তুমি আমাকে শান্তি দিলে না। একটু খুশি থাকলে আমার দিনটা কীভাবে বিগড়াতে হয় তা ভালো করেই জানো। আসলেই একটা অলক্ষ্মী তুমি। তুমি জীবনে থাকতে কেউ কখনো সুখী থাকতেই পারে না। যখন সাইয়ারা জীবিত ছিলো তখন ও সুখী ছিলো না, এখন আমি। তোমার কি মনে হয় আমি সাধে সাধে সারাবছর বাড়ির বাহিরে থাকি। আমি আমার নিজের বাড়িতে এজন্যই যাই না যে তোমার চেহেরাটা আমার দেখতে হবে। তোমার জন্ম হওয়াটাই ভুল ছিলো। এখন থেকে যা করার করো। আমি আর কিছু বলবো না।”

মুশতাক সাহেব যাবার পর ইনারা তার হাত দেখে। তার হাতে পরা ছিলো এক কাঁচের ব্রেসলেট। এটা তার মা’য়ের ছিলো। আজ সে প্রথম এটা পড়েছে। তার চাপ দিয়ে ধরায় ব্রেসলেটটা ভেঙে তার হাত ঢুকে পড়েছে। কিন্তু এর থেকেও বেশি আঘাত লেগেছে তার বাবার কথায়। বুকের ভেতর কেমন যন্ত্রণা করছে। তার চোখদুটো ছলছলে হয়ে আসলে। না, তার আর এই জমজমাট, হৈচৈ ভালো লাগছে না। তার একটু নীরব স্থান দরকার।

খুঁজে খুঁজে প্যালেসের শেষের দিকে একটা বেলকনি পেল সে। এদিকে কেউ নেই। সে সেখানেই যেয়ে দাঁড়ায়। তার হাত থেকে কাঁচটা বের করতেই চোখ বন্ধ করে নেয় ইনারা। তার চোখে জমে থাকা জল টুপ করে পরে তার গাল দিয়ে। কিন্তু এই মুহূর্তেও হাত থেকে তার বুকের পীড়াটা বেশি যন্ত্রণাদায়ক। তার কানে বারবার এই শব্দগুলোই গুঁজছে,
‘আসলেই একটা অলক্ষ্মী তুমি। তুমি জীবনে থাকতে কেউ কখনো সুখী থাকতেই পারে না। যখন সাইয়ারা জীবিত ছিলো তখন ও সুখী ছিলো না, এখন আমি।’
‘তোমার জন্ম হওয়াটাই ভুল ছিলো।’

দম বন্ধ হয়ে আসছে ইনারার। কাঁপা কাঁপা নিশ্বাস ফেলছে সে। কিন্তু কিছুতেই যে কাঁদতে পারবে না সে। কেউ যদি তাকে খুঁজতে খুঁজতে এসে পড়ে। কান্না থামানোর চেষ্টায় মুখ চেপে ধরে সে। কান্না থামে না। কিন্তু কান্নাটা নিরব হয়। কিছুক্ষণ পর যখন তার কান্না কমে তখন সে ভাঙা ব্রেসলেটটা দেখে বলে, “মা সত্যিই কি আমার জন্য তুমি অসুখী ছিলে? তুমি কি এজন্যই আমাকে ছেড়ে চলে গেছ না। আমি অনেক সরি মা, সরি, সরি।”
বুকে জড়িয়ে ধরে তার মা’য়ের ব্রেসলেটটা ইনারা।

“তুমি তাহলে এখানে।” হঠাৎ সভ্যের কন্ঠ শুনে ইনারা তার চোখ মুছে নেয়। তারপর স্বাভাবিকভাবে তাকায় সভ্যের দিকে, “আপনি এখানে?’
“তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আসলাম। তোমার পছন্দের ব্লুবেরি কেকও আনলাম।”
ইনারা মুখ ফেরাতেই সভ্যের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ এঁকে উঠে, “কী হয়েছে তোমার তুমি ঠিক আছো তো?”
“আরে আমি তো ঠিকই আছি। আমার সম্ভবত চোখে এলার্জি আছে। অনেকের কাজলে এলার্জি থাকে। সুরভিরও আছে। একটু যন্ত্রণা করছিলো। এখন ঠিক আছে।”
“সত্যি বলছো তুমি?”
“আপনার সাথে মিথ্যা বলতে যেন আমার বয়েই গেছে। দেখি দিন তো, আমার কেকটা দিন।”
ইনারার একটি বিশেষ গুণ রয়েছে। সে মুহূর্তেই নিজের মুখের ভাব পরিবর্তন করতে পারে। এমন ভাবে তার অনুভূতি লুকাতে পারে যে সামনের জন কিছু বুঝতেই পারে না। তাই সভ্যও তার কথাটা সত্য মনে করে নিলো। ইনারার হাতে কেকের প্লেট দিয়ে সে তাকায় আকাশের দিকে।

ইনারা হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা আপনাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি?”
“তুমি অনুমতি নিচ্ছো? বাহ! সূর্য কোন দিক থেকে উঠলো?” মশকরা করে বলল সভ্য। কিন্তু ইনারা আর দুষ্টুমি করে না তার সাথে। সে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা আপনার মা বা বাবা কি কখনো এত নারাজ হয়েছে যে তারা আপনার মুখও দেখতে চায় নি?”
কপাল কুঁচকে যায় সভ্যের, “এ কেমন প্রশ্ন। কোনো মা বাবাই এমন হয় না। উল্টো তারা তোমার জন্য নিজের সকল খুশি ত্যাগ করতে একবিন্দুও আফসোস করে না। কিন্তু তুমি হঠাৎ করে এমন প্রশ্ন করছ কেন?”
“না। কিছু না। আচ্ছা আপনি কেক খেয়েছেন? অনেক মজা খেয়ে দেখুন।”
“আমার মিষ্টি খাবার ভালো লাগে না।”
“আমি সাধছি তাই আপনার খেতেই হবে। নিন।”
ইনারা জোর করে সভ্যের মুখের সামনে চামচ নেওয়ায় সে ইনারার হাত ধরে নেয়। সাথে সাথে ইনারা শব্দ করে উঠে। তার একদম কাটা স্থানে ধরে সভ্য।

সভ্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমি তো আলতো করে ধরেছি। তোমার ব্যাথা লেগেছে?”
“আরে না। যাক আজকে আপনাকে জিততে দিলাম। খাওয়ালাম না। এরপর আর ছাড়বো না। আসুন এবার ভেতর যাই।”
সভ্য ইনারার এমন অস্বাভাবিক ব্যবহার দেখে একটুখানি অবাক হয়। ইনারা এগিয়ে গেল সে পিছনে যেতে নিলেই সে দেখতে পায় তার হাতে রক্ত লেগে আছে। সে চিন্তায় পড়ে যায়, হঠাৎ রক্ত এলো কোথা থেকে?

সে তাকায় ইনারার দিকে। ছুটে যেয়ে তার সামনে দাঁড়ায়। আদেশের সুরে বলে সভ্য, “তোমার হাত দেখাও।”
“হাত দেখাব? কেন?”
“দেখাও।” কাঠখোট্টা গলায় বলে সে।
“উফফ বাবা আপনিও কম জ্বলান না দেখছি।”
ইনারা তার বাম হাত দেখায় সভ্যকে, “এবার খুশি। আসেন।”
ইনারা যেতে নিলেই সভ্য তার হাতের প্লেট নিয়ে, নিচে রেখে তার ডান হাত রেখে। হ্যাঁ, তার ধারণাই ঠিক। ইনারার হাতের কিছু অংশ কেটে রক্ত বের হচ্ছে। তার এতটুকু আঘাতেই মাথায় রক্ত চড়ে আসে সভ্যের। সে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে, “কে করেছে এমনটা?”
“আরে চিন্তা করেন না তো। এটা তেমন কিছু না।”
“আমি জিজ্ঞেস করছি কে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে?”
উচ্চ স্বরে বলায় কিছুটা ঘাবড়ে উঠে ইনারা। ভয়ও পেয়ে যায় সে সভ্যের এমন রাগ রেখে। সভ্যের রাগ সে আগে দেখেছে কিন্তু এমন রাগান্বিত মুখ আগে সে দেখে নি।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here