অনুভবে পর্ব-৩৭

0
953

অনুভবে
পর্ব-৩৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ইনারার কোলে মাথা রেখে অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করছিলো সভ্যের মাঝে। ভালো লাগা কাজ করছিলো। শান্তি লাগছিলো। যা তার জীবনের শেষ কয়েক বছরে হারিয়ে গিয়েছিল। ইনারার কোলে মাথা রেখে তার নরম তুলতুলে হাতের স্পর্শে নিদ্রার রাজ্যে হারিয়ে যায় সে।

ঠিক কতক্ষণ পর তার ঘুম ভাঙে সঠিক জানে না সে। তবে আশেপাশের বাতি বন্ধ ছিলো। ঘুম ভাঙার পর সে খেয়াল করে ইনারার হাত এখনো তার চুলে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। সে চমকে উঠে বসে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি আমাকে ঘুম থেকে উঠাও নি কেন? বেশি রাত হয়ে গেছে?”
ইনারা হাই তুলে ঘুমঘোর গলায় বলে, “আপনি ক্লান্ত ছিলেন তাই উঠায় নি? ভালো লাগছে এখন?”
সভ্যের খারাপ লাগতে শুরু করল। তার জন্য ইনারা না ঘুমিয়ে তার মাথায় হাত বোলাচ্ছিল। তার মাথা ব্যাথা ছিলোই না। সে কেবল ইনারার কোলে মাথা রেখে তার হাতের ছোঁয়া অনুভব করতে চাচ্ছিল। এতে যে ইনারার এত কষ্ট হয়ে যাবে সে বুঝে নি। সে বলে, “হ্যাঁ ভালো লাগছে। আমি যাই তুমিও যেয়ে ঘুমিয়ে নেও।”

সভ্য যেতে নিলেই ইনারা তার হাত ধরে নেয়, “আপনার ক্লান্ত লাগছে?”
“না, আমি তো মাত্র ঘুম থেকেই উঠলাম। আর গাড়িতেও সারা রাস্তা ঘুমিয়েই এসেছি। আমার লাগবে কেন? তোমার তো লাগছে। তাই বলছি, ঘুমিয়ে যাও।”
“তাহলে একটু পাশে এসে বসুন।”
“তোমার চোখে মুখে ঘুম ঘুম ভাব। প্রোগ্রামের কারণে গত কয়দিন ঠিক মতো ঘুমাতে পারো নি তুমি।”
“বছরের ক’টি দিনে চোখ বন্ধ করলেই দুঃস্বপ্ন দেখি। সে রাতগুলোতে আমি ঘুমাই না। আজও এমন একটি রাত।”
সভ্যের বুকের ভেতর খানিকটা নড়ে উঠে। সে জানে, আজ ইনারার মা’য়ের জন্মদিন। এ নিয়েই কি ইনারার দুঃস্বপ্ন দেখা? প্রশ্নটা করল না সভ্য। চুপচাপ যেয়ে বসলো ইনারার পাশে।

কিছুক্ষণ পর ইনারা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠে, “আজ আমার মা’য়ের জন্মদিন। তার এ জায়গাটা ভীষণ প্রিয় ছিলো।”
“তাই এখানে এসেছ?”
“হুম, প্রতিবছর আসি। এখানে মা’য়ের সাথে স্মৃতিগুলো মনে পড়ে। জানেন আমার মা আর নেই।” ইনারা সভ্যের দিকে তাকিয়ে বলে। সভ্য তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সাথে সাথে সে চোখ নামিয়ে নিলো। তার চোখে ভেসে থাকা জল লুকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সভ্য থেকে তা আর লুকাতে পারলো না। সভ্য তার গালে হাত রেখে উপরে উঠাল এবং বলল, “তোমার মা’য়ের জন্মদিনে এভাবে তোমার চোখেত মুক্তোর মতো মূল্যবান জল ভাসাবে? নট ফেয়ার। আমি নিশ্চিত তোমার মা যেখানেই হবে না কেন তোমার চোখের জল দেখলে তিনি অখুশি হতেন।”
কথাটা ইনারার কান্না কমায় না। উল্টো বাড়ায়। সে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। সভ্য ঘাবড়ে যায়, “তুমি দেখি আর কান্না বাড়িয়ে দিলে। আমি তো তোমার কান্না বাড়ানোর জন্য কথাটা বলি নি। আচ্ছা আই এম সরি, কান্না থামাও প্লিজ।”
ইনারা কান্না থামায় না। সভ্য আরও বলে। যখন আর লাভ হয় না তখন সে ইনারার বাহু ধরে তাকে বুকে টেনে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ” লক্ষ্মীটা প্লিজ কান্না থামাও। তোমায় কাঁদতে দেখলে আমার ভালো লাগে না।”
সে ভেবেছিলো ইনারা তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিবে। কিন্তু সে এমনটা করল না। তার বুকের মাঝেই লেপ্টে থেকে কাঁদতে থাকল।

ইনারার তার বুকের মাঝে থাকার সুখ এবং তার কান্নার ব্যাথা দুটোর মিশ্রণে অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিলো তার মাঝে। সভ্য কিছু বলে না। আলতো হাতে কেবল ইনারার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শান্ত হবার সময় দেয় তাকে। একসময় ইনারা শান্তও হয়ে যায়। তার কান্না বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু সভ্যের বুকের মাঝ থেকে উঠে না। কিছু সময় কাটে। ইনারা নড়াচড়া না অনুভব করতে পেরে এসব সভ্য উঠে দেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। মৃদু হাসে সে। ইনারাকে কোলে তুলে রুমে যেয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। উঠতে নিলেই খেয়াল করে মেয়েটা তার জ্যাকেট শক্ত করে ধরে আছে হাতের মুঠোয়। ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই ইনারা নড়ে উঠে। তার ঘুম ভাঙতে চায় নি সভ্য। তাই তার পাশেই বসে যায়। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তার ঘুমন্ত চেহেরার মুগ্ধতায় ডুবে যায়। আলতো করে একখানা চুমু খায় তার কপালে। আর আঙুলে পেঁচিয়ে তার চুলের সাথে খেলা করতে করতে বলে, “তোমার দুঃখ আমার ভাগ্যে নেবার সাধ্য আমার হলে নিমিষেই নিয়ে নিতাম। কিন্তু এর সাধ্য আমার নেই। তবে তোমাকে দুঃখবিলাস থেকে দূরে রাখার জন্য আমার যা করতে হয় আমি সব করব। তোমার চোখের জল যে আমার বুকে প্রচন্ড আঘাত করে প্রণয়ী।”
.
.
পর্দা সরানো জানালা থেকে। তাই জানালা ফাঁকে সকালের প্রথম মিষ্টি সোনালী রোদ্দুর এসে ঝরে পরছিলো ইনারার উপর। তার মুখে প্রায়ই গোলাপি আভা ছড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে তার গাল দুটোয়। এই সোনালী রোদ্দুরের ছোঁয়ায় তার এই আভা গাঢ় হয়ে উঠেছে। তার সোনালী চুলগুলো ‘আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তার এমন মিষ্টি আভা থেকে সভ্য এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতে পারে না।

ইনারা মিটমিটিয়ে চোখ খুলতেই প্রথমে সভ্যের চেহেরা দেখতে পায়। প্রথমে ড্যাবড্যাব করে কিছু মুহুর্ত তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সভ্য তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। ইনারার এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে না হেসে পারল না সে।

হুঁশ আসতেই একলাফে উঠে বসে ইনারা। অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বলে, “আপনি… আপনি এখানে কী করছেন?”
“আমাকে সবসময় আপনার কাছে পাবার ইচ্ছাটা পূরণ করবার বসে ছিলাম মহারাণী?”
“কী!”
সভ্য তার জ্যাকের দিকে ইশারা করে। ইনারা সাথে সাথে তার জ্যাকেট ছেড়ে উঠে বসে। দূরে সরে যেয়ে চোখ নামিয়ে মিনমিন গলায় জিজ্ঞেস করে, “আপনি সারারাত আমার জন্য এখানে বসে ছিলেন?”
“এখন তোমাকে ঘুমের মাঝে এতটা শান্ত এবং নিষ্পাপ দেখাচ্ছিলো। এ ঘুম তো ভাঙতে পারি না। নাহয় সারাক্ষণ ডাইনীর মতো করে আমাকে জ্বালাও।”
ইনারা সরু দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। রাগে নাক ফুলিয়ে কিছু বলতে নিবে তখনই সভ্য আবার বলে, “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল খুব শান্তিতে ঘুমিয়েছ। তাই উঠানোর মতো দুঃসাহস করি নি।”
ইনারা সত্যিই অবাক হয়। প্রতি বছর তার মা’য়ের জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী এবং নিজের জন্মদিনে খুবই অশান্তি লাগে ইনারার। এসব দিনে তার মাকে সবচেয়ে বেশি মনে করে সে। এসব দিনে সে ঘুমাতে পারে না। তার হৃদয়ের দুঃখ তার দুঃস্বপ্নের রূপ নিয়ে নিদ্রায় হানা দিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলে। তার মা’য়ের মৃতদেহের দুঃস্বপ্ন। এই দিনগুলোর আশেপাশের কিছু রাত তার কিছুতেই ঘুম আসে না। খুব অশান্তি লাগে। তাইতো গত দুইরাত সে না ঘুমিয়ে একটানা কাজ করেছে। এই কাজের কারণে সে নিজেকে সামলে রাখতে পেরেছিলো। অথচ গতরাত কি শান্তিতে ঘুমাল সে। কতবছর এমন শান্তির ঘুম হয় নি তার। আচ্ছা সভ্য কী জাদু জানে? নাহয় কীভাবে সে গতরাতে এত শান্তিতে ঘুমায়? কীভাবে সে সভ্যের বুকের মাঝে এত শান্তি খুঁজে পায়?

সে এইসব ভাবনার জগতে হারিয়েই ছিলো তখনই সভ্য উঠে দাঁড়ায়। তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, “সূর্যোদয়ের সৌন্দর্যতা নেই, তবে শুভ্র সকালের মুগ্ধতা এখনো আছে। আমার সাথে দেখতে যাবেন মহারাণী সাহেবা?”
লজ্জায় ইনারার গালদুটো আরও লালচে হয়ে আসে। সে সভ্যের সাথে চোখ মিলাতে পারে না। তবে হাত বাড়িয়ে সভ্যের হাত ধরে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। দুইজনে বের হয় রুমের থেকে। শুভ্র সকাল। আশেপাশে কেউ নেই তেমন। তাই সভ্য নিশ্চিন্তে মুখ খুলে হাঁটছে। আর আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে ইনারার দিকে। সে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। সভ্য জিজ্ঞেস করল, “গতরাতের কনসার্ট কেমন লেগেছে?”
“অস্থির, অসাধারণ। আমরা অনেকে ব্যাকস্টেজে ছিলাম না? আমরা সকলের কথা শুনেছি। সকলে পঞ্চসুরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।”
“শুনে ভালো লাগলো। ওদের ভালোবাসা তো অনেক মূল্যবান।”
“তা ঠিক। দেখবেন আমিও একদিন এভাবে সবার ভালোবাসা পাব। এতজনের ভালোবাসা পেতে অনেক ভালো লাগে তাই না? নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়। তাই না?”
“এটা ভুল নয়। কিন্তু এর বিপরীত প্রতিক্রিয়াও আছে।”
“যেমন?”
“যেমন আমি চাইলেই কোথাও যেতে পারি না, পছন্দের কোনো কাজ করতে পারি না, আর…”
“আর?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সভ্য। এক ঢোক গিলে, “আর ভালোবাসার সাথে সাথে কত মানুষের ঘৃণার স্বীকার হতে হয়। যখন তুমি সফলতার শিকরে উঠবে তখন যেমন কতগুলো অজানা ভালোবাসার মানুষ পাবে এর সাথে ঈর্ষার কারণে আপন মানুষরাও পর হয়ে যায়। অতীতে যারা খুব ভালো বন্ধু ছিলো তারাও শত্রু হয়ে যায়।”

ইনারা বুঝতে পারে সভ্য জোহানকে নিয়ে কথা বলছে। সে ঠিক কি উওর দিবে বুঝতে পারে না। তাই কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে বলে, “দেখলাম কনসার্টে আপনার জন্য মেয়েরা ভালোই চিল্লাচিল্লি করছিলো। মনে হলো চিল্লিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেলবে।”
সভ্য ফিক করে হেসে দেয় ইনারার কথা শুনে,”কেন তোমার হিংসা হচ্ছে?”
“আ…আমার হিংসা হবে কেন? ভাবছিলাম কোন জাদু করেছেন তাদের।”
সে ইনারার বাহু ধরে তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়। তার চোখে চোখ রেখে বলে, “জাদুটা কী তোমার উপর চলেছে বলো তো?”
ঢোক গিলে ইনারা। সভ্যের চোখে চোখ রাখতেই যেন তার ভিতরের সবটা এলোমেলো হয়ে যায়। নিশ্বাস হয়ে যায় দিশেহারা। তার নিজেকে ছন্নছাড়া করে দিতে মন চায়।

হঠাৎ করে এক লোক সভ্যকে ডাক দেয়। সাথে সাথে চমকে উঠে দুইজন। দূরে সরে যায়। লোকটা রিসোর্টের মালিক। সে একজন মহিলা এবং দুইজন বাচ্চা ছেলে নিয়েছে। লোকটা জানাল তারা সকলে সভ্যের অনেক বড় ভক্ত। তারা সভ্যকে দেখে উৎসুক হয়ে যায়। গতরাতে হয়তো সভ্যকে দেখে সে পরিবার নিয়ে এসেছে। ইনারা তাদের সভ্যের সাথে ছবি তুলে দিয়ে নিজে একটু দূরে যেয়ে দোলনায় বসে। তাদের একা সময় দেয়। দোলনায় দুলতে দুলতে সে তাকিয়ে রয় সভ্যের দিকে। গতরাত নিশ্চয়ই নির্ঘুম কেটেছে তার জন্য। আর এতদিনের কাজেও। তাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। অথচ এখনো কত হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। নিশ্চয়ই সে জাদু জানে। যে জাদুতে তার প্রতি মুগ্ধ না হওয়াটা অসম্ভব। সে দেখে সভ্য তার দিকেই তাকিয়েছে। সাথে সাথে সে চোখ সরিয়ে নিলো। আবার তাকাল। এখনো সভ্যের দৃষ্টি তার দিকে আটকানো। এবার সে চোখ সরাল না। দোলনার দঁড়িতে মাথা ঠেকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। এক না বলা প্রতিযোগিতা চলল। যেখানে না কারও জয় আছে, আর না পরাজয়।

দুইজনে চা নাস্তা করে নিজের রুমে গেল ফ্রেশ হতে। ইনারা ফ্রেশ হয়ে নিয়ে তার ব্যাগ খুলে ড্রেস বের করার জন্য। তখনই তার চোখ পরে তার মা’য়ের নীল শাড়িটার উপর। নীলের উপর আকাশী রঙের কাজ। শাড়িটা সৌমিতা আন্টি তাকে দিলেন আসার আগে। তার কাছে মা’য়ের শেষ স্মৃতিটা না’কি এটাই। কেন যেন এটা এখানে নিয়ে এলো ইনারা। শাড়িটার ঘ্রাণ নিয়ে তার মা’য়ের কথা মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু এবার তার চোখে জল নয়, ঠোঁটে হাসি এঁকে এলো। তার মনে পড়লো সভ্যের বলা গতরাতের কথা। সত্যিই তো মা কখনো তার চোখের জল সহ্য করতে পারতো না। কষ্ট পেত। তাহলে সে আজ এত বিশেষ দিনে তার মা’কে কষ্ট দিতে পারে কীভাবে?

দরজায় টোকা পরে। নিশ্চয়ই সভ্য। তার এতক্ষণে তৈরি হবার কথা ছিলো। সে দ্রুত যেয়ে দরজা খুলে। সভ্য তার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “মেয়েরা যতই গেঞ্জি প্যান্ট পরুক না কেন তৈরি হতে তার দেরি হবেই।”
“তাহলে জানলে এত তাড়াহুড়ো করে এলেন কোন দুঃখে? এসেই যখন পরেছেন এসে বসুন।”
ইনারা সভ্যকে রেখে বাথরুমে গেল চেঞ্জ করতে এসে। এসে দেখে তার হাতে মা’য়ের শাড়ি। সে বলে,”এটা আমার আম্মুর শাড়ি সুন্দর না?”
কথাটা বলতে দেরি। সভ্যের তাকে ধরে আয়নার সামনে নিয়ে দাঁড় করাতে দেরি হয় না।

ইনারা হতবাক, “করছেনটা কী?”
সভ্য শাড়িটা ইনারার উপর জড়িয়ে বলে, “তোমাকেও সুন্দর লাগছে। আজ এটা পরে চলো না।” কেমন আবদারের সুরে বলল সে।
কিন্তু ইনারা তো কিছুতেই রাজি না।
“অসম্ভব। পাগল আপনি? আমি জীবনেও শাড়ি পরি নি। আর কোথায় যাব আমরা?”
“কেন ঘুরতে।”
“ঘুরতে? আমি কখনো এখানে আসলে ঘুরাঘুরি করি না।”
“আজকে করবে।”
“কেন?”
“কারণ আমি নিশ্চিত তোমার মা কখনো এটা চাইতো না যে তার মেয়ে তার কথা ভেবে চুপচাপ এখানে বন্দী হয়ে থাকবে। এ সুন্দর পৃথিবী ঘুরে দেখতে পারবে না। আজ তোমার মা’য়ের জন্মদিন তাই না? চলো আজ উনার জন্মদিন এই সুন্দর রাজ্যে পালন করি। আর তোমার শাড়ি পরলে তাকে অনুভবও করতে পারবে তুমি। মনে হবে সে সবসময় তোমার কাছে।”
“কিন্তু আমি শাড়ি পরতে পারি না।”
সভ্য ইনারাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দুষ্টুমির সুরে বলল, “”আমি পরিয়ে দিব?”
ইনারা সভ্যের বুকে মেরে বলল, “ছিঃ! কী বলেন এসব?”
সভ্য হাসে, “মজা করছি। আমি এখনই আসি।” বলেই সভ্য বাহির দিকে দৌড়ে যায়। ইনারা উঁচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় যাচ্ছেন?”
“তোমার শাড়ি পরানোর ব্যবস্থা করতে।”
“আমি কখন বললাম আমি যাব?”
“তুমি যাবে আমি জানি।”
“কিন্তু আপনার তো সমস্যা হবে।”
সভ্য দাঁড়ায় দরজার কাছে, “লোকালয়ে আগামীকাল মাস্ক পরে যাব। চিন্তা করো না তোমাকে শাড়ি পরিয়ে আজ লোকদের সামনে নিয়ে যাচ্ছি না।” আবার বিড়বিড় করে বলল, “সেভাবে তোমাকে দেখার অধিকার কেবল আমারই আছে।”
বলেই এক দৌড় দিলো সে।

রিসোর্টের মালিকের স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলো সভ্য। সে ইনারাকে নিয়ে যায় শাড়ি পরানোর। তার বাসা রিসোর্টের সাথেই। এতটুকু সময় সভ্য বসে বসে কথা বলছিলো রিসোর্টের মালিকের সাথে তাদের বাড়িতেই। রিসোর্টের কিছু স্টাফ বাদে কেউ-ই তাকে দেখে নি এখানে। এবং সে সকলকে অনুরোধও করেছে কাওকে না জানাতে। এই দুইদিনের জন্য এই রিসোর্ট সে বুক করে নিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেও এখানে থাকা গেস্টরা চলে যাবে। তারপর তারা স্বাধীনভাবেই ঘুরতে পারবে। নাহলে এতক্ষণে সে বিশাল ঝামেলায় পড়তো।

লোকটার সাথে কথা বলতে বলতে অতিষ্ঠ হয়ে পরেছিল সভ্য ইনারার অপেক্ষায়। তার তো তর সইছে না। মেয়েটা তার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে। খুবই বাজে পরীক্ষা। এখন তার খুবই বিরক্ত লাগছিলো। সে ক্লান্ত হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে কথা বলছিলো লোকটার সাথে। তবে তার দৃষ্টি আটকে আছে দরজার দিকে। সে দেখে দরজা থেকে বের হচ্ছে ইনারা। তার পরনে নীল শাড়ি, চোখে নীল কাজল মাখা, দুইহাত ভর্তি নীল চুরি, তার গাল দুটো লালচে, ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি লিপ্সটিক দেওয়া। আর চুলে খোঁপা বাঁধা। তার দর্শনেই সভ্য যেন নিজের সামাল হারাল। দেয়াল থেকে কাঁধ পিছলে পরে যেতে নেয়। খুব কষ্টে সামলায় নিজেকে। তবুও যেন তার নিশ্বাস আটকে এলো। তার দৃষ্টি সরানো দায়। বেহায়ার মতো তাকিয়ে রইলো ইনারার দিকে। আশেপাশের লোকদের কথাও তার মাথায় নেই। এর পূর্বে সে কখনো ইনারার রূপে পাগল হয় নি। কিন্তু আজ যেন ইনারা নামক নেশায় আসক্ত হয়ে গেছে। তার আশেপাশের বাতাস মাতাল হয়ে এলো।

মুখে কোনো কথা হয় না। কিন্তু সভ্যের এমন বেহায়া দৃষ্টির মাঝেই ইনারা প্রশংসা খুঁজে পায়। মুচকি হেসে চোখ নামিয়ে নেয়। লজ্জায় লালিমায় রঙে যায়। এর পূর্বে সে অন্যকারো জন্য এমন লজ্জা পেয়েছে বলে সন্দেহ। এমন নারীসুলভ আচরণও খুব কম করেছে সে। তার এসব পছন্দ না। কিন্তু আজ তার ইচ্ছা করছে সে প্রতিটা দিন এভাবে শাড়ি পরেই দাঁড়িয়ে থাকুক সভ্যের সামনে। আর সভ্য এমন বেহায়াভাবেই তাকিয়ে থাকুক তার দিকে। সে এভাবেই লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেক। তবুও সভ্য তার দৃষ্টি না সরায় তার থেকে। দেখতে থাকুক। এভাবে দেখতে দেখতে তার প্রেমে ভেসে যাক। তার হঠাৎ জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হলো, “গায়ক সাহেব, আপনাকে চাওয়া হাজারো মেয়েদের মাঝেও কি আপনি এই সাধারণ মেয়েটির প্রেমে পড়তে পারবেন? কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও?”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here