অনুভবে পর্ব-৩৯

0
1004

অনুভবে
পর্ব-৩৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

“আজ এই মাতোয়ারা বৃষ্টিকে সাক্ষী রেখে স্বীকার করছি ভালোবাসি তোমায় প্রণয়ী…..”
বলেই গালে চুমু খায় সে। ভিজে থাকা গালে সভ্যের ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠে ইনারা।

সভ্য মুখ তুলে তাকায় ইনারার দিকে। ইনারার চোখ নেয়। লজ্জামাখা তার গাল। উওর কি তাহলে হ্যাঁ ধরে নিবে সে? তার কাঁধে ভিজে থাকা কেশ নিয়ে খেলা করতে শুরু করে সভ্য। ইনারা এখনো চুপ। মুখ নিচু করে দাঁড়ানো। কিছুসময় পর যখন সে চোখ তুলে কোনো উওর দিতে নেয় এর পূর্বেই সভ্য তার ঠোঁটজোড়া নিজের দখলে নিয়ে নেয়। আরও কাছে টেনে নেয় তাকে।

“কোথায় হারিয়ে গেলেন? আসুন না, আমার সাথে ভিজুন একটু। ভালো লাগবে।” ইনারার কথায় ঘোর ভাঙে সভ্যের। সে অস্থির হয়ে আশেপাশে তাকাতে শুরু করে। ইনারা তার কাছে নেয়। বরং দুই হাত দূরে দাঁড়ানো। সে এখনো খিলখিল করে হেসে দুইহাত পেখমের মতো মেলে তাকিয়ে আছে। তাহলে এতক্ষণের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ কল্পনা? ইনারাকে কাছে টেনে নেওয়া, তার ভালোবাসার স্বীকারোক্তি করা, চুমু দেওয়াটা, সবই কি কেবল কল্পনামাত্র! এটা সত্যি হলে ইনারা এভাবে খিলখিল করে হাসতো না। হয়তো সে লজ্জায় ডুবে থাকতো, নাহয় তার গালে জোরে এক চড় বসিয়ে দৌড়ে যেত রিসোর্টের দিকে।

দুই নং ঘটনাটা হবার সম্ভাবনা বেশি। ইনারা কিশোরী মাত্র। তাই তার আবেগ বেশি। এই আবেগী দিনে লজ্জা পাওয়াটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো পুরুষ তার অনুমতিবিহীন এমন কান্ড করলে নিশ্চিত সে এতটা সহজে ব্যাপারটা নিবে না। এমনকি তার মুখও হয়তো কখনো দেখতে চাইতো না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সভ্য। ব্যাপারটা কল্পনা হবার কারণেই বেঁচে গেল, নাহলে এই মাতোয়ারা পরিবেশ তো তাকেই আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। তবে এ মুহূর্তে সত্যিই তার ইনারার কাছে নিজের ভালোবাসাটা স্বীকার করতে মন চাইছে। কিন্তু যদি ইনারা তাকে প্রত্যাখ্যান করে দেয়? তাদের দেখা হয়েছে সবে সাড়ে তিনমাস। একে অপরকে বুঝার জন্য আরও সময় প্রয়োজন। তার এই স্বীকারোক্তিটা নাহয় আরও কিছু সময় পর হোক। আর এই কল্পনাটা সে একদিন সত্যি করবেই। আজ না হোক, হয়তো তাদের বিয়ের পর।

সভ্য আবারও নিচে বসে পরে। বৃষ্টির বেগ এখনো তীব্র। ইনারার দিকেই দৃষ্টি রেখে হাতে গিটার নিয়ে বাজাতে শুরু করে। সে তাকিয়ে রয় ইনারার দিকে। গিটারের সুরে ইনারা তাকায় সভ্যের দিকে। ঝুম বৃষ্টিতে তাকে আবছা দেখাচ্ছে। তবুও তার ঝলক ইনারার গালের হাসিটা গাঢ় করল। মানুষটা তার দিকেই তাকানো। সভ্যের গিটারের সুরের সাথে তার এই ঝুম বৃষ্টিটা স্বপ্নের মতো লাগছে। তার ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তটা এখানেই থেমে যাক।

কিন্তু মুহূর্তটা থেমে যায় না। বৃষ্টি ঝরা বন্ধ হয়। আজ তাদের রিসোর্ট থেকে বের হবার কথা ছিলো না। কিন্তু হতে হলো। সভ্যের কোম্পানি থেকে কল এসেছে। আগামীকাল তাদের মিটিং। তার সেখানে থাকাটা জরুরী। তার দল হয়ে তাকেই সব কথা বলতে হয়। তাকে এক প্রকার নিজের দলের জন্য যেতে বাধ্য হতে হয়। কিন্তু হঠাৎ করে এই মিটিং কিসের তা বলা হলো না। তার এখনই রওনা দেওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু সে রওনা দেয় না। রাতে দিবে। ইনারার সাথে প্রতিটি মুহূর্ত তার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

রিসোর্টটা দেখতে সুন্দর। তাই সেখানেই দুপুর পর্যন্ত ঘুরেফিরে খাবার খেয়ে বের হয় দুইজন শ্রী মঙ্গলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। গাড়িতে করে রওনা দিতে চাইলো সভ্য। কিন্তু ইনারা কিছুতেই গাড়িতে যাবে না। সে রিসোর্টের মালিককে দিয়ে একটি অটো আনাল। তার ভাষ্যমতে অটোতে খোলামেলা জায়গা দিয়ে শ্রীমঙ্গলের সৌন্দর্য বেশি দেখা যায়। তার জেদের সাথে পারা যায়? ইনারা আজ পরেছে একটি গোলাপি রঙের কামিজ সভ্য খানিকটা অবাক। তাকে এই প্রথম সে সেলোয়ার-কামিজ দেখছে। আর গোলাপি রঙেও। ইনারার মধ্যে মেয়ে সুলভ ভাবটা একটু কম। আর তার পোশাকে মেয়েলী ভাব দেখাই যায় না। কিন্তু ইদানিং সে পরিবর্তন হচ্ছে। এর পরিবর্তন হওয়ার কারণটা সে ধরতে পারছে না। রাস্তায় যাবার সময়ে চা বাগানে একটু ঘুরেঘারে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো ইনারা। এমনকি সভ্যকে ধরে নিয়ে তার সাথেও তুলল। যদিও সভ্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। সে মাস্ক এবং ক্যাপ পরা। সেখান থেকে তারা রওনা দিচ্ছিল বাইক্কা বিলের দিকে। মাঝপথে একটি কাশবাগান দেখে ইনারা অটো থামায়। কাশবাগানে যাবার জন্য এক পাহাড়ি ঝর্ণার এক ঝিরিপথ পার করতে হবে। ইনারা খুবই উৎসাহ নিয়ে জুতো খুলেই নেমে পরলো। কিন্তু সভ্য সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়। সে এসব বুঝে না। কখনো এমন কিছু অভিজ্ঞতা তার হয়নি। কিন্তু ইনারা তো তাকে একা ছেড়ে যাবে না। তাই ধরে বেঁধে নিয়ে গেল তাকে। তারও সে শীতল জলে পা রাখতে হলো। কিন্তু পাড় হবার পূর্বে ই ইনারার মাথায় দুষ্টুমি চড়ে। সে পানি হাতে নিয়ে সভ্যের মুখে মারতে থাকে। আর প্রতিবার এই দুষ্টুমি করবার পর খিলখিল করে হেসে উঠে। সভ্য একবার বকা দিতে চায়। কিন্তু এমন হৃদয় কাঁপানো হাসি দেখে কিছু বলার সাহস কোথা থেকে পায় সে?

এত কষ্ট কেবল কিছু কাশফুল ছোঁয়ার জন্য। কিছু কাশফুল হাতে পেয়েই দৌড়ে চলে আসে সে। তারপর তারা যায় মনিপুরী পল্লীতে। সেখান থেকে সতেরোটা শাড়ি কিনে সভ্য। আর ইনারা দুইটা। তাও আইজা আপি আর সুরভীর জন্য।

ইনারা অটোতে বসেছিলো। একটা আট রঙের চা অর্ডার দেওয়া হয়েছে। একটা কারণ সভ্য পাবলিক প্লেসে মুখ খুলে চা খেতে পারবে না। ইনারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাড়িগুলোর দিকে। তার এমন মুখ দেখে সভ্য জিজ্ঞেস করে, “কেমন প্যাঁচার মত মুখ করে রেখেছো কেন?”
“তো আর কি করবো? আমার ঘুলি উড়ায় দিলেন আপনি। আপনি তো পুরো ঢাকা শহরের জন্য শাড়ি কিনে আনলেন। অটোতে আমার জায়গায় শাড়ি ভর্তি।”
“এত কোথায়? আমি তো আরো বেশি নিতে চেয়েছিলাম। তুমিই তো বকা দিয়ে মানা করলে।”
“ইসব আসছে এমন মুখ করে আছে যেন ভাঁজা মাছ উলটে খেতে পারে না। বলুনতো এত শাড়ি আপনি কার জন্য নিয়েছেন?”
“তোমার তো দেখছি জানার খুব আগ্রহ।”
“থাক বলতে হবেনা।”
চা এসে পড়েছে। একটি ছোট ছেলে ইনারার হাতে চায়ের কাপটা দিয়ে গেল। সেই চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার পূর্বে বিড়বিড় করে বলল, “আমায় বলবে কেন? নিশ্চিত ঐশির জন্য নিয়েছে। তাকে ছাড়া আর কার জন্য নিবে?”
তার চোখেমুখে বিরক্তি দেখা গেল। চা’য়ের কাপে চুমুক দিয়ে সে বলল, “অসাধারণ চা। কিন্তু আফসোস আপনি খেতে পারবেন না।”
খানিকটা আর ঢঙ করেই বললো সে। সভ্য হাসে, “আচ্ছা চা অসাধারণ বুঝলাম। তাহলে তোমার মুখ এমন পেঁচার মতো করে রেখেছো কোন দুঃখে? আচ্ছা বলছি, এখানে পনেরো রঙ্গের শাড়ি আছে। এর মধ্যে তিনটা নীল পাড় ওয়ালা গোলাপি জমিনের শাড়ি। সে তিনটার মধ্যে একটা ঐশির, আরেকটা সুরভির।”
থতমত খেয়ে যায় ইনারা, “সুরভির জন্য কেন?”
সভ্য হেসে ইনারার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে খুবই দ্রুত চা’য়ের কাপে চুমুক দিলো। যেন কেউ না দেখে তারপর বলল, “আহ চা আসলেই অসাধারণ। তুমি তো আমাকে চায়ের নেশাও করে দিচ্ছ। আমার ডায়েটের বারোটা বেজে যাচ্ছে তোমার জন্য।”
“কথা একদম ঘুরাবেন না। সুরভিকে কেন দিচ্ছেন?”
সভ্য মনে বলে, “নিজের শালী সাহেবাকে ঘুষ দিয়ে রাখতে হবে না? ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।” কিন্তু মুখে বলল, “সেদিন বললে ও আমাকে খুব পছন্দ করে তাই ভাবলাম খুশি হবে।”
ইনারা সম্ভবত সন্তুষ্ট হয় উওরে। এর থেকে বেশি খুশি হয়। সভ্য ভাবে এই সে জিজ্ঞেস করবে তার শাড়িটা কোথায়? অথবা মন খারাপ করবে নিজের জন্য। কিন্তু এমন হলো না। ইনারা সুরভির কথা শুনেই খুশিতে আত্নহারা। এর উপর সে নিজের জন্য কিছুই কিনে না। কিন্তু সুরভি এবং আইজার জন্য ঠিকই শাড়ি নিয়ে নিয়েছে।
ইনারা প্রশ্ন করেন তারপরেও সভ্য বলে, “জানো পনেরোটা শাড়ি কার জন্য?”
“কার জন্য?”
“আমার বউয়ের জন্য। সে শাড়ি পরলে মনে হয় পৃথিবীর সকল মায়া তাকে ঘিরে রেখেছে। বিয়ের পর তাকে বলব প্রতিদিন যেন কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও আমার সামনে শাড়ি পরে এসে বসতে।”
ইনারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার হাসিমাখা মুখ মুহূর্তেই কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। অর্থাৎ সত্যিই সভ্যের জীবনে কেউ আছে? যাকে বউ বলে সম্বোধন করতেও দ্বিধাবোধ করছে না সে। ইনারার প্রচুর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো তার নাম কিন্তু এর সাহস হলো না। সম্ভবত সে বিষয়টা সইতে পারবে না।

সেখান থেকে রওনা দেওয়ার পর খুবই চুপচাপ রইল ইনারা। আজ সারাক্ষণ তার বকবক শেষ হচ্ছিল না। আর হঠাৎ করেই সে এমন চুপচাপ হয়ে গেল।

দুইজনে বাইক্কা বিলে যেয়ে পৌঁছাল খুবই সুন্দর সময়ে। সূর্যোস্ত হবে। নৌকায় বসে তারা যখন বিলের মাঝখানে পৌঁছায় তখন আকাশে লালিমা ছড়িয়ে যায়। জলে ছায়া পড়ে রঙিন আকাশের। সেখানে সারি সারি গোলাপি রঙের পদ্মা ভেসে আছে। সূর্যের রক্তিম লালিমায় দৃশ্যটা স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তার সামনে বসা কন্যাটাকেও। তার মুখের উপর সূর্যের লালিমা পরছে। চোখের নিচে লেপ্টে থাকা সকালের কাজল, কপালে এখনো লাগানো নীল টিপ। অতি সাধারণ দেখাচ্ছে তাকে। তবুও তার সামনে অন্যকিছু দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না ইনারার। সে মুগ্ধ নয়নে ইনারাকে দেখছে, এবং ইনারা মুগ্ধ দৃষ্টিতে এই সম্ভব সুন্দর দৃশ্য। সভ্য হাতের কাছে একটা পদ্মা পেয়ে তুলে নিলো। তা এগিয়ে দিলো তার প্রণয়ীর দিকে। ইনারা কিছুটা আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। তার উদাসীন ঠোঁটে এঁকে উঠে সূর্যের লালিমার মতো উষ্ণীষ হাসি। তা তার হৃদয়েও উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয়। সে হাত বাড়িয়ে পদ্মাটা নেয়। আঙুলে আঙুল ছোঁয়। কেঁপে উঠে সভ্যের বুকের ভেতর। আচ্ছা প্রেমিকরা তো তার প্রেমিকাকে প্রথম ফুল গোলাপ দেয়। সে দিলো পদ্মা। এটা কী মানানসই? প্রেম সম্পর্কে তার ধারণা বিন্দুমাত্র। আচ্ছা সে কী প্রেমিক হিসেবে উত্তীর্ণ হতে পারবে তো?

অবশেষে রাতে রওনা দেয় সভ্য। ইনারা যাবে আরও একদিন পর। তাকে ছেড়ে যাওয়াটা খুবই কষ্টকর হলেও তার যেতে হয়। তার ইচ্ছা ছিল একেবারে ইনারার সাথেই যাবে। এমন সুযোগ পাবে কোথায়? তবে সে গেলেও সারারাস্তা ইনারার সাথে ফোনে কথোপকথন হলো তার। কেউ ঘুমালো না। কেউ ফোন রাখার কথা বলল না। এপাশ থেকে সভ্য ইনারার ছবি দেখে কথা বলছিলো। তো ওপাশে ইনারা শুয়ে শুয়ে সভ্যের অর্ধেক লেখা গানটি বারবার মনে মনে পড়ছিলো,

“প্রেমের উষ্ণ হাওয়ায় মাতাল তুমি আর আমি
তোমার আঁখি নীল সমুদ্র তোমাতেই আমি;
আমি ডুবে যাব ডুবে যাব তোমার মাঝে, প্রণয়ী
আমি ডুবে যাব ডুবে যাব তোমার মাঝে, প্রণয়ী।

তুমিতে তুমিতে হারাই বারে বারে আমি;
তোমারেই ভালোবাসি কীভাবে বলি আমি?”
.
.
ভোর ভোর সভ্য ঢাকায় পৌঁছালো। কিন্তু ঘুমানোর সময় পেল না। সেখানে জরুরী কিছু কাজ সেরেই মিটিং এ গেল। এত জরুরি মিটিং ছিলো জোহানের এক্টিং কারিয়ারের জন্য। একদিন আগে একাউন্স করা হয়েছিলো তার নতুন অভিনেতার যাত্রার। অথচ আগামী দুইদিনেই তার প্রথম ফিল্মের শুটিং শুরু। এটা তো সম্ভব নয়। দুই দিনে কিছুই হয় না। নিশ্চয়ই এ প্রজেক্টর কথা মাসখানিকের বেশি সময় নিয়ে চলছে। যা কাউকে জানানো হয়নি। অথচ এটা বড় একটা ইফেক্ট পরতে পারে তাদের দলীয় কার্যক্রমে। সভ্য যখন প্রশ্নটি তুলে তখন মিঃ হক তার পূর্ব হতে ভেবে রাখা উত্তরটি দেয়, “আমি কেবল জোহানের কথা ভাবছি না। তোমাদের সবারই এখন আলাদা প্রজেক্টে কাজ করা শুরু করা উচিত। দলীয় কার্যক্রম চলবে। বছরে ধরো একটা অ্যালবাম বের হলো। আর সাথে তোমাদের একত্র কাজ চলবে।”

উওরটাতে সবাই সন্তুষ্ট। সভ্য ছাড়া। সে জানে মিঃ হক কেবল জোহানের দিকটাই ফোকাস করতে চান। তিনি দলটাকে ভাঙার পূর্বে জোহানের ফ্যান ফলোয়ার বাড়াতে চান। এতে তার সমস্যা না হলেও, তার চিন্তা দলের বাকি সদস্যদের নিয়ে। বিশেষ করে ঐশী এবং ইরফান। ঐশি খুবই লড়াই করে এই পর্যায়ে এসেছে। তার বাবা মেয়েদের ক্যারিয়ার গড়ার ব্যাপারটা সহ্য করতে পারে না। আর গান তার স্বপ্ন। সে এই স্বপ্ন সারাজীবন বাঁচতে চায়। তাইতো সে কেবল বাহ্যিক জগতের ঘৃণার সাথেই না, নিজের বাবার সাথে লড়াই করেও এই ফিল্ডে টিকে আছে। অন্যদিকে ইরফান মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে। তার জন্য এসব অর্জন করা সবচেয়ে বেশি কঠিন হয়েছিলো। তাই এই দুইজনের জন্য সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা সভ্যের।
.
.
একদিন পর ঢাকায় এসে পৌঁছায় ইনারা। রাতের সময়। সে বাসায় এসে দেখে ঘরে মুশতাক সাহেব আছেন। তার সাথে বসে আছে সাইদ, জোহান এবং আইজা আপু। সে তাদের না দেখার ভান করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে তখনই আইজা ডাক দেয়, “ইনু তুই বাসায় এসে পড়েছিস? দেখ আজ দাওয়াতে কে এসেছে?”
ইনারার থামতে হলো। তার রুমে যেয়ে সভ্যকে আসার খবর দেবার কথা। তাই সে দ্রুত রুমে যেতে চেয়েছিল কিন্তু এখন তো তার আর যাওয়া সম্ভব নয়। ইনারা জোরপূর্বক ফিরে এসে দাঁড়ায় টেবিলের সামনে। মুশতাক সাহেব কঠিন গলায় বলে, “কত বেয়াদব হয়েছ! মেহমান ঘরে এসেছে দেখেও থেমে কথা বলার প্রয়োজনবোধ করলে না?”
প্রতিবারের মতো এবারও আইজা বাঁচায় তাকে, “আরে মামা ছাড়েন না। ইনু হয়তো দেখিনি। কত ক্লান্ত দেখুন, মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে।”
মুশতাক সাহেব জোহানের জন্য কথা বাড়ালেন না। নয়তো কিছু নিশ্চয়ই বলতেন।

আইজা বলে, “জানিস কয়দিনেই জোহানের সাথে আমার প্রথম ফিল্মের শুটিং শুরু হবে। আমার প্রথম ফিল্ম জোহানের সাথে আমি কত ভাগ্যবান দেখেছেন। এর উপর ফিল্ম মামা ডিরেক্ট করছে।”
ইনারা খুশিতে জড়িয়ে ধরে আইজাকে। তার গালে গাল ঘেঁষে টেনে বলে, “কনগ্রেটস আপি।”
“আমাকে অভিনন্দন জানাবে না?” জোহান জিজ্ঞেস করে। সে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। তার দৃষ্টি দেখি কেমন অস্বস্তি লাগে ইনারার। তবুও সে জোরপূর্বক হেসে বলে, “কনগ্রেটস।”

আইজা তাকে নিজের পাশেই বসায়। সকলে ফিল্মটা নিয়ে গল্প করছে। সকলেই বেশ উৎসুক। অথচ সবচেয়ে বেশি উৎসুক দেখাচ্ছে সাইদ ভাইয়াকে। সে আইজা আপুর সাফল্যতার কথা ভেবেই উৎসব পালন করছে। ইনারা ভাবতে বাধ্য হয়, সকল প্রেমিক মানুষ কি তার প্রেমিকার সাফল্যতা দেখে তার থেকেও বেশি খুশি হয়?

তবে সে খেয়াল করে ফুপু জোহানের যতটা খাতির করছে তার চেয়ে বেশি অবহেলা করছে সাইদকে। কথায় আছে না, টাকায় কথা বলে। এখানেই ব্যাপারটা তাই। কিন্তু ইনারার ব্যাপারটা অকপটে লাগে। সে নিজেই উঠে সাইদকে খাবার পরিবেশন করতে শুরু করে।

খাবার শেষে সবার আগে উঠে মুশতাক সাহেব। আইজা এবং সাইদও উঠে যায় কিছু কাজের জন্য। ইনারা খাবার খাচ্ছিলো। সে ভাবে যেহেতু বসেই থাকতে হবে সেহেতু খেয়েই নেক। তার সবচেয়ে বেশি দেরি হলো। কিন্তু সে যতক্ষণ না পর্যন্ত খাবারের টেবিল থেকে উঠে ততক্ষণ পর্যন্ত জোহানও বসে থাকে। টেবিল থেকে উঠে যেতে নিলেই জোহানও উঠে তার হাত ধরে নেয়, “তুমি কি আমাকে ইগনোর করছো?”
প্রশ্ন করে জোহান।
“আমি আপনাকে ইগনোর করতে যাব কেন?”
“মনে হচ্ছে। তুমি আগের মতো আমার সাথে কথা বলো না।”
“আমি আপনার সাথে সাধারণ ভাবেই কথা বলছি। আগে পাগলামো করে আপনার আগেপিছে ঘুরে বেড়াতাম।” মজার সুরেই কথাটা বলে ইনারা।
“তাহলে আবারও সে পাগলামোটা করো না প্লিজ। তোমার এমন ব্যবহার আমার সহ্য হচ্ছে না।”
এবার আসলেই ব্যাপারটা গম্ভীরভাবে নেয় ইনারা, “আজব তো আপনিই তো একদিন বলেছিলেন আপনার আমার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই। তাহলে গত একমাসে আপনার কী হলো?”

ইনারার ফোন বেজে উঠে। টেবিলে ফোন রাখা। ক্রিনে সভ্যের নাম ভেসে আছে। তার নাম দেখতেই জোহান আরেকটু শক্ত করে ধরে নেয় ইনারার হাত। দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে তোমার এ ব্যবহার এর কারণ কী সভ্য? ওর সাথে কি চলছে তোমার?”
ব্যাথা পায় ইনারা। সে কপাল কুঁচকে তাকায় জোহানের দিকে, “সমস্যা কী আপনার? আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার আপনি কে? আপনি জানতে চান আমি আপনার সাথে এমন ব্যবহার কেন করছি? কারণ আগে আমি আপনার সম্মান করতাম। আপনার কিছু ব্যবহারের কারণে সে সম্মানটা আর করি না। যার জন্য আমার হৃদয়ে সম্মান নেই, তার জন্য কোনো অনুভূতিও নেই।”
“তাহলে তোমার মনে এখন কার জন্য সম্মান আছে? সভ্যের জন্য।”
“আপনাকে এ প্রশ্নের উওর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ আমি করছি না। সভ্যকে ভুলেও এর মাঝে আনবেন না।”
ইনারা এক ঝটকায় জোহানের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার ফোনটা হাতে নিলো। যাবার পূর্বে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল জোহানের দিকে, “আর খবরদার আমার অনুমতি ছাড়া আমার হাত ধরার সাহস করবেন না। আপনাকে আমি এই অধিকার দেই নি। তাই এর পরিণাম ভালো হবে না।”
ইনারা চলে গেল।

জোহান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই। আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে তার সাথে এভাবে কথা বলে নি। এর উপর মেয়েটা ইনারা হওয়ায় তার রাগ চরম সীমানায় চলে গেল। মাথায় রক্ত চড়ে বসেছে তার। সে হাত মুঠোবন্দী করে রাগান্বিত সুরে বলল, “তোমাকে তো আমার হতেই হবে ইনারা। তা আমার প্রেমে পড়ে হোক কিংবা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হোক। অধিকার না পেলে কীভাবে ছিনিয়ে নিতে হয় তা আমি ভালো করেই জানি। ”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here