অনুভবে পর্ব-৪২

0
1008

অনুভবে
পর্ব-৪২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সভ্য ইনারার গালে নিজের গাল মিশিয়ে রঙটা তাকেও মাখিয়ে দেয়। একটু সরে সে তাকায় ইনারার দিকে। হাসে। ইনারার দিকে ঝুঁকে তার চুল কানের পিছনে গুঁজে দেয় এবং মৃদুস্বরে বলে, “এবার তো তুমি আমার রঙে রঙিন হয়ে গেলে। এখন কি করবে?”

ইনারা লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। তার এই লজ্জামাখা মুখ দেখে তো সভ্য পাগল হয়ে যায়। মাতোয়ারা হতে ইচ্ছে হয় তার। আর তাকে সবচেয়ে বেশি আসক্ত করে ইনারার নীলাভ চোখদুটো। সে কখনো মদ্য ছুঁয়েও দেখে নি, তবুও সে নিশ্চিত একটানা মেয়েটার চোখে তাকিয়ে থাকলে মদ্য থেকেও বেশি নেশায় ডুবে যাবে সে। সে ইনারার চিবুকে হাত রেখে তার চোখে চোখ রাখে এবং বলে, “ইনারা তুমি জানো তোমার চোখজোড়া সায়রের মতো। যে কাওকে মুহূর্তে ডুবাতে বা ভাসাতে পারে।”
হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তটির সমাপ্তি ঘটে কলিংবেলের শব্দে। দুইজনে চমকে উঠে। যেন কেউ তাদের চুরি ধরে নিয়েছে। সভ্য উঠে যেয়ে দরজা খুলে। সে দেখে সকলে এসে পড়েছে রাতের খাবার নিয়ে। এরপর সভ্য কেক বানাতে চলে যায়। আর সকলে কথা বলতে থাকে। সকলে বলতে প্রধানত ইনারা এবং সামি। দুইজনে হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকে। আগে তাদের আড্ডায় ঐশিও যোগ দিতো কিন্তু এখন আর সে ইনারার সাথে কোন কথাই বলে না। সে সোজা গেল সভ্যের কাছে। রান্নাঘরে।

তার সভ্যের কাছে যাওয়াটা দেখেই ইনারার মুখের হাসি মলিন হয়ে আসে। কোনো এক কারণে সে সভ্যের আসেপাশে ঐশিকে দেখে ঈর্ষান্বিত অনুভব করে। কিন্তু কথাটা প্রকাশ করতে পারে না। সে সামি এবং ইরফানের সাথে কথা বললেও বারবার দৃষ্টি যায় রান্না ঘরের দিকেই।

খাবার শেষে ইরফান ঐশিকে বাসায় পৌঁছে দিতে যায় এবং সামি কিছু সময়ের জন্য যায় তার রুমে। ইনারা বারান্দায় বসে দোলনায় দোল খাচ্ছিল। সভ্য এলো এক প্লেটে কেকের স্লাইস নিয়ে এবং অন্যহাতে তার কফি নিয়ে। সে ইনারার হাতে কেকের প্লেট দিয়ে নিজে এক চেয়ার এনে বসে।

“আজকে চাঁদটা খুব সুন্দর লাগছে তাই না? মনে হচ্ছে না অন্ধকার আকাশ ছড়িয়ে আছে সে চাঁদের জ্যোৎস্নায়।”
সভ্য হেসে চায়ে চুমুক দেয়, “তুমি এরকম কবি কবি কথা কবে থেকে বলা শুরু করলে? তোমার মুখে এসব মানায় না।”
মুখ বানায় ইনারা, “মানাবে না কেন? এখন অভিনেত্রী হলে তো মানাতেই হবে। আজ বিকালে যখন নাটক প্রদর্শন করেছিলাম তখনও কি মানায়নি? বাজে লাগছিল?”
“আমি ইনারার কথা বলেছি। তুমি যখন ওই চরিত্র প্রদর্শন করেছিলে তখন সে চরিত্র হিসেবে মানিয়ে নিয়েছ।”
“সত্যি বলুন, পার্ফোরমেন্স ভালো হয়েছে তো।”
“দেখ আমি কাওকে মাখন মেরে কথা বলতে পারি না। যা সত্য তা বলছি। তুমি নতুন। তাই সেরা হবে না স্বাভাবিক। কিন্তু তোমার এক্টিং এ কোনো অভিজ্ঞতা নেই বা তুমি কখনো এক্টিং ক্লাস করো নি একথা বলাটা মুশকিল। তোমার অভিনয়ে আবেগটা কম ছিলো। বিশেষ করে তোমার কান্নাটা আসল মনে হয় নি। আর যখন কারও কান্না আসল না মনে হয় বা সে চরিত্রটাকে আসল না মনে হয় তাহলে জনগণ তোমার সাথে কানেক্ট হতে পারে না। এছাড়া তোমাকে অস্থির লাগছিলো। স্টেজে তোমার আত্নবিশ্বাসী হতে হবে। আত্নবিশ্বাসী হলে তুমি ভুল করলেও সেটা মানুষের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। আর নার্ভাস থাকলে সবাই তোমার ভুল ধরার চেষ্টা করে। আর তোমার অন্যান্য চরিত্রের সাথে সম্পর্কেও কিছু একটা মিসিং লেগেছে।” এরপর এক এক করে সভ্য তার ভুলগুলো বলতে থাকে। অবশেষে সে বলে, “তোমার কাছে অনেক সময় আছে। চেষ্টা করলে তুমি খুব দ্রুতই সব শিখে যাবে।”
ইনারা সভ্যের কথা শুনে নিজেই ভয় পেয়ে গেল। চিকন সুরে বলল, “আপনি এক নিশ্বাসে এতকিছু বললেন কীভাবে? আর এতকিছু আপনি জানেন কীভাবে? আপনি তো গানের ইন্ডাস্ট্রিতে আছেন।”
“অভিনয় দেখলেই জানা যায়। তুমি যদি বেস্ট হতে চাও তাহলে পরিশ্রম তো করতে হবে।”
“করব। আমার যা করা লাগে সব করব। আর একদিন আমি আমার মায়ের মতো সবাইকে সেরা অভিনেত্রী হয়ে দেখাবো।”
বলেই দাঁত দিয়ে জিহ্বায় কামড় দেয় সে। কথাটা ভুলে মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে।

সভ্য কফিতে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গেল। সে তাকাল ইনারার দিকে। তাকে চিন্তায় ফেলার এক দুষ্টুমি বুদ্ধি এসেছে তার মাথায়। সে বলে, “মায়ের মতো? এ কথার অর্থ কি?”
ইনারা পড়ে গেল চিন্তায়। সে কি বলবে বুঝতে পারল না। কিন্তু অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল সভ্য থেকে তার পরিচয় লুকাবে না। সে সভ্যকে ভালোবাসে, সেই ভালবাসার মর্যাদাও থাকা উচিত। সে যদি ভালোবাসার মানুষটির কাছে নিজের পরিচয় লুকাতে ব্যস্ত থাকে তাহলে কিসের ভালোবাসলো। কিন্তু তার ভয়ও হচ্ছে। সে জানে সভ্য মিথ্যা অপছন্দ করে। সভ্য তাকে ভুল বুঝবে না তো?

সে বলল, “আচ্ছা আমি যদি আপনার কাছ থেকে একটা বড় তথ্য লুকাই। আপনি কি একটু বেশি রাগ করবেন?”
“কীসের কথা বলছ?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনারা। সাহস জোগাড় করে বলে, “আমি আমার মিথ্যা পরিচয় দিয়েছি। আমি কোন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে নই, অভিনেত্রী সাইয়ারা এবং পরিচালক মুশতাকের মেয়ে। আসলে আমার মা সবসময়ই চাইতো আমি নিজের বুঝ না হওয়া পর্যন্ত সাধারণভাবে সমাজের মাঝে জীবনযাপন করি। যেন ভবিষ্যতে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে আমার সমস্যা না হয়। বাবাও তাই চাইতেন। তাই আমার সবাইকেই মিথ্যা বলতে হতো।”
সভ্যর চোখেমুখে রাগ ভেসে উঠে। সে চেঁচিয়ে উঠে, “হোয়াট দ্যা হেল! তুমি এত বড় মিথ্যা কথা বলে এতদিন আমাদের সাথে ছিলে?”
ভয়ে কেঁপে উঠে ইনারা। শঙ্কিত হয়ে যায় সভ্যের উঁচু স্বর শুনে, “স..সরি।”
সভ্য আর পারে না। ফিক করে হেসে দেয় সে। ইনারার গাল টেনে বলে, “ভয় পেলে কত কিউট লাগে তোমাকে। আমি মজা করছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছি। এখানে রাগ করার কিছু নেই। কখনো কখনো আমাদের নিজের এবং আপনজনদের জন্য কিছু লুকাতে হয়।”
হাফ ছাড়ে ইনারা। সভ্যের বাহুতে মেরে বলে, “আপনি অনেক খারাপ বুঝলেন? এভাবে ভয় দেখায় কেউ।”
“তুমি জানো তোমার চোখ ছাড়া অনেক কিছুই মিলে তোমার মা’য়ের সাথে। খুব কাছের থেকে না দেখলে বুঝা যায় না। তোমার গাল একটু ফোলা ফোলা তো তাই।”
ইনারা নিজের গালে হাত রেখে বলে, “আসলেই তো। আমার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঢোকার পূর্বে শুকাতে হবে তাই না?” তারপর কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “আমার কেক, হালুয়া, বার্গার, ফ্রেঞ্চফাই, বিরিয়ানি, আর যা প্রেমি আছে সব ছাড়তে হবে? আমি কীভাবে থাকব ওদের ছাড়া।”
সভ্য শব্দ করে হেসে দেয়, “তুমি একটা পাগল। আর মনে রাখবে, তুমি যেমন আছো সুন্দর আছো। সবচেয়ে বেশি সুন্দর। তোমার পার্সোনালিটি এবং লুক তোমাকে অন্য সবার থেকে ভিন্ন করে বুঝলে?”
মৃদু হাসে ইনারা, “আপনি বিদেশে যেয়ে আমাকে ভুলে যাবেন না-তো?”
“প্রতিদিন রাতে কল দিব তোমাকে।”
“একদম না।”
“কেন? আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না?”
“কিন্তু আপনার পরীক্ষার সময় না। আপনার যে এক্সামের পূর্বএ বেশি বন্ধ থাকবে কেবল সেদিন কল।দিবেন। আচ্ছা আপনি এডুকেশন দিয়ে করবেন কি? আপনার তো ক্যারিয়ার সেট। আমার তো ভার্সিটির পড়া পড়তে আলসামি আসে আর আপনি তাও পড়াশোনা কন্টিনিউ করছন। ধন্য আপনি।”
হাসে সভ্য। জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা তোমার আসল পরিচয় কে কে জানে?”
“সুরভি, প্রিয় ও সাইদ ভাইয়া। সাইদ ভাইয়া জানে কারণ সে আইজা আপুর ফ্রেন্ড। ওহ হ্যাঁ, জোহান জানে।”
সভ্য চমকে তাকায় ইনারার দিকে। জোহান জানে? ইনারা তাকে বলে নি কিন্তু জোহানকে বলেছে? কথাটা জানতেই তার মাঝে অস্বস্তি ছড়িয়ে গেল। সে এ নিয়ে প্রশ্ন করতে চেয়েও করল না। কোন অধিকারে এ প্রশ্ন করবে সে?

এমন সময় ফোন আসে তার ফুপুর। সে সাথে সাথে দাঁড়িয়ে যায়, “আয়হায় বাসায় যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। এখনই রওনা দিতে হবে।”
“আমি তোমাকে দিয়ে আসছি।”
“না না আপনার অনেক কাজ বাকি। আমি ড্রাইভার আংকেলের সাথে চলে যাব। গাড়ি আছে নিচে।”

সভ্য নিচে এলো ইনারাকে এগিয়ে দিতে। ইনারা বলল, “আচ্ছা তাহলে আমি যাই। আপনি সাবধানে যেয়েন।”
ইনারা যেতে নিলেই সভ্য তার হাত ধরে নেয়। কেন যে তাকে নিজের চোখ থেকে উধাও হতে দিতে চায় না সভ্য। তাকে কি এতটাই ভালোবেসে ফেলেছে? না’কি ভয় হচ্ছে তার ইনারাকে হারানোর? তার ইচ্ছা করছে ইনারাকে বলতে, “আমি এভাবেই তোমার হাত সারাজীবনের জন্য ধরে রাখতে চাই। তোমাকে দূরে যেতে দিতে চাই না।” কিন্তু বলতে পারে না।

ইনারা জিজ্ঞেস করে, “কী হলো?”
সভ্য মাথা নাড়ায়। জোরপূর্বক হেসে বলে, ‘কিছু না।”
সভ্য হাত ছেড়ে দেয় ইনারার। সে গাড়িতে উঠে। গাড়ি স্টার্ট হয়। আবার পিছনে ফিরে তাকায় সে। সভ্য এখনো দাঁড়ানো। বুকের ভেতর কেমন এক অনুভূতি হয় তার। শান্তির, আবার অস্বস্তির। হঠাৎ তার কানে ভাসে সভ্যের কথা, “ইনারা তুমি জানো তোমার চোখজোড়া সায়রের মতো। যে কাওকে মুহূর্তে ডুবাতে বা ভাসাতে পারে।” ভাবতেই তার হৃদয়ে কেমন করে উঠে। আচ্ছা সভ্যের এমন প্রশংসা করার অর্থ কী? সভ্যের মনেও কি কিছু আছে তাকে নিয়ে? একবার আসুক সভ্য, তাকেই জিজ্ঞেস করবে। তার এমন কথা বলার অর্থ কী? হঠাৎ এভাবে কাছে আসার কারণ কী? তার মনে থাকা সব প্রশ্ন করবে। কিন্তু এখন নয়। আগে সভ্যের পরীক্ষা শেষ হোক। সে আবার ফিরে আসুক তার কাছে।
.
.
কয়েকদিন পর,
পরীক্ষা একদিন বাদেই। সভ্য পড়ছিলো। খুব ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তার বিশেষ কোনো ইন্টারেস্ট নেই পড়াশোনায়। কিন্তু তার দাদাসাহেবের হুকুমে পড়তে হয়। হঠাৎ করে তার ফোন বেজে উঠে। ঐশির কল। সে কল ধরে বলে, “হ্যাঁ ঐশি, বল।”
“স…সভ্য…মা!” নিশ্বাস যেন আটকে আছে ঐশির। সে ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না।
“তুই কাঁদছিস? কী হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?” আতঙ্কিত সুরে বলল সভ্য। কিন্তু ঐশি কান্নার জন্য কথা বলতে পারছিলো না। এরপর সামির কন্ঠ শুনতে পায় সে, “দোস্ত মামীর অবস্থা জটিল। ইসকেমিক স্টোক করেছে। ডাক্তার বলেছে তার অবস্থা ক্রিটিকাল। ”
“আমি আসছি।”
“না, আমি তোকে এখানের অবস্থা জানাব। প্রয়োজনে পরে আসিস। ঐশি না বুঝে তোকে কল দিয়ে দিয়েছে।”
“কিন্তু… ”
“কোনো কিন্তু না। তুই দেশে নেই যে এসে পরবি। আর তুই আসলেই তো আন্টি সুস্থ হয়ে উঠবেন না। আর আমরা সকলে আছি এখানে। আমি তোকে সব জানাব।”
“জোহান কোথায়? ও ঠিক আছে তো?”
কিছু মুহূর্ত সময় নিয়ে সামি জানায়, “ওর অবস্থা তেমন ভালো নয়। ও নিজেকে দোষারোপ করছে আন্টির এ অবস্থার জন্য।”
” কিন্তু কেন?”
“আন্টি কয়েকদিন ধরে ওকে তার কাছে একবারের জন্য আসতে বলছিলো। যায় নি জোহান। আজ স্টোক করার কিছুক্ষণ পূর্বেও ওকে কল দিয়ে আসতে বলেছিল। জোহান বিরক্ত হয়ে কল কেটে দিলো। ওর মতে এসব ওর দোষ।”
“এখন ও কোথায়?”
“বাড়ি গিয়েছে। খুব ডিস্টার্ব দেখাচ্ছিল।”
“তাহলে তোরা এখানে কি করছিস? ওকে একা ছাড়লি কীভাবে তুই? ও যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে? জলদি ওর কাছে কেউ যা।” আতঙ্কিত হয়ে উঠে সভ্য।
সামি গম্ভীরমুখে বলে, “ইনারা তার পিছু গিয়েছে।”
মুহূর্তে চুপ হয়ে যায় সভ্য। নিজের অনুভূতি বুঝার চেষ্টা করার সময় নিলো। তার মনে হলো তার হৃদয়ের ঈর্ষা তার মনের মায়ার উপর ভারী হচ্ছে। এ মুহূর্তে তার মনে এ খেয়াল কীভাবে আসতে পারে যে ইনারা আবার জোহানের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বে না’কি! এমন করুণ সময় এটা কীভাবে ভাবতে পারে সে? তার মানবতাও কি হ্রাস পাচ্ছে? এসময় জোহানের কাউকে প্রয়োজন। এখন এটাই গুরুত্বপূর্ণ।

জোহান হাওয়ার গতিতে তার রুমে ঢুকে কাঁচের আসবাবপত্র ভাঙতে শুরু করে। এক এক করে পুরা রুমের আসবাবপত্র ভেঙে মেঝেতে বসে পড়ে। তার হাত পা কাঁপছে। সে বুঝতে পারছে না কি করবে! শরীরের ভেতর কাঁপছে। বুকের ভেতরটা যন্ত্রণা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে মাথার ভেতরও কাঁপছে। তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে তার মা’য়ের সাথে কাটানো সব সুন্দর মুহূর্ত। তাকে অবহেলা করার মুহূর্তও। যন্ত্রণা অনুভব করে সে। কাঁদতে চায় না। কিন্তু চোখ ভিজে আসে তার। তার অস্থিরতা মেটানোর জন্য আরও যন্ত্রণা দিতে চায় সে নিজেকে। পাশে থাকা একটি কাঁচের টুকরা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে নেয়।

ইনারা জোহানের পিছনে আরেকটা গাড়ি নিয়ে আসছে। জোহানের রুমের বাহিরে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলো। তাকে দেখেই তারা চলে যায়। রুমে প্রবেশ করতে দেখে সারা কক্ষ কাঁচের টুকরোয় ভরা। এক কোণায় বসে আছে জোহান। তার দৃষ্টি মেঝেতে। তার চোখের পলক পরছে না। কেবল চোখ দিয়ে অশ্রুজল ভাসছে। আর হাতের মুঠোতে ভাসছে রক্ত। তার হাত দেখতেই কেঁপে উঠে ইনারা। মা’য়ের মৃত্যুর পর থেকে সে রক্ত দেখলে ভয় পায়। আর কেমন টুপ টুপ করে মেঝেতে পড়সে রক্ত। এ দৃশ্যটা শিউরে দেবার মতোই।

সে দৌড়ে যেয়ে জোহানের পাশে বসে। হাত থেকে কাঁচের টুকরো ছাড়ানোর চেষ্টা করে করে বলে, “কি করছেন এসব? ছাড়েন কাঁচের টুকরো।”
জোহানের গলার স্বর কাঁপা কাঁপা, “তুমি এখান থেকে যাও ইনারা, নাহলে আমি তোমারও কোনো ক্ষতি করতে পারি। দেখ নি আমার জন্য মা’য়ের আজ কি অবস্থা?”
“আপনার জন্য কিছু হয় নি। আপনি অকারণে নিজেকে দোষারোপ করছেন।”
“অকারণে না। অকারণে না ইনারা। আমি…আমি অনেক খারাপ জানো? আমি অনেক খারাপ। আমি মা’কে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তাকে অনেক অবহেলা করেছি। যে…যে আমার জন্য… আমার স্বপ্নের জন্য তার গুছানো জগত ছেড়ে আমার সাথে গেছে তাকে নিয়ে না’কি আমি লজ্জা পেতাম। সে..সে হাইক্লাস না বলে। আমি তাকে কত কষ্ট দিয়েছি। অবহেলা করেছি। অসুস্থ হলে তার খবর নিতাম না। নিজের মজায় ডুবে থাকতাম। আমি এই ফ্রেমেএ জগতে হারিয়ে নিজের মা’কে কীভাবে তুচ্ছ করতে পারি? ” জোহান চোখদুটো বড় বড় করে তাকায় ইনারার দিকে। চোখদুটো রক্তিম। তার মুখে ভয়, অপরাধবোধ, দুঃখ। সে কাঁপানো গলায় বলে, “আর আজ…আজ সে আমার সামনে পরে ছিলো। কিন্তু আমার সাথে কথা বলে নি। মা আমায় দেখলেই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো কিন্তু আজ নড়েও নি। হাত তুলে আমার চুলে হাত বুলিয়ে দেয় নি। ডাক্তার বলেছে…তার বাঁচার নিশ্চয়তা নেই। তুমি বলো কার দোষ? কার দোষ এখানে?”
ইনারা কি বলবে বুঝতে পারে না? এই মুহূর্তে তার কি বলা উচিত তাও বুঝতে পারে না। জোহানকে শান্ত করার জন্য বানিয়ে এক মিথ্যে কথা বলে, “আসার সময় সামি কল করেছিলো। আন্টি এখন অনেকটা বেটার। সে ঠিক হয়ে যাবে।

সাথে সাথে জোহান তাকায় ইনারার দিকে। দৃষ্টিটা অন্যরকম। দৃষ্টিতে আশার আলো ছিলো। সে বলে, ” সত্যি? তুমি সত্যি বলছ?”
ইনারা মাথা নাড়ায়। সে বসে জোহানের পাশে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আমরা সবাই জীবনে কোনো না কোনো ভুল করে থাকি। কেউ পার্ফেক্ট হয় না। জীবন আমাদের তা ঠিক করার একটি সুযোগ দেয়। সে সুযোগ আমরা কীভাবে কাজে লাগাব তা আমাদের উপর নির্ভর করে। তাই না?”
ইনারা হাতে জোহানের হাত নেয়। তার হাতের মুঠো খুলে কাঁচটি বের করে মেঝেতে ফেলে। সে একটু উঁচু হয়ে জোহানের মাথায় হাত রেখে বলে, “সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি চিন্তা করেন না।”
জোহান তাকিয়ে রইলো ইনারার দিকে। ঠিক সে মুহূর্তে হঠাৎ তার মনে হলো তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠেছে। হৃদয়ের স্পন্দন থেমে গেছে। ইনারাকে নিজ অজান্তেই খুব আপন মনে হয় তার। এই প্রথম তার মনে হলো তার পাশে বসা মেয়েটাকে সারাজীবন এভাবে দেখে গেলেও তার দৃষ্টি ক্লান্ত হবে না।

ইনারা জোহানকে সেদিন আর হাস্পাতালে নিয়ে যায় না। তার অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে ঔষধ দিয়ে ঘুম পারায়। সেদিন সে প্রথম জানতে পায় জোহানের অসুস্থতার কথা। ভাগ্যবশত সেদিন রাতেই সৌমিতা আন্টি সুস্থ হয়ে উঠে।
.
.
প্রায় দুইমাস পর বাংলাদেশে এসে পৌঁছায় সভ্য। তার আসার খবর এখনো ইনারা জানেনা। তাকে না জানানোর একটি বিশেষ কারণ আছে। সে যখন অস্ট্রেলিয়াতে ছিল তখন ইনারার জন্মদিন যায়। অথচ সে ইনারার সাথে জন্মদিন পালন করতে সাথে ছিলো না। তাদের দেখা হবার পর ইনারার প্রথম জন্মদিন ছিলো কিন্তু সে সাথে ছিলো না। ভাবতেই মনটা উদাসীন হয়ে যায় তার। তাই সে ভেবেছে ইনারাকে স্যারপ্রাইজ দিবে। এজন্য সে ইনারাকে তার আসার খবর দেয় নি। সামিকেও দিতে মানা করেছে। ইনারার তাকে বাদে কেবল সামির সাথেও যোগাযোগ হয়। আর জোহানের সাথেও আজকাল ইনারার ভালোই যোগাযোগ হয়। কতটুকু সে ধরতে পারে না। কিন্তু প্রায়ই ইনারাকে ফোন দিলে জোহান পাশে থাকে। সম্ভবত সৌমিতা আন্টির অসুস্থতা এর কারণ।

ইনারার সাথে আগের মতো কথা হয় নি তার। প্রথম ক’দিন ভালোই কথা হলেও পরে সৌমিতা আন্টি অসুস্থ হবার পর তাকে সময় দিতে হয়। যখন সে ব্যস্ত থাকে তখন ইনারা কল দেয়, আবার যখন তার সময় ফ্রী থাকে তখন ইনারা ব্যস্ত থাকে। এজন্য তাদের যোগাযোগে সমস্যা হয়ে যায়। কিন্তু এখন সব ঠিক হয়ে যাবে। সে যে এসে পড়েছে। ইনারাকে এক মুহূর্তের জন্যও একা ছাড়বে না। মেয়েটা তাকে হঠাৎ এখানে দেখে খুশিই হবে। তার মুখের উৎসুকভাব মনে করতেই কেমন খুশি লাগে তার।

কোম্পানিতে যেয়ে সকলের সাথে দেখা করেই সে সামিকে নিয়ে বাসায় আসে। আরামও করে না। এই ক্লান্ত শরীর নিয়ে লেগে পরে ইনারার বিশেষ দিন পালনের আয়োজনে। সে নিজের হাতে কেক বানানোর প্রস্তুতি নেয়। বেলুন দিয়ে ঘর সাজাতে সাহায্য করে সামি। তারপর ফুল আনতে যায়। এর মধ্যে সভ্য রাতের খাবারের প্রস্তুতি নেয়। ইনারার পছন্দের খাবার আজ নিজের হাতে রান্না করবে সে। এমন সময় কলিংবেল বাজে। সে ভাবে সামি এসেছে। যেয়ে দরজা খুলতে খুলতে বলে, “সামি তুই এত জলদি…”
চুপ হয়ে যায় সে। তার সামনে সামি না, জোহান দাঁড়ানো। তাকে দেখে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে।

জোহান হাসে, “সামি না জোহান। কোম্পানিতে না-কি সবার সাথে দেখা করে এলি। আমার সাথেই দেখা করিস নি। তাই আমি দেখা করতে চলে এলাম। এসেছি বলে নিরাশ হয়েছিস না-কি?”
সভ্য মাথা নাড়ায়, “নিরাশ না। অবাক হচ্ছি তোকে দেখে। তাও আমার ঘরে।”
“ভেতরে ডাকবি না?”
“আজও তোর আমার বাসায় আসতে পারমিশন লাগবে না।”
জোহান ভেতরে ঢুকে সোফায় বসে। সভ্য বসে তার সামনে। জিজ্ঞেস করে, “আন্টি কেমন আছে এখন?”
“ভালোই। আগের থেকে অনেক ভালো আছে। আর খুশিও। ঠিক বলেছিলি তুই, মা’কে আমি অনেক ভালোবাসি। নিজের বোকামিতে তাকে অবহেলা করে যে এত কষ্ট দিচ্ছি তা বুঝতে পেরেছি। আর তাকে হারানোর ভয়ও অনুভব করতে পেরেছি। তাকে হারানোটা সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
জোহানের এমন কথা শুনে সভ্যের ঠোঁটে হাসি এঁকে উঠে, “আমি অনেক খুশি হয়েছি তুই কথাটা বুঝতে পেরেছিস।”
“এই সেটআপ কি ইনারার জন্য?”
প্রশ্নটা অন্যকেউ করলে হয়তো সভ্যের উওর দিতে দ্বিধাবোধ হতো না। কিন্তু জোহান প্রশ্নটা করায় তার একটু অকপটে লাগলো। তবুও সে মাথায় নাড়িয়ে হ্যাঁ উওর দেয়, “ওর জন্মদিনে ছিলাম না। তাই ভাবলাম একটা স্যারপ্রাইজ দিব।”,

জোহান বলে, “সাজ অনেক সুন্দর হয়েছে। স্যারপ্রাইজ মন্দ হবে না। কিন্তু ওর জন্মদিন বাদে অন্যকিছুর জন্য স্যারপ্রাইজটা বেশি মানায়।”
সভ্য বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করে, “কী নিয়ে?”
“আর কি আমার এবং ইনারার বিয়ের জন্য স্যারপ্রাইজটা দিলে বেশি ভালো হয়।”
বিয়ের কথা শুনতেই সভ্য স্তব্ধ হয়ে যায়। তার ঠোঁটের হাসি মলিন হয়ে আসে। সে জোহানের কথার উওরে প্রশ্ন যে করবে তাও পারছে না। তার গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হচ্ছে না।

জোহান আবারও বলল, “এই মুহূর্তে মা, বাবা এবং ঐশি ইনারার বাসায় গেছে। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এবং তারা রাজিও হয়ে গেছে।”

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here