অনুভবে
পর্ব-৪৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
জোহান আবারও বলল, “এই মুহূর্তে মা, বাবা এবং ঐশি ইনারার বাসায় গেছে। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এবং তারা রাজিও হয়ে গেছে।”
বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠছে সভ্যের। মুহূর্ত যেন তার আশেপাশের সব শুণ্য হয়ে গেল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, “আমি মানতে রাজি না।”
ফোন বের করে জোহান। ঐশিকে কল দেয়। দুষ্টুমির সুরে বলে, “হ্যালো ভাই, তোর তর না হইলে নিজেই এসে পড়তে। এ নিয়ে কতবার কল দিলে বলতো।” বলে মিটিমিটি হাসে সে।
“আচ্ছা শুন ইনারার পরিবার রাজি তো বিয়ের জন্য?”
“একটু আগেও তো তোমাকে মেসেজ দিলাম। তারা এক কথায় রাজি। আর ভাই তোমার সাথে আমি রাগ। তোমরা সবাই জানতে ইনারা যে সাইয়ারা আন্টির মেয়ে। আমার বলো নি? আজ আসো। তোমার খবর আছে।”
“আচ্ছা তাহলে আপাতত রাখছি।”
কল কেটে জোহান আবার তাকালো সভ্যের দিকে। তার চোখে মুখে এখনো অবিশ্বাস্যতার ছাপ।
জোহান আবার বলল, ” আমার কথা বিশ্বাস হয় নি? তাহলে এবার ইনারার মুখ থেকে শুনে নিতে পারিস।”
সে ইনারাকে কল দেয়। ইনারার কল ধরতে একটু দেরি হয় বটে। সে কল ধরেই বলে, “জোহান জানেন আজ কি হয়েছে? আমি সুপার ডুপার এক্সাইটেড সবাইকে বলার জন্য। উপস আপনি তো জানবেনই। আপনিই তো সব ফিক্স করলেন।”
“তুমি খুশি তো?”
“এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়। অনেক খুশি আমি। কাল কোম্পানিতে আসবেন। সবাইকে একত্রে খুশির সংবাদটা দিব।”
“মানে বাবার প্রস্তাবে তো রাজি তুমি।”
“অবশ্যই। এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়?”
“আচ্ছা। তাহলে কাল দেখা হচ্ছে।”
জোহান আবারও কল কেটে দেয়। সভ্য বসে আছে। স্থির হয়ে। তার মুখে কোনো কথা নেই। তার দৃষ্টি শূন্য।
জোহান সভ্যকে জিজ্ঞেস করে, “এখন বিশ্বাস হয়েছে? দেখেছিস ও কতটা খুশি। তোকে বলেছিলাম না ও আমাকে ভালোবেসেছিল আর হাজারো অভিমান করুক না কেন ও আমার কাছে ফিরে আসবে।”
সভ্যের চোখে পানি এসে জমেছে। তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরেছে। তার নিশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। সে কাঁপা-কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “তোর কী?” সে চোখ তুলে তাকায় তার সামনে বসে থাকা জোহানের দিকে, “আজ ওকে পেয়ে তো তোর জেদ শেষ। দুইদিন পর ওর সৌন্দর্যের তৃপ্তি মিটে গেলে অন্য মেয়ের জন্য…”
“আমি ওকে ভালোবাসি…” জোর গলায় বলল জোহান, “আমি ওকে আসলেই অনেক ভালোবাসি। একারণেই বিয়ের কথা বলেছি, নাহয় আমি কাওকে অকারণে বিয়ের কথা বলবো না। ও এখন আর আমার জেদ না, ভালোবাসা। আর আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারব না। এটা সত্য যে প্রথমে আমি ওকে ওর সৌন্দর্যের জন্য পছন্দ করেছিলাম। কিন্তু বিগত মাসে এমন কিছু হয়েছে যা ওর প্রতি আমার হৃদয়ে অন্যরকম এক অনুভূতি জাগ্রত করেছে। যা আর কখনো হয় নি।”
কথাগুলো বলার সময় সভ্য এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। জোহানের চোখে সত্যতা দেখতে পেল সে। অথচ এই সত্যতা তার দম বন্ধ করে দিচ্ছে।
“গুড, তাহলে তুই ওকে ভালোবাসির। আর ও…তোকে। তাহলে আমার কাছে কী? আমাকে সংবাদ দিতে কেন এসেছিস?” ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করে সভ্য। সে উঠে যেয়ে পিঠ করে দাঁড়ায়। জোহানও উঠে তার পিছনে এসে দাঁড়ায়, “তোর মনে আছে তুই বলছিলি আমি একবার বললে তুই গান ছেড়ে দিবি।”
উওর দেয় না সভ্য। চুপ করে থাকে।” জোহান আবারও বলে, “আমি চাই তুই গান ছেড়ে দে। আমাদের সকলের জীবন থেকে বের হয়ে যা।”
“কেন?” পিছনে ফিরে তাকায় সভ্য। জিজ্ঞেস করে, “কেন যাব আমি? তোরা একে অপরকে ভালোবাসিস। তাহলে আমার যাবার কথা উঠছে কেন শুনি।”
“কারণ তুই ওকে আমার থেকে বেশি ভালোবাসিস। আর এটা আমার সহ্য হয় না। নিরাপত্তাহীনতায় নির্ঘুম রাত কাটে আমার। অশান্তি লাগে সারাক্ষণ। ইনারা আমার পাশে থাকলেও কেন যেন মনে হয় দূরে সরে আছে। তুই ওর দিকে তাকালে, ওর পাশে থাকলে, ওর সাথে থাকলেও আমার সহ্য হয় না।” গলার স্বর উঁচু হয়ে আসে তার। তারপর হঠাৎ করে নম্র হয়ে আসে, “তুই আমাকে বলেছিলি আমি বন্ধু হিসেবে একবার বললে তুই তোর গান ছেড়ে দিবি। আমি অনুরোধ করছি। প্লিজ চলে যা। আমি তোকে এখানে জোর করে এনেছিলাম আর এখন অনুরোধ করে যেতে বলছি। আমাদের বন্ধুত্বের খাতিরে।”
সভ্য ফিরে শক্ত করে জোহানের কলার চেপে ধরে। রাগে, না কষ্টে এই বুঝার সামর্থ্য এখন আর তার নেই। তার চোখে পানি জম আছে। বুকের ভেতর আটকে রয়েছে এক আকাশ যন্ত্রণা। হাত কাঁপছে তার। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল, “ইনারাকে একটা কষ্ট দিলেও তোর জীবন নিয়ে নিব আমি। মনে থাকে যেন। ওর চোখে এক ফোঁটা জলও যেন না আসে।”
“আসবে না। ওয়াদা দিলাম।”
সভ্য জোহানের কলার ছেড়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “নাউ গেট লস্ট।”
জোহান তবুও কিছু মুহূর্ত সেখানে দাঁড়ায়। তারপর চল যায়।
সভ্য সে একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মেঝের দিকে। কল আসে তার। সামির কল। সে যন্ত্রের মতো করে তার দিকে তাকায়। আর লাউড স্পিকারে দেয়। ওপাশ থেকে সামির কন্ঠ শোনা যায়, “দোস্ত ইনারার জন্য কোন ফুল আনব? লাল গোলাপ? তোর ভালোবাসার প্রতিক হিসেবে লাল গোলাপ দিবি? ” সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার পূর্বেই সভ্য ছুঁড়ে মারে তার হাতের ফোনটা। মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে যায় যন্ত্রটা।
সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে মেঝেতে। নিঃস্ব লাগছে তার নিজেকে। সে জীবনে কখনো কেঁদেছে বলে মনে নেই। কিন্তু আজ তার চোখের জল এমন অবাধ্য হলো কেন? কেন এই ভালোবাসা নামক যন্ত্রণা তার জীবনে এলো যখন তার ভাগ্যেই এই অনুভূতিটা ছিলো না? কেবল যন্ত্রণা দিতে? নিজের বুকের বা’পাশের দিকের শার্ট আঁকড়ে ধরে সভ্য। বুকের ভেতরটা বেশ ব্যাথা করছে।
.
.
ইনারা ভীষণ খুশি মনে ছিলো তাই সে আজ প্রিয় এবং সুরভির সাথে সময় কাটাতে যায় সুরভির বাসায়। আজ সেখানেই থাকবে সে। খুশির কারণ হলো আজ সে পরিচালক আলতাফের সাথে দেখা করতে গিয়েছে। ইউনিভার্সিটির থিয়েটারে তার অভিনয় দেখে তাকে নিজের সিনেমায় কাস্ট করতে চাইতেন তিনি। জোহানই তাদের মিটিং ফিক্স করিয়ে দিয়েছিলো। আর তাকে একটা মুভির অফার দিলো। যদিও প্রধান চরিত্রে না। অবশ্য অনেক বছর ইন্ডাস্ট্রিতে থাকলেও তার ছবিতে কাজ পাওয়া যায় না। সেখানে প্রধান চরিত্রের আশা করাটাও বোকামি। যতটুকু পেয়েছে এটাই তার জন্য ঢের। তার ইচ্ছা করছে সভ্যকে এখনই কল দিয়ে খুশির খবরটা জানিয়ে দিক। কিন্তু না। সে খবরটা এখন দিবে না। সভ্য আগে আসুক, তারপর তাকে স্যারপ্রাইজ দিবে।
পরেরদিন সকালেই ইনারা যায় কোম্পানিতে। সকলকে এই খুশির খবরটা দিতে চায় সে। এছাড়া জোহান বলেছে মিঃ হক তাকে তাদের কোম্পানির অংশ হবার অফার দিয়েছে। এ বিষয়েও কথা বলবে সে। কিন্তু সবাইকে খুশির খবরটা দেওয়ার পূর্বেই সে জানতে পারে গতকাল সভ্য এসেছিলো। সভ্য এসেছিলো? তবুও তার সাথে দেখা না করে চলে গেল? এটা কী করে সম্ভব? সে সভ্যকে কল দিয়ে না পেয়ে কল দেয় সামিকে, “হ্যালো পার্টনার ইনারা বলছি।”
“কী চাই?”
“তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? আচ্ছা এটা বাদ দেও তুমি আজ কোম্পানিতে আসো নি?”
“না।”
“সভ্যের সাথে তুমি? সভ্য না’কি দেশে ফিরেছে শুনলাম। আমার সাথে দেখা করে নি কেন?”
“কারণ তার ইচ্ছা হয় নি। তোমার সাথে ও কেন দেখা করবে শুনি?”
ইনারার খুব আজব লাগে সামির ব্যবহার, “তুমি এভাবে কথা বলছ কেন?”
“এতকিছু বলতে পারব না। কেবল এতটুকু বুঝে নেও যে আর সভ্যের সাথে যোগাযোগ করার কোনো প্রয়োজন নেই। ”
“প্রয়োজন নেই মানে? কী হয়েছে সভ্যের?”
“সব ছেড়ে চলে গেছে ও। ওর স্বপ্ন, ওর ক্যারিয়ার, সব।”
“কী বলছ তুমি এসব? তোমার কাছে ওর নতুন কোনো নাম্বার আছে? দেও তো। আমি উনার সাথে কথা…”
“কোনো প্রয়োজন নেই।” ধমকে উঠে সামি, “সভ্য তোমার মতো মেয়ের চেহেরাও আর দেখতে চায় না। কথা বলা তো দূরের কথা। আমার সাথেও আর যোগাযোগ করার প্রয়োজন নেই।”
বলেই সে কল কেটে দিলো। ইনারা হতভম্ব। কি হলো সে কিছুই বুঝতে পারলো না। সে আবার কল দিতেই দেখে সামি তাকে ব্লক করেছে।
সে কিছুই বুঝতে পারছে না। কি করেছে সে? সামি তার সাথে এমন ব্যবহার করল কেন? আর সভ্যই বা তার সাথে কথা বলতে চাইবে না কেন? কি করেছে সে? হঠাৎ তাকে অশান্তি ঘিরে ধরে। সে কি করবে বুঝতে পারে না। তবুও সে নিজেকে সংযত রাখে মিঃ হকের সাথে কথা বলতে যায়। সেখানে জোহানও ছিলো। কন্টাক্ট নিয়ে কথা বলা শেষে জোহানের সাথে বাহিরে আসে সে। তখন জোহান তাকে জিজ্ঞেস করে, “কী ব্যাপার? তোমার মুখ এমন মলিন লাগছে কেন?”
ইনারা মাথা নাড়ায়, “কিছু না।”
“কিছু তো হয়েছে।”
“সভ্যকে নিয়ে চিন্তা করছিলাম।”
সভ্যের কথা শুনতেই রাগে জোহান হাত মুঠোবদ্ধ করে নিলো।
ইনার মুখ থেকে সভ্যের নাম শুনলেই কেন যেন তার গা জ্বলে ওঠে। কিন্তু তা ইনারার সামনে প্রকাশ করল সে, “সভ্য আমাদের কন্টাক্ট রিনিউ করতে চায় না। ও বিদেশে শিফট হচ্ছে। ও সেখান থেকে পেপার ওয়ার্ক করে আমাদের জানাবে।”
চমকে উঠে ইনারা, “সভ্যের সাথে তো আমার দুইদিন আগেও কথা হয়েছে। সে আমাকে কিছু বলেনি তো।”
“জানি না হঠাৎ কি হয়েছে। ওরে সিদ্ধান্তে যতটা আমাদের গ্রুপের ক্ষতি হয়েছে ততটাই ক্ষতি হয়েছে কোম্পানির। সব ইনভেস্টর বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এখানে বাবাকে কি করবে বলো। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে।”
“না, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে সভ্যের এসব করার পিছনে। আমি… আমি যে করেই হোক খোঁজ নিচ্ছি।”
ইনারা সামনে এগিয়ে যেতে নিলেই জোহান তার হাত ধরে নেয়, “তোমার ওর খোঁজ না করাটা সবচেয়ে বেশি ভালো হয়।”
“মানে কী? উনি হঠাৎ করে চলে গেছে আর আমি তার খোঁজ করব না?” রাগান্বিত সুরে বলে ইনারা।
জোহান বুঝতে পারে ইনারার সাথে এভাবে কথা বললে হবে না। তার ব্রেনের সাথে খেলতে হবে। ইনারার আত্মসম্মান তার সবচেয়ে বেশি প্রিয়। তার আত্মসম্মানে আঘাত করতে হবে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমার কারণে বলছিলাম। ও তোমার নামে যা বলল এরপর… থাক, বাদ দেও। তুমি তাকে খুঁজতে চাইলে খুঁজতে পারো।”
“আপনি কি বলতে যেয়ে থেমে গেলেন?”
“কিছু না। আসো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেই।”
“টপিক পাল্টাবেন না। বলুন সভ্য কী বলেছে?”
“আহা বললাম তো কিছু না।”
“আপনি বলবেন কি-না?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জোহান। উদাসীন হবার নাটক করে বলে, “আমি জানি তুমি কষ্ট পাবে তাই বলতে চাইছিলাম না। আমি গতরাতে সভ্যকে কিছু কথা বলতে শুনেছিলাম তোমার নামে।”
“কী কথা?”
“যে… যে তোমার মধ্যে সমস্যা আছে। যে কারও সামান্য এফোর্টেই গলে যাও। ও কিছু রোমেন্টিক কথা বলেছে আর তুমি লজ্জা পেয়ে গেছ। তার প্রেমে পড়ে গেছ। যে কেউ চাইলেই তোমাকে প্রেমে ফালাতে পারে। তুমি একবার আমার প্রেমে পড়েছিলে তো ক’দিন পর ওর প্রেমে পড়ে গেছ। ও কেবল মজা নিচ্ছিল তোমার।”
“আপনি মিথ্যা বলছেন। সভ্য আমাকে এসব বলতে পারে না।”
“আর আমি তোমার সাথে মিথ্যে বলব কেন? ”
“তা আমি জানিনা। কিন্তু আমার সভ্যের উপর বিশ্বাস আছে। ”
“আমি তো তোমাকে কথাগুলো বলতে চাইনি। তুমিই জোর করলে। এছাড়া আমি তোমাকে সহজ ভাষায় বলেছি। তোমার চরিত্র নিয়ে আরও বাজে কথা শুনেছি। কিন্তু তা মুখে আনার মতো ক্ষমতা আমার নেই। এই নিয়ে গতকাল ঝগড়াও লেগেছিল আমাদের। দেখ ইনারা তুমি কথাগুলো বিশ্বাস করো বা না করো আই ডোন্ট কেয়ার। আমরা ক’দিন আগে ফ্রেন্ডশিপ করেছি। আমি চাই না এ বিষয় নিয়ে আমাদের বন্ধুত্বে কোনো ফাঁটল আসুক। আমি তোমার সাথে সভ্যকে নিয়ে আর কোন কথা বলবো না। আর আমি এটাও চাই না যে তুমি আমার সাথে ওকে নিয়ে কোনো কথা বলো। কারণ আমি নিজের কানে ওর বলা কথা শুনেছি। আসো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।”
ইনারাকে অস্থির দেখা গেল। সে বলে, “ড্রাইভার আছে। আমি যদি তে পারব।”
বলে সে চলে গেল।
জোহান সেখানে দাঁড়িয়েই উনার যাওয়ার পথ দেখছিল। সে বাঁকা হেসে তার হাত পকেটে ভরে বলে, “সরি সুইটহার্ট তোমাকে পাওয়ার জন্য একটু কষ্ট দিতে হচ্ছে তোমাকে। মিথ্যা বলতে হচ্ছে। বাট আই প্রমিজ এরপর তোমার জীবন সুখে ভরিয়ে দিব। এখন হয়তো তুমি আমার কথা বিশ্বাস করতে চাইছো না। কিন্তু আমি জানি যখন তুমি আর সভ্যের খুঁজে পাবে না তখন আমার কথা মানতে বাধ্য হবে।”
ইনারা গাড়িতে উঠে বারবার কল করতে থাকে সভ্যকে। কল ধরে না কেউ। অস্ট্রেলিয়ার নাম্বারেও কল করে পায় না। আগামী কয়েকদিনে সে সভ্যের বাসায় যায়, কোম্পানিতে খোঁজ নেয়, তার অস্ট্রেলিয়ার ভার্সিটির নাম্বার জোগাড় করে সেখানেও কল দেয় কোথাও পায় না। এমনকি কোম্পানি থেকে তার তথ্য চায় কিন্তু বিশেষ কিছু পায় না সে।
.
.
দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে যায়। ইনারা প্রথম চার মাস খোঁজ করার পর ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। পঞ্চসুরও ভেঙে যায়। এখন যে যার পথ বেছে নিয়েছে। এই ছয় মাসের মধ্যে প্রতিটা মুহূর্তে তার সভ্যের প্রতি রাগ এবং ঘৃণা বাড়তে থাকে। একটা মানুষ কি এভাবে হারিয়ে যেতে পারে? তার কি একটিবারও মনে পড়ে না তার কথা? তার সাথে কাটানো সকল মুহূর্তই কি এতটা তুচ্ছ ছিলো সভ্যের জন্য? এই এক কথা ভেবে কতরাত যে নির্ঘুম কাটে তার।
কেউ একজন ঠিকই বলেছ, একটি মানুষের জন্য জীবন শূন্য হয়ে যেতে পারে কিন্তু কারও জন্যই জীবন থেমে থাকে না। ইনারা পড়ালেখার পাশাপাশি নতুন সিনেমায় কাজ করা শুরু করবে। তবুও আজ পর্যন্ত কেউ তার আসল পরিচয় জানে না। তাকে নিউ ফেস হিসেবে পোস্টার প্রকাশ করা হয়েছে। সকলের কাছ থেকে অনেক প্রশংসাও পেয়েছে সে। তার সৌন্দর্যের জন্য। আগামী মাস থেকে শুটিং শুরু হবার কথা। ক’দিনের মাঝেই খুব ব্যস্ত হয়ে পড়বে সে তাই আজ সুরভীকে নিজের বাসায় নিয়ে এসেছে গল্প করার জন্য। দরজা দিয়ে ঢুকতেই তার ডাক পড়লো। মুশতাক সাহেব ডাকছেন।
“আব্বু ডেকেছ?”
মুশতাক সাহেব পায়ের উপর পা তুলে চা’য়ে চুমুক দিচ্ছিলেন। ইনারার দিকে তাকালেন তিনি। সাথে তার পেছনে থাকা সুরভীর দিকেও তাকালেন। সুরভি সালাম দেওয়ায় উওরও দেয়।
আজকাল মুশতাক সাহেব আর খারাপ ব্যবহার করে না ইনারার সাথে। বিশেষ করে অভিনয়ের কথা বলার সময় ইনু ভেবেছিল অনেক বড় একটা তামাশা করবেন সে। অথচ সে কিছুই বললেন না। হয়তো জোহানের ঘর থেকে তার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে একারণেই। তার সাথে বিয়ে হলে মুশতাক সাহেবের সব দিক থেকে লাভ হবে না?
মুশতাক সাহেব বললেন, “তাহলে কি ভাবলে তুমি যখন জোহানকে নিয়ে।”
“আমি আগেও বলেছি আমি আগে আমার ক্যারিয়ার করতে চাই তারপর বিয়ে। অন্তত পক্ষে পাঁচ বছর পর।”
“দেখ ইনারা, তোমার মা চাইত তুমি জোহানের সাথে বিয়ে করো। এটা তার শেষ ইচ্ছা ছিল। আমি কেবল তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে চাই। এছাড়া তুমি জানো এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কত খারাপ! আমি চাইনা তুমি কোন ধরণের সমস্যায় জড়িত হও। জোহন তোমার ভালো খেয়াল রাখতে পারবে।”
“খেয়াল রাখার সাথে বিয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।”
“কিন্তু আমি তোমাকে ওর হাতে তুলে দিয়ে চিন্তা মুক্ত হতে চাই।”
ইনারা এবার বিরক্তির স্বরে বলে, “আমি এখন বিয়ে করতে তৈরী না। সে এখন বলছে আমাকে সাপোর্ট করবে। ভবিষ্যতে কি?”
“আচ্ছা, ঠিক আছে তোমার বিয়ে করা লাগবে না।” অনেকটা রাগ রাগ ভাব নিয়ে বললেন মুশতাক সাহেব, “তোমার মা’য়ের কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে। আর না তার ইচ্ছার মূল্য আছে।”
“আপনি জানেন আমার মা’কে আমি কতটা ভালোবাসি। সে তো এটাও চাইতো আমি জীবনে সফলতা অর্জন করি। তার এ ইচ্ছা অপূর্ণ রাখি কীভাবে?”
“আচ্ছা ঠিকাছে বিয়ে নাহয় পরে করলে বাগদান করতে তো মতো সমস্যা নেই। তাই না?”
“না।” স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলো ইনারা, “কোনো সমস্যা নেই।”
সুরভি চমকে উঠে তার উওর শুনে। এরপূর্বে ইনুর বলা কোন কথাই তাকে বিস্ময়ে ফেলতে পারে না। অথচ এ কথা শুনে সে যেন আকাশ থেকে পড়লো।
ইনারা জিজ্ঞেস করে, “আমি কি এখন আমার বান্ধবীকে নিয়ে রুমে যেতে পারি?”
মুশতাক সাহেব অনুমতি দেয়।
ইনারা সুরভির হাত ধরে বলে, “আয়।”
রুমে ঢুকতেই সুরভির প্রশ্নের বর্ষণ শুরু হয়, “এটা কি হলো ইনু? কি বাগদানের জন্য এভাবে হ্যাঁ কি করে বলতে পারিস? তুই সভ্যকে ভালোবাসিস।”
সভ্যের নাম শুনলেই মাথায় রক্ত উঠে যায় তার। সে বিছানায় ব্যাগ রেগে সুরভির দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে, “আর কই সে সভ্য? কোথায়? আমি তো তাকে দেখছি না। ইনফ্যাক্ট ছয়মাস ধরে তাকে দেখতে পারছি না আমি।”
“তাই বলে এভাবে যে কারো সাথে বিয়ের জন্য হ্যাঁ করতে পারিস না। জোহানকে তিনি যে অন্য মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছিস। তুই কি করে ওর সাথে থাকতে পারবি?”
“এছাড়া দীপার সাথে তখন ওর সম্পর্ক ছিলো। এটা ওর পাস্ট ছিলো। সবার পাস্ট থাকে।”
আই ডোন্ট ইভেন কেয়ার ও কার সাথে ছিলো। আমার এখন আর কিছু আসে যায় না। যার প্রতি আমার ফিলিংস নেই সে যাই করুক না কেন আমার কষ্ট লাগবে না। এই প্রেম-ভালোবাসা-বিয়ে এসব ফালতু কথা।”
“তুই এটা সভ্যের উপর রাগ করে করছিস। তুই নিজে বলেছিস তোর তার কথায় বিশ্বাস নেই তাহলে কেন?”
“কারণ সে লোকটা আমাকে ভালোবাসার অনুভূতি দিয়ে হারিয়ে গেছে।” তার গলার স্বর হঠাৎ করে মৃদু হয়ে আসে, “একবারও আমার খোঁজ নেয় নি। আমি আজ পর্যন্ত প্রতিরাতে তাকে কল দেই। এই আশায় যে সে কলটা ধরবে। কিন্তু সে ধরেনা। পৃথিবীর অন্য কোণে সে ঠিকই সুখে আছে। আর এদিকে আমি অচেনা এক অপেক্ষায় ভুগছি। এখনও বেনামি সম্পর্কে বেঁধে আছি আমি। যে সম্পর্কের স্বীকারোক্তি অন্যপাশ থেকেই আসে নি। এই সম্পর্কটা আমার কাছে এখন খাঁচার মতো লাগে। মনে হয় আমি এই খাঁচায় বন্দী। দম আটকে আসে আমার। অন্যকারো দাঁড়াই হোক না কেন আমি এই খাঁচা থেকে মুক্তি পেতে চাই। হোক তা জোহান। তার সাথে এখন অনেক ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। এই বন্ধুত্ব দিয়েই জীবন কেটে যাবে। সাথে আমার মা’য়ের ইচ্ছাও সম্পূর্ণ হবে। আর আমি জানি জোহান ওদিন বাড়িয়ে বলেছে। আমাকে পাওয়ার জন্যই বলেছে। সভ্য আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলতেই পারে না। কিন্তু একটা কথা ঠিক বলেছে। আমার ভালোবাসার মজা বানিয়ে হারিয়ে গেছে ও। এর জন্য আমি তাকে কখনোই ক্ষমা করব না। কখনো না।”
“ইনু হতে পারে সে কোনো কারণে গেছে।”
“তাই বলে সকলের সাথে দেখা করল অথচ কেবল আমার সাথে দেখা না করে যাবে? তার মনে আমাকে নিয়ে কোন অনুভূতি না থাকলে কেনো কাছে আসতো আমার? কেন এমন কথা বলতো যেন মনে হতো সে ভালোবাসতো আমায়? আমার চোখের মতো সুন্দর চোখ না-কি সে কখনো দেখে নি। প্রতিরাতে সে চোখ ভিজে তার কারণে। এ জলের মূল্য সে দিতে পারবে। আমার মাঝেমধ্যে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার লেখা সে অর্ধ গানটি পড়লে। বুকে ব্যাথা করে তার স্মৃতি মনে পড়লে।” গলা কেঁপে উঠে ইনারার। সে আবার বলে, ” এভাবে ছেড়ে যেতেই হলে কেন অনুভব করাল আমি তার জন্য বিশেষ। এটা কি ধোঁকা দেওয়া না? আমার ভালোবাসার অপমান না? চোখে চোখে হাজারো আশা দিয়ে আমাকে নিঃস্ব করে চলে গেছে সে। সে মানুষটাকে আমি ক্ষমা করব? অসম্ভব!”
“ইনু আমার কথা শুন।”
“সুরভি আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না। জোহানের সাথে আমি বিয়ে করবো। নিজের ভালোবাসাকে সুযোগ দিয়ে দেখে নিয়েছি। সে ভালবাসা অসমাপ্ত থেকে গেছে। এখন না হয় আমার মায়ের শেষ ইচ্ছাটাই পূরণ করি।”
সুরভী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে জানে ইনারাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। সে একবার জেদ ধরলে তার সিদ্ধান্ত পাল্টানো যাবে না। আর কি বলে সে আশ্বাস দিবে? অপেক্ষা করতে বলবে? পাগলের মতো সভ্যের খোঁজ করল ইনু। কিন্তু ফলাফল শূন্য।
সে রাতে সুরভি ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম নেই ইনারার চোখে। আজকাল রাতে তার ঘুম আসে না। নির্ঘুম কাটে সারারাত। রাতের নিরবতা ভয়ঙ্কর লাগে তার কাছে। সভ্যের সাথে তার স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভাসতে থাকে। আচ্ছা, রাত এত ভয়ঙ্কর হয় কেন? মানুষ দিনে তার সকল অনুভূতি যে সিন্দুকে আটকে রাখে, রাতে সে বিনা অনুমতিতে সে অনুভূতি সিন্দুক থেকেই বেরিয়ে এসে তাকে গভীরভাবে বশ করে নেয়। হাজার চেয়েও সে অনুভূতি সিন্দুকে ভরে রাখতে পারে না মানুষ। একাকিত্বতায় যেন আবেগ নামক ভয়ঙ্কর জিনিস আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।
সুরভির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনারা। তারপর ফোন হাতে নিয়ে কল দেয় সভ্যকে। ফোন অফফ। প্রতিদিনের মতো। সে উঠে যায় বারান্দায়। তার হাতের মুঠোয় সভ্যের লেখা গানটা। সে কাগজে এক বিন্দু অশ্রুজল পরে। ভেজা অংশটার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইনারা। তার বুক চিরে বেরিয়ে এলো দুঃখ-নিঃশ্বাস। সে আকাশের দিকে তাকালো। বলল, “আহা প্রণয়ী!”
.
.
আরও দুইমাস কেটে যায়। ইনারার শুটিং শুরু হয়েছে। সে একটা এডও করেছে। প্রতিদিনই তার কাজ থাকে। তাই সকাল সকাল বের হতে হয়। রাতেও ঘুম হয় না তার। কিন্তু আজ তার ছুটি। তাই একটু ঘুমাচ্ছে সে। কিন্তু এ ঘুমও কপালে জুটে না তার। ফোনের রিং বেজে উঠে। সে ঘুমঘুম চোখে কল রিসিভ করে কানের কাছে নিয়ে বলে, “হ্যালো।”
“ইনু…তুই ঘুমাচ্ছিস?”
“হুঁ আজ শুটিং নেই। তোর সকাল সকাল কী হলো? কল দিচ্ছিস কেন?”
“তুই খবর শুনিস নি? নিউজ চ্যানেল যেয়ে দেখ জলদি।”
“ধ্যুর ঘুমাতে দে তো। এভাবে বলছিস যেন আকাশ ভেঙে পরছে।”
সুরভী চিন্তিত কন্ঠে বলল, “তাই ভেবে নে। সর্বনাশ হয়ে গেছে ইনু।”
*গল্পটা খুব দ্রুত এগোচ্ছি আমি জানি। কিন্তু এখানে আস্তে-ধীরে নিলে আপনাদের মজা লাগবে না। তাই এত দ্রুত এগিয়ে নেওয়া। এছাড়া আগামী দুইদিনও ঈদ উপলক্ষে গল্প দেবার চেষ্টা করব। ইনশাআল্লাহ।”
চলবে…..