অনুভবে
পর্ব-৪৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। ভালোবেসেছিলাম। আর তুমি এই মূল্য দিলে আমার ভালোবাসার? আমার তোমার উপর ঘৃণা করা উচিত। কিন্তু তোমায় এত ভালোবাসি যে ঘৃণাও করতে পারছি না। তোমায় ভালোবাসাটা কী আমার অপরাধ ছিলো?” ইনারা মেঝেতে বসা। তার চোখে অশ্রুজল। সে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার সামনের পুরুষটির দিকে। সে পুরুষটি বিরক্তির সুরে বলল, “দেখো, আমাদের সম্পর্কের চারবছর কেটে গেছে। আমি আগের মতো আর তোমাকে ভালোবাসতে পারি না। আমি এখন লিন্ডাকে ভালোবাসি। আর ওর সাথেই জীবন কাটাতে চাই।”
“তাহলে আমার কী হবে? আমি মরে যাব তোমাকে ছাড়া।”
লোকটার চোখেমুখে বিরক্তি বাড়ে। সে তার স্যুটকেস নিয়ে যেতে নিলেই ইনারা এসে তার হাত ধরে নেই। কাঁদতে কাঁদতে বলে, “ছেড়ে যেও না আমায়। যেও না। আমি মরে যাব তোমাকে ছাড়া।”
কিন্তু লোকটা কথা শুনে না। এক ঝটকায় ইনারার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, “যা ইচ্ছা করো।”
বলে সে চলে যায়। ইনারা বসে থাকে মেঝেতেই। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লোকটার যাওয়ার দিকে। আর তার চোখের জল অবাধ্য হয়ে ঝরতে থাকে।
আশেপাশের বাতি জ্বলে উঠে। তালির বর্ষণ শুনা যায়। থিয়েটারে কেবল কয়েকটা লোক। কেবল স্টাফরা। এতক্ষণ এক নাটকের রিহার্সাল চলছিলো। যেখানে ইনারা প্রধান চরিত্রে ছিলো। নাটকটি সম্পূর্ণ ইংরেজিতে। তার সংলাপও। দৃশ্যটি শেষ হবার সাথে সাথে ডিরেক্টর ইংরেজিতে বলে উঠে, “বাহ ইনারা, অসম্ভব সুন্দর কাজ করলে তুমি। আমি নিজে এই কাহিনীটা লিখিছি তবুও আমার কান্না এসে পড়ছিলো। তুমি যদি আসলেই এই নাটকটায় কাজ করতে।”
ইনারা মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ায়। নিজের চুল ঠিক করে বলে, “একটি পুরুষ তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে চারবছর থাকার পর বিয়ের আগে বলে সে অন্যকাওকে ভালোবাসে এবং মেয়েটা তার কাছে ভিক্ষা চায় থাকার জন্য। আর অবশেষে ওই পুরুষের সাথেই তার বিয়ে হয়ে হ্যাপি এন্ডিং হয়। নো, এমন সেন্সলেস ড্রামায় আমি কাজ করি না। ব্রিয়ানা ম্যাম বলেছিলো বলে এখানে এলাম দেখাতে কীভাবে এক্টিং করতে হয়।”
“কাম অন ইনারা, এতটা রুক্ষ না হলেও পারো।”
ইনারা তার ব্যাগ নিয়ে স্টেজ থেকে নিচে নামতে নামতে বলল, “যা সত্যি তাই বললাম। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি গেলাম।”
ইনারা তার পাশ কাটিয়ে বাহিরের দিকে এগোয়। ডিরেক্টর এর নাম টম। সে এবং ইনারা একসাথেই এই ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়েছি। পার্থক্য হলো ইনারা এক্টিং এর জন্য ভর্তি হয়েছিলো এবং সে ডিরেক্টর হবার জন্য। প্রথম দেখা থেকেই সে ইনারাকে পছন্দ করে। অনেকবার ইনারাকে বলেছেও কিন্তু বারবার রিজেক্ট হয়েছে। কিন্তু আজ সে আবার চেষ্টা করবে। কেননা ইনারা আগামীকালই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আর শেষ চেষ্টা না করে সে ছাড়বে না। সে ইনারার হাত ধরে নেয়, “ইনারা তুমি জানো আমি তোমাকে পছন্দ করি। তাহলে এত ইগনোর করছ কেন? আমি কি দেখতে শুনতে খারাপ? কত মেয়েরা আমার জন্য পাগল। আরেকবার ভেবে দেখো, তোমাকে আমাকে একসাথে কত ভাল্লাগবে।”
“ঠিকাছে ভাবছি।” এক মুহূর্ত না কাটতেই ইনারা উওর দেয়, “না। এখন আমার হাত ছাড়।”
“ছাড়বো না। তোমার আমাকে বলতেই হবে আমার সাথে রিলেশন এ যেতে তোমার সমস্যা কোথায়?”
“আমি কোনো সম্পর্কে যাব না। এটাই সমস্যা। এখন তুমি আমার হাত ছাড়ো, আমি ব্যাথা পাচ্ছি।”
“আমার কিছু আসে যায় না। তুমি আমাকে বলো আমার সাথে রিলেশনে যাবে কি-না।”
ইনারা বিরক্ত হয়ে টমের হাত ধরে উল্টো তার হাত মুড়িয়ে ধরে। ব্যাথায় চেঁচিয়ে উঠে টম। ইনারা বলে, “তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। দুই বছর আগে আমি ক্যারাটে ক্লাস করতাম। তোমার শব্দ শুনে মনে হচ্ছে ভালোই শিখেছি। থ্যাংকস বাডি।”
বলেই তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। কাঁধে তার ব্যাকপ্যাক নিয়ে চলে যায় সেখানে থেকে।
ইনারা একটি উবার ডেকে বাসার জন্য রওনা দেয়। ইন্সটিটিউটটির দিকে তাকায়। তিন বছর আগে সে এসেছিলো আমেরিকায়। এসেই এই ইন্সটিটিউট এ ভর্তি হয়। আর আজ এখানে তার শেষ দিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনারা। চোখ বন্ধ করে হেলান দেয় সিটে। মনে পড়ে যায় তিন বছর আগের ঘটনা। সে রাতে অজ্ঞান হবার পর চোখ খুলেছিলো হাস্পাতালে। প্রায় একদিন অজ্ঞান থাকে সে। চোখ খোলার পর সে দেখতে পায় কতগুলো লোক দাঁড়িয়ে আছে তার রুমে। সব মুখ অচেনা। সকলে সাদা শার্টের উপর কালো কোর্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে সিরিয়াল ধরে। তার হাতে স্যালাইন দেওয়া। তাকে দেখে একজন পুরুষ এগিয়ে আসে, “ম্যাম কেমন অনুভব করছেন আপনি?”
ইনারা চিনে না তাকে। সে চোখ দুটো সরু করে জিজ্ঞেস করে, “আপনারা কে? এবং আমি এখানে কি করছি?”
“আমার নাম রহমান। আপনি আমাদের স্যারের গাড়ির সামনে এসে পড়েছিলেন। আপনার অবস্থা করুণ ছিলো। তাই হাস্পাতালে আনা হয়েছে।”
ইনারা ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছিলো না। তবুও সে কষ্ট করে উঠে বসতে নিলে লোকটা আবার বলে, “ম্যাম আপনি শুয়ে থাকুন। আপনার রেস্ট দরকার।”
“আপনাদের ধন্যবাদ। কিন্তু আমার এত সামর্থ্য নেই যে আমি এই হাস্পাতালের বিল দিতে পারব।”
“আপনাকে কিছু দিতে হবে না ম্যাডাম। উল্টো আপনার সব ভরণপোষণের দায়িত্ব আমাদের স্যার নিবে। আপনার পড়াশোনা, থাকা, আর আপনার যা চাই। সব করতে পারবেন।”
কপাল কুঁচকে নেয় ইনারা, “আমার দায়িত্ব আপনার স্যার নিবেন কেন?”
“পরিবর্তে তার একটা শর্ত আপনার মানতে হবে।”
“কী শর্ত?”
“তা এখন আমি বলতে পারবো না। আমি নিজেও জানি না। স্যার অফার দিয়েছেন যে আপনি কিছু বছর বাহিরের দেশে যেয়ে পড়াশোনা কন্টিনিউ করবেন। আপনাকে সেখানের সবচেয়ে বড় এক্টিং ইন্সটিটিউটে পড়তে পারবেন। আপনার থাকা, খাওয়া, যাবতীয় সকল খরচ স্যার দিবেন। পরিবর্তে সময় হলে আপনাকে যা বলা হবে আপনি তা করবেন।”
“আপনার স্যার কোথায়? ”
“তা আপনার জানার প্রয়োজন নেই। সময় হলে সে নিজেই আপনাকে দেখা দিবে।”
“ফাজলামো চলছে? চিনি না, জানি না আমি যে কারও কথায় বিদেশে চলে যাব? আমার সাথে কি করা হবে কে জানে?” ইনারা রাগে একটানে তার হাতের ক্যানোলা খুলে উঠে দাঁড়াতে নিলেই তার মাথা ঘুরান দিয়ে উঠে।
রহমান আতঙ্কিত সুরে বলে উঠে, “ম্যাম এখনো আপনার শরীর দুর্বল। উঠবেন না।”
ইনারা তবুও উঠে। সে উঠে দরজার সামনে যেতেই কয়েকজন লোক তার রাস্তা আটকায়।
রহমান দ্রুত কাওকে কল করল। ব্যাপারটা জানাল। এরপর সে লোকগুলোকে বলল, “ম্যামকে যেতে দেও। স্যার আদেশ দিয়েছে।”
ইনারার রাস্তা ছাড়া হয়। সে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। হাস্পাতাল থেকে বের হবার সময়ও সে খেয়াল করল লোকজন তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাস্তায়ও এ জিনিসটা চোখ এড়ায় না তার। সে একটি মহিলাকে কথা বলতে শুনলো, “এটা সে মেয়ে না যার ভিডিও ভাইরাল হইছিলো? ছিঃছিঃ একটু স্বার্থের জন্য চরিত্র শরীর বিক্রি করে দিলো। কোন দুনিয়ায় এসে পড়ছি। এর উপর এমন বেহায়ার মতো ঘুরছে। লজ্জাও লাগে না।”
তার পাশের মহিলাটা বলল, “আরে আপা দেখেন শরীরে কত দাগ! মনে হয় কেউ বাজেভাবে মেরেছে।”
“রাখেন তো। এসব মেয়ে মরলে সমাজ একটু পরিষ্কার হবে। মনে হয় কীর্তি সবার সামনে আসার পর মা বাপে মারছে। এমন মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। আমার মেয়ে হইলে তো জিন্দা পুড়ায় দিতাম।”
“তা যা বলেছেন। আজকালকার মেয়েদের লাজ শরম বলতে কিছু নাই।”
ইনারা আর শুনতে পারে না। তার কোনো ভুল নেই। তবুও এমন কটু কথা শুনতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু মুখে উওর দেবার শক্তিটুকুও তার নেই। আর বললেও এমন না যে তারা বিশ্বাস করবে ইনারার কথা। তাই সে রিক্সাতে উঠে রওনা দেয় সুরভির বাসার উদ্দেশ্যে। তার আর কোথাও যে যাবার জায়গা নেই।
কলিংবেল বাজায় ইনারা। সুরভি এসে দরজা খুলে ইনারাকে দেখতেই তার চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। সে ইনারার হাত ধরে কাঁপা-কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “এ’কি অবস্থা তোর? কি হয়েছে তোর? কোথায় ছিলি তুই? কত কল দিলাম, তোর বাসায় গেলাম কোথাও খোঁজ নেই তোর।” সুরভি জড়িয়ে ধরে ইনারাকে, “আমার জান আটকে আসছিলো। প্রিয়কে হারানোর পর আর তোকে হারানোর সাহস আমার নেই।”
“কে এলো রে?” সুরভীর মা রান্না ঘর থেকে বের হতে হতে জিজ্ঞেস করলেন। ইনারাকে দেখে ছুটে এলেন সে। তার মেয়েকে দূরে সরিয়ে বলল, “তুই ওর কাছে যাবি না। দূরে যা। সর।”
ইনারা হতভম্ব। দশেক বছরের মতো হবে সে সুরভির বাসায় আসে। সুরভির মা অনেক আদর যত্ন করে তাকে। আর আজ হঠাৎ এমন কথা বলছেন তিনি!
সুরভি বিস্মিত গলায় বলল, “মা একি বলছো তুমি?”
“ঠিক বলছি…একদম ঠিক বলছি। ওর জন্য আজ প্রিয় আমাদের মাঝে নেই। আর তুই ওর সাথে যদি তোরও কিছু… না না। তুই ওর কাছে থাকবি না। ইনারা তুমি বের হও। যাও এখান থেকে।”
“মা তুমি ওর অবস্থা দেখছ? ওর হাত, পা, মুখ সব জায়গায় আঘাত।”
“তুই চুপ কর।” সুরভির মা তার হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে দরজা আটকে দিলেন। সুরভি বারবার দরজা ধাক্কা দিতে থাকে। অনুরোধ করে ইনারাকে বের না করার জন্য। কিন্তু সুরভির মা মানে না। সে ইনারার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, “দেখ ইনারা তোমাকে আমি অনেক আদর করি। কিন্তু আমার পোলাপান থেকে বেশি না। তুমি ওদের আশেপাশে থাকলে কখন না ওদেরও জীবন নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া তোমার চরিত্র নিয়ে সকলে কত কথা বলছে। আমি জানি তুমি এমন কিছু করতে পারো না। কিন্তু লোকে মানবে কীভাবে? তুমি আমার মেয়ের সাথে থাকলে ওর ভবিষ্যত শেষ হয়ে যাবে। ওকে কে বিয়ে করতে রাজি হবে বলো। প্লিজ তুমি চলে যাও। এক মা অনুরোধ করছে। প্রয়োজনে মাই তোমার পা’য়ে পড়ছি।”
সুরভির মা আসলেই ঝুঁকে তার পা ধরতে নেই। সাথে সাথে ইনারা তার হাত ধরে নেয়, “আন্টি আমাকে পাপের ভাগিদার করবেন না। আপনি আমার মা’য়ের মতো। আপনাকে দোষারোপ করছি না আমি। আপনি ভুল বলেন নি। আমার সাথে থাকলে প্রিয়র মতো যদি সুরভির সাথেও…না। আমি চাই না ওর কিছু হোক। আমি আসি আন্টি। ওর খেয়াল রেখেন।” শান্ত গলায় বলে ইনারা। ফিরে রওনা দেয়। কিন্তু সুরভির মা তাকে থামিয়ে দিয়ে তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলে, “এটা রাখো। তোমার যদি কাজে লাগে।”
ইনারা বাড়ির সামনে দাঁড়ানো রিক্সাকে টাকা দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। কোথায় যাচ্ছে সে জানে না। তার কোনো গন্তব্য নেই। সে হেঁটে চলেছে অচেনা পথে। সহ্য করছে পথের লোকজনের দৃষ্টি সব দৃষ্টি তার দিকেই স্থির। হঠাৎ সে শুনতে পায় কিছু ছেলের কন্ঠ, “এটা ঐ হোটেলের মেয়ে না? মাইয়াটা কী সুন্দর দেখসোস?”
“সেই। আমাদের সাথে কী একরাত কাটাইব রে?”
ছেলেগুলো পা’য়ের শব্দ তার দিকে এগোল। ইনারা তার হাঁটার গতি বাড়ায়। সাথে পিছনের ছেলেদের পায়ের শব্দও বাড়ে। এর মধ্যে এক ছেলে বলে, “ওগো সুন্দরী আমাদের সাথে হোটেলে যাবা? আমরা ছবি দিতে না পারলেও টাকা দিতে পারমু। এক রাতের কত?”
ইনারা জানে না এখানে কত ছেলে আছে। সে পিছনে ফিরেও তাকায় না। কেবল দ্রুত হাঁটতে থাকে। যত দ্রুত সম্ভব। ভয়ে তার জান যেন দেহ থেকে বেরিয়ে আসবে। সে দেখে তার সামনে দিয়ে কতগুলো গাড়ি আসছে। গাড়িগুলো তো সামনে এসেই থামে। এর মধ্য থেকে বের হয় রহমান এবং কতগুলো লোক। রহমান ইনারার দিকে তাকিয়ে বলে, “ম্যাম আপনি ঠিক আছেন?”
তাদের দেখেই ছেলেগুলো দৌড়ে পালায়। ইনারার যেন জানে জান আসে। রহমান আবার বলে, “ম্যাম আবার এ প্রস্তাবে পরিকল্পনা করে দেখুন। আপনার জন্য ভালো হবে।”
ইনারার আর এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কিন্তু এদেরকেই বা বিশ্বাস করে কিভাবে? তাই সে বলল, “আপনাদের সাথে আমি সেইফ থাকব এর গ্যারান্টি কী?”
“আমাদের উপর এখন বিশ্বাস না-ই থাকতে পারে। স্বাভাবিক। তাই কাওকে নিয়ে এসেছি।”
গাড়ির দরজা খোলা হলো। তার খালাজান বের হলো গাড়ি থেকে। তাকে দেখেই ইনারা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে। খালাজান তার গালে চুমু দিয়ে বলে, “আমার ফুলের মতো ইনুমণিটারে ওই জানোয়ার কি অবস্থা করছে!”
রহমান আবারও জিজ্ঞেস করে, “এবারও কি আপনি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবেন? রাস্তায় আসার সময় আপনার খালাজান আমাদের সব জানিয়েছে। আমাদের স্যার আপনার সব কিছুতে সাহায্য করতে পারে। আপনি যদি রাজি হন।”
“এতে আপনার স্যারের লাভ কি?”
“সে চিন্তা আপনার করতে হবে না। আপনি কেবল রাজি হয়ে যান। আপনি রাজি?”
ইনারা ভাবার জন্য এক মুহূর্ত নেয়। মাথা নাড়ায় সে। সে রাজি।
.
.
ড্রাইভারের কন্ঠে চোখ খুলে ইনারা। তারা অ্যাপার্মেন্ট এসে পড়েছে। আজ তিন বছর হয়ে গেল অথচ সেদিনগুলোর স্মৃতি আজও তার চোখে ভাসে, কানে গুঁজে। তার শরীরের আঘাতের দাগ চলে গেছে কিন্তু হৃদয়ের আঘাত এখনো তাজা। প্রতি মুহূর্তে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে সে। এতদিনে তার অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটেছে। কাল সে তার দেশে ফিরে যাচ্ছে। যারা তার থেকে জীবনের সকল খুশির কারণ কেড়ে নিয়েছে আগামীকাল তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছে সে। তাদের সর্বনাশ করতে।
সে দরজা খুলে এপার্টমেন্টে প্রবেশ করে দেখে অনেকগুলো কাপড়চোপড় মেঝেতে পড়ে আছে। আর তার খালাজান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সানগ্লাস পড়ছে। তাকে দেখে ইনারা জিজ্ঞেস করে, “খালাজান, কি করছেন?”
“আরে ইনুমণি দেখ…দেখ আমাকে মর্টিন লাগতাছে না?”
ইনারা হাসে, “ওটা মর্টিন না খালাজান, মর্ডান।”
“কিন্তু আপনি এভাবে কাপড় এলোমেলো করে রেখেছেন কেন?”
“কেন আগামীকাল আমরা দেশে যাইতাসি মকিং করতে হবে না? ”
“মকিং না প্যাকিং।”
“ওই একই। আমার গ্রামের সবাইকে যাইয়া এই সুন্দর সুন্দর জামা দেখাইয়া ভাব নিমু। আহ সবগুলো জ্বইলা পুইড়া ছাই হইয়া যাবে।”
“কিন্তু দেশে তো যাচ্ছি আমি একা।”
“একা? একা মানে?” খালাজান আতঙ্কিত সুরে বলল। ইনারার দিকে এগিয়ে এলেন তিনি, “না, তোমাকে আমি একা যেতে দেবো না। গতবার ওই জানোয়ারগুলো তোমার সাথে কি করেছিলো।”
“কিন্তু এখনতো আমি আর গতবারের ইনু না। কেউ আমাকে ছুঁয়েও দেখতে পারবে না। এছাড়া রহমান ভাই তো আছে। সে আমার খেয়াল রাখবেন সেখানে।”
“কিন্তু…”
ইনারা খালাজানকে থামিয়ে তাকে সোফায় বসাল। বলল, “খালাজান এ তিন বছর এখানে আছি। কোনো সমস্যা হয়েছে? কারণ রহমান ভাই বা তার যে স্যারই হোক না কেন সে রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। সেখানেও এমন হবে। আর তুমি কি চাও আমি এখানে হাতের উপর হাত রেখে বসে থাকি? আমার মা ও প্রিয়র সাথে যা হয়েছে, আমার সাথে যা হয়েছে তা ভুলে ওদের স্বাধীনভাবে বাঁচতে দেই?”
“না, আমি চাই তুমি তাদের রক্তের কান্না করাও। তোমারে যা কষ্ট দিসে তার জন্য যেন তারা তোমার কাছে এক মুহূর্ত শান্তির জন্যও ভিক্ষা চায়।”
“তাহলে তো আমার ভয় পেলে চলবে না। তাদের মুখোমুখি হতে হবে। এছাড়া স্যার আছে তো। হ্যাঁ আমি তাকে কখনো দেখি নি। কিন্তু তিনি এ পর্যন্ত আমাদের জন্য যা করেছে তাতে আমার এতটুকু বিশ্বাস হয়েছে যে সেই আমার যাত্রায় আমাকে সাহায্য করতে পারেন।”
“এমনিতেই তো তোকে সাহায্য করবে না তাই না? তার এক শর্ত ছিলো। কি শর্ত বলেছে?”
এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল ইনারা। উঠে গেল সে। টেবিল থেকে পানি নিয়ে গ্লাসে ঢালতে ঢালতে বলল, “না। পরে বলবেন।”
“আচ্ছা। সুরভি কে জানাইসো যে তুমি দেশে যাইতেছো?”
“না, সময় হলে জানাব। তুমি চিন্তা করো না খালাজান আমি নিজের খেয়াল রাখব। আর তুমিও এখানে নিজের খেয়াল রেখো। রহমান ভাই তোমার জন্য লোক পাঠাবে তোমার সাথে থাকার জন্য। ওখানে সব গুছানো হলেও আমি তোমাকে নিয়ে যাব।”
খালাজান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন। আর বললেন, “তোমার জন্য খাবার আনি। আজকে নিজের হাতে খাইয়ে দিব।”
খালাজান যেতেই ইনারা শান্তির নিশ্বাস ফেলে। খালাজানের কাছে ধরা খায় নি সে। রহমান সাহেব তাকে শর্তটা বলেছিলেন। এ সুবাদেই তো সে দেশে যেতে পারছে। নাহয় স্যারের অনুমতি ছাড়া তার যাওয়াটা প্রায় অসম্ভব ছিলো। কিন্তু এই শর্তের কথা সে বলতে পারবে না খালাজানকে, নাহলে সে কিছুতেই ইনারাকে এই কাজ করতে দিবে না।
.
.
পরের দিন সকালের ফ্লাইটে ইনারা রওনা দেয় বাংলাদেশের জন্য। তার পাশে একটি মেয়ে বসেই জিজ্ঞেস করে, “এক্সকিউজ মি আপু, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
ইনারা বিরক্তির স্বরে বলে, “এটা বাংলাদেশ ফ্লাইট। তাহলে বাংলাদেশেই তো যাব তাই না?”
“ও হ্যাঁ। আমি অনেক বোকার মত প্রশ্ন করছি। হাই আমি সৃষ্টি। আমি না অনেক বছর ধরে আমেরিকাতেই থাকি। এই প্রথম দেশে যাচ্ছি। জানেন কেন? এক্টর হব বলে। আমার আব্বাজান বলে আমি অনেক ভালো অভিনয় করি। সেখানে যেয়ে সব নায়িকাকে এক ছক্কায় উড়ায় দিব।”
ইনারা কিছু বলে না। চুপচাপ মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু সৃষ্টির কথাই থামে না। ফ্লাইন টেক অফফ করে কিন্তু তার কথা শেষ হবার নাম নেই। সে কানে হেডফোন দেয় তাও সৃষ্টি চুপ হয় না। সে ইনারার কানের হেডফোন খুলে বলে, “আপু দেখেন আমার কাছে কি আছে। ”
এবার ইনারার ধৈর্য হার মানে। সে বিরক্ত হয়ে কিছু একটা বলতে নিবে এমন সময় সে দেখে সৃষ্টি হাতে
একটি ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনটা পুরনো। প্রায় পাঁচ বছর পূর্বেই। পঞ্চসুরের ম্যাগাজিন। কভারেই পঞ্চসুরের ছবি।
সৃষ্টি তাকে জিজ্ঞেস করে, “আপনিতো বাংলাদেশি। তাহলে নিশ্চয়ই পঞ্চসুরকে চিনেন। গান শুনেছেন তাদের?”
“হুম, শুনেছি।”
“বলেন কি? আমি চৌদ্দ বছর থেকে তাদের গান শুনছি। তারা বেস্ট। কিন্তু আফসোস হঠাৎ করে আলাদা হয়ে গেল তারা। আর একজন মেম্বার তো হারিয়েই গেল।”
ইনারার বুকের ভিতরটা ভারী হয়ে গেল। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সৃষ্টি আবারও বলে, “আমি এখনো সবাইকে ফলো করি। জোহান ও সামি আমার ফেভারেট। আপনিও কি এখনো কাওকে ফলো করেন? আপনার ফেভারিট কে ছিলো?”
ইনারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। অন্যদিকে তাকিয়ে সে বলে, “আমার মাথা ব্যাথা করছে। কথা বলেন না প্লিজ।”
“আরে সরি সরি আপু। আমি বুঝতে পারি নি। এই আমি চুপ। আর কোনো কথা বলব না।”
ইনারা তাকিয়ে আছে জানালার ওপাড়ে। এখান থেকে শুভ্র মেঘকে খুব কাছে থেকে দেখা যাচ্ছে। মেঘেদের মাঝে ভাসছে সে। সে সবাইকেই ফলো করে। সব খোঁজ রেখে আসছে সে। আজ ইরফান দেশের বিখ্যাত লেখক। তার লেখা সব সিনেমা সুপারহিট হয়েছে। সে গান গাওয়া ছেড়ে দিলেও লেখা ছাড়ে নি। ঐশি এখনো গানের জগতে আছে। কিন্তু তার নাম কমে গেছে। অন্যান্য সদস্যদের মতো সে সাফল্যতা পায় নি। সামি দেশের সবচেয়ে বড় এজান্সির আন্ডারের সোলো আর্টিস্ট এবং আজকাল জোহানের গানের থেকে বেশি ছবি চলে। দেশের নামকরা অভিনেতার মধ্যে একজন সে। ভাবতেই তাচ্ছিল্য হাসে সে। নিজ থেকেই সৃষ্টিকে জিজ্ঞেস করে, “জোহান তোমার ফেভারিট?”
“একদম। সে বেস্ট। আমার ক্রাশও। ”
“তাহলে এটাও শুনেছ তার এনগেজমেন্ট হয়েছে।”
“এটা আবার শুনব না? যদিও খারাপ লেগেছে তারপরেও এতটুকু শান্তি যে এত ভালো মানুষের সাথে জীবন কাটাবে সে। দেখেন অভিনেত্রী আইজা আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় অভিনেত্রী হবার পড়েও তার কোনো অহংকার নেই। দেশের সবচেয়ে প্রিয় নায়িকা সে।”
ইনারা তাচ্ছিল্য হাসে। কিছু বলে না। সৃষ্টি আবার বলে, “এখন তো সামি এবং জোহান আমার ফেভারিট। কিন্তু সে সময় সকলের মুখে কেবল একটি নাম থাকতো, সভ্যের। না জানি কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের স্বপ্নের প্রিন্স।”
সভ্যের নাম শুনতেই তার বুকের ভিতরটা কামড়ে উঠলো। নিঃশ্বাসটা কেমন বন্ধ হয়ে আসছিল। সে মুখ ফিরিয়ে আবার জানালার দিকে তাকালো। কাঁপানো গলায় বলল, “কিছু মানুষ জীবনে আসেই হারিয়ে যাবার জন্য।”
ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে দেশে। সন্ধ্যার সময়। সৃষ্টি তার সাথেই বের হয়। দুজনে একসাথে চেক আউট করে। ইনারা বলে, “দেখা করে ভালো লাগলো। আমার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে। তাহলে বিদায় নিলাম।”
“আপু আমার বাসায় আসেন না। আব্বাজান যা খুশি হবে। আপনাকে পুরান ঢাকার বিরিয়ানি খাওয়াব।”
“আরেকদিন। নাম্বার তো দিয়েছ। আজ আমার যেতে হবে।”
“আজ একটু বের করে আসতে পারবেন না।”
“না কারণ আজ আমার বিয়ে।”
.
.
ইনারা গাড়িতে বসে আছে। সবে পার্লার থেকে বের হয়েছে সে। তাকে বউ সাজানো হয়েছে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা পার্লারে যাওয়া হয় তাকে। যেয়ে দেখে তার জন্য সোনালী কাজ ভর্তি একটি লাল লেহেঙ্গা এবং ভারী গয়না রাখা আছে। এতকিছু করার মানে হয় না। শর্ত অনুযায়ী তার স্যারকে বিয়ে করতে হবে। লোকটা কে বা দেখতে কেমন ইনারা তাও জানে না। তবে যে এত সম্পত্তির মালিক সে কোনো যুবক হবে না। নিশ্চিয়ই বুড়ো লোক। অন্তত রহমান ভাইয়ের কথা শুনে তো তাই মনে হয়েছে। যে তাদের বড় স্যার বয়স্ক মানুষ।শর্তানুযায়ী তাদের দুইবছর বিয়ের বন্ধনে থাকতে হবে। এরপর যে যার রাস্তায় যেতে যেতে পারে। কেবল দু’বছরের জন্য বিয়ে করার কারণটা সে আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলো না। কিন্তু সে বিরোধ করতে পারে না। কেননা এতদিনে সে এতোটুকু বুঝেছে মুখে বললেই প্রতিশোধ নেওয়া যায় না। তার এর জন্য ক্ষমতা লাগবে। যা স্যারের কাছে আছে। আর সে নিজে প্রতিশোধের জন্য যে কোনো সীমা পেরিয়ে যেতে পারবে। তার জীবনে কোনো পিছুটান নেই। তার বাঁচারও কোনো কারণ নেই। কেবল একটি কারণেই সে নিশ্বাস নিচ্ছে, তার শত্রুদের ধ্বংস করার জন্য। এর পরিণাম যাই হোক না কেন সে মানতে রাজি।
কাজি অফিসের সামনে এসে গাড়ি থামে তাদের। তাদের সামনেই আরেকটি গাড়ি ফুল দিয়ে সাজানো। সে রহমানকে জিজ্ঞেস করে, “এটাই কি আপনার স্যারের গাড়ি।”
“জ্বি ম্যাম।”
“এ বয়সে এসেও আপনার স্যারের এতো শখ। এসব না করে কি একবারে বিয়ে সারলে হতো না? এ লেহেঙ্গা আমার থেকেও বেশি ভারী।”
“বড় স্যারের আদেশ অনুযায়ী সব হচ্ছে।”
“আচ্ছা বলুন তো আপনার স্যার কি এখনো বিবাহিত না ডিভোর্স হয়েছে?”
“ম্যাম এ কি বলছেন আপনি? স্যারের বিয়ে তো হয় নি। আপনার সাথে আজ তার বিয়ে।”
কপালে ভাঁজ পরে ইনারার, “এত বয়সেও বিয়ে হয় নি তার?”
“এত বয়স? ছোট স্যারের কেবল আটাশ বছর।”
“কিন্তু আপনি না বললেন আপনার স্যার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িত পঞ্চাশ বছর ধরে। তার থেকে বেশি আমাকে কেউ সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে না। তাহলে?”
“আপনি ভুল ভাবছেন ম্যাম। আপনার বিয়ে বড় স্যারের নাতির সাথে। আমাদের ছোট স্যার।”
ইনারা কাজির কক্ষের দরজায় এসে দাঁড়ায়। বিস্মিত সুরে বলে উঠে, “কী!”
রহমান রুমে ঢুকে বলে, “ছোট স্যারও এখানে উপস্থিত।”
ইনারা সামনের দিকে তাকায়। কাজির সামনে চেয়ারে বসা। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। তার দিকে পিঠ করে বসে আছে সে। একটি কালো রঙের স্যুট পরা।
রহমান সে পুরুষটির কাছে যেয়ে বলল, “স্যার ম্যামকে নিয়ে এসেছি।”
লোকটি উঠে দাঁড়ায়। তার দিকে তাকানোর পূর্বেই রহমান বলে, “বড় স্যারের আদেশে আজ আপনার বিয়ে আমাদের ছোট স্যারের সাথে। সাফওয়াত ইসমাত সভ্যের সাথে।”
পুরুষটা পিছনে ফিরতেই ইনারা থমকে যায়। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সামনের লোকটার দিকে। তার ভেতরটা যেন মুহূর্তে এলোমেলো হয়ে গেল।
—————————————————————–
এখানেই অনুভবে গল্পের প্রথম খন্ডের সমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় খন্ড আসবে।