অনুভবে
১৮তম পর্ব
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
,
,
মিস্টার মালেক তার লোক লাগিয়ে দিয়েছে মুহিতকে খুজতে। ব্যাংকের সমস্ত ডকুমেন্টস রাবিকের নামে। এই মুহিতকে রাকিব বানানোর মুল উদ্দেশ্য ব্যাংক থেকে যেন সমস্ত টাকা তুলে নিজের নামে করে নিতে পারে মিস্টার মালেক। এরপর আর কোনো ঝামেলা রাখতে চান। হঠাৎ একদিন শোনা যাবে একজন লোকের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সেই মৃত্যুটা হবে মুহিতের। মাঝে মাঝে মিস্টার মালেক নিজেই নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করে মুচকে হেসে ওঠেন।
,
আজকে মুহিতকে খুজে বের করতেই হবে। এই একমাসে মুহিতকে প্রচুর ভাবে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেছে মিস্টার মালেক। কিন্তু এখান বুঝতে পারছে যে ফলাফল শূন্য। মিস্টার মালেক জানেনা যে মুহিত তার কুকীর্তি সব জানে তাই সব কিছু সুষ্ঠভাবেই করতে চান। তারপর মুহিতকে মেরে ফেলার দিন সব সত্য প্রকাশ করবে।
,
,
মুহিত মিস্টার মালেকের বাসা থেকে পালিয়ে রিতার দেওয়া ঠিকানায় উপস্থিত হয়। ফোনে রিতার মেসেজ আসে, ” সামনে যে হোটেল টা দেখছেন তার রিসিপশনে আপনার নাম বললে একটা রুমের চাবি দিয়ে দেবে। আপনি এই রুমে কিছুদিন থাকবেন, আমি এদিকটাই কিছু করতে পারি কিনা দেখবো।
,
মুহিত একটু বাকা হাসি দিয়ে নিজে নিজেই বলে,
,
– মেয়েটা কতই না বোকা! মালেক মারা যাওয়ার পর তো এই সমস্ত সম্পত্তির মালিক ওই মেয়েটা হবে। তাহলে কেন ও আমাকে বাংলাদেশে যেতে সাহায্য করতে চাইছে আর কেনই বা ও নিজেও চলে যেতে চায়।
,
,
আনমনে হাটতে হাটতে হোটেলের দিকে রওনা দেয় কিন্তু হঠাৎ করে একটা জিপ এসে ধাক্কা দেয়। অনেকটাই চোট পায় মুহিত। ঠিক যতটা চোট পেলে একজন জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ততটাই চোট পেয়েছে।
,
জ্ঞান ফিরতেই দেখে মিস্টার মালেক আর রিতা সামনে দাঁড়িয়ে। রিতার মুখটা শুকনা দেখাচ্ছে, যেন অনেক কিছু সে হারিয়ে ফেলেছে। হ্যা, হারিয়ে ফেলেছেই। এতো বড় প্লান, সব কিছুই ভেস্তে যাবে রিতা ভবতেই পারেনি।
,
হঠাৎ মুহিতের কথার ধরন শুনে রিতার অন্ধকার মুখটা আলোয় ভরে ওঠে। রিতাকে অবাক করে দিয়ে মুহিত মিস্টার মালেকের সাথে কথা বলতে থাকে।
,
মিস্টার মালেক- তা মিস্টার মুহিত কি ভেবেছিলে? পালিয়ে বেচে যাবে?
,
মুহিত- ড্যাড, এসব কি বলছো তুমি?
,
মুহিতের মুখে ড্যাড আর কথার ভঙ্গিতে পরিবর্তন দেখে মালেক সাহেব বেশ কনফিউজড হয়ে গেছে। তাহলে যেটা গাড়িতে ছিলো ওটা কে?
,
মুহিত- ড্যাড তুমি কি ভাবছো বলোতো? আর মিস্টার মুহিত কে?
,
রিতার মুখে মুচকি হাসি লেগেই আছে। বুঝতে বাকি নেই যে মুহিত রাকিবের রোল প্লে করতে শুরু করে দিয়েছে
,
মিস্টার মালেক যেন শকের উপরে শক খাচ্ছে। যে ছেলেটাকে মৃত অবস্থায় পেয়েছিল তাহলে সেটা কে ছিল?
মুখ বিকৃত হয়ে যাওয়ার কারণে তো তাকে রাকিব হিসেবে ধরে নেয়া হয়েছিলো।
,
অভিনয়ের আরেক ধাপ বাড়িয়ে দিয়ে মুহিত বলল,
,
– ড্যাড, তুমি কি শুরু করেছো বলো তো? আমার সঙ্গে কথা কেন বলছোনা? বারবার কোথায় খেয়ালে হারিয়ে যাচ্ছো?
,
মিস্টার মালেকের এবার বিশ্বাস হতে শুরু করল যে এটা মুহিত নয়, এটা তার ছেলে রাকিব কারণ কথা বলার সময় হাত নাড়ানো এবং কথার যে টান সেটা একদম রাকিবের। অনেক্ক্ষণ পর মিস্টার মালেক বলল,
,
– কিছুনা মাই সান, আমি তোমাকে অনেকদিন পর দেখে একটু অবাক হয়ে গেছি? তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছিনা। সেদিন অ্যাক্সিডেন্টে কে ছিল ওটা?
,
– ওটা আমার বন্ধু পিটার ছিল। রিতাকে বাসায় পৌছে দেয়ার জন্য ওকে পাঠিয়েছিলাম।
,
মালেক- কিন্তু তুমি এতদিন আমার সঙ্গে দেখা কেন করোনি?
,
– আমি নিজেই স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিভাবে সেটা আমার মনে নেই তবে এখনই এখানে আমি নিজেকে আবিষ্কার করছি।
,
– তুমি একটা গাড়ি সঙ্গে একসিডেন্ট করেছিলে মাইসান।,
,
একবার মুহিত রিতার দিকে তাকিয়ে ভ্রু উচিয়ে জানান দিচ্ছে যে অভিনয় কেমন হচ্ছে। রিতা হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিলো, দারুন।
,
রিতার যেন নিঃশ্বাসটা হালকা হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে গিয়ে আর ফিরে আসবেনা। সেখানে থাকার একটা বন্দোবস্তও আছে। রাকিব একবার শখ করে বাংলাদেশে একটা বাড়ি বানিয়ে ছিল বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায়।। রাকিব চাইতো জীবনের শেষ সময়টা সেখানেই কাটিয়ে দেবে, যেখানে থাকবেনা শহরের কোলাহল, যেখানে কেউ ডিস্টার্ব করবে না। শুধুমাত্র রিতা আর রাকিবের ভালোবাসাময় জীবন যেখানে থাকবে।
,
হঠাৎ করেই আবার রিতার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে। এই ভারী নিঃশ্বাসটা যে এতো কষ্টের, সেটার মতো কষ্ট আর কিছু হতে পারে না। এই অপূর্ণতার কোন ব্যাকআপ নেই না কেউ রাকিব কে ফিরিয়ে এনে দিতে পারবে।
,
হ্যা এনে হয়তো দিতে পারবে না তবে তার বানানো বাড়িতে থেকে নিজের বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চায় রিতা। কিছুদিন পর মুহিতকে নিয়ে মিস্টার মালেক নিজের বাড়িতে চলে যায়।
,
মিস্টার মালেক এটা জানেনা যে তার কুকর্ম তার ছেলে জানে। শুধু সে এটাই জানে তার কুকর্ম শুধু রিতা জেনেছে, সে কারণে বাড়িতে এসে রিতাকে একটু শাসিয়ে দেয় যে, রাকিবের সামনে যেন কোনোভাবেই সে তার সত্য প্রকাশ না করে।
,
রিতা মিস্টার মালেকের কথায় রাজি হয়ে যায়।। রাজি না হওয়ারই বা কি আছে! এখন সবকিছু তো তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী চলছে, এতোটুকু সেক্রিফাইস তো করাই যায়। এটা তো অভিনয়ের আরেকটা ধাপ হাহাহা।
,
দেখতে দেখতে কয়েক মাস চলে গেছে। এদিকে মুহিত সম্পূর্ণ রাকিব হয়ে উঠেছে আর ওদিকে,
,
,
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে হিমেল।
,
মিলি হিমেলের কোলে বসে আছে। আব্বুকে প্রশ্ন করে অতিষ্ঠ করে তুলছে।
,
একটু পর পর মিলি বলে উঠছে,
,
-আব্বু আমার ভাইয়ুটা কখন আসবে?
,
-এইতো এক্ষুনি চলে আসবে।
,
হিমেল এর কথা বলা শেষ হতে না হতেই ভিতর থেকে ছোট বাচ্চার কান্নার আওয়াজ বাইরে আসে। হিমেলের চোখ থেকে কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
,
-আব্বু তুমি কাঁদছো কেন? আমার ভাইয়ুর জন্য কি তোমার রাগ হচ্ছে?
,
হিমেল মিলির কপালে একটা চুমু এঁকে দিয়ে বলে,
,
-মারে তুই বড্ড ছোট। যেদিন নিজের সন্তান হবে সেদিন বুঝবি চোখের জলটা দুঃখের না, সুখের।
,
ছোট্ট মিলি মাথা চুলকাতে থাকে সাড়ে পাঁচ বছর বয়সের একটা মেয়ের এত কথা বোঝার সাধ্য নেই।
,
ডাক্তার বাইরে বের হয়ে হিমেলকে কংগ্রাচুলেশন করে এবং ভিতরে যাওয়ার পারমিশন দেয়।
,
হিমেল মিলিকে কোলে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারের ভিতরে প্রবেশ করে। মিহির পাশে তার ছোট্ট রাজপুত্রটি নিজের আঙ্গুল গালের ভিতর দিয়ে নিশ্চিন্তে যেন ঘুমাচ্ছে। একটু আগেও যে কান্না করছিল এখন সে ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে।। যেন ঘুম সদ্য জন্মানো বাচ্চাটার হলেও সুখটা সম্পুর্ন হিমেলের মনে দোলা দিচ্ছে। হিমেল মিহির পাশে বসে কপালে একটা চুমু এঁকে দেয়।
,
মিলি হিমেলের কোল থেকে নেমে কোমরে হাত দিয়ে বলে,
,
– আব্বু তোমার লজ্জা নেই? ছোট্ট মেয়ের সামনে নিজের বউকে চুমু খাচ্ছো?
,
হিমেল হো হো করে হেসে ওঠে। মিহি কথা এড়ানোর জন্য বলে,
,
– তোমার ভাইয়াকে দেখবেনা?
,
মিহি ঘুম ভেঙচিয়ে মিহিকে বলে
,
– হুহ, সেটা তোমার সাথে বলবো কেন? তোমরা প্রেম করো যাও।
,
এরপর মিলি হাঁটতে-হাঁটতে বেডের অপর পাশে যায় এবং দেখতে পারে তার ছোট্ট ভাইটি চোখ বুঝে শুয়ে আছে।
,
মিলি মিহিকে খুব আগ্রহের সাথে জিজ্ঞাসা করে,
,
– আম্মু আমার ভাইয়ু ঘুমিয়ে আছে কেন? ওকে ডেকে দাও। আমি ওর সাথে খেলা করব।
,
মিহি একটু কষ্ট করে নিজের হাতটা বাড়িয়ে মিলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
,
– ছোট বাচ্চারা দিনের সবসময়ই প্রায় ঘুমায়। ও কিছুটা বড় হোক তারপরে তুমি ওর সাথে খেলা করবে।
,
মিলি আবার মুখ ভেঙচিয়ে বলে,
,
– তোমার ছেলেকে নিয়ে তুমি থাকো। আমার আব্বুই ভালো।। আব্বুর কাছে যাচ্ছি।
,
এইবলে মিলি ঘুরে এসে হিমেলের কোলে ওঠার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। হিমেল পরম আদরে মেয়েকে আবার কোলে তুলে নেয়। পরিবারের পূর্ণতার আরেক ধাপ পেরিয়ে গেছে হিমেলের। মিহিও খুশি কিন্তু এই সুখের মাঝেও যেন মিহির হঠাৎ করে মনের মধ্যে ধুকধুকানি শুরু হয়ে গেছে। কেন এমন হচ্ছে সে নিজেও জানেনা। যেন মনে হচ্ছে কোন কালবৈশাখী ঝড়ে মিহির সাজানো সংসারটিকে ভেঙে তছনছ করে দিচ্ছে।
,
,
চলবে
,
বানান ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
,
পরবর্তী পর্ব আগামীকাল পাবেন।