অনুভবে (২য় খন্ড) পর্ব ১৪

0
1311

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ১৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

জোহান শুটিং এর জন্য বাহিরের দেশে গিয়েছিল। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এলো নতুন মুভির জন্য সাইন করতে। যেহেতু সকল ফিল্ম বাছাই করার দায়িত্ব জোহানের টিমের তাই এখনো সে স্ক্রিপ্টই পড়ে নি। তাই যতটুকু পারছে এই পথেই পড়ে নিচ্ছে। সে দ্রুত এজেন্সির ভেতর ঢুকছিল। এখান থেকে তার আবার একটা নতুন গানের রেকর্ডিংও করতে হবে।

তাড়াহুড়ো করে ভেতরে যাওয়া এবং তার স্ক্রিপ্টের দিকে চোখ থাকার কারণে সামনের দিকে নজর ছিলো না তার। তাই তার সামনে থাকা একজনের সাথে ধাক্কা লাগে তার। সে থেমে যায়। পিছনে ফিরে দেখে একটি মেয়ের সাথে ধাক্কা লেহেছে তার। মেয়েটি লেভেন্ডার ড্রেস পরে আছে। তার সরি বলার আগেই মেয়েটি নিচে বসে পরে তার ফোন নেবার জন্য এবং বিরক্তির সুরে বলে, “দেখে চলতে পারেন না? দেখে চললে কী বিশেষ সমস্যা হয়?”

কন্ঠটা শুনে জোহান এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। কন্ঠটা যে তার ভীষণ চেনা মনে হলো। মেয়েটির দিকে স্থির থাকে তার দৃষ্টি। মেয়েটা উঠে দাঁড়াতেই তার স্থির থাকা চোখ দুটো যেন কোটের থেকে বের হয়ে আসতে চাইল। তার সামনে ইনারা দাঁড়ানো। নিজের দৃষ্টিকে বিশ্বাস হলো না তার।

ইনারা উঠে জোহানকে দেখতেই অপ্রস্তুত হয়ে যায়। জোহানের সাথে এখনই দেখা হবার পরিকল্পনা সে করেনি। তার মনে পড়ল সভ্য এখনো ফোনে আছে। সে জোহানের দিকে তাকিয়েই ফোনটা কানের কাছে নিলো। বলল, “আমি আপনাকে এখান থেকে বের হয়ে কল দিচ্ছি।”
বলে সে ফোন কেটে দেয়।

জোহান তার হাতের স্ক্রিপ্টটা মেঝেতে ফেলে গর্জন করে উঠে, “তুমি এখানে কী করছ?”
তারা এক কথাতেই সকলের দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় তাদের দুজনের উপর। এখানে চোখ বুলিয়ে সবার দিকে একনজর তাকায়। তারপর হঠাৎ নিজের ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে আনে, “আপনি মিঃ জোহান না? আহা দেখলন আপনাকে চিনতেই পারি নি আমি। আমি তো অডিশন দিতে এসেছি। আপনি এখানে কী করছেন? ওহ আপনিও এই মুভিতে আছেন। আমিই না ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা আমি যাই, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।” ইনারা জোহানের পাশ কাটিয়ে যাবার সময় তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, “নিজের কন্ঠ এবং হাত দুটোই কন্ট্রোলে রাখুন, নাহয় প্রশ্ন উঠলে নিজের কুকর্মের কথা কীভাবে সবাইকে বলবেন। তাই ভেবেচিন্তে মুখ আর হাত চালাবেন। বুঝলেন?”

জোহান ইনারার দিকে তাকায়। ইনারার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। তার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে এখনই তার চোখের ভেতর থেকে আগুনের ফুলকি বের হয়ে তাকে ধ্বংস করে দিতে প্রস্তুত। সে নিজেকে সামলায়। কোনো এক ভুল পদক্ষেপ অনেক বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই নিজের স্ক্রিপ্টটা নিয়ে সে ভেতরের দিকে যায়।

ইনারা অনেকক্ষণ পর খুঁজে পায় অডিশন রুমটা। রুমের দরজার বাহির থেকে জিজ্ঞেস করে, “আসবো?”
“আসুন।”
অনুমতি মেয়ে ইনারা ভিতরে ঢুকে। দেখে সেখানে আগের থেকে কয়েকজন উপস্থিত। এর মধ্যে দীপাকে দেখে সে খানিকটা অবাক হয়।
পরিচালক রফিক তার দিকে তাকিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলে, “আপনার আসতে এত দেরি হলো কেন?”
“রুম খুঁজে পেতে সমস্যা হচ্ছিল।”
“তাহলে আগে আসবেন খোঁজার জন্য। ” রুক্ষ গলায় বলে পরিচালক রফিক, “আমাদের কোনো কাজ কাম নেই যে আপনার জন্য এখানে অপেক্ষা করব আমরা? আপনার কি সময়ে আসার মতো ভদ্রতা নেই?”

এবার ইনারার মেজাজ বিগড়ায়। সে হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় পরিচালকের দিকে। জোর গলায় উওর দেয়, “আর আপনার এতটুকু ভদ্রতা নেই যে আপনার কর্মীদের এতটুকু শিখাবেন কেউ ডিরেকশন জিজ্ঞেস করলে তা বলতে হয়। আর আপনি কি শিখাবেন? আপনার মাঝে কোনো ভদ্রতা আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।”

ইনারার মুখ থেকে এমন সরাসরি কথা শুনে গলা দিয়ে কিছু মুহূর্তের জন্য শব্দ বের হলো না রফিকের। এত জনের সামনে তাকে একজন অপমান করছে সে ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না। প্রায় সাত বছর ধরে সে পরিচালক হিসেবে কাজ করছে। আজ পর্যন্ত কেউ তার সাথে এভাবে কথা বলে নি। আর এই মেয়ে কি না প্রথম দেখাতেই তার মুখের উপর এভাবে কথা বলছে? তাও চরিত্র পাবার আগেই! সে আঁতকে উঠল, “তোমার সাহস তো কম না আমার সাথে এ সুরে কথা বলছ?”
“কেন? আপনি বলতে পারলে আমি পারব না কেন? আপনি আমার সাথে যে সুরে কথা বলছেন আমিও সে সুরে বলছি। আপনি ভালোভাবে কথা বললে আমিও আপনার সাথে ভালোভাবে কথা বলব। সোজাসাপটা ব্যাপার।”
রফিক সাহেব সামনে কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলেন। সে দরজা দিয়ে জোহানকে ঢুকতে দেখে তার দিকে এগিয়ে যায়। বিনয়ের সাথে তাকে বলে, “আরে জোহান তুমি এসেছ? তোমারই অপেক্ষায় ছিলাম। আসো তোমার সাইনের কাজটা আগে সারিয়ে আসি।”
“আপনার না এখন অডিশন নেবার সময়? আমি দেখা করতে আসলাম কেবল।”
“আরে ওরা অপেক্ষা করতে পারবে। তুমি গুরুত্বপূর্ণ। তোমার কাজ আগে সারিয়ে আসি।”
রফিক জোহানকে নিয়ে দরজা থেকে বের হবার পূর্বেই ইনারা বলে, “আমি কারও অপেক্ষা করতে পারব না। আপনি এখন অডিশন না নিলে আমি চলে যাচ্ছি। আমার এত সময় নেই।”

রফিক ইনারার দিকে তাকায় অবাক দৃষ্টিতে, “তুমি এখানে অডিশন দিতে এসেছ। কিন্তু তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে কত বড় অভিনেত্রী তুমি!”
ইনারা বাঁকা হাসে, “আপনি আমার পাঁচ মিনিট দেরিতে আসায় আমাকে ভদ্রতার লেকচার দিয়েছিলেন। যেখানে আমাকে না রুম নাম্বার বলা হয়েছে, আর না দেখানো হয়েছে। এখন আপনি আমাদের অপেক্ষা করতে বলছেন। কেন এখন অডিশনে দেরি হবে না। আর হ্যাঁ আমি এখন কোনো বড় নায়িকা নই। আর এক কাজ করুন, আপনার স্ক্রিপ্ট আপনি রাখুন। আমি চললাম।”

ইনারাকে যেতে দেখে রফিক সাহেব মেজাজ খারাপ করে বলেন, “এক মিনিট, অডিশন করেই যাচ্ছি।”
জোহানের দিকে সে তাকিয়ে আবার বলে, ” জোহান এই ঝামেলা আগে শেষ করে নেই। তারপর আরামে বসে তোমার চরিত্র ও মুভি সম্পর্কে কথা বলতে পারব।”
পাশ থেকেই জোহানের এসিস্ট্যান্ট বলে, “কিন্তু স্যারের দেরি হয়ে যাচ্ছে। উনার তো আরও কাজ আছে না’কি?”
জোহান ইনারার দিকে তাকায়। চোখ সরায় না। তার দিকে তাকিয়ে থেকেই উওর দেয়, “না, আমার কোনো তাড়া নেই।”
জোহানকে রফিকের পাশে বসার জন্য একটি চেয়ার দেয়া হলো। সামনের বেঞ্চে বসে ছিলো ইনারাসহ চারটি মেয়ে। সবাই অভিনেত্রী। আগে কোনো না কোনো সিনেমায় কাজ করেছে। এর মাঝে কেবল ইনারাই নতুন। তার হাতে একটি কাগজ দেওয়া হলো। কাগজে লেখা তার এই মুহূর্তে কি পরিস্থিতিতে অভিনয় করতে হবে। পরিস্থিতিটা এমন যে একটি মেয়ের সাথে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও ছেলে অন্য সম্পর্কে জড়ায়। মেয়েটিকে একথা জানানোর পর তার প্রতিক্রিয়া দ্বারাই এই দৃশ্য উপস্থাপন করতে হবে।

ইনারার সম্পূর্ণ ধ্যান ছিলো তার স্ক্রিপ্টের উপর। আর জোহানের সম্পূর্ণ ধ্যান তার উপর । রফিক এই সিনেমা নিয়ে অনেক কথা বলে যাচ্ছে কিন্তু সেদিকে জোহানের মাথাব্যথা নেই। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইনারা দিকে।
হঠাৎ করে রফিক তার বাহু ধরে নাড়িয়ে বলে, “জোহান তুমি আমার কথা শুনছো?”
জোহান আগে পরে কিছু না ভেবে বলে, “রফিক এই মেয়েকে আমি মুভিতে চাই না।”
“কী? কিন্তু ওর অডিশন নেবার কথা প্রডিউসার নিজে বলেছে। আইজাও রিকুয়েষ্ট করেছে।”
“আমি ফ্রী তে এই মুভি করতে রাজি কিন্তু ও যেন এই মুভিতে না থাকে।”
রফিক অনেকটা বিস্মিত সুরে বলে, “ওর সাথে তোমার কোনো সমস্যা আছে?”
“সেটা তোমার না জানলেও চলবে। কেবল আমি এই মেয়েকে মুভিতে চাই না।”
“ঠিকাছে। যেভাবে বলছ সেভাবেই হবে।”

দীপা ইনারার সামনে এসে দাঁড়ায়, “তুমি অকারণে এত কষ্ট করে স্ক্রিপ্ট পড়ছ। স্যারের সাথে এমন বেয়াদবি করার পর তোমাকে এই চরিত্রে নিবে ভেবেছ? একতো এতগুলো অভিজ্ঞ অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে অডিশন দিতে এলে আর প্রথম দেখায় পরিচালকের সাথে খারাপ ব্যবহার করলে? নিজের পা’য়ে নিজে কুড়াল মারে কীভাবে তা তোমার থেকে শেখা উচিত।”
ইনারা মুখ তুলে তাকাতেই দীপার কপাল কুঁচকে যায়। মুখে কালো ছায়া এসে জমে, “তোমাকে কোথায় যেন আমি দেখেছি। তু-তুমি ইনারা না?”
“চিনতে বেশি দেরি হলো না। আর কী বললেন নিজের পা’য়ের নিজে কুড়াল মেরেছি? এক সময়ের বিখ্যাত অভিনেত্রী আজ নতুন আসা মানুষদের সাথে একটি সাইড ক্যারেক্টর এর জন্য অডিশন দিচ্ছে। এতে তো মনে হয় আপনিই নিজের পা’য়ে নিজে কুড়াল মেরেছেন।”
দীপার সম্পূর্ণ কথা কানেও গেল না৷ সে হা করে তাকিয়ে রইলো ইনারার দিকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যাচাই করল। একসময় যে ছেলেদের মতো বেখেয়ালি ভাবে চলাফেরা করতো তাকে কখনো এত সুন্দর দেখাতে পারে কল্পনাও করে নি সে। তার গলায় সকল শব্দ এসে জমাট বেঁধেছে। তাই ইনারার কথার উওরও দিতে পারছে না সে।

একজন স্টাফ ঘোষণা করল তাদের অডিশনের সময় শুরু হয়ে গেছে। সবার পূর্বে দীপার পালা এবং শেষে ইনারার। মাঝখানে আরও তিনজন আছে। যেহেতু সবাইকে একই স্ক্রিপ্ট দেওয়া হয়েছে সেহেতু দীপার চরিত্র পাবার সুযোগ সবচেয়ে বেশি এবং ইনারার সবচেয়ে কম। একজন স্টাফকে তাদের সাথে অভিনয় করার জন্য দাঁড় করানো হয়েছে। ছেলেটি তার ডায়লগ বলার পর অভিনয় করছে মেয়েরা। দীপার অভিনয়টা আসলেই বেশ ভালো এবং আবেগী ছিলো। সে অডিশন দিয়েই ইনারার পাশে এসে বসে বলে, “তখন কি বলছিলে যেন? আমি প্রধান চরিত্রে এখন আর অভিনয় না করলেও এই চরিত্রের জন্য ফার্স্ট চয়েজ আমি। তাইতো আমাকে সবার আগে সুযোগ দেওয়া হয়েছ। দেখেছ দ্বিতীয়জন আমার মতো অভিনয় করছে। সবাই এই অভিনয় করবে। কারণ কোনো বিকল্প নেই। তাই পরিচালক প্রথম পার্ফোরমেন্স এর উপর প্রভাবিত হবে এবং আমাকে বাছাই করবেন।”
ইনারা হাসে। সে উওর দেয় না। তার স্ক্রিপ্ট পড়ায় ধ্যান দেয়। তবে দীপার কথাটা ঠিক হয়। সকলেই দীপার মতো আবেগপ্রবণ অভিনয় প্রদর্শন করে।

ইনারার সুযোগ আসে। সে উঠে যেয়ে দাঁড়ায় ছেলেটার সামনে। ছেলেটা স্বাভাবিকভাবেই তার সংলাপের অংশটি বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দেও, আমি এখন আর তোমাকে ভালোবাসি না। গত ছয় বছর খুব ভালো সময় কাটিয়েছি আমরা। কিন্তু তোমার প্রতি এখন আর ভালোবাসা অনুভব করতে পারি না আমি। আমি অন্যকাওকে ভালোবাসি।”
ইনারা থিয়েটারে এমন দৃশ্যতে অভিনয় আগেও করেছে। সবগুলোতে সে কান্নাকাটির দৃশ্য। সবাই এই মুহূর্তে তাকে এমন অভিনয় করার প্রত্যাশাই করছিল। এবং একই ধরনের অভিনয় দেখে দেখে সকলের মাঝে একরকম বিরক্তিও এসে পড়েছে। কিন্তু ইনারা উল্টো কাজ করল।

“ভালোবাসা অনুভব করতে পারো মানেটা কী?” শান্ত গলায় বলে ইনারা। পরক্ষণেই সে রাগে গর্জন করে উঠলো, “ভালোবাসার অনুভূতি হারিয়ে যাওয়াটা কি এতটাই সহজ? আমার জীবনের এতটা বছর বরবাদ করার পর তুই এখন অন্যকাওকে ভালোবাসিস? তাহলে এতটা বছর আমাদের মাঝে কী ছিলো?”
ইনারার গর্জন শুনে তার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি কেঁপে উঠে। সে ভয়ে পিছনে সরে যায়। ইনারা তার কলার চেপে ধরে রাগান্বিত সুরে বলে, “আমাকে খেলনা পেয়েছিস তুই? যখন ইচ্ছা ভালোবেসে কাছে টেনে নিবি আর যখন ইচ্ছা জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিবি? একজনের সাথে সম্পর্কে থাকার পর অন্যকাওকে ভালোবাসা এতই সহজ তোর জন্য? একবার আমার কথা চিন্তা করেছিলি তুই? এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে ভালোবাসলে আমাকে কষ্ট দেবার পূর্বে হাজারোবার ভাবতি তুই।”
ইনারার গলা কেঁপে উঠে। তার চোখে ভিজে আসে।

“স্যার এসব ডায়লগ তো স্ক্রিপ্টেই নেই।” একজন কথাটা বলল পরিচালক রফিককে। রফিক সাহেব ইনারার পার্ফোরমেন্স দেখায় ব্যস্ত। তাকে উৎসুক দেখাচ্ছে। সে ছেলেটিকে বলল, “স্ক্রিপ্ট থেকে বেটার। চুপ করো তো।আর আমাকে অভিনয়টা দেখতে দেও। একদম আসল মনে হচ্ছে।”

ইনারা কাঁপছিলো। কিন্তু তাও তার ভেজা চোখে যেন অগ্নির ফুলকি উঠছে। সে ক্ষোভের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমাকে আঘাত দেবার আগে একশোবার ভাবা উচিত ছিলো। আহত বাঘিনী কারও জীবনও নিতে পারে। কি ভেবেছিস? এভাবে এসে বলবি তুই অন্যকাওকে ভালোবাসিস আর আমি বিগত ছয় বছর ভুলে তোর খুশি চাইবো। আমাকে কষ্ট দেবার পরিবর্তে জীবন বরবাদ করে দিব তোর। আমি ফুলের মতো মিষ্টি হতে পারলে, সে ফুলের কাঁটাও হতে পারি।”

“মাফ করে দেন আপু। ভুল হয়ে গেছে।” ইনারার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি ভীত গলায় বলল। ইনারা থতমত খেয়ে গেল, “আমরা তো এক্টিং করছি।”
“আপনি যেভাবে বললেন ভয় পাইসি আমি।”

রফিক সাহেব শব্দ করে হাসে। সে ইনারার সামনে এসে দাঁড়ায়, “তুমি বাকি সবার থেকে উল্টো অভিনয় করলে কেন জানতে পারি?”
“অবশ্যই পারেন। আমি স্ক্রিপ্ট পড়ে চরিত্রটাকে যতটা বুঝেছি সেই চরিত্র আবেগ প্রকাশ করে না। এছাড়া ব্যক্তিগত ভাবে যে বিশ্বাসঘাতকতা করবে তার কাছে ভালোবাসার ভিক্ষা করার অর্থ হয় না।”
“ওয়েল ডান। এই চরিত্রটা তোমার।”

জোহান বিস্মিত ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ পূর্বেই রফিক তাকে কথা দিয়েছিলো সে ইনারাকে কাস্ট করবে না আর এখনই তাকে মুভিতে নিয়ে নিলো!
দীপা আঁতকে উঠে বলল, “কিন্তু আমাদের রেজাল্ট তো একসাপ্তাহ পর দেবার কথা। আর ও আপনার দাথে বেয়াদবি করেছিল তার কী?”
“আমি ব্যক্তিগত ক্ষোভ আমার কাজের উপর তো ফেলবো না। এছাড়া ওর মতো পাওয়ারফুল অভিনেত্রীর সাথে অনেক বছর হলো কাজ করি নি। কিন্তু ডোন্ট ওয়ারি, তোমাদের অন্য চরিত্রের জন্য বাছাই করার চিন্তা ভাবনা করেছি। আর মিস ইনারা, অভিনন্দন। এভাবেই এটাটিউড রাখবেন চৈতীর চরিত্রের সময় কাজে লাগবে।”
রফিক সাহেব হাত বাড়ালে ইনারাও মৃদু হেসে হাত মেলায়, “আপনার সাথে কাজ করার অপেক্ষায় থাকব।”

রফিক সাহেব যেতে নিলে জোহান দরজায় তাকে আটকায়, “আপনি বলেছিলেন ওকে নিবেন না।”
রফিক হাসে, “এখন জোহান তুমি তো ওর অভিনয় দেখেছ। ওকে না নিলে আমার নিজের কাছেই বোকা লাগবে। আর আমি চাই না আমার পূর্বে ওকে অন্যকেউ কাস্ট করুক। ওর অভিনয় সুন্দর হলে নাম তো আমারও হবে। এছাড়া আইজা ও প্রডিউসার দুইজনকে ওকে নিতে বলেছে। আর এত হাই বাজেট ফিল্মে তোমাকে কিছু টাকা দিলে তো বিশেষ সমস্যা হবে না। আর টাকা না দিলে আহামরি লাভও হবে না। এসব বাদ দিয়ে আসো তোমার সাইনটা করে নেও।”
“আপনি যান, আমি একটু পর আসছি।”

ইনারা বেঞ্চ থেকে তার ব্যাগ নিয়ে দীপার দিকে তাকিয়ে হাসি দিলো। হাসিটা দেখেই যেন দীপার শরীর জ্বলে উঠছিল। ইনারা বিড়বিড় করে বলে, “শুটিং করতে যা মজা হবে তা ভেবেই আমার আর তর সইছে না।”
সে ফিরে যেতে নিলেই পথে জোহান তার হাত ধরে নেয়, “তুমি এই মুভি করতে পারো না।”
“আমি কি করতে পারি আর কি না তা আপনার থেকে জিজ্ঞেস করতে হবে?”
“ইনারা তুমি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আসতে পারবে না।”
“তাহলে থামিয়ে দেখান।”
“চেলেঞ্জ দিচ্ছ? তোমার কী মনে হয় তুমি আইজাকে ব্লাকমেইল করে যা ইচ্ছা করতে পারবে? আমি এতদিন এই দেশে ছিলাম না, নাহলে তুমি এইখানে অডিশন দিতেও আসতে পারতে না।”
ইনারা তাচ্ছিল্য হাসে, “আপনার মনে হয় আপনি আমাকে আটকাতে পারবেন? আচ্ছা আইজার সাথে আমার ছবি ছাপা, হঠাৎ আমার আপনাদের সামনে উপস্থিত হওয়া, এখানে অডিশনে এসে সিলেক্টও হয়ে যাওয়া। এসব নিয়তি মনে হয় আপনার? একটা মজার কথা বলি? এসব আমি করেছি। আপনি আমার আপন কেউ না তো তাই আপনি আমাকে এত আঘাত দিতে পারেন নি। কিন্তু যতটা আঘাত দিয়েছেন তার থেকে বেশি ফিরিয়ে দিব। নিজের সীমায় থাকুন, এখনো আপনার পরিণতির সময় আসে নি। বেশি লাফালাফি করলে আইজার আগে আপনাকে শিক্ষা দিতে বাধ্য হবো আমি। আর আমার হাত ধরার সাহস করবেন না।”
ইনারা এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে নিলো।

জোহান হাতটা মুঠো করে। চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল।
.
.
ইনারা অডিশন দিয়ে বাসায় যাবার পূর্বে সুরভির সাথে দেখা করে নেয়। বাসায় যেতে যেতে রাত হয় তার। সে নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে পিছনে ফিরে সভ্যকে দেখে চমকে উঠে। সে নিজের বুকে হাত রেখে গভীর নিশ্বাস ফেলে, “এভাবে দরজায় ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
“আমার বউয়ের অপেক্ষা করছিলাম।”
“আপনাকে মানা করেছি না এই বউ বউ করবেন না।”
সভ্য ইনারার কাঁধের একপাশের দেয়ালে হাত রেখে তার দিকে ঝুঁকে বলে, “তাহলে কী বলব তুমিই বলে দেও।”
সভ্যের তার দিকে আসা দেখে ইনারা লজ্জায় ডুবে যায়। তার চোখে লজ্জার ছোঁয়া দেখা যায়। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সভ্যর বুকে হাত রেখে ধীরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে, “বিরক্ত করবেন না।”
“অডিশন কেমন গেল তা তো বলো।”
ইনারা ব্যাগ বিছানায় রেখে বসে বলে, “আমি সিলেক্ট হয়ে গেছি।”
“আমি জানতাম। এখন ট্রিট কোথায়? আজ খুশিতে আমি মিষ্টি কিছু খাব।”
“মিষ্টি আর আপনি! অবাক কান্ড। আপনি নিজের মত পাল্টাবেন না। বসে থাকুন আমি এখনি রহমান ভাইকে মিষ্টি আনতে বলছি।”
ইনারা উঠে যেতে নিলেই সভ্য তার হাত ধরে এক টানে তাকে বিছানায় বসায়। তার গালে হাত রেখে আঙুল বুলিয়ে বলে, “মিষ্টি তো তোমার কাছেই আছে।”
“আমার কাছে? কীভাবে?”
সভ্যের দৃষ্টি ইনারার ঠোঁটের উপর। তার আঙুলের ছোঁয়া ইনারার ঠোঁটে পেতে সে কেঁপে উঠে। নম্র দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। সভ্যের দৃষ্টি মুগ্ধ, নেশায় আসক্ত। সে দৃষ্টি যেন তার হৃদয়ে তীরের মতো লাগছে। সভ্য ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে তার দিকে মুগ্ধতা ভরা দৃষ্টিতে চাইলো। তার চুলে হাত বুলালো। এরপর তার দিকে এগিয়ে এলো। তাকে চুমু খাওয়ার জন্য। ইনারাও শক্ত করে মুঠোয় আঁকড়ে ধরে তার স্কার্ফ। চেপে বন্ধ করে রাখে তার চোখ
জোড়া।

দরজা খোলার শব্দে দুইজনে চমকে উঠে। চোখ খুলেই সরে যায় দুইজনে। সভ্য বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বছর, “এই দুনিয়া আমার প্রেমের দুশমন। এমনিতেই আমার বউ দজ্জাল। এর মধ্যে আধ একটু রোমেন্স করার সুযোগ পাই কেউ না কেউ টপকাবেই।”
সে দেখে দরজায় রহমান দাঁড়ানো। সে ক্ষেপে উঠে, “তুমি এখানে কী করছ?”
“আপনাদের মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে?”
“এই তুমি নক করে আসতে পারো না? সবাই কী সভ্যতা, ভদ্রতা ভুলে যাচ্ছে না’কি আজকাল?”
“স্যার..স্যার এখন সভ্যতা, ভদ্রতার সময় নেই। নিজের জান বাঁচান।”
“কোন জায়গায় ভূমিকম্প এসেছে?”
“ভূমিকম্প না, দাদাজান এসেছে।”
কথাটা শুনতে না শুনতেই সভ্যর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। নিজেকে না সামলাতে পেরে বিছানা থেকে ঠাস করে পড়ে যায় সে। এক ঢোক গিলে সে। তার গলার স্বর চিকন হয়ে আসে। সে ভীত গলায় বলে, “কে…কে এসেছে?”
“দাদাজান।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here