অনুভবে (২য় খন্ড) পর্ব ১৫

0
1129

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ১৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ইনারা রহমানকে দেখে প্রথমে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও যখন জানতে পারলো রহমান কিছু দেখে নি তখন শান্তির নিশ্বাস ফেলে। পরক্ষণেই সে শুনে সভ্যের দাদাজান এসেছে। তার মুখের খুশি কে দেখে? তার সাথে দেখা করার অনেক বছরের ইচ্ছা ছিলো ইনারার। যে এত বছর ধরে তার এত সাহায্য করেছে তাকে দেখার খুব শখ ছিলো। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার শখ ছিলো। সে দেখলো দাদাজানের কথা শুনে সভ্য বিছানা থেকে নিচেই পড়ে যায়। কিন্তু সেদিকে ইনারা পাত্তা না দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, “আমি জলদি করে উনার সাথে দেখা করে আসছি।”
ইনারা দ্রুত রহামানের পাশ কাটিয়ে চলে গেল সেখান থেকে।

সভ্য ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ আতঙ্কিত সুরে রহমানকে বলল, “ওকে আটকাও।”
“কেন স্যার? বড় স্যারের সাথে দেখা করার জন্য কত উৎসুক ম্যাডাম দেখুন।”
“আরে গর্দভ ইনারা জানে দাদাজান আমাদের বিয়ে করিয়েছে। আর দাদাজান বিয়ের সম্পর্কে কিছু জানে না। জানলে তোমাকে আমাকে দুইজনেকে ফাঁসিতে চড়াবে।”
“এই কথা তো ভাবি নি।”
বলে রহমান এক দৌড় দিলো ইনারার পিছনে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। ইনারা দাদাজানের সামনে দাঁড়ানো।

সভ্যও দ্রুত উঠে যায় রহমানের পিছনে। ইনারাকে দাদাজানের সামনে দেখে ঘাবড়ে যায়। তবুও সে যেয়ে প্রথমে দাদাজানকে সালাম দিয়ে ইনারার দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বলে, “অনুমতি না নিয়ে এখানে এলে কেন?”
ইনারা সভ্যের কথার ধরণ দেখে অবাক হয়, “অনুমতি নেওয়া লাগবে মানে?”
“মানে নিজের রুমে যাও। না ডাকা পর্যন্ত আসবে না।”
“আমি তো কেবল দাদাজানের সাথে দেখা…”
সভ্য তার কথা কেটে আদেশের সুরে বলে, “ইনারা নিজের রুমে যাও।”

ইনারা সরু দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। দাদাজানের সামনে মারতেও পারবে না সভ্যকে, নাহলে এতক্ষণে হাড্ডি ভেঙে দিতো। সাহস কত বড় তার সাথে জোর গলায় কথা বলছে। সে মৃদু গলায় বলল, “একা দেখা হোক, পরে মজা বুঝাচ্ছি।”
সভ্য তার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ইনারার যাবার পর্যন্ত অপেক্ষা করল। সে যেতে না যেতেই সভ্য দাদাজানের দিকে তাকায়। দাদাজানের দৃষ্টিই যথেষ্ট ভয়ে তার নিশ্বাস বন্ধ করার জন্য। সে এক ঢোক গিলে। দাদাজান তার হাতের লাঠিটা মেঝেতে বারি দিয়ে কাঠ-কাঠ গলায় বলে, “তুমি কি বুঝেছ এক মেয়ের সাথে তুমি আমার বাড়িতে থাকবে অথচ আমি জানব না?”
সভ্য রহমানের দিকে তাকাতেই সে বলে উঠে, “সত্যি আমি কিছু জানাই নাই।”
দাদাজান আবার প্রশ্ন করেন, “ওর দিকে কি তাকাচ্ছ? এই বাড়িতে কি হচ্ছে না হচ্ছে এর খবর অন্য কেউ দিতে পারে না আমাকে? এখন বলো মেয়েটা কে?”

সভ্য একদৌড়ে যেয়ে তার দাদাজানের পা’য়ের কাছে যেয়ে বসে। ভীতিকর ও অস্থির গলায় বলে, “দাদাজান…দাদাজান ক্ষমা করে দেন আপনাকে না জানিয়ে আমি বিয়ে করে ফেলছি। আমি জানি আমার এটা করা উচিত হয় নি। কিন্তু কিছু করার ছিলো না। ক্ষমা করে দেন দাদাজান। আর ভুল হবে না দাদাজান। সরি…সরি…”
দাদাজান সভ্যের কাঁধে হাত রাখতেই সে ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।
দাদাজান বলেন, “সাব্বাশ এই না হলে আমার নাতি।”

সভ্য চোখ খুলে প্রথমে অবাক হয়ে দাদাজানের দিকে তাকায়। সে ভাবে নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছে সে। নিজের হাতে চিমটি কেটে ব্যাথায় লাফিয়ে উঠে। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দাদাজানের দিকে। তার চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। যেন ভীষণ অবাক করা কিছু দেখে নিয়েছে সে। সে আমতা-আমতা করে জিজ্ঞেস করে, “আপনি রাগ হন নি?”
“রাগ হবো কেন? জীবনে প্রথম কোনো প্রশংসনীয় কাজ করলি?”
“কী প্রশংসনীয় কাজ করলাম?”
“প্রেম করে বিয়ে করলি।”
“এটা প্রশংসনীয়?”
“তো কী? তুই প্রমাণ করে দিলি তুই আসলে আমার মতোই। যুদ্ধের আগে তো তোর দাদীজানকে নিয়ে পালিয়ে যেয়ে বিয়ে করেছিলাম আমি। সে কী অবস্থা! কিন্তু রোমাঞ্চকরও ছিলো বটে। আমার বাবাও তো প্রেম করে মা’কে বিয়ে করেছিলেন। আর অন্যদিকে তোর বাপ, ছাগল একটা। একটা প্রেমও করতে পারে নাই, ধ্যুর! তোর ভাই তো আরও এগিয়ে। বিয়ের কথা বললে যেভাবে কাজের বাহানায় বিয়ের কথা এড়িয়ে যায় মনে হয় তার থেকে বেশি কাজ আর কেউ করে না। তুই আমার দিল খুশি করে দিলি।”
সভ্য জোরপূর্বক হাসে। সারাজীবন সে পড়াশোনায় প্রথম হতো, খেলাধুলাতেও। দেশের সবচেয়ে বড় ব্যান্ড তার ছিলো। তার গানের প্রশংসা পৃথিবী জুড়ে। কিন্তু আজ সে প্রথম তার দাদাজানের কাছে সাব্বাশি পাচ্ছে তাও প্রেম করে বিয়ে করায়।

দাদাজান পরক্ষণেই ধমক দিয়ে বললেন, “কিন্তু তোর সাহস তো কম নয়, আমার সামনে আমার নাতবৌকে তুই ধমক দিয়েছিস! আমাদের ঘরে নারীদের সাথে উঁচু আওয়াজে কথা বলার শাস্তি তুই জানিস না?”
সভ্য বিড়বিড় করে বলল, “আপনার নাতবৌ একটুপর আমার জীবন হারাম করে দিবে।”
“এখন কী বলছিস তুই? আমি কি বলেছি তার উওর দে।” দাদাজানের কঠিন কথার ধরণে ছোটবেলা থেকেই ভয় পায় সভ্য। তার কথা শুনলেই বুকের ভেতর কেঁপে উঠে।
সভ্য সোফায় বসে আমতা-আমতা করে বছর, “আসলে দাদাজান আমি চাই নি ওর সাথে আপনার কথা হোক।”
“কেন?”
“আপনাকে একটা ব্যাপার জানানোর আছে। দয়া করে রাগ করবেন না।”

সভ্য দাদাজানকে ইনারার অতীতের সব ঘটনা বলে। সাথে এটাও জানায় যে দাদাজানের নাম নিয়ে সে ইনারাকে সাহায্য ও বিয়ে করেছে । সবটা শুনে দাদাজান গম্ভীর গলায় বলে, “সব ঠিক আছে। ওর সাহায্য করে ভালো কাজও করেছিস তুই। আমি খুশি হয়েছি। আমার নাম এসবে আছে তাও আমার সমস্যা নেই। কিন্তু যেখানে ও তোকে ভালোবাসে না সেখানে তুই ওর অসহায়তার লাভ উঠিয়ে বিয়ে করেছিস এটা মানতে পারলাম না।”
“কিন্তু দাদাজান ওকে দূরে রাখলে যদি ও কোনো সমস্যায় পরে তখন কী করব আমি? কীভাবে জানবো আর কীভাবে ওকে প্রটেক্ট করব?”
“তাও ঠিক। আবার ওই যে বেয়াদ্দব ছেলেকে ভালোবাসে সেও তো ভালো না। তাহলে ঠিক আছে। মানুষ এত খারাপ! এত মিষ্টি মেয়ের সাথে এত খারাপ করতে পারলো! তুই আমাকে বললেই তো সবাইকে মুহূর্তের মাঝে জেলে ভরতাম।”
“না, দাদাজান। ইনারার লড়াই ও নিজে লড়বে। তাহলেই শান্তি পাবে ও।”
“তাও ঠিক। এই শুন, জলদি নাতবৌ যেন তোকে ভালোবাসা শুরু করে। আমাদের পরিবারে আজ পর্যন্ত তালাক হয় নি। আগেও হবে না। কিন্তু ওকে জোর করে নিজের সাথে রাখবি তাও আমি চাই না।”
“জ্বি দাদাজান। আশা করি এমনই হবে।”
“এখন আমার নাতবৌকে ডেকে আন, যা।”
“আমি?”
“তুই নয়তো কে?”
সভ্য জোরপূর্বক হাসে, “ওটাই আমি নয়তো কে?”

সভ্য নিজের জন্য শুভকামনা করতে করতে গেল ইনারার রুমে। দরজা খুলে দেখে ইনারা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। সে বল, “ইনারা শুনো।”
ইনারা চোখ তুলে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো সভ্যের দিকে। সভ্য নিজের জানের দোয়া করে এগিয়ে গেল তার দিকে, “দাদাজান তোমাকে ডেকেছে।”
ইনারা তার পাশের বালিশ একের পর এক ছুঁড়ে মারে সভ্যের দিকে, “আপনিই জান দাদাজানের কাছে। জাহান্নামে যান। আমি এই রুম থেকেই আর বের হবো না।”
“ইনারা প্লিজ রাগ করো না।”
“না রাগ করব না। আপনাকে আদর করব তো। আমাকে এমন বকাঝকা করে এসেছন কাহিনী করতে?”
“আরে আমার কথা তো শুনো। এভাবে হুটহাট করে দাদাজানের সামনে গেলে কি ভাববে বলো? ভাববে কি মেয়ে না ডাকাতেই সামনে এসে পড়লো।”
ইনারা থেমে যায়। বলে, “ভুল তো বলেন নি। ঠিকাছে যান মাফ করলাম।”
“আচ্ছা তুমি একটু চেঞ্জ করে আসো। যেহেতু দাদাজানের সাথে প্রথম দেখা করবে ওয়েস্টার্ন ড্রেস বিশেষ মানায় না। দাদাজান কিছু মনে করবে না তাও।”
“আমি এক্ষুনি চেঞ্জ করে আসছি।”
ইনারা দৌড়ে আলমিরা থেকে একটা আনারকলি নিয়ে ওয়াশরুমে গেল।

সভ্য তার বুকে হাত রেখে শান্তির নিশ্বাস ফালায়, “আজ দুই দুইবার বাঘের মুখ থেকে বেঁচে আসলাম।”
ইনারার আসতে আসতে সভ্য রুম পরিষ্কার করে নেয়।
ইনারা আসে একটি আকাশী রঙের আনারকলি পরে। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটি টিপ কপালে দিলো এবং চোখে কাজল পরতে পরতে বলল, “এখন ঠিক আছে?”
সভ্য পিছনে তাকায়। ইনারাকে আয়নাতে দেখে মোহিত হয় সে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। অপলক তাকিয়েই রয়।
ইনারা আবারও জিজ্ঞেস করে, “বললেন না তো ঠিক আছে কী?”
সভ্য এগিয়ে যেয়ে ইনারার পিছনে দাঁড়ায়।
ইনারা কানেরদুল পরে গলায় একটি মুক্তোর মালা পরতে নেয়। সভ্য সে মালাটি তার হাত থেকে নেয়। ইনারার চুলগুলো কাঁধের একপাশ থেকে সরিয়ে সে মুক্তোর মালাটি ইনারার গলাতে পরায় এবং আয়নাতে ইনারার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কালো মেঘের পরী কৃষ্ণকলির গল্প চারধারে,
পরন্তু আমার মন কেবল এক আসমানীর জন্য মরে।”

ইনারা আয়নার দিকেই মুখ বানিয়ে বলল, “কোন গল্পের কোন আসমানী? আর কোন কৃষ্ণকলি? দেখুন এসব কবিতা টবিতা আমি ভালো বুঝি না। নরমালি বলুন তো।”
সভ্য হাসে। মুহূর্তে ইনারার পেটে দুইহাত আবদ্ধ করে তার পিঠ নিজের বুকের সাথে মেশায়। তার কাঁধে মাথা রেখে বলে, “মানে তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।”

ইনারা শিউরে ওঠে। সভ্য হঠাৎ এমন কিছু করবে সে ভাবে নি। সে ঘাবড়ে যায়, “করছেনটা কি? আবার কেউ এসে পড়বে।”
“আসুক।”
“আপনাকে বলেছি আমার কাছে আসবেন না।”
সভ্য চোখ বন্ধ করে ইনারার কাঁধে নিজের নাক বুলায়। তারপর আলতো করে চুমু খেয়ে বলে, “তাই?”
ইনারা চোখ দুটো চেপে বন্ধ করে নেয়। সভ্যের ছোঁয়া পেতেই সে শিউরে ওঠে। তার নিশ্বাস বেগতিক হয়ে যায়। সে সভ্যের হাতের উপর হাত রেখে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তা। সভ্য আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তাকে। নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।

দরজায় টোকা পরে। রহমানের গলার শব্দ ভেসে উঠে দরজার ওপাশ থেকে, “সভ্য স্যার, বড় স্যার আপনাদের ডাকছে। জলদি আসতে বলল।”

সভ্যের হুঁশ ফিরে। ইনারার মুগ্ধতা থেকে নিজেকে বের করে তাকে ছেড়ে দূরে সরে বলে, “দেখলে তো তোমার জন্য দাদাজানের আমাদের ডাকতে হলো। বলো তো কি ভাববে সে?”
“আমার জন্য!”
“আচ্ছা থাক থাক মাফ চাওয়া লাগবে না। জলদি আসো।”
সভ্য দরজা পর্যন্ত যেয়ে আবার কি মনে করে দৌড়ে আসে। ইনারার ওড়না চেয়ার থেকে নিয়ে তার মাথায় দিয়ে বলে, “এইত্তো এখন আমার বউ লাগছে।”
বলে ইনারার গালে চুমু খেয়ে এক দৌড়ে পালাল।
ইনারা নিজের গালে হাত রেখে লজ্জামাখা কন্ঠে বলে, “আসলেই লোকটা অসভ্য।”
.
.
ইনারা বসে আছে দাদাজানের সামনে। সভ্য ও রহমানের মুখের থেকে সে শুনেছে দাদাজান অনেক রাগী। তাই সে একদম চুপচাপ। তার চোখ নিচু। ভয়ে সে আঙুল নিয়ে খেলছে। সভ্য তা খেয়াল করে। সে ইনারার হাত ধরে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, “ভয় পেও না। দাদাজান মেয়েদের সাথে রাগী গলায় কথা বলে না। বিশেষ করে ঘরের মেয়ে ও বউদের সাথে।”

দাদাজান ভারী গলাতেই বলে, “এই প্রথম তোমার সাথে আমার দেখা হচ্ছে। সামনা-সামনি দেখে ভালো লাগলো।”
“আমারও আপনার সাথে দেখা করার অনেক ইচ্ছা ছিলো। আপনি আমার জন্য যা করেছেন তার কৃতজ্ঞতা আমি কখনো শোধ করতে পারব না।”
“জানো তো ছেলে মেয়ে থেকে নাতি নাতনির প্রতি আদর বেশি থাকে। তুমি আমার নাতবৌ হও। মানে আমার নাতির থেকেও বেশি আদরের। এদিকে আসো, আমার পাশে বসো।”
সভ্যও ইশারায় বলে তাকে যেতে। ইনারা তাই করে। পাশে যেয়ে বসতেই দাদাজান হেসে তার মাথায় হাত রেখে বলেন, “আমার নাতির ভাগ্য খুলে গেছে। কী মিষ্টি মেয়ে! সবসময় খুশি থাকো। সব স্বপ্ন পূরণ হোক তোমার।”
ইনারা চেয়েও তার চোখ জোড়া ভেজা থেকে আটকাতে পারলো না। দাদাজান ঘাবড়ে গেলেন, “আরে নাতবৌ তুমি কাঁদছ কেন? আমি ভুল কিছু বললাম?”

ইনারা ভেজা চোখ নিয়েই হাসিমুখে তাকায় দাদাজানের দিকে। কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে, “জানি না। তবে মনে হলো আপন কারও হাত মাথায় আছে। এভাবে আগে কেউ মাথায় হাত রেখে দোয়া করে নি আমার জন্য।”
“আমি জানি তোমার পরিবারের কথা। কাঁদে না নাতবৌ। এখন আমি তো আছি। সভ্যের সম্পূর্ণ পরিবার এখন তোমার। আর সভ্যের আগে আমি তোমার দাদাজান বুঝেছ?”
ইনারার হাসি আরও গাঢ় হয়। সে তার চোখ মুছে দ্রুত মাথা নাড়ায়। দাদাজান ইনারাকে তার পকেটে ঝুলানো স্বর্ণের ঘড়ি দিয়ে বলে, “এটা তোমার জন্য। আমাদের বংশে ঘরের বউয়ের সাথে প্রথম দেখা হলে তাকে স্বর্ণ দেওয়া লাগে। তোমার সাথে দেখা হবে জানলে তোমার জন্যই কিছু আনতাম। কিন্তু আপাতত এটা রাখো।”
“না দাদাজান এটা আমি কীভাবে… ”
“বলেছি না রাখো। আর শুনলাম তুমি না’কি নায়িকা সাইয়ারার মেয়ে? তিনি আমার সবচেয়ে পছন্দের অভিনেত্রী ছিলেন। তোমাকে প্রথম দেখেই তার কথা মনে পড়লো। তোমার চোখ ছাড়া প্রায় সবই তার মতো দেখতে।”
“সত্যি দাদাজান মা আপনার পছন্দের নায়িকা ছিলো?”
“একদম। আর আমি জানি তুমিও হবে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক নাম কামাবে তুমি।”
দাদাজানের কথা বলতে বলতে নজর গেল সভ্যের উপর। সে তাকিয়ে আছে তাদের দুইজনের দিকে। তা দেখে দাদাজান বললেন, “তুই তাকিয়ে কী দেখছিস? যেয়ে আমাদের জন্য একটু পায়েশ বানিয়ে নিয়ে আয়। প্রথম আমার নাতবৌকে দেখছি মিষ্টি কিছু খাব না?”
“বাহিরের থেকেই আনাব দাদাজান?”
“কেন বাহির থেকে আনাবা? নিজে বানিয়ে আনো, যাও।”
ধমক শুনে সভ্য দ্রুত উঠে দাঁড়ায়।

দাদাজান ইনারাকে বলে, “শুনো নাতবৌ, তোমার যা মন চায় ওকে দিয়ে রান্না করাবা। আমার ছেলে, নাতি সবাইকে সকল ধরনের কাজ শিখানো হয়েছে। ওদের তো প্রফেশনাল সেফ দিয়ে রান্নার ক্লাস করিয়েছিলাম। আরাম করবে আর ওকে হুকুম দিবে।”
“আরে দাদাজান বলেন না যে জ্বালায় আমাকে। সারাক্ষণ বকা দেয়।”
“সাহস কত বড় ওর? আমার নাতবৌকে বকা দেয়? ওর খবর আছে আজ। রান্না শেষ করে আসুক। আসল মজা বুঝাব। আর তুমিও ওকে টাইটে রাখবে বুঝলে? স্বামীদের টাইটে না রাখলে হাত থেকে ছুটে যায়।”
সভ্য যাবার সময় কথাটা শুনে পিছনে তাকায়। দুইজনের এমন খাতির দেখে সে বিরক্ত হয়ে বলে, “বাহ দুইজনে কি কারসাজি করছে। একদম হিন্দি বৌ-শাশুড়ির সিরিয়ালের মতো প্লানিং প্লটিং। যাক, আমারও সময় আসবে। একবার দাদীজানের সামনে গেলে দেখব কার কত সাহস।”
বলে সে রাগে হনহনিয়ে গেল রান্নাঘরে। পায়েশ বানাতে।
.
.
সকলে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। ইনারা দাদাজানের পাশে বসে বলছিল, “দাদাজান জানেন আপনার নাতি আমাকে এসেই প্রথমদিন যা বকা দিয়েছিল। আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম।”
সভ্য এবার তাকাল ইনারার দিকে। সে কখন থেকে দাদাজানের সামনে তার খারাপদিক গুলো বলে তাকে বকা খাওয়েই যাচ্ছে। আর থামছে না। সে এবার বিরক্ত হয়ে বলল, “তুমি বকা খাওয়ার কাজ করলে বকব না?”

তখনই দাদাজানের ধমক এলো, “এই আমার নাতবৌকে আমার সামনে ধমকাচ্ছিস তুই সাহস তো কম না।”
ইনারা আরও উসকানি দেয় তাকে, “দাদাজান এখন তো কিছু না। আগে তার বাসায় গেল সোফার বালিশ একটু এদিক ওদিক হলে যা বকা দিতো। আর আমাকে তো কতদিন এত কাজ করিয়েছে যে আমি অসুস্থ হয়ে গেছি।”
“মিথ্যুক! তুমি কোনো অসুস্থ হও নি।” সভ্য প্রতিবাদী সুরে বলল।
দাদাজান আবার উঁচু স্বরে বলে উঠে, “এই কন্ঠ নিচে। আমার নাতবৌ মিথ্যা কেন বলবে? তোর সাহস তো কম না ওকে দিয়ে এত কাজ করিয়েছিস। কাল অফিসে গেলে বুঝাব তোকে কাজ কি হয়।”
সভ্য রাগে কটমট ইনারার দিকে তাকাল
আর ইনারা টেবিলের অপরপাশে বসে নিঃশব্দে হাসছিলো। আর সভ্যকে ভেঙাচ্ছিল। সে হেসে মুখে পোলাওর লোকমা তুলতেই দাদাজানকে বলতে শুনে, “শুন আজ তোর রুমে আমি ঘুমাব। অন্যরুমে ঝি ঝি পোকার শব্দে ঘুম আসে না। তুই আর নাতবৌ আজ পশ্চিম দিকের রুমে ঘুমাস।”
সাথে সাথে ইনারার কাশি চলে এলো। তার খাবার গলায় আটকে যায়। সে তার হাতের কাছের গ্লাসটি নিয়ে এক নিশ্বাসে পানি পান করে অবাক হয়ে দাদাজানকে জিজ্ঞেস করে, “আমরা একসাথে ওরুমে ঘুমাব?”
“এটাতে অবাক হবার কী আছে নাতবৌ? এমন ভাবে বলছ যেন তোমরা আলাদা রুমে ঘুমাও।”
ইনারা জোরপূর্বক হাসে, “না মানে আমি বলছিলাম আপনার নাতির সাথে এতদিন পর দেখা হলো, আপনি চাইলে আজ যদি উনার সাথে…”
“না না নাতবৌ, প্রয়োজন নেই। আমি একাই ওরুমে ঘুমাব।”
“আচ্ছা।”
ইনারা মন মেরে বলল। ভয়ে সে মুখে আর লোকমা তুললো না। আজ সভ্যকে যে হারে বকা খাওয়াল, তার খবর আছে আজ। এর উপর আজকাল যা রোমেন্স শুরু করল লোকটা। মনে হয় আসলেই বিয়ে করে এনেছে।

সাথ সাথে সে নিজের ফোনে সভ্যের মেসেজ পেল, “আজ তোমার রেহাই নেই।”
ইনারা ঢোক গিলে। ভয়ে ভয়ে তাকায় সভ্যের দিকে। সভ্যের চোখ সরু ও ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি হাসি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here