অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ১৮
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“তুমি বলেছিলে না আমি তোমার স্বামী। তোমার কাছে আসার, তোমার নয়ন সায়রে ডোবার, তোমায় ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার কেবল আমার আছে। অন্যকোনো পুরুষ তোমায় ছুঁলে আমার সহ্য হয় না।”
সভ্যের কথায় ইনারা চোখ নামিয়ে নেয়। তার নিয়ন্ত্রিত হওয়া পছন্দ না। তার জীবনের সিদ্ধান্ত কেবল সে নিজে নিতে পারবে। কিন্তু সভ্যের তাকে আয়ত্ত করাটা কেন যেন ভালো লাগে তার। সে মৃদু হাসে। কিন্তু তার এই খুশিটা প্রকাশ করে না। সভ্যকে উল্টো বলে,
“এখন আপনি তো আমার হাতে এই মলম লাগিয়ে দিলেন। খাব কীভাবে?”
“তুমি এখনো খাও নি?”
“সন্ধ্যা থেকেই তো কেক বানাচ্ছি। খাব কীভাবে? খিদে লেগেছে।”
সভ্য হেসে উঠে যায়। ডাইনিং রুম থেকে খাবার এনে খাইয়ে দেয় ইনারাকে। খাওয়ানোর সময়ই সভ্য বলে, “সরি। আমারও তোমার সাথে এভাবে ব্যবহার করা উচিত হয় নি।”
“একদম ঠিক বলেছেন। কিন্তু সরি বললে তো হবে না। ঘরের যা ময়লা হয়েছে সব আপনার পরিষ্কার করতে হবে।”
আদেশ দেয় ইনারা।
সভ্য ভ্রু কপালে তুলে অবাক হয়ে বলে,
“ভালোই তো, আমাকে সরি বলাতেই আমি মেনে গেছি। আর তোমার থেকে সরি মঞ্জুর করানোর জন্য আমার এই যুদ্ধের ময়দান পরিষ্কার করতে হবে?”
“মেয়েদের মানানো এত সহজ না বুঝলেন জনাব?”
সভ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “বুঝলাম। তোমাকে খাইয়ে কাজ শুরু করে দিচ্ছি।”
.
.
জোহানকে নিয়ে কথাগুলো বলার পর সভ্য আর ইনারার উপর প্রশ্ন উঠায় না। কিন্তু ইনারা চায় যেন সভ্যের মনে কোনো রকমের প্রশ্ন না উঠুক তার এবং জোহানকে নিয়ে। একারণে জোহানের বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ জোগাড় করতে বলে সে রহমানকে। আইজার সাথে তাকেও শিক্ষা দিবে সে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সে এমন কিছুই পায় না। গত সাড়ে তিনবছর ধরে তার কোনো খারাপ রেকর্ডই পাওয়া যায় না। এমনকি আইজা ছাড়া অন্যকোনো মেয়ের সাথে তার নামও জড়িত হয় নি। ইনারা বিরক্ত হয় প্রচুর। আইজাকে আসলেই ভালোবেসে সব ছেড়ে দিলো না’কি জোহান?
এর মধ্যে ইনারার শুটিং এর তারিখ এসে পড়ে। তাকে এক বছরের কন্টেক্ট-এ সাধারণ একটা কোম্পানির আন্ডারে নেওয়া হয়। যেন ভবিষ্যতে সে বড় কোনো কোম্পানিতেও যেতে পারে এই ব্যবস্থা করে দেয় সভ্য। জুলি নামের এক মেয়ে তার এসিস্ট্যান্ট হিসেবে জয়েনও করে। মেয়েটিকে সাধাসিধা মনে হয়। গোল চেহেরা। চোখেও গোল গোল চশমা পড়ে সে।
শুটিং এর প্রথম দিনেই মেজাজ খারাপ হয় তার। একই সেটে সকালে প্রথম সিন স্যুট করিয়ে তার পরের সিন শেষ সন্ধ্যায় স্যুট করায়। তাকে কয়েক ঘন্টা অকারণে বসিয়ে রাখা হয়। যেখানে একসাথেই দুইটা সিন শেষ করে তাকে ছুটি দিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু এসব তাঁকে জ্বালানোর জন্য করা হচ্ছে তা ভালোভাবে বুঝতে পারছে সে। এখন আর তার ধৈর্য আগের মতো কম না। বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নেবার মানুষ সে। আজকের দিনটাই খারাপ। রহমান বলেছিল অমৃতার খোঁজ পেয়েছে সে। অথচ যেয়ে দেখে সে অমৃতা অন্য কেউ। ইনারার এই খবরটাতেও বিরক্ত লাগে।
শুটিং শেষে জোহান তার রুমে আসে। ইনারার চেঞ্জ করে বের হবার কথা তখন। কিন্তু জোহান এসে বাঁধা দিলো। রুমের অন্যসবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনারা সকলে একটু কষ্ট করে বাহিরে যান। আমার মিস ইনারার সাথে কথা আছে।”
ইনারা বলল, “আপনি তো এভাবে আমার রুমে এসে চাইলেই কথা বলতে পারেন না। কেউ কোথাও যাবে না।”
তার মানা করা সত্ত্বেও সকলে জোহানের কথানুযায়ী বাহিরে চলে গেল।
জোহান হেসে বলে,
“এখনো তুমি আমার সামনে কেউ না। তোমার আন্ডারে কাজ করা লোকেরাও আমার কথা মানে। লজ্জাজনক ব্যাপার তাই না?”
“আমি আপনাকে পাত্তা না দেওয়ায় আপনি নিজে আমার সাথে কথা বলতে এসেছেন, এটা লজ্জাজনক নয়? যাই হোক, আপনার সাথে তর্কাতর্কি করার মতো আমার কোনো ইচ্ছা নেই।”
“তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”
“আপনার কথা শুনারো আমার কোনো ইচ্ছা নেই।”
ইনারা জোহানের পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই সে শুনে, “তোমার আসল বাবাকে নিয়ে কথা বললেও তোমার ইচ্ছা হবে না?”
ইনারার পা সেখানেই থেমে যায়। সে স্তব্ধ হয়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য তার নিশ্বাস আটকে এলো। তার নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না।
সে পা পিছিয়ে নিলো। পিছনে ফিরে তাকাল জোহানের দিকে।
জোহান বলল, “বসে কথা বলি আসো।”
ইনারা ও জোহান সামনা-সামনি চেয়ারে বসে। জোহান সোজাসাপটা কথা বলে,
“আমি চাই তুমি এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দেও। আর আমি তোমাকে তোমার বাবার পরিচয় দিব।”
“আর আপনি কেন চান আমি এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দেই? আপনার কী মনে হয় আমি এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে চলে গেলে আপনাদের কিছু করতে পারব না?”
“আমি কেবল চাই তুমি সকলের সামনে না আসো। আর তুমি ফেরত-ই বা এলে কেন? আগে যেমন লুকিয়ে ছিলে তেমনি….”
ইনারা তার কথা কেটে বলল,
“গুনাহ আপনারা করেছেন, আমি না। আমি কেন লুকিয়ে থাকব? আপনাদের পাপের শাস্তি আপনাদের দিয়েই ছাড়বো।”
“এত আত্নবিশ্বাস ভালো না। তিনবছর আগে কি হয়েছিলো মনে আছে?”
“ভালো মতো আছে। আর কারা করেছিলো তাও মনে আছে। আর আমার শেষ কথাগুলো প্রতি শব্দে শব্দে মনে আছে। সম্ভবত আপনারা ভুলে গেছেন। তা মনে করাতেই এলাম।”
“আবার তোমার সব হারাতে হতে পারে।”
“হারানোর মতো কি রেখেছেন শুনি?”
“ইনারা জেদ করো না। এককালে তুমি আমার কাছের কেউ ছিলে একারণে ওয়ার্নিং…”
ইনারা তার কথা কেটে বলে,
“ওহ প্লিজ, এসব ঢঙ আমার সামনে করবেন না। আপনার অন্যান্য গার্লফ্রেন্ডের সামনে করুন। তারা আপনার কথায় নেচে বেড়াবে। আমিও ভাবি আমার ছোট বেলায় টেস্ট এত খারাপ ছিলো কিভাবে? যাক বড় হবার সাথে সাথে আমার ছেলেদের মধ্যে টেস্টও ভালো হয়ে গেছে।”
জোহানকে বিরক্ত দেখায়। সে সরু দৃষ্টিতে ইনারার দিকে তাকিয়ে বলে, “এজন্য সভ্যকে পছন্দ করেছ তুমি?”
ইনারা চোখজোড়া বড় করে তাকায় জোহানের দিকে, “আপনি জানতেন? তাও আমার সাথে বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন?”
জোহান নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে, “তুমি যদি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে আগের মতো হারিয়ে যাও তাহলে আমি তোমার বাবার পরিচয় জানাব। এই শর্তে রাজি তুমি?”
“আমার আপনার সাহায্যের কোনো প্রয়োজন নেই। আমি নিজের সব লক্ষ্যে নিজে পৌঁছাতে জানি। এখন আসি, আর আমাকে ডিস্টার্ব করার চেষ্টা করবেন না।”
ইনারা উঠে চলে যেতে নেয়। দরজার কাছে যেতেই জোহান বলে, “তোমার মনে হয় এসব করে তুমি খুশি থাকতে পারবে?”
“মানে আপনাদের জীবন বরবাদ করে? হেল ইয়েস। নিজের সুখের দিনের উল্টো গণনা করা শুরু করে দেন।”
ইনারা বাঁকা হাসি দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।
বের হতেই জুলি তার পিছু পিছু আসে। ইনারার সাথে গাড়িতে উঠতে নেবার পূর্বেই তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়। ইনারা বলে, “অফিসের রাস্তা কী চিনো তুমি?”
জুলি জানালা দিয়ে ঝুঁকে ইনারার দিকে তাকিয়ে উওর দেয়, “জ্বি ম্যাম, চিনি।”
“গুড। আগামীকালকের মধ্যে নিজের ইস্থফা দিয়ে যাবে।”
“ম্যাম আমি কী করেছি যে হঠাৎ আপনি….”
“নিজের পুরনো বসের কথা মানা অভ্যাসটা সম্ভবত যায় নি তাই না? তুমি কি ভেবেছ আমি জানি না তুমি আগে জোহানের জন্য কাজ করতে? এসব ঢঙ বন্ধ করো।”
জুলির ভাব ভঙ্গি হঠাৎ করেই পরিবর্তন হয়ে যায়। সে নিজের চশমা খুলে জানালার ওপাড় থেকে বিরক্ত হয়ে তাকায় ইনারার দিকে,
“যখন জানতেই তখন কেন তোমার আর আমার দুইজনের সময় নষ্ট করলে বলো তো?”
“দুইটা কারণ। ম্যানেজার হিসেবে খুব ভালো তুমি। জোহানের গত তিনবছরের সকল ঝামেলা এভাবে পরিষ্কার করলে তুমি যে আমি একটা কিছুও খুঁজে পাইনি। ইনফ্যাক্ট তিন বছরেই সোশ্যাল মিডিয়াতে ওর পপুলারিটি নাকি দ্বিগুণ করে দিয়েছ। তাই নিয়েছিলাম। দ্বিতীয় তোমার দ্বারা জোহানকেই মিডিয়াতে আবার বদনাম করতে চেয়েছি।”
“তাহলে এখন কেন বের করছ?”
“কারণ তোমাকে জোহানই আমার কাছে পাঠিয়েছে এই সন্দেহ থাকলেও আজ কনফার্ম হলাম। আমি তোমার বস অথচ জোহানের একবার বলায় তুমি রুম থেকে বেরিয়ে গেলে। এর মানে তুমি ওর জন্যই কাজ করছ।”
“ওয়াও, আমার ভাবনা থেকেও তোমার বুদ্ধি বেশি। আই এম ইম্প্রেশড। যদি এবার আসলে তোমার জন্য কাজ করতে চাই তাহলে?”
“তাহলে আমার দ্বিতীয় কারণটা আগে সত্যি করে তখন এসো। আমি আবার কাজ ছাড়া কারো উপর টাকা খরচ করি না। আপাতত আমি যাই, আমার দেরি হচ্ছে।”
ইনারা ড্রাইভারকে আবার বলে, “ড্রাইভার গাড়িটা চালু করেন।”
ইনারার গাড়ি দ্রুত যেতেই জুলি এক পা পিছিয়ে যায়। বিরক্তি নিয়ে কিছু সময় ভাবে। ইনারা যদি তাকে কাজ থেকে বের করে দেয় তাহলে জোহানও রেগে আর তাকে চাকরিতে রাখবে না৷ জোহানের কাছ থেকে যত বড় অঙ্কের টাকা সে পায় তা অন্যকারো থেকে পাওয়াটা কঠিন হবে। ভালোই ফাঁসলো সে। না এদিকের রইল, না ওদিকের।
.
.
সুরভি ভার্সিটি থেকে বের হয়ে দেখে গেইটের সামনে আহনাফ দাঁড়ানো। সিগারেট খাচ্ছে সে। হঠাৎ তাকে এখানে দেখে অবাক হয় সে। তার কাছে যেয়েই প্রথমে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি যে সিগারেট খান তা কী আংকেল জানে?”
সুরভীকে দেখে চমকে উঠে আহনাফ। সাথে সাথে নিজের হাতের সিগারেট ফেলে বলে, “তুমি এখানে!”
“আমার ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে আমাকেই জিজ্ঞেস করছেন?”
“তুমি এখানে পড়ো?”
“ক’দিন আগেই তো বলেছিলাম। ভুলে গেছেন? আর আমার সাথে দেখা করতে না আসলে এখানে কী করেন আপনি?”
আহনাফ জোরপূর্বক হাসে। আমতা-আমতা করে বলে,
“বিশেষ কিছু না। এমনিতেই এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। সিগারেট খেতে দাঁড়ালাম।”
“লজ্জাও লাগে না বলতে তাই না? আজকের পর থেকে সিগারেটকে হাতও দিবেন না।”
“আর দিলে কি করবে তুমি শুনি?”
“আংকেলকে বলে দিব।”
“এখানের কথা ওখানে করা বাজে স্বভাব জানো না?”
“আর সিগারেট খাওয়া তো কত মহান কাজ। স্বভাব না ছাড়লে সোজা আংকেলকে বিচার দিব।”
বলে সুরভি হাঁটতে শুরু করে। আহনাফও তার পিছু নেয়, “তুমি আসলে আব্বাকে বলবে না, তাই না?”
“একশোবার বলবো। আমি নিজের কথা থেকে ফিরে যাই না।”
আহনাফ মাঝরাস্তাতেই তার হাত ধরে নেয়, “আব্বা আমাকে খুন করবে। প্লিজ বলো না।”
সুরভি মুখ চেপে হাসে, “আসলে বাপ তো বাপই। পাঁচ ফিট দশ ইঞ্চি হয়েও বাবার নাম শুনে কিভাবে ভয়ে কুঁকড়ে গেলেন?”
“তুমি আমার মজা নিচ্ছো?”
“আবার জিগায়।”
“অনেক খারাপ তুমি।” আহনাফ নিজেও হেসে বলে। এমন সময় তার নজর পড়ে দরজা থেকে বের হওয়া একটি মেয়ের উপর। হঠাৎ-ই তার হাসি মলিন হয়ে যায়।
হঠাৎ করেই তার এমন মলিন মুখ দেখে সুরভি অবাক হয়ে পিছনে তাকায়। একটি মেয়েকে দেখে। মেয়েটি তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আবার তাদের হাতের দিকে তাকাল, আর চলে গেল।
মুহূর্তও লাগলো না আহনাফের তার হাত ছাড়তে।
.
.
রাতে ইনারার ঘুম আসছে না। সে বারবার এদিক-ওদিক করছে। আজকের জোহানের কথা কেবল কানে বাজছে তার। সে কী স্বার্থপরের মতো কাজ করেছে তার বাবার পরিবর্তে তার প্রতিশোধ এবং তার স্বপ্ন বাছাই করে?
ইনারা উঠে বসে তার বালিশ বুকে চেপে ধরে। এমন ঘুমহীন রাত আগেও এসেছে তার জীবনে। সেরাতগুলো ছিলো তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক রাত। এতকিছু একসাথে হারানোর পর সে কীভাবে সুস্থ থাকতে পারতো? প্রতিরাত তার চোখের সামনে প্রিয়’র মৃতদেহ ভাসতো, কানে ভাসতো আইজার কথাগুলো এবং মস্তিষ্কে বারবার ঘুরতো কেবল এতবছর তার মিথ্যা জীবনীর গল্প। তার ঘর, বাবা, ফুপি, বোন সব মিথ্যা। তার জীবনটাই মিথ্যা লাগছিলো। বারবার তার নিজের মা ও প্রিয়’র কাছে যেতে ইচ্ছা করতো। সে কয়েকবার আত্নহত্যা করার চিন্তাও করেছিলো। ব্লেডটা দিয়ে তার হাত কেটে, বিষ খেয়ে, এমনকি উঁচু মঞ্জিল থেকে লাফ দিয়েও। মরে গেলেই তো সকল কষ্ট শেষ, তাই না? আর তার এমন কোনো পিছুটান নেই যার জন্য বাঁচতো। সুরভির নিজের পরিবার ছিলো যারা তাকে সামলাতো। খালাজানের ছেলে আছে। আর সভ্য তো নিজেই তাকে ছেড়ে গিয়েছিল। তার আসল বাবার খবর তো সে কখনোই জানে নি। তাহলে কার জন্য বাঁচতো? এই দুঃখ সহ নিজের জীবন রাখাটা কী সঠিক না বেঠিক? তবুও প্রতিবার নিজের জীবন নিতে যেয়ে তাদের জন্যই দুর্বল হয়ে পড়তো সে। পরক্ষণেই আবার এইসব খেয়াল মাথায় আসতো, আবার সে সুসাইড করতে যেত। কিন্তু শেষ বার যখন সে এক উঁচু মঞ্জিলের ছাদে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাল। তখন সবকিছু পিঁপড়ার মতো ছোট ছোট লাগলো। একখান থেকে লাফ দেবার কিছু মুহূর্ত পর সব শেষ। তার জীবন, তার কষ্ট, সব। তাহলে লাফ দিচ্ছে না কেন সে? মুহূর্তে তার চোখের সামনে খালাজান, সুরভি ও সভ্যের ছবি ভেসে উঠে। কিন্তু তবুও সে নিজেকে বুঝায়। সে চলে গেলে সকলে হয়তো কয়দিন কাঁদবে কিন্তু পরে নিজের আপনজনদের সাথে সুখে থাকবে। তাই হাওয়ায় পা বাড়ায় ইনারা। ঠিক সে সময় তার নিজের একটি হাসতে থাকা ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে। কিন্তু তার কী? তার হাসির, স্বপ্নের, জীবনের কী? তার নিজের কাছে কোনো মূল্য নেই? তার জীবনের কোনো মূল্য নেই? সেই মুহূর্তেই ইনারা নিজের পা পিছিয়ে নেয়। সেদিন সে নিজের জীবন বাঁচায়। নিজেকে বাঁচায়। হয়তো সেদিন তাকে ভালোবাসার জন্য খুব কম মানুষ ছিলো কিন্তু সে নিজের জীবনকে এমনভাবে গড়ে তুলবে যে হাজারোজন তাকে ভালোবাসবে। এভাবে নিজেকে শেষ করে দিলে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করবে না সে। নিজের সাথে অন্যায় করবে না। সেদিনের পর আর কখনো ইনারা নিজেকে খুন করার কথা চিন্তাও করে নি। সেদিন সে প্রথম নিজের জীবনের কদর করেছিলো। অতীতের বেদনার অংশের জন্য নিজের জীবন নিলে এক মুহূর্তেই সব শেষ হয়ে যাবে। সাথে ভবিষ্যতের আশাও। হতে পারে তার নিয়তিতে বেদনার পরবর্তী অধ্যায় অনেক ভালো কিছু আছে। যদি না থাকে, সে নিজে এই অধ্যায় লিখবে। এই ওয়াদাটা সে নিজেকে করেছিলো।
অস্থির লাগছিলো ইনারার। দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। মনে অশান্তি। আজ আকাশের কৃষ্ণমেঘের সাথে তার হৃদয়ও অশান্তিতে ঢাকা।
ইনারার কিছু ভালো লাগছিলো না। এই মুহূর্তে তার সভ্যকে ছাড়া অন্য কারও কথা মাথায় এলো না।
সভ্যের ঘুম ভাঙে দরজার শব্দে। সে ঘুমঘুম চোখে উঠে যায়। দরজা খুলে ইনারাকে দেখে অবাক হয় সে, “ইনারা তুমি এত রাতে এখানে?”
ইনারা কিছু বলে না। কিছু মুহূর্ত সভ্যের দিকে তাকিয়ে থেকে ঝাপটে পড়ে তার বুকেতে।
সভ্য হতভম্ব। এই মধ্যরাতে ইনারার এমন করাটা অবাক করে তাকে। সে ইনারার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে, “কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?”
ইনারা উওর দেয় না। কেবল সভ্যের বুকে চুপটি করে মুখ লুকিয়ে রাখে। সভ্যও বেশি প্রশ্ন করে তাকে বিরক্ত করে না। সময় দেয় তাকে।
হঠাৎ ইনারা প্রশ্ন করে উঠে, “আচ্ছা সভ্য আমি কী খুব স্বার্থপর?”
আচমকায় এমন প্রশ্নে সভ্য অবাক হয়। সে ইনারাকে তার বুক থেকে তুলে মুখে হাত রেখে বলে, “এসব কী বলছ তুমি? আমি যে ইনারাকে চিনি সে সবাইকে ভালোবাসতে জানে, স্বার্থপর হতে নয়।”
“আজ জোহানের সাথে আমার আলাদাভাবে কথা হয়েছিল। সে আমাকে একটা শর্ত দিয়েছে।”
সভ্য এমনিতেই জোহানের নাম শুনে প্রভাবিত হয়। ইনারার মুখ থেকে জোহানের নাম শুনতেও কেমন ভয় লাগে তার। ভয় হয় ইনারাকে আবারও হারানোর। কিন্তু ব্যাপারটা সে বুঝতে দেয় না ইনারাকে। তাকে জিজ্ঞেস করে, “কী শর্ত দিলো?”
“আমি যদি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দেই তাহলে সে আমার বাবার পরিচয় জানাবে। কিন্তু আমি নিজের স্বপ্ন বাছাই করেছি। যেখানে রহমান ভাই এত চেষ্টা করা সত্ত্বেও তার খোঁজ পাই নি। আমি পারতাম তার পরিচয় জানতে। কিন্তু আমি…আমি তা করি নি। আমার পরিবারের শেষ অংশ ছিলেন সে। অথচ আমি….” অস্থির হয়ে প্রশ্ন করে ইনারা, “আমি তাকে বেছে নেই নি। আমি কি ভুল করেছি সভ্য?”
আগ্রহ নিয়ে উওরের আশায় তাকায় সে সভ্যের দিকে।
সভ্য ইনারার হাত ধরে নিয়ে তাকে বিছানায় বসায়। এবং সে মেঝেতে বসে ইনারার হাত নিজের হাতে নেয়। বলে, “তুমি স্বার্থপর না ইনারা। স্বার্থপর হলে এখন এই কথাগুলো ভাবতে না। তুমি যা করেছ, ঠিক করেছ। নিজেক ভালোবাসা তো কোনো অন্যায় না। আমি নিশ্চিত তোমার বাবাও এটাই চাইতেন যে তার মেয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করুক। আমি জানি তার পরিচয় জানা তোমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু পরিচয় জানলেই তো সে ফিরে আসবে না। যে এই পৃথিবীতে নেই তার নামের পরিবর্তে নিজের এত বছরের তপস্যা বিলিয়ে দেওয়াটা বোকামি। এছাড়া তোমার তো প্রিয় এবং তোমার মা’য়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে তাই না? তোমার স্বপ্নও পূরণ করতে হবে। এত নরম হয়ে পড়লে কীভাবে তুমি এত ক্ষমতাবান মানুষের সামনে দাঁড়াবে বলো?”
ইনারার চোখ ভিজে আসে। তবুও সে একগাল হেসে উঠে দাঁড়ায়। বলে, “ওটাই এত সহজে আমি নিজের স্বপ্ন ছাড়বো না। আমার লক্ষ্য থেকে পিছু হবো না। এত রাতে আপনাকে ডিস্টার্ব করলাম। আমি যাই, রুমে যাই। আপনি এবার আরামে ঘুমান।”
ইনারা সেখান থেকে যেতে নেয়। কিন্তু সভ্য তার হাত ছাড়ে না, “তুমি চাইলে আজ এখানে ঘুমাতে পারো।”
ইনারা হ্যাঁ বলে না। কিন্তু না-ও করে না। কেবল এক’পা এগিয়ে আসে সে সভ্যের দিকে। সভ্য ইনারার উওর হ্যাঁ মেনে নেয়। সে ইনারার হাত ধরে এন বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ে পাশে।
আবার ইনারার কাছ থেকে অনুমতি নেয়, “তোমার খারাপ লাগলে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পারো।”
ইনারা এবারও উওর দেয় না। সভ্য এবার তার উওর না ভেবে অন্যদিকে ফিরতে নিলেই ইনারা তার গেঞ্জি মুঠোয় আঁকড়ে ধরে। আর ধীরে ধীরে তার কাছে এসে বুকে মুখ লুকিয়ে নেয়। নীরবে।
সভ্য মৃদু হাসে। এক হাত দিয়ে ইনারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, অন্যহাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে।
ইনারা তার বুকের ভেতর থেকেই জিজ্ঞেস করে, “আপনি কী নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, না অন্যকাওকে?”
সভ্য উওরটার জন্য কিছু মুহূর্ত ভাবে। তারপর বলে, “অবশ্যই সকলের পরিবার তার সবচেয়ে বেশি কাছের থাকে। কিন্তু জীবনের বিভিন্ন মোড়ে অন্য কিছু মানুষও আমাদের জন্য অনেক বেশি মেটার করে। আমাদের নিজের থেকেও বেশি। ছোট বেলায় আমার মা আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি কাছের ছিলেন। তাকে ছাড়া কিছু বুঝতাম না আমি। কিন্তু অনেক বছর দূরে থাকার পর তার থেকে অনেক দূরত্ব সৃষ্টি হয় আমার। তখন জো…” নামটা বলতে যেয়েও নিজেকে থামায় সভ্য, “তখন আমার এক বন্ধু আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। সে আমাকে জীবনের নতুন এক দিক দেখিয়েছিল। তার জন্য নিজের পরিবারের সাথেও লড়াই করেছিলাম আমি। কিন্তু এক পর্যায়ে এসে তাকে অপরিচিত কেউ মনে হতে থাকে। এরপর আমি নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছি। এই পৃথিবীতে সবাই আপনাকে ছেড়ে যেতে পারে, সবাই আপনাকে ধোঁকা দিতে পারে। দিন শেষে কেবল আমরাই নিজের সাথে থাকি। আমি ভেবেছিলাম এই পৃথিবীতে আমি নিজের থেকে বেশি আর কখনো, কাওকে ভালোবাসতে পারব না। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। আমি নিজের থেকেও বেশি একজনকে ভালোবেসেছি।”
“কে সে?” কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করে ইনারা।
“জেনে লাভ নেই৷ সে আমাকে ভালোবাসে নি। কিন্তু সে আমাকে হাসতে শিখিয়েছে। এই যান্ত্রিক জীবনের বাহিরে একটি সুন্দর জগৎ দেখিয়েছে। শিখিয়েছে এই যান্ত্রিক জীবন মূল্যহীন। জীবন তো সেটা যেখানে হাসি, কান্না, রাগ, অভিমান, অনুভূতি সব থাকে। তার পরিবারের জন্য ভালোবাসা দেখে আবার নিজের পরিবারের মূল্য বুঝেছি। তাদের কাছে গিয়েছি। তাদের আরও ভালোবেসেছি। আমার বন্ধুদের আরও ভালোবেসেছি। নিজেকে আরও ভালোবাসতে শিখেছি। আগের থেকেও গাঢ় ভাবে। এবার কেবল নিজের সাফল্যতাকে নিজের প্রতি ভালোবাসা মনে করেনি। আসলে ভালোবেসেছি। জানো ইনারা, এই পৃথিবীতে অন্যদের চেনা, তাদের জানা, তাদের ভালোবাসা যত সহজ, নিজেকে চিনতে পেরে নিজেক ভালোবাসা ততই কঠিন।”
কিন্তু মুহূর্ত চুপ রইল ইনারা। কিছু একটা ভাবলো। তারপর প্রশ্ন করল, “মেয়েটা কে এখনও আপনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন?”
“হ্যাঁ, তার জন্য এক মুহূর্তে আমি নিজের সব বিলিয়ে দিতে রাজি।”
ইনারা আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে সভ্যকে। যেন তাকে ছাড়লেও দূরে কোথাও হারিয়ে যাবে সভ্য। সে প্রশ্ন করে, “এখন কোথায় সে?”
সভ্য ইনারার হাত তার গেঞ্জি থেকে ছাড়িয়ে নিজের বুকের বাঁ পাশে রাখে, “এখানে। আমার হৃদয়ে, আমার অনুভবে….”
চলবে…