অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ২৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“বুঝলাম।” ইনারা গভীর চিন্তা করে বলল।
সভ্য জিজ্ঞেস করে, “এই’যে মেডাম। আপনার এতটুকু মাথায় আবার কি ঘোল পাকাচ্ছেন বলেন তো?”
“ওসব সময় এলে বুঝবেন। আগে আমি ভাবি কি রান্না করা যায়। আপনি তো সব পারেন। বলুন না কি রান্না করা সবচেয়ে বেশি সহজ।”
“বলতে পারি তবে…”
“তবে?”
সভ্য নিজের ঠোঁটের আঙুল রেখে বলল, “এখানে একটা চুমু দিতে হবে।”
ইনারা বিরক্ত হয়, “লাগবে না আপনার সাহায্য। লুচু একটা।”
সে যেতে নিলে সভ্য তার হাত আবার ধরে নেয়, “আরে দৌড় মারো কেন? আচ্ছা ঠিকাছে গালে দিও। চালিয়ে নিব।”
“লজ্জা লাগে না একটুও, তাই না?”
“রেসিপি লাগবে কি-না বলো?”
“ঠিকাছে ঠিকাছে। রাতে দিব নে। এখন কি বানাবো তা বলেন।”
“মিষ্টি কিছু বানালে একাধিক পদ রান্না করা লাগবে না৷ সুজির হালুয়া বানাও, অনেক সহজ রান্না করা।”
“রান্না তো সবই সহজ, যারা পারে না তাদের জিজ্ঞেস করেন।” হতাশ গলায় বলল ইনারা।
“তো মেডাম কোন মাউন্ট এভারেস্ট জয় করতে গিয়েছিলেন যে শিখতে পারেন নি।”
“আপনি কেবল এখান থেকে চলেন তারপর বুঝাচ্ছি।”
“এই’যে তোমরা দুইজন এখানে কী করো?”
ভারী এক কন্ঠে দুইজন সামনে তাকায়। দাদাজানকে দেখে সভ্য সাথে সাথে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, “এমনিতেই গল্প করছিলাম। এখন আমি যাচ্ছি। আপনারা গল্প করুন।”
“না, তুই কোথাও যাবি না। এই ছয়মাসে অনেকবার দাবার প্রাক্টিস করেছি। এবার আমিই জিতবো। আর তুই হারবি। আয় আমার সাথে খেলবি।”
“আবার?” সভ্য মুখ লটকিয়ে বলে, “দাদাজান আপনার সাথে খেলা শুরু করলে আপনি রাত পর্যন্ত ছাড়েন না।”
“এই আমার মুখের উপর কথা বলছিস? তুই খেলবি। আর আজ হেরে জলদি খেলা শেষ করব আমি।” তারপর ইনারার দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বলল, “নাতবৌ তুমিও আসো।”
“ওকে দাদাজান আমি আপনার দলে।”
ইনারা দৌড়ে যেয়ে দাদাজানের হাত ধরে তার সাথে এগোল। আর বাচ্চা মেয়ের মতো লাফাতে লাফাতে তার সাথে ভেতরে গেল।
অন্যদিকে সভ্য বিরক্ত ও নিরাশ হয়েই এগোয়।
.
.
খেলা চলছে। দুই পক্ষের চেহারা গম্ভীর। ইনারা ও সভ্যের বাবা গালে হাত রেখে তাদের থেকে একটু দূরে বসে আছে। এই খেলা চলছে বিগত দুইঘণ্টা ধরে। দুই ঘন্টায় তিনবার খেলা শেষ হলো। তিনবারই সভ্যই জিতেছে। চতুর্থবারও খেলা শেষের দিকে। এবারও সভ্যই জিতবে মনে হচ্ছে।
ইনারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে, “আংকেল এইটা আর কতক্ষণ চলবে?”
“আব্বা না জিতে যাওয়া পর্যন্ত। আর সভ্য তো হারবে না। সভ্যকে দাবাতে কেউ হারাতে পারে না।”
“তাই?”
“হ্যাঁ, ওর হেরে যাওয়াটা পছন্দ না। প্রথমে অভ্রের সাথে আব্বার দাবা খেলা হতো। তখনও সে হারতেন। এরপর কলেজে উঠার পর যখন বাসায় আসে তখন দুইজনের খেলা দেখে নিজেও খেলতে চায়। আগে টুকটাক খেলতো না’কি। কিন্তু অভ্রর থেকে হেরে যায়। একবার হেরে যাওয়ার পর দিনরাত দাবা খেলার প্রাক্টিস করে পরে সাপ্তাহেই অভ্রকে হারিয়ে মানে। তারপর থেকে আব্বা ওর পিছনে লাগছে। আমার আর মিষ্টির কি মনে হয় জানো? অভ্র ইচ্ছা করে আব্বার থেকে পিছু ছাড়ানোর জন্য সভ্য থেকে হেরে গেছে।” বলে শব্দ করে হাসলো সভ্যের বাবা।
ইনারা কৌতূহল নিয়েপ্রশ্ন করে, “মিষ্টি কে?”
“আরে অভ্রর মা। ওকে আমি আদর করে মিষ্টি করে ডাক দেই। একদম মিলে না বলো?”
“একদম।”
ইনারাও তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসে।
সভ্যর বাবা আবার বলে, “সভ্য কিন্তু অনেকটা নিজের দাদাজানের মতো। ছোট থেকে ও নিজের পরাজয় মানতেই পারে না। রাগী, আবার জেদিও। একারণে কোনো সিদ্ধান্ত শান্ত মাথায় নিতে পারে না। সব হুটহাট। এই’যে আব্বার বিরুদ্ধে যেয়ে গান শুরু করল। আবার হঠাৎ করে ছেড়ে দিলো। কিন্তু ছেলেটা আবার সবাইকে অনেক ভালোবাসে। সবার আগে অন্যেরটা ভাবে। এতে নিজের ক্ষতি হোক। আমার বড় ছেলে অভ্র কিন্তু আবার আলাদা। ছোট বেলা থেকে অভ্রর মতো হতে চেয়েছিল কিন্তু ভাগ্যিস তেমন হয় নি।”
“অভ্র ভাইয়া কেমন?”
“অভ্র একদম আলাদা। শান্ত মাথায় চিন্তা ভাবনা করে৷ ওর মাথায় কখন কি চলছে কেউ বুঝতে পারে না। ওর জন্য সবার পূর্বে কেবল ও নিজে। অন্যকেউ না। ক্ষমতাটা ওর জন্য একটা নেশা। অন্যের সাথে থেকে কিভাবে নিজের কাজ বের করবে কেউ বলতে পারবে না। প্রচন্ড বুদ্ধিমান। হাসি মুখে সামনের জনকে শেষ করে দিলেও সামনের লোকটা টের পাবে না। সবাই মনে করে ও হেরে গেছে কিন্তু হেরেও ওই জিতে।”
কথাগুলো শুনে ইনারার ভ্রু কপালে উঠে যায়, “বিবরণ শুনে তো ডেঞ্জারাস মনে হচ্ছে।”
সভ্যের বাবা হাসে, “তেমন কিছু না৷ আমাদের সবাইকে অনেক সম্মান করে। যদিও আব্বার পর কাওকে আমি ভয় পেলে ওকেই পাই সেটা আলাদা বিষয়।”
ইনারা ফিক করে হেসে দেয়। সভ্যের বাবা চোখদুটো বড় করে বলে, “বাহ বৌ’মা তোমার চোখগুলো তো অনেক সুন্দর! তোমার চোখ দেখে একজনের কথা মনে পড়েছে।”
“কার?”
সভ্যের বাবা কিছুসময় চিন্তা করলেন। এরপর বললেন, “আমাদের দিনের নায়ক ছিলো। বিদেশে যদিও এই চোখের রঙ কমছিলো কিন্তু তখন তো রঙিন চোখের মণি এ দেশে সহজে দেখা যেত না। আর আমাদের দেশের মানুষদের মনে ছিলো কৌতূহল। তাই সকলে নায়কটাকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলো। ভালোই নাম কামিয়েছিল সে। কিন্তু চার/পাঁচটা ছবি করার পর হারিয়ে গিয়েছিলো। তার নামটা ঠিক মনে পড়ছে না।”
“ইয়েস, আমি আবার জিতে গেছি।” সভ্যের কন্ঠে দুইজনে তাকাল সামনে। সভ্য আবার জিতেছে। দাদাজান বলল, “আবার খেলবো। এবার তো আমিই জিতবো।”
ইনারা চোখদুটো গোল গোল করে নিলো। আরও একঘন্টা এখানে বসে থাকতে হবে? অসম্ভব। সে দৌড়ে যেয়ে দাদাজানের পিছনে যেয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “দাদাজান আর খেলে কি করবেন? জীবনে একটা কিছুতেই ভালো করেছে বেচারা। এ খুশি রাখতে দিন। আপনি তো সবকিছুতে বেস্ট। আর আপনি তো এতক্ষণ ধরে এখানে বসে খেলতে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবেন দাদাজান।”
“ভুল বলো নি নাতবৌ। এখন তো আমার বয়স হয়েছে আমি ক্লান্ত হয়ে যাব। সভ্য শুন আমার নাতবৌ আমার হয়ে তোকে হারাবে।”
“হে!” ইনারা থতমত খেয়ে বলে। দাদাজান নিজে উঠে তাকে বসিয়ে বলে, “যতক্ষণ পর্যন্ত নাতবৌ না জিতে ততক্ষণ পর্যন্ত আজ কেউ উঠবো না।”
সভ্য গালে হাত রেখে বলল, “ওকে হারাতে তো আমার পাঁচ মিনিটও লাগবে না।”
আসলেই কিছু সময়ের মধ্যে ইনারার হেরে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু সে এখানে এতক্ষণ ধরে বসে থাকতে চায় না। তাই সে সভ্যকে মৃদুস্বরে বলল, “আমাকে রাউন্ডটা জিততে দিন প্লিজ।”
“সাফওয়াত ইসমাত সভ্য কারও কাছ থেকে পরাজিত হয় না।”
“আপনি যে বাগানে একটা জিনিস চেয়েছিলেন না? পরে দরদাম করে গালে আনলাম? তা ঠোঁটেই দিব।”
সভ্য বড় বড় চোখ করে বলে, “সত্যি?”
“একদম সত্যি।”
সভ্য এই প্রথম রাউন্ডেই হেরে যায় ইনারার কাছে। তা দেখে দাদাজান এবং বাবা প্রথমে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন, পরে খুশিতে লাফিয়ে উঠেন। ইনারাকে নিয়ে নাচ গান করতে থাকে তার জয়ের খুশিতে। জয়ধ্বনি গাইতে থাকে। এসব শব্দ শুনে দাদীজান হাজির হয়।
“কী চলছে এখানে?” দাদীজান রাগান্বিত সুরে বলে। ভয়ে তিনজনই এক লাইনে দাঁড়ায়। দাদাজান ভয়ে আমতা আমতা করে বলে, “ওই দাবা খেলছিলাম বউ বুঝছ। ইনারা সভ্যকে হারিয়ে দিলো।”
বাবাও উৎসাহ নিয়ে বলল, “হ্যাঁ আম্মা দেখো এত বছরে কেউ সভ্যকে হারাতে পারে নি আর বৌমা একবারেই হারিয়ে দিলো।”
কথাটা শুনে আরও রেগে গেলেন দাদীজান। বললেন, “নতুন বউ আসছে দুইদিনের জন্য। কোথায় সংসারের কাজ দেখবে। না সে ছেলেদের সাথে বসে খেলা করছে। আর কুর্তি পরে নতুন বউ ঘরে ঘুরে? শাড়ি পরবে। বুঝেছ?”
ইনারা আমতা-আমতা করে বলল, “জ্বি দাদীজান।”
“আর তুমি সভ্যের খেয়াল রাখো তো?”
ইনারা আড়চোখে সভ্যের দিকে তাকালো। গালে হাত দিয়ে সিনেমার মতো দৃশ্যটা দেখছে। তাকে দেখে মুখ টিপে হাসলো। রাগে গা জ্বলে উঠে তার। সে দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দেয়, “জ্বি দাদীজান খুব ভালোভাবে।”
“ভালো। আমার নাতির ভালোভাবে খেয়াল রাখাটা তোমার দায়িত্ব। ওর যেন কোনো কষ্ট না হয়। তুমি এখানে অভ্রর মা’য়ের কাছে যাও।”দাদীজান আবার দাদাজান এবং বাবাকে বললেন, ” তোমরা দুইজন আমার সাথে আসো। তোমাদের গান নাচ বের করছি।”
দুইজন ভয়ে ভয়ে দাদীজানের পিছনে যায়। ইনারা যেতে নিলেই সভ্য তার হাত ধরে নেয়, “কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
“শুনেন নি দাদিজান বলেছে মায়ের কাছে যেতে?”
“দাদীজান তো তার নাতির খেয়াল রাখতেও বলেছে মেডাম। আমার পাওনাটা কখন দিবেন?”
ইনারা অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করে, “পাওনা? কীসের পাওনা?”
“তুমি না বলেছিলে হারলে ঠোঁটে চুমু দিবে?”
“তাই? আমি তো ভুলে গেছি।”
সভ্য হা হয়ে যায়, “এই আমার সাথে বেইমানী করবে না। আমি আজ বহু কষ্টে হেরেছি। তাও তোমার জন্য। এখন কথা থেকে ফিরতে পারবে না।”
“আমি তো ফিরে গেছি।” নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল ইনারা। বলেই সভ্যের থেকে হাত ছাড়িয়ে তাকে ভেঙিয়ে চলে গেল।
সভ্য তার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগে ফোঁপাচ্ছিল।
.
.
সে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ইনারা দাদীজানের পিছু পিছু ঘুরে তাকে মানানোর চেষ্টায় জুটে আছে। দাদীজানের মন গলার তো নামই নেই। এর উপর সভ্য আরও জ্বালায় তাকে। দাদীজানের কাছে ইচ্ছা করে ভেজাল বাঁধিয়ে তাকে বকা খাওয়ায়।
ইনারা কেবল তার রাগ গিলে। এখান থেকে বের হয়ে মজা দেখাবে সভ্যকে।
সন্ধ্যাতে এমনই এক বৈঠক বসে সবার। ব্যাপারটা সবার কাছে খুবই সাধারণ। কিন্তু ইনারা এমন আগে না দেখায় তার কাছে একটু অবাক লাগে। ইনারা একটি সাদা জমিন এবং সবুজ পাড়ের কাজ করা শাড়ি পরেছিল। শাড়িটি সভ্যের মা’য়ের। সাথে তিনি ইনারাকে স্বর্ণের কিছু গহনা পরিয়েছেন। তাদের বাড়ির বউদের না’কি স্বর্ণ পরে থাকতে হয়। আর তার নীলাভ চোখে আঁকে কৃষ্ণ কালো কাজল। মা সকলের জন্য নাস্তা বানিয়ে ড্রইংরুমে আনছিলো। তাকে সাহায্য করে ইনারাও কিছু খাবার আনতে যেয়ে তিনবার হোঁচট খেল। আজ সারাদিন এই শাড়ি পরে তার অবস্থা কাহিল। কতবার মেঝেতে পড়ে গেল হিসাব নেই। তাই মা তাকে পাঠিয়ে দেয়। আসতে না আসতেই ফুপি বলে উঠে, “মা দেখেছেন আজকালকার মেয়েরা একটু শাড়ি পরে হাঁটতেও পারে না তারা না’কি আবার সংসার করবে। ভাবিকে সাহায্য করতে যেয়ে এমনিতেই এসে পড়লো।”
ইনারা হেসে বলল, “আহা ফুপি আমি তো তাও সাহায্য করতে গিয়েছিলাম, মা করতে দেয় নি। আপনি তো উঠেনও নি। সকাল থেকে দেখছি এখানে পড়ে…মানে বসে আছেন। আর সবার উপর সিসিটিভির মতো নজর রাখছেন। ভালোই হলো ঘরে সিসিটিভির খরচ বেঁচে গেছে।”
“মা মেয়ের মুখ দেখছেন? বড়দের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”
“এখন ফুপিজান আপনি যেভাবে কথা বলবেন আমি তো সেভাবেই উওর দিব। বড়দের মতো বিহেভও করেন।”
“বেহায়া মেয়ে আমার সাথে কথা বলবে না। আমি আমার মা’য়ের সাথে কথা বলছি। মা দেখেন কি ঘোড়ার লেজের মতো চুলে কালার করে রেখেছে। দেখা যায় কেমন!”
ইনারা খোঁপা করা ছিলো কথাটা শুনে সে নিজের চুল খুলে দিলো। তার ঝরঝরে চুলগুলো কোমর ছাড়িয়ে যেতে ফুপি চোখদুটো বড় করে নেয়। ইনারা বলে, “এটা একদম ন্যাচারাল ফুপি। আমি ফুল ন্যাচারাল বিউটি। আফসোস আপনার ব্যাপারে তা বলতে পারছি না।”
এবার দাদাজান এবং বাবার সাথে মিনুও নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
ফুপি বুঝতে পারলো এই মেয়ের সাথে কথা বলতে গেলে মেয়েটা তার সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিবে।
মিনু ইনারার পাশে এসে বসে তার চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বলে, “মাশাল্লাহ ভাবি তোমার চুলগুলো যা সুন্দর। আর চোখগুলোও। পুরা তুমিই মাশাল্লাহ ।”
“তোমার থেকে কম।”
ইনারা চোখ টিপ মারে মিনুকে।
ফুপি মিনুকে বকা দেয়, “এই তোর এত খাতির কীসের এই মেয়ের সাথে? তোর মা’কে যা না তা বলতে আর তুই ওর সাথে খাতির জমাচ্ছিস?” ফুপি আবার দাদীজানের দিকে তাকিয়ে বলে, “মা ও এত বেয়াদবি করছে তুমি কিছু বলিছ না কেন?”
এর উওর দিলেন দাদাজান, “আরে তোর মা তো নিজের সময় আরও ভয়ানক ছিলো। ও আর কি বলবে? আমার ভাবি একটা খোঁটা দেওয়া কথা বললে যেন কথা দিয়েই চামড়া ছিঁলে মরিচ লাগিয়ে দিবে। এমন অবস্থা।”
সভ্য দ্রুত উঠে এসে দাদীজানের পাশে বসল, “সত্যি না’কি সুইটু”
দাদীজান চোখ রাঙালেন দাদাজানের দিকে, “বাচ্চাদের সামনে এসব কি বলছ? চুপ করে চা খাও।”
মিনু সভ্যকে বলে, “সভ্য ভাই। অনেক বছর হলো আপনার গান শুনি না। আজ তো সবাই আছে বাড়িতে অভ্র ভাই ছাড়া। আর নতুন সদস্যও আছে। গান হবে না’কি?”
“এখন আমার গান শোনার জন্য হাজার হাজার টাকা লাগে। কিন্তু যেহেতু আমার মন অনেক বড় তাই তোদের আজ ফ্রী-তেই শোনালাম। আমার রুম থেকে গিটারটা নিয়ে আয়, যা।”
মিনু এক দৌড়ে গিটার এনে দিলো সভ্যকে। সভ্য গিটারের তারগুলো ঠিক করতে করতে ইনারার দিকে তাকাল। সবার থেকে চুরি ইনারাকে একটা চোখ টিপ মারে। আর ইনারা ভেংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
কন্যা রে, কন্যা রে-
বাঁকা চুলেতে খোঁপা, আর বাঁইধো না রে ।
ঐ চুলেতে জাদু আছে রে,
আমার ঘুম আসেনা রাতে একলা ঘরে রে ।
কন্যা রে, কন্যা রে-
বাঁকা চুলেতে খোঁপা, আর বাঁইধো না রে।
অন্তর কাড়িলা বন্ধু, ঘুম কাড়িলা ।
বৃথা প্রেমের রঙিন আশা কেন দেখাইলা ।
মন দিয়েছি বন্ধু আমার, প্রাণ দিয়েছি ।
আজ থেকে সবই আমার উজাড় করেছি ।
কন্যা রে, কন্যা রে.. আমার কন্যা রে…
গান শুরু করতেই ইনারা চকিতে তাকায় সভ্যের দিকে। সভ্য গানটা তার জন্যই গাইছে। এটা কেবল সে না সবাই-ই বুঝতে পেরেছে। তাইতো মিনুও পাশে ব্যাপারটা নিয়ে তাকে জ্বালাচ্ছিল। একটু আগের ফুপির কথার জন্যই যে এই গান গাওয়া তাও বুঝতে পারলো সে। আর বুঝাটা যে পরিষ্কার। সভ্য এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বেহায়ার মতো। সবার সামনে এভাবে তাকিয়ে থাকতে কি একটু লজ্জা লাগছে না লোকটার? ইনারা নিজেই লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলো। তার বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়েছে। কিন্তু সভ্যের এভাবে তাকে দেখাটার লোভ কীভাবে সামলায় সে? চোখ তুলে একপলক তাকিয়েই নেয়। চোখে চোখ মিলে। কেবল কিছু মুহূর্তের জন্য।
.
.
রাতে মা তাকে রুমে ডাকে। সভ্যের বউয়ের জন্য সে কিছু জিনিস জমিয়ে রেখেছিল। তাদের মন মতো বিয়ে তো হলো না কিন্তু সে আজ সভ্যর বউকে মন মতো সাজাল। হাল্কা সাজ। কিন্তু বউয়ের লাল লেহেঙ্গা ও সোনালী গহনায় তার সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশের মতো নয়। বধূ সেজে ইনারা সবার পূর্বে সভ্যকে দেখানোর জন্য ছুটে গেল। সে দরজা লাগিয়ে ডাক দিতে শুরু করে, “সভ্য…. সভ্য…”
সভ্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফি পান করছিলো। ইনারার এমন ডাক শুনে সে অবাক হয়। বারান্দার টেবিলে কফির মগটা রেখে যায় রুমের ভেতর, “কী হয়েছে মহারাণী? কোথায় ভূমিকম্প এসেছে যে এভাবে…. ”
রুমে ঢুকতেই সে স্তব্ধ হয়ে যায়।
ইনারা তার দিকে এগিয়ে এসে উৎসুক গলায় বলে, “দেখেন মা আমাকে এ লেহেঙ্গা দিয়েছে। কত সুন্দর লেহেঙ্গাটা দেখো। মা নিজে আমাকে সাজিয়েছে সুন্দর লাগছে না? কি হয়েছে বলছেন না যে? ভালো লাগছে না?”
সভ্য মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় ইনারার দিকে। তার দিকে এগিয়ে আসে। ঘোরে তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।
সে বহুকষ্টে বলে, “আমাদের বিয়ের দিনও তো তোমায় এত সুন্দর লাগে নি। আজ তোমাকে সদ্য আসমান থেকে নামা হুরপরী দেখাচ্ছে।” সভ্য ইনারার হাত ধরে তার বুকের বা পাশে রাখে, “আমার হৃদয়ের অবস্থা দেখো, করুণ হয়ে আছে।”
ইনারার গালদুটো লজ্জায় রঙে যায়। সে চোখ নামিয়ে নেয়। তার হৃদয়ের স্পন্দন স্বাভাবিক নয়। সে আমতা-আমতা করে বলে, “মা…মা আমাকে বলেছিল আপনাকে দেখিয়ে যেন মা’য়ের কাছে যাই। আমি আসছি।”
ইনারা যেতে নিলেই সভ্য তার ওড়না ধরে নেয়। থেমে যায় ইনারা।
“আমার কাছ থেকে পালাতে চাচ্ছো? আমার পাওনা কে দিবে শুনি?” সভ্য এগিয়ে আসে ইনারার দিকে।
“কী-কীসের পাওনা? আপনি কি নিয়ে কথা বলছেন আমি তো জানি না।”
“তাই?” সভ্য তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। তার কাঁধে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে খোঁপা থেকে চুলগুলোকে মুক্তি দেয়। তার খোলা কেশের ঘ্রাণ নিশ্বাসে মিশিয়ে বলে, “আমি তো আমার পাওনা আদায় করা ছাড়া তোমাকে ছাড়ব না।”
সভ্য ইনারার চুলে মুখ গুঁজে নেয়।
ইনারার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে। সে নিজের মুঠোবন্দী করে নেয়। চোখদুটো চেপে ধরে।
সভ্য তার গলাতে আরেকটি চুমু খায়। সাথে সাথে ইনারা পিছনে ফিরে সভ্যের বুকে মুখ লুকিয়ে নেয়।
সভ্য মৃদু হাসে, “বউ তোমার মুখটা দেখাবে না?”
ইনারা মুখ তুলে। করুণ দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে।
সভ্য তার কোমরে হাত রেখে নিজের কাছে নিয়ে আসে। তার গালে হাত রেখে মুখটা তুলে বলে, “আজ একদম আমার বউয়ের মতো লাগছে তোমাকে। আমার বউ।”
সভ্য ঝুঁকে তার ঠোঁটে ঠোঁট মিশাতেই চোখ বন্ধ করে নেয় ইনারা। সভ্যের পাঞ্জাবিটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। তার বুকের ভেতর যেন তুফান উঠেছে। আজ যেন সে আর নিজের মধ্যে নেই। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। সে যেন আজ সভ্যের নিয়ন্ত্রণে। সভ্যের বাহুডোরে আবদ্ধ। এই বাহুডোরে সারাজীবন কাটাতে পারবে সে।
সভ্য তাকে ছাড়ার পর সে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। এই লজ্জায় মাতাল হয়ে সভ্য আরেকটা ছোট চুমু খায় ইনারাকে।
ইনারা লজ্জায় মাখা মাখা হয়ে যায়। তার গালদুটোর লালচে হয়ে গেছে। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে বলে, “মা’য়ের কাছ থেকে আসছি।”
ইনারা যেতে নিলে সভ্য আবার তার হাত ধরে নেয়, “পালিয়ে গেলেও ফিরে তো আমার কাছেই আসতে হবে মহারাণী।” বলে সে হাত ছেড়ে দিলো।
ইনারা লজ্জায় মেখে গিয়ে সেখান থেকে ছুটে পালালো।
চলবে…
[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]