অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ২৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“তোমার কাছে একটা চাওয়া আছে আমার।” দাদীজান বললেন। রাতে সবার খাওয়া শেষে তিনি ইনারাকে রুমে ডেকেছেন। দাদাজানও আছেন রুমে। সে চুপচাপ এককোণে দোলন চেয়ারে বসে ফাইলে কাজ করছিলেন।
দুপুরের পর দাদীজান তার প্রতি নরম হলেও বাড়ির অন্যসবার মতো তাকে এত ভালোবাসা দেখান নি। এত জলদি তাকে অনেক আদর করবে আশাটাও ইনারা করে নি। তবে দাদীজানের মনে খানিকটা মায়া জন্মেছে এটা সে বুঝতে পারছে।
ইনারা জিজ্ঞেস করল, “চেষ্টা করব দাদীজান। বলে দেখুন।”
“দেখো সভ্য তোমাকে নিশ্চয়ই বুঝেশুনে বিয়ে করেছে। তুমি আসার পর বাড়ির সবাইকে যেভাবে আপন করে নিয়েছ তাতেও আমি খুশি। তোমাকে নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের পরিবারের একটা সম্মান আছে। আমি চাই না পরিবারের বউ বাহিরে কাজ করুক। সম্পত্তি বা টাকা পয়সার তো অভাব নেই আমাদের। তাহলে কাজ করার প্রয়োজন কী? তাও আবার সিনেমাতে। ওখানে নারীরা হাজার ভালো হলেও, মানুষ তাদের খারাপ চোখেই দেখে। আমি চাই তুমি এই কাজটা ছেড়ে দেও।”
ইনারা বুঝতে পারলো না সে কী উওর দিবে? সে একবার তাকাল দাদাজানের দিকে। সে কিছু বলবে এই আশায়। কিন্তু দাদাজান ফাইল থেকে মুখ তুললেন না। অবশেষে ইনারা নিজের পক্ষ রেখে কথা বলল, “দাদীজান আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“করো।”
“আপনার পরিবারে আপনার এবং দাদাজানের আগে কী কারও লাভ ম্যারেজ হয়েছিল?”
“আমার কথার সাথে তোমার প্রশ্নের কী সম্পর্ক? যাই হোক, উওরটা না।”
“অর্থাৎ আপনি প্রথম লাভ ম্যারেজ করেছেন। আর তা কেন করেছেন?”
“ইনারা বড়দের এসব কথা বলতে নেই।”
“প্লিজ দাদীজান বলুন না।” আবদারের সুরে বলে ইনারা।
“কারণ তাকে ভালোবাসতাম তাই।”
দাদাজান এবার রুমের অন্যদিক থেকে বললেন, “নাতবৌ জানো তোমার দাদীই আমার কাছে এসে বলেছিল, ‘চলো পালিয়ে বিয়ে করে নেই, আমি তোমাকে হারালে বাঁচবো না।'”
তিনি অভিনয়টাও করে দেখালেন। ইনারা সে দৃশ্য দেখে নিজের হাসি আটকাতে পারে না।
দাদীজান চোখ রাঙিয়ে তাকায় দাদাজানের দিকে। সাথে সাথে সে চুপ করে ধ্যান দেয় নিজের কাজে।
ইনারা দাদীজানের হাত ধরে বলে, “দাদীজান আপনি কয়বছর ধরে দাদাজানকে ভালোবেসে তাকে ছাড়া বাঁচতে পারবেন না। অথচ আমি ছোট থেকে এই স্বপ্ন নিয়ে বাঁচছি। আমার অভিনয়কে ভালোবাসছি। আমি স্বপ্নের এতো কাছে এসে কীভাবে ছেড়ে দেই? আর সবকিছুরই তো প্রথম আছে। আপনারা ছেলে মেয়েদের তফাৎ না করে সভ্যকে রান্না করা শিখিয়েছেন। তাহলে বউদের বাহিরে কাজ করতে কী সমস্যা? আর মানুষ কি ভাববে সে হিসেবে চলতে গেলে তো বাঁচাটাই দুষ্কর হয়ে যাবে। আমরা তো সবাইকে খুশি করতে পারবো না দাদীজান তাই না?”
দাদীজান কিছু বলছেন না। তিনি গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করছেন। ইনারা অস্থির হয়ে তার হাত আরও শক্ত করে ধরে বলল, “দাদীজান আমার পরিবার নেই। কিন্তু এখানে আসার পর সে শূন্য অনুভূতিটা যেন হাওয়ায় মিশে গেছে। আজ আমার মা যদি আমাকে অভিনেত্রী হিসেবে দেখতেন তাহলে অনেক গর্ব করতেন। তার চোখে সে গর্বিত অনুভূতিটা দেখার সুযোগ আমার নেই। তাই আমি চাই আপনাদের চোখে সে গর্বটা দেখতে। চাই আপনি নিজের নাতিদের মতো আমার সাফল্যতার উপরও গর্ব অনুভব করুন।”
দাদীজান এবার হাসলেন, “কথার জাল খুব ভালো বুনতে পারো দেখছি। না মেনে উপায় আছে? আচ্ছা যাও, তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করো। আমি বাঁধা দিব না।”
“সত্যি দাদী? ইউ আর গ্রেট। আপনি এত সুইট কেন?” বলে দাদীজানকে জড়িয়ে ধরলো।
“হয়েছে আর মাখন মারা লাগবে না। এখন অভ্রর মা’কে যেয়ে বলো আমার পান সুপারির বাক্সটা দিয়ে যেতে।”
“এখনই যাচ্ছি।”
ইনারা প্রায় দৌড়ে গেল সেখান থেকে।
দাদীজান বিরক্ত হয়ে বললেন,”বাচ্চা নেওয়ার বয়স হয়েছে আর এখন নিজেই বাচ্চার মতো লাফালাফি করে।”
দাদাজান হেসে উঠে এসে বসলেন দাদীজানের পাশে। বললেন, “তোমাকে বলেছিলাম না মেয়েটা মনের ভালো। সাথে আবার বুদ্ধিও আছে। তুমি এক কথার মানুষ। তোমার বলা কথা আজ পর্যন্ত আমি ঘুরাতে পারলাম না, অথচ মেয়েটা এই দুইদিনে কতবার তোমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দিলো।”
“কী করব? মেয়েটার মুখে যে মায়া মন কঠিন রাখতে পারি না। এর উপর ওকে দেখলে কেন যেন নিজের অতীত মনে পড়ে। মা হারা সন্তানরা কত কষ্ট পায় তা আমি জানি।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দাদীজান, “আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি মেয়েটা যখন বলেছে, সে কিছুতেই আমাদের পরিবারের সম্মান ডুবতে দিবে না। অভ্রর মা তো নরম মানুষ। যে কেউ নিজের স্বার্থে বোকা বানাতে পারবে। তাই ভয় হতো আমি মরার পর এই পরিবারের কি হবে। কিন্তু ইনারাকে দেখে শান্তি পেলাম। এখন নিশ্চিন্তে মরতে পারবো। ও ভালো হলেও, সময় হলে কঠিনও হতে পারবে। এখন অভ্রর জন্য এমন একটা মেয়ে পেয়ে গেলেই হবে। যেন আমার দুই নাতবৌ সুখে এক পরিবার হয়ে থাকে। এই শোনো, দেখো তো ইনারার কাছের কোনো বোন বা বান্ধবী আছে কি-না?”
“কেন?”
“অভ্রর জন্য দেখব। আর কেন?”
“ওর জন্য আর দেখার প্রয়োজন নেই। গতবার বিয়ের কথা শুনে কি রাগারাগি করে বের হয়েছে তোমার মনে নেই?”
.
.
ইনারা গুনগুন করতে করতে রান্নাঘরের দিকে এগোচ্ছিল। মা’য়ের কাছে যাবে বলে। মাঝরাস্তাতেই সে দেখে সভ্য এক দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করা। ইনারাকে দেখেই ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী ম্যাডাম আমার দাদীজানকে মাখন মারা শেষ?”
“আমি মাখন মারি না। আমি এতই মিষ্টি যে সবাই আমাকে দেখলেই গলে যায়।”
“এহ আসছে এমনিতেই গলে যায়। আমাকে দিয়ে আজ দুপুরে এত ভয়ানক নাটক করালে। এখন লজ্জা লাগে না এ কথা বলতে?”
“আপনার লজ্জা লাগে না আমার মতো সরল সোজা মেয়েটাকে ফাঁসাতে।”
সভ্যর চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল, “সরল সোজা আর তুমি? তোমার বুক কাঁপে নি এত বড় মিথ্যা কথা বলার আগে? চতুর শিয়ালের মতো সব অকপটে বুদ্ধি ভরা তোমার মাথায়।”
“কী বললেন আপনি আমাকে? নিজেকে দেখা যায় ব্যাঙের ছাতার মতো। প্লাস আছে তো এক খালি মাথা।আবার আসছে আমাকে কথা শুনাতে। এবার দেখেন ওয়াসিন খানের সাথে নতুন মুভি করছি না? বলে বলে রোমেন্টিক সিন দিবে। আর সে সিনগুলো সবার আগে আপনাকে দেখাব।”
“কী বললে তুমি?” সভ্য এক পা এগিয়ে এলো ইনারার দিকে, “আবার বলো তো। খুব রোমেন্টিক সিন করার শখ তোমার তাই না? তোমার শখ বের করছি।”
ইনারা আমতা-আমতা করে আশেপাশে তাকাল। সে বুঝতে পারল এই ব্যাপার নিয়ে সভ্যর রাগ তোলাটা নির্ঘাত বোকামি ছিলো তার। সভ্য নিশ্চয়ই চটে গেছে। সে এক পা পিছাল। এরপরও সভ্যকে নিজের কাছে আসতে দেখে এক দৌড় দিলো সে।
“এই মেয়ে কই যাচ্ছ? দাঁড়াও। তোমার শখ আজ মেটাচ্ছি আমি।” বলে সেও ইনারার পিছু গেল।
ইনারা ছুটে গেল রান্নাঘরে। যেয়ে মা’য়ের পিছনে যেয়ে লুকাল। মা জিজ্ঞেস করলেন, “আরে তোমার কী হলো?”
“মা দেখেন আপনার ছেলে আমাকে বকা দেয়।”
সে দেখে সভ্য ইনারার পিছনেই আসছে। সে রাগে ফোঁপাচ্ছিল। আসতেই ইনারাকে বলল, “এই তুমি এখনই মা’য়ের পিছন থেকে বের হও। তোমাকে আজ মজা দেখাচ্ছি আমি।”
“চুপ।” মা উঁচু স্বরে ধমক দিলেন সভ্যকে, “মেয়েটার পিছনে পরলি কেন হঠাৎ? পিচ্চি মেয়েটা কত ভয় পেয়েছি। সারাক্ষণ বিরক্ত করে।”
“কে পিচ্চি? এই মেয়ে আস্তো এক দজ্জাল।”
“মাইর দিব। লজ্জা লাগে না এত মিষ্টি মেয়ের ব্যাপারে এমন কিছু বলতে? ও কী করেছে বল তো।”
“হুম বলেন বলেন। কি করেছি আমি?” ইনারাও মা’য়ের কথায় তাল মেলায়। আর মা’য়ের পিছনে দাঁড়িয়ে। মাথায় দুই হাত রেখে ভেঙাতে শুরু করে সভ্যকে।
সভ্য চুপ করে যায়। সে তো আর মা’কে ইনারার কথাটা বলতে পারে না। কিন্তু ইনারার এমন ভেঙানি দেখে আরও চটে যায় সে। মা’কে বিচার দেয়, “দেখো মা তোমার এই মিষ্টি মেয়ে কীভাবে আমাকে ভেঙাচ্ছে?”
মা পিছনে তাকায়। সে তাকানোর পূর্বেই ইনারা সোজা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মুখ ফুলিয়ে, তার ঠোঁট উল্টে। সে ইনারার গালে হাত রেখে বলে, “দেখ কি সুন্দর করে দাঁড়িয়ে আছে। ও কোনো দুষ্টুমি করতে পারে না’কি?আর তুই অকারণে মেয়েটাকে বকছিস। আর একবার ওকে বকলে মাইর দিব তোকে।”
ইনারা মা’কে বলে, “মা দাদীজান বলেছিল তাকে পান সুপারির বাক্সটা দিতে।”
“আচ্ছা আমি যেয়ে দিয়ে আসছি। আর এই ছেলে আরেকবার তোমাকে বিরক্ত করলে আমাকে এসে জানাবা। আমি ওকে শিক্ষা দিব।”
“আচ্ছা মা।” মিষ্টি করে বলল ইনারা।
মা যাবার পর ইনারা দুষ্টুমি হাসি নিয়ে তাকাল সভ্যের দিকে। তার দিকে এগিয়ে বলল, “এইবার বকা দেন দেখি। জনাব আপনার চক্করে এই দুইদিন অনেক খাটুনি গেছে আমার। কাল বাসায় যেয়ে নেই। মজা বুঝাব আপনাকে।”
“কাল আমরা বাড়িতে যাচ্ছি না।”
“কী? তাহলে কোথায় যাচ্ছি?”
“একদম বলব না। আমি না বললে জানার জন্য তোমার পেট ব্যাথা করবে। আর তুমি আমার পিছু পিছু ঘুরবে। এখন মা বলেছে তাই তোমার ধমক দিতে পারব না। কিন্তু পিছনে তো ঘুরাতেই পারি।”
সভ্য তার পকেটে হাত রেখে বেপরোয়াভাবে হাঁটতে শুরু করে।
ইনারা বল, “যান। আপনি কী ভেবেছেন আমি আপনার পিছনে আসবো? জানা লাগবে না।”
কিন্তু সে তো ভারী ধৈর্যহারা মানুষ। কৌতুহল সামলাতে না পেরে আসলেই সভ্যের পিছনে ছুটে যায়।
.
.
রাতেই রওনা হয় দুইজনে। সবার কাছ থেকে দূড়ে যেতে একদম ইচ্ছা করছিল না ইনারার। কান্নাও পাচ্ছিল। এই দুইদিনে কারো প্রতি এমন মায়া জন্মায় ইনারা জানতো না। পারলে সে সেখানেই থেকে যায়। কিন্তু তা হলো না। আসার সময় সে না পেরে মা’কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। আর বলে আসলো আগামী মাসে আবার সে সবার সাথে দেখা করতে আসবে।
গাড়িতে উঠার কিছুক্ষণ পরই ঘুমিয়ে পড়ে ইনারা। এরপর দুইটা গাড়ি চেঞ্জ করে সভ্য। ইনারা ঘুমিয়ে থাকায় তাকে আর উঠায় না। কোলে তুলে অন্য গাড়িতে নিয়ে যায়। বড্ডই ঘুমকাতুরে মেয়েটা। তাকে উঠিয়ে নিয়ে দুইবার গাড়ি চেঞ্জ করল কিন্তু তার ঘুমই ভাঙলো না। সে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে রইলো সভ্যের বুকেতে। সে বুকের মাঝে যেন তার সারা জীবনের শান্তি।
ভোরের আলো যখন ইনারার মুখ ছুঁয়ে যায় তখন তার চোখ খুলে। চোখ খুলতেই সে দেখতে পায় সভ্য তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে হেসে বলল, “মহারাণী উঠে গেছেন?”
ইনারা কাঁচুমাচু করে আবার চোখ বন্ধ করে মুখ গুঁজাল সভ্যের বুকেতে। হঠাৎ তার জায়গাটার কথা মাথায় আসতেই লাফ দিয়ে উঠে বসে সে। জায়গাটা দেখে খুব অবাক হয় সে। আঁকাবাঁকা সড়কের দুইপাশে সবুজ গাছপালা এবং চা’য়ের গাছের বাহার। আকাশে রক্তিমা রঙের ছড়াছড়ি। ভোরের মিষ্টি রোদ্দুর আসছে জানালা ওপার হতে। ইনারা অবাক হয়ে তাকায় সভ্যের দিকে, “আমরা কোথায় এসেছি?”
“আমি ভেবেছি অন্তত এই জায়গাটা তুমি চিনবে। আজকের তারিখ দেখো।”
ইনারা তার ফোন অন করে তারিখটা দেখল। আজ তার মা’য়ের জন্মদিন। সভ্যের পরিবারের সাথে থেকে তারিখটাই খেয়াল করে নি সে। গত কয়েকবছর ধরে তার আর আসা হয় না এখানে। আজ এতবছর পর এখানে এসে তার হৃদয়ে কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে। বিশেষ করে এতটুকু ভেবে যে সভ্য তার থেকে বেশি তার খুশি, অনুভূতির খেয়াল রেখেছে। তার হৃদয় এই সুখের জন্য যেন খুব ছোট স্থান। কিন্তু এই সুখের মুহূর্তেও তার কান্না পেল। শব্দ করে কাঁদতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু সে কাঁদলো না। কিছু বললও না।
সভ্য তাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি খুশি হয়েছ?”
ইনারা কিছু বলল না। কেবল মাথা নাড়াল।
রিসোর্টে আসতে আরও সময় লাগে। তারা গাড়ি থেকে নেমে দেখে রিসোর্টের সকলে তাদের জন্য ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছিলো। আজ চার বছর পর এই একই স্থানে, একই সাথে আসলো তারা দুইজন। অথচ তাদের সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভিন্ন। আগে তাদের সম্পর্কের কোনো নাম ছিলো না। এখন আছে। পবিত্র এক সম্পর্কে আবদ্ধ তারা দুইজন।
সভ্য গাড়ি থেকে নেমে হাত এগিয়ে দিলো ইনারার দিকে। সে মৃদু হাসে। সভ্যের হাত ধরে নামে গাড়ি থেকে। নামতেই রিসোর্টের মালিক হাসিমুখে তাদের স্বাগতম করে। সাথে বলে, “আমার কত সৌভাগ্য আপনারা আমার রিসোর্টে এসেছেন। চার বছর আগে এত খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে এত বড় এক তারকা এসেছে আমাদের রিসোর্টে। আজ দুইজন জনপ্রিয় তারকা আমাদের রিসোর্টে পা রাখছে।”
সাথে সাথে তার বউ বললেন, “আমার তো গতবারই মনে হয়েছিল আপনাদের দুইজনের মধ্যে কিছু একটা চলছে। আপনাদের দুইজনকে একসাথে যে কত সুন্দর লাগে। একদম মেড ফর ইচ আদার। আসুন, আপনাদের ভেতরে নিয়ে যাই।”
সভ্য রিসোর্টের মালিকের সাথে কিছু কথা বলছিলো। এবং তার বউ ইনারাকে নিয়ে গেল সে রুমে। এই কয়বছরে রিসোর্টের অনেককিছু পরিবর্তন হয়েছে কেবল রুমটা ছাড়া। রুমটা যেমন ছিলো তেমনই আছে। সে রুমটা দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা আপনারা সবকিছু পাল্টেছেন, এই রুমটা পাল্টাননি কেন?”
“ওই টিনুর বাবাই করে নি। এই রুমটা তো ভাড়াও দেওয়া হয় না।”
”কেন?”
“কে জানি? চার বছর ধরে এই রুম কাওকে দেয় নি টিনুর বাবা। কেবল সভ্য স্যার ছাড়া। প্রতিবছর এই সময়েই তিনি এখানে আসেন এবং তখন সম্পূর্ণ রিসোর্ট তিনি বুক করে…” বলতে বলতে থেমে যান তিনি। বোধহয় বুঝতে পারে ভুল কিছু বলে ফেলেছে। তাই দাঁত দিয়ে জিহ্বায় কামড় দেয়। এমন সময় বাহির থেকে তার ডাক পড়ে। সে দ্রুত দৌড়ে যেয়ে ইনারার হাত ধরে বলে, “এ কথাটা বলার ছিলো না। টিনুর বাবা মানা করেছে। ভুলে বলে ফেলেছি। প্লিজ কাউকে জানাবেন না, নাহলে টিনুর বাবা অনেক রাগ করবে।”
আবারও ডাক পড়লো তার। তাই দৌড়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।
ইনারা হতভম্ব। তার অনুপস্থিতিতে সভ্য প্রতি বছর এখানে এসেছে? কিন্তু কেন? সে তো এতবছর ধরে তাকে ভালোও বাসতো না। তাহলে কেন এখানে আসতো? ইনারা এই একটি ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করতে থাকলো। তার হৃদয়ের ভেতর যেন ভারী কিছু এসে জমেছে। খুব অস্থির লাগছে তার।
এমন সময় রুমে প্রবেশ করল সভ্য। সে হাতে করে নিয়ে এলো একটি নীল রঙের মনিপুরী। আর বলতে থাকল, “দেখো ইনারা আমি কি এনেছি। আমি সাইয়ারা আন্টিকে এইরকম মনিপুরী শাড়ি পরতে দেখেছিলাম এক সিনেমাতে। আজ রাতে যখন আমরা দুইজন মিলে আন্টির জন্মদিন পালন করব তখন তুমি এই শাড়ি পরবে।”
সভ্যকে দেখে ইনারা তাকিয়ে রইলো মুগ্ধ নয়নে। আজ বুঝি সে আরেকবার প্রেমে পড়ল মানুষটার। সভ্য তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে শাড়িটি এগিয়ে দিলো, “তোমার ভালো লেগেছে ইনারা?”
“অনেক। আপনি ব্যালকনিতে যেয়ে অপেক্ষা করুন আমি পরে আসছি।”
“যো হুকুম মহারাণী।”
ইনারা তৈরি হলো। নীল শাড়ির সাথে সে সাজল নীল কাজল এবং টিপ দিয়ে। সাথে হাতে পরল কাঁচের চুড়ি এবং পা’য়ে এক জোড়া নুপুর। এতটুকুই। দরজা খুলে সে গেল সভ্যের কাছে।
সভ্য বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে তাকিয়ে ছিলো সামনের দিকে। সামনে কেবল আছে কিছু গাছ গাছালি। সেগুলো দেখতে দেখতেই হঠাৎ সে শুনতে পেল নুপুরের ছনছন শব্দ। চকিতে সভ্য পিছনে ফিরে তাকায়। নীলবর্ণের শাড়িতে এক রূপসী তার দিকে এগিয়ে আসছে। তার হাতের চুড়ি এবং পা’য়ের নুপুরের শব্দেই হৃদয়ে করুণ অবস্থা। এই রঙে তার সৌন্দর্য এমনিতেই ফুটে ছিলো। এর উপর তার নীলাভ চোখে সেই নীল কাজল যেন সভ্যকে হৃদয়ের স্পন্দনই আজ বন্ধ করে দিবে।
সে নীল কাজলের চোখ দেখে এক ঢোক গিলে সভ্য। চোখ বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস ফেলে। আজ সে নিজের এমন করুণ অবস্থা লুকায় না। বরং তার বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বলে, “মহারাণী এত সুন্দর করে সেজে আসার পূর্বে আমার এই নরম হৃদয়ের কথা চিন্তা করতেন। এত সৌন্দর্য এই হৃদয় যে সইতে পারবে না।”
ইনারা কিছুই বলল না। তার গলা দিয়ে যেন কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। সে কেবল তাকিয়ে রইলো সভ্যের দিকে। চুপ করে। মুগ্ধতাময় তার দৃষ্টি। হঠাৎ, নিজ অজান্তেই তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল এক বিন্দু জল। অথচ তার ঠোঁটে হাসি।
হঠাৎ এভাবে তার চোখে পানি দেখে অস্থির হয়ে পড়ল সভ্য। সে এগিয়ে এসে ইনারার গালে হাত রাখে, “কী হয়েছে ইনারা? তুমি ঠিক আছো তো? কাঁদছ কেন তুমি? আমি কি ভুল কিছু বলেছি? সরি…সরি ইনারা, তাও তুমি কান্না করো না। তোমার চোখের পানি যে আমাফ সহ্য হয় না।”
ইনারা কিছুই বলল না। কেবল ঝাপটে পরল সভ্যর বুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। মুহূর্তে যেন তার সকল অস্থিরতা মিশে গেল। শান্তি ছড়িয়ে গেল তার হৃদয়ের কোণে কোণে। সে সভ্যর বুকে মাথা রেখে কেবল জিজ্ঞেস করে, “সভ্য আমার সকল কাছের মানুষড়া আমার থেকে দূরে হয়ে যায়। আপনি কখনো আমার কাছ থেকে দূরে যাবেন না তো?”
সভ্য খানিকটা চমকায় হঠাৎ এই প্রশ্নে। তবুও এই নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে না। কেবল ইনারাকে তার বুক থেকে উঠিয়ে তার কপালে আলতো করে চুমু খায় এবং বলে, “আমি তোমাকে ছেড়ে কখনো যাব না। আমার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমি তোমার সাথে থাকব।”
ইনারা মৃদু হাসলো কথাটা শুনে। সভ্যের বুকে নিজের চিবুকটা রেখে দৃষ্টিমিলন করল এবং মনে মনে বলল, “আমিও প্রাণোপণ করছি, এই জীবনে কেবল আপনাকেই বারবার ভালোবাসবো।”
চলবে…
[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]