অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ২৬
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
ইনারার পাহাড়ের এক কোণায় বসে আছে। এখানে বসে সামনের সৌন্দর্য দর্শনের জন্য বসার একটি স্থান করা। সত্যিই এই জায়গাটি দেখতে অপূর্ব। খোলা আকাশ এবং গভীর পাহাড়ের মাঝে যেন মেঘ ভাসছে।
ইনারার খুব ইচ্ছে ছিলো সভ্যের সাথে এই অঞ্চলের সৌন্দর্য ঘুরেঘুরে দেখবে। কিন্তু তা হবার নয়। সবকিছুরই একটা মূল্য পরিশোধ করতে হয়। তাদের দুইজনের স্বপ্নের মূল্যটা ছিলো তাদের স্বাধীনতা। মন মতো ঘুরে-বেড়ানোর উপায়টা যে নেই।
সভ্য মাটির দুই কাপে চা এনে বসল ইনারার পাশে, “এত গভীর মনোযোগ দিয়ে কী ভাবছেন মহারাণী?”
ইনারার ঘোর ভাঙে, “বিশেষ কিছু না। আচ্ছা বলুন তো এই রিসোর্টে যে আসলাম যদি কেউ আমাদের একসাথে দেখে নেয়? আপনার জন্য সমস্যা হয়ে যাবে না?”
“উঁহু, কেউ বলবে না। আমার রিসোর্টের মালিকের সাথে বোঝাপড়া হয়ে গেছে।”
“কিন্তু শেষবার যে এখান থেকে যাবার পর আপনি এখানে একটা মেয়ের সাথে এসেছিলেন সে নিউজ এসেছিলো। এখন তো আমরা দুইজনই সবার কাছে পরিচিত।”
“হ্যাঁ তা রিসোর্টের কেউ খবরে দিয়েছিল। কিন্তু এরপর তাদের সাথে ভালো হয় নি। ভয়ে আর কখনো মুখ কখনো মুখ খুলবে না।”
“মানে? আপনি কী করেছেন তাদের সাথে?”
“আমি কিছু করি নি। আমি এত কঠিন শাস্তি দিতে পারি না। অভ্র ভাইয়া জেনে গিয়েছিল। তার একজন কর্মীই বিষয়টা সামলে নিয়েছে। এরপর আর কারও সাহস হবে না মুখ খোলার।”
“ঘরে সবার কাছে অভ্র ভাইয়ার কথা শুনলাম অথচ তাকে এখনও দেখলাম না।”
“তুমি হয়তো অলরেডি তাকে দেখেছ কিন্তু চিনতে পারো নি। তার সাথে আমার চেহেরা বিশেষ একটা মিলে না।”
“দেখেছি? কোথায় দেখেছি?”
“সময় আসলেই জানবে। তবে তোমার যে ভিডিও লিক হয়েছিল না? তার ফুল ফুটেজ প্রথমে কেউ দিতে চাচ্ছিল না। ভাইয়ার এসিস্ট্যান্টকে দেখে নিজেরাই বের করে দিয়েছে।”
“বলেন কি? এত ক্ষমতা আপনার ভাইয়ার? আপনাদের থেকেও বেশি?”
“আই মিন টাকার ক্ষমতা থাকলেও আমাদের কারও সামনে যেয়ে হুমকি দেবার পারমিশন নেই। কিন্তু ভাইয়া এসব রুলস মানে না। এখন ভাইয়ার কথা বাদ দেও। আমার কথা বলো। আমার সাথে থাকলে কেবল আমাকে নিয়ে কথা বলবে বুঝলে।”
“কেন জনাব? অন্যকাওকে নিয়ে কথা বললে আপনার ঈর্ষা হয় না’কি?”
“হতেই পারে।”
ইনারা লজ্জামাখা হেসে মুখ ফিরিয়ে নেয়। চা’য়ে চুমুক দিয়ে বলে, “জায়গাটা একেবারে স্বপ্নের মতো তাই না?”
তবে সভ্য চোখ ফেরায় না ইনারার দিকে থেকে, “উঁহু, স্বপ্ন থেকেও সুন্দর।”
ইনারা তাকায় তার দিকে। চোখে চোখ মিলে। দৃষ্টিমিলনে হৃদয় কাঁপে। বাতাসে খেলা করার জন্য সভ্য খোঁপা থেকে ইনারার কেশ মুক্ত করে দেয়।
মুহুর্তে অবাধ্য চুলগুলো জ্বালায় ইনারাকে। সে বিরক্ত হয়ে বলে, “আপনার শান্তি নেই তাই না? আমায় জ্বালাতে খুব মজা লাগে আপনার।”
“তা লাগে। কিন্তু তোমাকে খোলা চুলে দেখতে আরও মজা লাগে। আমার হৃদয় কাঁপে।
কথাটা শুনে ইনারা চুপ করে গেল। সে মাথা রাখল সভ্যের কাঁধে, “এই শেষ কয়দিন আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময় কাটিয়েছি আমি। ইশশ আজ যদি বৃষ্টি পড়তো তাহলে সময়টা কত জাদুময় হয়ে যেত।”
কথাটা বলতেই সভ্যর চোখে ভেসে উঠলো সেদিনটা। যখন ইনারা পক্ষীর মতো দুইহাত ছড়িয়ে মুখ তুলে তাকিয়েছিল আকাশের দিকে। উপভোগ করছিল বৃষ্টির প্রতিটি জলের বিন্দু। আর সভ্য সেদিন এত সুন্দর এক কল্পনা করেছিলো। ইনারাকে কাছে পাওয়ার, তাকে ভালোবাসার। আজ এত বছর কেটে গেল অথচ এখানে এসে আজও সেদিনের প্রতিটি মুহূর্তের কথা মনে পড়ে তার।
বাহিরে না যাওয়া হলেও রিসোর্টেই বেশ মজা করে দুইজন। সারাদিন হাসি ঠাট্টায় কাটলো দুইজনের। রিসোর্টের মাঠে দোলনা দোলা, ছুটাছুটি করা, ঘুরে বেড়াতেই দিন কেটে গেল। বিকেলে তারা বের হলো আশেপাশে ঘুরতে। আশেপাশের চা বাগান, লেক এবং প্রকৃতির আরও কিছু সৌন্দর্য উপভোগ করল তারা। কিন্তু আফসোস গাড়ি থেকে নামতে পারে নি। কেউ তাদের চিনে নিলে সমস্যা। রাতে যখন দুইজনে ডিনার করে রিসোর্টে ফিরে তখন ইনারা দেখে তাদের রুমটা মোমবাতির আলো দিয়ে ভরা। চারদিকে বেলিফুলের ঘ্রাণ ম ম করছে। মেঝেতে, বিছানায় বেশিফুল ছড়ানো। এবং বিছানার মাঝখানে রাখা একটি সাদা রঙের কেক। কেক- লেখা, ‘Happy birthday maa…”
ইনারা এসব দেখে অবাক হয়ে বলল, “এসব কী?”
“আরে আজ আমার মা’য়ের বার্থডে আমি সেলিব্রেট করব না? তুমি কী ভেবেছ তোমাকে আমি একাই আমার মা’য়ের উপর অধিকার বসাতে দিব? তোমার মা’য়ের উপরও তো আমার অধিকার আছে না?”
সভ্য যেয়ে বসে বিছানায়।
ইনারা খুশিতে কিছু বলার শব্দ হারিয়ে ফেলে৷ সে বারবার অবাক হয় সভ্যের চিন্তার উপর। কিন্তু এবার সে আর আবেগী হয় না। এই খুশির সময়গুলো আবেগী হয়ে কাটানোর নয়। সেও যেয়ে বসে সভ্যের পাশে। আর দুষ্টুমি করে সভ্যের গালে কেক লাগিয়ে দেয়। আর হেসে বলে, “কেন দিব? আমি আমার দুইটা মা’কে নিজের কাছে রেখে দিব।”
“এত লোভ করা ভালো না বুঝেছে মহারাণী।”
“আমি তো করব। আরেকবার আপনার বাড়িতে যেয়ে নেই। পরিবারের সবাইকে আমার করে নিব। কেউ আপনাকে পাত্তাই দিবে না।”
“ছিঃ! এমনি এমনি তোমাকে জংলী বলি? আমার সব ছিনিয়ে নেবার চিন্তাভাবনা তোমার মাথায় ঘুরে তাই না?”
ইনারা খিলখিল হেসে উঠে। সভ্য ইনারার গালে হাত রেখে তার মুখ নিজের দিকে ফেরায়। চোখে চোখ রেখে বলেন, “সব ছিনিয়ে নেওয়ার পরও তো তুমি আমারই বউ থাকবে।”
সভ্য নিজের ক্রিম লাগানো গালটা ছোঁয়াল ইনারার গালে। সাথে সাথে ইনারা শিউরে ওঠে। লজ্জায় মেখে যায়। সে লজ্জামাখা চোখে সভ্যের দিকে তাকায়। সাথে সাথে সভ্য চোখ টিপ মেরে বলে, “এই লজ্জা পেলেই তোমাকে কেবল একটু মিষ্টি লাগে, নাহয় জংলী নাম্বার ওয়ান।”
ইনারা বিরক্ত হয়ে ধাক্কা দেয় সভ্যকে, “আপনি এত বাজে কেন?”
সভ্য হাসে, “আসো কেকটা কাটি। কাটার পর তো মহারাণী একাই সম্পূর্ণটা শেষ করে দিবেন।”
“আই উইশ।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনারা, “কিন্তু পুরশু থেক নতুন ফিল্মের শুটিং শুরু। তাই মেইনটেইন করতে হবে।”
“তা দেখা যাবে।”
এরপর দুইজনে মিলে কেক কাটে। একে অপরকে একটু করে খাওয়ায়।
পনেরো মিনিট পর সভ্য ইনারার দিকে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকে। তার অর্ধেক কেক খাওয়া শেষ। সভ্য ভ্রু নাচিয়ে বলে, “পুরশু থেকে না তোমার শুটিং শুরু?”
“হ্যাঁ, কেন?”
“তুমি না মেইনটেইন করবে?”
“ধ্যুর কী আছে জীবনে? এখন খেয়ে নেই। পরে ঘাসপুস খেয়ে ওজন কমায় নিব।”
“তুমি এক জিনিস বটে।”
হঠাৎ আকাশে ডাক দেয়। বাহিরর বজ্রপাতের শব্দ শোনা যায়। শব্দটা শুনতেই ইনারা হাতের কেক রেখে বারান্দায় যায়।
ব্যালকনিতে যেয়ে দেখে আকাশটা কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেছে। কালো মেঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে আকাশের বুকেতে। ইনারা বাচ্চাদের মতো উৎসুক হয়ে বলল, “দেখুন সভ্য আমি আজ সকালে বলেছিলাম আর বৃষ্টি নেমে পড়ল। আজ মনে হচ্ছে জোরেই বৃষ্টি হবে।”
সভ্য ইনারার পিছনে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। বলে, “তোমার মিষ্টি আবদার বৃষ্টিও ফেলতে পারে নি। বৃষ্টি থেকে ভালো আমার নয়নের সাগরে ভাসো।”
“এত চিজি লাইন পান কোথা থেকে বলেন তো?”
“আমি একটু রোমেন্টিক হতে নিলেই তোমার রোমেন্সে পানি ঢালা লাগবে তাই না?”
ইনারা পিছনে মুখ ফিরিয়ে ভেঙায় তাকে।
ঝুম বৃষ্টি ঝরে। মাতাল হাওয়ার সাথে বৃষ্টির জল ছুঁয়ে দেয় দুইজনকে। ভিজিয়ে দেয় খানিকটা। ইনারা বলে, “এখন তো এই বৃষ্টিতে আমি বিলাসী হয়েই ছাড়বো।”
সে সভ্যের বাহুডোর থেকে মুক্ত হয়ে ছুটে যায় নিচের খোলা জায়গায়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করে, “আপনি আসবেন না?”
“না মেডাম আপনিই বৃষ্টিবিলাসী হন। আমি আপনাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি।”
ইনারা নেমে গেল। ঝুম বৃষ্টির এক মুহূর্তের ছোঁয়াতেই ভিজে জবজবে হয়ে গেল। সে চোখ বন্ধ করে দুই হাত পক্ষীর ডানার মতো মেলল। আর অনুভব করতে থাকলো এই মাতাল বৃষ্টির ছোঁয়া।
সভ্য গ্রিলের বর্ডারে হাত রেখে তাকে দেখে মৃদু হাসি ঠোঁটের কোণে এঁকে রেখেছিল। ইনারা দুই হাত মেলতেই তার ঠোঁটের হাসি উড়ে গেল। তার মনে পড়লো চার বছর আগের কথা। সে মুগ্ধ হলো, মাতাল হলো। বৃষ্টির ছোঁয়ায় তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল। মুগ্ধতায় ডুবে গেল সভ্য। এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে এগোল সে।
বৃষ্টিতে ভেজা তার সামনের চুলগুলো আঙুল দিয়ে আঁচড়ে পিছনে নিলো। ইনারার সামনে যেয়ে তার কোমরে হাত রেখে কাছে টেনে নিলো তাকে।
চমকে উঠে ইনারা। হঠাৎ এমন কিছু সে আশা করে নি। চোখ খুলে সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। সভ্যের এমন মাতাল দৃষ্টি কেমন শিহরণ জাগায় তার বুকে। সভ্য কিছুই বলে না। তবুও কেন যেন ইনারা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়।
সভ্য মৃদু হেসে তার ভেজা কেশের সাথে খেলা শুরু করে দেয়। বিরক্ত করে তাকে। তার চোখে, গাল, ঠোঁট আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেয়। অবশেষে চুমু খায় তার গলায়।
কেঁপে উঠে ইনারা। অস্থির হয়ে যায়। আঁকড়ে ধরে সভ্যের শার্ট। চেপে ধরে নিজের চোখ দুটো।
সভ্য মুখ তুলে তাকায় তার দিকে। গালে আঙুল বুলিয়ে মৃদুস্বরে বলে, “মহারাণী চোখ খুলুন।”
ইনারা ধীরে ধীরে চোখ খুলে। সভ্যের চোখে চোখ রাখতেই লজ্জায় মেখে যায়। সাথে সাথে সভ্য তার ঠোঁট দখলে নিয়ে নেয়।
এই মাতাল বৃষ্টির মাঝে সে ডুবে যায় সভ্যের ছোঁয়ার। তার বুকের ভেতর কেমন ধুকপুক করছে। সে যেন হারিয়ে ফেলছে নিজেকে সভ্যের মাঝে।
আচমকায় সভ্য তাকে কোলে তুলে নিলো। ইনারা বাঁধে দিলো না, বরং নীরব অনুমতি দিলো। এই বৃষ্টির রাতে মাতাল হলো। সভ্যের মাঝে ডুবে গেল।
.
.
শ্রীমঙ্গল থেকে দিল তার পরদিনই। ইনারার নতুন ফিল্মের শুটিং শুরু হয়ে গেছে। প্রথমদিন তার ভালোই লাগল। ভালো লাগার কারণও আছে৷ এখানে অন্তত আগের সিনেমার মতো বিপদ তৈরি করার জন্য আইজা বা জোহান নেই। এখানে সবার সাথে ভালো ব্যবহার করছে। ওয়াসিন খান তো আসলেই তার জন্য সকাল থেকে কতগুলো মজার খাবার অর্ডার দিয়েছে। এমনকি দুপুরে তার ভ্যানিটিতে নিজে খাবার নিয়ে এসেছিল।
সারাদিন শেষে ইনারার লাস্ট সিন শ্যুট হলো। কাহিনীটা ফ্যান্টাসির। ইনারার ডার্ক কুইন লুক করা হয়েছে। তার সম্পূর্ণ পোশাক, মেকাপই কালো। কেবল তার গহনা এবং মুকুট ছাড়া। এইটাই ইনারার প্রথম লুক হবে। সারাদিনে তার কোনো দৃশ্যেই দুইটার বেশি রিটেক দিতে হয় নি। কিন্তু এই সামান্য ফার্স্ট সিনটার জন্য সে পনেরোবার রিটেক দিয়েছে। অথচ পরিচালকের মন মতো হয় নি। তারা দুইজন মিলে দৃশ্যটা আবার দেখছিল। কোথায় সমস্যা তা খোঁজার জন্য।
পরিচালক আজমল বললেন, “সম্ভবত আবার কাল এই সিন আবার রিটেক নিতে হবে। আমি শান্তি পাচ্ছি না।”
“ওকে স্যার। পার্ফেক্ট না হওয়া পর্যন্ত আমি রিটেক দিতে রাজি।”
“সব ঠিক আছে কিন্তু…” পরিচালক তাকালেন ইনারার দিকে। কেমন অদ্ভুত ভাবে। কিন্তু তার দৃষ্টিটা খারাপ নয়। ইনারার ভালো খারাপ যাচাই করার বুদ্ধি এখন হয়েছে। সে প্রশ্ন করে, “কিন্তু কী স্যার?”
“কিন্তু তোমার চোখে সে ভয়ানক বা হিংস্র ভাবটা দেখতে পারছি না। সম্ভবত তোমার চোখের মণির জন্য। তোমার নীল চোখটা বেশ শান্ত ও আবেগী ধরনের। এতে মায়া আছে, হিংস্র ভাবটা নেই।”
“লাল লেন্স পরলে কেমন হয়?”
আজমল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। মৃদুস্বরে বলে, “খারাপ না। তাই করো।”
“আপনাকে খুশি দেখাল না।”
সে কিছুটা চিন্তা করে বললেন, “ইনারা তুমি জানো এবার আমি তোমার অভিনয় দেখে তোমাকে সুযোগ দিয়েছি। কিন্তু এর পূর্বেও আমি তোমাকে সুযোগ দিয়েছিলাম। তখন তোমার অভিনয় এত ভালো ছিলো না। তুমি হারিয়ে যাওয়ায় অনেক দুঃখও পেয়েছি। তখন কেন তোমাকে সুযোগ দিয়েছি জানো?”
“কেন?” ইনারার চোখে কৌতুহল।
“কারণ তোমার চোখজোড়া আমাকে কারও কথা মনে করিয়ে দেয়। খুব কাছের কেউ।”
“কে স্যার?”
“বাদ দেও। সে এখন আর এই পৃথিবীতে নেই। বাই দ্যা ওয়ে, তোমার চোখগুলো খুব সুন্দর। তোমার পজিটিভ স্ক্রিনটাইমের জন্য আর লেন্স পরা লাগবে না। এই চোখই অনেক কথা বলে যাবে।”
“ধন্যবাদ স্যার। আপনার চোখগুলোও খুব সুন্দর। ধূসর কালো রঙের। আপনার দিনে এসব চোখের রঙের দেখা সহজে পাওয়া যেত না তাই না?”
“একদম। অনেক পপুলার ছিলাম আমার দিনে।” হাসলেন তিনি।
“শুনেছিলাম আপনি নাকি অনেক গম্ভীর মেজাজী। এখন দেখি কথাটা একদম মিথ্যা। কী সুন্দর হাসছেন আপনি!”
কথাটা শুনে আজমল সাহেব তাকালেন ইনারার দিকে, “আমি সহজে কারও সাথে হাসি ঠাট্টা করি না। জানি না আজ কি হলো। সম্ভবত তোমার মাঝে কাওকে খুঁজতে চাচ্ছিলাম। যাই হোক। বাদ দেও। আপাতত বাসায় যেয়ে রেস্ট নেও। কাল মর্নিং রুটিন আছে।”
“জি স্যার।”
.
.
ইনারা সেখান থেকে বাসায় গেল না। তার গাড়ি একটি বিল্ডিং এর সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। সে গাড়ি থেকে নেমে নিচতলার ফ্লাটের কলিংবেল বাজায়। আর হাত আড়া আড়ি ভাঁজ করে অপেক্ষা করতে থাকে দরজা খোলার।
“কে? কে এসেছে এ অসময়?” এক বিরক্তিভরা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো দরজার ওপাড় থেকে। কন্ঠের সাথে মিল রেখে একইরকম বিরক্তি ভাব নিয়ে দরজা খুলল এক মেয়ে। ইনারাকে দেখে যেন সে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে রইলো। তার নিশ্বাস যেন সে মুহূর্তেই আটকে গেছে।
ইনারা হেসে বলে, “অনেক বছর পর দেখা হলো অমৃতা। আমার কথা মনে আছে তো? আমি প্রিয়’র বেস্ট ফ্রেন্ড। তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক ভালো মতো মনে আছে। ভেতরে আসতে দিবে না।”
অমৃতা এক মুহূর্তটা লাগাল না দরজাটা ইনারার মুখের উপর বন্ধ করতে।
কিন্তু ইনারা মেজাজ খারাপ করল না। বরং হাসলো। আবারও কলিংবেল দিলো। বারবার দিলো। দরজার ওপাশ থেকে স্পষ্ট শব্দ শোনা যাচ্ছে, “কী এক অপয়ারে আনলাম বাড়িতে বউ কইরা। আমার পোলা মায়া কইরা একটা ধর্ষিতারে বিয়া কইরা আনলো। কিন্তু সে কী দিলো? একটা নাতি নাতনীর মুখ তো দেখাতেই পারে নাই। সারাদিন বইসা আমার পোলার টাকায় গিলতে জানে। দরজাও আমার খুলতে হয়।” একটু থেমে সে আবার বলল, “এই মাইয়া তুই দরজার সামনে দাঁড়ায় আসোস দরজা খুলোস না কেন? দেখি সর। আমিও দেখি কে মরসে যে এত কলিংবেল বাজায়।”
এবার দরজা খুললেন এক বৃদ্ধা। সে ভালো করে দেখল ইনারাকে। তারপর জিজ্ঞেস করল, “তোমাকে কোথায় যেন দেখছি মনে হয়।”
ইনারা মিষ্টি হেসে সালাম দেয়, “আমি টুকটাক অভিনয় করি আন্টি।”
“অভিনয় করো? টিভিতে?”
“সিনেমায়।”
মহিলাটি চমকে বললেন, ” আমাদের বাড়িতে অভিনেত্রী আসছে? আমি এখনই সবাইকে ডেকে আনি।”
তিনি বেরোতে নিলেই থামায় ইনারা, “আপনি ব্যাপারটা কাওকে না জানালে খুশি হবো। আসলে অমৃতা আমার পরিচিত। তাই ওর সাথে দেখা করতে আসলাম।”
“পরিচিত?” সে পিছনে ফিরে অমৃতার দিকে মুখ বানিয়ে তাকায়। আবার বলে, “আচ্ছা তুমি ভেতরে আসো।”
ইনারা ভেতরে ঢুকে। ড্রইংরুমে বসে। মহিলাটি আবার বলে, “বাহিরের গাড়িটা তোমার?”
ইনারা মাথা নাড়ায়। মহিলাটি এবার উৎসুক ভাব নিয়ে বলে, “বলো কি? আমি তো জানতামই না আমার বউয়ের এত বড়লোক কারও সাথে পরিচয় আছে। তুমি আমার বউয়ের সাথে বসো। আমি তোমার জন্য চা নাস্তা আনি।”
ইনারা কথায় সায় দিলো।
মহিলাটি যাবার পর ইনারা তাকায় অমৃতার দিকে। সে ভয়ে পাথর হয়ে গেছে। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ইনারা পা’য়ের উপর পা তুলে বলে, “দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো।”
অমৃতা বসল না। ইনারা হেসে বলল, “মাতৃত্ব একটা পবিত্র জিনিস৷ এ নিয়ে খারাপ কিছু বলা উচিত না। কিন্তু তোমার শাশুড়ির কথা শুনেছি বাহির থেকে। তোমার না-কি বাচ্চা হয় না। তোমার কি মনে হয় একটা মা’য়ের কোল খালি করে তুমি মাতৃত্বের স্বাদ পাবে? উপরওয়ালা এক না একদিন সবাইকেই কর্মের পরিণতি দেখায়।”
অমৃতা ঢোক গিলল। অনেক সাহস করে বলল, “প্লিজ আপনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।”
“বেরিয়ে যাব? আমি তো তোমাকে একটা অফার দিতে এসেছি।”
অমৃতা জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
ইনারা বলে, “আমি চাই তুমি সব সত্যিটা মিডিয়ার সামনে স্বীকার করো। যে প্রিয় তোমার কোনো ক্ষতি করে নি। আর এসব তোমাকে দিয়ে কে করিয়েছে তাও স্বীকার করো।”
“আমি এতটাও বোকা না যে নিজের সুখের জীবনটা এভাবেই বিসর্জন দিব। প্রি..প্রিয় এখন আর নেই। ওর জন্য আমি নিজের জীবন শেষ করতে পারব না। প্লিজ আমি এখানে অনেক সুখে আছি। আমার জীবনে আর হস্তক্ষেপ করবেন না।”
“একটু আগে তোমার শাশুড়ির কথা শুনে মনে হয় নি তুমি সুখে আছো। আর তোমার স্বামী যে তোমাকে অবলা ভেবে বিয়ে করেছে, তার কানে সত্যিটা গেল কী হবে একবার ভাবো। আমি তোমাকে পঁচিশ লক্ষ টাকা দিব। সাথে তোমার কোনো শাস্তি হবে না। অফারটা খারাপ না। ভেবে দেখো।”
অমৃতা কিছু মুহূর্তর জন্য কথা বলতে ভুলে গেল। অবশেষে তার মুখ দিয়ে বের হলো, “আমার আপনার কথায় বিশ্বাস হচ্ছে না। শেষ মুহূর্তে যদি নিজের কথা থেকে ফিরে যান?”
ইনারা বাঁকা হাসে, “ইনারার কথার দাম আছে। সে মানুষকে কথা দিলে তা রাখতে জানে। এখন তুমি সিদ্ধান্ত নেও। টাকা পেয়ে নিজের শাশুড়ীর কটু কথা বন্ধ করবে, না’কি তোমার স্বামীকে ব্যাপারটা জানানোর পর ঘর থেকে বের হয়ে ব্যাপারটা নিয়ে ভাববে?”
চলবে…
[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]