অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৩৩,৩৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
৩৩
ইনারা এবার দৌড়ে নিজের রুমে যেতে নিলেই সভ্য তার হাত ধরে নেয়। তাকে ফিরিয়ে নিজের দিকে ঘোরাতেই সর্বুপ্রথম তার চোখে পড়ে ইনারার কপালের সেলাইয়ে। সে আঁতকে উঠল, “তোমার কী হয়েছে? কপালে কী হয়েছে তোমার? ব্যাথা পেলে কীভাবে?”
ইনারা খুঁজে পায় না কি বলবে। সত্যিটা সে বলতে চাচ্ছিল না। সভ্য অকারণে চিন্তায় পড়ে যাবে এজন্য। তাই একটি মিথ্যাই বানিয়ে বলতে হলো তাকে, “শুটিং এর একটা সিন শুট করতে যেয়ে লেগেছে।”
“শুট করতে যেয়ে? তারা নিজের এক্টরদের সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখে না? আমি এখনই রহমানকে ফোন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
সভ্য ফোন বের করে।রহমানকে কল দেবার পূর্বেই ইনারা তা ছিনিয়ে নেয়, “দোষ উনাদের ছিলো না। আমার ছিলো। জানেনই তো আমি কত ক্লামজি। আমার নিজের দোষেই ব্যাথা পেয়েছি।”
“তোমার কথার ধরণ আজ এত আজব লাগছে কেন?”
ইনারা মুখ ফুলিয়ে তার কপাল দিকে ইশারা করে। সভ্য ভ্রু কপালে তুলে বলে, “ব্যাথা পাওয়ায় তোমার কথার ধরণ আজব হয়ে গেছে?”
ইনারা মাথা নাড়ায়। সভ্য গভীর নিশ্বাস ফেলে মিনমিনে গলায় বলে, “মেয়েটা আস্তো এক পাগল। ওর সাথে থাকতে থাকতে আমিও একদিন পাগল হয়ে যাব।”
সে আবার ইনারাকে জিজ্ঞেস করে, “মেডিসিন নিয়েছ?”
“ছিঃ! মেডিসিন কে খায়? একটুও মজা না।”
“ঔষধ তোমার মজার জন্য দেয় নি। ব্যাথা ঠিক হওয়ার জন্য দিয়েছে।”
“ঠিক করার কিন্তু উপায় আছে।”
“কী?”
ইনারা ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে বলল, “কিসসি দিলে ব্যাথা কমে যাবে।”
সভ্য মুখ বানায়, “ব্যাথা লেগেছে কপালে, তোমার ঠোঁটে না। চলো চুপচাপ ঔষধ খেয়ে নিবে।”
ইনারা হাজার কান্নাকাটির ঢঙ করে কিন্তু এতে কোনো লাভ হয় না। সভ্য তাকে ঔষধ খাইয়েই ছাড়ে।
.
.
“আমি বুঝতে পারছি না ইনারা বিলাসবহুল এলাকায় প্রবেশ করলো কীভাবে? সে এলাকায় তো কেবল দেশের বড় বড় ধনীরা থাকে।” মুশতাক সাহেব বললেন। তিনি মিঃ হকের অফিসে বসে আছেন। আজ ইনারার পিছনে লোক লাগিয়েছিলেন তিনি। তার বাসার ঠিকানা জানার জন্য। কিন্তু কাজে দেয় নি। এর পূর্বেও কয়েকবার ইনারার ঠিকানা জানার জন্য লোক লাগিয়েছিলেন পিছনে। লাভ হয় নি।
মিঃ হক বললেন, “ওর কী আপনার ছাড়া কেউ আছে?”
“আছে এক পরিবার। কিন্তু তাদের কথা তো ইনারার জানে না। জানার কথাও না। আমি বাদে কেবল একজনই তাদের কথা জানে। সৌমিতা। ও কী…”
মিঃ হক কথা কেটে বললন, “না, সৌমিতার সাথে ইনারার কোনো যোগাযোগ নেই। ওর উপর আমার লোকের নজর থাকে চব্বিশ ঘণ্টা।”
“তাহলে ইনারা কীভাবে এত বিলাসবহুল জায়গায় থাকছে আমি বুঝতে পারছি না।”
দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে জোহান। কক্ষে মুশতাক সাহেবকে দেখেও না দেখার ভান করে। এবং তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, “বাবা আমি কী শুনলাম? তুমি এই মিথ্যা বক্তব্য কেন দিলে? ইনারার তো সভ্যর যাওয়ার সাথে জড়িত না।”
“তুমি কী সব ভদ্রতা ভুলে গেছ? এক তো অনুমতি ছাড়া রুমে ঢুকেছ। এর উপর বড় কাওকে দেখেও তার সাথে কথা বললে না? এসব শিক্ষা দিয়েছি তোমাকে?”
মুশতাক সাহেব তাকে থামালেন, “আহা বকছেন কেন ওকে? ইনারা মেয়েটা আসার পর থেকে সবার জীবনটা এলোমেলো করে দিলো। বেচারাও তো আমাদের মতো চিন্তায় আছে না’কি?”
“চিন্তার কিছু নেই। ওর ঠিকানা না পেলে কি হয়েছে? আগামীকালের ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। আগামীকাল ধামাকা হবে। ওর তুচ্ছ মেয়ের সব সাফল্য, কৃতিত্ব, অহংকার মুহূর্তে মাটিতে মিশে যাবে।”
.
.
পরেরদিন ইনারা খবর পায় তার কিছুক্ষণের মধ্যে বের হতে হবে। একটি বিউটি ব্যান্ডের ফেস হিসেবে সে সাইন করেছিল কয়মাস পূর্বে। তার নতুন পণ্য লঞ্চের জন্য তার আজ যেতে হবে। শেষ মুহূর্তে তারা ইভেন্ট ক্যান্সেল করতে পারবে না। টাকা দিয়েই ব্যাপারটা মিটমাট করা সম্ভব না। সে না গেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। একারণে তার ঝুঁকি নিয়ে বের হতেই হলো। একটি শপিং মলে ছিলো সে ইভেন্ট। ইনারা ইভেন্টে যেয়ে দেখে অনেক মানুষের ভিড় জমে আছে। এখনো সে স্টেজে উঠে নি। তার এক প্রকার ভয় করতে লাগলো গতকালের ঘটনার পর। কিন্তু এই কিছু সময় পাড় করতে পারলেই সে বাঁচে।
অন্যদিকে সভ্য অফিসে কাজ করছিল। আনিকাকে ডাকা হয় কনসার্টের খবরের জন্য। কনসার্টে টিকিট কত টাকায় ধরলে ভালো হয় তা নিয়ে পরামর্শ লাগবে। আনিকা এসে দাঁড়ায় সভ্যের সামনে। সবার পূর্বেই জিজ্ঞেস করে, “ইনারা ম্যামের কী অবস্থা স্যার?”
সভ্য কাজ করছিল। আনিকার কথা শুনে সে মুখ তুলে তাকায়। আনিকা ইনারার কপালের আঘাত এর কথা জানল কীভাবে?
সে জিজ্ঞেস করে, “কোন বিষয়ে কথা বলছ?”
“স্যার গতকাল যে মিঃ হক স্টেটমেন্ট দিয়েছিলেন সে বিষয়ে। ইনারা ম্যামের উপর গতকাল থেকে সকলে ক্ষেপে আছে। শুনেছি গতকাল একজন না’কি তাকে আঘাতও করেছে।”
সভ্য এইসব ব্যাপারে কিছুই জানে না। সাথে সাথে সে এই খবর নিয়ে সার্চ করে। আসলে ব্যাপারটা সত্যি। মুহূর্তে রাগে ক্ষোভে তার গা জ্বলে উঠে। সে রহমানকে ফোন দিয়ে ধমক দিয়ে সেই মুহূর্তে তার কক্ষে উপস্থিত হতে বলে।
রহমান দৌড়ে আসে সেখানে। জিজ্ঞেস করে, “স্যার…স্যার ডেকেছিলেন?”
সভ্য ল্যাপটপটা তার দিকে ঘুরায়, “এসবের মানে কী?”
রহমান ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। ভীত সুরে বলে, “মাফ করবেন স্যার ইনারা ম্যাম বলেছিল আপনাকে না জানাতে।”
“তোমাকে বেতন কে দেয়? আমি না তোমার ম্যাম? তোমাকে ওর দায়িত্ব দিয়েছি আমি। ওর সব খবর আমাকে দেওয়ার জন্য বলেছিলাম। আর এত বড় খবর তুমি আমাকে দেও নি? সাহস কী করে হয় তোমার? তোমাকে আমি এসে দেখব। এখন বাসায় যাচ্ছি ইনারার কাছে। আমার সব কাজ বাসায় পাঠিয়ে দিও।”
“স্যা…স্যার… আসলে ম্যাম তো বাসায় নেই।”
আরও ভড়কে উঠে সভ্য, “তুমি এই অবস্থায় ওকে শুটিং এ যেতে দিয়েছ? মাথা খারাপ তোমার?”
“না স্যার। ডিরেক্টর তো নিয়েই তাকে ছুটি দিয়েছে। কিন্তু… ”
“কিন্তু? কিন্তু কী?”
“ম্যামের একটা ব্যান্ডের সাথে ডিল ছিলো৷ আমি তো জানি না একমাস পূর্বে মিঃহক সে ব্যান্ডের শেয়ারে ইনভেস্ট করেছে। আজ সে ব্যান্ডের ইভেন্টে ম্যামের যাবার কথা ছিলো। ম্যাম বলেছিল যাবে না কিন্তু তাকে জোর করা হয়েছে। আমি টাকার অফার দিয়েছি রাজি হয় নি।”
রহমান দ্রুত টিভি চালু করল। বিভিন্ন নিউজে সে ইভেন্টের খবর আসছে। মানুষ ভরা সে ইভেন্টে। ইনারা এখনো সেখানে যায় নি।
সভ্য বসে পড়ে তার চেয়ারে। এই মুহূর্তে তার মাথা কাজ করছিলাম। গতকালের ভিডিও সে দেখল। ইনারাকে যেভাবে আঘাত করা হয়েছ তা দেখার পর জান শুকিয়ে এলো তার। সে বুঝতে পারছিল না তার কি করা উচিত হবে।
.
.
ইনারা স্টেজে উঠে দেখে সেখানে মিঃ হক উপস্থিত। তাকে দেখে ইনারা যতটা অবাক হয় এর থেকে বেশি তার রাগও উঠে। উনার জন্যই তার আজ এই ঝামেলায় পড়তে হলো। তবুও সে নিজেকে সামলে রাখে। স্টেজে উঠে। কিন্তু প্রডাক্টের এনাউন্সমেন্ট করার আগেই সামনে দাঁড়ানো কতগুলো মিডিয়ার লোকেরা তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে শুরু করে,
“মিস ইনারা বিগত কিছুদিন ধরে আপনার নামই সকল খবরে ছড়িয়ে আছে। নানান কথা জানা গেল আপনাকে নিয়ে। আপনার পরিবারের সম্পর্কে আজ পর্যন্ত আমরা কিছু জানি না। এই ব্যাপারে কী বলতে চান আপনি?”
উওর দেবার পূর্বেই তাকে আবারও একজন জিজ্ঞেস করে, “আপনি কী আসলে পরিচালক আজমলের আত্নীয়? আপনার জন্য কী সত্যিই পঞ্চসুর ভাঙলো? আপনার জন্য সভ্য এই ব্যান্ড ছেড়ে দিয়েছে?”
“যে মেয়ের জন্য আমাদের ফিফথ মেলোডি ভেঙে গেছে তাকে আমরা মোটেও ছাড়ব না।” ভিড়ের থেকে একটি কন্ঠ ভেসে এলো। এরপর একের পর এক মানুষ কথা বলতে শুরু করে। তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। তাকে গালাগাল দেয়। ভিড়ে এখন আর কোনো কথা পরিষ্কার নয়। এক পর্যায়ে এসে তার উপর হামলাও করা হয়। জিনিসপত্র ছুড়ে মারা হয়। কয়েকজন উঠে স্টেজেও আসতে চায় কিন্তু তার বডিগার্ডের জন্য পারে না। ইনারা বুঝতে পারছিল না সে কি করবে। মাইক নিয়ে সে সত্যিটা সবাইকে বলতে চেয়েছিল। কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক তাও সে বলতো। কিন্তু এমন অবস্থা দেখে সে যেন নড়াও ভুলে যায়। পাথর হয়ে যায় সে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই জায়গায় চারপাশে মানুষের ধাক্কাধাক্কি। নেমে যাবারও উপায় নেই। এমন সময় সে ভিড়ের মাঝে দেখতে পেল জোহানকে। সে স্টেজের দিকেই আসছিলো। তাহলে জোহানও তার তামাশা দেখতে এসেছে তার বাবার সাথে?
এমন সময় তাকে জিনিসপত্র ছুড়ে মারার গতি বাড়ল। সে তার হাত মুখের উপর দিয়ে তা বাঁধা দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু লাভ হয় না। সে ব্যাথা ঠিকই পায়। সে কি করবে বুঝতে পারে না। কান্না পাচ্ছে তার। খুব কান্না পাচ্ছে। এ সময় তার পাশে তার মা বা সভ্য থাকলে হয়তো তার এতকিছু সহ্য করতে হতো না।
হঠাৎ কারও ছোঁয়া পেল সে। কেউ তাকে বাহুডোরে ভরে তার মাথার পিছনে তার রেখে নিজের বুকে তার মাথা গুঁজলো। চমকে উঠে সে। এই স্পর্শ তার চেনা। সে চকিতে মুখ তুলে তাকায়। একটি মাস্ক পরা লোক তাকে বুকে ভরে রেখেছে। তার চোখদুটো দেখেই তাকে চিনে নিলো ইনারা। সভ্য তার সামনে। সভ্য? সে এখানে কী করছে? তার তো সকলের সামনে আসাটা মানা। তার তো এখানে আসাটা অসম্ভব ব্যাপার ছিলো।
সভ্য আর থাকতে পারে না। গাড়ি নিয়ে সোজা এসে পরে শপিং কমপ্লেক্সে। এসেই দেখে ভিড়ে কয়েকজন মানুষ আঘাত করছে স্টেজে দাঁড়ানো ইনারাকে। তার বুক কেঁপে উঠে। সে ভিড় চিরে যায় ভেতরে। তার বডিগার্ডরা সাহায্য করে তাকে। স্টেজে উঠেই ইনারাকে জড়িয়ে ধরে । ভিড়ের দিকে করে দেয় তার পিঠ। ইনারা চোখ তুলে তাকায়। সে চোখে ভয় ও বিস্ময় ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না সভ্য। সে দেখতে পায় ইনারার গালে ছোট একটি স্থানে কাটা গেছে। থেকে হাতেও ব্যাথা পেয়েছে সে। অনেক বাজে জিনিস মারা হচ্ছে তাকে। তাকে দেখেই ইনারার চোখ ভিজে গেল। চোখ দিয়ে পানি পড়লো। সে কাঁপা গলায় বলল, “আ-আপনি এখানে?”
তাকে উওর দিলো না সভ্য। তার অবস্থা দেখে সভ্যর যেমন কষ্ট হচ্ছে এর থেকে বেশি রাগ হচ্ছে মানুষগুলোর উপর। সে এক-দুই না ভেবে নিজের মাস্ক খুলে তাকায় পিছনে। তাকে দেখতেই ভিড় শান্ত হয়ে যায়। চিৎকার চেঁচামেচি পরিবর্তে হয় গুনগুন শব্দ। সকলের চোখেমুখে বিস্ময়। হবেই তো, আজ এত বছর পর সভ্য সবার সামনে এসেছে। আর সবচেয়ে বেশি বিস্ময় সে দেখতে পেল মিঃ হকের চোখেমুখে। সে স্টেজের অপরপাশে যেয়ে একজনের হাতের থেকে মাইক নিয়ে বলল, “হ্যালো এভরি ওয়ান, আশা করি আপনারা সবাই আমাকে চিনতে পেরেছেন। অবশ্যই চেনা উচিত। আমার জন্যই তো আপনারা এখানে এসে এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি করেছেন। এসব আপনাদের শোভা দেয়?”
সভ্য আবার মিঃহকের দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনারা কীভাবে যার তার কথা শুনে কারও উপর এমন আঘাত করতে পারেন? আমি তো কাওকে আমার ছাড়ার কারণ বলিনি। সিদ্ধান্তটা এক ব্যক্তিগত কারণে ছিলো। কিন্তু অবশ্যই এর কারণ আমার ডিয়ার ওয়াইফ ইনারা না।”
শেষ কথাটা শুনে সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লো। সবাই অবাক হবার জন্য শব্দ করল। সভ্য সবাইকে শান্ত করে ইনারার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। তার কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে টেনে এনে বলে, “জ্বি আপনারা ঠিক শুনেছেন। ইনারা আমার স্ত্রী, আমার জীবন, আমার অর্ধাঙ্গিনী এবং ওর সাথে আমার ব্যান্ড ছাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে গতকাল যে কথাটি বলেছিল তার সম্পর্ক আছে। মিঃ হক আপনিই না ছিলেন যে আমাদের ব্যান্ডকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন। যেন আপনার ছেলে আরও সাফল্যতা অর্জন করে?”
মিঃহক থতমত খেয়ে গেলেন কথাটি শুনে। সে বিস্ময়ে না কিছু বলতে পারলেন আর না করতে পারলেন।
সভ্য আবার তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, “আপনার সাহস আছে বলতে হবে। ন্যাশনাল টিভিতে এত বড় মিথ্যা ঘটনা সাজালেন আবার আজ তার পরিণামও দেখতে আসলেন? বাহ! আমার স্ত্রীকে অনেক জ্বালাতন করেছেন আপনারা। আমি চুপ ছিলাম। কিন্তু এখন আমার ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। সামলে থাকবেন কারণ সাফওয়াত ইসমাত সভ্যর স্ত্রীকে কষ্ট দেবার পরিণাম ভালো হবে না।”
সম্পূর্ণ নাম শোনার পর যেন মিঃ হক আকাশ থেকে পড়লেন। নিজেকে সামলাতে না পেরে পিছিয়ে গেলেন। তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে এলো।
জোহান ভীড়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো দুইজনের দিকে। তার চোখেমুখে বিস্ময়ের ছায়া। সভ্য ইনারার বিয়ে থেকে শুরু করে সভ্যর আসল নাম জানা পর্যন্ত সবটাই তার জন্য মেনে নেওয়া মুশকিল ছিলো। এত বছর সে সভ্যর সাথে বন্ধু ছিলো অথচ কখনো জানলোই না সে ইসমাত পরিবারের অংশ!
সভ্য তার শেষ কথাটি বলল জনগণের সাথে। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে, “আমি জানি আপনারা আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি,” সে ইনারার হাত ধরে। ইনারা তাকায় তার দিকে। সভ্যও তার দিকে তাকিয়ে বলল, “যারা আমাকে ভালোবাসেন তারা আমার বউকেও ভালোবাসা দিবেন। ও আমার কাছে আমার জীবন থেকেও বেশি দামী। ওকে আঘাত করা মানে আমার অন্তরে আঘাত করা।”
চলবে…
[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]
অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৩৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
সভ্যও ইনারার দিকে তাকিয়ে বলল, “যারা আমাকে ভালোবাসেন তারা আমার বউকেও ভালোবাসা দিবেন। ও আমার কাছে আমার জীবন থেকেও বেশি দামী। ওকে আঘাত করা মানে আমার অন্তরে আঘাত করা।”
ইনারা প্রথমে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সভ্যর দিকে। এরপর মৃদু হাসে। হয়তো এই কথাগুলোর প্রতিক্রিয়া আসতো সামনের ভিড় থেকে। কিন্তু বিস্ময় সবাইকে ঘিরে আছে। সভ্য মাইকটা নিচে রেখে ইনারাকে নিয়ে নিচে নামলো। বডিগার্ডরা রাস্তা বানাল দুইজনের যাওয়ার জন্য। তখনই এক রিপোর্টার সভ্যকে জিজ্ঞেস করে, “মিঃ সভ্য আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন? আপনাকে কী আবারও গান গাইতে দেখতে পাবো আমরা?”
সভ্য উওর দেয় না। এই মুহূর্তে কেবল ইনারাকে সুরক্ষিত ভাবে এখান থেকে নিয়ে যাওয়াই তার প্রধান লক্ষ্য।
কিন্তু এই এক প্রশ্ন থেকে শুরু হয় প্রশ্নের ভান্ডার। ভিড় আবার উত্তেজিত হতে শুরু করে। চারদিকে সভ্যের নাম গুঁজতে থাকে। যাবার সময় সভ্যের দৃষ্টি যায় জোহানের উপর। জোহান তাদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। তাকে দেখে সে ইনারাকে নিজের আরও কাছে টেনে নেয়।
গাড়িতে উঠার পর দ্রুত গাড়ি চালু করা হয়। স্পেশাল সিকিউরিটি টিম আসে তাদের সুরক্ষার জন্য। একদল শপিং মলের বাহিরে যেয়ে ভিড় আটকায়। অন্যদল তাদের গাড়ির পিছনে গাড়িতে আসে। দুইজনে প্রথমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পরক্ষণে ক্ষেপে যায় ইনারা, “আপনার মাথা খারাপ হয়েছে? আপনি কেন সবার সামনে আসতে গেলেন? মানে বুদ্ধিতে কী ঠাডা পরেছে আপনার?”
সভ্য থতমত খেয়ে যায়, “মানে তোমার জন্য আমি এসব করলাম আর তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ?”
“তো বলব না? আপনি সেদিন বলেছিলন যে আপনার কত সমস্যা হতে পারে সবার সামনে আসার কারণে। তাহলে কেন এলেন? আমি তো সব সামলে নিতাম।”
“দেখেছি তো কত সামলাও। চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলে সেখানে। আর তোমার গলার জোর দেখে তো আমি অবাক হচ্ছি। একতো রহমানকে আমাকে সত্যি জানাতে মানা করেছ এর উপর বড় গলায় কথা বলছ? সাহস আছে তোমার বলতে হবে। কী ভেবেছ আমি কোথাও থেকে জানব না?”
সভ্যের এমন ধমকে ইনারা চুপসে যায়। এই মুহূর্তে সে সভ্যের প্রতি যতটা কৃতজ্ঞ এর থেকে বেশি চিন্তিত, সভ্যের এখানে আসায় সে কোনো বিপদে না পড়ে যায়।
.
.
ইনারা সোফায় বসে আছে। তারা বাসায় এসেছে এক ঘন্টা হবে। আসার পরপরই দাদাজানের কল আসে সভ্যের ফোনে। সভ্য ভয়ে ভয়ে ফোনটা হাতে নেয়। এরপর থেকেই দাদাজানের রাগের স্বীকার হয় সভ্য। ইনারার ঘটনাটা দেখে খুব খারাপ লাগে সভ্যের জন্য। তারজন্যই মানুষটা এত বকা খাচ্ছে।
ফোন রেগে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সভ্য সামনের সোফায় বসে। চোখ বন্ধ করে কপালে হাত রখে বসে থাকে। ইনারা উদাসীন মনে বলে, “সরি আমার জন্য আপনার এত বকা শোনা লাগলো।”
সভ্য মুখ তুলে ইনারার দিকে তাকায়। তার উদাসীন ভাব দেখে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে, “দাদাজান তোমার কথা শুনে এত বকা দেয় নি। উনি একটু চিন্তায় আছেন কেবল।”
“আপনি কেন নিজের নামটা নিতে গেলেন বলেন তো। আপনার সম্পূর্ণ নাম না নিলে তো সমস্যাটা এত বড় হতো না।”
ইনারার কথা শুনে সভ্য সে মুহূর্তকে মনে করে যখন সে গাড়িতে উঠে বসেছিলো। খুব চিন্তায় ছিলো সে। তার কাছে সে মুহূর্তে এত বডিগার্ডও ছিলো না যে এত বড় ভিড়কে সামলাবে। তাই সে কল করে তার ভাই অভ্রকে। প্রথমে কল না ধরলে তেরো নাম্বার কলে ঠিকই কল ধরে। সভ্য বিচলিত সুরে বলে, “ভাই তোমাকে কতক্ষণ ধরে কল দিচ্ছি কোথায় ছিলে তুমি?”
অভ্রর কন্ঠ একদম শান্ত, “আমি তো সারাক্ষণ ফ্রী বসে থাকি না তোর কল ধরার জন্য। কাজ করছিলাম।”
অভ্রর সোজা প্রশ্নের এমন ত্যাড়া উওর দেওয়ার স্বভাবটা পুরনো। তাই সেদিকে সভ্য মাথা ঘামায় না।
“ভাইয়া একটা সাহায্য দরকার।” চিন্তিত শোনায় সভ্যের কন্ঠ।
অভ্র তাচ্ছিল্য হাসে, “সাহায্য দরকার পরলেই তো আমার কথা মনে পড়ে তোর। বল কি সাহায্য দরকার?”
সভ্য সম্পূর্ণ ব্যাপার খুলে বলে। অভ্র বলে, “বাহ অবশেষে তাহলে দাদাজানের ভয় ছেড়ে একটা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করছিস।”
“ভাইয়া প্লিজ সে পুরনো কথা আর তুলো না।”
“কেন তুলবো না? সে কবের থেকে দাদাজানের এসব ফালতু পুরনো কথা মাথায় ঢুকিয়ে রেখে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিস। আমাকে দেখেও শিক্ষা পাস নি। তার এত নিয়ম মানার পর আমি কী পেয়েছিলাম? কেবল বন্দী জীবন এবং অপমান। আর আজ আমাকে দেখ। আমার এক ইশারায় ইসমাত ইন্ডাস্ট্রিতেও তালা লেগে যাবে। এজন্যই বলেছিলাম নিজেকে এত ক্ষমতাবান করে তুল যেন অন্যের আদেশ না শুনতে হয়। আজ নাহয় তুই লুকিয়ে আছিস। বিয়ে করেছিস, ক’দিন পর বাচ্চা হলে কী তাদেরও এমন লুকিয়ে রাখবি? না’কি তাদেরও দাদাজানের ভয়ে নিজের স্বপ্ন মেরে কোম্পানিতে বসিয়ে রাখবি?”
“ভাইয়া প্লিজ তোমার একটা সাহায্য দরকার করবে কি-না বলো।”
“করবো। কিন্তু পরিবর্তে আমি কী পাবো? তুই তো জানিস, নিজের লাভ ছাড়া আমি কোনো কাজ করি না।”
“কী লাগবে তোমার?”
“তোর নাম।”
“আমার নাম?”
“হ্যাঁ, তুই তোর নামের ক্ষমতা আজ পর্যন্ত জানলি না। তোর নামই আমার নিজের লক্ষ্যএ পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট। সাথে তোরও কাজে আসবে।”
“কীভাবে?”
“তোর কী মনে হয় ইসমাত নাম শোনার পর কেউ তোর ওয়াইফের ক্ষতি করার সাহস পাবে? ঠিকাছে তোর ওয়াইফ শোনার পর কিছু ফ্যান ইনারাকে হেইট করতে পারে কিন্তু বড় অংশে ভালোবাসাও পাবে। আর যারা ইনারার ক্ষতি করতে চায় তারাও আর সাহস করবে না।”
“তোমার এমন মনে হয়?”
“আমার প্রিয় ছোট ভাই, তুই বইয়ের ব্যাপারে যত জ্ঞানী হস না কেন, বাস্তব ও রাজনৈতিক জীবনে আমার জ্ঞান তোর থেকে বেশি। এমনই হবে। ইনফ্যাক্ট আমি এটাও শিউর এতে তোর বিরোধী ধ্বংস হয়ে যাবে তোর কোনো কিছু করা ছাড়া। আর ইসমাত কোম্পানির শেয়ার ভ্যালু বেড়ে যাবে। দাদাজান দুইদিন রাগ থাকলেও নিজের কোম্পানির লাভ দেখে সব ভুলে যাবে।”
“আর আমাদের পরিবারের সেইফটি?”
“তোর দাদাজান তো সবাইকে লুকিয়েই রাখে তাহলে সেইফটির চিন্তা করছিস কেন? আর বেশি হলে সিকিউরিটি বাড়িয়ে দিবি। না’কি এতটুকু টাকাও ইসমাত কোম্পানির কাছে নেই?”
সভ্য কিছু সময় নেই চিন্তা করার জন্য। এই মুহূর্তে ইনারার কথাই তার মাথায় ঘুরে কেবল। সে রাজি হয়। বল, “ঠিকাছে। আমি কেবল চাই তুমি বেস্ট সিকিউরিটি আমার জন্য পাঠান, এখনই। ইনারাকে নিয়ে সব স্কেন্ডাল সরিয়ে দিন। সে বিউটি ব্রান্ড ও মিঃহকের বিরুদ্ধে কড়া একশন নিন।”
অভ্র হাসে, “অন্যসব আমি একদিনেই দেখে নিব। কিন্তু শেষটার জন্য একটু সময় নিলাম। শত্রুকে আস্তে-ধীরে ধ্বংস হতে দেখার মজাই আলাদা। তাই ইনজয় কর।”
বলে সে কল কেটে দেয়। সভ্য অবাক হয়ে তাকায় ফোনের দিকে। অভ্রর কথা সে বুঝে না। সে শপিং মল এবং ব্রান্ডের নাম জানা ছাড়াই কীভাবে কল কেটে দেয়? শপিং মলের নাম জানা ছাড়া কীভাবে আসবে সিকিউরিটি টিম? সে আবার কল দেয় অভ্রকে, বারবার দেয়। কিন্তু অভ্র কল ধরে না। সভ্য শপিং মলের সামনে যেয়ে দেখে অভ্রর পাঠানো টিম তার আসার আগেই হাজির।
ইনারা আবারও জিজ্ঞেস করে, “সভ্য কিছু বলছেন না যে?”
সভ্যর ধ্যান ভাঙে। সে ভাবনা থেকে বেরিয়ে ইনারার দিকে তাকায়। তার প্রশ্নের উওর দেয়, “দেখতে চাইছিলাম আমার নামে কত ক্ষমতা আছে।”
“মানে?” অবাক হয় ইনারা।
“মানে তোমার এখন বুঝা লাগবে না৷ আগে বলো এখন কেবল লাগছে? ব্যাথা নেই তো?”
ইনারার তেমন কোথাও ব্যাথা লাগে নি। লাগলেও তা খুব হাল্কা কিন্তু সভ্যের জিজ্ঞেস করাতে তার মাথায় বুদ্ধি আসে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “একটু ব্যাথা আছে। আমি আরাম করতে যাই।”
উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে সে ব্যাথার শব্দ করে বসে পড়ে। সভ্য ছুটে আসে তার কাছে। আতঙ্কিত কন্ঠে বলে, “কী হয়েছে তুমি ঠিক আছো তো?”
“পা’য়ে খুব ব্যাথা পেয়েছি। উঠে দাঁড়াতেও পারছি না। রুমে যাব কী করে?” তারপর সে দুইহাত ছড়িয়ে বলে, “আমাকে কোলে তুলে নিয়ে যান।”
সভ্য কপাল কুঁচকে নেয়, “তুমি না একটু আগে এত সুন্দর করে হেঁটে বাসায় ঢুকলে?”
“আহা তখন তো ব্যাথা বেশি লাগে নি। এখন লাগছে।”
“আজব ব্যাথা তোমার।”
বলে সভ্য তাকে কোলে তুলে নেয়।
ইনারা তো সভ্যের বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে মহাখুশি। তার মনে পড়ে স্টেজে বলা সভ্যের কথাগুলো। সে দুষ্টুমি করে বলে, “আপনি আমার জন্য সব ভুলে ছুটে চলে এলেন। হাউ রোমেন্টিক!”
সভ্য বিরক্তির ভাব করে বলে, “নিজের ভুল ধারণা নিজের কাছে রাখো। আর চুপ করে থাকো, নাহলে নিচে ফেলে দিব।”
“ইশশ আমাকে নিচে ফেলতে পারবেন আপনি। আপনার অন্তরে আঘাত লাগবে না?”
ইনারা সভ্যের বুকে হাত রেখে বলে। সভ্য সরু দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। রুমের ভিতর ঢুকে বিছানার উপর ছেড়ে দেয় তাকে।
ইনারা বিছানায় পরায় ব্যাথা না পেলেও অবাক হয়। সে চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে সভ্যের দিকে। “আমি ভালো করে জানি তুমি ব্যাথা পাও নি। এসব নাটক সিনেমায় করো, আমার সামনে না।” বলে সভ্য সেখান থেকে চলে যায়। আর ইনারা হা করে তাকিয়ে রইলো। যাওয়ার সময় ইনারা রাগে তার বালিশ ছুঁড়ে মারে সভ্যের দিকে। যা তার লাগে না, যেয়ে লাগে দরজায়। সভ্য আগেই বের হয়ে যায়।
.
.
সত্যিই পরের দিন থেকে মিস্টার হকের কোম্পানির লোকসান হতে শুরু করে। অন্যদিকে ইসমাত কোম্পানির মুনাফা তিনগুণ বেড়ে যায়। হঠাৎ এত মার্জিন দেখে দুই কোম্পানি ভীষণ অবাক হয়। সভ্যের নামই আমি যথেষ্ট ছিল দুই কোম্পানির এমন হঠাৎ পরিবর্তনের।
ঐশীর হলুদ শেষে আজ বিয়ের অনুষ্ঠান। জোহান কাল রাত থেকে না খেয়ে বিয়ের সাজগোজের কাজ দেখছে। তার একমাত্র বোনের বিয়ে বলে কথা। সে কোন রকমের কমতি রাখতে চায় না। স্বপ্ন থেকেও সুন্দর করতে চায় তার বোনের বিয়েটা। এমন সময় মিস্টার হক অফিস থেকে রাগে হলে প্রবেশ করলেন। সে রাগান্বিত স্বরে জোহানকে জিজ্ঞেস করলেন, “সাইদ বলল তুমি না’কি এড শ্যুটে যাবার জন্য মানা করে দিয়েছ? এটা কী সত্যি?”
“আপনারা কীভাবে হঠাৎ করে আমার একটা স্যুট রাখতে পারেন? ঐশির বিয়ে আজ। ওর বিয়েতে ছুটি নেওয়ার জন্য আমি একটানা দেড়মাস রাত দিন কাজ করেছি। দুই তিনঘণ্টা ঘুমিয়ে এত কাজ করলাম। অথচ হঠাৎ করে আপনারা আমার জন্য নতুন কাছে নিয়ে এলেন? আমি পারবো না।”
“আমি তোমার থেকে অনুমতি চাইনি। আদেশ দিয়েছে। তোমার কাজটা করতেই হবে। এখন তুমি কোম্পানির অবস্থা জানো। পঞ্চসুর ভাঙার পর থেকে এমনিতেই লাভ কম হচ্ছে এর উপর গতপুরশু সভ্যের কথার পর থেকে শেয়ার নিচে নেমে গেছে। আর্টিস্টরাও কোম্পানি ছেড়ে চলে যেতে চায়।এখন তোমারই কিছু করতে হবে। আর এমন তো না যে তোমার বোনকে জীবনও দেখতে পারবেনা। কিন্তু এখন কোম্পানির জন্য কাজ প্রয়োজন।”
জোহান এবার প্রচুর বিরক্তবোধ করে, “বাবা আমি আপনার ছেলে, কাজ করে টাকা ছাপার মেশিন না।”
মিঃ হক এবার ধমক দিয়ে উঠে, “চুপ। আমি তোমার জন্যই করছি। আমি যা বলছি তা করো, নাহয় আজ আর এখানে কোনো বিয়ে হবে না।”
বলে সে চলে গেলেন। জোহান এখানে দাঁড়িয়ে রইল। তার কিছু বলার নেই। করার নেই।
.
.
ইনারা তৈরি হয়েছিল ঐশির বিয়েতে যাবার জন্য। এই দুইদিন কোনো ফাংশনে যায় নি। যাচাই করছিল বাহিরের অবস্থা। বাহিরের অবস্থা এখন অনেকটা শান্ত। এমনকি একদিনে তার সোশ্যাল মিডিয়াতে ফলোয়ার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। যদিও সকলের ভালোবাসার পাত্র সে হয় নি তবুও অনেকাংশ মানুষ তাকে সমর্থন করছে।
সে একটি গোলাপি রঙের শাড়ি পরে বের হয়। সভ্যকে জানানোর জন্য যে সে বিয়েতে যাচ্ছে। সভ্যকে ড্রইংরুমে না পেয়ে তার কক্ষে প্রবেশ করে। দেখে সভ্য একটি শেরওয়ানি হাল্কা নীলচে-সবুজ রঙা শেরোয়ানি পরে আছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে সে। ইনারা তাকে দেখে অবাক হয়, “কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
সভ্য তাকায় তার দিকে, “যেখানে তুমি যাচ্ছ। ঐশির বিয়েছে।”
কথাটা শুনে ইনারার চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠে, “সত্যি? সত্যি আপনি যাবেন?”
সভ্য এগিয়ে আসে ইনারার দিকে, “এখন সকলের সত্যি তো এসেই পরেছে। তাহলে কেন আমি জীবনের সুন্দর স্মৃতি তৈরী থেকে বঞ্চিত থাকব? আসো, রওনা দেই।”
ইনারা সভ্যকে থামায়, “একটু, একটু অপেক্ষা করুন।”
বলে সে দৌড়ে আবার যায় নিজের রুমে। ঠাস করে দরজা আটকে দেয়।
এদিকে সভ্য অবাক। মেয়েটা তো সম্পূর্ণ তৈরিই ছিলো। তাহলে আবার কীসের জন্য গেল?
চল্লিশ মিনিট হয়ে এলো ড্রইং রুমে বসে অপেক্ষা করছে। ইনারার কোন খবর নেই। সে বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হচ্ছে।
নুপুরের ছনছন শব্দ তার কানে এসে লাগে। সে বিরক্ত হয়ে মাথা তুলে বলে, “এতক্ষণ লাগে মানুষের?”
কিন্তু চোখ তুলে তাকাতেই তার বুক কেঁপে উঠে। চোখ বড় হয়ে আসে। ঘোর লেগে যায় তার। মোহে ডুবে যায়। আনমনেই সে উঠে দাঁড়ায়। তার শেরোয়ানির সাথে মিলিয়ে একটি গাউন পরেছে সে। অ্যাকোয়ামেরিন রঙের সাথে গোলাপি রঙ মেশানো। গহনার মধ্যে কেবল পরা কপালে একটি টিকলি ও পায়ে নুপুর। মাথায় ওরনাটি নেওয়া। তার মনে হচ্ছিলো কোনো এক পরী সদ্য আকাশ থেকে নেমে এসেছে। কেবল তার জন্য।
ইনারা তার সামনে এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগছে আমায়?”
সভ্য মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। তার সকল রাগ অভিমান যেন ভুলে যায় মুহূর্তের জন্য। ইনারার হাত ধরে। তার বুকের বাঁ পাশে রেখে বলে, “আমার হৃদয়ের স্পন্দনের এমন হাল দেখে নিজেই সিদ্ধান্ত নেও।”
ইনারা লজ্জায় মাথা নামিয়ে দেয়। আবার মুখ তুলে সভ্যের কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনার অন্তরে আঘাত করলাম বুঝি?”
কথাটায় সভ্যর হুঁশ ফিরে তার মনে পরে সে কি বলেছে কিছুক্ষণ পূর্বে ইনারাকে। লজ্জিত হয় সে। আশেপাশে তাকায়। এত সহজে নিজের অভিমান ছাড়ার মানুষতো সে নয়।
সে পিছিয়ে যেয়ে কড়া গলায় বলে, “এতক্ষণ লাগে কারো পোশাক পরিবর্তন করতে? আসো, নাহয় প্লান অনুযায়ী আর কিছুই হবে না?”
“প্লান?”
“সামি প্লান করেছে। ঐশি ও ইরফানের এন্ট্রির সময় আমি গান গেয়ে ওদের সামনে আসবো। ওদের জন্য স্যারপ্রাইজ হবে।”
.
.
বিয়ের হলের দ্বিতীয় তলায় বসে আছে সভ্য এবং ইনারা। সামিই তাদের লুকিয়ে ঢুকিয়েছে। কেবল তাদেরকে ছেড়ে বাহিরে গেল সামি। ঐশির গাড়ি না’কি এসেছে। কিন্তু গাড়ির সামনের নাচ গানের জন্য তা ভেতরেই ঢুকতে পারছে না। অনেক হৈ-হুল্লোড় গান বাজনা হচ্ছে। ইনারা জানালা দিয়ে তা দেখছিল। সে সভ্যকে বলল, “এসব দেখে আমারও বিয়ে করতে মন চাচ্ছে।”
সভ্যর উওর আসে না। সে চেয়ারে বসে মোবাইল চালাচ্ছে। ইনারা পিছনে তাকায়। দ্রুত সভ্যের সামনের চেয়ারে বসে আবার বলে, “শুনুন না, আমার বিয়ে করতে মন চাচ্ছে।”
“কার সাথে?”
“কার সাথে মানে? আপনার সাথে?”
সভ্য মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে তাকায় ইনারার দিকে। বিরক্তির সুরে বলে, “মানুষের মাথা জীবনে একবারই খারাপ হয়। যেদিন খারাপ হয়েছিল ওদিন তোমার মতো পাগলের সাথে বিয়ে করেছি।”
কথাটি শুনে ইনারা রাগে লাথি মারে সভ্যের পা’য়ে।
ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে সভ্য, “জংলী।”
“আপনি যাই বলেন না কেন? আমি বিয়ে করব, করব, করব। এভাবে ধুমধাম করে বিয়ে করেই ছাড়ব।” জেদ ধরে ইনারা।
চলবে…
[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]