অনুভবে (২য় খন্ড) পর্ব ৪০

0
1190

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৪০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

নিচের অংশটুকু পড়ার পূর্বে সভ্য থেমে গেল। সে কী ঠিক পড়ছে। ইনারা তাকে ভালোবাসতো? তার বিদেশ যাবার পূর্ব হতে? উওরের জন্য সভ্য আবারও পড়তে শুরু করল চিঠিটা,

“আমি জানি আপনি কী ভাবছেন? আপনাকে ভালোবাসলে আমি জোহানকে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বললাম কেন? আমি তখন ওকে হ্যাঁ বলি নি। জোহান মিথ্যা বলেছিল আপনাকে। আপনি আমার সাথে কথা না বলে কেন ওকে বিশ্বাস করলেন তা আমার অজানা। তখন জোহান কেবল আমার ভালো বন্ধু ছিলো। ওর সাথে সময় কাটানোর কারণ ছিলো ওর কোম্পানি থেকে আমি অভিনেত্রী হিসেবে জয়েন করেছিলাম এবং ও আমাকে অভিনেত্রী হিসেবে পরিচালকের সাথে দেখা করতে সাহায্য করতো। এতটুকুই। এমনকি জোহান নিজেও জানতো আমি আপনাকে ভালোবাসি। কেবল আপনাকে। ওর প্রতি যা ছিলো তা ভুল বয়সের আবেগ। যা সময়ের সাথে সাথে জীবন থেকে মুছে গেছে। আপনি কিন্তু কখনো আমার জীবন থেকে মুছেন নি। একারণেই হয়তো বিয়ের পর আপনাকে এতটা ঘৃণা করতাম। ভাবতাম আপনি আমাকে ভালোবাসার আভাস দিয়ে দূর কোথাও উড়ে গেছেন। অথচ আপনি আমার জন্যই নিজের স্বপ্ন ছেড়ে দিয়েছিলেন। অথচ আমি অজান্তেই আপনাকে কত কষ্ট দিয়েছি, কতবার দূরে সরিয়েছি, কতকিছু না বলেছি। পারলে ক্ষমা করে দিয়েন।
পাঁচ বছর পূর্বে আপনি আমার জন্মদিন পালন করতে চেয়েছিলেন নিজের মনের অনুভূতি বলে। আজ পাঁচ বছর পর আমি আপনাকে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করছি। ভালোবাসি সভ্য, আপনাকে খুব ভালোবাসি। আপনি কী আমার ভালোবাসাটা গ্রহণ করবেন?”
~আপনার মহারাণী

সভ্য চিঠিটা পড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। আর বাঁকা হাসল।
.
.
ইনারার মেকাপ করা শেষে তাকে গাউন পরানো হচ্ছিল। সাদা গাউন। হাতে সাদা গ্লাভস পরা এবং চুলে ফুল পরানো হচ্ছে। সবটা খুব জলদি করা হচ্ছে। একসাথে দুই তিনজন তাকে সাজাতে ব্যস্ত। কেননা একঘন্টায় রাত বারোটা বাজবে। তার দ্রুতই বাহিরে যাওয়া উচিত। এমন সময় তার ফোন বাজল। একটি মেয়ে তার ফোনটা এনে দিয়ে বলল, “আপু আপনার মেসেজ আসছে।”

ইনারা হাতে ফোনটা নিয়ে দেখে সভ্যর মেসেজ, “নিচে যাবার পূর্বে আমার রুমে এসো। আমি অপেক্ষা করছি।”
ইনারার মলিন মুখেতে হাসি ফুটে। সম্ভবত সভ্য তার চিঠিটা পড়েছে। ইনারা সভ্যকে কথাগুলো সামনা-সামনি বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল সে পারবে না। তাই চিঠিতে সব লিখে দিলো। কিন্তু আগামীকাল সভ্যর জন্য একটা স্যারপ্রাইজ আছে তার কাছে। কিন্তু সভ্য এই মুহূর্তে কীজন্য তার রুমে ডেকেছে? চিঠি নিয়ে কিছু বলতে না’কি তার হৃদয়ের অবস্থা ইনারার সামনে খুলে রাখতে?

তাড়াহুড়োর মধ্যে তৈরি হলো ইনারা। সুরভি তাকে নিতে এসেছিলো। কিন্তু তাকে ভুলভাল বুঝিয়ে দিয়ে চুপিচুপি গেল সভ্যর রুমে। দরজায় টোকা দিলো। দরজা খুলল সভ্য। তার পরনে সাদা শার্ট এবং কালো রঙের স্যুট। ইনারার চুলে দেওয়া সাদা ফুল আছে সভ্যর পকেটেও। তাকে দেখে কিছু মুহূর্তের জন্য ইনারা কথা বলতে ভুলে গেল। পুরুষ মানুষের এতটা সুদর্শন হতে নেই। এই মুহূর্তে আশেপাশে কোনো মেয়ে না থাকা সত্ত্বেও ইনারার ঈর্ষা হচ্ছে। যদি কেউ সভ্যকে এভাবে দেখে তার প্রেমে পড়ে যায়?

সভ্যও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ইনারার দিকে। তাকে বাস্তব মনে করাটা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল সভ্যর পক্ষে। এত সৌন্দর্য প্রকৃতি কীভাবে সয়? সাদাতে তাকে পবিত্র ও নিষ্পাপ দেখাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল মেঘের কোল থেকে এই মাত্র কোনো রাজকন্যা নেমে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে মোহে ডুবে তাকিয়ে রইলো ইনারার দিকে। যতক্ষণ পর্যন্ত সে সভ্যর ঘোর না ভাঙলো,”সভ্য ডেকেছিলেন?”
“হঁ?”
“ডেকেছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
ইনারা ভাবে হয়তো চিঠি সম্পর্কে কথা বলার জন্যই ডেকেছে সভ্য তাকে। সে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “আপনি কী চিঠিটা নিয়ে….” সে থেমে যায়। রুমে আজমল সাহেবকে দেখে অবাক হয়, “আপনি এখানে?”
সভ্য ইনারাকে ভেতরে যাবার রাস্তা করে দেয়, “আমি আজমল সাহেবকে ডেকেছিলাম।”
ইনারা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। সভ্য বলে, “আমি তৈরি হয়ে বের হচ্ছিলাম তখন ক’দিন আগের একটা রিউমারের কথা মনে পড়ল, যে আজমল সাহেব তোমার আত্নীয় হয় তাই তোমাকে এত জলদি তার সিনেমার জন্য নিয়েছে।”
“হ্যাঁ, আর এই গুজব কে ছড়িয়েছে তাও আমি জানি। এ নিয়ে কি আবার কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“আমার তখন মনে পড়ে আজমল সাহেব অনেক বছর পূর্বে আমাকে জানিয়েছিলেন তার ভাই নায়ক ছিলো আর তার ভাইয়ের নাম হলো ইমতিয়াজ চৌধুরী। সে তোমার আপন চাচা হন।”
কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। নিজের কানকে বিশ্বাস করাটা একটু কঠিন হয়ে পরছিল তার জন্য। এক বছর যার সাথে সে কাজ করেছে সে তার পরিবার। অথচ সে জানতোই না?

আজমল সাহেবের মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কান্না করে দিবে, অথবা করেছে। সে কাঁপানো গলায় বলল, “আ-আমার প্রতি মুহূর্ত এমন মনে হতো তুমি আমার আপন কেউ। তোমার চোখের দিকে তাকালেই আমার ভাইয়ের কথা মনে পড়তো।”
ইনারা তাও নড়ে না। সে কতকিছু ভেবে রেখেছিল এই মুহূর্তের জন্য। যখন সে তার পরিবারের সন্ধান পাবে তখন সে খুশিতে আত্নহারা হবে, লাফালাফি করবে, সবাইকে যেয়ে জড়িয়ে ধরবে। অথচ আজ এই মুহূর্ত আসার পর তার জন্য নড়াটাও যেন কঠিন হয়ে গেছে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে সে।
সভ্য ইনারাকে দেখে কিছু মুহূর্ত। তাকে এভাবে একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে নিজেই তার হাত ধরে আজমল সাহেবের সামনে দাঁড় করায়। ও বলে, “আমি উনাকে সব জানিয়েছি।”
আজমল সাহেব এগিয়ে আসেন। কাঁপা-কাঁপা হাতে ইনারার মাথায় হাত রেখে বলে, “আমাকে ক্ষমা করে দেও, তুমি এতকিছু সহ্য করলে অথচ আমি তোমার পাশেই ছিলাম না। ভাইয়ার পর আমার উচিত ছিলো তোমাকে দেখাশোনা করা, তোমাকে রক্ষা করা, তোমার যেন বাবার কমতি অনুভূতি না হয় তার খেয়াল রাখা কিন্তু আমি তা করতে ব্যর্থ।”
অনেকক্ষণ ইনারা তাকায় আজমল সাহেবের দিকে। ছলছলে তার নয়ন দুটো। সে ভেজা কন্ঠে বলে, “এভাবে বলবেন না। আপনি কিছু জানতেন না আমার ব্যাপারে।”
“হয়তো শুরুতেই নিজের সকল দায়িত্ব থেকে মুখ না ফেরালে জানতে পারতাম। এত আমি এটা বলতে পারতাম আমার কাছে তোমার মতো একটা লক্ষ্মী মেয়ে আছে।”
কথাটা শুনে আর ইনারা নীজেকে আটকে রাখতে পারে না। দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে শব্দ করে কান্না করে দেয়। আজমল সাহেব তার মাথায় হাত রেখে নিজেও কান্না করে দেন, “তোমাকে বলেছিলাম না তোমার চোখ দুটো দেখে খুব কাছের কারো কথা মনে পড়ে যায়? আমার ভাইয়ের কথা বলেছিলাম। তোমার বাবার কথা। আমার কাছে তার চোখগুলো সবচেয়ে সুন্দর লাগতো। তুমি তার চোখ পেয়েছ।”
ইনারার কান্না কমে না, আরও বাড়ে।
“বাবাও আজ এখানে থাকলে কত খুশি হতেন তাই না? আমি কখনো তাকে দেখি নি। একটিবার তাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আজ আর তা সম্ভব না। তাকে আমি কখনো চেয়েও একটিবার ছুঁতে পারব না।” বলে কান্না করে দেয় ইনারা।
তার কান্না দেখে যেন আজমল সাহেবের বুক কেঁপে উঠে তারও আজ নিজের ভাইয়ের কথা খুব মনে পড়ছে। সে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ইনারাকে, “আমি আছি তো। তোমার চাচ্চু। তোমার বাবার সব দায়িত্ব আজ থেকে আমি পালন করব।”
.
.

সুরভী ইনারার রুমে খুঁজে তাকে। পায় না। রাত বারোটা হতে চলল। তার জন্য বিশেষ আয়োজন করেছিল সে এবং সভ্যর বন্ধুরা। কিন্তু মনে হচ্ছে তাদের কোনো পরিকল্পনাই ঠিক হবে না। কিছুক্ষণ পর সে তাকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে দেখে। তার সাথে সভ্য ছিলো। কিন্তু সে এটা দেখে অবাক হলো যে তার সাথে আজমল সাহেবও আছেন।

এই মুহূর্তে বাগান ছেড়ে সকলে দাঁড়ানো ড্রইংরুমে। বাহিরের সকলে চলে গেছে। আছে কেবল সভ্য ও ইনারার কাছের মানুষেরা। তবে রাত গভীর হওয়ায় দাদাজান এবং দাদীজান ঘুমিয়ে পরেছেন। ভেতরেও কিছুটা ডেকোরেশন করা হয়েছে। হাল্কা রঙের। রুমের মাঝখানে, ঠিক ঝাড়বাতির নিচের এক টেবিলে রাখা হয়েছে একটি সাদা রঙের কেক। যার ডিজাইন ইনারার চুলে লাগানো ফুলের মতো।

সিঁড়ি দিয়ে নামছিল ইনারা। সে আজমল সাহেবের বাহু ধরে নিচে নামছিল। সভ্য ছিলো আজমল সাহেবের অপরপাশে দাঁড়ানো। সবাই তাদের সাথে আজমল সাহেবকে দেখে খানিকটা অবাক হয়। সামি তো সরাসরি জিজ্ঞেসই করে নেয়, “সভ্য আর ইনারার তো একসাথে আসা বুঝলাম। আজমল সাহেব তোমাদের সাথে কেন? ইনারা তুমি কি বিয়ের মধ্যে তোমার নেক্সট স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ করতে শুরু করে দিলে?”
ঐশি পাশ থেকে তার পেটে ঘুষি মেরে বলে, “চুপ কর।”

সুরভি দৌড়ে আসে ইনারার কাছে। এসেই ইনারার হাত ধরে অস্থির গলায় বলে, “এতক্ষণে এলি? তোকে খুঁজে আসলাম মাত্র। আচ্ছা শুন আমরা সবাই মিলে একটা জিনিস প্লান করেছি…” সেখানেই সুরভিকে থামিয়ে দেয় সভ্য, “সুরভি একটু সময় দেও।”
সুরভি থেমে যায়। সভ্যর হঠাৎ করে এভাবে বলাটা খটকা লাগে সুরভীর। ইনারাকে এই মুহূর্তে একটু অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে তার কাছে। ভয় পেতে শুরু করে সুরভি। সভ্যকে চিঠি দিয়েছিল ইনারা। সে চিঠি নিয়ে তো দুইজনের মাঝে কোনো সমস্যা হয় নি?

সভ্য একটু এগিয়ে যেয়ে দাঁড়ায় কক্ষের মাঝখানে। পকেটে হাত রেখে সকলের সামনে উচ্চস্বরে বলে, “আপনাদের মাঝে অনেকেই ইনারাকে ভালো করে চিনে, আবার অনেকে ইনারার অতীত সম্পর্কে কিছুটা জানেন। কিন্তু এতটুকু জানতেন ইনারার আপন পরিবার ছিলো না।”
এই কথা শুনেই ক্ষেপে যায় সভ্যের মা, “পরিবার ছিলো না মানে? তাহলে আমরা কী?”
“আহা মা হাইপার হবার প্রয়োজন নেই। সম্পূর্ণ কথা তো শুনো। ওর অতীতের কথা বলছি। কিছু কারণের জন্য ইনারা কখনো তার আসল বাবার পরিচয় জানতে পারে নি। কিন্তু আজ ওর বাবা এবং বাবার পরিবারকে পেয়েছি। আজমল সাহেব ইনারার আপন চাচা হন।”
“বলিস কী?” সভ্যর মা এগিয়ে যায় ইনারার দিকে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “সত্যি।”
ইনারা খুশিতে বাচ্চাদের মতো হেসে মাথা নাড়ায়। মা অনেক খুশি হয়। মা আজমল সাহেবকে বলেন, “তবে আপনি আমার বেয়াই হলেন। আপনি ওর চাচা হতে পারেন কিন্তু আমি আগে দিয়ে বলে দিচ্ছি ও সবার পূর্বে আমার মেয়ে। তাই ওর উপর আমার অধিকার বেশি কিন্তু।”
আজমল সাহেব হাসেন, “আসলে এখন আমার কি বলা বা করা উচিত আমি জানি না। তবে একটা কথা বলবো, এখানে এসে আমি দেখেছি আপনারা ওকে কত ভালোবাসেন। আমার ওর জন্য এক মুহূর্ত চিন্তা করারও প্রয়োজন নেই। কারণ আমি জানি যাই হোক না কেন, আপনারা সবসময়ই ওর পাশে থাকবেন। ও অনেক ভাগ্যবান আপনাদের মতো পরিবার পেয়ে।”
মা হাসলেন।

সভ্যর বাবা জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু আমরা তো ইনারার বাবার নামটা জানলামই না।”
“ইমতিয়াজ, ইমতিয়াজ চৌধুরী। আপনাদের সময়ের অনেক বড় নায়ক ছিলেন।” আজমল সাহেব জানালেন। ইনারা সাথে যোগ করে, “আব্বু আপনি আমাকে যে বলেছিলেন আমার চোখ একজন নায়কের সাথে মিলে। আপনি কি…”
“হ্যাঁ আমি ইমতিয়াজ চৌধুরীর কথাই বলছিলাম। কী আশ্চর্যজনক ঘটনা! আমি তো সাধারণভাবেই বলেছিলাম আর তা সত্যি হয়ে গেল। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমাদের যুগের জনপ্রিয় নায়ক নায়িকা আমার আত্নীয় লাগে। বাহ!”
ইরফানও বলে, “এজন্যই তো বলি ইনারা এত সুন্দর হয়েছে কোথা থেকে। সাইয়ারা ম্যাম এবং ইমতিয়াজ স্যারের মেয়ে তো সবচেয়ে সুন্দর হবেই।”
ঐশি ইরফানের দিকে তাকায় চোখ রাঙিয়ে। সাথে সাথে ইরফান বলে উঠে, “ভাই…ভাবি…ইনারা ভাবি।”
“গুড।”
আজমল সাহেব সভ্যের মা’কে জিজ্ঞেস করেন, “আপা কিছু মনে না করলে আমি কী আগামীকাল সভ্য এবং ইনারাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি? আসলে আমাদের আর কেউ তো নেই। মা খুব অসুস্থ থাকে। ভাইয়ার মৃত্যুর পর থেকেই তার অসুস্থতা। ইনারাকে এক মুহূর্তের জন্য দেখলেও শান্তি পাবে। আমিব্জানি আগামীকাল বিয়ের অনুষ্ঠান আছে। জলদিই এসে পরবে।”
“আপনি অনুমতি কেন নিচ্ছেন? আপনার মেয়ে আর ঘরের জামাই। যখন, যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যান।”

সুরভি ইনারাকে একপাশ জড়িয়ে ধরে বলে, “আমি তোর জন্য অনেক হ্যাপি জানু।” আবার মুহূর্তখানিক পর তাকে ছেড়ে বলে, “কিন্তু এখন কি আমরা আমাদের প্রোগ্রাম শুরু করতে পারি? আর কিছুক্ষণ বাকি আছে। কেক কাটা শেষে আমরা সকলে আবার ইমোশনাল গল্প করব, ওকে?”
সুরভির কথা শুনে হেসে দেয় সকলে।
সভ্যের মা জিজ্ঞেস করেন, “তো তোমাদের প্রোগ্রাম কীভাবে শুরু হবে?”
“দুলাভাই ইনারার হাত ধরে এদিকে আসুন।”
সভ্য অবাক হয়, “কেন?”
“আহা এত প্রশ্ন না জিজ্ঞেস করে আসুন তো।”

আজমল সাহেব ইনারার হাত সভ্যর হাতে তুলে দিলেন, “যাও বাবা।”
সভ্য ইনারার হাত ধরে এগোতেই আশেপাশে লাইটগুলো বন্ধ হয়ে গেল। মাঝখানে একটি গোলাকৃতির বাতি জ্বলল। ইনারা ও সভ্য অবাক হয়। তাদের আশে পাশে তাকাতেই গান শুরু হয়,

“তুমি না ডাকলে আসব না, কাছে না এসে ভালোবাসব না
দুরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?
না কি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়?
দূরের আকাশ নীল থেকে লাল, গল্পটা পুরনো
ডুবে ডুবে ভালোবাসি, তুমি না বাসলেও আমি বাসি…”

গানটা শুনতে অবাক হয়ে দুইজন। তাদের প্রথম গানে নাচা, কাছে আসা, হৃদয়ের স্পন্দন দিশেহারা হওয়া। কয়েক বছর আগে এভাবেই দুজনে এই গানে তালে তাল মিলিয়ে নেচেছিল। হারিয়ে গিয়েছিল একে অপরের মাঝে।

পিছন থেকে উচ্চ শব্দ এলো। সভ্য ইনারার বন্ধুবান্ধবরা তাদের নাচার জন্য শব্দ করছে। হৈ হুল্লোড় শুরু করে দিয়েছে। শব্দ শুনে ঘোর ভাঙে দুইজনের। ইনারা সামনা-সামনি দাঁড়াল সভ্যর। তার হাত সভ্যর কাঁধে রাখল। সভ্যও আলতো করে হাত রাখে তার কোমরে। গানের সুরে হাল্কা দুলতে থাকল তারা। চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয় ইনারা। তার হৃদয়ের অবস্থা করুণ। তার হৃদয়ের স্পন্দন দিশেহারা হয়ে আছে। আবারও।

ইনারা সভ্যকে মৃদুস্বরে বলে, “ধন্যবাদ। আপনার জন্য না হলে, আজ আমি হয়তো এখানেই উপস্থিত থাকতাম না। আর না আজ এতকিছু পেতাম আমার জীবনে।”
সভ্য চুপ থাকলো। কিছু বলল না।
ইনারা আবার আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “চিঠিটা কী পেয়েছেন?”
সভ্য এবারও উওর দেয় না। ইনারা আবারও জিজ্ঞেস করে, “আমি ওখানে যা লিখেছি তা নিয়ে কিছু বলবেন না?”
“হাতের লেখা দেখে মনে হয়েছে কাক কাগজের উপর হেঁটে গেছে আর তুমি তা আমাকে ধরিয়ে দিসো।”
কথাটা শুনে ইনারা হা হয়ে যায়। সে নাচ ছেড়ে পিছিয়ে যায়। উচ্চ স্বরেই বলে কী বললেন আপনি? আমার হাতের লেখা কাকের ঠ্যাংয়ের মতো?”
“ঠ্যাং আবার কী?”
“ঠ্যাং মানে পা। কিন্তু কথা তো ওটা না, কথা হচ্ছে আপনি এটা বললেন কীভাবে? সাহস কত বড় আপনার?”
“সত্যি বলায় সাহস আসে কোথা থেকে?”
“ওহ প্লিজ এক মহান মানুষ বলেছে ট্যালেল্টেড মানুষদের হাতের লেখা একটু এমনই হয়।”
“আর সে মহান মানুষ কে শুনি?”
“আমি, আর কে?”
“এটা কী জোক ছিলো?”
ইনারা রাগে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলে, “আমার হাতের লেখা কাকের ঠ্যাংয়ের মতো হলে আপনার…আপনার মুখ ব্যাঙের ঠ্যাংয়ের মতো।”
“এই মেয়ে এই ঠ্যাংঠ্যুং এর মতো শব্দ আমার সামনে ব্যবহার করবে না।”
“একশোবার করব।”
সুরভি পাশ থেকে বলে, “আরে এত রোমেন্টিক মোমেন্ট ছেড়ে কেউ এভাবে ঝগড়া করে? এট লিস্ট এই বিয়েতে ঝগড়াটা না করলেন।”
ইনারা বলে উঠে, “ধ্যুর বিয়েই করব না এই ছাগলের সাথে।”
সভ্য চোখ বড় করে নেয়, “তুমি আমাকে সবার সামনে এসব ফালতু কথা বলবে আর আমি চুপ থাকব না’কি? আমারও তোমাকে বিয়ে করার কোনো শখ নেই।”
“আমি যেন বিয়ের জন্য মরে যাচ্ছি।
“ওহ প্লিজ, তোমার কথাতেই এই বিয়েটা হচ্ছে।”
“ওটাই তো সব আমারই করতে হয়। আপনি তো এই এত বড় নাকটায় শুধু এক ডজন রাগ নিয়ে ঘুরতে পারেন।”
“তোমাকে আমি…”
সুরভি দুইজনের মাঝে এসে দাঁড়ায়, “হয়েছে হয়েছে, অনেক ঝগড়া হয়েছে। বারোটা বাজতে এলো। আমরা কেক কাটি এখন?”
সুরভি দুইজনের হাত ধরে কেকের সামনে নিয়ে যায়। ছুড়িটা ইনারার হাতে দিয়ে বলে, “চুপ করে কেক কাট। একটা কথাও বলবি না আর। সবাই বার্থডের গান গাই, আসুন।”

সকলে বার্থডের গান গায়। ইনারার কেক কাটতেই হাততালি দেয় সবাই। ইনারা কেক কেটে সবার আগে সভ্যর মা, বাবা ও নিজের চাচাকে খাওয়ায়। সুরভি তাকে বলে,”ভাইয়াকে কেক খাওয়া।”
“ওই শয়তানের হাড্ডি কি করেছে দেখিস নি? খাওয়াব না।”
“তুইও কম করিস নি।”
“আগে ও শুরু কর…”
“চুপচাপ যেয়ে খাওয়া।” ধমক দিয়ে বলে সুরভি।

ইনারা না চাওয়া সত্ত্বেও যায় সভ্যের কাছে। মুখ বানিয়ে কেকটা সভ্যের দিকে এগিয়ে বলে, “খেয়ে নিন।”
সভ্য বিরক্তির সুরে বল, “এভাবে পেঁচার মতো মুখ করে বললে কার খেতে মন চাইবে?”
“আমি পেঁচার মতো মুখ করে বলেছি?” ইনারা এক দুই না ভেবে সম্পূর্ণ কেক মাখিয়ে দিলো সভ্যর মুখে। আর রেগে বলল, “এবার ভালো মতো খান।”
বলে সে রাগে উপরে চলে যায়।

সকলে কান্ডটা দেখে হতবাক হয়ে গেল। বিশেষ করে সভ্যর মা বাবা। এর মধ্যে আজমল সাহেব বললেন, “রাগও একবারে ভাইসাবের মতো। ভয়ংকর।”
সভ্যর মা বাবা তাকায় তার দিকে। তাদের দেখে আজমল সাহেব জোরপূর্বক হাসেন।

সামি দৌড়ে আসে সভ্যর কাছে, “তো তোকে ডিট্টো ভূতের কপি লাগছে।”
সভ্য রাগে কটমট করে তাকায়। সাথে সাথে সে টিস্যু দিয়ে বলে, “এভাবে রাগে তাকাইস না। বুকের ভেতর ভয়ে কাঁপে। আর রাগ বাদ দিয়ে যেয়ে ভাবিকে মানা। সেই রাগ করে গেছে।”
সভ্য তার মুখ মুছতে মুছতে বলে, “যেন ওর রাগে আমার কিছু আসে যায়। ওকে আমি দেখছি।”

সভ্যও দৌড়ে উপরে যায়। ইনারার কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী সমস্যা তোমার?”
“আপনার কী সমস্যা? আমি আপনাকে নিজের মনের সব কথা চিঠিতে লিখে দিলাম কিন্তু আপনি এমন ব্যবহার করছেন যেন আপনার উপর তার কোনো প্রভাবই পড়ে নি?” ইনারাও রেগে বলে।
“তাহলে আমার কীভাবে রিয়েক্ট করা উচিত শুনি?”
“অন্তত এভাবে না। প্লিজ আপনি যান। অলরেডি আমার মুড নষ্ট করে যেয়েছেন। আমার বিশেষ দিনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন।” অন্যদিকে তাকিয়ে বলে ইনারা।
“তুমি আগে আমার সাথে কথা বলো।”
“বলবো না, যান তো।”
“বলবে না?”
সভ্য ইনারার হাত ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়৷ ইনারা ঠেলে দূরে সরাতে চাইলে সভ্য তার কোমরে হাত রেখে নিজের কাছে টেনে আনে এবং হঠাৎ করেই তার ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে বসে। আবার তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “কথা বলবে না?”
আকস্মিকভাবে সভ্যের এমন কান্ডে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ইনারা। সে গোল চোখ করে তাকিয়ে রইল সভ্যর দিকে। সভ্যকে এত কাছে দেখে তার যেন নিশ্বাস আটকে আসছে। সে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। সে কাচুমাচু করতে শুরু করলেই সভ্য তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। ইনারা সভ্যর ব্যবহারে ভীষণ অবাক হয়। প্রথমে তার চিঠির ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া, তার পর তার সাথে এভাবে ঝগড়া করা, এখন তার এত কাছে আসা। চলছেটা কি সভ্যর মাথায়?

চলবে…

[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here