অনুভবে (২য় খন্ড) পর্ব ৪১

0
1133

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৪১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ইনারা সভ্যর ব্যবহারে ভীষণ অবাক হয়। প্রথমে তার চিঠির ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া, তার পর তার সাথে এভাবে ঝগড়া করা, এখন তার এত কাছে আসা। চলছেটা কি সভ্যর মাথায়?

ইনারা বলতে নেয়, “আপনি ঝগড়ার মাঝে হঠাৎ এমন… ” সম্পূর্ণটা বলার পূর্বেই সভ্য তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। স্তব্ধ হয়ে গেল ইনারা। শিউরে উঠলো। এর থেকেও বেশি চমকিত হলো। হঠাৎ কেউ এমন করে? তাও গম্ভীর ঝগড়ার মাঝে? তবুও সে সরাল না সভ্যকে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করল তার স্পর্শ। যখন সে হাত এগিয়ে ধরল সভ্যর কোর্টটা, তখনই সভ্য তাকে ছেড়ে দেয়৷ ইনারা চমকে তাকিয়ে রয় সভ্যর দিকে। সভ্য তাকে আর একটা কথাও বলে না, সেখান থেকে চলে যায়। ইনারা কেবল হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো সভ্যর যাওয়া দেখে।
.
.
সকাল সকাল রওনা হবার জন্য বের হলো ইনারা। আজমল সাহেবের ঠিকানা অনুযায়ী যাবার কথা তাদের। ইনারা জলদি করে তৈরি হয়ে নিচে নামলো। গাড়ির দরজা খুলে সভ্যকে দেখে খানিকটা স্তব্ধ হয়ে গেল। ভাবল গতকালের কথা। তারপর ভেতরে ঢুকে বসলো। সভ্যর দিকে তাকায় সে, কিন্তু সভ্য একপলকও তার দিকে তাকায় না। এবার ইনারারও জেদ উঠে। ভেংচি কেটে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

সারা রাস্তা চুপচাপ কাটে দুইজনের। তাদের প্রায় তিন ঘন্টা লাগে গন্তব্যে পৌঁছাতে। ইনারা দেখতে পায় আজমল সাহেব তাদের বরণ করার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন মুখ্য দরজায়। তাদের দেখে একগাল হেসে এগিয়ে আসে। তাদের খুশিমনে নিয়ে যায় বাড়ির ভিতর। বাড়ির কাঠামো একটু পুরনো দিনের মতো। কিন্তু আসবাবপত্র সব নতুন। ইনারা এই কথা চিন্তা করতে করতেই আজমল সাহেব বলেন, “এটা আমাদের দাদার কালের বাড়ি। খুব পুরনো। আমার আরেক বাড়ি ফিল্মসিটির পাশে আছে। কিন্তু মা এই বাড়ি ছেড়ে যেতে চান না। বলেন, মরলে এই বাড়িতেই মরবো, তাও বাড়ি ছেড়ে যাব না। একারণে ফিল্মের শুটিং থাকলে আমি ওই বাড়িতে থাকি এবং না হলে এই বাড়িতে।”
“আপনাদের পরিবারের আর কেউ থাকে না?”
“পরিবারে তো আর কেউ নেই। বাবা একা সন্তান ছিলেন আর আমরা দুই ভাই। ভাইয়া কতবছর পূর্বে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আর আমার কখনো পরিবার হয় নি তাই আমাদের আর কেউ নেই। কিন্তু এখন তোমরা আছো।”
আজমল সাহেব হেসে ইনারা ও সভ্যর দিকে তাকিয়ে বললেন। কথা বলতে বলতে রুমে এসে পড়লেন তিনজন। দরজায় দাঁড়িয়েই দেখতে পায় বিছানায় শুয়ে আছে একজন বৃদ্ধ মহিলা। তার পা টিপে দিচ্ছে আরেকটি মাঝারি বয়সের মেয়ে। তাদের তিনজনকে দরজায় দেখতেই মেয়েটি মাথায় কাপড় দিয়ে নিলো। আজমল সাহেব পরিচয় করাল তাদের, “ও হলো মিতু। এই বাড়িতেই থাকে এবং মা’য়ের দেখাশোনা করে।”
মেয়েটি সালাম দিলো সবাইকে।

“কে রে? আজু তুই আসছিস?” বৃদ্ধ মহিলাটা উঠে বসার চেষ্টা করে। না পারায় মিতুই তাকে ধরে বসায়। আজমল সাহেব এগিয়ে যেয়ে তার বিছানার পাশে দাঁড়ায়। তার হাত ধরে বলে, “মা তোমাকে বলেছিলাম না আজ এক বিশেষ অতিথি আসবে। দেখ নিয়ে এসেছি। ইনারা এদিকে আসো।”
ইনারা সামনে এগোল। আজমল সাহেব তাকে বললেন বিছানায় বসতে। সে বসলোও। কিন্তু চোখ নিচু করে রাখল। কেমন জানি অনুভূতি হচ্ছে। অদ্ভুত। তার সামনে বসা বৃদ্ধ মহিলাটা তার দাদী হয়। সে কখনো তার মা’কে মেনে নেয় নি। মা’য়ের জন্য তার আপন ছেলেকে এতবছর দূরে রেখেছে। একবার খোঁজও নেয় নি। তাহলে তাকে কী মেনে নিবে?

“কে ওরা? তোর সঙ্গে কাম করে?” দাদী বললেন। আজমল সাহেব ইনারাকে জানালেন তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকেই দাদী খুব জলদি সবাইকে ভুলে যান। কিছু মনে রাখতে পারেন না। কাউকে মনে রাখতে পারেন না। আজমল সাহেব দাদীকে আবার জানান, “মা ওর নাম ইনারা। তোমাকে আজ সকালে বলেছিলাম না ওর কথা? ও তোমার নাতনি হয়। ইমতিয়াজ ভাইয়ের মেয়ে।”
“ইমতিয়াজের মাইয়া? আমার নাতনি?”
মহিলাটা খপ করে ইনারার হাত ধরে। হাত ধরতেই ইনারা মুখ তুলে তাকায় তার দিকে। খুশিতে মহিলাটার চোখ জ্বলজ্বল করছে। সে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আমার নাতনি? আমার ইমতিয়াজের মাইয়া?”
ইনারা প্রথমে কিছু বুঝতে পারল না। তারপর মাথা নাড়ালো।
দাদী ইনারাকে খুব ভালো করে কয়েক মুহূর্ত দেখলো। তারপর নিজেই বলল, “হো ওই আমার ইমতিয়াজের মাইয়া। সেই চোখ, সেই নাক। আমার ইমতিয়াজের মাইয়া ওই।” বলে ইনারার গাল ধরে তার সারামুখে চুমু খেল। তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে শুরু করলেন সে। তার কান্নায় হাহাকার করে উঠে ঘরের চার দেয়াল।

ইনারা সেই মুহূর্তেও বুঝতে পারছিল না কি করা উচিত তার। অজান্তেই তার চোখ ভিজে গেল। দাদী তাকে ছেড়ে যখন বললেন, “তোমার রঙরূপ একবারে তোমার মা এর মতো হইসে। কী সুন্দর! তোমার মা আইসে?”
“আমার মা?” ইনারা তাকাল আজমল সাহেবের দিকে। সে বললেন, “মা প্রায়শ্চিত্ত করছে তোমার মা’য়ের সাথে তার ব্যবহার করার জন্য। একবার কেবল তার সাথে দেখা করে চেয়েছিল কিন্তু এর আগেই উনি…” বলতে বলতে চুপ হয়ে গেলেন তিনি। ইনারা তার কথাটা বুঝতে পারল। সে দাদীর হাত ধরে বলল, “উনি আসেন নি।”
“আর আমার ইমতিয়াজ ওই আসছে?”
ইনারা মাথা নাড়াল। আসে নি। সে বলল, “পরে আসবে দাদী।”
“দাদী! আজমল শুন ওই আমারে কী কইসে? দাদী। আমারে দাদী কইসে। আমার কলিজার ভেতরটা ঠান্ডা হইয়া গেল। আমার নাতনি আমারে দাদী কইয়া ডাকছে। আমার পোলার কোনো সন্তান দেখার লাইগা আমার কলিজা পুইড়া যাইতাছিল। আর আজ আমার ইমতিয়াজের মাইয়া আমার কাছে আছে। বু তুই আমার কাছ থেকে দূরে যাইস না।”
বলে আবার জড়িয়ে ধরলেন তাকে।

ইনারাও কান্না করে দিলো। খুশির কান্না। এই জীবন আস্তে আস্তে তার সব ছিনিয়ে নিয়েছিল। রেখে গিয়েছিল কেবল দুঃখ কিন্তু আজ এতো বছর পর মনে হচ্ছে এই জীবন তাকে জীবনের সকল শান্তি একসাথে ফিরিয়ে দিচ্ছে।
ইনারাও জড়িয়ে ধরল দাদীকে। কিন্তু হঠাৎ দাদী তাকে সরিয়ে দিলেন। কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কে? তুই এখানে কী করছিস?আজমল এই মাইয়া কে?”
“আমার অতিথি মা। পরে আবার পরিচয় করিয়ে দিব। তুমি এখন আরাম করো।”

আজমল সাহেব ইনারাকে বললেন, “উনি তোমার সব ভুলে গেছেন। চিন্তা করো না তোমাকে দেখতে দেখতে একসময় মনে রাখবে। মন খারাপ করো না।”
ইনারা মাথা নাড়ে, “যে মেয়ে অর্ধেক জীবন তার পরিবারকে কাছে পায় নি তার জন্য এতটুকু মুহূর্তও অনেক।”

আজমল সাহেব ঘর ঘুরিয়ে দেখাতে থাকেন দুজনকে। একসময় তার রুমেও নিয়ে গেলন। সেখানে দেখলেন একটি দেয়ালে বড় ফ্রেমে লাগানো ছবি। ছবিটায় আজমল সাহেব সহ তার বাবা, মা এবং সৌমিতা আন্টি দাঁড়ানো। ছবিটা দেখে সে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। সভ্যও এসে দাঁড়ালো ইনারার পিছনে। ছবিটা দেখে জিজ্ঞেস করল, “সৌমিতা আন্টি এই ছবিতে?”
আজমল সাহেব হাসলেন, “আগে আমরা চারজন একসাথেই থাকতাম অনেক সময়। ভাইয়া, ভাবির জন্য দেখা হতো। অনেক মজা করতাম সবাই একসাথে। এরপর হঠাৎ সব শেষ হয়ে গেল। আমি ভারতে পড়তে চলে গেলাম। আর ভাইয়া ভাবি বিয়ে করার পর মা’য়ের কসমের জন্য কখনো তাদের সাথে কথাও বলিনি। দেশে ফিরে এসেও ভাইয়াকে প্রথম দেখি মৃত অবস্থায়।” দীর্ঘশ্বাস ফেলল আজমল সাহেব। আবার বললেন, “হয়তো আমাদের সবার জীবন আজ অনেক আলাদা হতো। ভাইয়া, ভাবি আমাদের সাথে থাকতো যদি মা বাবা এত কঠিন মন না রেখে ভাবিকে মেনে নিতেন। আমরা ইনারাকে ছোট থেকে বড় হতে দেখতে পারতাম, আদর করতে পারতাম। তাদের এক সিদ্ধান্ত সব শেষ করে দিলো।”
ইনারা এখনো তাকিয়ে থাকে ছবিটির দিকে, “মা বাবাকে একসাথে কত সুন্দর দেখাচ্ছে। যেন একে অপরের জন্যই তৈরি হয়েছিল।”
ইনারা পিছনে ফিরে তাকায় আজমল সাহেবের দিকে, “আপনি আমাকে যে মেয়েটার কথা বলেছিলেন সে কী সৌমিতা আন্টি? যাকে আপনি ভালোবাসতেন?”
কথাটা শুনে সভ্য ও আজমল সাহেব দুইজনই চমকে উঠে। তারপর আজমল সাহেব মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ, কিন্তু কখনো ওকে বলা হয় নি। সৌমিতাও হয়তো বাসতো। ভাবির কারণে প্রায় দেখা হতো আমাদের। চিঠি লেনদেনও হতো, বন্ধু হিসেবে। কিন্তু হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে গেল। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। আমার সামনেই ওর বিয়ে হয়েছিল। ওকে বধূ বেশে ভীষণ সুন্দর লাগছিলো। ওকে দেখার পর অন্যকাউকে এই পরাণ চায় নি। সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এই জন্মে আর কাওকে ভালোবাসবো না। বাসি নি।”
সভ্য জিজ্ঞেস করে, “আপনার খারাপ লাগে না?”
“লাগলে ওর দেওয়া চিঠিগুলো পড়ে নেই। চিঠিগুলো আজও সযত্নে আমার কাছে আছে। এছাড়া ওকে নিজের পরিবারে সুখী দেখেই আমার শান্তি।”
ইনারার মনে পড়ে কীভাবে মিঃ হক সৌমিতা আন্টিকে কষ্ট দিচ্ছিল। কিন্তু সে কিছু বলল না। কেবল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক চিরে।

তারা বিকালেই রওনা দেয়। রাতে আবার মেহেদীর অনুষ্ঠান আছে। ইনারার পার্লারে যেতে হবে। তৈরি হতে হবে। সারা রাস্তা কথা না বললেও হঠাৎ সভ্য বলে, “আমি অন্যগাড়ি আনতে বলছি। তুমি এ গাড়ি নিয়ে যাও।”
“কেন? কেন? কেন?”
ইনারা আতঙ্কিত কন্ঠে এমন প্রশ্ন শুনে অবাক হয় সভ্য, “এমন রিয়েক্ট করছ কেন? আমার এক মিটিং আছে। ওখানে যেতে হবে।”
“বিয়ের সময় আপনার কীসের মিটিং হ্যাঁ?”
“তুমি তো পার্লারে যেয়ে আধাদিন বসে থেকে টাইমপাস করতে পারবে আমি তো আর পারব না। আমার তো সময় কাটাতে হবে।”
ইনারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “কখন মিটিং আপনার?”
“কিছুক্ষণ পরই।”
“আপনি কোথাও যাবেন না।”
“তাহলে কি তোমার সাথে পার্লারে বসে থাকবো?”
“তাই থাকবেন।”
“ইনারা জেদ করো না।”
ইনারা তাকে আর পাত্তা দিলো না। সে ড্রাইভারকে বলল, “ড্রাইভার আংকেল যদি আপনি উনার কথায় গাড়ি থামিয়েছেন তাহলে উনার সাথে আপনাকে রকেটে বেঁধে উড়ায় দিব৷ যেখানে বলেছি ওখানে গাড়ি নিন।”

ইনারা সভ্যকে নিয়ে এলো তার আগের ফ্ল্যাটে। যেখানে পঞ্চসুরের সময় থাকত সভ্য। সভ্য জিজ্ঞেস করে, “গাড়ি এখানে এনে কেন থামালে?”
“সামি এখানে আসতে বলেছিল।” গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলে ইনারা।
সভ্যর চলে যাবার কয়েকবছর পরই তার ফ্ল্যাট কিনে নেয় সামি। সেখানে থাকে। আজ অনেক বছর পর এই বিল্ডিং দেখে সভ্যর তার পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। স্মৃতিগুলো চোখে ভাসে তার।

ফ্লাটের সামনে যেয়ে ইনারা দরজা খুলে। ভেতরে ঢুকতেই চমকে উঠে সভ্য। চারপাশে ফুল ও মোমবাতি দিয়ে সাজানো। আর মাঝখানে টেবিলের উপর একটি কেক রাখা। সে পাঁচ বছর পূর্বে যেভাবে সাজিয়েছিল সম্পূর্ণ ডেকোরেশন ঠিক তেমন। এই দৃশ্যটা দেখতেই পাঁচ বছর পূর্বের কথা মনে পড়ে গেল তার। এখানে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করছিল সে ইনারার। আর মুহূর্তে সব শেষ হয়ে গেল।

ইনারা সামনে এসে দাঁড়ায়। একগাল হাসি নিয়ে। তার হাত ধরে কক্ষের মাঝখানে এসে দাঁড় করায়, “এই দৃশ্যটা মনে আছে আপনার? এভাবেই আপনি আমার জন্য সব তৈরি করেছিলেন তাই না?'”
সভ্য চুপ থাকে। উওর দেয় না।
ইনারা নিজে ঘুরে ঘুরে সব দেখায় ও বলে, “সামির কাছ থেকে ছবি নিয়ে আমি সব সেরকম করেছি। এই’যে এই ফুল, সাদা মোমবাতি, এই সেইম কেক। সব। যেন সেদিন আমাদের জীবনে যা অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছিল তা আজ সম্পূর্ণ করতে পারি। কেবল শেষ একটা জিনিস বাকি।”
ইনারা উত্তেজিত হয়ে একটানা কথা বলে হয়রান হয়ে গিয়েছিলো। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার ব্যাগ থেকে একটি রিং বের করে হাঁটু গেড়ে নিচে বসলো, “আপনি আমায় ঠিক কীভাবে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতেন আমি জানি না। তবে আমি নিজের মতো করে বলি, আপনি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ। আপনি আমার জীবনে সে ব্যক্তি যার নামে আমি নিমিষে আমার সম্পূর্ণ জীবন লিখে দিতে পারি। আমার দুঃখভরা আকাশে সুখের মেঘ আপনিই এনেছেন। আপনি কাছে থাকলে আমি এই পৃথিবীতে নিজেকে সবচেয়ে ভাগ্যবতী বলে মনে করতে পারি। আপনার সাথে যেমন ঝগড়া করতে আমার ভালোলাগে, তেমনি আপনার বাহুডোরে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে আমি ভালোবাসি। আপনিই এই হৃদয়ের স্পন্দনে লেখা। আপনাকে কখনো বলা হয় নি। আজ বলছি, ভালোবাসি….”

সভ্য এখনো চুপ। ইনারা অবাক হয়। এই মুহূর্তে সভ্যর কিছু তো বলা উচিত। সে মশকরা করে বলল, “জলদি বলুন আপনিও আমাকে ভালোবাসেন, নাহয় এভাবে বসে থাকতে থাকতে আমার পা যাবে।”
সভ্য তখনো কিছু বলে না। এবার ইনারার একটু খটকা লাগে। সে উঠে দাঁড়ায়, সভ্যকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কিছু বলছেন না কেন?”
“কী বলবো?”
“কী বলবো মানে? আপনার কী চিঠি পড়ার পর অথবা আজ আমার কনফেশন শোনার পর কিছু অনুভূতি হয় নি?”
“অনুভূতি? আমার তো সকল অনুভূতি তখনই হারিয়ে গিয়েছিল যখন তুমি আমাকে বলেছিলে আমি কেবল তোমার দেহ পাবার জন্য তোমার কাছে আসি।”
ইনারা চমকে উঠে, “কী বলছেন আপনি? এটা তো কত আগের কথা। আমি ভেবেছি আপনি কথাগুলো ভুলে গেছেন?”
“এত সহজে ভুলে যাব? এত সহজ মনে হয় তোমার কাছে? তুমি যা বলেছিলে তা আজ পর্যন্ত আমার কানে বাজে। আমি এসব ভুলতে পারব না। তোমার সিদ্ধান্ত ছিলো এই সম্পর্কটা রাখা, এই বিয়ে করা। এসব যাস্ট ফর্মালিটি আর কিছু না। তোমার জন্য আমার মনে আর কিছু নেই। আর কিছু আসবেও না। এই বিয়েটা এখন নামমাত্র।”
ইনারা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো সভ্যের দিকে। তার চোখে বিস্ময়। এই মুহূর্তটা তার কল্পনা মনে হচ্ছে। কিন্তু এটা কল্পনা না। বাস্তব।

সভ্য আবার তার ঘড়ি দেখে বলল, “আমার মিটিং আছে। দেরি হয়ে যাবে। আমি যাই।”
সে ফিরে যেতে নিলেই ইনারা জিজ্ঞেস করে বসলো, “তাহলে গতরাতের আপনি আমাকে এভাবে হলুদ লাগিয়ে দিলেন কেন, আমার কাছে আসলেন কেন, এভাবে তাকালেন কেন যেন আমি আপনার সম্পূর্ণ পৃথিবী।”
সভ্য দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু ইনারার দিকে তাকায় না, “হঠাৎ করে পুরনো অনুভূতি মনের ফাঁকে উঁকি দেয়। এরপর থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখবো। চিন্তা করো না।”
“আপনি ভুল করেন নি? আপনি অন্য একজনের কথা শুনে আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। কিছু জিজ্ঞেস করেন নি, কিছু বলেন নি। হঠাৎ চলে গেলেন। আপনি না গেলে কি আমাদের জীবনের এতগুলো বছর আলাদা থাকতে হতো?”
সভ্য উওর দিলো না। কিছু বললও না। কেবল বের হয়ে গেল।

ইনারা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। নিস্তব্ধ, নিথর। সেখানেই বসে পড়লো ইনারা। তার এই এক ভুলের মাশুল কতদিন দিতে হবে কে জানে? সভ্য কী আদৌও সব ভুলে তাকে মেনে নিতে পারবে। হঠাৎ ইনারার নিজেকে খুব দুর্বল মনে হচ্ছিল। সে থপ করে নিচে বসে পড়লো।
.
.
সুরভি জলদি করে গাড়ি থেকে নামে। তার লেহেঙ্গাটা উঁচু করে দৌড়ে আসে ভেতরে। সভ্যর বাড়িতে এসেছে সে। সে সামিকে পেয়ে যায় দরজাতেই। অস্থির হয়ে সামিকে জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া এসেছে?”
সামি তার এমন হাঁপানি দেখে বলে, “রিলেক্স হও। এত হাইপার হবার কিছু নেই। সভ্য অনেক আগেই এসে পড়েছে।”
“ভাইয়ার না কাজ ছিলো?”
“যায় নি। সম্ভবত ক্যান্সেল হয়ে গেছে।”
“ওহ।”
“পার্টনার কোথায়?”
“ওঁকে বলেছি মাঝরাস্তা থেকে আমার ফেরত যেতে হচ্ছে। মা’য়ের জরুরি ফোন এলো বলে। বিয়ের ড্রেসটা ওরই এখান থেকে এসে নিতে হবে। আমার ওর মুখ দেখে যা খারাপ লাগছিলো। তুমি কল দেবার পর আমি ওকে তোমার বাসা থেকে জোর করে নিয়ে পার্লারে গেলাম। ও আমায় কিছু বলে নি। কিন্তু মেকাপ করার সময়ও বারবার চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো।”
“আরে কিছু মুহূর্তই তো। তারপর ওর মুখে কেবল হাসির ঝলক দেখবে। তো ভাবি কখন আসবে।”
“এইত্তো এসে পড়বে। আমি পার্লার থেকে বের হওয়ার দশ মিনিট পরই ওকে আসতে বলেছিলাম। এখনই এসে পরবে।”
“আর তুমি এখন বলছ?”
সামি দৌড়ে যায় বাগানের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঐশি ও ইরফানকে বলে, “জলদি সব ঠিক করে ভেতরে চল। জলদি। ইনারা আসছে। জলদি।”

ইনারা গাড়ি থেকে নামলো। তার পরনে হলুদ ও লাল রঙের সারারা। তার সোনালি উজ্জ্বল চুল হলুদ রঙের ফুল দিয়ে বাঁধা। সাজগোজে তাকে রূপসী দেখাচ্ছে। আজ তার জন্য এত বড় দিন বলে কথা। কিন্তু তার ঠোঁটের হাসিটা আজ নেই। মলিন তার মুখ। বিয়ের খুশিটা যেন আর তার মাঝে নেই। সভ্যর মতো তার জন্যও এসব কেবল ফর্মালিটি। এই বাড়িটা দেখে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ইনারার বুক চিরে। দুই বছর পূর্বে এই বাড়িতেই সভ্যের বধূ সেজে পা রেখেছিল সে। তখন তার কোনো স্বপ্ন ছিলো না সভ্যকে নিয়ে। আজ হাজারো স্বপ্ন তার বুকে গাঁথা অথচ তার কাছে সভ্য নেই। এই বাড়িটা দেখতেই কেবল নিশ্বাস আটকে আসছে তার। বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে তার ও সভ্যর স্মৃতিতে ভরা। জলদি করে তার লেহেঙ্গা নিয়ে এখান থেকে বের হলেই হয়। আজ সভ্যর কথাগুলো শোনার পর আর সে এখানে থাকতে পারছে না।

ইনারা ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে নিলেই কিছু শব্দ শুনে বাগান থেকে। গুণগুণ শব্দ। সে বাগানের দিকে যায়। চারদিকে অন্ধকার। তবুও শব্দটার দিকে সে এগোয়। সে জিজ্ঞেস করে, “কে?”
চারদিকে বাতি জ্বলে উঠে। ইনারার সামনে একটি গোল মঞ্চ সাজানো। সাদা ও হলুদ ফুল দিয়ে। সে মঞ্চের ঠিক অপরদিকে বসে আছে সভ্য। কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। তার হাতে একটা গিটার। ইনারা কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই চোখ টিপ দিয়ে গিটার বাজাতে শুরু করে এবং গান ধরে তার জন্য,

“বৃষ্টি নেমেছে আজ আকাশ ভেঙে
হাঁটছি আমি মেঠো পথে
মনের ক্যানভাসে ভাসছে তোমার ছবি
বহুদিন তোমায় দেখিনা যে।

তোমায় নিয়ে কত স্বপ্ন, আজ কোথায় হারাই
পুরানো গানটার সুর, আজ মোরে কাঁদায়।

তুমি তো দিয়েছিলে মোরে কৃষ্ণচূড়া ফুল
আমি তো বসে ছিলাম নিয়ে সেই গানের সুর
তুমি তো দিয়েছিলে মোরে কৃষ্ণচূড়া ফুল
আর কোথাও ফেলে যেও না আমায় বহু দূর…”

ইনারা তাকিয়ে রইলো সভ্যর দিকে। এক দৃষ্টিতে। সভ্য গান গাইতে গাইতেই এগিয়ে এলো তার কাছে। তার গায়ের গিটার রেখে এলো মাঝপথে। টেবিল থেকে তুলে নিলো এক মুঠো কৃষ্ণচূড়া। ইনারার চারপাশে ঘুরে গান গাইতে গাইতে তার উপর বর্ষণ করল কৃষ্ণচূড়া। সে মুহূর্তে ইনারার গালে হাসি ফুটে ওঠে। তার মনে খুশির জোয়ার ভাসে। সে দুই হাত ছড়িয়ে উপভোগ করে কৃষ্ণচূড়ার বর্ষণ। আর তাকায় সভ্যর দিকে। অবশেষে সভ্য থামে। সে ইনারার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার হাত ধরে কাছে টানে। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, এখনও। সভ্য তার দিকে ঝুঁকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদুস্বরে বলে, “ভালোবাসি, আমার মহারাণী।”

চলবে…

[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here