অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৮,৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
৮
সুরভির গাঢ় হাসি আঁকে ঠোঁটের কোণে, “হ্যাঁ, ইনারার সাথে দেখা করে এসেছি।”
শূন্য দৃষ্টিতে সুরভির দিকে তাকিয়ে রইল সাইদ। সুরভির এত সহজে এই উওর দেওয়াটা অবাক করল তাকে। তবুও সে নিজেকে সামলে নেয়। শান্ত গলায় বলে, “ওর সাথে তোর যোগাযোগ আছে।”
“থাকবে না? আমার বেস্টফ্রেন্ড ও।”
তার মা দ্রুত এসে দুইহাত ধরে সুরভিকে ধমকের সুরে বলে, “ওই মেয়ের জন্য একবার প্রিয়’র সাথে কি হয়েছে তাও মনে নেই তোর? তোর কী আমাদের খেয়াল নেই? কীভাবে তুই ওর সাথে যোগাযোগ রাখতে পারিস?”
“যেভাবে তোমার ছেলে তাদের সাথে কাজ করতে পারে।” এই একটা বাক্যতেই মা’য়ের অগ্নি দৃষ্টি নম্র হয়ে আসে। সে আস্তে করে সুরভির হাত ছেড়ে দেয়। সুরভি আবারও বলে, “তুমি আমাকে ইনারার সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য ধমক দিতে পারছ কিন্তু ভাইয়া যে সে খুনিদের জন্য কাজ করে তাকে তো কিছু বললে না?”
“সুরভি!” হাত তুলে নেয় সাইদ। কিন্তু সুরভি চোখ নামায় না, একটুও নড়ে না সেখান থেকে। সাইদের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, “কেন তুমি জানো না তুমি যাদের জন্য কাজ করে তারা প্রিয়’র হত্যা।”
“ও আত্নহত্যা করেছে।”
“ওকে আত্নহত্যা করার জন্য জোর করা হয়েছিল। তোমার প্রেমিকা করিয়েছে।”
“সুরভি নিজের মুখে লাগাম দে। এরপর আমি আর নিজেকে সামলাতে পারব না।”
“আমি আমার চোখের সামনে ওর লাশ….” এতটুকু বলেই সুরভি চোখ বন্ধ করে নেয়। কাঁপা-কাঁপা নিশ্বাস ফেলে সে। আবারও বলে, “ওর আর ইনারার জীবন শেষ করে দিয়েছে তারা। তবুও তুমি তাদের জন্য কাজ করছ! প্রিয় না তোমার ভাইয়ের মতো ছিলো ইনারা না তোমার বোনের মতো? মানে আমার সাথে এমন কিছু হলেও তোনার কিছু আসতো যেত না? আইজাই তোমার জন্য সব তাই না। জানো এই তিনবছরে তোমাকে আমি কেন ভাই ডাকি না? কারণ আমার ভাইও আমার জন্য মরে গেছে।”
কথাটা শেষ হবার পূর্বেই সুরভির গালে জোরে এক চড় পরে।
সুরভির বাবা উঁচু স্বরে বলে, “সাইদ! আমাদের ঘরে মেয়েদের উপর হাত তুলে না। এই শিক্ষা দেই নি তোকে?”
সুরভি বল, “আমাদের তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার শিক্ষাও দিয়েছিলে। কিন্তু সময় আসার পর তো নিজেরাই বেঁধে নিলে।”
“এত মুখে মুখে কথা বলা কবের থেকে শিখেছিস তুই?” সুরভির মা তার উপর আবার হাত তুলতে নিলেই তার বাবা থামায়। সুরভিকে নিয়ে সোফায় বসে তার মাথায় হাত রেখে বলে, “দেখ মা, আমরা তোকে শিক্ষা দিয়েছি। আর সে শিক্ষার মান না রেখে ভুলও করেছি। কিন্তু আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের। এত ক্ষমতাশীল লোকদের সাথে প্রতিবাদ করার মতো শক্তি আমাদের নেই। তারা মুহূর্তে আমাদের পরিবার শেষ করে দিবে। আর সবচেয়ে বেশি চিন্তা তোকে নিয়েই তো। তারা যদি ইনারার মতো তোর সাথেও কিছু… না না ভাবতেই আমার বুক কেঁপে উঠলো। তুই বুঝার চেষ্টা কর মা, এই সমাজ এত সোজা না। চাইলেই সব হয় না।”
“ওকে বুঝিয়ে লাভ নেই। মাথা নষ্ট হয়ে গেছে ওর।” সাইদ ধমক দিয়ে বলল। সে আরও জানাল, “ওর বিয়ের ব্যবস্থা করো। আহনাফ ভালো ছেলে। পড়াশোনা ভালো, বিদেশ থেকে পড়ে এসেছে। বাড়ি আছে, জায়গা জমি সব আছে। ভালো চাকরিও করে। আর আমি খোঁজ নিয়েছি। ছেলের ব্যবহারও ভালো।”
সুরভি সাথ সাথে উঠে দাঁড়ায়, “আমি জানিয়েছিলাম আমি সে লোকের সাথে বিয়ে করব না। লোকটা এখনো তার প্রাক্তনের ছবি ফোনে নিয়ে ঘুরে।”
“সবার অতীত থাকে। এটা কোনো কারণ না এত ভালো ছেলে হাতছাড়া করার।”
“অতীত ভুলে যাওয়া এত সহজ হল তুমি আইজাকে ভুলছ না কেন?”
সাইদ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় সুরভীর দিকে, “ওর সাথে বিয়ে করার পর তুই যা ইচ্ছা তাই করিস। আর না হলে এবার ফোর্থ ইয়ারের এক্সাম দেবার কথা ভুলে যা। এ বাসা থেকে একবারে তখন বের হবি যখন তোর বিয়ে হবে।”
বলেই সে ভেতরে চলে যায়।
সুরভির রাগে কটমট করতে করতে বলে, “ফাজলামো চলছে আমার জীবন নিয়ে? যে কারও সাথে বিয়ে করায় দিবে, বললেই হলো?”
সুরভির মা তাকে আবার সোফায় বসিয়ে বল, “আরে শান্ত হো, দেখ আমিও শুনেছি আহনাফ অনেক ভালো ছেলে। আর ওর পরিবারের প্রশংসা সবার মুখে শুনেছি। মানুষের অতীত তো থাকেই। তোরও হয়তো আগে কেউ পছন্দ ছিলো তাই না?”
“জ্বি না।” রাগে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলে সুরভি।
“আচ্ছা ঠিকাছে ছিলো না। কিন্তু সবার যে থাকবে না এমনও তো না। বিয়ে হলে আগের সব ভুল যাবে। এছাড়া তোকে কি এখন ধরে বেঁধে বিয়ে করাচ্ছি না’কি? তুই আগে ওর সাথে কথা বল, যদি তোর পছন্দ হয় তাহলেই বিয়েটা আগাবো। আর না হলে বিয়ে হবে না। কিন্তু তুই আগে আমার কসম খা ওকে একদম সঠিক সুযোগ দিবি।”
সুরভি উঠে দাঁড়ায় আবারও, “উফফ মা তোমরা যেখানে পারো কসম তুলে আনো। কতবার বলেছি এই কসম জিনিস ভালো না। তাও এতে কসম ওতে কসম, কসমের দোকান বসো একটা। বিরক্তিকর!” বলে সে হনহনিয়ে তার রুমে চলে গেল।
তার মা বসলেন বাবার পাশে। আফসোসের সুরে বলল, “কি শুরু করল এই দুইজন? আমি তো পাগল হয়ে যাব।”
“সুরভি কিন্তু সাইদের কথাটা ভুল বলে নি।” বাবা বললেন গম্ভীর গলায়।
“তা আমিও জানি। কিন্তু কি করব? সাইদ তো আমার কথা শুনতেও রাজি না। এছাড়া ও এখনো সেখানে কাজ করছে বলেই সুরভি সুরক্ষিত আছে। আমার মনে হয় ওর সেখানে কাজ করার কারণ এটাও।”
সুরভি রুমে এসে তার হাতের ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে বিছানায়। রাগে তার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। এই মুহূর্তে তার ভাইয়ের আগে ওই আহনাফকে তার খুন করতে মন চাচ্ছে। অন্যকাওকে ভালোবাসলে তার দরকার ছিলো বিয়ের জন্য হ্যাঁ করে সুরভিকে ভেজালে ফেলার?
তার বাসায় এসে সবার আগে ইনারাকে কল দেবার কথা ছিলো। কিন্তু এত মাথা গরম মেয়ে তার সাথে কথা বলার ইচ্ছা হলো না। মেজাজ খারাপ করে কথা বললে ইনারাও চিন্তায় পড়ে যাবে। এমনিতেই কম চিন্তা নয় তার। এর মধ্যে আরেকটা যুক্ত করার মানে হয় না। এর কারণেই সে আহনাফের ব্যাপারটাও জানায় নি ইনারাকে।
সবার আগে সুরভি লম্বা সময় ধরে গোসল করে তার মাথা ঠান্ডা করার জন্য। রুমে এসে বসতেই দেখে তার ফোনে তিনটা মিসকল। নাম্বারটা তার চেনা নয়। সে কল ব্যাক করে। ফোনের ওপাশ থেকে একটি ভারী কণ্ঠ ভেসে আসে, “আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। জ্বী কে বলছেন?”
“আমি আহনাফ।”
নামটা শুনে অনেকটা বিরক্ত লাগছিল তার। সে কাঠখোট্টা গলায় জিজ্ঞেস করে, “কী চাই বলুন?”
“আমার কিছু চাইনা। আপনার ভাইয়া কল করে বলেছিল আপনি বিয়েতে রাজি। তাই আরুহি আমাকে জ্বালাতন করছিল আপনাকে কল দেবার জন্য।”
সুরভির এত কষ্টে ঠান্ডা করা মাথাটা আবারও গুরম।হয়ে গেল। সে বিরক্তি নিয়ে বলল, “আমি বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলি নি। কথা বলতে রাজি হয়েছি। মা বলেছে কয়েকদিন কথা বলে দেখতে রাজি না হলে বিয়ে হবে না।”
“ওকে।”
“আপনার এতে কোনো সমস্যা নেই?”
“না।”
“কোনো সমস্যাই নেই? আমি আপনার সাথে এত রুক্ষ ব্যবহার করছি তাও না?”
“দেখুন, আমার বিয়ে হবার কারণ আমার বাবা ও বোন। তাদের জন্য আমি বিয়ে করছি। তাই তাদের যাকে পছন্দ তাকেই করব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। তাদের দুজনের আপনাকে অনেক পছন্দ হয়েছে।”
“আর আপনার পছন্দের?”
খানিক্ষন সময় নিলো আহনাফ। তারপর বলল, “আপনি আমার সাথে একজনের ছবি দেখছিলেন। আপনি তা না দেখলেও আমি আপনাকে ওর কথা জানাতাম। আমি একটা জিনিস পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমি যে মেয়েটাকে সে ভালোবাসি। আমার পক্ষে অন্য কাওকে ভালোবাসা সম্ভব নয়।”
“তাহলে বিয়ে করছেন কেন?”
“বিয়েতে ভালোবাসা লাগে না’কি? বিয়েতে দায়িত্ববান হওয়া প্রয়োজন। আমি ভালোই দায়িত্ববান। কেবল ভালোবাসতে অক্ষম।”
সুরভি যায় ব্যালকনিতে। রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। বলে, “নিজের প্রশংসা ও বদনাম একসাথে? ইন্টারেস্টিং। তবে একটা জিনিস ভুল বললেন।”
“কী?”
“বিয়েতে দায়িত্ব পালনের ও ভালোবাসার ক্ষমতা দুটোই প্রয়োজন। আর আমি ভালোবাসা ছাড়া কাওকে বিয়ে করতে পারব না। এই জীবনে কেবল একজনকে ভালোবাসবো বলে বেশিরভাগ ছেলেদের থেকে দূরে দূরে থাকতাম। হাজারো স্বপ্ন সাজিয়েছি সে মানুষটার জন্য। এভাবে সে স্বপ্ন আমি ভাংতে পারি না।”
আহনাফ এবার শব্দ করে হেসে উঠে।
“আমি কি রসিকতা করেছি? হাসছেন কেন?”
“আপনার আর আমার কোনো একদিক থেকে মিল পেলাম বুঝলেন। এই ভাবনাটা আমিও ভেবেছিলাম। যাকে নিয়ে ভেবেছিলাম তাকে পেলাম না। কিন্তু তাকে ভালোবেসেই যাচ্ছি। এমন ভালোবাসাটাই যত কষ্টের গোড়া। তবে আশা করি আপনার ইচ্ছাটা পূরণ হোক। আপনি চাইলেই বিয়ের জন্য না করতে পারে।”
“এখন সম্ভব নয়। ঘরে ঝামেলা হবে। ইমোশনাল ব্লাকমেইল করা হবে। একমাস দেখি, আপনার মত না পাল্টালে মানা করে দিব।”
“আপনি আমার মত পাল্টাতে চাইছেন? আমাকে কি আপনার এতটাই ভাল লেগেছে?”
প্রশ্নটায় হতভম্ব হয়ে গেল সুরভি। খানিকটা অস্বস্তি দেখাল তার মাঝে। সে আমতা-আমতা করে বলল, “এমন কিছু না। যাস্ট কথার কথা বললাম। আচ্ছা ফোনটা রাখি।”
সে আহনাফের উওর পাবার আগেই কল কেটে দিকে য়। বুকে হাত রেখে গভীর নিশ্বাস ফেলে সে। একটু আগেও মনে হয়েছিল তার নিশ্বাস আটকে আছে।
ফোনটা হাতে দেখে তার ইনারাকে কল দেবার কথা মনে পড়ল। কিন্তু সে কল দিলো না। মেসেজ দিলো, “তোর কথানুযায়ী ভাইয়াকে জানিয়েছি যে তোর সাথে আমার দেখা হয়েছে।”
.
.
সভ্য প্রায়ই রাতে বাগানে ঘুরতে বের হয়। হাঁটাহাঁটি করে। আজও এসেছে। এসে দেখে ইনারা সে কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে বসে কেকের সাথে আইস্ক্রিম খাচ্ছে। সে-ও সুযোগ পেয়ে তার সামনে যেয়ে দাঁড়ায়, “লজ্জা করো। আমি এত কষ্ট করে বানিয়েছি আমাকে একবারও সাধলে না।”
কথাটায় ইনারা বিশেষ ধ্যান বলে মনে হলো না। বেখেয়ালি মনে বলল, “আপনার বাড়ি, আপনি রান্না করলেন তাও আপনাকে সাধতে হবে।”
“ভুল বলো নি তো।” বলে সভ্য ইনারার পাশে বসে গেল। তার হাতের থেকে প্লেট নিয়ে নেয়।
ইনারা হতবাক। সে কপাল কুঁচকে তাকায় সভ্যের দিকে, “এটা কোন ধরনের বেয়াদবি?”
“কিসের বেয়াদবি? বাড়ি আমার, বানানো কেক আমার, বউ আমার। নিজের জিনিস নেওয়াতে বেয়াদবি কীভাবে?”
“বলেছি না আমার সামনে এমন বউ বউ করবেন না। বিরক্তি লাগে।”
“আজকাল তো তোমার কথায় কথায় বিরক্ত লাগে। কত বদলে গেছ তুমি।”
“এ বদলানো রূপের আপনিও একটা কারণ।” কথাটা বলতে চেয়েও বলল না ইনারা। চুপচাপ বসে রইলো। তাকাল সে তারা খেলা করা আসমানের দিকে।
আর সভ্য তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তারা ভরা আকাশের নিচে বসে আছে দুইজন। চারদিকে ফুলের ঘ্রাণ ম ম করছে। বাতাসে দুলছে ইনারার কেশ। সে কেশগুলো বারবার তাকে বিরক্ত করছে। তার মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে এবং বিরক্ত করছে। সভ্যের ইচ্ছা হলো সে চুলগুলো তার মুখ থেকে সরিয়ে দিক। পরে সে থামলো। তার ভালো লাগছে এই দৃশ্য দেখতে। মাতোয়ারা লাগছে এই বাতাস যা ইনারার চুলগুলো নিয়ে খেলা করছে। তার মনে হলো মুহূর্তটা এখানে থেমে গেলে খুব ভালো হতো। কিন্তু মুহূর্তটা থামে না।
হঠাৎ ফোনে শব্দ হতেই তার ধ্যান ভাঙে। সে দেখে ইনারা ফোনটা তুলে কিছু একটা পড়লো। মুহূর্তেই তার ঠোঁটের কোণে গাঢ় হাসি এসে উপস্থিত হয়।
তার মনে কৌতুহল জাগে। সে ইনারাকে জিজ্ঞেস করে, “কী দেখে এমন হাসছো?”
“সুরভি সাইদ ভাইয়াকে জানিয়েছে যে ওর সাথে আমার দেখা হয়েছে।”
সভ্য অবাক হয়, “এতে তুমি খুশি?”
“আমিই ওকে বলেছিলাম এমনটা করতে।”
“আর আমি জানি তুমি যে করেই হোক সুরভিকে প্রটেক্ট করতে চাও তাহলে ওকে কেন বলতে বললে?”
“সাইদ ভাইয়া কখনোই সুরভির নাম এসবে আনবে না। আমি জানি।”
“আর তোমার কথা জানানোর কারণটা জানতে পারি?”
ইনারা বাঁকা হাসে, “তাদের আমাকে খুঁজতে হবে না? কাল আমার দেখা পাবে তারা। তবে এতটা সহজে আমি ধরা দিব না। যখন তারা আমাকে পাগলের মতো খুঁজে হয়রান হয়ে যাবে তখন তাদের সামনে যেয়ে হাজির হবো। তারা ভাববে এটা তাদের নিয়তি। কিন্তু তারা এটা জানে না এখন থেকে তাদের নিয়তি ইনারার হাতের মুঠোয় আছে।”
চলবে…
অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“তাদের আমাকে খুঁজতে হবে না? কাল আমার দেখা পাবে তারা। তবে এতটা সহজে আমি ধরা দিব না। যখন তারা আমাকে পাগলের মতো খুঁজে হয়রান হয়ে যাবে তখন তাদের সামনে যেয়ে হাজির হবো। তারা ভাববে এটা তাদের নিয়তি। কিন্তু তারা এটা জানে না এখন থেকে তাদের নিয়তি ইনারার হাতের মুঠোয় আছে।”
কথাটা বলে ইনারা সভ্যের দিকে তাকিয়ে দেখে সে হাসছিল। সে মুখ বানায়, “ওহ এই ডায়লগ দিয়ে একটা কমেডি মুভি বানানো যাবে তাই না?”
“এখানে কমেডির কি ছিলো?”
“তাহলে হাসছেন কোনো দুঃখে?”
“তোমার মুখে এত গম্ভীর কথা শুনে হাসি এসে পড়ে।”
“কেন আমি জোকার?”
“আগে তো এমনই ব্যবহার করতে। একবার দেখতাম এখানে লাফাও, আবার ওখানে। তুমি পাঁচ মিনিটের জন্য বাসায় আসলে নিজের বাসাকে আর চিনতাম না। আর এত কথা বলতে যে মাথা ধরে যেত।”
“এজন্যই তো এখন নিজেকে পরিবর্তন করে নিয়েছি।” বলে ইনারা তাকায় আকাশের দিকে।
ইনারার মুখে কথাটা শুনে সভ্যের ঠোঁটের হাসিটা মলিন হয়ে যায়। সে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে, “একটু বেশিই পরিবর্তন হয়ে গেছ৷ আগের তোমার বিরক্তিতেও একটা মিষ্টি ভাব থাকতো কিন্তু আজকাল তোমার হাসিতেও সে মিষ্টি ভাবটা নেই। তবুও আজ সুরভিকে দেখে তোমার মুখে একটু খুশি দেখতে পেয়েছি। তবুও আগের মতো কিছু নেই।”
“আপনিই একবার বলেছিলেন পৃথিবীটা কঠিন তাই পৃথিবীর সাথে তাল মিলাতে হলে নিজেরও কঠিন হতে হয়। কোমল থেকে নিজের সব হারিয়েছি। আগের ইনারাটা অনেক আগেই মরে গেছে। দফন হয়ে গেছে হৃদয়ের পীড়ার মাঝেই।” ইনারার চোখ নম্র হয়ে এলো। কিন্তু সে এই নম্র দৃষ্টি সভ্যকে দেখাতে চায় নি। সে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে চোখের কোণা মুছে নিলো।
সভ্য বলল, “হ্যাঁ আমি বলেছিলাম। জগৎ এর সামনে কঠিন থাকো, কে মানা করেছে। কিন্তু নিজেকে হারিয়ে নিজের উপর এভাবে অত্যাচারের মানে হয় না। আগের তুমিটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করো।”
ইনারার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি আঁকে। সে হাঁটু ভাঁজ করে। সভ্যের দিকে মুখ করে মাথাটা রাখে হাঁটুর উপর, “আপনি কখনো আপন কাওকে হারিয়েছেন? হারান নি। আপনি এই অনুভূতি কীভাবে বুঝবেন বলুন?”
সভ্য শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তার বুকের ভেতর খানিকটা যন্ত্রণার অনুভব হলো। সে জোরপূর্বক মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়, “ঠিক বলেছ।”
তারপর চোখ নামিয়ে নেয়। ইনারা তো জানে না তাকে হারিয়ে নিজের ভেতটা শূন্য করে বেঁচে আছে সে। বাঁচছে, নিশ্বাস নিচ্ছে, কিন্তু শান্তি পাচ্ছে না। তার মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় ইনারাকে নিজের বুকে ভরে রাখতে, একটুখানি শান্তির উদ্দেশ্যে। কিন্তু চেয়েও তার সাহস হয় না। যদি তাকে চোখের সামনে দেখার ভাগ্যটাও হারিয়ে যায়।
“আপনি মিষ্টি খাবার খাওয়া শুরু করেছেন?” ইনারার কথায় চমকে উঠে সভ্য। সে ইনারার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। উওর না।
ইনারা আবার বলে, “তাহলে অকারণে আমাকে জ্বালানোর জন্য আমার ব্রাউনি এবং আইস্ক্রিম নিয়েছিলেন।”
“ওহ হ্যাঁ তোমার খাবার।” সভ্য প্লেটটা ফিরিয়ে দেয়। ইনারার কথাটা শোনার পরে তার আর কিছু ভালো লাগছে না। অশান্তি লাগছে খুব।
ইনারা বিরক্ত হয়ে বলে, “আপনার চক্করে আমার আইস্ক্রিম গলে গেল। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো।” সে তাকায় সভ্যের দিকে, “আপনি প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে হঠাৎ করে ব্যান্ড ছেড়ে দিলেন। কারণটা কি ছিলো? আপনাদের তো নতুন এলবাম রিলিজ হবার কথা ছিলো। আপনি অনেক এক্সাইটেড ছিলেন।”
“কিছু ব্যক্তিগত কারণ ছিলো।”
“কারও সাথে যোগাযোগ না রাখার জন্যও কারণ ছিলো?”
“তাই ভেবে নেও।!
“এখন বলা যায়?”
“না।” কিছু সময় বিরক্তি নিয়ে সভ্য যোগ করল,
“তবে সবার সাথে যোগাযোগ রাখি নি এমন না।”
ইনারার বুকের ভেতর যন্ত্রণা শুরু হয়। তবে সভ্যর কারও সাথে যোগাযোগ ছিলো? ঐশির সাথে? তা-ই কি স্বাভাবিক নয়? ঐশি তো উনার বিশেষ কেউ-ই।
এরপর কিছু মুহূর্তে নীরবতা ছড়িয়ে যায় পরে মহলে। কারো মুখে কোন কথা নেই। দুইজন চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো।
সভ্য ভাঙল এই বেমানান নিরবতা, “শুনেছিলাম তোমার ও জোহানের বিয়ে হতে যাচ্ছিল। তার কী হলো?”
তাচ্ছিল্য হাসে ইনারা, “মজার ছোট গল্প শুনাই, এনগেজমেন্ট এর ক’দিন আগে নিউজে খবর পাই জোহান আমার বোনের সাথেই সম্পর্ক আছে। ভেবেছিলাম মিথ্যা। কিন্তু আজ তিনবছর ধরে দেখি তাদের সম্পর্ক ভাঙে নি। যাক, জোহান একজনের সাথে তো এত বছর টিকলো। আচ্ছা বলেন তো এমন এক মুভি বানালে কত হিট খাবে?”
ইনারা কথাগুলো হেসে বললেও সভ্য গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে, “তোমার এই হাসিটায় কষ্ট লুকানো।”
ইনারা তাকায় সভ্যের দিকে, “আপনি সবার হাসির উপর পি এইচ ডি করে রেখেছেন?”
সভ্য ইনারার কাছে এগিয়ে আসে। তার ঠোঁটের কোণে থাকা আইস্ক্রিম নিজের বুড়ো আঙুল দিয়ে মুছে দেয়। বলে, “উঁহু কেবল তোমার।”
ইনারার বুকের ভেতর ধক করে উঠে। হঠাৎ তার মনে হয় তার হৃদয়টা কেউ চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে। এতটা ব্যাথা করছে। কিন্তু সভ্যের শেষ কথায় অদ্ভুতভাবে প্রশান্তিও লাগছে। এমন অনুভূতির অদ্ভুত মিলনটা কি স্বাভাবিক? না তাকে কোনো রোগে ধরেছে। তার ভয় লাগতে শুরু করল। তার মনে হলো সে আবার সভ্যের প্রেমে পড়ছে। নতুন ভাবে। না, একবার ভুল দ্বিতীয়বার করবার মানুষ সে নয়।
“আমার খাবার শেষ, আমি উঠি।” বলে ইনারা যেতে নিলেই সভ্য তার হাত ধরে নেয়।
ইনারা থেমে যায়। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু পিছনে ফিরে তাকায় না সভ্যের দিকে। সভ্যের হাতের স্পর্শ তার আঙুল ছোঁয়াতেই তার হৃদয়ের স্পন্দন কেমন আটকে আসছে।
সভ্য বলে, “সুরভি যাবার পর না তুমি বলেছিলে আমার থেকে আরেকটা সাহায্য লাগবে তোমার?”
ইনারা পিছনে ফিরে তাকায়, “বলেছিলাম।”
“তাহলে এর পরিবর্তে আমায় কি দিবে তুমি?”
সভ্যের প্রতি ইনারার কোমল অনুভূতি আকস্মিকভাবে বিরক্তিতে পরিবর্তন হয়। সে বিরক্তির সুরে বলে, “এই তো পারেন আপনি। একে মোটেও সাহায্য বলে না। একে লেনদেন বলে।”
“তাই ভাবো।” নম্র গলায় বলে সভ্য।
“বলুন কি চাই?”
“বসো।”
“কেন?”
“আমি বলছি বলে।”
ইনারা বিরক্তি নিয়ে বসে। সভ্য তার হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে একপাশে রাখে। ইনারা জিজ্ঞেস করে, “এ-কি করছেন?”
“তোমার লেনদেন।”
সভ্য ইনারার কোলে মাথা রাখে। ইনারার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে তার চুলে রেখে বলে, “হাত বুলিয়ে দেও।”
“কোন দুঃখে?”
“তোমার আমার কাছ থেকে ফেভার লাগবে এজন্য।”
ইনারা বিরক্তি নিয়ে তার মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সভ্য তাকে সাধারণভাবে এ কাজটা করতে বললে তার নিজেরও ভালো লাগতো। কিন্তু তার সাহায্যের বিনিময়ে এমন কিছু করাটা তার মোটেও পছন্দ নয়।
সভ্য তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। গম্ভীর গলায় বলে, “জানো ছোটবেলায় মা প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে এভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। যখন ফাস্ট অস্ট্রেলিয়াতে শিফট হই তখন প্রচুর কান্না করতাম সবার জন্য। মা, বাবা, দাদা, দাদী, ফুপি। সবার জন্য। তখন আমার কেবল বারো বছর। অস্ট্রেলিয়াতে আমার বড় ভাই ছাড়া অন্য কেউ আপন ছিলো না। প্রতি রাতে মা’য়ের এভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পড়ানোর জন্য কান্না করতাম, দাদীর হাতে খাওয়ার জন্য কান্না করতাম, বাবার সাথে খেলার জন্য কান্না করতাম। কিন্তু যতদিন আমি কান্না করে বাড়িতে ফোন দিয়েছিলাম ততদিন দাদাজান আমাকে ফোনে কথা বলতে দেয় নি কারও সাথে। তার মতে আমি অনেক নরম ছিলাম। পুরুষদের এত নরম হতে নেই। বড় ভাইয়াও আমাকে সময় দিতে পারতো না। তাই একা ছিলাম খুব। একসময় কাঁদতে ভুলে গেলাম। মন শক্ত হয়ে এলো আমার। এই কারণেই হয়তো আগে খুব রুক্ষ ছিলাম। কখনো হাসতাম না। তারপর আমার জীবনে তুমি এলে।” বলে সভ্য তাকাল ইনারার দিকে, “পাগল একটা মেয়ে। এমন কার্টুন আমি জীবনেও দেখি নি।”
সভ্যের প্রথম কথাগুলো শুনে ইনারার মন খারাপ হয়ে এলো। সভ্যের জন্য একটু হলো ছোট্ট একটি স্থান কোমল হয়ে এলো। কিন্তু শেষের কথাটা শুনে সে চেতে উঠে, “কী আমি কার্টুন?”
রাগে ফোঁপাতে থাকে ইনারা। কিন্তু সভ্য হেসে দেয়, “এভাবে রাগলেও তোমাকে কার্টুনের মতো লাগে।”
ইনারা সভ্যের মুখ চেপে ধরে, “একটা কথাও বলবেন না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন, নাহলে উঠে যাব আমি।”
সভ্য তাই করে। চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে থাকে ইনারার হাতের কোমল ছোঁয়া।
জিজ্ঞেস করে, “কী সাহায্য প্রয়োজন তোমার?”
“যে ব্যক্তিটি আমার সাথে মিসবিহেভ করেছিল তার থেকে একটা কনফেশন বের করতে হবে। যে এই কাজটা তাকে দিয়ে কে করিয়েছিল। পারবেন?”
“দশমিনিট এর মার খেলেই সে সব বলে দিবে। তা কি সোশ্যাল মিডিয়াতে….”
“না, তা আমার কাছে থাকলেই হবে।”
“আর কিছু মহারাণী?”
“মুখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন।”
সভ্য ইনারার আদেশ পালন করল। সে কিছু বলল না। ইনারার আর কিছু সময় পর নিচ থেকে বলল, “আমার না কৃষ্ণচূড়া গাছ অনেক পছন্দ। ছোটবেলায় আমাদের আরেক বাড়ি ছিলো। মা সে বাড়িকে তার স্বপ্নবিলাস বলতো। সেখানে আমার জন্য কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে একটি দোলনা লাগিয়েছিলো। কৃষ্ণচূড়ার সিজনে প্রতিবছর আমরা সেখানে যেয়ে থাকতাম। আমি দোলনায় ঝুলতাম। আর কৃষ্ণচূড়ার বর্ষণ হতো আমার উপর। একদম স্বপ্নের মতো মনে হতো। মনে হতো যেন স্বপ্নবিলাশ করছি।”
সভ্য কোন উত্তর না দাওয়ায় আবারও জিজ্ঞেস করে, “ঘুমিয়ে পড়েছেন?”
উওর আসে না। ইনারা ভাবে আসলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সে সভ্যর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অনেক সময় পর তার ঠোঁটের কোণে আসলেই হাসি ফুটে উঠে। সে তার হাতের কোমল ছোঁয়া চুল থেকে সরিয়ে সভ্যের মুখে নিয়ে আছে। তার কপাল ছোঁয়, তার চোখ ছোঁয়, তার গাল স্পর্শ করে। সে যত সভ্যকে ছুঁয়ে দিচ্ছে ততই তার হৃদয়ের স্পন্দন বেগতিক হচ্ছে। কেমন এক অনুভূতি হচ্ছে তার হৃদয়ের মাঝে।
হঠাৎ করে সভ্য তার হাত ধরে নেয়। স্তব্ধ হয়ে যায় ইনারা। চমকে উঠে। সে ভেবেছিল সভ্য ঘুমাচ্ছে।
সভ্য চোখ খুলে বলে, “কী করছেন মেডাম?”
ইনারা লজ্জাজনক অবস্থায় পড়ে যায়। কি করবে না বুঝে দিশেহারা হয়ে যায়। এক দুই না ভেবে সেখান থেকে সরে, উঠে যেয়ে দৌড় দেয়।
সভ্যের মাথা ঘাসে লাগায় ব্যাথা পায় সে। মাথায় হাত ঢলে ইনারাকে উঁচু স্বরে বলে, “কী নির্দয় মহিলা তুমি! নিজের স্বামীকে একতো ব্যাথা দিয়েছ এর উপর ছেড়ে যাচ্ছ?”
ইনারা থামে না। সে তাকায়ও না। এক দৌড়ে পালায় সে এই লজ্জাজনক পরিস্থিতি থেকে। সভ্য হাসে। উঠে বসে বলে, “পাগল একটা। তোমাকে সম্পূর্ণ কথাটাই বলা হলো না। এই কথাটাই বলা হলো না যে তুমি আমার জীবনে হাসি ফিরিয়ে এনেছ। আমার হাসির কারণ হয়েছ। তোমার এসব পাগলামোই তো আমার ঠোঁটে হাসি আঁকে।”
বলে সে কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর দিকে তাকাল।
.
.
আটদিন কেটে যায়। আইজার একরকম ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। একতো এত ঘৃণাভরা কমেন্ট আছে তার জন্য বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এর উপর কেউ এটা লিক করে দিয়েছে যে তার নতুন প্রজেক্ট সে লোকের ইনভেস্ট করা সিনেমাতেই যে ইনারার সাথে খারাপ কিছু করতে চেয়েছিল। এমনকি তার আগের যত ছবি সে লোকের সাথে জড়িত তার জন্যও অনেক বাজে কথা শুনতে হচ্ছে তার। এসবে তার দম আটকে আসছে। এক এক করে তার সব প্রজেক্ট হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সবাই তাকে বের করে দিচ্ছে। সে কি করবে কিছু বুঝতে পারছেনা। তার এত কষ্টে অর্জন করা খ্যাতি সে এভাবেই নষ্ট হতে দিতে পারে না। এর জন্য তার অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে। নিজেকেও শেষ করতে হয়েছে। এভাবে সে এসব হারাতে পারে না।
সাইদের সকালে আসার কথা। সে না’কি উপায় পেয়েছে একটা। তাই ড্রইংরুমে পায়চারি করছে সে। তার মা সোফাতে বসে ছিলো। “তুই এভাবে হাঁটলে কি সব অসুবিধা শেষ হয়ে যাবে না’কি?”
“তো কি করবো মা? চিন্তা না করে কি করার আছে আমার?”
ইনারার ফুপু বিরক্তির সুরে বলল, “ওই হতভাগা মাইয়া আমার মেয়ের পিছুই ছাড়ে না। এত কষ্টে পিছু ছাড়ালাম। তাও আবার এসে আমার মেয়ের খুশিতে কালো নাগিনীর মতো বসে আছে। আমি তো ভাবছিলাম মরে টরে গেছে। যদি মরেও পিছু ছাড়বে না। দুর্ভাগা একটা।”
“মা তুমি এসব বন্ধ করবে। এদিকে চিন্তার মরছি আর তুমি কথা বলেই যাচ্ছ।”
সাইদ কক্ষে প্রবেশ করে। তাকে দেখতেই আইজা ছুটেছে তার হাত ধরে বলে, “কী উপায় বের করেছ তুমি? বলো। আমার যে আর সহ্য হচ্ছে না।”
“তুমি শান্ত হয়ে বসো। আমি বলছি।”
তারা দুজনে সোফায় বসল। আইজার আবারও মুখ বানিয়ে বললেন, “যাক তাহলে কোনো কাজে তো আসলো এ ছেলে। আমি তো ভেবেছিলাম অকারণে এই পোলার পিছনে টাকা খরচ করতেছোস। ছেলেটা কোনো কাজের না।”
সাইদ কথাটায় ধ্যান দেয় না। সে আইজার দিক তাকিয়ে বলে, “ইনারা যদি মিডিয়ার কাছে তোমার পক্ষে কথা বলে তাহলে হয়তো এসব শান্ত হতে পারে।”
আইজার মা আবার বল, “এহ কি অদ্ভুত বুদ্ধি আনসে। আমার মেয়ে ওই হতভাগা, কলংকিনীর মাইয়ার কাছে সাহায্য চাইব?”
“মা তুমি একটু চুপ করো তো।” আইজা বলে। আবার সাইদকে জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু ইনারার তো খবর নেই। তিন বছর হয়ে গেল ওকে একবারও দেখলাম না। তাহলে ওকে কীভাবে পাব? আর কিছু ঠিক হবে না সাইদ। সব শেষ হয়ে গেছে।”
বলেই আইজা মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করল।
তখনই সাইদ বলে, “গতকাল ওর দেখা পেয়েছি আমি। ওকে দেখিছি।”
“কী! কীভাবে?” চমকে উঠে আইজা।
সাইদ গত কয়েকদিন ধরেই সুরভির পিছু করছিল। ইনারার দেখা পাওয়ার জন্য। কিন্তু তাকে পায় নি। গতকাল রাতে পেয়েছে। তারা এক বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েছিল। কিন্তু সুরভীর নাম এখানে আনা যাবে না। সুরভিকে এসবের মাঝে টানতে চায় না সে। তাই সাইদ বলল, “জ্যামে আটকে গিয়েছিলাম। তখন দেখলাম। তারপর পিছু নেই। এক বৃদ্ধাশ্রম এ গিয়েছিলো। সেখানে ডোনেশন দিয়েছে।”
সাথে সাথে আইজার মা চোখ দুটো বড় বড় করে বলে উঠে, “ডোনেশন দিসে? এত টাকা আইসে কোথা থেকে। নিশ্চয়ই কোনো কুকাম করে আমি বলতেছি।”
তার কথায় কেউ ধ্যান দিলো না। সাইদ আইজাকে বলল, “আমি সেখান থেকে ওর নাম্বার নিয়েছি। তুমি কথা বলবে?”
“ও জীবনেও মানবে না। কেন মানবে? ওর মানার কোনো কারণ নেই।”
“যদি ওর স্বপ্ন আবার ও ফেরত পায় তখনও না?”
আইজা কপাল কুঁচকে নেয়, “মানে?”
“রোজাউরকে আবার পুলিশে ধরে নিয়েছে। এইবার বেইল হয় নি। সিনেমার বাকি ইনভেস্টররা রোজাউরকে বের করে দিয়েছে। ওদের প্রডাকশন হাউস অনেক লোকসানে গেছে। আমি তাদের সাথে কথা বলেছি। ওরাও তাদের সম্মান বাঁচানোর জন্য ইনারাকে কাস্ট করতে চায়। ওকে অপ্রধান এক চরিত্র দেওয়া হবে। এতে তোমার সবচেয়ে বেশি লাভ। তুমি ওর সাথে কথা বলো।”
সাইদ ফোন লাগিয়ে আইজার দিকে এগিয়ে দিলো। ফোন লাউড স্পিকারে ছিলো। ফোনের ওপাশ থেকে ইনারার কন্ঠ ভেসে এলো, “হ্যালো…”
আইজার যেন ভয়ে নিশ্বাস আটকে এলো। তার মনে পড়ে প্রিয়র মৃত্যুর কথা। সে প্রিয়র মৃত্যুর অন্যতম কারণ ছিলো। এই ঘটনাটার কথা মনে করতেই তার জান বের হয়ে আসে। এর উপর ইনারার কন্ঠ শুনে তার শেষ বলা কথাটা মনে পড়ে। ইনারার চোখে তখন আগুন ছিলো। সে অগ্নি দৃষ্টি দেখে যেন মনে হচ্ছিলো তখনই আগুনের ফুলকি তাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিবে। তার কেন যেন মনে এলো তাদের জীবনে আরও অনেক বড় ঝড় আসা বাকি।
চলবে…