অনুভবে ২১তম পর্ব

0
4484

অনুভবে
২১তম পর্ব
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
,
মুহিত রিতাকে নিয়ে তাদের গ্রামে পৌঁছিয়েছে মিনিট পাঁচেক আগে।
গ্রামের লোকজন মুহিতকে দেখে কেমন একটা সন্দেহর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে।
” এই লোকটাকে দেখে এই গ্রামের মনেই হচ্ছে না কিন্তু চাল-চলন হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে এই গ্রাম জন্ম জন্মান্তর ধরে চেনে”
,
মুহিত আর রিতা একটু এগিয়ে যেতেই করিম চাচার দোকানে পৌঁছালো কিন্তু এই দোকানটি আগের মত নেই।
,
কাঠের ছোট টং এর দোকান টি এখন পাকা হয়ে গেছে, দোকানের ভিতর টিভিও লাগিয়েছে, করিম চাচা মুখ ভর্তি দাড়ি রেখেছে, চুলদাড়ি সব পেকে গেছে।
,
গ্রামটা দেখে বেশ ভালই লাগছে মুহিতের যে গ্রামের অনেক উন্নতি হয়েছে। ছয় বছরে ছোট্ট একটি গ্রাম যেন মোটামুটি একটা মাইক্রো সিটি হয়ে গেছে।
,
পথ ধরে নিজেদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে মুহিত। বাড়ির একদম কাছাকাছি যেতেই একটা বাচ্চা ছেলে সামনে পথ আগলে দাঁড়ালো। বয়সটা পাঁচ বছরের মতোই হবে।
,
মুহিত ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
,
– কি ব্যাপার কিছু বলবে তুমি?
,
বাচ্চাটি তখন তোতলা গলায় বলল,
,
– কে তুমি আর আমাদের বাড়ির দিকে কেন যাচ্ছ?
,
-এটা তোমাদের বাড়ি?
,
বাচ্চাটা মাথা উপর নিচ করে বলে,
,
– হ্যা এটা আমাদের বাড়ি।
,
মুহিত অবাক কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
,
– তোমার আব্বুর নাম কি?
,
-রুমন।
,
বাচ্চাটিকে মুহিত কোলে তুলে নেয়। কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে,
,
– আমি তোমার কাকা মুহিত।
,
বাচ্চাটি ঠিক উত্তরটা বুঝতে পারল না কিছু কারণ সে জন্মানোর আগেই তার ছোট কাকা মারা গেছে এটাই জানে সে। তাই জিজ্ঞাসা করলো,
,
– তুমি আমার কাকা না। আমার কাকাতো মারা গেছে। অবেক আগে। আমার কাকা দেখতে অন্য রকম ছিলো। আমি ছবি দেখেছি।
,
মুহিত বুঝতে পারল যে বাচ্চা ছেলেটার সাথে কথা না বলাই ভালো। এখন বরং বাড়িতে যাওয়া যাক।
,
সমস্ত ঘটনা রিতা মুহিতের পাশে পাশে হাটতে হাটতে দেখছে। যেন একটা রোবট যাকে হুকুম না করা হলে কিছুই করবেনা। রিতা চুপচাপ বসছে হাঁটছে দাঁড়াচ্ছে এভাবেই চলছে মুহিতের সাথে, শুধুমাত্র মুখ বন্ধ। মুহিত সব ফিরে পাবে এটা ভাবলেই রিতার খুব খুশি লাগছে।
,
বাচ্চা ছেলেটিকে কোলে নিয়ে বাড়ির মেইন দরজার টোকা দিল মুহিত।
,
মাঝবয়স্ক একজন মহিলা দরজাটা খুলে দিল।
,
মহিলাটিকে দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারল না।
,
‘মা’ বলে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল মুহিত। কিন্তু তার মা কিছুই বুঝতে পারলো না বুঝবেই বা কি করে ছেলের চেহারা যে নেই আর।
,
মুহিতের মা মুহিতকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
,
– কে তুমি তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না। আমাকে মা ই বা কেন বলছো?
,
মুহিত খুব আগ্রহের সাথে বলল,
,
– মা তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি তোমার মহিত।
,
মুহিতের কন্ঠর খুব মিল আছে ছেলেটার সাথে। কিন্তু ছয় বছর আগেই যে তার ছেলেটাকে কবরে শোয়ানো হয়েছে।
তাই বলল,
,
-আমার মুহিত মারা গেছে আজ থেকে ছয় বছর আগে।
,
মা সেটা অন্য কারো লাশ ছিলো। আমি মুহিত তোমার ছেলে। আমার কথা আমার চলন দেখেও কি বুঝতে পারছোনা?
,
-কিন্তু তোমার চেহারাটা……..
,
মাকে থামিয়ে দিয়ে মুহিত তার সাথে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনাটা খুলে বলে। সব শুনে মুহিতের মা মুখ চেপে কান্না করতে থাকে। এতবছরের বেদনা এই বুঝি কম হলো।
,
মুহিত খুব কষ্টে কোনরকমে তার মাকে শান্ত করলো।,
,
মা চোখ মুছে হঠাৎ পাশের মেয়েটার দিকে তাকাই। হালকা কোকড়া চুল। লম্বায় মুহিতের কান পর্যন্ত। বড্ড মানিয়েছে দুজনকে।
,
রিতাকে ছেলের বউ ভেবে তার পাশে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
,
– দেখেছো মা, তোমাকে খেয়ালই করা হয়নি।
,
– সমস্যা নেই আন্টি মা ছেলের মাঝে ৩য় ব্যক্তি থাকতে নেই। তাই চুপচাপ ছিলাম এতোক্ষণ।
,
মুহিতের মা রিতার থুতনিতে হাত রেখে বলে,
,
– আমাকে আন্টি বলছো কেন? মা বলো। আমি তোমার স্বামীর মা।
,
এই কথা শুনে রিতা চোখ যেন চড়কগাছে।
,
মুহিত তার মায়ের কল্পনা ভেঙে দিয়ে বলে,
,
– মা ও আমার বউ না। আমার বন্ধু, ও খুব বিপদে ছিলো তাই সাথে করে আমি এনেছি।
,
মুহিতের মা মুহিতকে রিতাকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে যায় কিন্তু বাকিদের কাছে মুহিতের পরিচয় দিতেই তার ভাই এবং ভাবীরা তাকে চিনতে অস্বীকার করে।
,
মুহিত জানত তার সাথে এমন কিছুই হবে। ভাই ভাবি এমন করবে এটাই তো স্বাভাবিক। মুহিতকে যদি মেরে ফেলা যায় তাহলে তো সব সম্প্রতি তাদের ভাগেই থাকবে।
,
মুহিতে সেখানে আর একটাও কথা না বলে রিতাকে
বললো,
,
– চলো রিতা। এখানে আর থাকা সম্ভব না। যেখানে সম্পত্তি সম্পর্কের উপরে সেখানে ভাই-ভাই অপরিচিত।
,
বাড়ির উঠান থেকেই রিতার সাথে আবার বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো মুহিত।
,
মা বার বার পিছু থেকে ডাক দিলো। মুহিত মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,
,
– খুব শীঘ্রই আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। ততদিন না হয় ভাবো আমি বেচে নেই, যেভাবে এতো বছর ভেবেছিলে।

,
এবার মুহিত মিহির বাড়িতে যায়। মুহিতকে চিনতে পারছিলো না মিহির বাবা। শেষমেষ সব ঘটনা খুলে বলতে তিনি যা বললেন তাতে যেন হিমেলের পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসলো।
,
কারণ মিহির বাবা-মা বলল,
,
– আমার মেয়ে মারা গেছে।
,
মুহিতের যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো কান্না করতে করতে বলল,
,
– না, আপনার মিথ্যা বলছেন। আমার মিহি মারা যায়নি।
,
মিহির বাবা ধমক দিয়ে বলল,
,
– এসব ন্যাকা কান্না কানবেনা। আমার মেয়েটা পেটের সন্তান নিয়ে তোমার বাবা কাছে গেছিলো তার সন্তানের যেন বংশপরিচয়টা পায় সে জন্য। কিন্তু তোমার বাবা আমার মেয়েকে বেশ্যার তকমা লাগিয়ে দেয়। আমিও সেদিন আমার মেয়েকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। এখন দেখে যাওয়ার পর নদীতে ঝাপ দিয়ে আমার মেয়েটা মারা যায়। এখন তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও। নাহলে দা দিয়ে তোমাকে টুকরো করবো।
,

নিজের আপন লোক গুলো তাকে অস্বীকার করছে আর নিজের ভালোবাসার মানুষটা তকে ভূলে পরপারে চলে গেছে। তাহলে আর এখানে থাকার মানেই হয় না। মিহিদের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে মুহিত আর রিতা।
,
মুহিত বের হতেই মিহির মা মিহির বাবাকে বলে,
,
– ছেলেটা কতবড় আশা নিয়ে এসেছিলো কিন্তু তুমি এতোবড় মিথ্যাটা কেন বললে।
,
– তুমি তো জানো রোকেয়া, আমার মিহি এখন কত সুখে। মেয়েটা আমাদের সাথে যোগাযোগ না করুক আমরা তো হিমেল বাবাজির সাথে কথা বলি নিয়মিত। আমি চাইনা এই ছেলের জন্য আর মেয়ের সংসারে আগুন লাগুক। আমি এটাও চাইনা হিমেলের মত সৎ একটা ছেলের জীবনেও আধারে নেমে আসুক এই ছেলেটার জন্য।
,
দুইদিন পর,
,
ঢাকায় ফিরে এসেছে সেদিনই। এরপর একটা হোটেলে দুইটা রুম ভাড়া নিয়ে আছে মুহিত আর রিতা।
,
রিতা কিছুই বুঝতে পারছেনা যে কিভাবে মুহিতকে সান্তনা দেবে। শেষমেষ কিছু একটা ভেবে সে মুহিতকে প্রপোজাল দিল কক্সবাজারে ঘুরতে যেতে চায়। বেড়ানোর মধ্যে দিয়েও যদি মনটা ভালো করা যায় তবে এটাই রিতার জন্য খুশির খবর হবে।। মুহিত রিতার কথা ফেলতে পারল না। আগামী সপ্তাহে কক্সবাজার যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেল। কিন্তু রিতা নাছড়বান্দা একসপ্তাহ অনেক দেরি। সে আজ কালই যেতে চায়। অগত্যা আগামীকাল কে যাওগা ফিক্সড হলো।
,
,

সকাল থেকে গুছানোর কাজ চলছে মিলির। একটু পরে চারজন মিলে কক্সবাজারের দিকে রওনা দিবে।। সেখানে তিন দিন থাকার পর হিমেলের বড় আপুর বাসায় দুইদিন থেকে তারপর আবার ঢাকায় ব্যাক করবে।
,
মিলি যদিও ছোট বাবুকে নিয়ে কক্সবাজার যেতে রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু মিলির জোরাজোরি আর আরোহী আপুর সাথে দেখা হওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে শেষমেষ রাজি না হয়ে উপায় থাকল না।
,
,
,
চলবে
,
বানান ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here