অনুভবে ৩য় পর্ব

0
3157

অনুভবে
৩য় পর্ব
লেখনীতেঃ #রাফিজা_আখতার_সাথী
,
-বাবা এই মেয়ে আমার বউ না।
,
মুরাদ সাহেব সজোরে হাসি দিয়ে বললেন
,
– এই মেয়ে তোমার বউ না তাইনা?
,
– হ্যা বাবা।
,
এবার রোহান বলল,
,
– দেখেছো নানু, এবার মামু স্বীকার করলো যে এইটা আমার মামী। দেখলেনা হ্যা বলল!
,
হিমেল রোহানকে ধমক দিতেই মুরাদ সাহেব হিমেলকে ধমক দিয়ে বললেন,
,
– শাট আপ! কি পেয়েছো তুমি? ইয়ারকি হচ্ছে? একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছো, তোমার ভাগনেটা বলছে তাও ফাজলামি করো!
,
– বাবা তুমি ভুল বুঝছো।
,
– আর একটাও কথা না। বউমা তুমি ভিতরে আসো।
,
এতোক্ষণ ধরে মিহি সব কিছুই দেখেছে এবং শুনেছে কিন্তু মুখের ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছে। যেন ওর মুখটা কেও তালাবদ্ধ করে দিয়েছে।
,
মুরাদ সাহেব মিহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
,
– মাশাল্লাহ, এমন ঘরের লক্ষিই তো আমি চেয়েছিলাম। আজকে আমার বাড়িটা পূর্ণ মনে হচ্ছে। যাও মা হিমেলের সাথে ওর ঘরে যাও। ফ্রেশ হয়ে আসো। তারপর তোমার শাশুড়ীর সাথে দেখা করবে।
,
হিমেল রাগে গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে গেলো।
,
“এই জন্য কাওকে সাহায্য করতে নেই।।নিজেরই বিপদ চলে আসে। আর মেয়েটাই বা কি? মুখ থেকে কথায় বের হচ্ছিলো না একটাও। দুর! মেজজটাই খারাপ হয়ে গেলো।” বিড়বিড় করতে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো।
,
রোহান মিহির হাত ধরে বলল,
,
– চলো মামী, আমি তোমাকে দিয়ে আসছি।
,
মিহিরও এবার ভীষণ রাগ হচ্ছে এই রোহানের উপর। ছোটো বাচ্চারা বেশি কথা বললে তারা খুব আদরের হয় তবে এর মত ছোটো বাচ্চাকে মাথায় তুলে আছাড় দিতে ইচ্ছে করছে মিহির।
,
?
,
রোহান মিহিকে ঘরে দিয়ে গেলো। মিহি ঘরে ঢুকতেই হিমেল দরজা আটকে দিলো। মিহির দুই হাত ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে,
,
– এই মেয়ে, তোমাকে আমি সাহায্য করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি তো আমার বিপদে সাহায্য করলে না বরং এখন আমার গলায় ঝুলে পড়লে! এখন আমার কি হবে, আমি বাবাকে বলবো কিভাবে।
,
মিহি হিমেলের অগ্নিদৃষ্টি দেখে খুব ভয় পেয়ে যায়।
,
– দ দে দেখুন, ওখানে কথা বলার মত কোনো অবস্থা ছিলো না। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না আমি সব কিছুই বলবো আপনার বাবার সাথে।
,
– তখন কি হয়েছিলো? তখন বলোনি কেন? আমার বাবার সামনে বলোনি কেন ড্যাম ইট?
,
– আমি তো বললতেই গেছিলাম। কিন্তু তখন আমি কেন যেন আমার বলার শক্তিই হারিয়ে ফেলেছিলাম।
,
– এসব ঢং করবে না আমার সাথে ওকে?
,
– আপনি প্লিজ আমার হাতটা ছাড়ুন। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে আমার।
,
– তোমার তো হাতের যন্ত্রণা হচ্ছে? আমার যে মরে যেতে ইচ্ছা করছে। অন্যের সন্তান তোমার পেটে। সন্তান গর্ভে না থাকলেও তো একটা কিছু ভাবতাম আমি। আমি পারবোনা এই সন্তানের দ্বায়িত্ব নিতে, কোনোভাবেই পারবোনা। কেন যে আপনাকে বাচাতে গেলাম! আত্মহত্যা করছিলেন ভালোই হচ্ছিলো।
,
– আপনি চিন্তা করবেন না মিস্টার হিমেল। আমি আপনাকে বিপদে ফেলবো না। হয়তো আবারও কোনো সময় আমার মৃত্যু আসবে। সেটা শীঘ্রই। তবে এবার আর আপনাকে আর আমাকে বাচাতে হবেনা।
,
হিমেল এবার বুঝতে পারলো সে রাগের মাথায় অনেক কিছু বলে ফেলেছে। সাথে সাথে মিহিকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
,
– আই এম সরি। আমি আপনার সাথে এমন আচরণ করতে চাইনি। আসলে রাগে বসে!
,
– হ্যা আমি বুঝতে পেরেছি।
,
– আপনি এই বাথরুমে ফ্রেস হয়ে নেন। আমি রহিমা খালাকে দিয়ে আপনার ড্রেস পাঠাচ্ছি।

,
এই বলে হিমেল বের হয়ে মায়ের ঘরেত দিকে গেলো। মিহি দেয়াল ঘেঁষে ফ্লোরে বসে পড়লো। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা ওর। তোতা পাখির মত নিজে নিজে বলতে থাকে,
,
– আমি তো মরতেই যাচ্ছিলাম। উনি আমাকে বাচালো কেন। আমার জন্য তাহলে আর ওনাকে এতো চিন্তাই পড়তে হতো না। আপনি চিন্তা করবেন না মিস্টার নেহাল। আমি আপনাকে বিপদে ফেলবোনা। আজকেই মরবো আমি। চিঠিও লিখে যাবো যে আমার মৃত্যুর জন্য কেও দায়ী না।
,
কেও একজন মিহির হাতে পোশাক দিয়ে বলল,
,
– ছোটো বাবু এগুলো আপনাকে দিতে বলল।
,
মিহি ভালো করে দেখলো মহিলাটার বয়স ৫০/৫৫ হবে হয়তো। মুখে মিষ্টি হাসি লেগেই আছে।
মিহির কৌতূহল দৃষ্টি দেখে উনি নিজেই বলল,
,
– আমি হলাম এই বাড়ির কাজের লোক আর হিমেল বাবার খালামনি। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি যাচ্ছি এখন।
,
উনি যেতেই মিহি ঘরের দরজা আটকে দিয়ে ওয়াশরুম গেলো।
,
?
মায়ের পাশে বসে আছে হিমেল। বাবা ও অন্যান্য কাজের লোকেদের মুখে কেমন একটা অন্ধকার বিরাজ করছে।
,
– তোমরা কেও কিছু বলছোনা কেন? সবার মুখ এমন ভার কেন। বাবা তুমি তো কিছু বলো? একটু আগেও তো তুমি কি হাসিখুশি ছিলে, এখনই কি হলো? কালু তুই তো কিছু বল!
,
– ইয়ে মানে….
,
– কি ইয়ে মানে মানে করছিস? ক্লেয়ার করে বল সব।
,
এবার মা মুখ খুলে বলল,
,
– আরে পাগল কিছু না। আমি বিছানায় শুয়ে আছি তাই হয়তো কারো মনে ভালো লাগছেনা তাই এমন মুখ ভার করে আছে সবাই। তুই আগে যা ফ্রেশ হয়ে নে তারপর কথা হবে। আমার বউমা নিয়ে আসবি এই ঘরে।
,
হিমেল অন্য একটা ওয়াশরুম গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। সারাদিন মিহির সাথে দেখে হয়নি হিমেলের। হবেই বা কি করে মিহি সারাদিন ঘরের ভিতর বসেই ছিলো। আর হিমেল মায়ের কাছেই বসে ছিলো। কাজের লোকেরা খাবার দিয়ে এসেছে মিহিকে। সন্ধ্যায় হিমেল মিহির সাথে একটু কথা বলার জন্য ওর ঘরে গেল। তখন খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলো সরিও বলেছে তবুও গিল্টি ফিল হচ্ছে তাই ঘরে গেলো।
,
মিহি সিলিং ফ্যানে নিজের ওড়না বাধানোর চেষ্টা করছে। হিমেলের বুঝতে বাকি রইলো না মিহি কি করতে যাচ্ছে। মেজজটা আবার বিগড়ে গেলো। সাথে সাথে খাট থেকে মিহিকে নামিয়ে সজোরে মিহির গালে একটা চড় দিলো হিমেল,
,
– হেই ইউ, তোমার মরার ইচ্ছ হলে বাড়ির বাইরে গিয়ে মরবে ওকে? আর ঘরের মধ্যেই যেহেতু মরবে তাহলে দরজা খুলে রেখেছো কেন? যেন কেও এসে বাচায় আর ন্যাকামি করতে পারো?
,
মিহি গালে হাত দিয়ে কেদেয় চলেছে।
,
-আবার কান্না করছে, দুর।
,
রাগে মিহিকে ছেড়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হতে নিলেই মায়ের ঘর থেকে চিৎকার শোনে হিমেল। দৌড়ে মায়ের ঘরে যায় হিমেল পিছনে পিছনে মিহিও যায়। হিমেল দৌড়ে গিয়ে মায়ের কাছে বসে,
,
– মা কি হচ্ছে তোমার? ( পিছন ফিরে দেখে বড় বোনও চলে এসেছে)
,
হিমেলের মনে কু ডাকতে থাকে।
,
– ও মা বলোনা কি হচ্ছে তোমার। হাসপাতালে নিয়ে যাবো।
,
হিমেলের মার নিঃশ্বাস নিতে খুবই কষ্ট হচ্ছে তবুও চাচ্ছে শেষ সময়টাকে ছেলের সাথে স্বাভাবিক গলায় কথা বলতে,
,
– না ডাক্তার বলেই দিয়েছে সব। আ, আমি তো চলেই যাবো। নিজের খেয়াল রাখবি বাবা।
,
দরজার দিকে চোখ পড়তেই মিহিকে দেখলো হিমেলের মা। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হাতের ইশারায় উনি মিহিকে ডাক দিলেন। মিহি ওনার কাছে যেতেই নিজের পাশে বসার ইঙ্গিত দিলেন। মিহি বসতেই উনি মিহির হাত ধরে বললেন,
,
-আমার ছেলেটা কোনোদিন ওর বাবা বা আমার অবাদ্ধ হয়নি। কিন্তু ও আজকে এমন একটা কাজ করেছে যেটা আমাদের জানিয়ে করেছে তবুও আমার চরম খুশির খবর সেটা। সারাজীবন চাইতাম তোমার মত সুন্দর ফুটফুটে একটা বউমা থাকবে। মেয়েটাতো চট্টগ্রামে চলে গেছে। বউমাকে নিজের মেয়ে করে রাখবো, তেল দিয়ে দেবো, আমি পছন্দ করে ড্রেস কিনে আনবো। কিন্তু ভাগ্য আমাকে অতদুর যেতে দিচ্ছেনা মা।
,
নিজের হাত থেকে বালা দুটো খুলে মিহির হাতে পরিয়ে দেয়,
,
– আমার তরফ থেকে তোমাকে সেওয়া প্রথম ও শেষ উপহার। আরেকটা উপহার তো তুমি আগেই নিয়ে নিয়েছো, আমার সোনার টুকরো ছেলে। যাকে ভরশা করলে কোনোদিন ঠকবে না তুমি। ওর পৃথিবীর অর্ধেক আমি। আজকে আমিই চলে যাবো। ওর বাবা বোন আছে তাও আমাকে ছাড়া ওর থাকতে কষ্ট হবে। খুব কষ্ট হবে। আমার কোলে মাথা না রাখলে ওর ঘুম হয়না।
,
হিমেল কাদতে কাদতে বলছে,
,
– মা তুমি এসব কি বলছো?
,
– আমার হাতে সময় হয়তো কম বাবা। আমাকে সব বলতে দে। আর তোর বাবাকে আমিই স্বাভাবিক থাকতে বলেছিলাম যায়ে তুই এসেই হাইপার হয়ে না যাস।
,
– মা!!
,
হিমেলের মা মিহির হাতটা হিমেলের হাতের মধ্যে দিয়ে ওদের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
,
– মা, আমি তোমাকে আমার জীবনের সেরা গিফট দিয়ে যাচ্ছি, কথা দাও তুমি ওকে কোনোদিন একা হতে দিবেনা!

,
মিহির মাথায় অন্য কোনো চিন্তা আসেনি। হিমেলের দিকে তাকিয়ে দেখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কেদেই যাচ্ছে। মিহি মৃত্যুর পথযাত্রী একজন মাকে সে ফিরিয়ে দিতে পারছেনা। না তার মন সাড়া দিচ্ছে না তার মস্তিষ্ক সাড়া দিচ্ছে। তাই তোতা পাখির মত বলে দেয়,
,
– মা আমি কখনো আপনার ছেলেকে ছেড়ে যাবোনা কথা দিলাম।
,
– আলহামদু….
,
শেষ হওয়ার আগেই নির্জীব হয়ে যায় হিমেলের মা। হিমেল, বড় বন, বাড়ির সবাই চিৎকার করে কেদে ওঠে।
,
মিহিও কান্না আটকাতে পারেনি।
,
,

চলবে
,
বানান ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
৪র্থ পর্ব আগামীকাল পাবেন ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here