অনুভূতিটা_অদ্ভুত “পার্ট ০৬”
#লাবিবা_ওয়াহিদ
————————
আমি লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি একটা ছায়া দ্রুত সরে গেলো। এটা আবার কি হলো? কে আসলো আমার রুমে? আর দরজা তো লক করা কারো ভেতরে আসার মতো কোনোরকম উপায়ই তো নেই। উফফফফ কি যে হচ্ছে ইদানীং! মাথা কাজই করছে না। ভেবে আবার গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লাম এবং ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলাম। হঠাৎ একটা ঠান্ডা স্পর্শ আমার কপাল ছুঁলো। আমি শিউরে উঠলাম। সেই ঠান্ডা হাত টা পরম যত্নে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এতোটাই আরাম লাগছে যে চাইলেও চোখ মেলতে পারছি না। সকল চিন্তা, দুঃখ যেনো নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো আর আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে,,
ঘুম থেকে উঠে দেখি ফজরের নামাজের ওয়াক্ত হয়ে এসেছে। রুমের চারপাশে চোখ বুলালাম নাহ কেউই তো নেই তাহলে কে আমায় কাল মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো? আর একটা মানুষের হাত বরফের মতো ঠান্ডা কি করে হয়? কে জানে যাক গে আগে নামাজ টা পড়ে ফেলা জরুরি।
বলেই গিয়ে মুখ ধুয়ে ওযু করে নিলাম। তারপর জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করে নিলাম। কোরআন পড়া শেষ করে সব গুছিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। নাহ অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি রান্না সারতে হবে নইলে না খেয়ে থাকতে হবে সবার আমার জন্য।
ভেবেই ছুটে গেলাম রান্নাঘরে। রান্নাঘরে গিয়ে দেখি ফুপিই সব রান্না সেরে ফেলেছে এখন চায়ের কাপে চা ঢালছে। অবাক হয়ে বলি,”ফুপি তুমি কেন রান্নাঘরে এলে আমায় ডেকে দিতে আমি সব করে দিতাম।”
– আমি নিজে করলে কি হবে হুম? তোকে আমি খাটাবো ভাবলি কি করে? আমার ইচ্ছে হয়েছে করেছি আর হ্যাঁ এখন থেকে তোর বাইরে টিউশনি করতে যাওয়া বারণ আর রান্নাঘরেও যেনো না দেখি তোকে।
– মানেহ? টিউশনি না করলে সংসার চলবে কি করে ফুপি?
– বাসায় যারা আসে তাদের দিয়েই। ওহ আর হ্যাঁ এক ছেলে বলেছে উপর তলায় ভাড়া আসবে সেই ভাড়া দিয়েই বেশ চলা যাবে এর বেশি কোনো কথা নয়।
– কিন্তু ফুপি বাসা ভাড়া তো এতো বেশি না। আর আমি টিউশনি করে যা পাই তা…
– আয়াত! আমি কিছু শুনতে চাই না। তুই ফোন করে জানিয়ে দে তুই টিউশনি করাতে যাবি না। এক গ্রাম পেরিয়ে অন্য গ্রামে যাওয়ার পারমিশন একদমই আমি দিবো না। যদি আমাকে মানো তাহলে আমার কথা শুনো।
আমি আর কিছু বললাম না। বেশ ভালো বুঝেছি যাই বোঝাই না কেন ফুপি আমার কোনোরকম কথা শুনবে না তাই কি করার চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ফুপি এক কাপ চা ধরিয়ে দিয়ে বলে যেনো দাদিম্মিকে দিয়ে আসি। আমি হেসে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে দাদিম্মির রুমে গেলাম। সে মাত্র ঘুম থেকে উঠে বসেছে। আমায় দেখলে শুধু শান্ত দৃষ্টিতেই তাকায় কোনোরকম কথা বলে না। আমি তাকে চা টা দিয়ে আমি আবার রান্নাঘরে চলে আসি। ফুপি আমাকে আরেক কাপ চা ধরিয়ে দিলো। আমি চোখ বড় বড় করে বলি,”আমায় কেন দিলে কি করবো এটা দিয়ে?”
– শোনো মেয়ের কথা। তোকে যেহেতু দিয়েছি অবশ্যই তুই খাবি বলে নাকি?
– কিন্তু ফুপি আমি তো চা খাইনা।
– তো কি হয়েছে আজ খাবি। চল আমরা বাগানে চেয়ার টেবিলে গিয়ে বসি। এই শীত শীত পরিবেশ এবং কুয়াশার মাঝে কালো চা এর মজাই আলাদা।
আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। দুজনই হাতে চা নিয়ে বাগানে এসে দুজন দুই চেয়ারে বসলাম। চা দিয়ে ধুয়ো উড়ছে। আমি একটু ফু দিয়ে এক চুমুক চা খেলাম। সত্যিই বেশ ভালো লাগছে। ফুপির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম সেও বেশ তৃপ্তি করে খাচ্ছে। এভাবে কয়েকবার চুমুক দিয়ে ফুপিকে জিজ্ঞেস করলাম,”আচ্ছা ফুপি তোমার এমন পছন্দ হলো কিভাবে? বাবাকে যতোটুকু দেখেছি সে কখনো বাইরে বসে চা খেতো না আর দাদিম্মিও বাসার বাইরে আসে বা।”
ফুপি এক চুমুক দিয়ে হাতের মাঝে কাপ রেখে মুচকি হেসে বলে,”তোর ফুপার সাথে রোজই বাইরে বসে চা খেতাম। তাই তো অভ্যাস হয়ে গেছে। মানুষ টা এমন ছিলো যে আমার সকল কিছুর খেয়াল রেখেছে, খুটিনাটিতে বড় বড় আনন্দ দিয়েছেন।”
আমি ফুপির দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম এবং ভাবতে লাগলাম,”ইসসস আমারও যদি এমন একজন ভালোবাসার মানুষ থাকতো কতোই না ভালো হতো।”
★
বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো। এখনো সেই অচেনা মানুষটির কন্ঠসর পেলাম না। রাতে ছাদে গিয়ে কতোবার তাকে ডেকেছি কিন্তু তাকে অনুভব করিনি। কেন সে আমার সামনে আসে না কি দোষ ছিলো আমার? সে কি বুঝে না তার সাথে কথা বলতে না পেরে আমি কতো যন্ত্রণায় ভুগছি। তার জন্য রোজ কাঁদি তা কি সে জানে? উহুম যদি জানতো ঠিকই আমার সাথে কথা বলতো ঠিক আগের মতো। বড্ড অভিমান করে আছি তার উপর। সে কি আসবে না আমার অভিমান ভাঙ্গাতে নাকি আমার আশাটা আশাই থেকে যাবে?
এসবই ভাবছিলাম ছাদে দাঁড়িয়ে আনমনে। হঠাৎই পেছন থেকে কারো কথা শুনে পিছে ফিরলাম।
– কি রে আয়ু এতো রাতে ছাদে কি করিস জ্বিনের পাল্লায় পরার সখ হয়েছে নাকি?
এই কয়েকদিনে ফুপির সাথে বেশ ক্লোজ হয়ে গেছি তাই দুজনে প্রচুর ঠাট্টা মশকরা করি এখনও তার ব্যতিক্রম হবে না।
– কি বলো ফুপি আমি তো ভেবেই রেখেছি একজন জ্বিনকেই বিয়ে করবো তাইতো রাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জ্বিন খুঁজি যদি হাতে পাই ডাইরেক্ট কাজিকে ডেকে বিয়ে!!
আমার কথায় ফুপি ফিক করে হেসে দিলো সাথে আমিও হেসে দিলাম। ফুপি কিছুক্ষণ পর হাসা বন্ধ করে বলে,”জানিস তো মানুষ এবং জ্বিনের বিয়ে হয়?”
– নাহ আমি তো ভেবেছিলাম ইতিহাসে আমিই প্রথম জ্বিন বিয়ে করে ইতিহাস বদলে দিবো।(দুস্টুমি করে)
ফুপি হেসে বলে,”চালিয়ে যা তোর মিশন আমি গেলাম ঘুমোতে।”
বলেই ফুপি চলে গেলো। সত্যিই মানুষটার সাথে কথা বললে মুড টা ফ্রেশ হয়ে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ কেউ মলিন সুরে বলে উঠে,”আপনি এতোরাতে ছাদে কি করছেন?”
ছেলে কন্ঠ শুনে চমকিয়ে পিছে তাকালাম। দেখি সেই ছেলেটা যে আমাদের দোতলায় ভাড়ায় এসেছে। আমি তড়িঘড়ি করে মাথায় ঘোমটা দিলাম এবং কিছুটা সরে দাঁড়িয়ে বললাম,”এমনিহ জ্যোৎস্না বিলাস করতে ভালো লাগে তাই এসেছি।”
– তাই নাকি।
বলে আমার থেকে কিছু টা দুরুত্ব বজায় রেখে রেলিং ঘেষে দাঁড়ালো। এই একটা মানুষ যাকে দেখলে প্রচুর অস্বস্তিতে পড়তে হয়। প্রথম যেদিন তাকে দেখেছি তার সেই অদ্ভুত বাদামি রঙের মণির মধ্যে হারিয়ে গেছিলাম। ছেলেটা দেখতে বেশ সুদর্শন। তার মতো সুদর্শন যুবক কখনো দেখেছি বলে মনে হয়না। যেমন তার সুন্দর্য তেমনই তার ব্যবহার। কন্ঠের কথা তো বাদই দিলাম। খুব চুপচাপ স্বভাবের, নম্র, ভদ্র এবং বেশি কথা বলে না। তবে তাকে কখনো তার বাসা থেকে বেরোতে দেখি না। সারাক্ষণ বাসায় বসে কি এমন রাজকার্য করে আল্লাহ মালুমই ভালো জানেন। ছেলেটার নাম ফুপির কাছে জিজ্ঞেস করতে চেয়েও লজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারিনি যদি কি না কি ভেবে বসে তাই। এখন যেহেতু সে আমার সামনেই আছে একবার নাহয় জিজ্ঞেস করেই দেখি।
এসব ভাবতে ভাবতে তার দিকে একপলক তাকালাম। বেশ মনোযোগ দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কোনো এক গভীর ভাবনায় আছেন। চাঁদের আলোতে তার চেহারা ঝলমল করছে। আমি হা করে তার এই অদ্ভুত সুন্দর্য দেখছি। কেমন অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে তার প্রতি। মনে হচ্ছে যেনো তিনি আমার খুব কাছের একজন মানুষ। সে আকাশের দিকে তাকিয়েই আমায় বলে,”এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
তার কথায় থতমত খেয়ে বলি,”কককই? আপনার দিকে তাকিয়ে আছি মানেহ?”
– আমি তো সেই কখন থেকেই খেয়াল করছি আপনি আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন তাই আর কি জিজ্ঞেস করলাম।
এ বাবা এই ব্যাটা তো বেশ অদ্ভুত। সে তো আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো তাহলে বুঝলো কি করে আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম ধুর! কি লজ্জাতেই না ফেললো ছেলেটা।
– হয়েছে আপনার আর লজ্জায় পরতে হবে না তাও আমার জন্য। কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে করুন নাহলে আমি যাই।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে। দেখলাম সে আমার দিকে একপলক তাকিয়ে অন্যদিকে ফিরে গেলো। আচ্ছা সে বুঝলো কি করে আমি জিজ্ঞেস করতে চাই? যেই সে চলে যেতে নিবে ওমনি পেছন থেকে বললাম,”দাড়ান”
আমার কথায় সে দাঁড়ালো এবং পিছে ফিরে বলে,”কিছু বলবেন?”
————————–
চলবে!!!