অনুভূতিটা_অদ্ভুত “সূচনা পর্ব”

0
3094

অনুভূতিটা_অদ্ভুত “সূচনা পর্ব”
#লাবিবা_ওয়াহিদ

.
লাইট নিভিয়ে যেই শুলাম তখনই জানালার পর্দায় কারো ছায়া দেখতে পেলাম। ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। দাদিম্মি আমার চিৎকার শুনে দৌড়ে আসে এবং বলে,”কি হলো আয়াত এভাবে চিৎকার দিলি কেন কি হয়েছে?”(লাইট জ্বালিয়ে)

আমি এখনো সেই পর্দাটার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছি আর থরথর করে কাঁপছি। আমার মুখে কোনো শব্দই নেই কথা বলা যেনো ভুলে গেছি। দাদিম্মি আমার কাছে এসে আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে পর্দার দিকে তাকালো। তারপর চোখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,”ওই দিকে কি দেখছিস তুই আর চুপ করে আছিস কেন বল??”(আমায় ঝাঁকিয়ে)

আমি দাদিম্মির দিকে তাকিয়ে পর্দার দিকে কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে দেখিয়ে বললাম,”দাদিম্মি ওখানে কেউ আছে।”

দাদিম্মি আমার কথা শুনে বেলকনির পর্দার সামনে যায়। পর্দা সরিয়ে কাউকে দেখতে পায়না। দাদিম্মি আবার আমার পাশে এসে বলে,”কই কিছুই তো নেই। হয়তো তোর মনের ভুল। আর বেশি কথা না বাড়িয়ে ঘুমিয়ে পড় দেখি শুধু শুধু নিজেও ভয় পেলো আবার আমাকেও ভয় পাইয়ে দিলো।”

– এটা কি করে সম্ভব দাদিম্মি আমি সত্যি ওখানে কারো ছায়া দেখেছি বিশ্বাস করো।

– হয়েছে আয়াত থাম এবার চুপচাপ ঘুমা কাল সকালে উঠবি তা কি ভুলে গেছিস?

আমি মুখ গোমড়া করে বললাম,”নাহ ভুলিনি তুমি যাও আমি ঘুমোচ্ছি।”

দাদিম্মি লাইট অফ করে চলে যায়। আর আমি চুপচাপ গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছি। চোখ দিয়ে দু এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ছে না চাইতেও।

আমি আয়াত। দাদিম্মি কে নিয়েই আমার পরিবার। জম্মের পরপরই মা মারা যায়। বাবা ২বছর আগে মারা যায়। তারপর থেকেই দাদিম্মির সাথে থাকি। কিন্তু দাদিম্মির সাথে আমার সম্পর্ক এতোটাও ভালো নয়। দাদিম্মি চাইতো যেনো তার নাতিন হয় কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি মেয়ে হয়ে জম্মেছি। হয়তো এটাই আমার দোষ। মেয়ে হয়ে জম্ম নেওয়ার পরপরই দাদিম্মি মায়ের উপর প্রচুর খেপা হয়ে ছিলো। যখন ছোট ছিলাম তখন থেকেই শুনে এসেছি আমার মাকে অলক্ষ্যি অপয়া আরও অনেক কিছু বলতো। তখন খুব কান্না পেতো কিন্তু কিছুই করতে পারতাম না। কোন সন্তানই বা পারে নিজের মৃত মায়ের এমন অপমান সহ্য করতে?

দাদিম্মি অনেক জোরজবরদস্তি করতো বাবাকে নতুন বিয়ে করতে এবং আমায় এতিম খানায় রেখে আসতে কিন্তু বাবা কোনো কথাই শুনেননি। দাদিম্মির বেশি কথা সহ্য করতে না পেরে বাবা আমায় নিয়ে আলাদা থাকা শুরু করে। দিন গুলো ভালোই যাচ্ছিলো কিন্তু সুখ কি আর আমার হাতে এতো সহজে ধরা দিবে? একদিন রাতে মায়ের মতো করেই চলে গেলো না ফেরার দেশে। সেদিন যেনো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ঝড় গেছিলো। অসহায়ত্ব, একাকিত্ব ঘিরে ধরেছিলো সেদিন। দাদিম্মি সেদিন এসে আমায় নিয়ে গেছিলো নিজের সাথে। কিন্তু ভালোবেসে নয় তার খরচ চালানোর জন্য। বাবা মারা যাওয়ার আগে বাবাই তার খরচ চালাতো এক ফুপি আছে সে কখনোই দাদিম্মির খবর নিয়েও দেখেনি। সেই থেকে আমি কয়েকটা টিউশনি করে কোনোরকম চালাচ্ছি।

এগুলো ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে আযানের সুরে ঘুম ভেঙ্গে গেলো।ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ওযু করে নিলাম। তারপর রুমে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ে নিলাম। নামাজ পড়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি এখনো আলো তেমন করে ফুটেনি। বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে। দাদিম্মির বাড়িটা গ্রামে। তবে পুরোপুরি গ্রামও বলা যায়না। আর নামাজের পরপরই বাইরে হাটা টা এক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। চারপাশে কুয়াশাছন্ন, ঠান্ডা পরিবেশ আর মাঝে সরু রাস্তায় হাটার মজাই আলাদা। কিছু পা এগোতেই আমার পায়ের নিচে থেকে একটা কন্ঠ শুনলাম “ও মাগো” বলে কেউ চিল্লিয়ে উঠে । তাড়াতাড়ি দু এক পা পিছিয়ে এসে দাঁড়ালাম আর যেখানে পা দিয়েছিলাম সেখানে ভালো করে দেখলাম কিন্তু সেখানে কিছুই নেই। হচ্ছে কি আমার সাথে? আমি কি তাহলে ভুল শুনলাম নাকি সত্যিই কিছু ছিলো সেখানে। নাহ থাকলে তো দেখতাম কিন্তু আমার ভুল শোনারও তো কথা নয়। আমি স্পষ্ট শুনেছি কেউ…নাহ এগুলো ভেবে আর কাজ নেই ভাবতে গেলে মাথা ফেটে যাবে।

এরপর এসব না ভেবেই বাসায় চলে আসি। গিয়ে নাস্তা বানাতে মনোযোগী হলাম। কিছুক্ষণ পরই দাদিম্মি হাই তুলতে তুলতে রান্নাঘরে এসে চেক দিলো। আমি দাদিম্মি কে দেখেই মুচকি হাসি দিলাম এবং বললাম,”চা দিবো দাদিম্মি?”

– হুম দে আমি আসছি।

বলেই দাদিম্মি চলে গেলো। আমি নাস্তা বানানো রেখে দাদিম্মির জন্য চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। চটপট দাদিম্মির জন্য রঙ চা বানানো শেষ করে দাদিম্মির রুমে দিয়ে আসলাম। তারপর আবার রান্নাঘরে এসে নাস্তা বানানো শেষ করি। নাস্তা নিয়ে দাদিম্মির রুমে গেলাম তারপর একসাথে বসে খেলাম।

– যা মরিচ গুলো বেছে রোদে দিয়ে আয়।

– আচ্ছা যাচ্ছি।

বলেই রান্নাঘর থেকে মরিচের ডালা টা নিয়ে ছাদে চলে আসি এবং ছাদের এক কোণে বসে বসে সেগুলো থেকে পাতা আলাদা করতে থাকি। এই আমার রোজকার রুটিন সারাদিন কাজ করো আর রাতে ঘুমাও। তবে খরচের দিক দিয়ে তেমন কোনো সমস্যা নেই ৩ টা টিউশনি করে সংসারের খরচ আর দাদিম্মির ওষুধ মিলিয়ে বেশ যাচ্ছে। সকাল ১০টায় মরিচ আর পাতা বাছা শেষ করে সেগুলো রোদে দিয়ে নিচে চলে আসি। নিচে এসে দেখি পাড়ার ছোট ছেলে মেয়ে গুলো এসে হাজির। তাদের দেখে মুচকি হাসলাম। তারপর আমার রুমে নিয়ে ওদের পড়াতে শুরু করলাম। হঠাৎ আনমনে হতেই মনে পড়ে গেলো গত রাতের কথা।

“আমার স্পষ্ট মনে আছে পর্দার পিছে কেউ ছিলো কিন্তু নিমিষেই সে কোথায় হারিয়ে গেলো?দাদিম্মি যতোই বলুক কেউ ছিলো না কিন্তু আমি কেন বিশ্বাস করতে পারছি না? কেন মনে হচ্ছে কেউ ছিলো? আচ্ছা কোনো চোর টোর নয় তো?”

চোরের কথা মাথায় আসতেই তাড়াতাড়ি আলমারির দিকে গেলাম এবং চেক করতে লাগলাম কোনো কিছু চুরি হলো নাকি।

– আপু তুমি ওখানে কি করছো?

– কিছু না তুবা এমনি তোমরা পড়ো।

– আচ্ছা।

আমি ভালোমতো চেক করে দেখলাম নাহ কোনো কিছুই চুরি হয়নি। যেখানে যেটা ছিলো সেখানে সেটাই রয়েছে। তাহলে কি ব্যাটা চোরে কোনো কিছু চুরি করেনি?

“আচ্ছা ব্যাটা কি কাল চুরি করতে এসেছিলো? হয়তোবা চুরি করতেই এসেছিলো কিন্তু করার আগেই আমি চিল্লিয়ে উঠেছিলাম। হুম এবার সব আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে। সে যাইহোক চোরদের আমি বেশ ভালো টাইট দিতে জানি একবার পালালে পরেরবার ঠিকই তো পাবো তাইনা?”

ভেবেই একটা রহস্যময়ী হাসি দিলাম। তারপর বাচ্চাদের পড়ালাম। পড়া শেষ হতেই যে যার বাসায় চলে গেলো। আর আমি রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় ভাত বসালাম আর ২টা ডিম নিলাম। এই আমাদের দুপুরের খাবার। ভাত রান্না শেষে ডিম ১টা ভাঁজলাম। আরেকটা ভাঁজতে নিলে দাদিম্মি এসে আটকায়।

– একি করছিস তুই জমিদারি পাইসিস? ২টা ডিম শুধু শুধু কেন ভাঁজতে যাস রাখ ওটা শুধু শুধু নষ্ট হবে এক কাজ কর আমার জন্য যেটা ভেঁজেছিস সেখান থেকে আমি তোকে একটু দিয়ে দিবো আর ওই ডিম টা রেখে দে।

দাদিম্মির কথাগুলো যেনো তীরের মতো বুকে লাগলো। আমি একটা ডিম খেলে কি সেটা নষ্ট হবে? তবুও নিজেকে শক্ত করে বললাম,”ঠিক আছে দাদিম্মি তুমি গিয়ে খেয়ে নাও আমি গোসল করে পড়াতে যাবো।”

– কেন খাবিনা?

– নাহ খিদে নেই আমার তুমি খেয়ে নাও আমার নামাজও বাকি।

– এতোই যখন খিদে নেই তাহলে আরেকটা ডিম ভাঁজতে নিলি কেন? তেজ দেখাচ্ছিস আমাকে যত্তোসব। যা এখন সামনে থেকে।(রেগে)

আমি কিছু বললাম না চুপচাপ সেখান থেকে সোজা ওয়াশরুমে চলে এলাম। শাওয়ারের নিচে বসে খুব কাঁদতে লাগলাম।

“কেন আল্লাহ কেন তুমি আমায় এতো অসহায় করে দুনিয়ায় পাঠালে? কি এমন দোষ করেছিলাম যার কারণে তুমি আমায় এভাবে কষ্ট দিয়েই চলেছো? মায়ের ভালোবাসা টুকু পেলাম না। বাবার থেকে যতোটুকুও পেতাম তাকেও তুমি নিয়ে গেছো। এতোটা অভাগীনি কেন বানালে তুমি আমায়?”

বলেই জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম। আমার কান্না টুকু ৪ দেয়ালের মাঝেই যে সীমাবদ্ধ। আমার ভেতরের ক্ষত টা কেউ কখনো দেখতে চায়নি শুধু নিজেদের স্বার্থ টাই বুঝে এসেছে।

এভাবে প্রায় কিছুক্ষণ থেকে গোসল সেরে রুমে এসে নামাজ টা পড়ে নিলাম। নামাজ পড়লে মনের মধ্যে থাকা বোঝাটা হালকা হয়। নামাজ শেষ করে দেখি ৩ টা বাজতে প্রায় ১৫মিনিট। তাড়াতাড়ি বোরকা হিজাব পড়ে রুম থেকে বেরোলাম এমন সময়ই দাদিম্মির ডাক পড়ে।

– এই দাড়া থালা গুলো পরিষ্কার করে যা।

– কিন্তু দাদিম্মি আমার যে দেরি হয়ে যাচ্ছে।

– কোনো কথা না একটা থালা ধুতে তো আর ১ঘন্টা লাগে না। যা বলছি তাই কর হতচ্ছাড়ী।

আমি আর উপায় না পেয়ে তাড়াতাড়ি করে প্লেট ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম। খুদায় পেটের মধ্যে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে হাটার মতো শক্তিও পাচ্ছি না কিন্তু কি করার তাড়াতাড়ি তো যেতে হবে।
,
,
,
,
চলবে!

(নতুন গল্পটি হবে ভৌতিক এবং রহস্যময়। দেখি আপনাদের কতো রেস্পন্স এই গল্প থেকে। তবে নিয়মিত দিবো না গল্প টি একটু ওয়েট করতে হবে আপনাদের। কেমন লেগেছে জানাবেন গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here