রিখিয়া গুনগুন করে গান গাইছে আর তৈরি হচ্ছে। ওর সাজ যেন আজ শেষই হচ্ছেনা।
পেছন থেকে অর্ণা এসে ওর মাথায় একটা বারি মেরে বলে,
— “এই তোর কাহিনীটা কি বলতো এভাবে পেত্নির মতো সাজ দিচ্ছিস কেন? সেই কখন থেকে সেযেই যাচ্ছিস সেজেই যাচ্ছিস থামার নামই নেই। দেখাতো করতে যাচ্ছিস না মনে হচ্ছে যেন বিয়ে করে আজই বাড়ি ফিরবি!”
রিখিয়া অর্ণার গাল টান দিয়ে বলে,
— “সেটা সময় হলেই দেখতে পাবে বান্ধবী।”
— “আচ্ছা বাদ দে। এখন চলতো দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
— “হুম, চল।”
দুই বান্ধবী মিলে কফিসপে যাচ্ছে রিখিয়ার বয়ফ্রেন্ড সামির সাথে দেখা করতে। আসলে ঠিক বয়ফ্রেন্ড বলা যায়না। সামির ছবি রিখিয়া দেখলেও রিখিয়াকে এখন পর্যন্ত সামি দেখেনি। ফোনেই টুকটাক কথাবার্তা হয়েছিলো ওদের।
কফিসপে ঢুকতেই ওদের চোখ পড়ে কর্ণারে বসে থাকা সামির উপর।
সামি খুব টিপটপ হয়ে এসেছে আজ। কর্ণারের একটা টেবিলে বসে আছে। পুরো টেবিলটা অর্কিড দিয়ে সুন্দর করে সাজানো।
অর্কিড রিখিয়ার সবচেয়ে পছন্দের ফুল। তাই হয়তো ওকে ইমপ্রেস করার জন্যই এই ফুল দিয়ে ডেকোরেট করেছে।
রিখিয়া আর অর্ণা ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
ওদেরকে দেখেই সামি মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
হাসিটা বজায় রেখেই রিখিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, “হায় রিখি। আমি সামি। চিনতে পেরেছো তো।”
রিখিয়াও ফিচেল হাসি দিয়ে জবাব দেয়, “ওফস স্যরি জিজু তোমার তো একটুখানি ভুল হয়ে গেলো। আমি রিখিয়া নই আমি অর্ণা। এই যে এই হচ্ছে তোমার রিখি অর্ণাকে দেখিয়ে।”
মুহূর্তের মাঝেই সামির হাসিহাসি মুখটা অন্ধকার হয়ে যায়।
এই শ্যামলা দেখতে আনস্মার্ট একটা মেয়েকে ও ওর গার্লফ্রেন্ড হিসেবে কিছুতেই মানতে পারছেনা।
আর এদিকে অর্ণাতো পারেনা হাসিতে গড়াগড়ি খায়। ওর পেট ফেটে হাসি আসছে তাও অনেক কষ্টে আটকে রেখেছে।
রিখিয়াকে ও খুব ভালোভাবেই চেনে শুধুমাত্র মুখের মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভোলার পাত্রী ও নয়। তাই সামিকে একটু পরখ করে দেখছে।
রিখিয়া, সামি আর অর্ণা তিনজনেই বসে পড়ে তিনটে চেয়ার টেনে। তিনজনেই চুপচাপ। নিরবতা ভেঙ্গে রিখিয়াই প্রথম বলে,
— “আরে চিল ইয়ার! প্রথমবার দেখা করতে এসেছো কোথায় দুজন নিজেদের মনের সব কথা একে অপরকে খুলে বলবে তা না করে মুখে কুলুপ এটে বসে আছো, এটা কোন কথা? নাকি আমি আছি বলে তোমাদের অস্বস্তি হচ্ছে? তাহলে আমি বরং চলে যাই নয়তো অন্যপাশে গিয়ে বসছি।”
রিখিয়া কথাটা বলে উঠতে নিলেই সামি ওর হাতটা ধরে আটকে ফেলে।
— “আরে না,না। তোমার কোথাও যেতে হবেনা। তুমি এখানেই বসো।”
রিখিয়া কিছুক্ষণ সামির হাতটার দিকে তাকিয়ে থাকে, সামি বুঝতে পেরে হাতটা ছেড়ে দেয়। রিখিয়াও আর কথা না বাড়িয়ে বসে পড়ে।
ওয়েটারকে ডেকে ওরা তিনটে কোল্ড কফি অর্ডার করে।
কফি খেতে খেতে কথা বলতে থাকে। সামি অর্ণার সাথে দুয়েকটা কথা বলে রিখিয়ার সাথে কথায় মেতে উঠে। রিখিয়াও হাসিমুখে সামির সব কথার জবাব দিচ্ছে। অনেকক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর রিখিয়া ইশারা করতেই অর্ণা ওর একটা কল এসেছে বলে অন্য সাইডে চলে যায়।
অর্ণা যেতেই সামি রিখিয়ার হাতটা ধরে বলে, “অর্ণা তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
— “হ্যা, বলো।”
— “অর্ণা আমি আসলে……..”
— “তুমি আসলে কি বলো?”
— “আসলে অর্ণা আমার না রিখিয়ার চেয়ে তোমাকেই বেশি ভালো লেগেছে। তুমিই বলোনা ওর মতো একটা আনস্মার্ট আনকালচার্ড মেয়ের সাথে কি আমার কখনো যায়? তারউপর গায়ের রংটাও দেখো আরেকটু চাপা হলেই কালোদের দলে গিয়ে পড়তো। আমার মতো এরকম স্মার্ট, হ্যান্ডসাম, ড্যাশিং ছেলের সাথে ওকে কোনভাবেই যায়না। আমার মতো ছেলের পাশে তোমার মতো মেয়েকেই মানায় ওর মতো মেয়েকে না।”
সামির কথাটা শেষ করতে দেরি রিখিয়ার ওকে থাপ্পড় মারতে দেরি নেই। পরপর কয়েকটা থাপ্পড় মারে ও, আর থাপ্পড়গুলোও ছিল বেশ জোরেশোরে । আশেপাশের কিছু উৎসুক মানুষ ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
রিখিয়া এতক্ষণ চুপচাপ থাকলেও এবার জবাব দেয়,
— “তোর সাহস কি করে হয় আমার বেষ্টি আমার অর্ণার সম্পর্কে এমন কথা বলার? ও কি তোর যোগ্য নয়? তুই নিজেই ওর পায়ের নখের যুগ্যিও নোস। ওর মতো মেয়ে ভাগ্য করে পাওয়া যায়। আর তুই ওকে আনস্মার্ট, আনকালচার্ড বলিস আবার ওর গায়ের রঙ নিয়েও কথা বলিস তোর স্পর্ধা কত। বলেই আরেকটা থাপ্পড় মারে। এরমধ্যে অর্ণাও চলে আসে।
সামি এতক্ষণ চুপ থাকলেও অর্ণা আসলেই অর্ণাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
— “রিখি দেখো তোমার এই বান্ধবী আমাকে তোমার বিরুদ্ধে উস্কাচ্ছে। বলছে কিনা তোমার মতো একটা আনস্মার্ট, কালো মেয়ে নাকি আমাকে ডিজার্ব করেনা। আমাকে অফার করছে ওর সঙ্গে রিলেশনে যাওয়ার।”
সামি ভেবেছিলো কথাগুলো বলে দুই বান্ধবীর মাঝে ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারবে। কিন্তু ওর ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে অর্ণাও ওকে থাপ্পড় মারে। থাপ্পড়টা মেরেই মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে,
— “তুই ভাবলি কি করে ওর বিরুদ্ধে কিছু কথা বলেই আমাকে ওর বিরুদ্ধে উস্কে দিতে পারবি।”
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে অর্ণা বলে ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন ও’ই হচ্ছে রিখিয়া। তোমাকে বাজিয়ে দেখার জন্যই আমাকে তোমার কাছে রিখিয়া বলে পরিচয় দিয়েছিলো।
এ কথাটা শুনেই রাগে সামির চোখমুখ লাল হয়ে যায়। ও রিখিয়ার ডানহাতটা পেছনে মোচড় দিয়ে ধরে। রিখিয়া ব্যথা পেয়ে আহঃ করে উঠে।
অর্ণা আসতে নিলেই রিখিয়া চোখের ইশারায় ওকে আশ্বস্ত করে।
নিজের সর্বশক্তি দিয়ে রিখিয়া পায়ের হিলটা দিয়ে সামির পায়ে পাড়া দেয়।
সামি রিখিয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে পায়ে হাত দিয়ে বসে পড়ে।
দূর থেকে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে অর্ক মনে মনে বলে, “আমার পিচ্ছিটা আজ অনেক বড় হয়ে গেছে। নিজেকে নিজে প্রোটেক্ট করতে শিখে গেছে।” তারপর মুচকি হেসে চলে যায়।
অর্ণা আর রিখিয়াও সেখানে আর দাঁড়িয়ে না থেকে চলে আসে।
_______________
রাতে শোয়ার আগে আজকেও রিখিয়া মাটির তৈরি ঘোড়াটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে। এটা ওর প্রতিদিনকার অভ্যাস। ঘুমোনোর আগে একবার হলেও যদি ঘোড়াটা হাতে না নেয় তাহলে ওর ঘুম আসেনা।
একবারতো অর্ণাদের বাড়ি গিয়েছিলো গ্রীষ্মের ছুটি পরায়। তখন কেমন করে যেন ভুলে গিয়েছিলো ঘোড়াটা সাথে করে নিয়ে যেতে। আর রাতেরবেলা যখন পুরো ব্যাগ ঘেঁটেও ঘোড়াটা পেলোনা তখন তো পারেনা আবার এসে ঘোড়াটা নিয়ে যায়। সেদিন সারারাত রিখিয়া শুধু এপাশ ওপাশ করে গেছে তবে একফোঁটাও ঘুমোতে পারেনি। শেষরাতের দিকে দূরে কোথাও থেকে সেই পরিচিত কণ্ঠস্বরে পরিচিত গান ভেসে আসে। কিছুক্ষণের মাঝেই রিখিয়া ঘুমে তলিয়ে পড়ে। আর ভাববার অবকাশ পায়নি এ গান এখানে কে গাইছে আর কণ্ঠস্বরটাও তো সেই মানুষটারই মনে হলো ওর কাছে কিন্তু এ কি করে সম্ভব?
পরেরদিনই রিখিয়া ফেরত চলে এসেছিলো। অর্ণা অনেক চেয়েও ওকে আটকাতে পারেনি।
অর্ণা ভেবে পায়না এ ছোট্ট মাটির একটা খেলনায় কি এমন আছে যে এটা ছাড়া রিখিয়া একটা রাত্তিরও ঘুমোতে পারেনা।
— “তোর ছোট মাথায় এসব ঢুকবেনা। এতো চাপ নিয়ে লাভ নেই।”
রিখিয়ার কথায় অর্ণার মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠে। এ মেয়েটার জন্য মনে মনে কিছু ভেবেও শান্তি নেই। ওর মুখের ভাবভঙ্গি দেখেই রিখিয়া বুঝে ফেলে যে ও কি ভাবছে?
রিখিয়া ঘোড়াটা আগের জায়গায় যত্নসহকারে রেখে এসে টেবিল লাইটটা অফ করে অর্ণার পাশে এসে শুয়ে পড়ে। একটা সময় দুই বান্ধবীই ঘুমিয়ে পড়ে।
______________
রিখিয়া আর অর্ণা দুজনেই কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রথম বর্ষে পড়ছে।
রিখিয়ার বাসা কলেজ থেকে খুব একটা দূরে নয়। ওদের নিজেদের গাড়িও আছে চাইলেই বাসা থেকে গাড়ি দিয়ে আসা যাওয়া করতে পারতো। তবে অর্ণা গ্রামের মেয়ে ওর বাড়ি কুমিল্লার চাঁদপুরে। চাঁদপুর থেকে আসা যাওয়া করে নিয়মিত ক্লাস এটেন্ড করা সম্ভব নয়। তাই দুই বান্ধবী মিলে ধর্মপুরেই একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছে। যদিও রিখিয়া অর্ণাকে অনেকবার অনুরোধ করেছিলো রিখিয়াদের বাসায় থাকতে তবে অর্ণাই রাজি হয়নি।
আজ ক্লাস শেষে দুই বান্ধবী মিলে ঠিক করলো ধর্মসাগর পাড় থেকে একটু ঘুরে আসবে। ধর্মসাগর পাড় নামটা শুনলেই মনে হয় ধর্মসাগর কোনো সাগরের নাম আর সেই সাগরপাড় টাই ধর্মসাগর পাড় নামে পরিচিত। তবে ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়। ওখানে ছোটখাটো মতন একটা দিঘি আছে। দিঘির পাড়ের পরিবেশটা খুবই মনোমুগ্ধকর। শিশুদের জন্য একটা শিশুপার্কও আছে ওখানে। ওখানে গেলেই অনেক কাপলদের ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। আর স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়েরাও দলবেঁধে আসে আড্ডা দিতে। যারা গান গাইতে জানে তারাও মাঝেমাঝে তাদের দলবলসমেত গিটার নিয়ে হাজির হয়ে যায় আর শুরু হয় নিজেদের মতো গানবাজনা। গানপ্রিয় অনেকেই তখন ভীর জমিয়ে তাদের গান শুনতে থাকে।আর ঝালমুড়ি, বুট, বাদাম ভাজা, ফুচকা এগুলো তো আছেই।
‘
‘
‘
ওরা দুই বান্ধবীর সাথে ওদের আরো কিছু বন্ধু-বান্ধব ও যাবে। রিখিয়া আর অর্ণা একটা রিকশায় উঠে। রিখিয়াদের সামনের তিনটে রিকশায় ওদের অন্য ছয়জন বন্ধুরা বসেছে।
রিখিয়া অনেকক্ষণ যাবৎ খেয়াল করছে একটা কালো রঙ্গের গাড়ি ওদের পিছুপিছু আসছে। শুধু আজ নয় মাঝেমাঝেই এই গাড়িটাকে ওদের পেছন পেছন আসতে দেখেছে। তবে সন্দেহভাজন তেমন কিছু চোখে না পড়ায় কিছু বলতে পারেনি।
(চলবে)——–
সূচনা পর্ব
জাহানারা রিমা