অন্তরালে লুকিয়ে আছো, পর্ব – ১১

0
1129

সকাল সকাল আহমেদ ভিলাতে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বাড়ির একমাত্র ছেলের রিসেপশন বলে কথা। রাদিব আহমেদ কোন কমতি রাখতে চান না।
প্রথমে মিসেস শাহিদার সাথে তিনি বেশ রাগারাগি করেছিলেন। পরে ভেবে দেখলেন এ ঘটনায় উনার নিজেরও বেনিফিট আছে কারণ সামনেই ইলেকশন। তাই আর ঝামেলা করেন নি। স্বামী স্ত্রী দুজন মিলেই নিমন্ত্রণের পাট সম্পন্ন করেছেন।

বিকাল পার হতে না হতেই আহমেদ ভিলায় মানুষের ঢল নামে। একদিনের মাঝেই রাদিব আহমেদ এলাহি আয়োজন করে ফেলেছেন। গেটের সামনে ওয়েডিং প্লেনারদের তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে তারা আগত অতিথিদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছেন। এখনো অনেক আত্মীয় স্বজন আসা বাকী রয়ে গেছে। রায়ান ভেতরের গেস্টদের এট্যান্ড করতে ব্যস্ত। তাও তার চোখ একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রায় সবাই চলে আসলেও এখনো সেই কাঙ্ক্ষিত লোকটা আসছেনা কেন সেটাই ও বুঝে পাচ্ছেনা।
রায়ানের থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে অর্কও সেই একই ব্যক্তির অপেক্ষায় আছে।

এর মাঝেই রায়ানের চোখ যায় সিঁড়ির দিকে। ভারী লেহেঙ্গাটা দুহাতে আগলে ধীরে ধীরে নিচে নামছে একটি শ্যামবর্ণা মেয়ে। তাকে দেখেই ওর হার্টবিট কয়েকবার মিস করে গেলো। নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে ও। অর্ণার চোখ রায়ানের দিকে পড়তেই মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। রায়ানও আজ একই রঙের শেরওয়ানী পড়েছে। শেরওয়ানি পড়া অবস্থায় প্রথমবার দেখছে ও রায়ানকে। তবে রায়ানের এমন ঘোরলাগা দৃষ্টি দেখে বেশিক্ষণ আর ও তাকিয়ে থাকতে পারলোনা।

বর আর কনের জন্য স্টেজে যে দুটি আসন পাতা হয়েছে সেখানে নিয়ে রিখিয়া অর্ণাকে বসিয়ে দেয়। তারপর রায়ানকে ডেকে জোর করে পাশে বসিয়ে দিয়ে নিজে অর্ণার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। গেস্টরা সব এসে একে একে ওদের সাথে পরিচিত হয়ে যাচ্ছে। অর্ণার যাতে অস্বস্তি ফিল না হয় তার জন্যেই ও অর্ণাকে কোম্পানি দিতে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে।

অর্ক এখনো চারদিকে খুঁজে চলেছে লোকটাকে। এখনো পর্যন্ত তার আসার কোন নাম গন্ধ নেই। তবে কি সে আজ আসবেনা? কিন্তু না আসলে কেমন করে হবে? ওদের সব প্লান যে ফ্লপ হয়ে যাবে।
খুঁজতে খুঁজতে ওর চোখ যায় স্টেজের দিকে।
ওর চোখ আটকে যায় কনের পাশে দাঁড়ানো কালো রঙের লেহেঙ্গা পরিহিত হালকা সাজে সজ্জিত রমণীটির দিকে। আজ যেন কিছুতেই ওর পিচ্চির উপর থেকে নজর সরাতে পারছেনা। ফরসা গায়ে কালো রঙের লেহেঙ্গায় অনন্য লাগছে ওর প্রিয়তমাকে। সকলের চোখে না হলেও ওর কাছেতো এমনই মনে হচ্ছে। কারণ যে যাকে সত্যিকার অর্থে মন থেকে ভালোবাসে, মনের গভীরে যার জন্য সমস্ত অনুভূতিরা লুকায়িত থাকে তার চোখে একমাত্র তাকেই জগতের সবচেয়ে সুন্দর আর অনন্য মনে হবে। আশেপাশের সকল সৌন্দর্য তখন ফিকে মনে হবে।

অর্ক ওর পিচ্চি বুচিরানীকে দেখতে ব্যস্ত। বুচিরানী নামটা মনে আসতেই অর্ক আনমনে হেসে উঠে। রিখিয়ার দাদী আর অর্ক ওকে বুচি বলে ডাকতো। আর এ ডাক শুনেই রিখিয়া চটে যেত। ওর বোঁচা নাকটা আরেকটু ফুলিয়ে বলতো, ‘ তোমরা দুজনেই পঁচা। তোমাদের সাথে আমি আর কক্ষনো কথা বলবো না। ‘
কিন্তু খানিকবাদে থাকতে না পেরে নিজেই এসে আবার অর্ক আর দাদীর সাথে কথা বলতো। এ দুজন মানুষের সাথে কথা না বলে ও পাঁচ মিনিটও থাকতে পারতোনা।
মাঝে মাঝে অর্ক ইচ্ছে করেই রিখিয়াকে খেপাতো। কারণ ওই ফোলানো বোঁচা নাকের পিচ্চি রিখিয়াকে দেখতে ওর কাছে বেশ লাগতো।

রিখিয়াকে পলকহীন দেখতে দেখতে অর্ক যখন অতীতের পাতা ঘাটতে ব্যস্ত তখন ও খেয়াল করলো এতক্ষণ যার জন্য অপেক্ষা করছিলো সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি স্টেজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, হাতে একটা অনেক বড় গিফট বক্সসহ। লোকটাকে দেখেই অর্কের ঠোঁটের কোণে ফিচেল হাসি খেলে যায়।

লোকটাকে দেখে রায়ানের মুখেও এক চিলতে হাসি দেখা গেলো। লোকটা অর্ণার হাতে গিফট বক্সটা তুলে দেয়। তারপর রায়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ কি ব্যাপার ইয়াং ম্যান? আমাকে চিনতে পেরেছো তো? আমি তোমার আরিফ আংকেল, তোমার আরমান আংকেলের ছোট ভাই। আরমানকে তো নিশ্চয়ই মনে আছে। ওর ছেলে অর্কেরতো তোমার সঙ্গে বেশ ভাব ছিলো। ‘

রায়ান মাথা নেড়ে হ্যা অর্থ বুঝায়। আর মনে মনে বলে, তোকে চিনবোনা তোর মত বেঈমানকে না চিনে উপায় আছে। যার নিজের আপন বড় ভাইকে নিজ হাতে খুন করতে একটাবার ও হাত কাঁপে না ।
তবে এ খুনের ব্যপারটা শুধু রায়ান আর অর্কই জানে। উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় ওরা কিছু করতে পারেনি। তাইতো এই হারামিটা এখনো খোলা আকাশের নিচে এভাবে ঘুরে বেড়াতে পারছে।
তবে এখন ওদের অপেক্ষার প্রহর ঘনিয়ে এসেছে। আর আরিফ চৌধুরীর খোলা আকাশের নিচে মুক্ত বিহঙ্গের মত ঘুরে বেড়ানোর সময়টাও ফুরিয়ে এসেছে।

_______________
অর্ণার বাবা মাকে ফোন করে বলে দেওয়া হয়েছে। তারা আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে। তারা আসলে রাদিব আহমেদ নিজে এসে তাদেরকে রিসিভ করে ভেতরে নিয়ে যান। ভেতরে নিয়েই সবার সাথে উনাদের পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। তবে তাদের সাধারণ পোশাকআশাক দেখে অনেকেই নাক মুখ কুঁচকাচ্ছে। তাদের কাছে যেন দামী পোশাক পরিধান করে আসাটাই মুখ্য ব্যাপার। মনুষ্যত্ববোধের কোন মূল্যই তাদের কাছে নেই। তাদের কাছে দামী পোশাকআশাক পরিধান, দামী দামী গাড়ি চড়ে বেড়ানো এগুলোই মুখ্য। মানুষের কোন দামই নেই। যে এর প্রতিবাদ করবে সেই তাদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়াবে।

(চলবে)———–
জাহানারা রিমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here