অন্তরালে লুকিয়ে আছো, পর্ব – ১২

0
1119

রাদিব আহমেদ সকলের সাথে অর্ণার বাবাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বলাবাহুল্য অর্ণার বাবার সাথে তার এত ভালো আচরণের মুখ্য কারণ সমাজের মানুষের কাছে নিজেকে মহান প্রমাণ করা। যাতে নির্ঝঞ্ঝাটে তিনি ইলেকশন জিতে যেতে পারেন।

অর্ক আজ নিজের সেফটির জন্য মাথায় একটা ক্যাপ পরে আছে। ক্যাপটার জন্য ওর মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা।
রিখিয়া তখন খুব ছোট থাকায় অর্ককে এক দেখাতেই চিনতে পারেনি।
তবে বাকি বড়রা যারা আছে তারা যদি একটু ভালোভাবে ওকে পর্যবেক্ষণ করে তাহলে ওকে চিনতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয় তাদের। তাই এই সুরক্ষার ব্যবস্থা।

অবশেষে অনুষ্ঠানটা খুব সুন্দরভাবেই সম্পন্ন হলো। খাওয়া দাওয়ার পাট সম্পন্ন হতেই মেহমানরা একে একে বিদায় নিতে থাকে।

—————–
রায়ান অর্ণা আর মিসেস শাহিদাকে ওর আসতে একটু দেরি হবে কথাটা জানিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে।

অর্ক আরো আগেই আরিফ চৌধুরীর পেছন পেছন বেরিয়ে পড়েছে। আরিফ চৌধুরী নিজের গাড়ি স্টার্ট দিতেই অর্কও তাড়াতাড়ি এসে নিজের গাড়িতে উঠে আরিফ চৌধুরীর পিছু করতে থাকে। এর কয়েক মিনিটের মাথায় রায়ানও বেরিয়ে পরে গাড়ি নিয়ে।

আরিফ চৌধুরী অনেকক্ষণ যাবৎ খেয়াল করছে তার গাড়িটার পেছন পেছন একটা কালো আর একটা অফ হোয়াইট কালারের গাড়ি আসছে। ভয়ে মুহূর্তেই তার কপালে ঘামের সরু রেখা দেখা যায়। তার ঠোঁটদুটো তিরতির করে কাঁপছে। জীবনে অন্যায় কাজ তো আর কম করেন নি। কে জানে কোথাকার কোন শত্রু এখন তার পিছু নিয়েছে। গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিয়েও লাভ হলোনা। কালো রঙের গাড়িটা তার গাড়িকে ওভারটেক করে সামনে এসে নিজের গাড়িটাকে আড়াআড়িভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই আরিফ চৌধুরীকে বাদ্ধ হয়ে নিজের গাড়ির ব্রেক কষতে হয়। গাড়িটাকে পেছনের দিকে নিতে যাবে তবে সে উপায়ও রইলোনা পেছনে ঐ অফ হোয়াইট কালার গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে।

আরিফ তরতর করে ঘামছে।
পালানোর আর কোন উপায়ই রইলো না। তাই বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।
পেছনের আর সামনের দুইটা গাড়ি থেকেও দুইজন যুবক নেমে আসে। মাথায় ক্যাপ থাকার কারণে সামনের ছেলেটার মুখটা সে দেখতে পারছেনা। তবে পেছনের ছেলেটাকে দেখে বিস্ময়ে তার চক্ষু কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়। রায়ান এখানে কি করছে? রায়ানের সাথে তো ওর কোনদিনও কোন ঝামেলা হয়নি। তাহলে রায়ান এভাবে এখানে? এসব নানা প্রশ্ন যখন ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। তখন সামনের ছেলেটা মাথা থেকে ক্যাপ খুলে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। এবার ছেলেটার মুখ একদম স্পষ্ট। তবে খুব চেনা চেনা লাগছে এ মুখটা। খুব পরিচিত কারো সাথে কি মিল আছে এ মুখটার? অবশেষে ওর মাথায় আরো একটা চেহারা খেলে গেলো। সম্পূর্ণ মিলে যাচ্ছে দুটো চেহারা। তবে কি…?
আর ভাবতে পারছেনা আরিফ। মাথা চেপে ধরে নিচে বসে পড়ে।
বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘ না এমনটা হতে পারেনা। অর্ক এখানে কোত্থেকে আসবে? ওতো নিজে আগুন লাগিয়ে অর্ক আর ওর মাকে শেষ করে দিয়েছিল। তাহলে এতগুলো বছর পর আবার ও ফিরলো কিভাবে?

—————-
একটা চেয়ারের সাথে হাত পা শক্ত করে বেধে রাখা হয়েছে আরিফের। ঠিক যেখানে আসিফকে এনে বেধে রাখা হয়েছিল সেখানেই আনা হয়েছে ওকে।

তখন দুশ্চিন্তা আর ভয়ের কারণে স্নায়ুকোষে বেশি চাপ পড়ায় আরিফ জ্ঞান হারায়। এতে অর্ক আর রায়ানের বেশ সুবিধাই হলো। নির্ঝঞ্ঝাটে ওকে এখানে নিয়ে আসতে পেরেছে।

আরিফের জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে একটা চেয়ারের সাথে বাধা অবস্থায় পেলো। চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো একটা গোডাউনের মতো ঘরে ওকে আটকে রাখা হয়েছে। হয়তো পরিত্যক্ত কোন গোডাউন হবে এটা। ধীরে ধীরে সবটা মনে পড়তেই ওর মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

অর্ক আর রায়ান এসে ঘরে প্রবেশ করে। কারো পদধ্বনি শোনেই আরিফ চোখ মেলে সামনে তাকায়।
অর্ককে দেখেই বলে উঠে, ‘ তুই অর্ক হতে পারিস না। কিছুতেই না। ওকেতো আমি নিজ হাতে…. ‘

এটুকু বলেই থেমে যায় আরিফ।

আরিফের অসম্পূর্ণ কথাটা অর্ক নিজেই সম্পন্ন করে,
‘ ওকেতো তুমি নিজ হাতে মেরে ফেলেছিলে আগুনে ফুরিয়ে, তাইতো? ’

আরিফ আমতাআমতা করে বলে, ‘ আমি কিছু করিনি। আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা। ‘

রাগে অর্কের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।

‘ বুঝেছি এভাবে হবেনা। নাঈম, নাঈম। ‘

অর্কের হাকডাক শুনেই নাঈম দৌড়ে ভেতরে আসে।

‘ জি! ‘

‘ আমার গাড়ির ব্যাক সিটে একটা কালো ব্যাগ রাখা আছে ওটা নিয়ে আসো। ‘

একটুক্ষণ বাদেই নাঈম আবার ফিরে আসে হাতে একটা মিনি সাইজের ব্যাগ নিয়ে। ব্যাগটা সাইজে ছোট হলে কি হবে এর ভেতরটা হরেকরকম যন্ত্রপাতিতে ঠাসা।

পাশে একটা আধভাঙা টেবিল। অর্ক ইশারা করতেই নাঈম ব্যাগটা ওখানে রেখে দেয়। তারপর আরেকটা চেয়ার টেনে আরিফের মুখোমুখি বসে।

ব্যাগের চেইনটা খুলে অর্ক প্রথমেই একটা প্লাস বের করে।
যা দেখে আরিফ থরথর করে কাঁপতে থাকে। ভয়ে আরিফের অবস্থা খারাপপ্রায়।

নাঈমকে ইশারা করতেই ও এসে আরিফের হাতের বাধন গুলো খুলে দেয়।
অর্ক আরিফের ডান হাতটা নিজের বা হাতে নেয়। তারপর ডান হাতে প্লাসটা ঘুরাতে ঘুরাতে প্রশ্ন করে,
’ আমার বাবাকে কেন খুন করেছিলিস? ‘

‘ আয়ায়া মইইইই কিইইইছউউউ করিনি বিশ্বাস করো। ওটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। আর এক্সিডেন্টে আমার কোন হাত ছিলোনা। ‘

আরিফের কথা শুনে অর্ক বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসে। তারপর বলে, ‘ বিশ্বাস তাও আবার তোকে? যে লোক নিজের আপন বড় ভাই যে তাকে ছোট থেকে বাবার স্নেহে বড় করে তুলেছে সেই ভাইকে খুন করেছে। ‘ বলেই আবার অপ্রকৃতস্থের মত হাসতে থাকে অর্ক। অর্কের এমনতর অস্বাভাবিক হাসি দেখে আরিফ একটা শুকনো ঢোক গিলে।

‘ কি ভেবেছিলিস ছোট ছিলাম বলে সব ভুলে বসে আছি। একদমই না। সেদিনের প্রতিটা কথা এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। বাবা যখন কার এক্সিডেন্টে মারা গেলো তার ঠিক চারদিন পর বাড়িতে মিলাদের আয়োজন করা হয়েছিলো। সেদিন আমি নিজ কানে শুনেছিলাম কাউকে ফোনে বলছিলে বাবার কার এক্সিডেন্টটা তুমিই লোক লাগিয়ে করিয়েছিলে। আমি ওখান থেকে যাওয়ার সময় কোনভাবে হয়তো তুমি আমাকে দেখে ফেলেছিলে। তাই আমাকেও রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলতে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিলে ভাবলে মা ছেলে একসাথে পুড়ে শেষ হয়ে গেলে তোমারি লাভ সব সম্পত্তিও তুমি একাই ভোগ করতে পারবে। কি ঠিকতো? ‘

আরিফ আর বলার মত কিছু খুঁজে পেলোনা।

অর্ক এবার হুংকার ছেড়ে বললো, ‘ আমি ঠিক বলছিতো? ‘

আরিফ কোনরকম তুতলে বললো, ‘ সব মিথ্যে। তুই ভুল শুনেছিস। বিশ্বাস কর আমি কিছু করিনি। ‘

অর্কের মুখে এবার একটা রহস্যময় হাসি ফুটে উঠে। ওর এই হাসি দেখে আরিফের গায়ে কাটা দিয়ে উঠে।
অর্ক প্লাসটা দিয়ে আরিফের ডান হাতের মধ্যমায় চিপ দিয়ে ধরে। আরিফ ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে। আর এদিকে নাঈম আর রায়ান নিরব দর্শক হয়ে সবটা দেখে যাচ্ছে।

আরিফের হাতের আঙ্গুল প্রায় অনেকটাই থেঁতলে গেছে। তাও ও মুখ খুলছেনা দেখে অর্কের রাগ হুরহুর করে বেড়ে উঠে। অর্ক এবার ব্যাগটা থেকে একটা চার ইঞ্চি পরিমাণ লম্বা পেরেক বের করে।

‘ আমার বাবাকে কেন খুন করেছিলিস এক্ষুণি না বললে আমি কিন্তু এ পেরেকটা তোর হাতের তালুতে ঠুকে দেবো। ‘

অর্কের রাগ সম্পর্কে আরিফের ভালোই ধারণা আছে। তাই এবার ভয়ে ভয়ে সব বলতে শুরু করে।

(চলবে)————

জাহানারা রিমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here