অন্তরালে লুকিয়ে আছো, পর্ব ১৩

0
1205

‘ আমি বরাবরই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ ছিলাম। আমার কাছে টাকাই ছিলো সব। কারণ টাকা ছাড়া তো আর নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা গুলো পূরণ করা সম্ভব ছিলোনা ।
বাবার ব্যবসাটা ভাইয়াই দেখাশোনা করতো আর এতে আমার কোন সমস্যা ছিলোনা। ধীরেধীরে বাবার ছোট ব্যবসাটাকে ও অনেক বড় জায়গায় নিয়ে গেলো। সমাজের ধনী ব্যক্তিদের মাঝে একজন হয়ে উঠলো।
যখন যা চাইতাম তাই পেয়েছি ওর কাছে। কিন্তু আমার মাঝে আরো বড় হওয়ার নেশা জাগে। তাই আমি আর আমার এক পার্টনার মিলে ড্রাগস সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করি। কারণ সৎ পথে বড় হতে সময় লাগলেও অসদ উপায়ে অল্প সময়েই কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া যায়। শুরু শুরুতে কেউ এটা জানতে পারেনি। তবে একদিন কেমন করে যেন তোর বাবা বিষয়টা জেনে গেলো। আমাকে থ্রেট দিলো যদি আমি এ ব্যবসা বন্ধ না করি, এ পথ থেকে সরে না আসি তাহলে সে আমাকে পুলিশে দিবে।

কিন্তু তার হুমকিতেও যখন কাজ হলোনা আমি আমার মত নিজের ব্যবসা চালিয়ে যেতে লাগলাম তখন সে পুলিশের কাছে যাচ্ছিলো। তাই মাঝরাস্তাতেই লোক দিয়ে ওর গাড়িটার এক্সিডেন্ট করিয়ে দেই।

পরে আমি যখন একদিন আমার ভাড়া করা লোকগুলোর সাথে ফোনে কথা বলছিলাম সেটা তুই শুনে নিলি। তাই তোদেরকেও রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য রাতেরবেলা বাড়ির পর্দাগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেই। মিনিট দশেকের মধ্যেই পুরো বাড়িটা দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে।
কিন্তু ওই আগুন থেকে তুই কিভাবে বেচে ফিরলি সেটাই এখনো আমার মাথায় ঢুকছেনা। ‘

এবার বাকিটা আমি বলি। তারপর অর্ক নিজেই বলতে শুরু করে,
‘ সেদিন মা তোমাকে আগুন লাগাতে দেখে নিয়েছিলো। হাতে সময় কম থাকায় আমরা দ্রুত পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ”

‘ তাহলে এতদিন কোথায় ছিলি তোরা? আর এতদিন পরই বা কোত্থেকে এলি? ‘

‘ সেদিন বাবাকে হারিয়ে মা এমনিতেই দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো তাই কোথায় যাচ্ছে কি করছে নিজেই বুঝতে পারছিলোনা। রাস্তায় উদ্ভ্রান্তের মতো হেঁটে চলেছিলাম আমরা। তখন হুট করে কোথা থেকে একটা গাড়ি এসে মাকে ধাক্কা মারে। গাড়ীটাকে আসতে দেখেই মা আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলো তাই আমার গায়ে কোন আঘাত লাগেনি। মাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ভদ্রলোকই সব চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। উনার ড্রাইভারের ভুলের কারণেই দুর্ঘটনাটা ঘটে তারজন্যে উনি বারবার ক্ষমাও চেয়েছেন। অন্যদিকে ডাক্তার এসে জানায় মিসেস ফারজানা আর কখনো নিজের পায়ে হাটাচলা করতে পারবেন না। কারণ আঘাতটা পায়েই বেশি লেগেছে।
তারপর থেকে আমরা উনার কাছেই ছিলাম। উনার ছেলেমেয়ে কেউই ছিলোনা। তাই মাকে নিজের মেয়ের মত আর আমাকে নিজের নাতির মতই আগলে রেখেছেন। আজ কয়েক বছর হলো উনি গত হয়েছেন। আজ আমি যা কিছু সব ওই মানুষটার বদৌলতে।

উনি বেচে থাকতে তোকে খুঁজে বের করার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। শুধু গা ঢাকা দিয়ে ছিলিস বলে বেচে গেছিলিস।

আর আমাকে এতদিন কারো সামনে আসতে দেয়নি কারণ আমার উপর আবার হামলা হতে পারে সেই আশঙ্কায়।
আর আমিও ছোট ছিলাম তখন। তাই সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম।

আরিফ ভয়ে ভয়ে জানতে চায়, ‘ কি করবে কি তোমরা? ’

অর্ক বলে, ‘ সেটা সময় হলেই দেখতে পাবি। ‘

এবার রায়ান মুখ খুলে, ‘ অর্ক আগে আমাদের এর মুখ থেকে এর পার্টনারের নামটা বের করতে হবে। নয়তো একে শাস্তি দিলেও এর ওই পার্টনার ড্রাগস দিয়ে যুবসমাজকে শেষ করে দিবে। ‘

রায়ানের কথায় অর্কও সায় দেয়।
অনেকবার জেরা করার পরেও আরিফ মুখ খুলেনা। তাই অর্ক পাশে পরে থাকা একটা লোহার রড নিয়ে এসে বেধড়ক মারতে থাকে। আরিফের নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু হয়ে গেছে ওর অবস্থা খারাপপ্রায়। তাও অর্কের থামার নাম নেই। আরিফ আর সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করে বলে, ‘ বলছি বলছি আমি। আর মেরো না। তারপর বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে যে নামটা বলে তা শোনার জন্য ওরা কেউই প্রস্তুত ছিলোনা। ‘

অর্ক আর রায়ান দুজনেই গাড়ি নিয়ে রায়ানদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরোয়।

ওরা দুজনেই বাড়ির ভেতর যায়। কলিংবেলে চাপ দিতেই রাহেলা খালা এসে দরজা খুলে দেয়। রায়ান রাহেলাকে পাঠায় বাড়ির সবাইকে ডেকে আনতে।

—————-
রায়ানদের হলরুমে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। রাদিব আহমেদ, মিসেস শাহিদা আর রায়ানের দাদির মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে আছে। তাদের সামনে জলজ্যান্ত অর্ক দাঁড়িয়ে আছে সেটা ওরা যেন বিশ্বাসই করতে পারছেনা। এদিকে রিখিয়া আর অর্ণা কিছুই বুঝতে পারছেনা। নিরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা।
দাদি অর্কের সামনে গিয়ে ওর সারা মুখে হাত বুলিয়ে বলে, ‘ অর্ক দাদুভাই। ‘

রিখিয়া আর অর্ণা দুজনের মাথায় যেন বাজ পড়লো নামটা শুনে।
রিখিয়ার এতক্ষণে বোধগম্য হলো কেন ওই চোখদুটো ওর এতোটা চেনাচেনা লাগছিলো। তারপরেও রিখিয়া টুঁশব্দটিও করছেনা। একইরকম ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

রায়ান ওদেরকে সবটা খুলে বলে।

সব শুনে দাদির চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে। জানতে চায়, ‘ ওই আরিফকে এখন কি করেছিস তোরা? ‘

‘ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে দিয়েছি উনারা এখানেই আসছেন এখন। ‘
রায়ানের কথা শুনে দাদি প্রশ্ন করে, ‘ কিন্তু আমাদের এখানে কেন? ‘

‘ কারণ তার ক্রাইম পার্টনার এ বাড়িতেই আছে। ‘

রায়ানের কথা শুনে উপস্থিত সকলে অবাকের আরেক ধাপ উপরে পৌঁছে যায়।

এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। রাদিব আহমেদের কপাল বেয়ে চিকন ঘামের সরু স্রোত নিচে নেমে আসে।

কিছুক্ষণ পর ওখানে পুলিশ আসলে রায়ান এসে ওর বাবার সামনে দাঁড়ায়।
‘ কি ব্যাপার রাদিব আহমেদ এখনো চুপ করেই থাকবেন? ‘

‘ বিশ্বাস কর আমি কিছু করিনি। ‘

রায়ান বিদ্রুপের হাসি হাসে। তারপর পকেট থেকে ফোনটা বের করে রেকর্ডিং চালু করে। তখনকার আরিফের বলা সব কথাই ওরা রেকর্ড করে রেখেছে প্রমাণ স্বরূপ। সেই সাথে আরিফের স্বীকারোক্তি তো আছেই।

সব শুনে দাদিমা রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠেন, ‘ অফিসার এই কুলাঙ্গার টাকে এক্ষুণি আমার সামনে থেকে নিয়ে যান। আর দেখবেন যাতে ক্ষমতার বলে বেরিয়ে না আসতে পারে। কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি এদের প্রাপ্য। এদের জন্যেই যুবসমাজ আজ হুমকির মুখে। ‘

উপস্থিত সকলের চোখে পানি চলে আসে দাদির কথা শুনে। মুখে প্রকাশ না করলেও সবাই ঠিকই বুঝতে পারছে এ বৃদ্ধ মানুষটার মনের উপর দিয়ে কি ঝড়টাই না বয়ে চলেছে।
আবার শ্রদ্ধাও বেড়ে গেছে তার এমন সততা দেখে।

রায়ান আর রিখিয়াও কিছু বলছেনা। আর মিসেস শাহিদা অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।

রাদিব আহমেদকে নিয়ে পুলিশের ফোর্সটা বেরিয়ে পড়ে।
দাদিমা রায়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ এতোদিন দূরে ছিলে ঠিক আছে। তবে এখন থেকে তুমি আর তোমার মা দুজন এখানেই থাকবে। ‘

অর্ক কোন প্রত্যুত্তর করেনা। ও সুযোগ খুঁজছে রিখিয়ার সাথে একটু আলাদা কথা বলার। রিখিয়ার ভাবগতি ও কিছুই বুঝতে পারছেনা। অনুভূতিশূণ্য মানুষের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক বেচে আছে জেনে ও কি তাহলে খুশি হয়নি? কথাটা ভাবতেই অর্কের চোখের কোণে একবিন্দু জল এসে ভিড় জমায়।

——————–
রিখিয়া সকাল সকাল নাশতা করেই ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। নতুন বিয়ে হওয়ায় অর্ণা এখন কয়েকটা দিন বাড়িতেই থাকবে। তাই রিখিয়া একলাই বেরিয়ে পড়েছে।

ক্লাস শেষ করে বের হতেই সামনে অর্ককে দেখতে পায়। অর্ককে দেখেও ও আগের মতোই ভাবলেশহীন থাকে। অর্ককে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। অর্ক বারবার ডাকার পরেও রিখিয়ার কোন সাড়া পায়নি। রিখিয়া একটা রিকশা নিয়ে চলে আসে। অর্ক বাসায় ফিরে আসলে ঘণ্টা দুয়েক পর রায়ানের কল আসে। কলটা পিক করতেই যে নিউজটা শুনে তাতে ওর হাত থেকে মোবাইলটা নিচে পড়ে যায়।

(চলবে)———–

জাহানারা রিমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here