অন্তরালে লুকিয়ে আছো, পর্ব ১৪

0
1277

বিছানায় অর্ধচেতন অবস্থায় পরে আছে রিখিয়া। ক্লোরোফর্মের রেশ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। আস্তে আস্তে পিটপিট করে চোখ খুলতেই নিজের সামনে অর্ককে আবিষ্কার করলো। অর্ককে দেখেই ওর ঝিমানি ভাবটা কেটে যায়। পরক্ষণেই তখনকার কথা মনে পরতেই ভয়ে ওর গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। ও যখন রিকশা করে বাসায় ফিরছিলো তখন কোথা থেকে সামি কয়েকটা ছেলেপিলে নিয়ে এসে ওর পথ আটকায়। রিকশাওয়ালা তো ভয়েই তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে কেটে পরে। রিখিয়া রেগে সামিকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সামি ওর মুখে একটা রুমাল চেপে ধরে। ব্যস এরপর আর কিছুই ওর মনে নেই।

অর্কের চোখদুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে। যা দেখেই রিখিয়া একটা শুকনো ঢোক গিলে।

অর্ক রিখিয়াকে জেগে উঠতে দেখেই ওর সামনে গিয়ে ওর দুবাহু চেপে ধরে। বেশ জোরেশোরেই ধরেছে যার দরুন রিখিয়া ব্যথায় ককিয়ে উঠে। ব্যথায় রিখিয়ার চোখে জল চলে এসেছে।
তাও অর্ক ওর হাত ছাড়লো না। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
‘ আমি যদি সময়মত না আসতে পারতাম কি হতে পারতো ভেবে দেখেছিস একবার। ‘ কথাগুলো বলার সময় ক্রোধে অর্কের গলার স্বর কাঁপতে থাকে। অর্কের এরকম রুদ্ধমূর্তি দেখে রিখিয়া কেঁপেকেঁপে উঠে।

‘ সামি তোর সাথে কি করতে চলেছিলো তোর কোন আইডিয়া আছে? অবশ্য সেটা হলেই বোধহয় ভালো হতো একটা শিক্ষা হতো তোর। ‘ কথাটা বলেই সামনের দেয়ালে একটা ঘুষি মারে। ঘুষিটা এতোই জোরে ছিলো যে ব্যথায় অর্কের মুখের ধরন চেঞ্জ হয়ে যায় তাও টুঁশব্দটিও করলো না।

রায়ানের কাছ থেকে তখন জানতে পারে রিখিয়া এখনো বাসায় ফেরেনি। তখন ওর অবস্থা ঠিক কি হয়েছিলো সেটা একমাত্র ও’ই জানে। রিখিয়ার ফোনে বারবার কল করেও ফোনটা বন্ধ পায়।

পরে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলো রিখিয়ার যদি কেউ ক্ষতি কর‍তে চায় তাহলে সে কে হতে পারে? ওর মাথায় দুইটা নামই আসলো আসিফ আর সামি। প্রথমে আসিফের ব্যপারে খোঁজ নিয়েও সন্দেহভাজন কিছু পেলোনা। পরে সামির ব্যাপারে খোঁজ লাগায়। সোহেলের কাছ থেকে সামির নাম্বারটা নিয়ে দ্রুত নাম্বারটা ট্র‍্যাক করে।

সামি আর ওর বন্ধুদের সঠিক ব্যবস্থা ও করে ফেলেছে। আর তারপর রিখিয়াকে নিজের সাথে নিয়ে এসেছে। রায়ানকে কল করে রিখিয়ার খবর জানিয়ে দিয়েছে আপাতত কেউ আর দুশ্চিন্তা করবেনা।

তখন সঠিক সময়ে অর্ক এসে না পৌঁছালে রিখিয়ার সাথে কি হতো ভাবতেই ওর চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।
রিখিয়া অপরাধীর ন্যায় এসে অর্কের সামনে দাঁড়ায়।

মুখটাকে কাছুমাছু করে বাচ্চাদের মত বলে, ‘ সরি। ‘

রিখিয়ার কথা শুনে অর্ক মুখ তোলে ওর দিকে তাকায়। রিখিয়ার এমন মুখভঙ্গি দেখে অর্কের রাগ পরতে শুরু করে।
তাও মুখটাকে সিরিয়াস করে রাখার চেষ্টা করে।

অর্ককে নির্লিপ্ত থাকতে দেখে রিখিয়া নিজের দুহাত ক্রস করে ওর দুইকান ধরে ইনোসেন্ট ফেস করে আবার সরি বলে।

রিখিয়ার এমন কাণ্ডে অর্ক আর হাসি চেপে রাখতে পারেনা। বেশ উচ্চস্বরেই হেসে উঠে।

অর্কের হাসি দেখে রিখিয়া ওর কান থেকে হাত ছেড়ে দেয়। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ যাবৎ অর্কের অকৃত্তিম হাসিটির দিকে।
পরক্ষণে গতকালকের কথাগুলো মনে পড়তেই অভিমানেরা আবার ঝেকে ধরে ওকে।

মুহূর্তেই ওর মুখে আধার ঘনিয়ে আসে। হুট করে রিখিয়ার এমন বিমর্ষ হয়ে যাওয়ার কারণটা অর্ক কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেনা।

অর্ক হয়তো এবার কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে রিখিয়ার নিশ্চুপতার কারণ। ও উঠে গিয়ে একটা ড্রয়ার খুলে সেখান থেকে একটা নীল মলাটের ডায়েরী বের করে এনে রিখিয়াকে দেয়। রিখিয়া প্রথমে নিতে না চাইলেও জোর করে ওর হাতে ঠেসে দেয়। একটুপর আরেকটা ড্রয়ার খুলে একটা মাটির তৈরি হাতি বের করে আনে। এটা দেখেই রিখিয়ার সামনে অতীতের কিছু স্মৃতি ভেসে উঠে। এটা ছোটবেলায় রিখিয়াই দিয়েছিলো অর্ককে রিখিয়া যেমন অর্কের দেওয়া ঘোড়াটা কখনো কাছ ছাড়া করতো না অর্কও ঠিক তেমনি এ হাতিটা নিজের কাছ ছাড়া করতো না।

‘ এটার কথা মনে আছে তোর বুচি? আমি কিন্তু কখনো এটা কাছ ছাড়া করিনি। ‘
রিখিয়া নিরুত্তর।
এরপর অর্ক রিখিয়াকে টেনে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ওকে ইশারায় বলে ডায়েরিটা খুলতে।

ডায়েরিটা খুলেই প্রথম পৃষ্ঠায় অর্কের হাতের গোটাগোটা অক্ষরে লেখা দেখতে পায়, ‘ আমার বুচিরানী। ‘

একে একে সব পৃষ্ঠাগুলো উল্টে পড়তে থাকে। পড়তে পড়তে ওর চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে। অর্ক নিজের সমস্ত আবেগ দিয়ে পুরো ডায়েরিটা লিখেছে। পুরো ডায়েরি জোরেই রিখিয়াকে নিয়ে অর্কের অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করা। প্রতিটা কথা প্রতিটা বাক্য হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।

রিখিয়া কাঁদতে কাঁদতে প্রশ্ন করে, ‘ এতই যখন ভালোবাসতে তখন এতদিন আমার থেকে আড়ালে ছিলে কেন? অন্তত আমার থেকেতো আড়াল হওয়ার দরকার ছিলোনা। ‘
আবারো অভিমানে মুখ ভার হয়ে আসে রিখিয়ার। রিখিয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে অর্ক আলতো স্পর্শে ওর চোখের জলগুলো মুছে দেয় ।
‘ আমার দুর্বলতা যে তুই সেটা আমি কাউকে বুঝতে দিতে চাইনি। আমি চাইনি আমার জন্যে তোর উপরে কোন আঁচ পড়ুক। তাই নিজেকে আড়ালে রেখেছিলাম। তোর থেকে আমি আড়ালে থাকলেও আমার থেকে কিন্তু তুই কখনোই আড়ালে ছিলিসনা। প্রতিমুহূর্তে তোর উপর আমার নজর ছিলো। ‘

‘ কিভাবে? স্পাই লাগিয়েছিলে নাকি আমার পেছনে? ‘

অর্ক কিছুক্ষণ আমতাআমতা করে বলে, ‘ হ্যা। তোর যাতে কেউ কোন ক্ষতি করতে না পারে তাই তোর উপর সর্বদা নজর রাখার জন্য একজনকে নিযুক্ত রেখেছি। ‘

অর্কের কথা শুনে রিখিয়ার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়।

রিখিয়া অকপটে অর্ককে একটা প্রশ্ন করে,
‘ ভালোবাসো আমাকে? ‘

অর্কও নিঃসংকোচে জবাব দেয়, ‘ ভালোবাসি নিজের থেকেও বেশি। যতটা ভালোবাসলে তোকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারিনা ততোটাই ভালোবাসি। নিজের বুকের বাপাশে হাত রেখে বলে – শুধু একটা কথাই বলবো, এই ” অন্তরালে লুকিয়ে আছো ” ছিলে আর থাকবেও সারাজীবন।

একই প্রশ্ন অর্ক করলে রিখিয়া কোন প্রত্যুত্তর না করে অর্ককে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কিছুকিছু সময় নিরবতাও অনেক কথা বলে দেয়। অর্কও নিজের প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছে। ওর ঠোঁটের কোণে লেগে আছে মিষ্টি এক প্রশান্তির হাসি। বহু আকাঙ্ক্ষিত কিছু পেয়ে যাওয়ায় তৃপ্তির হাসি।

মিসেস ফারজানা রিখিয়াকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। রিখিয়াও ওর মণিকে জড়িয়ে ধরে সুখের অশ্রুজল বিসর্জন করে। এর মাঝে রিনি আসে ওদেরকে খাওয়ার জন্য ডাকতে।
অর্ক বলে, ‘ রিনি তুই গিয়ে আগে মায়ের খাবারটা নিয়ে আয়। মাকে খাইয়ে দিয়েই আমি নিচে নামছি। ‘

এর মাঝে রিখিয়া বাধ সাধে ওর একটাই কথা ও আজ নিজ হাতে ওর মণিকে খাইয়ে দিবে।

রিনি খাবার নিয়ে এলে রিখিয়া ছোট ছোট লোকমা তুলে ফারজানাকে খাওয়াতে থাকে। ফারজানা তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। মনে মনে ভাবছে, যাকে পিচ্চি দেখে এসেছে আজ সেই পিচ্চি পরি ওকে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে এই সেদিনের ঘটনা যখন উনি পিচ্চি রিখিয়াকে হাতে তুলে খাইয়ে দিতেন। এসব ভাবতে ভাবতে তার চোখের কোণে একবিন্দু জল চলে আসে। রিখিয়া বা হাতে চোখের জলটা মুছে দিয়ে প্রশ্ন করে, কি হয়েছে?
উনি মাথা নেড়ে না বুঝান।
মিসেস ফারজানার খাওয়া শেষ হতেই রিখিয়া আর অর্ক মিলে নিচে নেমে আসে।

রিখিয়া আর অর্কের জোরাজুরিতে রিনি আর ওর মা ওদের সঙ্গে একসাথে খেতে বসে।

আজ রিখিয়া এ বাসাতেই থাকবে। কাল সকালে অর্ক গিয়ে ওকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

রিনি এসে রিখিয়াকে গেস্ট রুমটা দেখিয়ে দিয়ে চলে যায়।

খানিক বাদেই রিখিয়া গিয়ে আবার রিনির ঘরে হাজির হয়। রিনি মাত্রই শোয়ার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলো রিখিয়াকে হঠাৎ আবার এখানে ও আশা করেনি।

‘ আপনি এখানে কেন? আপনার কি কিছু লাগবে? ‘
‘ হুম, তোমাকে লাগবে। আজ সারারাত আমি তোমার সাথে গল্প করবো। আর এখানে তোমার সাথেই ঘুমোবো। ‘
‘ কিন্তু আপনি আমার সাথে কিভাবে…. ‘
‘ আমি কি বাঘ না ভাল্লুক যে আমার সাথে ঘুমোনো যাবেনা? ‘ এই বলেই রিখিয়া সটান হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়।
রিনির চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। ও মনে মনে শুধু একটা কথাই আওড়ালো, ‘ এ মানুষগুলো এতো ভালো কেন? ‘
রিখিয়া সারারাত রিনির সাথে গল্প করেছে, রিনির জীবনের গল্পগুলো শুনেছে। নিজেও অনেক কথাই বলেছে। শেষরাতের দিকে ওরা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে।

—————-
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই রিখিয়া আর ওর মাকে নিয়ে অর্ক বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্য রিখিয়াদের বাড়ি। এত তাড়াহুড়ো করার একমাত্র কারণ দাদি। সকাল সকাল ফোন করেই বেশ সিরিয়াস হয়েই বলেন, ‘ অর্ক দাদুভাই, এক্ষুণি তুমি রিখিয়া দিদিভাই আর তোমার মাকে নিয়ে আমাদের বাড়ি চলে আসো। খুব জরুরি। খেয়াল রাখবে দেরি যাতে না হয়। ‘
এই বলেই দাদি তখন ফোন রেখে দেয়।
অর্কের ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে হঠাৎ কি এমন ঘটলো যার জন্য এভাবে ওদেরকে জরুরি তলব করলো সেটাই ও বুঝতে পারছেনা।

ভাবনার মাঝেই কখন ওরা পৌঁছে গেছে টেরই পায়নি।
গাড়ি থেকে নামতেই ওরা তিনজনেই অবাক। পুরো বাড়িটা লাল, নীল, হলুদ বিভিন্ন রঙের আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে আছে। অর্ক ওর মাকে হুইল চেয়ারে করে ভেতরে নিয়ে যায়। ভেতরে যেতেই প্রথমে সবাই ফারজানাকে দেখে অনেকটা ইমোশনাল হয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ দাদি আর মিস শাহিদা কান্নাকাটি করেন। একটু পর দাদি নিজের চোখ মুছে বলেন,
‘ ফারজানা তোকে না বলেই আমরা সব আয়োজন করে ফেলেছি। আজ রিখিয়া আর অর্কের এংগেজমেন্ট টা আমরা সেরে নিতে চাই। ‘

দাদির এ কথা শুনে রিখিয়া আর অর্ক দুজনেই শকড। আর ওদেরকে দেখে অর্ণা আর রায়ান মিটিমিটি হাসছে।

খুব কাছের আত্মীয় ছাড়া আর কাউকেই বলা হয়নি।
অর্ণা রিখিয়াকে তৈরি করে নিয়ে আসে আর রায়ান অর্ককে। দাদি এসে অর্কের হাতে একটা আর রিখিয়ার হাতে একটা আংটির বক্স তুলে দেয়। অর্ণা আর রায়ান দূরে দাঁড়িয়ে ওদেরকে দেখছে।

প্রথমে অর্ক রিখিয়ার চোখের দিকে তাকিয়েই ওর হাতে আংটিটা পরিয়ে দেয়। আর রিখিয়া নিচের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। রিখিয়াও আংটিটা নিয়ে অর্কের হাতে পরিয়ে দেয়। দূরে দাঁড়ানো অর্ণা ওদেরকে দেখতে থাকে। আনন্দে ওর চোখে জল চলে আসে। উত্তেজনায় ও রায়ানের হাত নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরে। রায়ান মুচকি হেসে অর্ণাকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে।
আংটি পড়ানো হয়ে গেলেই অর্ক সকলের অলক্ষে রিখিয়ার হাতে একটা চুমু খায়। এতে রিখিয়া খানিকটা কেপে উঠে।

সমাপ্ত-

জাহানারা রিমা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here